দেশে অসংক্রামক রোগের কারণে মৃত্যুহার ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ আরও কয়েকটি রোগে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ মারা যায়, যাদের বেশির ভাগের বয়স ৩০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে।
অথচ অদ্ভুত ব্যাপার হলো, দেশে যত ডায়াবেটিস রোগী রয়েছেন, তাদের মধ্যে ৬১ দশমিক সাতজন মানতেই চান না, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। একে অত্যন্ত মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে অভিহিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নির্দিষ্ট বয়সের পর প্রত্যেকের নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানো উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যায় ২০৪৫ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের একটা হবে বাংলাদেশ। আর এমন পরিস্থিতিতে আজ সোমবার বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ডায়াবেটিস দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘আগামীতে নিজেকে সুরক্ষায় ডায়াবেটিসকে জানুন’।
চিকিৎসকরা বলছেন, শরীরে কোনো কারণে ইনসুলিন নামক হরমোনের অভাব বা ঘাটতি হতে পারে। আবার উৎপাদিত ইনসুলিন কার্যকরভাবে শরীরে ব্যবহৃত না হলে বা শরীরের ইনসুলিন নিষ্ক্রিয় থাকলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। এই গ্লুকোজ পরে প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। আর একেই বলা হয় ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। এ রোগ কখনো সম্পূর্ণ সারে না। আর এ রোগের কারণে আরও কিছু অসংক্রামক রোগের জন্ম হতে পারে।
তারা বলছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশের মতো বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য কার্যক্রমের অগ্রাধিকারের তালিকায় ডায়াবেটিসের স্থান অনেক নিচে। ফলে এসব দেশে ডায়াবেটিস স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মসূচি সন্তোষজনকভাবে গড়ে ওঠেনি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেয়া হলেও রোগী ইনসুলিন পায় কেবল হাসপাতালে ভর্তি হলে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, আর এর অর্ধেকেরও বেশি নারী।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ১০০ জনের মধ্যে ২৬ জন নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন, যাদের মধ্যে আবার ৬৫ শতাংশই পরবর্তীতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন।
সমিতির তথ্যমতে, দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ রোগীর মধ্যে প্রায় ৫৯ লাখেরও বেশি (প্রায় ৪৫ শতাংশ) রোগীকে ডায়াবেটিসসেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। বারডেম, বিআইএইচএস ও ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্ক (এনএইচএন)-এর ৩৫টি কেন্দ্র, ৬১টি অধিভুক্ত সমিতি ও ২৯টি সাব এফিলিয়েটেড অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে রাজধানীসহ সারা দেশে ডায়াবেটিসসেবা সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান দৈনিক বাংলাকে বলেন, দেশে এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ায় যত মানুষ আক্রান্ত হয়, তার চেয়েও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় ডায়াবেটিসে। এর চিকিৎসায় যে পরিমাণ খরচ, তা জোগাতে মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। অথচ ডায়াবেটিস নিয়ে দেশে যথাযথ সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। যার কারণে করোনা মহামারির কথা সবাই জানলেও ডায়াবেটিসও যে মহামারি- এটা বোঝানো সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ডায়াবেটিক সমিতি ‘ইব্রাহিম হেলথলাইন’ নামে একটি প্যাকেজ চালু করেছে। এর মাধ্যমে যেকোনো রোগী ১০৬১৪ নম্বরে ফোন করে স্বাস্থ্যসেবা লাভ করতে পারবেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশের জন্য ডায়াবেটিস রোগের ব্যবস্থাপনা একটি বড় বাধা। মধ্য এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে জনসংখ্যা, জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিস রোগীর বোঝাও দিনে দিনে বাড়ছে। গত ২২ বছরে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সেটা ৭৮ শতাংশে পৌঁছাবে।’
ডায়াবেটিস রোগীদের হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, ডায়াবেটিস রোগীদের প্রায় ৮০ শতাংশই মারা যাচ্ছে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের কারণে।
ডায়াবেটিসকে ‘কালপ্রিট’ আখ্যা দিয়ে ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ডায়াবেটিসের কারণে পুরো বিশ্বে মানুষ মারা যায় সাড়ে ছয় কোটি আর ডায়াবেটিসজনিত জটিলতার জন্য মারা যায় ৩০ কোটি মানুষ। আর বাংলাদেশে প্রতিবছর যত মানুষ মারা যায়, তার ৭০ শতাংশই অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়, তাদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, প্রতি পাঁচ সেকেন্ডে যে কয়জন মানুষ মারা যাচ্ছে, তার মধ্যে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আর বছরে ৯০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি চলে যাচ্ছে ডায়াবেটিস চিকিৎসার পেছনে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা