আপডেট : ২০ নভেম্বর, ২০২২ ০৮:৩৭
শেষ বেলায় মিলবে পূর্ণতা?
ক্রীড়া প্রতিবেদক

শেষ বেলায় মিলবে পূর্ণতা?

দুজন মিলেমিশে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পেয়েছেন ১২ বার। লিওনেল মেসি ৭ বার, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ৫। দুই দশক ধরে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নেশায় মত্ত দুজনে। বিশ্ব ফুটবল আগে কখনো এমন দ্বৈরথ দেখেনি, আর কখনো দেখবে কি না নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। বল পায়ে এমন সব কীর্তি দেখিয়েছেন, যা দর্শকদের চোখ কচলাতে বাধ্য করেছে বারবার। বাধ্য করেছে অবাক বিস্ময়ে স্বগতোক্তি করতে- ‘এও সম্ভব!’ হতভম্ব দর্শককে আরও বিহ্বল করে ইতিহাসের নতুন নতুন পাতায় সাফল্যের খতিয়ান লিখে চলেছেন নিরন্তর। দুজন আদৌ রক্তমাংসের মানুষ কি না, ভেবে প্রায়ই সংশয়ে পড়ে গেছে আমজনতা।

তবে এই সংশয়মুক্তির কাজটিও ‘দায়িত্ব’ নিয়ে কাঁধে তুলেছেন দুজন। দিয়েছেন নিজেদের নশ্বরতার প্রমাণ, যা দেখে বিশ্বজোড়া দর্শক হাঁপ ছেড়ে বলেছেন- ‘যাক বাবা! ওরাও তাহলে আমাদের মতোই!’ এই দুই অতিমানবকে সাধারণের কাতারে টেনে নামিয়েছে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরই। বিশ্বকাপে দুজন কি এমন কিছু করতে পেরেছেন, যা অন্য কেউ পারেননি?

উত্তরটা সোজাসাপ্টা- না। বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় শিরোপাটা ধরা দেয়নি দুজনের কারোর হাতেই। শুধু তা-ই নয়, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের দিক দিয়েও দুজন বড্ড ফ্যাকাশে। মেসি-রোনালদোর মতো দুজন খেলোয়াড় কখনো বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে গোল পাননি, বিশ্বাস হয়?

সেই ২০০৬ বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম উপস্থিতি, এর পর থেকে এখন পর্যন্ত নকআউট ম্যাচগুলোতে মেসি-রোনালদোর মোট ৪৮টি প্রচেষ্টা প্রতিপক্ষের পোস্টের সামনে গুমরে কেদে মরেছে, পায়নি জালের স্পর্শ। একই সময়ে ১০৫ জন খেলোয়াড় তাদের ছাপিয়ে নিজ নিজ দেশের হয়ে নকআউটে গোল পেয়েছেন। দুজনের সব কেরামতি ওই প্রথম রাউন্ডেই, যেখানে রোনালদোর গোল ৭টি, মেসির ৬টি। স্পেনের বিপক্ষে গতবার হ্যাটট্রিকের স্বাদও পাওয়া হয়ে গেছে পর্তুগিজ-বীরের। কিন্তু নকআউট পর্বে? ওখানেই নিস্তব্ধ মেসি-রোনালদোর সকল কোলাহল!

বিশ্বকাপে যে একের পর এক হতাশাই সঙ্গী হতে চলেছে, ওই ইঙ্গিত দুজন পেয়েছিলেন শুরুতেই। ২০০৬ বিশ্বকাপে ১৯ বছরের উচ্ছল মেসি গ্রুপে সার্বিয়ার বিপক্ষে এক গোল আর এক সহায়তায় আলো ছড়ালেও নকআউটে মেক্সিকোর বিপক্ষে খেলতে পেরেছেন শেষের কয়েক মিনিট। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে তাকে নামানইনি কোচ হোসে পেকারম্যান। জার্মানির হাতে দলের বাদ পড়া দেখে বেঞ্চে বসে মেসি কতটা চুল ছিঁড়েছিলেন, সে হিসাব রাখেনি কোনো ফুটবল-পরিসংখ্যানের ওয়েবসাইট।

একই অবস্থা রোনালদোরও। ২৫টি শট মেরেও সেবার এক পেনাল্টি ছাড়া গোল জোটেনি কপালে। মেসির সঙ্গে সেবার গোলে সমতা থাকলেও (১) সহায়তায় পিছিয়ে ছিলেন (০)।

একটি করে বালন দ’র নিয়ে পরেরবার দুজন গেলেন আফ্রিকায়। লক্ষ্য, ক্লাব-সাফল্য জাতীয় দলে অনূদিত করা। হলো না কিছুই। কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত হাঁচড়ে-পাঁচড়ে যাওয়া মেসি গোলহীন, দ্বিতীয় রাউন্ডে বিদায় নেয়া রোনালদো টেক্কা দিলেন উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে পাওয়া এক গোলে। যদিও একটি করে গোল-সহায়তায় দুজন পাশাপাশিই ছিলেন।

এরপর এল ২০১৪ বিশ্বকাপ। নিজের ‘বাইনারি সংখ্যা-প্রীতি’ থেকে মেসি পেলেন বেরিয়ে আসার উপলক্ষ- করলেন চার গোল, সহায়তা করলেন একটিতে। রোনালদো অবশ্য সেবারও একের ঘেরাটোপে আটকা। একটি করে গোল আর সহায়তা নিয়ে চোটজর্জর রোনালদোর বিদায় নতমুখে, প্রথম রাউন্ড থেকেই। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পাওয়া মেসির অবশ্য রোনালদোকে টপকানোর আনন্দটা ফিকে হয়ে যায় ফাইনালে হাতছোঁয়া দূরত্বে শিরোপা রেখে আসার বোবাকান্নায়।

রাশিয়ায় এসে রোনালদোর কপালে জুটল একাধিক গোল করার আনন্দ, মেসি ফিরে গেলেন সেই একের ঘরে। অবশ্য দুজনের এই লড়াইয়ে কারও দলেরই কোনো লাভ হয়নি। দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে ফ্রান্সের কাছে হেরে যেদিন সন্ধ্যায় মেসিরা বিদায় নিলেন, তাদের সঙ্গী হতে রোনালদোরা উড়োজাহাজের টিকিট কাটার বন্দোবস্ত করলেন কয়েক ঘণ্টা পরেই, উরুগুয়ের কাছে হেরে।

আজ ২০২২ সালের রাত থেকে আবারও শুরু হলো বিশ্বকাপ ফুটবল মহাযজ্ঞ। ২০০৬ সালে কেউ যদি বলতেন, এ দুজন ১৬ বছর পরও নিজ নিজ দলের মূল খেলোয়াড় হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যাবেন, অনেকেই হয়তো নিছক পাগলামো বলে উড়িয়ে দিতেন সে কথা। ১৬ বছর ধরে বল পায়ে দুজনের শ্রেষ্ঠত্ব আজ সে পাগলামোকেই দিচ্ছে স্বাভাবিকতার সনদ।

যে সনদ আরেকটু পূর্ণতা পাবে যদি নকআউট পর্বে দুজন মেতে ওঠেন গোলের উল্লাসে। আর পুরোপুরি পূর্ণতা পাবে যদি দুজনের কারও হাতে ওঠে সোনালি ট্রফিটা।

সে ক্ষেত্রে অবশ্য আরেকজন নিজের শেষ বিশ্বকাপে অপূর্ণই থেকে যাবেন।