আপডেট : ২০ নভেম্বর, ২০২২ ১১:১৬
এনবিআরের প্রধান সমস্যা লিডারশিপ, কর অব্যাহতিতে আড়াই লাখ কোটি টাকার ক্ষতি
প্রতিবেদক, দৈনিক বাংলা

এনবিআরের প্রধান সমস্যা লিডারশিপ, কর অব্যাহতিতে আড়াই লাখ কোটি টাকার ক্ষতি

গতকাল ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘প্রত্যক্ষ কর ও আয়-বৈষম্য’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ। ছবি: দৈনিক বাংলা

বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতির নামে বছরে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে বলে তথ্য দিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ। কর সুবিধা দেয়ার পেছনে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করছে বলে জানান তিনি। এনবিআরের প্রধান সমস্যা নেতৃত্ব বা লিডারশিপ বলে মনে করেন সাবেক এই আমলা।

গতকাল শনিবার অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘প্রত্যক্ষ কর ও আয়-বৈষম্য’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘রাজস্ব বিভাগকে গতিশীল করতে অনেক সংস্কার করা হলেও এর তেমন সুফল মেলেনি। কারণ সংস্কারগুলো তেমন কার্যকর ও বাস্তবসম্মত ছিল না।’

নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এনবিআরের মূল সমস্যা হচ্ছে নেতৃত্ব। এই সংস্থার লিডারশিপের দুর্বলতা আছে। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় বাড়াতে হলে এবং এনবিআরকে স্বচ্ছ ও গতিশীল সংস্থায় পরিণত করতে হলে সংস্থার প্রশাসনিক কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনতে হবে।’

তিনি বলেন, প্রত্যক্ষ কর, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ও শুল্ক সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকলে এনবিআর পরিচালনা করা কঠিন। সে জন্য এই সংস্থায় একজন পেশাদার ও যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজন। রাজস্ব আদায় বাড়াতে ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কাস্টমস, ভ্যাট ও মূল্য সংযোজন কর বিভাগের পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

রাজধানীর পল্টনে ইআরএফ কার্যালয় অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট বা রেপিডের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক।

ইআরএফ সভাপতি শারমিন রিনভীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইয়াজদানী খান, এনবিআরের সদস্য (জরিপ ও পরিদর্শন) মাহমুদুর রহমান এবং ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এ এস এম রাশিদুল ইসলাম। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ।

আলোচনায় মূল প্রবন্ধে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক উন্নতি হলেও দুটি ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় সরকারি ব্যয় বা বাজেটে বরাদ্দ কম। আয়-বৈষম্য দূর করতে হলে আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর বাড়াতেই হবে। পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।’

‘বর্তমানে বাংলাদেশে আয়কর আহরণের পরিমাণ জিডিপির তুলনায় মাত্র ৯ শতাংশ। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে কর-জিডিপি অনুপাত কমপক্ষে ৭০ শতাংশে উন্নতি করতে হবে। বাংলাদেশের জিডিপি যেহারে বেড়েছে, কর আদায়ে সেভাবে বাড়েনি। এর কারণ, আমাদের কর-নেট সীমিত। এখন দেশের কর আহরণের পরিমাণ মোট আদায়ের ৩৫ শতাংশ। এটাকে ৫০ ভাগে উন্নতি করতে হবে। এ জন্য এনবিআরের কাঠামোগত এবং নীতিগত সংস্কারে বেশি নজর দিতে হবে।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইয়াজদানী খান বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকারি ব্যয় বা বাজেটে বরাদ্দ কম। এর কারণ কর আদায় প্রত্যাশিত নয়। আমাদের অর্থনীতির যে আকার, তার সঙ্গে রাজস্ব আদায় সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখানে অনেক গ্যাপ বা ফারাক আছে। এ ফারাক কমাতে হলে কর আহরণ বাড়ানোর বিকল্প নেই।’

তিনি বলেন, অগ্রিম কর ব্যবস্থা পৃথিবীর সব দেশেই আছে এবং এটি একটি জনপ্রিয় ব্যবস্থা। বাংলাদেশে অগ্রিম কর নিয়ে সমালোচনা হয় এই কারণে যে, এখানে রিফান্ড বা ফেরত দেয়ার সংস্কৃতি ভালো নয়। করদাতাদের সুবিধার্থে টেক্স ফেয়ার সার্ভিস ইউনিটগুলোকে সক্রিয় ও সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, বাংলাদেশে অনেক বিদেশি উচ্চ বেতনে চাকরি করেন। তাদের সবাইকে নেটে আনতে পারলে কর আদায় আরও বাড়বে। ফ্ল্যাট ও জমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্য গোপন করা হয়। এ খাতে সংস্কার করতে পারলে কর আদায় বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে।

মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে বর্তমানে যে পরিমাণ প্রত্যক্ষ বা আয়কর আদায় হয় তা জিডিপির ২ দশমিক ৬ শতাংশ। সমাজের সবচেয়ে গরিবরা যে আয় করে তার ৭ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় হয় ভ্যাটের পেছনে। অন্যদিকে সমাজের সবচেয়ে ধনীরা ভ্যাটে খরচ করে মাত্র ১ শতাংশ। তার মানে, ধনীর তুলনায় গরিবরা করের জালে বেশি আটকে আছে। এতে আরও বলা হয়, সামর্থ্যবান সবাই যদি করনেটে আনা সম্ভব হয় তাহলে জিডিপির ৩ দশমিক ২ শতাংশ কর আদায় বাড়বে, যা এখন আছে ১ শতাংশ। বর্তমানে যে পরিমাণ করপোরেট ট্যাক্স আদায় হয়, যা কোম্পানিগুলোর দিয়ে থাকে, সেটি জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ।’

জয়েন্ট স্টক কোম্পানির হিসাব অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় সোয়া দুই লাখ। অথচ বার্ষিক রিটার্ন জমা দেয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার। মাত্র ১৫ হাজার লোক সারচার্জ দেন।

রেপিডের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির ৮৫ শতাংশ ইনফরমাল বা অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এদের অনেকেরই কর দেয়ার সামর্থ্য আছে। অথচ বড় অংশ কর নেটের বাইরে এখনো। সামর্থ্যবান সবাইকে যদি করের আওতায় আনা যায়, তাহলে আয়কর আদায় আরও বাড়বে। কর আদায় বাড়লে কমবে আয়-বৈষম্য।’

কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে অব্যাহতির তালিকা পর্যালোচনা করার পরামর্শ দেন তিনি। একই সঙ্গে করপ্রশাসনকে করনীতি থেকে আলাদা করার প্রস্তাব করেন রেপিড চেয়ারম্যান।