আপডেট : ১১ আগস্ট, ২০২২ ০৭:৩৭
চক্রাকার বাসেও ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য

চক্রাকার বাসেও ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য

২০১৬ সালে হাতিরঝিলে যাত্রী পরিবহনে ১০টি মিনিবাস চালু হয়। বর্তমানে সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত এই রুটে ২০টি বাস চলছে। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস/

রাজধানীতে বাসভাড়া নিয়ে প্রতিনিয়তই চলছে প্রতারণা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে যাত্রীদের কাছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে পরিবহনগুলো। এর বাইরে নয় সরকারি সংস্থা রাজউক পরিচালিত হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসও।

হাতিরঝিলে যে চক্রাকার বাস চলে, তাতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নির্ধারিত ভাড়ার আড়াই গুণের বেশিও আদায় করা হয়।

রাজউক সরাসরি এই বাস পরিচালনা করে না। অর্থের বিনিময়ে বাসগুলো ইজারা নিয়েছে এইচআর ট্রান্সপোর্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আর ইজারাদার কোম্পানিটি যাত্রীদের স্বার্থ না দেখে, নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে।

বেশি ভাড়া আদায়ের কারণ জানতে চাইলে রাজউকের এক কর্মকর্তা বলেন, এ বাস যাত্রী পরিবহনের সাধারণ বাহন নয়, এটি পর্যটন সংশ্লিষ্ট। ফলে বেশি ভাড়া আদায় করা যায়।

অথচ এই বাসে ঢাকার লোকাল বাসের মতোই দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন করা হয়। আর পর্যটন নয়, হাতিরঝিলের এক পাশ থেকে অপর পাশে যাতায়াতের জন্যই বাসটি ব্যবহার করে যাত্রীরা।

২০১৬ সালে হাতিরঝিলে যাত্রী পরিবহনে ১০টি মিনিবাস চালু হয়। বর্তমানে সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত এই রুটে ২০টি বাস চলছে।

গত নভেম্বর ও চলতি আগস্টে তেলের দাম দুই দফা বাড়ানোর পর বাসের ভাড়াও দুই দফা বাড়ানো হয়। অথচ দুই দফায় বাড়ানোর পর যে বাসভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, তার চেয়েও বেশি ভাড়া আগে থেকেই আদায় করা হচ্ছে এসব বাসে।

গত শুক্রবার লিটারে ৩৪ টাকা করে ডিজেলের দাম বাড়ানোর পরদিন বিআরটিএ রাজধানীতে প্রতি কিলোমিটারে বাসভাড়া আড়াই টাকা নির্ধারণ করে জানায়, সর্বনিম্ন ভাড়া হবে ১০ টাকা। অর্থাৎ চার কিলোমিটার যাওয়া যাবে এই ভাড়ায়। এরপর প্রতি কিলোমিটার হিসেবে যোগ হবে আরও আড়াই টাকা করে। কিন্তু হাতিরঝিলে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে কিলোমিটার প্রতি ৬ টাকারও বেশি হারে।

এফডিসি কাউন্টার থেকে রামপুরা পর্যন্ত ৪ দশমিক ২ কিলোমিটার দূরত্বে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া পড়ছে ৫ টাকা ৯৫ পয়সা। এর আগে, একই দূরত্বে আদায় করা হতো ২০ টাকা। তখন কিলোমিটারে পড়তো ৪ টাকা ৭৬ পয়সা।

অথচ বিআরটিএর নতুন বেঁধে দেওয়া হিসেবে ভাড়া আসে ১০ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ১০ টাকায় বাসে ওঠার কোনো সুযোগ নেই। প্রথম যখন বাস চালু করা হয়, সে সময়ই এই পথের ভাড়া ঠিক করা হয় ১৫ টাকা আর সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল ১০ টাকা। এরপর নভেম্বরে সর্বনিম্ন ভাড়া ঠিক করা হয় ১৫ টাকা। এবার ঠিক করা হয়েছে ২০ টাকা।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (এফডিসি) বাসস্টপ থেকে পুলিশ প্লাজা পর্যন্ত ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার আর পুলিশ প্লাজা থেকে রামপুরা পর্যন্ত আরও ১ দশমিক ১ কিলোমিটারের জন্যও এই ভাড়া ঠিক করা হয়েছে। বিআরটিএ সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা ঠিক করে না দিলে প্রথম গন্তব্যে সর্বোচ্চ ভাড়া হওয়া উচিত ছিল ৭ টাকা ৭৫ পয়সা এবং দ্বিতীয় গন্তব্যে হওয়া উচিত ছিল ২ টাকা ৭৫ পয়সা।

কিন্তু এখন এফডিসি থেকে পুলিশ প্লাজা পর্যন্ত ভাড়া পড়ছে ৬ টাকা ৪৫ পয়সা হারে, আর পুলিশ প্লাজা থেকে রামপুরা পর্যন্ত ১৮ টাকা ১৮ পয়সা হারে।

রামপুরা থেকে মধুবাগ পর্যন্ত ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটারের জন্যও আদায় করা হচ্ছে ২০ টাকা, যা আগে ছিল ১৫ টাকা। আগে ভাড়ার হার ছিল ৪ টাকা ১৬ পয়সা, এখন হয়েছে ৫ টাকা ৫৫ পয়সা।

শুরু থেকেই হাতিরঝিলের চক্রাকার পুরো পথ যাওয়ার সুযোগ ছিল। একেবারে শুরুতে ঠিক করা হয় ৩০ টাকায় যাওয়া যাবে ৭ দশমিক ৪ কিলোমিটারের এই পথ। দুইবার ৫ টাকা করে বাড়িয়ে এখন তা করা হয়েছে ৪০ টাকা। এতে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া পড়ছে ৫ টাকা ৪০ পয়সা হারে।

গত মঙ্গলবার থেকে বাড়তি এই ভাড়া কার্যকর করা হয়েছে। কাউন্টারের সামনে একটি তালিকা টানানো হয়েছে ভাড়া বাড়ানোর। নিচে লেখা আছে ‘কর্তৃপক্ষ’। তবে এই কর্তৃত্ব কারা তা জানা যায়নি। কারণ তাতে কোনো কর্মকর্তার স্বাক্ষর নেই।

এফডিসি বাস স্টপেজের টিকিট বিক্রেতা মাসুদ করিমকে ১৫ টাকা দিয়ে পুলিশ প্লাজার টিকিট দিতে বলা হলে তিনি বলেন, ১৫ টাকার কোনো টিকিট নেই, ২০ টাকা। এরপর তিনি ভাড়া বাড়ানোর বিজ্ঞপ্তি দেখতে বলেন। বিজ্ঞপ্তিতে কারও স্বাক্ষর না থাকার বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, এইটাই। গেলে ২০ টাকা দেন।

এদিকে, বাড়তি ভাড়া নেওয়া হলেও টিকিট দেওয়া হচ্ছে আগের মূল্যহারের। সেই টিকিটে নতুন একটা সিল দেওয়া হয়েছে কেবল। এ নিয়ে টিকিট বিক্রেতার মন্তব্য দায়সারা ধরনের।

জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর পর গত নভেম্বরে নতুন করে বাস ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তখন বাড়তি ভাড়া আদায় ঠেকাতে বিআরটিএ রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে অভিযান চালায়। তবে সেখানে বাদ পড়ে হাতিরঝিলের চক্রাবাস বাস।

‘যখন সরকারের বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে ভাড়ার নৈরাজ্য হয়, তখন নগরীর অন্য বাসগুলো আরও সুযোগ নিতে চায়।’ - মোজাম্মেল হক চৌধুরী, মহাসচিব, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি 

এবার যখন বাড়তির ওপর আরও বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, তখনও বিআরটিএ এই পথের বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। গতবার বাসভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যের বিষয়ে বিআরটিএ কর্মকর্তাদের ফোন দিলে তারা কথা বলতেন। এবার কেউ ফোনই রিসিভ করছেন না।

নির্ধারিত হারের দ্বিগুণের বেশি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে লাইন সুপারভাইজার শওকত হোসেন বলেন, বাইরের ভাড়ার সঙ্গে এখানের ভাড়া কমপেয়ার (তুলনা) করলে হবে না। এই গাড়িগুলো সম্পূর্ণ আলাদা। এটা হাতিরঝিল প্রজেক্টের গাড়ি। এটা টুরিস্ট বাস হিসেবে চলে।

বাইরের বাসের সঙ্গে এই বাস সার্ভিসের পার্থক্য জানতে চাইলে শওকত হোসেন বলেন, হাতিরঝিলে টুরিস্ট বাস হিসেবে বরাদ্দ। বাসে যাত্রীদের দাঁড়িয়ে যাওয়া নিয়ে তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে প্রজেক্ট এভাবেই চুক্তিবদ্ধ।

ভাড়ার চার্টে বিআরটিএ বা রাজউকের স্বাক্ষর না থাকার বিষয়ে এই লাইন সুপারভাইজার বলেন, ‘আপনার তো অপশন আছে। আপনি রাজউকের কাছে যান।’

এইচআর ট্রান্সপোর্টের ফিল্ড অফিসার মাসুদ করিমও একই কথা বলেন। তিনি জানান, রাজউকের স্বাক্ষর করা চার্ট অফিসে আছে।

তবে রাজউকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। ফলে তারা কোনো নতুন চার্ট তৈরি করে দেননি।

রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (প্রজেক্ট অ্যান্ড ডিজাইন) এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, তারা বাড়তি ভাড়ার বিষয়ে রাজউকের কাছে আবেদন করেছেন। কিন্তু রাজউক তা এখনো অনুমোদন দেয়নি।

রাজউকের অনুমোদন ছাড়া কি বাড়তি ভাড়া নিতে পারে?- এমন প্রশ্ন করা হলে রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, ‘রাজউক অনুমোদন দেবে নাকি দেবে না, সে জন্য তো তেলের দামবৃদ্ধি বসে থাকে না। আমরা সই দিয়ে দেবো।’

সরকারের নির্ধারিত ভাড়ার দুই গুণের বেশি ভাড়া নিচ্ছে তারা। আপনাদের হিসাব কীভাবে হয়?- এমন প্রশ্নে রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, এখানে কিলোমিটার ধরে ভাড়া নিচ্ছে না তো। এখানে সে হিসাব চলে না।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘যখন সরকারের বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে ভাড়ার নৈরাজ্য হয়, তখন নগরীর অন্য বাসগুলো আরও সুযোগ নিতে চায়। আমি মনে করি, রাজউকের এখানে দায়বদ্ধতা আছে। পাশাপাশি বিআরটিএ ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনেরও দায়বদ্ধতা আছে।’