এখন সাভারের নাম শুনলেই রানা প্লাজা ধসের কথা মনে পড়ে। বিশ্বজুড়েও সাভার কুখ্যাত ইতিহাসের অন্যতম মানবসৃষ্ট ট্র্যাজেডির কারণে। ওই একটি ঘটনা ম্লান করে দিয়েছে রাজধানীর কাছের এই ঐতিহাসিক উপজেলার নামডাক। প্রাচীনকালে এই সাভারেই কি না গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ ধর্মকেন্দ্র। অনেকেই ভাবছেন, লেখক ভুল করছেন। বৌদ্ধ বিহার-টিহার তো কুমিল্লায় আর ওই উত্তরাঞ্চলে, ঢাকায় কোত্থেকে বৌদ্ধ বিহার আসবে! আছে আছে, ঢাকার সাভারেই আছে এক প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। সবার কাছে এই বিহারটি রাজা হরিশচন্দ্রের প্রাসাদ বা ঢিবি বলে পরিচিত।
সাভারগামী যেকোনো বাসে উঠে গেলেই হয়। নামতে হয় সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে রিকশা বা অটোরিকশা নিলে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় সেই প্রাসাদ বা ঢিবিতে। প্রত্নস্থলটি সাভার বাজার থেকে প্রায় ৪০০ মিটার পূর্ব দিকের মজিদপুর গ্রামে অবস্থিত। বলে রাখি, সাভার কিন্তু শুধু এই বৌদ্ধ বিহারের কারণেই প্রাচীন জনপদ নয়। একসময় এটি ছিল সমৃদ্ধ নগরী। পালবংশীয় রাজা হরিশ্চন্দ্রের সর্বেশ্বর রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল ‘সম্ভার’। সে সময়ের প্রতিফলন দেখা যায় প্রাচীন একটি পদ্যে, ‘বংশাবতীর পূর্ব তীরে সর্বেশ্বর নগরী/ বৈসে রাজা হরিশ্চন্দ্র জিনি সুরপুরী’। অনেকের ধারণা, সম্ভার থেকেই সাভার নামের উৎপত্তি। ধলেশ্বরী ও বংশী নদীর মোহনায় বংশী নদীর পূর্বতটে এই নগর গড়ে ওঠে। বৌদ্ধ বিহারের ৫০০ মিটার পূর্ব দিকে আরকে প্রত্নস্থল রাজাসন। সাভারে সর্বমোট ১৩টি প্রত্নস্থলের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানাচ্ছে বাংলাপিডিয়া। তা ছাড়া আড়াপাড়া জমিদার বাড়িও কিন্তু কাছেই। কেতাবি আলোচনায় পড়ে যাব। চোখের দেখাটা আগে বলি।

বাস থেকে নেমে মোটর লাগানো রিকশায় করে পৌঁছে গেলাম হরিশচন্দ্রের প্রাসাদে। কোনো দিক থেকে দেখতে এটি মোটেও প্রাসাদ বা বাড়ির মতো নয়। বিহার বা ঢিবি বলাই ভালো। রিকশা থেকে নেমে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি আগেও এখানে এসেছি। এবার দেখলাম, অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। গোটা বিহারটি বামন দেয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রত্নকেন্দ্রটি রক্ষায় ব্যবস্থা ওই অটুকুই। বাকি সব সদরঘাট। অবাধে মানুষ ঢুকছে, ময়লা ফেলছে, দেয়ালে লিখছে, আড্ডা দিচ্ছে, সিগারেট ও গাঁজা সেবন চলছে, যেখানে-সেখানে মূত্রত্যাগেও মানা নেই। কে মানা করবে শুনি! এটি রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার্থে প্রত্নকেন্দ্রের ভেতরেই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর একটি বাড়ি গড়েছে। সেখানে সব সুবিধাসহ একজন থাকেনও দেখলাম, কিন্তু তার কাজটি কী বুঝতে পারিনি। সাভারের বৌদ্ধ বিহারটি দেখতে কুমিল্লা ও বগুড়ার বৌদ্ধ বিহারগুলোর মতোই। পুরো প্রত্নকেন্দ্রের মূল কেন্দ্র একটি বর্গাকার ঢিবি বা বেদি। বেদির চারদিকে চারটি প্রবেশমুখ। বেদিতে উঠে আবারও মন খারাপ। বেদিটি তো লাল ইটে তৈরি, এটি যখন সংস্কার করা হয় তখন এ সময়ের ইট ব্যবহার করা হয়েছে, এখনকার ইটে তো ইংরেজিতে কারখানার নাম লেখা থাকে, সংস্কারের সময় ইটগুলো উল্টেও দেয়া হয়নি! চোখে দেখা চিত্রের বর্ণনা স্থগিত থাক। বইপত্র নিয়ে বসি।

বিশ শতকের আশির দশকের শেষদিক থেকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এ সময়ের মধ্যে ঢিবি এলাকায় একাধিকবার খনন কাজ হয়েছে। ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে খনন কাজে নেতৃত্ব দেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সে সময়ের উপপরিচালক মো. মোশারফ হোসেন। তিনি এই প্রত্নকেন্দ্রটি নিয়ে তার ‘প্রত্নতত্ত্ব : উদ্ভব ও বিকাশ’ বইয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ১৯১৩ সালে প্রথম একজন স্কুলশিক্ষক এই ঢিবির হদিস পান। পরে ১৯১৮ সালে প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর উদ্যোগে খনন কাজ শুরু হয়। তখনই অনুমান করা হয়েছিল, পূর্ব দিকের রাজাসন এবং এই ঢিবির ধ্বংসাবশেষগুলো হারিয়ে যাওয়া মহাযানী বৌদ্ধ স্থাপনার অংশ। মজিদপুরে সর্বশেষ খননের পর পাওয়া গেল এই মাঝারি আকারের বেদি বা নিবেদন স্তূপ এবং বিহারের কাঠামো। আবিষ্কৃত প্রত্নস্থলে তিনটি নির্মাণ সময় পর্বের অস্তিত্ব মিলেছে বলে জানিয়েছেন জনাব হোসেন। দক্ষিণ দিকে এক সারি ভিক্ষুক কক্ষ ও টানা বারান্দা ছিল। তিনি আরও জানান, গোটা প্রাঙ্গণে সময়ের মোট চারটি স্তর জড়িয়ে আছে। উপরের স্তরে গুপ্ত যুগের স্বর্ণ মুদ্রা এবং পট্টিকের রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া যায়। অনুমান করা হয়, স্বর্ণ মুদ্রাটি ৬-৭ শতকের এবং রৌপ্য মুদ্রাটি ৮-৯ শতকের। এখান থেকে কয়েকটি মহাযানী এবং লোকেশ্বর মূর্তিও পাওয়া গেছে, যেগুলো ৭-১০ শতকের নিদর্শন। তাই ধারণা করা হয়, এই প্রত্নস্থলটি আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৭-১০ শতকের দিকে নির্মিত।
আমাদের শেকড়ের সন্ধানের অসীম যাত্রায় সাভারের এই অনন্য নিদর্শনটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তা তো আর ‘সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ’ ঘোষণা করে দিলেই টিকে যায় না, তাকে লালন করতে হয়, চর্চায় রাখতে হয়। বিহারটি ভালো নেই। এমন আরেকটি প্রত্নসম্পদও আমাদের নেই যে এটিকে পায়ে ঠেলা যায়। যাক, মন খারাপের কথা বাদ দিয়ে একটি সংযোগের কথা দিয়ে শেষ করি। যারা জানেন, বৌদ্ধ বিহার শুধুমাত্র কুমিল্লায় ও উত্তরবঙ্গে গড়ে উঠেছিল তাদের আশ্বস্ত করতে পারে সাভারে প্রচলিত একটি গপ্পো, ময়নামতির তান্ত্রিক মহারানীর পুত্র গোপীনাথের সঙ্গে নাকি সাভারের এই হরিশচন্দ্র রাজার বড় মেয়ে অনুদার বিয়ে হয়েছিল। সে হিসেবে সাভার হলো কুমিল্লার গোপীনাথের শ্বশুরবাড়ি।
লেখক: দৃশ্যগল্পকার ও লেখক
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা