- দুই দিনে ঢাকায় গ্রেপ্তার ৪৭২ জন
- সারা দেশে গ্রেপ্তার ১,৩৫৬ জন
- বিএনপির অভিযোগ, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ সামনে রেখে গ্রেপ্তার অভিযান
রাজধানীর বনানীতে গত শনিবার রাতে প্রায় একসঙ্গে একাধিক হোটেলে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। শুধু রাজধানীতেই নয়, দেশজুড়েই চলছে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান। অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিএনপি নেতা-কর্মীদের তালিকা তৈরি করে প্রতি রাতেই তাদের বাসাবাড়িতে যাচ্ছে পুলিশ। ফলে রীতিমতো পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাদের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র বলেছে, গত দুই দিনে সারা দেশে পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় দেড় হাজার। এর মধ্যে রাজধানীতেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৭২ জনকে।
বিএনপির অভিযোগ, ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর তাদের বিভাগীয় সমাবেশ সামনে রেখে পুলিশ এই সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। গত দুই দিনে তাদের দেড় হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা যাতে ঢাকার সমাবেশে যোগ দিতে না পারেন, সে জন্য পরিকল্পিতভাবে পুলিশ এই অভিযান শুরু করেছে।
অবশ্য পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা পুরোনো মামলায় পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করছেন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে সবাই বিএনপির নেতা-কর্মী না। গত ২৯ নভেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে যে বিশেষ অভিযানের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেই নির্দেশনা অনুযায়ী অভিযান চালানো হচ্ছে। দুই জঙ্গি ছিনতাই, বিজয় দিবস, বড়দিন এবং থার্টিফার্স্ট নাইট উদ্যাপন নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতেই এই অভিযান। পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, গত দুই দিনের বিশেষ অভিযানে রাজধানীতে ৪৭২ জনসহ সারা দেশে মোট ১ হাজার ৩৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সাঁড়াশি অভিযান ও গ্রেপ্তার নিয়ে বক্তব্য জানতে পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে এক দিন আগেই পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ আইনের মধ্যে থেকে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ অভিযানের নামে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের অভিযোগ ভিত্তিহীন। নিয়মের বাইরে কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, জঙ্গি ছিনতাই, বিজয় দিবস, বড়দিন বা থার্টিফার্স্ট নাইটের কথা বলা হলেও মূলত অভিযান চলছে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে। লিখিত কোনো আদেশ না থাকলেও বিএনপি নেতা-কর্মীদের তালিকা তৈরি করার জন্য আগেই মৌখিক নির্দেশনা দেয়া ছিল। তারও আগে সব রাজনৈতিক মামলা হালনাগাদ করা হয়েছে। পুরোনো মামলায় যারা পলাতক রয়েছে, পৃথকভাবে তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এখন সেই তালিকা ধরে অভিযান চলছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম বলেন, বিএনপি কোনো জঙ্গি সংগঠন না। পুলিশ জঙ্গি ধরুক। ৩০ নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত শুধু রাজধানীতেই ৭৫০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা সবাই আদালত থেকে জামিনে ছিলেন। তার পরও তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপির আরেক নেতা ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান বলেন, ‘আমরা নয়টি বিভাগীয় সমাবেশ করেছি। কোথাও কোনো ঝামেলা হয়নি। ঢাকাতেও হবে না। তার পরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এসব গ্রেপ্তার সমাবেশের জনসমুদ্র থামানোর জন্য করা হচ্ছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, গত শনিবার ডিএমপি সদর দপ্তরে এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা পৃথক বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে ঢাকায় সাঁড়াশি অভিযানের নির্দেশনা দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার রাতে রাজধানীর বনানী থানা পুলিশ কাকলী এলাকার একাধিক আবাসিক হোটেলে অভিযান চালায়। জঙ্গিবিরোধী অভিযানের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে আবাসিক হোটেলগুলোয় বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী অবস্থান নিয়েছে কি না, তা চেক করে দেখছেন পুলিশ সদস্যরা।
ওই সূত্র বলেছে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় যেসব আবাসিক হোটেল রয়েছে, সেসব হোটেল কর্তৃপক্ষকে ইতিমধ্যে মৌখিকভাবে আগামী কয়েক দিন বেশি লোকজনকে অবস্থান করতে না দিতে নিষেধ করা হয়েছে। একসঙ্গে বেশি লোকজন অবস্থান করলে তা স্থানীয় থানা পুলিশকে জানাতে বলা হয়েছে। তা না হলে হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে।
ডিএমপি সূত্র বলেছে, প্রতি রাতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘেরাও করে তল্লাশি অভিযান চালানো হবে। একেক দিন একেক এলাকায় তল্লাশি চলবে। ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী ডিএমপিতে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। এটি আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম। প্রতি মাসে আমরা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের বিশেষ অভিযান ঘোষণা করে থাকি। আমাদের বিশেষ অভিযানের লক্ষ্য পরোয়ানাভুক্ত আসামি, মাদক ব্যবসায়ী ও জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করা। এখানে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে না।
তবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের অর্ধশতাধিকেরও বেশি টিম রয়েছে। এসব টিমকে অন্যান্য নিয়মিত মামলা বাদ দিয়ে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পলাতক বিএনপি নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাতে বলা হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল শনিবার রাতে আমিনবাজার এলাকা থেকে যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সহসভাপতি নুরুল ইসলাম নয়ন, ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি জাভেদ হাসান স্বাধীন এবং টুকুর ব্যক্তিগত সহকারী মোখলেসুর রহমানসহ সাতজনকে আটক করেছে। গতকাল তাদের পল্টন থানার একটি পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, সারা দেশ থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিচ্ছিন্নভাবে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় আসতে শুরু করেছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে তাদের গ্রেপ্তার এড়িয়ে নানা ছদ্মবেশে ও বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। এ জন্য গোয়েন্দারাও আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার মেসবাসাগুলোয় তীক্ষ্ণ নজরদারি করছে।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি নেতা-কর্মীদের মালিকানাধীন বিভিন্ন কলকারখানাগুলোও নজরদারিতে রয়েছে। তাদের কাছে তথ্য রয়েছে, ঢাকার বাইরে থেকে লোকজন এনে এসব কলকারখানায় রাখার এবং সবাইকে ভুয়া আইডি কার্ড বানিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা হয়েছে, যাতে পুলিশের তল্লাশির সময় তারা সেটি দেখাতে পারেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, সরকার সমাবেশের আগে পরিবহন মালিক সমিতির মাধ্যমে কৌশলে কথিত ধর্মঘট দিতে চায় না। সাধারণ জনগণের ভোগান্তিতে সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় কৌশল পাল্টিয়ে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শহরের বাসস্ট্যান্ডগুলোয় নজরদারির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঢাকাগামী বাসে ওঠার বিষয়টি নজরদারি করছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মাসুদুর রহমান ভূঞা দৈনিক বাংলাকে বলেন, খুলনায় কোনো গণগ্রেপ্তার হচ্ছে না। যারা নিয়মিত মামলার আসামি, যাদের ওয়ারেন্ট আছে, পুলিশ শুধু তাদের গ্রেপ্তার করছে। গ্রেপ্তারের পর পরই তাদের আদালতে উপস্থাপন করা হচ্ছে। মামলা ছাড়া কাউকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা