ব্যাংক খাত দুর্বল এখনো, সংস্কারের পদক্ষেপ নেই। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণ দেয়ায় অনিয়ম এখনো আছে। সুশাসন ও সংস্কারের অভাবে এই খাত ক্রমাগতভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক-ইন সেন্টারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘সংকটে অর্থনীতি: কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?’ শীর্ষক সংলাপে এমন মন্তব্য করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এবং বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ এমডি রূপালী হক চৌধুরী। আলোচনায় ব্যাংক খাতের দুর্বলতা, তদারকি, ঋণ, অনিয়ম, মূল্যস্ফীতিসহ নানা বিষয় সামনে আসে। সবাই ব্যাংক খাতের দুর্দশার প্রসঙ্গ সামনে আনেন।
ব্যাংক খাত সংস্কারে পদক্ষেপ নেই
মূল প্রবন্ধে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংক খাত দুর্বল এখনো, সংস্কারের পদক্ষেপ নেই। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণ দেয়ায় অনিয়ম এখনো আছে। সুশাসন ও সংস্কারের অভাবে এই খাত ক্রমাগতভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছ। খেলাপি ঋণের উন্নতি না হলে এ ধরনের ঘাটতি রয়েই যাবে। খেলাপি যা বলা হচ্ছে, বাস্তবে এর পরিমাণ অনেক বেশি। আইএমএফসহ সংশ্লিষ্টরা এটি বারবার বলেছেন। তাদের ধারণা, সব সূচক যদি বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বর্তমানে যোগ হয়েছে ব্যাংকের তারল্য সংকট। ব্যাংকের ঋণ-আমানতে ৯ ও ৬ শতাংশ সুদহার ধরে রাখা ভুল সিদ্ধান্ত উল্লেখ কর বলা হয়, ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকের আমানত কমে যাচ্ছে। কিন্তু সংস্থারে কোনো পদক্ষেপ নেই।
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ভারতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুদহার সমন্বয় করেছে। কিন্তু এখানে সেটি করা হয়নি। আমরা ৬-৯ ধরেই বসে আছি। বিশ্বের অনেক দেশে পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু আমরা একই জায়গা ধরে আছি। ডলার সংকট সরকারের পক্ষ থেকে জানুয়ারি মাসে শেষ হবে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এটি আরও ছয় মাস থাকবে বলে আমি মনে করি।’ তিনি আরও বলেন, ব্যাংকে ৬-৯ সুদহার ধরে রাখা ভুল পদক্ষেপ। এতে উসকে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও মূল্যস্ফীতি কমছে, তারপরও সুদহার বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকেগুলোতে ঋণ দেয়ায় অনিয়ম, সুশাসন ও সংস্কারের অভাব রয়েছে। ফলে এই খাত ক্রমাগতভাবে দুর্বল হচ্ছে। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের উন্নতি না হলে এ ধরনের ঘাটতি রয়েই যাবে।
ব্যাংকগুলো থেকে যত টাকা লুট হয়েছে, ব্রিটিশরাও এত লুটে নেয়নি
গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘আমরা একটি নীতিবিহীন অর্থনীতির মধ্যে যাচ্ছি গত এক দশক ধরে। আগে কিছু ভারসাম্য ছিল। আগে সংসদে অনেক কিছু প্রতিফলিত হতো। গত চার বছরে আমরা তিন-চারজন সংসদ সদস্য, সিভিল সোসাইটির কাছ থেকে যা শুনি, যেটিকে আমাদের যৌক্তিক মনে হয়েছে, আমরা কোনো না কোনোভাবে সংসদে উপস্থাপন কিরেছি। কিন্তু বলার পরে কোনো কাজ হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছর আমি এক কথা বলে আসছি। কারণ, কোনো পরিবর্তন হয়নি। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, ড্রামাটিক ফ্লাকচুয়েশন, দুর্বল ব্যাংকিং খাতসহ আরও অনেক কিছু- এগুলোর কোনো কিছুই করোনা বা ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এগুলোর মূল কারণ খেলাপি ঋণ, ব্যাংক লুট। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো থেকে যেই পরিমাণ টাকা লুট হয়ে গেছে সেই পরিমাণ টাকা মনে হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও লুট করেনি। শেয়ার মার্কেটে ধস কয়েকবার হয়েছে। একটিরও সে রকম কোনো তদন্ত হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আর যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হিউজ কোনো টাকা আর্ন করে তার লক্ষ্যই থাকবে তারা এই টাকা বিদেশে পাচার করে দেবে। এটি একটি চক্র হয়ে গেছে। অবৈধ পথে আয় করা, অবৈধভাবে ডিফল্ট ঋণ নেয়া, ঋণগুলোকে অবলোপন করা এবং টাকা পাচার করা। এই চক্রের মধ্যে আমলা, রাজনীতিবিদ এবং একটি দুষ্কৃতকারী ব্যবসায়ী চক্র জড়িত। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন চাটার দলের কথা তারা ধান গম খাচ্ছে। এখনো চাটার দল আছে তারা ব্যাংক গিলে খাচ্ছে। এর থেকে দেশকে বের করতে হবে।
লাগামহীন মূল্যস্ফীতি
মূল প্রবন্ধে ফাহমিদা খাতুন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে পণ্যের দাম বাড়ছে, তার চেয়েও বেশি হারে বাড়ছে স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম। বিশেষ করে চাল, আটা, চিনি, ভোজ্যতেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও স্থানীয় বাজারে সেই প্রভাব নেই। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের দামও কারণ ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী। এ ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে।
লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ।
সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খাদ্য ব্যয় ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা। এটাকে রেগুলার ডায়েট বলছে সিপিডি। এখানে ১৯টি খাদ্যপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা। এটা ‘কম্প্রোমাইজড ডায়েট’ বা আপসের খাদ্য তালিকা। বেতন প্রতি বছর ৫ শতাংশ বাড়লেও সেটা রেগুলার ডায়েটের ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম।
‘অর্থনীতি প্রধানমন্ত্রী চলাচ্ছেন’
সিপিডির আলোচনায় অর্থমন্ত্রীর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বলা হয়, দেশের অর্থনীতি চালাচ্ছে কে? পরিকল্পনামন্ত্রী বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেন, ‘অর্থনীতি অর্থমন্ত্রী চালান না, অর্থনীতি পরিকল্পনামন্ত্রী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর চালান না। অর্থনীতি বাই রুল বাই অর্ডার চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এটিই আইন, কারণ উনি (প্রধানমন্ত্রী) সরকারপ্রধান। আমি হয়তো আজ অসুস্থ বা অন্য কেউ অসুস্থ হলেন, আমি হয়তো অফিসে গেলাম না। তাই বলে কাজ তো আর পড়ে থাকবে না।’
মূল্যস্ফীতি কমছে, তবে নিম্ন হারে উল্লেখ করে এমএ মান্নান বলেন, ফলে মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে। বিবিএস সঠিক নয় এটি কেউ বললে তার সঙ্গে আমি বিবাদে যাব। আমরা সংখ্যা নিয়ে অসত্য কথা বলি না। আমাদের ফিগার বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও স্বীকার করেছে।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘পরিকল্পনামন্ত্রী আমাদের বলেছেন দেশে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। তিনি হয়তো জেনে থাকবেন সিপিডি সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন। এর মধ্যে আমি নিজে একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। তারা কেউ কেউ সুবিধা পাওয়ার কথা জানালেও বেশির ভাগই বড় বড় সমস্যার কথা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। উন্নয়ন হয়েছে সেটি আমরা জানি তাতে সমস্যাগুলো কিন্তু চলে যাচ্ছে না।’
পরিকল্পনামন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনি কিন্তু সমস্যাগুলোকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এখানে দেশের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে, খুব ভালো হতো আপনি যদি বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতেন। যদিও এখানকার অনেক বিষয় আপনার উত্তর দেয়ার কথা নয়। (এখানে অর্থমন্ত্রীর কথা বোঝানো হয়েছে।) পদ্ম ফুল ফোটার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, পদ্ম ফুল বছরের একটি বিশেষ সময় ফোটে। আমাদের উত্তরগুলো পেতে পদ্মফুল ফোটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
এ সময় পরিকল্পনামন্ত্রীকে উদ্দেশ করে অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, ‘খুব ভালো হতো যদি এই সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতেন। কারণ, সমস্যাগুলোর সমাধান হওয়া দরকার। কিন্তু আপনি ব্যস্ত ছিলেন তৃণমূলের উন্নয়ন নিয়ে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান হওয়া দরকার।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা