আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৪:১৫
ভবন নির্মাণে ব্যয় কমাচ্ছে ‘হলো ব্লক’
এ এস এম সাদ

ভবন নির্মাণে ব্যয় কমাচ্ছে ‘হলো ব্লক’

ভবন নির্মাণে ইটের পরিবর্তে বালু, সিমেন্ট ও নুড়ি পাথরের ব্লক ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন স্থাপনায় গত ১০ বছরে বেড়েছে ‘হলো ব্লক’-এর ব্যবহার।

গবেষকরা বলছেন, এটি পরিবেশবান্ধব ও নির্মাণ ব্যয়ও কম। গত ১০ বছরে ভবন নির্মাণে পোড়া ইটের বদলে বেড়েছে ব্লকের ব্যবহার। বাসাবাড়ি, অফিস, শপিংমল কিংবা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে ব্যবহার হচ্ছে ব্লকের।

সাধারণত ভবন নির্মাণে ব্যবহারের সুবিধার জন্য, অবস্থানগত আকৃতির কারণে বা ডিজাইনারের নির্বাচনের কারণে বিশেষ আকার-আকৃতির ইটের প্রয়োজন দেখা দেয়। এগুলোকে ‘হলো ব্লক’ বা সিরামিক ইট বলা হয়।

প্রকৌশলীরা বলছেন, ভবন নির্মাণে ইটের বদলে ব্লকের ব্যবহার করলে ব্যয় অন্তত ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। কারণ, ভবন নির্মাণের সময় যেখানে একটি হলো ব্লকের ব্যবহার করা হয়, সেই সমপরিমাণ স্থানে পাঁচটি পোড়া ইটের দরকার হয়। বর্তমানে বাজারে একটি হলো ব্লকের খুচরা দাম ৩২ থেকে ৩৮ টাকা। আর প্রতিটি ইটের দাম ১২ থেকে ১৩ টাকা টাকা। ফলে পাঁচটি ইটের দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা হলে সেই সমপরিমাণ স্থানে একটি ব্লকের দাম পড়ে ৪৫ টাকা।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাখাওয়াৎ হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ব্লক তৈরি করা হয় সিমেন্ট, বালু ও নুড়ি পাথর দিয়ে। নির্মাণকাজে পাঁচটি ইটের জায়গায় একটি ব্লক ব্যবহার করা যায়। ফলে নির্মাণ খরচ কমে। সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া আছে, ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি ভবন ব্লক দিয়ে নির্মাণ করতে হবে। ব্লকের তৈরি ভবন ভূমিকম্প সহনীয়। কারণ, ব্লকের ভেতরে ফাঁপা থাকায় অনেকটা হালকা হয়।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নব্বই দশকে দেশে ব্লকের ব্যবহার নিয়ে প্রথম গবেষণা করে হাউস অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই)। এইচবিআরআই গবেষণার জন্য ব্লকের ব্যবহার করার কয়েক বছর পরে ১৯৯৮ সালে কনকর্ড গ্রুপ বাণিজ্যিকভাবে ব্লকের উৎপাদন শুরু করে এবং প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন প্রজেক্টে ভবন নির্মাণে এটি ব্যবহার করে। কনকর্ড রিয়েল এস্টেট ভবন নির্মাণে হলো ব্লক ব্যবহার করে। দেশে এই প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বেশি ব্লকের প্রকল্প আছে এবং তারা বাণিজ্যিকভাবে ব্লকের সরবরাহ করে।

বর্তমানে কনকর্ড গ্রুপ তিনটি কারখানায় হলো ব্লক তৈরি করছে। সবচেয়ে বড় কারখানাটি মেঘনা নদীর পারে। এ ছাড়া গাজীপুরের সালনা এবং ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের কারখানায় ব্লক উৎপাদন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশেই ব্লকের সরবরাহ করে থাকে।

কনকর্ড রিয়েল এস্টেটের এক্সিকিউটিভ মার্কেটিং নুসরাত নওশিন বলেন, ‘বাসা কিংবা অফিস হলো ব্লক দিয়ে তৈরি করলে ব্যয় কম হয়। কারণ, পাঁচটি ইটের জায়গায় একটি ব্লক ব্যবহার করলেই হয়। এ ছাড়া ব্লকের ভেতরের স্থানে অনেকটা ফাঁপা থাকে। তাই ঘর গরমে ঠাণ্ডা এবং শীতে গরম থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কনকর্ড গ্রুপ বছরে ১ কোটি ৫০ লাখ পিস ব্লক উৎপাদন করে। ব্লক বরাবর ভূমিকম্প সহায়ক, তাই ঝুঁকিও কম। বর্তমানে দেশব্যাপী ব্লকের চাহিদা বেড়েছে।’

বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেড (বিটিআই), মীর আখতারসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে ব্লকের উৎপাদন করছে। বিটিআইয়ের নিজেদের প্রকল্পে বছরে ৩৬ লাখ পিস ব্লকের চাহিদা আছে। এই ব্লকগুলো বিটিআইয়ের নিজস্ব কারখানা ধামরাইয়ে উৎপাদন করা হয়।

বিটিআইতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার প্রায় সব এলাকায় বিটিআইয়ের প্রকল্পে ব্লক ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ব্লক ব্যবহারে নির্মাণকাজ দ্রুত হচ্ছে। এতে খরচ কম ও অবকাঠামো টেকসই হয়। মাসে তিন লাখ পিস ব্লকের চাহিদা রয়েছে।

অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের অবকাঠামো নির্মাণে ব্লক ব্যবহার করছে। নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আবাসন তৈরিতে ব্লকের ব্যবহার হয়েছে। এ ছাড়া কনকর্ডের কাছ থেকে কিনে বাংলাদেশ নেভি, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (বিএসআরএম), এসকিউ গ্রুপ, এসিআই, বেঙ্গল গ্রুপসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি বর্তমানে অবকাঠামো নির্মাণের কাজে ব্লক ব্যবহার করছে।

বর্তমানে পরিবেশবান্ধব সংস্থাগুলো সরকারি ভবন নির্মাণে ইটের বদলে ব্লকের ব্যবহার করার তাগিদ দিচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘কৃষিজমির মধ্যে পোড়ানো ইটের কারখানা তৈরি করা হয়েছে। ফলে প্রতিবছর ১ শতাংশ কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। মাটি দিয়ে পোড়ানো ইটের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে হবে। পোড়ানো ইটের বিকল্প ইট প্রচলনে পরিবেশবান্ধব কাঁচামালের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার ২০২০ সালের মধ্যে মাটিতে পোড়ানো ইটের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে তাগিদ দিচ্ছে। ব্লকের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব এবং এটি উর্বর মাটি ক্ষয় কম করে। ব্লক তৈরি ভবন অনেকটা নিরাপদ ও ভূমিকম্প সহায়ক।’

নির্মাণ খাতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০০ সালের দিকে ব্লক দিয়ে ভবন নির্মাণ করা শুরু করে কয়েকটি কোম্পানি। ওই সময় ব্লক ব্যবহারে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছিল। ফলে প্রকল্পগুলো অনেক দিন ধরে বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে গত এক দশকে সেই সমস্যার সমাধান করে ব্লক দিয়ে ভবন তৈরি করা হচ্ছে। সিমেন্ট খাতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ব্লক তৈরি করতে যেহেতু সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়, ফলে গত কয়েক বছরে সিমেন্টের চাহিদাও বেড়েছে।