২০১৭ সালে দুর্নীতির মামলায় মাস ছয়েক কারাগারে ছিলেন প্রয়াত রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার। ওই সময় কারাগারে থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় এবং সেখানে থাকা অবস্থায় জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে তার সঙ্গে পরিচয় হয় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের অন্যতম আসকারি সদস্য আবু সিদ্দিক সোহেলের সঙ্গে। সোহেলের মাধ্যমেই তিনি পুরোদমে সম্পৃক্ত হয়ে যান আনসার আল ইসলামের সঙ্গে। বেরিয়ে এসে পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে পড়েন জঙ্গিবাদে।
ওমর ফারুকের স্ত্রী মার্জিয়া মলি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ফারুককে ফাঁদে ফেলে জঙ্গি বানানো হয়েছে। তাকে বুঝিয়ে দুই সন্তানের কথা বলেও জঙ্গিবাদের পথ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে চলত জেলে থাকা এক জঙ্গির কথামতো। শেষে ওই জঙ্গির বোনকেই সে বিয়ে করেছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আইনজীবী হিসেবে ফারুক আনসার আল ইসলামের সদস্যদের মামলাগুলোর দেখভালও করতেন। সর্বশেষ দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় রেকি করার সময়ও ওমর ফারুক সম্পৃক্ত ছিলেন। এমনকি জঙ্গি ছিনতাইয়ের পর সোহেলের স্ত্রী শিখাকে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এনে গোপন আস্তানায় পৌঁছে দেন ফারুক।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) উপকমিশনার এস এম নাজমুল হক দৈনিক বাংলাকে বলেন, দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ছাড়াও ওমর ফারুকের সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তার নিকটজনদের আর কেউ জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে ছিনিয়ে নেয়া দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন ওমর ফারুক তালকদার। পরে তিনি নর্দান ইউনিভার্সিটি থেকে আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। তার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা এলাকায়। একই এলাকার সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের প্রয়াত জ্যেষ্ঠ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাবেক এপিএস অনুকুল তালুকদার ডালটনের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। ২০০৮ সালে ডালটন আইন পড়তে লন্ডন চলে যাওয়ার সময় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে ফারুকের পরিচয় করিয়ে দেন। রেলমন্ত্রী হওয়ার পর সুরঞ্জিত ফারুককে নিজের এপিএস হিসেবে নিয়োগ দেন।
ফারুকের স্বজন ও বন্ধুরা জানান, ২০১২ সালে ৭০ লাখ টাকাসহ রেলের নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আধুনিক জীবনযাপন করতেন ফারুক। কিন্তু ওই ঘটনায় চাকরিচ্যুত হওয়ার পর থেকে একটু-আধটু ধর্মকর্মে মনোযোগ দেন। ২০১৭ সালে দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যাওয়ার পুরোপুরি পাল্টে যান ফারুক। জেলে থাকা অবস্থাতেই তিনি ধর্মীয় দিক থেকে কট্টর মনোভাবের হয়ে পড়েন।
জঙ্গিবাদ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন স্ত্রী
ফারুকের স্বজন ও বন্ধুরা জানান, ২০১৭ সালের পর থেকে বেশভূষায় পরিবর্তন আসে তার। তখন তারা কথা, আচরণ ও চালচলনে স্বজন ও বন্ধুরা বুঝতে পারেন উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়েছেন ওমর ফারুক তালুকদার। তার স্ত্রী মার্জিয়া মলিও একাধিকবার তাকে এই পথ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করেন।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, ওমর ফারুকের সঙ্গে তার স্ত্রীর কথোপকথনের কিছু রেকর্ড পেয়েছেন তারা। এতে ফারুকের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া নিয়ে তার স্ত্রীর ভাষ্য ও অনেক তথ্য রয়েছে। এসব তথ্য আমলে নিয়েও বিস্তারিত অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ওমর ফারুকের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও ইসলামি বক্তা আলী হাসান উসামারও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে দেয়া অর্থ কারাগারে থাকা জঙ্গিদের কাছে পৌঁছে দিতেন তিনি।
ওমর ফারুকের স্ত্রী মার্জিয়া মলি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ফারুককে ফাঁদে ফেলে জঙ্গি বানানো হয়েছে। আমি অনেক বুঝিয়েছি। আমাদের দুই সন্তানের কথা বলে তাকে জঙ্গিবাদের পথ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে জেলে থাকা এক জঙ্গির কথামতো চলত। শেষে ওই জঙ্গির বোনকেই সে বিয়ে করেছে।’
মার্জিয়া মলি বিভিন্ন সময়ে ফারুকের মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে বলেছেন, ‘প্লিজ ফারুক, মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। তুমি জঙ্গিদের ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসো।’
আরেক মেসেজে মলি বলেন, ‘আমার কোনো দুঃখ নাই। আমি তোমাকে ফেরানোর চেষ্টা করছি। আমার সন্তানসহ তোমার বন্ধুরা সাক্ষী। জঙ্গিরা তোমাকে ‘মাসনা’ (মাসনা অর্থ দ্বিতীয় বিয়ে) করিয়েছে, ঘরছাড়া করছে, এখন তোমাকে দিয়ে বোমা হামলা করাবে। তুমি ভয়ংকর জঙ্গি হয়ে গেছ, তোমার মাথা ওয়াশ, আমি বুঝে গেছি তোমার ফিরে আসা কঠিন। তুমি জেলখানার পরামর্শে চলো, জেলখানার পরামর্শে ঘর ছাড়ছ। জঙ্গি না হওয়াটা আমার অপরাধ হয়ে গেছে, তাই তুমি জঙ্গি বিয়ে করেছ।’
সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ফারুক চলতি বছরের এপ্রিলে মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেলের বোন তানজিনা শিরিনকে বিয়ে করেন। তাদের এই বিয়েও জেলে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন করে দেন আবু সিদ্দিক সোহেল।
দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের আগে রেকিও করেছেন ফারুক
আদালত থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের আগে জঙ্গিদের সহযোগীদের সঙ্গে ফারুকও নিম্ন আদালত এলাকায় রেকি করেছিলেন। এমনকি জঙ্গি ছিনতাইয়ের আগের দিনও তিনি পুরান ঢাকার আদালত এলাকায় ঘুরে এসেছেন।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের আগেই ফারুক নিজে ময়মনসিংহ গিয়ে আবু সিদ্দিক সোহেলের স্ত্রী শিখাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সোহেলের শ্বশুর ও শিখার বাবা আদালতে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দিও দিয়েছেন। ওই জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ফারুক একাধিকবার তার ময়মনসিংহের বাসায় গিয়েছেন। সর্বশেষ গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি শিখাকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। পরে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পর তিনি ফারুকের কাছে মেয়ে শিখার বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক তাকে শিখা ভালো আছেন বলেও জানান।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পর ফারুক তার ডিজিটাল ডিভাইসগুলো ফেলে দিয়েছেন যাতে পুলিশ তাকে ধরলে কোনো তথ্য বের করতে না পারে। গত ৫ ডিসেম্বর ওমর ফারুক বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি স্ট্যাটাসও দেন।
গত ২০ নভেম্বর আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনার এক মাসের মাথায় গ্রেপ্তার করা হয় ওমর ফারুককে। চার দিনের রিমান্ড শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, এই ঘটনায় ফারুকের দ্বিতীয় স্ত্রী তানজিলাকেও গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা