আপডেট : ২৭ আগস্ট, ২০২২ ০৯:৩৮
ডিসেম্বরেও শেষ হচ্ছে না বিআরটি প্রকল্পের কাজ

ডিসেম্বরেও শেষ হচ্ছে না বিআরটি প্রকল্পের কাজ

পাঁচজনের প্রাণহানির পরও বিআরটি প্রকল্পে নিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত করা হয়নি। শুক্রবার গাজীপুরের গাজীপুরা এলাকায় । ছবি: দৈনিক বাংলা

  • প্রকল্পের কাজে এখনো বসেনি নিরাপত্তাবেষ্টনী। নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিআরটির পরিচালনা পর্ষদ।
  • ইলেকট্রিক নয়, চলবে ডিজেলচালিত বাস। নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৭৯.0৯ শতাংশ।
  • ২০২৩ সালের জুনে চালু হতে পারে বিআরটি

প্রতিবেদক, দৈনিক বাংলা

রাজধানী ঢাকার সঙ্গে গাজীপুরের যোগাযোগ সহজ ও সময় সাশ্রয়ী করতে ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। চার বছর মেয়াদে কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত ১০ বছরেও কাজ শেষ হয়নি। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা বলা হলেও এ সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হচ্ছে না। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ আবারও বাড়বে। বাড়বে প্রকল্পের খরচ, ভুগবে মানুষ। 

প্রকল্পের ফিজিক্যাল নির্মাণকাজে সওজের অংশের ১৬ কিলোমিটারের কাজ হয়েছে ৮২ দশমিক ৯ শতাংশ। বিবিএ অংশের সাড়ে ৪ কিলোমিটারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৭২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ।

গতকাল শুক্রবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আশা করছি, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের মেজর কাজগুলো শেষ হবে। তবে ডিসেম্বরে বাস চালু হবে না। প্রকল্পের বাকি কাজ ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে সম্পন্ন হবে। তারপর ওই বছরের জুনে প্রকল্পটি চালু করা যাবে। তখন বাস চলবে বলে আমরা আশা করছি।’

তবে প্রকল্পের কাজের যে গতি তাতে ২০২৩ সালেও বিআরটি প্রকল্পে বাস চলবে কি না, তা নিয়েও সংশয় থেকেই যাচ্ছে। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর প্রকল্প এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, গত ১৫ আগস্ট উত্তরায় প্রাইভেট কারে গার্ডার পড়ে একই পরিবারের পাঁচ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকে এখনো প্রকল্পের সব কাজ বন্ধ। সড়কে যাত্রীসাধারণের চলাচলে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কাজ শুরু হবে না। তবে পুরো প্রকল্প এলাকায় সেফটি বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম এখনো দেয়া হয়নি। কিছু কিছু জায়গায় টিনের শেড দিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এখনো সব বাসস্টেশনের নির্মাণকাজ বাকি আছে। তবে গাজীপুরে বাসের ডিপো নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এদিকে প্রকল্পের কাজে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিআরটি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাও।

গতকাল প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে এ বিষয়ে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ইসরাত ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্পের কাজে নিরাপত্তার কিছুটা ঘাটতি আছে। কাজের ক্ষেত্রে ঠিকাদাররা কী ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছিল, তার লিখিত ডকুমেন্ট আমরা চেয়েছি। কারণ একটা বড় প্রকল্পে কাজ হলে সেখানে সবকিছুই নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে ঘিরে থাকা উচিত। যা এই প্রকল্প এলাকায় খুব একটা দেখা যায়নি।’

এদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেছেন, বিআরটি কর্তৃপক্ষকে বারবার অনুরোধ করার পরও তারা প্রকল্পের কাজের নিরাপত্তার বিষয়ে কখনোই আমলে নেয়নি। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেফটি নিশ্চিত করার কাজ করছে। তারা তাদের কাজ শেষ করলে তারপর আবার নির্মাণকাজ শুরু হবে।

এদিকে প্রকল্পের সার্বিক বিষয়ে বিআরটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শতভাগ সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারলে যথাসময়ে কাজ শেষ করা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত শতভাগ কাজ আমরা পাইনি ঠিকাদারের কাছ থেকে। তবে তাদের চাপে রেখেছি। তাদের তিনটি শর্ত পূরণ করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ফান্ড ও লোকবলের ঘাটতি দূর করা এবং মেজর সেফটি শতভাগ নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কাজ শুরুর অনুমতি দেয়া হবে না। ঠিকাদাররা যদি আমাদের কথা না রাখে, তাহলে ঠিক সময়ে কাজ হবে না, এটাই স্বাভাবিক।’ 

গার্ডার দুর্ঘটনার বিষয়ে শফিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টির তদন্ত চলছে। কার কার দায় আছে, সেটি তারা দেখবে।

ডিজেলচালিত বাস 

বিআরটি প্রকল্প শুরুর দিকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল এই করিডরে ইলেকট্রিক আর্টিকুলেটেড বাস চলাচল করবে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার দিকে এসে বলা হচ্ছে এখনই ইলেকট্রিক বাস চলার ফেসিলিটি রেডি হবে না। তাই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে কর্তৃপক্ষ। ইলেকট্রিক বাসের পরিবর্তে ডিজেলচালিত বাস দিয়েই বিআরটি করিডরে বাস সার্ভিস শুরু হবে। প্রথম দফায় ১৩৭টি ডিজেলচালিত বাস দিয়ে শুরু হবে। তবে পরবর্তী সময়ে ইলেকট্রিক বাসের ফেসিলিটি তৈরি করার পরে ইলেকট্রিক বাস নামানো হবে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিগগিরই ডিজেলচালিত বাস কেনার জন্য টেন্ডার দেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে বাসের স্পেসিফিকেশন ঠিক করে দেয়া হবে, কী ধরনের বাস চলবে এখানে। সে ক্ষেত্রে ১২ মিটারের স্ট্যান্ডার্ড বাস কেনার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। টেন্ডার হওয়ার পরে ছয় মাস সময় লাগবে বাস আসতে। কোন দেশ থেকে কেনা হবে সেটাও চূড়ান্ত হয়নি। তবে ভারত থেকে কেনা হবে না।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘পরিকল্পনার উল্টো পথে হাঁটছে দেশের প্রথম বিআরটি প্রকল্প। এত সময় ও ব্যয়ের পরে পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নমানের একটি বিআরটি করিডর হতে চলেছে।’

কী আছে বিআরটিতে

এ প্রকল্পে সড়ক হবে ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভূমিতে থাকবে ১৬ কিলোমিটার এবং উড়াল সড়ক হবে সাড়ে ৪ কিলোমিটার। টঙ্গীতে ১০ লেন ব্রিজ তৈরি হচ্ছে, ছয়টি ফ্লাইওভার হচ্ছে, এর মধ্যে বিমানবন্দর ফ্লাইওভার ৮১৫ মিটার, জসীমউদ্‌দীন ফ্লাইওভার ৫৮০ মিটার, কুনিয়া ফ্লাইওভার ৫৫০ মিটার, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি ফ্লাইওভার ৫৫০ মিটার, ভোগড়া ফ্লাইওভার ৫৮০ মিটার ও জয়দেবপুর ফ্লাইওভার ২ হাজার ১৪ মিটার। গাজীপুরে একটি বাস ডিপো থাকছে, যার কাজ শতভাগ সম্পন্ন। বিআরটি রুটে মোট স্টেশন থাকবে ২৫টি।

২০১২ সালের ২০ নভেম্বর একনেক সভায় অনুমোদন পায় ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট)। তখন এ প্রজেক্টে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের শেষ দিকে কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে ২০২১ সালেও এই কাজ সমাপ্ত হয়নি। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায়। তবে নতুন নির্ধারিত সময় ২০২২-এর ডিসেম্বরেও শেষ করার কথা রয়েছে।

প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি) ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) অর্থায়ন করছে।