আপডেট : ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ০৮:৩৩
পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে মানুষের কৃপণতা ও অপব্যয়ী চরিত্র
মোহাম্মদ হাননান

পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে মানুষের কৃপণতা ও অপব্যয়ী চরিত্র

কৃপণতা ও অপব্যয়ী চরিত্রের মানুষ

অনেক মানুষই স্বভাবগতভাবে খুব কৃপণ। মানুষ মনে করে জীবনে যা সে কামাই করেছে, নিজের গুণেই তা সে করতে পেরেছে। ফলে সে খরচ করতে চায় না। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে। শয়তানও মানুষকে ভবিষ্যতের ভয় দেখায়, ফলে মানুষ সম্পদ জমা করতে থাকে এবং সঞ্চয়ের পাহাড় গড়ে তোলে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মানুষের এই ‘কার্পণ্য’ বৈশিষ্ট্যকেও পবিত্র কোরআনে এভাবে তুলে ধরেছেন:

১. মানুষ তো বড়ই কৃপণ। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ১৩০)

২. যে অর্থ জমায় এবং বারবার তা গোনে... তাকে ফেলা হবে হুতামায়। (সূরা হুমাজা, আয়াত ১০৪)

৩. যে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়, আর দান করে সামান্যই, সে তো পাষাণ হৃদয়ের (মানুষ)। (সূরা নাজম, আয়াত ৩৩-৩৪)

৪. যে (মানুষেরা) অপব্যয় করে তারা তো শয়তানের ভাই।... (কৃপণের) মতো তোমার হাত যেন গলায় বাঁধা না থাকে...। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৬-২৯)

৫. ... যে (মানুষ) সম্পদ জমা করে এবং আঁকড়ে ধরে রাখবে...জাহান্নাম সে মানুষকে ডাকবে। (সূরা মাআরিজ, আয়াত ১৭-১৮)

৬. মানুষ যে ধন-সম্পদ নিয়ে কৃপণতা করে কেয়ামতের দিন সেই ধন-সম্পদই তার গলায় ফাঁস হবে। (সূরা আল-ই-ইমরান, আয়াত ১৮০)

৭. যে মানুষ কৃপণতা করে এবং মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয়, ... তারা জেনে রাখুক আল্লাহ তাআলা অভাব থেকে মুক্ত। (সূরা হাদিদ, আয়াত ২৩-২৪)

৮. যে (মানুষেরা) কৃপণতা করে তারা আসলে নিজেদের ওপরই কৃপণতা করে। (সূরা মুহাম্মদ, আয়াত ৩৮)

৯. (মানুষের মধ্যে) তারাই সফলকাম, যাদের মধ্যে কৃপণতা নেই। (সূরা তাগাবুন, আয়াত ১৬)

১০. বুদ্ধিজীবী ও সন্ন্যাসী যারা মানুষের ধন অন্যায়ভাবে ভোগ করে এবং মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। সোনা-রূপা জমা করে আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। (সূরা তওবা, আয়াত ৩৪)

যেসব মানুষ অকৃতজ্ঞ

আল্লাহ মানুষ থেকে কী আশা করেন! আল্লাহ আশা করেন যে, মানুষ সব সময় আল্লাহর শুকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) আদায় করবে। এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি আয়াত আছে-

১. আর আল্লাহ তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমন অবস্থায় বের করেছেন যে, তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের শোনার জন্য কান দিয়েছেন, দেখার জন্য চোখ দিয়েছেন এবং তোমাদের দিয়েছেন একটি দিল, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা বা শোকর প্রকাশ করতে পার। (সূরা নাহল, আয়াত ৭৮)

২. আর তিনি তোমাদের দিয়েছেন চোখ, কান ও হৃদয়। তোমরা (মানুষেরা) এর জন্য খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সূরা সাজদা, আয়াত ৯)

৩. আর আমি তো তোমাদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তার মধ্যে তোমাদের জীবিকার ব্যবস্থাও করেছি। তোমরা খুব অল্পই কৃতজ্ঞতা আদায় কর। (সুরা আরাফ, আয়াত ১০)

৪. তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের কান, চোখ ও মন দিয়েছেন, (অথচ) তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো। (সূরা মুমিনুন, আয়াত ৭৮)

৫. তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন আর তোমাদের দিয়েছেন দেখা ও শোনার শক্তি এবং একটি অন্তর। অথচ তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সূরা মুলক, আয়াত ২৩)

৬. তুমি কি তাদের দেখনি, যারা মৃত্যুভয়ে হাজারে হাজারে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ...পরে তিনি (আল্লাহ) তাদের জীবিত করেছিলেন। আল্লাহ (সব সময়) মানুষকে অনুগ্রহ করে থাকেন। অথচ মানুষদের মধ্যে অনেকেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। (সূরা বাকারা, আয়াত ২৪৩)

৭. যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা বানায়, কেয়ামতের দিন সম্পর্কে তারা কী জানে? আল্লাহ তো মানুষকে অনুগ্রহই করেন। কিন্তু মানুষের বেশির ভাগই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। (সূরা ইউনুস, আয়াত ৬০)

এই আয়াতগুলো অনেকটা ইতিবাচক শব্দ হিসেবে পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে। আবার ইতিবাচক ও নেতিবাচকের মাঝামাঝিও অনেক আয়াত এ বিষয়ে রয়েছে। যেমন-

১. আমি তাকে (মানুষকে) পথের নির্দেশ দিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে। (সূরা দাহর, আয়াত ২-৩)

২. ... তিনি (আল্লাহ) তোমাদের তার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারেন। প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। (সূরা লোকমান, আয়াত ৩১-৩২)

৩. ... আল্লাহ কি কৃতজ্ঞ লোকদের সম্বন্ধে ভালো করে জানেন না? (সূরা আনআম, আয়াত ৫৩)

তবে পবিত্র কোরআনে মানুষের ‘শুকরিয়া’ চরিত্র বিষয়ে বেশির ভাগই নেতিবাচক, অর্থাৎ মানুষ যে ‘অকৃতজ্ঞ’ চরিত্রের সেই ভাষ্যটিই বেশি ফুটে উঠেছে-

১. মানুষ তো তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ। (সূরা আদিয়াত, আয়াত ২)

২. নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল। কিন্তু (মানুষের) অধিকাংশই অকৃতজ্ঞ। (সূরা নমল, আয়াত ৭৩)

৩. মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৬৭)

৪. যদি আমি মানুষকে আমার দয়া দেখাই এবং পরে (কখনো) এই দয়া থেকে বঞ্চিত থাকে, তখনই সে হতাশ ও অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে। (সূরা হুদ, আয়াত ৯)

৫. আমি (আল্লাহ) যখন মানুষকে দয়া দেখাই তখন সে খুব আনন্দিত হয়ে পড়ে। আর যখন নিজের কৃতকর্মে তার বিপদ ঘটে, তখন মানুষ হয়ে পড়ে অকৃতজ্ঞ। (সূরা শূরা, আয়াত ৪৮)

৬. মানুষ (আল্লাহর) বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে তার (আল্লাহর সত্তার) অংশ গণ্য করে থাকে। মানুষ তো স্পষ্টই অকৃতজ্ঞ। (সূরা জুখরুফ, আয়াত ১৫)

৭. তিনি (আল্লাহই) তো তোমাদের জীবনদান করেছেন। তারপর তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আবার তিনিই তোমাদের জীবিত করবেন। মানুষ খুবই অকৃতজ্ঞ। (সূরা হজ্জ, আয়াত ৬৬)

অকৃতজ্ঞ মানুষের জন্য বার্তা

মানুষ আল্লাহর অনুগ্রহের পরও অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়লে আল্লাহর মনোবেদনার কারণ ঘটে। তখন তার জন্য রয়েছে আল্লাহর কাছ থেকে সমূহ বঞ্চনা, শাস্তি এবং গজব। আল্লাহ বলছেন-

১. আমি অকৃতজ্ঞ ছাড়া আর কাউকে শাস্তি দিই না। (সূরা সাবা, আয়াত ১৭)

২. তোমরা (মানুষেরা) অকৃতজ্ঞ হলে জেনে রাখো, আল্লাহ কারও মুখাপেক্ষী নন। তিনি তার বান্দাদের অকৃতজ্ঞতাকে পছন্দ করেন না। (সূরা জুমার, আয়াত ৭)

৩. মনে রেখো ... তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের প্রতি নেয়ামত আরও বাড়বে, আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠিন। (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত ৭)

৪. ... তোমাদের যা প্রয়োজন তিনি (আল্লাহ) তোমাদের তা দিয়েছেন। তোমরা আল্লাহর দানকে গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। অকৃতজ্ঞ মানুষ অতিমাত্রায় সীমালঙ্ঘনকারী। (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত ৩৪)

৫. আল্লাহ বিশ্বাসীদের রক্ষা করেন। তিনি কোনো বিশ্বাসঘাতক অকৃতজ্ঞকে ভালোবাসেন না। (সূরা হজ্জ, আয়াত ৩৮)

৬. মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেয়া হবে? সে কি স্খলিত শুক্র বিন্দু ছিল না? (সূরা কিয়ামা, আয়াত ৩৬)

৭. তোমরা (মানুষেরা) কি মনে কর যে, আল্লাহ তোমাদের এমনি ছেড়ে দেবেন। (সূরা তওবা, আয়াত ১৬)

৮. সে (মানুষ) কি মনে করে যে, কেউ কখনো তাকে কাবু করতে পারবে না? ... সে কি মনে করে যে, তাকে কেউ দেখেনি? আমি তাকে কি দুটো চোখ, জিহ্বা আর ঠোঁট দিইনি?... দুটো পথই কি আমি তাকে দেখাইনি? (সূরা বালাদ, আয়াত ৬-১১)

৯. যারা মন্দ কাজ করে তারা কি মনে করে যে, তারা আমার আয়ত্তের বাইরে থেকে যাবে? (সূরা আনকাবুত, আয়াত ৪)

১০. ... মানুষ তা-ই পায়, যা সে করে। তার কাজের পরীক্ষা হবে, তারপর তাকে পুরো প্রতিদান দেয়া হবে। (সূরা নাজম, আয়াত ৩৯-৪১)

এরপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সরাসরি শাস্তির প্রকৃতি কী হবে তাও মানুষকে জানান দিয়ে রাখছেন। আল্লাহ বলছেন-

১. আমি অকৃতজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি শেকল, বেড়ি এবং লেলিহান আগুনের শিখা। (সূরা দাহর, আয়াত ৩)

২. অকৃতজ্ঞ অবস্থায় তুমি কিছুকাল জীবন উপভোগ করে নাও, তুমি হবে একজন জাহান্নামি। (সূরা জুমার, আয়াত ৮)

৩. ... তোমাদের একদল প্রতিপালকের শিরক করে, ... ভোগ করে নাও, শিগগিরই জানতে পারবে। (সূরা নাহল, আয়াত ৫৫)

৪. ... এভাবে আমি অপরাধী সম্প্রদায়কে প্রতিফল দিয়ে থাকি। (সূরা ইউনুস, আয়াত ১৪)

৫. (সে) মানুষ ধ্বংস হোক, যে এত অকৃতজ্ঞ। (সূরা আবাসা, আয়াত ১৭)

লেখক: ইতিহাসবিষয়ক গবেষক ও কলামিস্ট