আপডেট : ২৭ আগস্ট, ২০২২ ০৯:৪৯
জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

তার এক হাতে ছিল রণতূর্য, আরেক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী। কবিতার পঙ্‌ক্তিতে বিদ্রোহের ঝংকার তুলে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারকে, ছড়িয়েছেন প্রেমের বার্তাও। জাত-পাত আর বৈষয়িক ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার জয়গান আর সাম্যের বাণীই ছিল তার রচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আজ ১২ ভাদ্র, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো সেই মহান পুরুষ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের এই দিনে ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক দৃপ্ত কণ্ঠস্বর কাজী নজরুল ইসলাম। মানুষের প্রতি, মানবতার প্রতি অন্যায়-অনিয়ম আর বঞ্চনায় যে রক্তক্ষরণ, সেগুলোই তীব্র প্রতিবাদ হয়ে ঝরেছে তার লেখনীতে। ব্রিটিশরাজ তখন ক্ষমতায়, তার বিরুদ্ধেও সমান সোচ্চার নজরুলের কলম। তাই বারবার শোষকের কোপানলে পড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন কারাগারে। কিন্তু আপসহীনতার আদর্শে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি, প্রতিবারই ফিরে এসেছেন আপন মহিমায়।

দ্রোহের সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের সাহিত্যে সমানভাবে মিশে আছে সাম্য ও মানবতাবাদ। মানুষে মানুষে সাম্যের বাণী ছড়িয়েছেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে ছন্নছাড়া এই চিরতরুণের বুকের ভেতরে এক কোমল হৃদয়ের বসবাসও ছিল, অভিমান আর আবেগ তাতে জলসিঞ্চন করত। প্রেমের অপরূপ বাণী তাই নিঃসৃত হয়েছে তার কলম থেকেই।

বিদ্রোহী কবি হিসেবেই কাজী নজরুলের পরিচিতি তার সব পরিচয়কে ছাপিয়ে গিয়েছে। তারপরও সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা- এমন অসংখ্য পরিচয়ের প্রতিটিতেই স্বমহিমায় ভাস্বর নজরুল। ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘দোলন চাঁপা’, ‘ছায়ানট’ ইত্যাদি তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। ‘বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘কুহেলিকা’ তার উপন্যাস। ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘শিউলিমালা’ ইত্যাদি তার বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ।

বাংলা গানেও নজরুলের অবদান অনন্য। অসংখ্য রাগ-রাগিণী সৃজন করেছেন তিনি, সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা গানের ভাণ্ডারকে। তার লোকজ ধাঁচের গানগুলোতে অপরূপভাবে ফুটে উঠেছে আবহমান বাংলা ও বাংলার মানুষের রং-রূপ-আবেগ-অনুভূতি। লিখেছেন শ্যামা ও কীর্তনাঙ্গের গান, বাংলায় গজল ও ইসলামী গানের ধারার সূচনাও তার হাতেই। তিন হাজারেরও বেশি গানের রচয়িতা নজরুলের কাছে তাই বাংলা গান অনেকখানি ঋণী।

কাজী নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালে ২৫ মে, বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। দারিদ্র্যপীড়িত শৈশব-কৈশোর কাটানো এই কবির পরিচিতি ছিল দুখু মিয়া নামেই। ১৯০৮ সালে বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ১০ বছর বয়সেই উপার্জনে নামতে হয় তাকে। মক্তবের শিক্ষক, মুয়াজ্জিন ও মাজারের খাদেম, লেটোর দলের হয়ে গান বাধা, নাটকে অভিনয় করা- জীবন ও জীবিকার জন্য কী করেননি তিনি! রেলের ইংরেজ গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের কর্মচারী হিসেবেও কাজ করতে হয়েছে। এর মধ্যেই কাজী নজরুলের শিক্ষা জীবন কেটেছে রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে। দারিদ্র্যের কশাঘাত কবিকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করতে দেয়নি। সিয়ারসোল রাজ স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তিনি যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে।

ব্যক্তিজীবনের সব সংগ্রামকে ছাপিয়েই বাউণ্ডুলে-ছন্নছাড়া এক জীবন নিয়েও বাংলা সাহিত্যের আকাশে কাজী নজরুলের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো, তারুণ্যের তেজদীপ্ততায় সবাইকে চমকে দিয়ে। তবে ধূমকেতুর মতো ক্ষণস্থায়ী নয়, ধ্রুবতারার মতো এক স্থায়ী আসন তিনি গড়ে নিয়েছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে, বাংলার মানুষের মন ও মননে।

কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদসংলগ্ন কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, দোয়া মাহফিল এবং আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কবি নজরুল ইনস্টিটিউট এ উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টায় ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এতে প্রধান অতিথি ছিলেন।

জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ শনিবার সকাল ৯টায় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবির সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ফাতেহা পাঠ ও দোয়া মাহফিল হবে। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে।