যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য এলাহি নৈশভোজের আয়োজন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে এই ডিনারের মেন্যু ছিল সম্পূর্ণ নিরামিষ। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশটির প্রেসিডেন্টকে সোনা ও রুপার থালা-বাটি-গ্লাসে খাবার পরিবেশন করা হয়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে গত শুক্রবার নয়াদিল্লিতে পৌঁছান বাইডেন। ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভি কে সিং দিল্লি বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান। তার পরই লোককল্যাণ মার্গে মোদির বাসভবনে পৌঁছান বাইডেন। শনিবারের জি-২০ সম্মেলনের আগেই মোদির সঙ্গে তিনি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক সারেন। নিজের বাসভবনে বাইডেনের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করেন মোদি।
বাইডেনের জন্য আয়োজিত এই বিশেষ ডিনার মেন্যুতে প্রাধান্য পেয়েছে বাজরার তৈরি খাবার। এ ছাড়া ছিল বাংলা, বিহারের নানাবিধ সুস্বাদু খাবার। বাইডেনকে কেবল নিরামিষ খাবার খেতে দেয়ার কারণ হিসেবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি নিরামিষাশী। আর সে কারণেই মোদির বাসভবনে ডিনারের মেন্যুতে বিশেষ নিরামিষ খাবারের আয়োজন করা হয়।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে মোদি ও বাইডেনকে খোশমেজাজে আলোচনা করতে দেখা যায়। বাইডেনকে স্বাগত জানানোর জন্য মোদি নিজেই বাসভবনের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। বাইডেন গাড়ি থেকে নামতেই দুজনে হাত মিলিয়ে একে অন্যকে সম্বোধন করেন। তারপর হাঁটতে হাঁটতে এক অন্যের কাঁধে হাত দিয়ে তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা যায়। বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক সেরে রাতেই এক্স হ্যান্ডেলে মোদি নিজেদের ছবি পোস্ট করেন। সেই সঙ্গে লেখেন, ‘বিশ্বের সার্বিক উন্নয়নে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে মেলবন্ধন বাড়ানো নিয়েও আমাদের কথা হয়েছে।’
জি-২০ ডিনারে কী কী থাকছে?
এদিকে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের রসনাতৃপ্তির ভার নিয়েছে দিল্লির বিলাসবহুল হোটেলের ৭০০-র বেশি শেফ। সরকারি সূত্রের দাবি, বিদেশি অতিথিদের পছন্দের কথা মাথায় রেখে সব মিলিয়ে সাড়ে তিন হাজারের বেশি পদ তৈরি করা হচ্ছে। এর মধ্যে ভারতীয় পরম্পরায় তৈরি খাবার যেমন থাকছে, তেমনই থাকছে পশ্চিমি ডিশও। দক্ষিণ ভারতের ইডলি-দোসা-উত্তপম, নারকেল তেল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পদ, কাশ্মীর আর লক্ষনৌয়ের নবাবি কাবাব, পাঞ্জাবের সরষো দা শাগ-মক্কিদা রোটি, মালাই দেয়া লস্যির সঙ্গে থাকছে বাংলার সরষে ভাপা পদ্মার ইলিশ আর ডাব-চিংড়ি। এর সঙ্গে থাকছে মিলেট, রাগি, বাজরার রুটিও। মিষ্টির আইটেম থাকছে কয়েক শ, যার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে বাংলার সুস্বাদু রসগোল্লা, নারকেল নাড়ুও। মেন্যুতে থাকছে সবার পছন্দের রাশিয়ান সালাদও।
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘাত ক্রমশই তীব্রতর হচ্ছে। হামলা ও পাল্টা হামলা যেন এক মুহূর্তের জন্যও থেমে নেই। রাতভর দুই পক্ষই নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে থাকে। এতে বেসামরিক লোকজন নিহত ও আহত হচ্ছেন।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আইআরএনএ জানিয়েছে, পশ্চিম ইরানের কেরমানশাহ শহরে ফারাবি হাসপাতাল ও মেডিকেল সেন্টারকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। এর ফলে হাসপাতালটি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
গতকাল সোমবার এক প্রতিবেদনে আইআরএনএ জানায়, স্থানীয় সময় সকাল ৯টার দিকে ইহুদিবাদী সরকার ফারাবি হাসপাতাল ও মেডিকেল সেন্টার এবং আশেপাশের ভবনগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এই হামলার পর ফারাবি হাসপাতালের বিভিন্ন অংশে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।
ছবিতে দেখা গেছে, হাসপাতালের ভেতরে রক্তাক্ত মেঝেতে ভাঙা কাঁচ এবং ধ্বংসাবশেষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
এছাড়া ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। কিছুক্ষণ আগে এই হামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে আল-জাজিরা। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সংক্ষেপে প্রচারিত ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বর্তমানে ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্যবস্তু।’ হামলার বিস্তারিত বা ক্ষয়ক্ষতির তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ধ্বংস করার ঘোষণা দিয়ে ইসরায়েল যে হামলাগুলো চালাচ্ছে, তার ফলে চার দিনে তেহরানে কমপক্ষে ২২৪ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৯০ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক।
এদিকে গতকাল সোমবার ইরান ইসরায়েলে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। গতকাল সকালে চালানো ইরানের হামলাকে বলা হচ্ছে এ পর্যন্ত চালানো হামলার মধ্যে সবচেয়ে তীব্র এবং বড় আকারের। ইরানের সর্বশেষ এ হামলায় অন্তত ৮ জন নিহত এবং বহু আহত হয়েছেন।
চলমান পরিস্থিতি ‘নিরাপদে’ থাকতে অভ্যস্ত তেল আবিবের বাসিন্দাদের এক নজিরবিহীন আতঙ্ক ও উদ্বেগে দিন কাটাতে বাধ্য করেছে। গতকাল সিএনএনের প্রতিবেদনে ইসরায়েলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর তেল আবিবের এই চিত্র ফুটে উঠেছে।
সর্বত্র বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি লক্ষ্য করেন সিএনএনের জেরুজালেম সংবাদদাতা জেরেমি ডায়মন্ড। জেরেমি জানান, তিনি তেল আবিবের রাস্তাগুলোতে ভেঙে পড়া স্থাপনা ও অন্যান্য আবর্জনা দেখতে পেয়েছেন। একটি অবস্থানে চারটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার পর সেখানে উদ্ধারকারী দল ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ধ্বংসস্তূপের ভেতর আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে ব্যস্ত ছিলেন।
এ সময় এক নারী জানান, ঘরের বেসমেন্টে লুকিয়ে থেকে প্রাণে বেঁচে গেছেন তিনি ও তার পরিবার। তবে মাটির নিচের বেসমেন্টে থেকেও ‘ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রভাব’ টের পাওয়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন ওই নারী।
তিনি আরও বলেন, ‘পোড়া ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছিলাম…আমি টি-শার্ট দিয়ে নিজের নাক ঢেকে রাখতে বাধ্য হই। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল রাখছিলাম যাতে নিঃশ্বাসের সঙ্গে ওই ধোঁয়া ফুসফুসে ঢুকে না যায়।’
জানা গেছে, ইসরায়েলের উপর সর্বশেষ ইরানি হামলায় নিহত আটজনের মধ্যে দুইজন নারী। তিনজন পুরুষ এবং উত্তরাঞ্চলীয় হাইফা শহরে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আরও তিনজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, সোমবার ইরানের সর্বশেষ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের কয়েকটি স্থান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানকার দমকল বাহিনী জানিয়েছে, ভূমধ্যসাগর উপকূলে একটি আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
সাধারণ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার ঠিক পরপরই সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানায়, হোমফ্রন্ট কমান্ড সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ টিমগুলোকে ইসরায়েলের এসব ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে পাঠানো হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস বলেছে, উদ্ধারকর্মীরা উপকূলবর্তী একটি ভবনের দিকে যাচ্ছেন, যেটি সরাসরি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।
ইসরায়েলের জরুরি সেবা সংস্থা, মাগেন ডেভিড আদম- এমডিএ একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে তাদের দল উপকূলীয় শহর হাইফাতে মোতায়েন রয়েছে এবং সেখানে কয়েকটি গাড়িতে আগুন লেগেছে এবং একটি আবাসিক ভবনের সামনের অংশ বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ডস কর্পসের (আইআরজিসি) একজন সিনিয়র কমান্ডার বলেছেন, অপারেশন ‘ট্রু প্রমিজ ৩’-এর মাধ্যমে ইসরায়েলি শাসনব্যবস্থার ওপর যে ক্ষতি হয়েছে, তা শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি।
গতকাল সোমবার মেহের নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, এক সাক্ষাৎকারে আইআরজিসির রাজনৈতিকবিষয়ক ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াদোল্লাহ জাভানি বলেন, শত্রুদের প্রাথমিক আক্রমণের প্রায় ২০ ঘণ্টা পর অপারেশন ‘ট্রু প্রমিজ ৩’ পরিচালিত হয়, যখন ইহুদিবাদী সরকার প্রতিরক্ষামূলক প্রস্তুতির শীর্ষে ছিল। ইরানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার পূর্বাভাস পেয়ে তারা তাদের সমস্ত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করে এবং এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে।
সংঘাত বন্ধে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত পুতিন-এরদোয়ান
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি বন্ধে মধ্যস্থতা করার আগ্রহ দেখিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইপ এরদোয়ান। উভয়ই আলাদাভাবে জানিয়েছেন, সংঘাত বন্ধের লক্ষ্যে তারা মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত রয়েছেন।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ‘সংঘাত নিরসনের জন্য রাশিয়ার আগের প্রস্তাব এখনও বহাল রয়েছে। যদিও পরিস্থিতি এখন আরও জটিল হয়ে পড়েছে।’
সমস্যার সমাধানে রাশিয়া বিবাদমান পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বলেও জানিয়েছে ক্রেমলিন।
এদিকে, তুরস্কের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল সোমবার রেচেপ তাইপ এরদোয়ান ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন।
ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের অবসান ঘটাতে তুরস্ক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনে প্রস্তুত বলে ইরানকে জানিয়েছেন এরদোয়ান।
তেহরান থেকে সরে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ
দখলদার ইসরায়েলের হামলার জেরে ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে সরে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, তেহরানের পেট্রোল স্টেশনগুলোতে লম্বা লাইন তৈরি হয়েছে। অনেক মানুষ শহর ছেড়ে আরও প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু তেহরান থেকে বের হওয়ার রাস্তায় ব্যাপক ট্রাফিক জ্যাম থাকায় অনেকেই যেতে পারেননি।
তেহরান থেকে অন্য একটি প্রদেশে চলে যাওয়া এক ব্যক্তি বিবিসি পার্সিয়ানকে বলেছেন, ‘আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না আমি এখন যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। আমি জানি না কখন আমি এর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই যুদ্ধ আমার যুদ্ধ নয়। আমি অন্য পক্ষেরও না। আমি শুধুমাত্র আমার পরিবারকে নিয়ে বাঁচতে চাই।’
অপর একজন বলেছেন, ‘কোনো না কোনোভাবে সবাই তেহরান থেকে পালানোর চেষ্টা করছে।’
আরেকজন বলেছেন, ‘তেহরান সত্যিই নিরাপদ নয়। ইসরায়েলি হামলা সম্পর্কে আমরা সরকার থেকে কোনো সতর্কতা বা বার্তা পাই না। আমরা শুধুমাত্র বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই এবং আশা করতে থাকি যেন আমাদের জায়গায় যেন কোনো হামলা না হয়। কিন্তু আমরা কোথায় যাব? কোনো জায়গাই নিরাপদ নয়।’
বিবিসি পার্সিয়ানের সাংবাদিক গোনচেহ হাবিবিয়াজাদ জানিয়েছেন, তেহরানের বাসিন্দারা বিভিন্ন ম্যাসেজিং অ্যাপে গ্রুপ খুলেছেন। তারা একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় করে রাজধানী ছাড়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেছেন, যারা তেহরান ছাড়ার চেষ্টা করছেন তাদের ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কেও এসব গ্রুপে সতর্ক করা হচ্ছে।
তেহরানের আকাশসীমা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দাবি ইসরায়েলের
ইরানের রাজধানী তেহরানের আকাশসীমায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি করেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে আইডিএফ মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন এই দাবি করেন।
আইডিএফ মুখপাত্র বলেন, আমরা তেহরানের ওপর পূর্ণ বিমান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছি। ইরানের এক-তৃতীয়াংশ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের বড় অংশের হামলা ব্যাহত করা সম্ভব হয়েছে।
ডেফরিন জানান, গত রোববার রাত ও সোমবার ভোরে ইরান থেকে ইসরায়েলের দিকে দুই ধাপে ৬৫টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ডজনখানেক ড্রোন ছোড়া হয়। এর বেশিরভাগই মাঝপথে ভূপাতিত হলেও তিনটির আঘাতে আটজন নিহত হন।
আইডিএফ মুখপাত্রের দাবি, ইরান ওই রাতে এর দ্বিগুণ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পরিকল্পনা করেছিল। তবে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী আগেভাগেই ইরানের অভ্যন্তরে ২০টি ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্য করে হামলা চালায়। সেগুলো তখনও ছোড়া হয়নি।
আইডিএফ আরও জানায়, প্রায় ৫০টি যুদ্ধবিমান ও ড্রোন একযোগে অভিযান চালিয়ে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র গুদাম, নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ও সেনাদের অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এর মধ্যে অনেকগুলো নিশানা ছিল ইরানের ইস্পাহান শহরে। সেখানেও শতাধিক সামরিক স্থাপনায় হামলা হয়েছে বলে জানায় ইসরায়েলি বাহিনী।
দ্বিতীয় মেয়াদে গত জানুয়ারিতে শপথ নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ‘সব যুদ্ধ বন্ধের’ পক্ষে থাকবেন এবং একজন ‘শান্তির দূত ও ঐক্য প্রতিষ্ঠাকারী’ হিসেবে নিজের উত্তরাধিকার রেখে যাবেন।
কিন্তু মাত্র ছয় মাসের মাথায় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছোড়া শুরু হয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র। গত শুক্রবার ভোরে ইরানে ইসরায়েলি হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে—এমন এক সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকেও এটি সংঘাতে টেনে নিতে পারে।
ইসরায়েলের ওই হামলাকে ট্রাম্প প্রায় প্রকাশ্যেই সমর্থন জানিয়েছেন। ফলে নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার তার প্রতিশ্রুতিই এখন সবচেয়ে বড় পরীক্ষার সম্মুখীন।
ট্রাম্পের এ সমর্থন তার অনুগত রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে, যাদের অনেকে ডানপিন্থি রাজনীতিক ও ভাষ্যকার, বিভক্ত করে ফেলেছে। তারা মনে করছেন, ইসরায়েলকে বিনা প্রশ্নে সমর্থন দেওয়া প্রকৃতপক্ষে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির পরিপন্থি। অথচ ট্রাম্পের মূল নির্বাচনী স্লোগান ছিল এটি।
আন্তর্জাতিক কূটনীতিবিষয়ক মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী সহসভাপতি ত্রিতা পারসি বলেন, ‘আমেরিকা ফার্স্ট ঘাঁটির (এ নীতির সমর্থক গোষ্ঠী) অনেক অংশে এখন প্রবল ক্ষোভ ও বিশ্বাসঘাতকতার অনুভূতি বিরাজ করছে। কারণ, তারা সত্যিকার অর্থেই যুক্তরাষ্ট্রকে আর কোনো যুদ্ধে জড়িয় পড়া বা তাতে সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি দেখতে চায় না।’
ত্রিতা পারসি আরও বলেন, ‘তারা (এ গোষ্ঠী) এখন ইসরায়েল নিয়ে ব্যাপক সংশয়ের মধ্যে পড়েছে। তারা মনে করে, এ ধরনের যুদ্ধই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টদের ব্যর্থ ও তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকারগুলো ক্ষুণ্ন করেছে।’
ইরানে গত শুক্রবার ইসরায়েলি হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন রক্ষণশীল নেতাও এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যেন এমন কোনো যুদ্ধে না জড়ায়, যা তার স্বার্থ রক্ষা করবে না।
ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (এমএজিএ) আন্দোলনের বড় মুখ ও প্রভাবশালী রক্ষণশীল ভাষ্যকার টাকার কার্লসন বলেন, ইসরায়েলের বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘যুদ্ধপিপাসু সরকার’কে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেওয়া উচিত নয়।
‘ইসরায়েল চাইলে যুদ্ধ করতেই পারে। ওটা স্বাধীন রাষ্ট্র। তারা যা খুশি করতে পারে। কিন্তু সেটা যেন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে না হয়,’ গত শুক্রবার ‘টাকার কার্লসন নেটওয়ার্ক’–এর সকালের নিউজলেটারে লেখা হয়।
নিউজলেটারে আরও বলা হয়, ইরানের সঙ্গে (যুক্তরাষ্ট্রের) যুদ্ধ হলে তা ‘পরবর্তী প্রজন্মের সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিতে পারে’ কিংবা একটি বিদেশি এজেন্ডার নামে হাজার হাজার মার্কিনের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
‘এ কথা বলাই বাহুল্য যে এ ধরনের কোনো সম্ভাবনাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভজনক হবে না। কিন্তু অন্য একটি পথও আছে: ইসরায়েলকে বাদ দাও। ওরা নিজেরা যুদ্ধ করুক,’ লেখা হয় নিউজলেটারে।
রিপাবলিকান সিনেটর র্যান্ড পলও ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানো নিয়ে সতর্ক করেছেন এবং ওয়াশিংটনের যুদ্ধ–সমর্থক রক্ষণশীলদের কঠোর সমালোচনা করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে র্যান্ড পল লিখেছেন, ‘মার্কিন জনগণ যে যুদ্ধের শেষ নেই, তার ঘোরবিরোধী এবং ২০২৪ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে তাঁরা সেটাই দেখিয়েছেন।’
‘আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অনুরোধ করব যেন তিনি তার অবস্থানে অটল থাকেন, যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দেন এবং অন্য দেশের মধ্যে চলা কোনো যুদ্ধে জড়িত না হন,’ বলেন র্যান্ড পল।
ডানপন্থী কংগ্রেস সদস্য মারজোরি টেলর গ্রিনও একটি বার্তায় ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি হামলার পক্ষে নন। এর আগেও তিনি ট্রাম্পকে সতর্ক করেছিলেন, তেহরান পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হচ্ছে—এমন ইসরায়েলি অভিযোগের ভিত্তিতে যেন ইরানে হামলা চালানো না হয়।
মারজোরি টেলর এক্সে লেখেন, ‘আমি শান্তির জন্য প্রার্থনা করছি। শান্তি। এটাই আমার আনুষ্ঠানিক অবস্থান।’
যদিও ইসরায়েলের সমর্থকেরা ইরানের সম্ভাব্য পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির হুমকির কথা উল্লেখ করে দেশটিতে হামলাকে যৌক্তিক বলে দাবি করছেন; তেহরান বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এমনকি ট্রাম্পের গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ডও গত মার্চে এক সাক্ষ্যে বলেছেন, ‘আমাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে না।’
ইসরায়েলের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে পরিচিত রিপাবলিকান কর্মী ও ভাষ্যকার চার্লি কার্কও ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানো নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
নিজ পডকাস্টে কার্ক বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমাদের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ ঘাঁটি কোনো যুদ্ধই চায় না। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা চায় না (ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে)। তারা চায় না যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়িয়ে পড়ুক।’
গত শুক্রবার ইসরায়েল যখন ইরানের সামরিক ঘাঁটি, পারমাণবিক স্থাপনা ও আবাসিক এলাকায় বোমাবর্ষণ শুরু করে, তার কয়েক ঘণ্টা আগেই ট্রাম্প বলেছিলেন, তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে তিনি আগ্রহী।
গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, ‘বিষয়টা খুবই সহজ। জটিল কিছু না। ইরান পারমাণবিক অস্ত্র রাখতে পারে না—এই একটাই কথা। তার বাইরে আমি চাই, তারা সফল হোক। আমরা সাহায্য করব।’
গতকাল রোববার ওমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ে ষষ্ঠ দফা আলোচনা হওয়ার কথা ছিল।
তবে শুক্রবার ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, তিনি আগেই ইসরায়েলের হামলার ব্যাপারে জানতেন। অবশ্য তিনি হামলা চালাতে ইসরায়েলকে নিষেধ করেছিলেন কি না, তা বলেননি। যদিও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ইসরায়েলের হামলাকে ‘একতরফা’ বলেই উল্লেখ করেছেন।
অথচ ট্রাম্প ইরানের ওপর হামলার দায় চাপিয়ে বলেন, দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য তার আহ্বানে ইরানের কর্মকর্তাদের সাড়া দেওয়া উচিত ছিল।
ট্রাম্প পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘আমি আগেই বলেছিলাম, তাদের জন্য এটা হবে এমন কিছু, যা তারা কল্পনাও করতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও জীবনঘাতী সামরিক সরঞ্জাম—অনেক অনেক বেশি। আর ইসরায়েলের কাছে এর অনেক কিছুই আছে, আরও আসছে।’
ত্রিতা পারসি বলেন, শুরুতে ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে সমঝোতা চেয়েছিলেন, কিন্তু তার চরম শর্ত—ইরানকে সম্পূর্ণভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করতে হবে—আলোচনায় অচলাবস্থা তৈরি করে।
‘এটা অনুমেয় ছিল যে এ চূড়ান্ত দাবির ফলে আলোচনা ব্যর্থ হবে। ইসরায়েল সেই ব্যর্থতাকে কাজে লাগিয়ে ট্রাম্পকে সামরিক পথ বেছে নিতে বাধ্য করেছে,’ বলেন ত্রিতা পারসি।
পারসি আরও বলেন, ‘গত সপ্তাহজুড়ে ট্রাম্প কূটনৈতিক উদ্যোগের পক্ষে কথা বললেও, তিনি জানতেন ইসরায়েলের হামলা আসন্ন। এভাবে তিনি সবাইকে ভুল বার্তা দিয়েছেন যে হামলা হবে আলোচনার পরে। অথচ সেটা আগেই হয়েছে।’
ইসরায়েলের হামলার পর কংগ্রেসে কিছুটা সমালোচনা হলেও বহু রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট এই হামলার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্পের ঘাঁটির একটি বড় অংশ, বিশেষ করে তরুণ ডানপনন্থিরা, ইসরায়েলকে অন্ধ সমর্থনের বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্যাটো ইনস্টিটিউটের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক জন হফম্যান বলেন, ‘তারা (ডানপন্থিরা) রিপাবলিকান পার্টির একটি উল্লেখযোগ্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, বিশেষত তরুণদের মধ্যে।’
হফম্যান আরও বলেন, ‘পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপ বলছে, ৫০ বছরের নিচের অর্ধেক রিপাবলিকানই এখন ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এই নিরন্তর যুদ্ধক্লান্তির মধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছেন।’
বিশ্লেষকদের মতে, ইরানে ইসরায়েলি হামলার প্রতি ট্রাম্পের নমনীয় অবস্থান তাঁকে আবারও এমন একটি সংকটের মুখে ফেলেছে, যেটা একসময় বুশ প্রশাসনকে ফেলেছিল।
হফম্যান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং রিপাবলিকান পার্টির অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কামনা করা প্রভাবশালীদের উপস্থিতি, যেমন লিন্ডসে গ্রাহাম—এসবই বড় ঝুঁকির সৃষ্টি করছে।’
‘এ পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার আশঙ্কা অনেক বেশি,’ বলেন হফম্যান।
সূত্র: আল জাজিরা
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছে। ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। এটিই এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে। বৈশ্বিক জ্বালানি পরিবহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথ বন্ধ হয়ে গেলে সম্ভাব্য ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ন্যাশনাল ইরানিয়ান আমেরিকান কাউন্সিলের (এনআইএসি) প্রেসিডেন্ট জামাল আবদি এই হুমকিকে ইরানের ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জামাল আবদি বলেন, ‘এটি প্রতিরোধের একটি প্রধান রূপ হতে পারে। অবশ্য ইরান আগেও এ ধরনের হুমকি দিয়েছে। কিন্তু স্পষ্টতই কখনো কার্যকর করেনি। ধারণা করা হয়, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়া মানে বিশ্ব অর্থনীতির শ্বাসরোধ করা। অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এটি খুব ছোট একটা জলপথ, তাই এটিকে একটি চোকপয়েন্ট বানানোর জন্য যে ধরনের সক্ষমতা ও আক্রমণ দরকার, ইরানের পক্ষে সম্ভবত তা সম্ভব।’
আবদি আরও বলেন, ‘আমরা বছরের পর বছর ধরে যে খারাপ ব্যাপারগুলোর বিষয়ে সতর্ক করে আসছি, এই যুদ্ধ কেমন হতে পারে সেগুলোর একটি চেকলিস্ট এখন বাস্তবে রূপ নিতে দেখছি। হরমুজ প্রণালির বিষয়টি, আমি মনে করি, এমন একটি পদক্ষেপ হবে যা অনেক বিশ্বনেতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনে এই ধারণা তৈরি করবে যে, 'ঠিক আছে, এখন আপনাদের ইরানিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলিদের সহায়তায় নামতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এতে তেলের দাম আকাশচুম্বী হবে এবং বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি আরও প্রকট হবে। যেখানে ইসরায়েল, ইরানে হামলার পরই বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে।
হরমুজ প্রণালি বন্ধে ইরানের এই হুমকিকে একটি কৌশলগত চাল হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা আঞ্চলিক সংঘাতের গতিপথ পরিবর্তন করতে চাচ্ছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ছাড় আদায় করারও একটি কৌশল এটি। তবে এই ‘ট্রাম্প কার্ড’ শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি নিয়ে আসে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক এড হিরস আল-জাজিরাকে বলেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর এর দ্রুত এবং মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে হিরস বলেন, ‘এই প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়, যা বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারের প্রায় ২০ শতাংশ। সৌদি আরব বা কুয়েতের জন্য ওই এলাকা থেকে বের হওয়ার কোনো সহজ বিকল্প পথ নেই।’
হিরস ব্যাখ্যা করেন, এই পরিবহন অর্ধেক কমিয়ে দিলে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১২০ ডলারের বেশি বেড়ে যাবে—এই প্রভাব খুব দ্রুত বিশ্বের সবার ওপর পড়বে।
হিরস আরও যোগ করেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলে ট্রাম্প ইরানে হামলা করার একটি অজুহাত পেয়ে যাবেন।
হিরসের মতে, বিশ্ব অর্থনীতিতে আঘাত করা, বৈশ্বিক বাজারে তেলের প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে সরাসরি মার্কিন অর্থনীতিতে আঘাত করা, সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রয়োজনীয় অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।
উল্লেখ্য, ইরানের আইআরআইএনএন সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, ইরানের সংসদের নিরাপত্তা কমিশনের সদস্য ইসমাইল কোসারি বলেছেন, ‘ইসরায়েলের হামলার জবাবে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার বিষয়টি ইরান গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করছে।’
ইসরায়েলে আরও এক দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান, এতে অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন আরও অনেকে। এ হামলার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল-ইরানের চলমান উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে।
স্থানীয় সময় সোমবার (১৬ জুন) ভোরে এই হামলা চালানো হয়। ইসরায়েলের জাতীয় জরুরি সেবার কর্মকর্তা মাগেন দাভিদ আদোম এই হতাহতের খবর নিশ্চিত করেছেন।
এ ছাড়া, এই হামলায় তেল আবিবের মার্কিন দূতাবাসের অবকাঠামোগত সামান্য ক্ষতি হলেও সেখানে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে সামাজিকমাধ্যম এক্সে নিশ্চিত করেছেন মার্কিন দূত মাইক হাকাবি।
এদিকে, ইসরায়েলে প্রায় ১০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার দাবি করেছে তেহরান। ইসরায়েলের চালানো হামলায় ইরানে এ পর্যন্ত ২২৪ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এর জবাবেই ইসরায়েলে হামলার কথা জানিয়েছে তেহরান।
এদিকে, সোমবারের হতাহতের পর ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এই হামলার জবাবে ইরানের কুদস বাহিনীর ১০টি কমান্ড সেন্টার জীবাণুমুক্ত করার জন্য আক্রমণ চালানোর দাবি করেছে তেল আবিব।
কুদস বাহিনী ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ইউনিট, যা বিদেশি অভিযান পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত।
এদিকে, ইরানের হামলায় তেল আবিবের নিকটবর্তী পেতাহ তিকভা শহরে স্থানীয়রা জানান, সেখানে একটি আবাসিক ভবনে সরাসরি আঘাতে কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্ট ও জানালা ভেঙে গেছে।
মাগেন দাভিদ জানান, নিহতদের মধ্যে দুইজন পুরুষ এবং দুইজন বুদ্ধ নারী, সঙ্গে আরও এক ব্যক্তি। এছাড়া আরও ৮৭ জন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে একজন নারী গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন।
এর আগে, ইসরায়েল হামলা অব্যাহত রাখলে কোনো যুদ্ধবিরতির কথা বিবেচনা করবে না বলে আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারী কাতার ও ওমানকে স্পষ্ট জানিয়েছে ইরান। তবে অভিযান আরও কঠিন হবে বলে হুঁশিয়ারি দেয় ইসরায়েল। এর জবাবে ইরানও কঠোর প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তেহরান বলেছে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তারা ‘নরকের দরজা খুলে দেবে’।
এদিকে, ইরানের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে দেশটিতে ইসরায়েলের হামলায় দুই শতাধিক নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অন্তত ১ হাজার ২০০ মানুষ।
শুক্রবার (১৩ জুন) ভোরে রানের রাজধানী তেহরানসহ একাধিক স্থানে হামলা চালায় ইসরায়েল। এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছে রাইজিং লায়ন। এর পর পরই পাল্টা হামলা শুরু করে ইরান।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে ইসরায়েল। ইরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির শেষ ধাপ পর্যন্ত না পৌঁছাতে পারে, তা নিশ্চিত করতেই এই হামলা চালানোর কথা জানিয়েছে তেল আবিব।
তবে এ অভিযানকে সম্পূর্ণরূপে বেসামরিক বলে আখ্যা দিয়েছে ইরান। এ ছাড়া, তেহরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করছে না বলে দাবি করেছে তারা।
গাজায় গণহত্যা বন্ধে ডাচ সরকারকে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে গতকাল হেগ শহরের রাস্তায় লাল পোশাক পরে কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও অক্সফামের মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলো হেগ শহরের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত অভিমুখে এ বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেখানে বিক্ষোভকারীরা সারিবদ্ধ হয়ে প্রতীকী ‘লাল রেখা’ তৈরি করেন।
বিক্ষোভকারীদের অনেকে ফিলিস্তিনি পতাকা উড়িয়ে এবং কেউ কেউ ‘স্টপ দ্য জেনোসাইড’ স্লোগান দিয়ে গতকাল বিকালে শহরের একটি কেন্দ্রীয় পার্কে লাল সমুদ্রে পরিণত করেন।
বিক্ষোভকারীরা ‘দৃষ্টি ফেরাবেন না, কিছু করুন’, ‘কুকর্মে ডাচ সহযোগিতা বন্ধ করুন’ এবং ‘শিশুরা ঘুমানোর সময় নীরব থাকুন, তাদের মৃত্যুর সময় নয়’ ইত্যাদি লেখা ব্যানার প্রদর্শন করেন।
বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজকরা ডাচ সরকারকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
তারা তাদের বক্তব্যে বলেন, গাজার মানুষের অপেক্ষার সময় নেই। গণহত্যা বন্ধ করতে নেদারল্যান্ডসের যথাসাধ্য চেষ্টা করার কর্তব্য রয়েছে। ৬৭ বছর বয়সি ডোডো ভ্যান ডের স্লুইস এএফপিকে বলেন, গণহত্যা থামাতে হবে। যথেষ্ট হয়েছে। আমি আর এটা নিতে পারছি না।
এর আগে ১৮ মে হেগে এক বিক্ষোভে এক লাখেরও বেশি লোক অংশ নেন। আয়োজকরা এটাকে ২০ বছরের মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হিসেবে বর্ণনা করেন।
ইসরায়েলে হামাসের হামলার জের ধরে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে এএফপির হিসাব অনুযায়ী, এই যুদ্ধে ইসরায়েলের ১ হাজার ২১৯ জন নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। হামাস ২৫১ জনকে জিম্মি করেছে, যাদের মধ্যে ৫৪ জন এখনো গাজায় আটক রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মতে, জিম্মিদের মধ্যে ৩২ জন মারা গেছেন।
হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৫৫ হাজার ২০৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। জাতিসংঘ এই পরিসংখ্যানকে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার করা একটি মামলার বিচার চলছে। সেখানে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, ইসরায়েল গাজায় তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে। ইসরায়েল এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
তেহরানের বাংলাদেশ দূতাবাসে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য হটলাইন চালু করা হয়েছে। আজ রোববার (১৫ জুন) তেহরান দূতাবাস এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইরানে বসবাসরত সব বাংলাদেশি নাগরিকের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য দূতাবাস ইমার্জেন্সি হটলাইন স্থাপন করেছে। ইরানে বসবাসরত সব বাংলাদেশি নাগরিকদের নিম্নোক্ত মোবাইলফোন নম্বরগুলোতে হোয়াটসঅ্যাপসহ সরাসরি যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
+ ৯৮৯৯০৮৫৭৭৩৬৮ এবং +৯৮৯১২২০৬৫৭৪৫।
ইরানের ভেতরে একটি গোপন ড্রোন তৈরির কারখানা স্থাপন করেছিল ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। একাধিক গোয়েন্দা সূত্র থেকে এমন দাবি করা হয়েছে। সেখান থেকে পরিচালিত বিস্ফোরক ড্রোন হামলাতেই ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে বলে দাবি তাদের।
ইরানে তখন গভীর রাত। মুহূর্তের মধ্যেই রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে আগুনের ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে ওঠে চারপাশ। এরপরই শুরু হয় ধারাবাহিক হামলা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে বড় হামলার মুখোমুখি হয়েছে ইরান। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংসের জন্য এ অভিযান চালানো হয়।
গোয়েন্দা সূত্র মতে, শুক্রবার (১৪ জুন) ভোরে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) যখন তাদের অপারেশন রাইজিং লায়ন বা জেগে ওঠা সিংহ শুরু করে, তখনই ড্রোনগুলো সক্রিয় করে মোসাদ।
এরপর তারা ইসরায়েলের দিকে তাক করে রাখা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণস্থলগুলোতে হামলা চালিয়ে অকোজো করে দেয়। এতে, ইসরায়েল বিনা প্রতিরোধেই হামলা চালাতে থাকে।
হামলায় ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতানজ, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা, শীর্ষ তিন সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীরা হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। এই হামলায় অন্তত ২০০টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি ইরানের প্রতিরক্ষা কাঠামোতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রাখার কৌশলের অংশ।
ব্রিটিশ-ইসরায়েল কমিউনিকেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার (বিআইকম) জানিয়েছে, মোসাদের ইউনিটগুলো ইরানের ভেতরে থেকেই ভূমি থেকে আকাশে ও ভূমি থেকে ভূমিতে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা লক্ষ্য করে নির্ভুলভাবে হামলা পরিচালনা করেছে।
ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফ মোসাদের প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজের বরাতে জানায়, ফুটেজে কিছু মুখোশ পরা ব্যক্তিকে রকেট লঞ্চার বসাতে দেখা যায়, যা পরে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ওই অপারেটররা তেহরানের আশেপাশে লক্ষ্যস্থলগুলোতে ভূমি থেকে ভূমিতে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিস্ফোরক ড্রোন হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে একটি ক্ষেপণাস্ত্র বহনকারী ট্রাকও ছিল। সাদাকালো ওই ভিডিওতে দেখা যায়, সশস্ত্র ব্যক্তিরা, একটি এলাকায় খোলা মাঠে বসে আইডিএফের হামলা শুরুর অপেক্ষা করছেন।
ইসরাইলের কৌশলগত সক্ষমতা
ইসরায়েলের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রকাশিত তথ্যগুলোকে ইসরায়েলের গোপন অভিযানগুলোর বিস্তৃতি ও গভীরতা তুলে ধরার পাশাপাশি দেশটির সক্ষমতা নিয়ে এক ধরনের কৌশলগত বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের দাবি সঠিক হলে এটি নজিরবিহীন একটি কৌশলগত সক্ষমতা হিসেবে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ অভিযানে নজরদারি, গোয়েন্দাগিরি এবং অস্ত্রশক্তি মিলিয়ে সমন্বিত আক্রমণ চালানো হয়েছে। তেহরানের পারমাণবিক হুমকির বিরুদ্ধে ইসরায়েল কতদূর যেতে পারে তার ইঙ্গিত এটি।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সামরিক বিজ্ঞানের পরিচালক ম্যাথু সাভিল বলেছেন, ‘মোসাদের অপ্রচলিত কার্যক্রমের সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলো ইসরায়েলের গুপ্তচরবৃত্তি দক্ষতার প্রমাণ, যার মাধ্যমে তারা ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে। এরপর স্বল্প সময়ে অপারেশন চালানোর ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে।’
ইরানের ভূখণ্ডে এমন গোপন অবকাঠামো স্থাপন করতে ইসরায়েলের বহুবার গোপন মিশন পরিচালনা করতে হয়েছে। সঠিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত করার জন্য ইরানের সামরিক ও অস্ত্রব্যবস্থার অবস্থান সম্পর্কেও নির্ধারিত গোয়েন্দা তথ্যের প্রয়োজন ছিল।
এই হামলায় ইরানের তিনজন সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিসহ সিনিয়র সামরিক নেতৃত্ব নিহত হয়েছেন, যা ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সামরিক সক্ষমতাকে আরও দুর্বল করেছে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতায় আঘাতের পাশাপাশি তারা প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাকারীদেরও হারিয়েছে।
সাভিল বলেন, ‘এই হামলার ব্যাপ্তি ও পরিসর ইঙ্গিত দেয় যে, এই অভিযান শুধু ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অনুসরণ থেকে বিরত রাখার জন্য নয়, বরং সম্ভাব্য সামরিক প্রতিক্রিয়া অক্ষম করা এবং শাসনব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার জন্যও পরিকল্পিত।’
শত্রু ভূখণ্ডে মোসাদের অভিযান নতুন নয়
শত্রু ভূখণ্ডে বিশেষ করে ইরানে মোসাদের সাহসী অভিযান চালানোর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ২০২০ সালে ইরানের শীর্ষ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল কাসিম সুলেইমানিকে হত্যা করতে যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করে মোসাদ।
২০২২ সালে দুটি মোটরসাইকেলে আসা হত্যাকারী আইআরজিসি কর্মকর্তা কর্নেল সাইয়্যাদ খাদায়িকে গুলি করে হত্যা করে। ২০২৪ সালে ইসরায়েল তেহরানে আইআরজিসির অতিথিগৃহে বোমা স্থাপন করে হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করে।
সাম্প্রতিক হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল ইঙ্গিত দিয়েছে আরও অনেক কিছু আসছে। ইসরায়েলের অপারেশন বিভাগের প্রধান মেজর জেনারেল ওডেড বাসিউক বলেন, ‘আমরা অপারেশনের মাত্র কয়েক ঘণ্টা ভিতরে ছিলাম... ছয় মাস আগে এটি কল্পনার মতো মনে হত।’
তিনি বলেন, ‘এই সাফল্য পরিকল্পনা, মহড়া এবং এখানে বসে যারা কাজ করেছে, তাদের পাশাপাশি যারা এখানে নেই তাদের কঠোর পরিশ্রমের ফল।’
এ রাতের হামলাটিকে ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময়কার মোসাদের অপারেশন ফোকাসের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। ওই সময় ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল মিসরের বিমানবাহিনীর প্রায় সবকিছুই ধ্বংস করে দিয়েছিল।
ভারতে এবার উড়াল দেওয়ার পরই বিধ্বস্ত হয়েছে যাত্রীবাহী একটি হেলিকপ্টার। এতে, পাইলটসহ সাত আরোহী নিহত হয়েছেন।
রবিবার (১৫ জুন) সকালে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য উত্তরাখণ্ডে এ ঘটনা ঘটে। রাজ্যের কেদারনাথ ধাম থেকে গুপ্তকাশী তীর্থস্থানের উদ্দেশে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয় হেলিকপ্টারটি।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উড্ডয়নের মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়।
স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা নন্দন সিং রাজওয়ার জানিয়েছেন, ‘দুর্ঘটনার পর উদ্ধার ও তল্লাশি অভিযান চলছে।’
অ্যারিয়ান অ্যাভিয়েশন নামের একটি বেসরকারি হেলিকপ্টার সংস্থার পরিচালিত হেলিকপ্টারটি কেদারনাথ তীর্থপথের নিকটবর্তী একটি বনাঞ্চলে স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বিধ্বস্ত হয়। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খারাপ আবহাওয়ার কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে।
দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে পাইলট ছাড়াও উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট থেকে আসা তীর্থযাত্রী ছিলেন বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। দুর্ঘটনার পর আগুন ধরে যাওয়ায় মরদেহগুলো মারাত্মকভাবে পুড়ে গেছে।
ভারতের অন্যতম চারটি তীর্থস্থানের একটি কেদারনাথ। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী সেখানে ভ্রমণ করেন। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলটিতে পৌঁছাতে অনেকেই হেলিকপ্টার সেবার ওপর নির্ভর করেন।
ভারতের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ দুর্ঘটনার শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই এই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনাটি ঘটলো। মাত্র তিন দিন আগে গত বৃহস্পতিবার (১২ জুন) দেশটির আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই যাত্রীবাহী এয়ার ইন্ডিয়া বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল।
এ ঘটনায় বিমানে থাকা ২৩২ যাত্রী ও ১০ ক্রুর মধ্যে ২৪১জনই নিহত হয়েছে। এ দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা অন্তত ২৭০ বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বিমানটি আহমেদাবাদের বিজে মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের ওপর বিধ্বস্ত হয়। এ সময় ছাত্ররা দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। এ দুর্ঘটনায় মেডিকেল হোস্টেলের ৫ শিক্ষার্থী নিহত ও আহত হয়েছেন আরও ৪০ জন।
যুক্তরাষ্ট্রের কোনো লক্ষ্যবস্তুতে তেহরান হামলা না চালালে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাত সহজেই শেষ করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা হলে ইরানের ওপর সেনাবাহিনীর ‘পূর্ণশক্তি’ প্রয়োগ করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
স্থানীয় সময় রবিবার (১৫ জুন) নিজস্ব সামাজিকমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে এসব বলেন ট্রাম্প।
তিনি বলেন, ‘ইরান যদি আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) ওপর কোনোভাবে আক্রমণ করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ণশক্তি ও ক্ষমতা তোমাদের (ইরান) ওপর এমনভাবে নেমে আসবে, যা পৃথিবী আগে কখনও দেখেনি।’
ট্রাম্প আরও বলেন, ‘তবে আমরা সহজেই ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পন্ন করতে পারি এবং এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারি।’
যদিও চুক্তি নিয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি তিনি। এর আগে, রবিবার রাতে ইরানের বোমা হামলায় ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১০ জনে পৌঁছেছে বলে জনিয়েছে ইসরায়েলি উদ্ধারকারী দল। এছাড়া ১৪০ জনের বেশি আহত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে।
একাধিক ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ও জরুরি সেবা সংস্থার বরাত দিয়ে বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, রবিবার ভোরে দুই দফায় ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের অভিযানে ইরানে প্রথম দিন ৭৮ জন নিহত হয়েছেন ও দ্বিতীয় দিনে আরও বহু মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানায় তেহরান। এর মধ্যে একটি ১৪ তলা আবাসিক ভবনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ২৯টি শিশুসহ ৬০ জন মারা যাওয়ার তথ্য দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, ইরানের অস্ত্র স্থাপনার আশপাশে বসবাসকারী নাগরিকদের সেখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য সতর্ক করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘ আগামী দিনে ইরান যা দেখবে, ইসরায়েলের এ যাবতকালের হামলা তার কাছে কিছুই না।’
শুক্রবার (১৩ জুন) রাজধানী তেহরানসহ দেশটির শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায় ইসরায়েল। আজ (রবিবার) ওমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের নির্ধারিত পারমাণবিক আলোচনাকে বানচাল করতেই ইসরায়েল এই হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি।
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করা হয়েছে। তাছাড়া ইসরায়েলের এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে এবং ইরান কেবল আত্মরক্ষার্থে জবাব দিচ্ছে বলেই মত দেন তিনি।
এর আগে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার মধ্যে ওমানের আলোচনা সম্ভব নয়।’
তাছাড়া, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে কেউ সহায়তা করলে, ওই দেশের সামরিক ঘাঁটিগুলোকেও হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হবে বলে সতর্ক করেছে তেহরান।
ইসরায়েলের দাবি, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখা এবং এর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে অকার্যকর করার জন্য এই সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে।
এই অভিযান ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে পুরোপুরি থামাতে না পারলেও একটি পূর্ণাঙ্গ যুক্তরাষ্ট্র-ইরান চুক্তির পথ খুলে দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
এদিকে, ইরান-সমর্থিত ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা রবিবার জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় তারা ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় এলাকা জাফায় একাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। ইরানের কোনো মিত্রের এটিই ছিল প্রথম সরাসরি হামলা।
তবে গাজায় ২০ মাসের যুদ্ধ এবং গত বছর লেবাননের সংঘর্ষে ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী আঞ্চলিক মিত্র হিজবুল্লাহকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যার ফলে ইরানের পাল্টা জবাবের ক্ষমতা কমে এসেছে বলে মনে করছেন অনেকে।
এ ছাড়া, ইসরায়েলের হামলার কারণে বিশ্বের বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্র ‘সাউথ পার্সের’ উৎপাদন আংশিকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে ইরান। এতে তেলের দাম বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সাউথ পার্স ক্ষেত্রটি ইরানের দক্ষিণ বুশেহর প্রদেশে অবস্থিত এবং এটি ইরানে উৎপাদিত গ্যাসের প্রধান উৎস।
তাছাড়া, ইসরায়েল জানিয়েছে, তাদের অভিযান কয়েক সপ্তাহ চলতে পারে। এমনকি ইরানের জনগণকে তাদের ইসলামি ধর্মীয় শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন নেতানিয়াহু। এর ফলে এই সংঘাত আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়বে এবং বাইরের শক্তিগুলোকেও জড়িয়ে ফেলবে—এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে ইসরায়েল। ইরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির শেষ ধাপ পর্যন্ত না পৌঁছাতে পারে, তা নিশ্চিত করতেই এই হামলা চালানোর কথা জানিয়েছে তেল আবিব।
তবে এ অভিযানকে সম্পূর্ণরূপে বেসামরিক বলে আখ্যা দিয়েছে ইরান। এ ছাড়া, তেহরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করছে না বলে দাবি করেছে তারা। অবশ্য জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থার তথ্যমতে, ইরান বৈশ্বিক পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির আওতায় থাকা বাধ্যবাধকতাগুলো লঙ্ঘন করেছে।
ইসরাইল ও ইরানের সংঘর্ষের কারণে বন্ধ ঘোষণার একদিন পর শনিবার জর্ডান, সিরিয়া ও লেবানন তাদের আকাশসীমা পুনরায় খুলে দিয়েছে।
আম্মান থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানায়।
জর্ডান, সিরিয়া ও লেবানন এ তিনটি দেশই ইসরাইলের প্রতিবেশী। তবে কেবল জর্ডানের সঙ্গেই ইসরাইলের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।
সিরিয়া দীর্ঘদিন ধরে ইরানের মিত্র বাশার আল-আসাদের শাসনাধীন ছিল। গত ডিসেম্বরে তাকে উৎখাতের পর থেকে ইসলামপন্থী বিদ্রোহীরা দেশটি নেতৃত্ব দিচ্ছে।
লেবাননে হিজবুল্লাহ নামে সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। তারা ২০২৪ সালের শেষের দিকে ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়। এরপর থেকে সরকার একটি যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে কাজ করছে। এতে শর্ত ছিল হিজবুল্লাহকে তার অস্ত্রাগার হস্তান্তর করতে হবে এবং ইসরাইলি সীমান্তের কাছাকাছি এলাকা থেকে সরে যেতে হবে।
জর্ডানের বেসামরিক বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান হাইথাম মিস্তো এক বিবৃতিতে বলেছেন, জর্ডান সকাল সাড়ে ৭টা (স্থানীয় সময়) থেকে তার আকাশসীমা পুনরায় খুলে দিয়েছে।
লেবাননের পরিবহনমন্ত্রী ফায়েজ রাসামনি শনিবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে দেশের আকাশসীমা পুনরায় উন্মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন।
সিরিয়ার বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষও বেসামরিক বিমানের জন্য দেশের আকাশসীমা পুনরায় উন্মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে।
দিল্লি থেকে আহমেদাবাদে যাত্রার সময় এক এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটে উঠে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন এক যাত্রী। তিনি বিমানের ভেতরের অস্বাভাবিক অবস্থার কথা তুলে ধরে ভিডিও করেন এবং সেটি পোস্ট করেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়ে ভিডিও করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সেই বোয়িং ৭৮৭-৮ বিমানটি আহমেদাবাদের মেঘানিনগর এলাকায় বিধ্বস্ত হয়।
আকাশ বাত্সা নামের ওই যাত্রী দিল্লি থেকে আহমেদাবাদে গিয়েছিলেন এআই-১৭১ ফ্লাইটে।
বিমানের মধ্যে প্রবল অস্বস্তিকর অবস্থা নিয়ে তিনি পোস্ট করা ভিডিওটিতে বলেন, ‘আমরা ট্যাক্সি করার অপেক্ষায়, কিন্তু এসি একেবারেই কাজ করছে না। চারপাশে যাত্রীরা গরমে অস্থির হয়ে পড়েছেন। এর ওপর টিভি স্ক্রিন, লাইট–কোনোটাই কাজ করছে না। এটি কি যাত্রীদের জন্য গ্রহণযোগ্য?’ তিনি এসব দৃশ্য ভিডিও করে এক্স-এ পোস্ট করেন।
ভিডিওতে দেখা যায়, বিমানের অভ্যন্তরে যাত্রীরা অস্বস্তিতে রয়েছেন এবং নানা যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে আছে।
অকাশের ভিডিও পোস্ট করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এআই-১৭১ ফ্লাইটটি আহমেদাবাদ থেকে উড্ডয়নের পরপরই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। লন্ডনের গ্যাটউইকগামী এই বোয়িং ৭৮৭-৮ বিমানে তখন ২৪২ জন যাত্রী ও ক্রু সদস্য ছিলেন। এদের মধ্যে ১৬৯ জন ভারতীয়, ৫৩ জন ব্রিটিশ, ১ জন কানাডীয় এবং ৭ জন পর্তুগিজ নাগরিক ছিলেন।
ঘটনার পর অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে কি বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটির ইঙ্গিত ছিল আগেই? আকাশের ভিডিও ও অভিজ্ঞতা দেখে অনেকেই বলছেন, ফ্লাইটটি হয়তো উড্ডয়নের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত অবস্থায় ছিল না। এমন অবস্থা সত্ত্বেও বিমানের যাত্রা চালিয়ে যাওয়াটাই বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
আহমেদাবাদ নামায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া আকাশ বাত্সা অপর একটি পোস্টে লেখেন, ‘আজ রাতে আর এয়ার ইন্ডিয়াতে ফিরছি না। যথেষ্ট হয়েছে।’
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে একজন যাত্রীর পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকেই যদি দুর্ঘটনার সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় গাফিলতির বিষয়েও।
এখন দেখার বিষয়, আকাশের অভিজ্ঞতা ও ভিডিও ভবিষ্যতে তদন্তের কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারে কি না।
ভারতের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় ২৪১ জন আরোহীসহ ২৯৪ জন নিহত হয়েছেন। বিমানটি ২৪২ জন আরোহী নিয়ে গুজরাটের আহমেদাবাদে বিজে মেডিকেল কলেজের একটি ছাত্রাবাসে আছড়ে পড়ে। এতে ওই মেডিকেল কলেজের অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থীও প্রাণ হারান।
বিধ্বস্ত লন্ডনগামী বিমানটির ২৪২ জন আরোহীর মধ্যে একজন ছাড়া সবারই মৃত্যু হয়েছে। প্রাণে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ব্যক্তিটি হলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক বিষ্ণু কুমার রমেশ। বয়স ৪০ বছর।
আগুনের গোলার মতো বিস্ফোরিত হওয়া ওই উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে অলৌকিকভাবে বের হয়ে আসেন বিষ্ণু কুমার। গতকোল শুক্রবার হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ভারতের জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যম ডিডি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তের কথা বর্ণনা করেছেন রমেশ।
জ্বালানিতে পরিপূর্ণ এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজটি লন্ডনের উদ্দেশে রওনা করেছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই এটি বিস্ফোরিত হয়।
বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, উড়োজাহাজের ১১এ নম্বর আসনে বসেছিলেন রমেশ। তার ভাইও ছিলেন একই উড়োজাহাজে। যুক্তরাজ্যে থাকা পরিবারের অন্য সদস্যরা সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
রমেশ বলেন, ‘উড্ডয়নের এক মিনিটের মধ্যেই হঠাৎ মনে হলো কিছু একটা আটকে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম, কিছু একটা ঘটেছে। তারপর হঠাৎ করে উড়োজাহাজের সবুজ আর সাদা আলো জ্বলে উঠল। এরপর মনে হলো উড়োজাহাজটি আরও জোরে ছুটছে। এটি সোজা গিয়ে একটা হাসপাতালের হোস্টেলে গিয়ে ধাক্কা খেল। আমার চোখের সামনেই উড়োজাহাজটা বিধ্বস্ত হলো।’
রমেশ এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সেখানে তার শরীরের পোড়া ক্ষত ও আঘাতের চিকিৎসা চলছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকাল শুক্রবার হাসপাতালে রমেশকে দেখতে যান। মোদির ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে।
বার্তা সংস্থা প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের খবরে বলা হয়েছে, রমেশের বয়স ৪০ বছর। তিনি যুক্তরাজ্যের লেস্টার শহরের বাসিন্দা। বার্তা সংস্থাটি রমেশের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে।
রমেশ বলেন, ‘শুরুতে ভেবেছিলাম, আমিও মারা যাচ্ছি। কিন্তু পরে যখন চোখ খুললাম, বুঝলাম, এখনো বেঁচে আছি।’
রমেশ আরও বলেন, ‘আমি সিটবেল্ট খুলে বেরোনোর চেষ্টা করলাম এবং পারলামও। আমার মনে হয়, আমি উড়োজাহাজের যে পাশটায় ছিলাম, সেটি হোস্টেলের দিকে ছিল না। আমি যেখানে নামলাম, সেটি মাটির কাছাকাছি ছিল এবং সেখানে ফাঁকা জায়গাও ছিল। আমার পাশের দরজাটা ভেঙে পড়ার পর দেখলাম, বাইরে জায়গা আছে। আর তখনই ভাবলাম, চেষ্টা করলে বেরিয়ে যেতে পারি।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পর বিষ্ণু রক্তমাখা টি-শার্ট পরে পা টেনে টেনে হাঁটছেন এবং নিজেই অ্যাম্বুলেন্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
বিষ্ণু বলেন, ‘আগুনে আমার বাঁ হাতটা সামান্য পুড়ে গেছে। একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে আমাকে হাসপাতালে আনা হয়। এখানকার লোকজন খুব ভালোভাবে আমার দেখভাল করছে।’
ইসরায়েলের দ্বিতীয় দফা আক্রমণের জবাবে এবার দেশটির সামরিক ও বিমানঘাঁটিগুলোতে একযোগে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলা থামা চলমান থাকায় তা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
শুক্রবার (১৪ জুন) ভোর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশদুটির পাল্টাপাল্টি হামলায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। তবে হতাহতের বেশিরভাগই ইরানের।
উভয় পক্ষের কর্মকর্তারাই তাদের অভিযান চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) শুক্রবার রাতে এ হামলা চালানোর কথা জানায়। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ইসরায়েলের হামলার জবাবে ‘ট্রু প্রমিস ৩’ নামের এই অভিযান শুরু হয়েছে।
ইসারায়েলের সামরিক বাহিনীর দাবি, ইরান ১০০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগ তারা প্রতিহত করেছে।
অপরদিকে, ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ইসরায়েলকে সহায়তা করেছে। ভূমিতে স্থাপিত ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থার মাধ্যমেই সেগুলো ভূপাতিত করা হয়েছে। তবে এখনও যুদ্ধবিমান কিংবা যুদ্ধ জাহাজের সহায়তা নেওয়া হয়নি।
এদিকে, তেল আবিবের পূর্ব এলাকা রামাত জানে ইরানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের আশপাশ থেকে আহতদের সরিয়ে নেওয়ার ছবি ও ভিডিও দেখা গেছে।
তেল আবিব মহানগর এলাকায় রকেট হামলায় পাঁচজন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির জাতীয় অ্যাম্বুলেন্স সেবা সংস্থা মাগেন ডেভিড অ্যাডম।
আহতদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে মাগেন ডেভিড অ্যাডমের এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত তেল আবিব এলাকায় হামলার খবর পাওয়া সাতটি স্থানে আমাদের উদ্ধারকারী দল পাঠানো হয়েছে।’
ইসরায়েলের হামলার জবাবে এবার পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরান। দেশটির পক্ষ থেকে ইসরায়েলের দিকে প্রায় ১০০টি ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন জানিয়েছেন, গত এক ঘণ্টায় ইসরায়েল অভিমুখে অন্তত ১০০টি ইউএভি (ড্রোন) ছোড়া হয়েছে, যেগুলো আমরা প্রতিহত করার চেষ্টা করছি।
ডেফরিনের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েলের খবরে বলা হয়েছে, ইরানে ইসরায়েলি হামলায় ২০০টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয়, যেগুলো দেশটির ভেতরে প্রায় ১০০টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।
পাশাপাশি, ইসরায়েলের হামলায় ইরানি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি এবং দেশটির জরুরি কমান্ড ইউনিটের প্রধান জেনারেল গোলাম আলি রশিদ নিহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এর আগে, ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরেও তাদের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করা হয়।
শুক্রবার ভোরে ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা নাতানজসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালায় ইসরায়েল। পরে দেশটির আরও কয়েকটি স্থানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বলে বার্তা সংস্থা এপির খবরে বলা হয়েছে।
এদিকে, ইসরায়েলের হামলার কঠোর জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করে তেহরান।
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের মুখপাত্র আবুলফজল শেখারচি বলেন, ‘জায়নবাদী এ হামলার জবাব অবশ্যই দেবে ইরানি সশস্ত্র বাহিনী।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলকে তার হামলার চড়া মূল্য দিতে হবে এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর কঠোর জবাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’
হামলার পর ইরানের অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কঠোর বিবৃতি দিয়েছে।