যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে আবারও হোয়াইট হাউসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার এই জয় অনেক দিক থেকেই ঐতিহাসিক। তিনিই হতে যাচ্ছেন ইতিহাসের প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি ফৌজদারি মামলার আসামি। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে অংশ নিয়ে দুবার জয় পেয়েছেন তিনি। চার বছর আগে জো বাইডেনের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিলেও এবার ট্রাম্পের অসাধারণ প্রত্যাবর্তন দেখেছে সারাবিশ্ব। হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বড় পরিবর্তন হতে চলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
রাশিয়া, ইউক্রেন এবং ন্যাটো
নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় ট্রাম্পকে একাধিকবার বলতে শোনা গেছে, তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ ‘একদিনে বন্ধ’ করে দিতে পারেন। তবে সেটা কীভাবে করবেন সেই প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য তিনি কিছু বলতে চাননি। গত মে মাসে ট্রাম্পের দুই প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা প্রধানের লেখা এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখা উচিত। তবে কিয়েভের রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় প্রবেশের বিষয়কে শর্তসাপেক্ষে সমর্থন করা উচিত।
রাশিয়াকে ‘প্রলুব্ধ’ করতে, পশ্চিমারা ন্যাটোতে ইউক্রেনের বহু কাঙ্ক্ষিত অন্তর্ভূক্তিকে বিলম্বিত করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে এ বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টারা বলেছিলেন, ইউক্রেন যে রাশিয়ার দখল থেকে তাদের সব অঞ্চল ফিরে পেতে পারে, সেই আশা ত্যাগ করা উচিত নয়। তবে এই আলোচনা হওয়া উচিত বর্তমানের ‘ফ্রন্ট লাইনের’ ভিত্তিতে। যুদ্ধ বন্ধ করার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ দৃষ্টিভঙ্গি ন্যাটোর ভবিষ্যত সম্পর্কিত কৌশলগত ইস্যুতেও প্রভাব ফেলতে পারে। এই মুহূর্তে ৩০টিরও বেশি দেশ ন্যাটোর অংশ। কিন্তু ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই এই জোটের বিষয়ে সন্দেহপ্রবণ ছিলেন। অন্যদিকে আমেরিকার সুরক্ষার প্রতিশ্রুতির সুযোগ ইউরোপ নিচ্ছে বলেও অতীতে অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
তবে ন্যাটো থেকে সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন কি না সেটা একটা বিতর্কের বিষয়।
মধ্যপ্রাচ্য
ইউক্রেনের মতোই মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি’ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর অর্থ হলো তিনি গাজায় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ এবং লেবাননে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধের ইতি টানবেন। কিন্তু তা তিনি কীভাবে করবেন সে বিষয়ে কিছু বলেননি। তিনি বারবার দাবি করেছেন, জো বাইডেনের পরিবর্তে যদি তিনি ক্ষমতায় থাকতেন তাহলে ইরানের ওপর তার ‘সর্বোচ্চ চাপ’ প্রয়োগের নীতির কারণে হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ করতো না। অনুমান করা যায়, ক্ষমতায় এসে তার দ্বিতীয় মেয়াদেও ট্রাম্প সেই নীতিই মেনে চলার চেষ্টা করবেন যার ভিত্তিতে তার প্রশাসন ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে এনেছিল। সে সময় ইরানের ওপর বৃহত্তর নিষেধাজ্ঞা জারি এবং ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করা হয়।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে ইসরায়েলের সবচেয়ে ভালো বন্ধু বলে উল্লেখ করেছেন। এদিকে ফিলিস্তিনিরা ট্রাম্প প্রশাসনকে বয়কট করেছিল। কারণ ফিলিস্তিনিদের জাতীয় ও ধর্মীয় জীবনের ঐতিহাসিক কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও জেরুজালেমের প্রতি তাদের (ফিলিস্তিনিদের) দাবিকে গুরুত্ব দেয়নি ওয়াশিংটন।
ফিলিস্তিন আরও ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে পড়ে যখন ট্রাম্প তথাকথিত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর মধ্যস্থতা করেছিলেন যাকে ইসরায়েল এবং বেশ কয়েকটি আরব ও মুসলিম দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য একটি ঐতিহাসিক চুক্তি হিসাবে দেখা হয়। এই মধ্যস্থতার সময় শর্ত হিসাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ফিলিস্তিনকে মেনে নিতে হয়নি। এর পরিবর্তে, এই চুক্তিতে সামিল দেশগুলো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিনিময়ে উন্নত মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের সুবিধা পেয়েছিল। এতে ধীরে ধীরে আরও কোণঠাঁসা হয়ে পড়ে ফিলিস্তিন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় বেশ কয়েকটি বিবৃতি দিয়ে ট্রাম্প বলেন, তিনি গাজায় চলমান যুদ্ধের অবসান চান। কিন্তু নেতানিয়াহুর সঙ্গে তার একটা জটিল সম্পর্ক রয়েছে, যা মাঝে মাঝে ‘অকার্যকর’ অবস্থারও সম্মুখীন হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে নেতানিয়াহুর ওপর চাপ প্রয়োগ করার ক্ষমতা তার রয়েছে।
চীন ও বাণিজ্য
চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি সে দেশের বৈদেশিক নীতির কৌশলগতভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যা বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। ক্ষমতায় থাকাকালীন, ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনকে সে দেশের ‘কৌশলগত প্রতিযোগী’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। একইসঙ্গে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু ক্ষেত্রে চীনা আমদানির ওপর শুল্কও আরোপ করেছিলেন। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসাবে মার্কিন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বেইজিংও শুল্ক আরোপ করে। এই ‘দ্বন্দ্বের’ অবসান ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু ততদিনে কোভিড মহামারীর প্রকোপ দেখা দেয়। দুই দেশের সম্পর্কের আরও অবনতি হয় যখন ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে আখ্যা দেন। সে সময় বাইডেন প্রশাসন দাবি করে, তারা চীন নীতির প্রতি আরও দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই চীনা আমদানির ক্ষেত্রে ট্রাম্প-প্রশাসনের শুল্ককেই বজায় রেখেছে তারা।
বাণিজ্য নীতির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প, উৎপাদন এবং সেই সংক্রান্ত কাজে মার্কিনদের অগ্রাধিকারের বিষয়ে জুড়ে দিয়ে ভোটারদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ইস্পাতের মতো ঐতিহ্যবাহী মার্কিন শিল্পে দীর্ঘমেয়াদী চাকরির সুযোগ কমে আসার একটা বড় কারণ কারখানার অটোমেশন এবং উত্পাদনগত পরিবর্তন। এর পেছনে বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা এবং অফ-শোরিংর মতো কারণ তুলনামূলক ভাবে কমই দায়ী। ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংকে একই সঙ্গে বিপজ্জনক এবং একজন অত্যন্ত কার্যকর নেতা হিসাবে প্রশংসা করেছেন।
যে ৭টি কাজকে প্রাধান্য দিতে চান ট্রাম্প
অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ন: ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার সময় অবৈধ অভিবাসীদের বের করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ করারও অঙ্গীকার করেছিলেন। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী- এ ধরনের বিপুল পরিমাণ অভিবাসী বের করে দেওয়ার বিষয়টি আইনগত এবং যৌক্তিকভাবে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এ বিষয়টি মার্কিন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধীর করে দিতে পারে।
অর্থনীতি, ট্যাক্স ও শুল্ক: নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা যে দুটি ইস্যুকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তার একটি অর্থনীতি। তবে ট্রাম্প আগেই মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি ফের কমে আসার আগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনে এটি বেশ উচ্চ স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল। তবে পণ্যের দামকে সরাসরি প্রভাবিত করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত।
জলবায়ু নীতিমালা সংস্কার: ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবার ক্ষমতায় এসে শতাধিক পরিবেশ সুরক্ষা আইন প্রত্যাহার এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মতো আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নেন। এবারও তিনি পরিবেশ সংক্রান্ত আইন শিথিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মূলত, মার্কিন গাড়ি শিল্পকে সহায়তা করার লক্ষ্যে তিনি এই উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ: ইউক্রেনে টানা আড়াই বছর ধরে আগ্রাসন চালাচ্ছে রাশিয়া। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় রশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা করছে কিয়েভ। রাশিয়ার সাথে এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। একইসঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই সংঘাত শেষ করার প্রতিশ্রুতিও দেন।
গর্ভপাত নিষিদ্ধকরণ ইস্যু: প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কে সমর্থকদের আপত্তি থাকার পরও কমলা হ্যারিসের বিপরীতে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে জাতীয়ভাবে গর্ভপাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আইনে স্বাক্ষর করবেন না। ২০২২ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাতের ওপর সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করে। গর্ভপাতের অধিকার ছিল কমলা হ্যারিসের নির্বাচনী প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং কয়েকটি রাজ্য নির্বাচনের দিন গর্ভপাতের অধিকার সংরক্ষণ বা সম্প্রসারণের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটগ্রহণ করা হয়। ট্রাম্প নিজে বারবার বলেছেন, গর্ভপাত নিয়ে রাজ্যগুলোর নিজেদের আইন করার স্বাধীনতা থাকা উচিত।
ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গায় জড়িতদের ক্ষমা: ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে হামলা হয়। জো বাইডেনকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যৌথ অধিবেশনের সময় সেখানে হামলা করেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের কয়েক হাজার উন্মত্ত সমর্থক। ওই দাঙ্গায় পুলিশ সদস্যসহ নিহত ৫ জন প্রাণ হারান। ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে হওয়া এই হামলার ঘটনায় ট্রাম্পের উসকানি ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ট্রাম্প বরারবই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন।
জ্যাক স্মিথকে অব্যাহতি: সদ্য নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন ক্ষমতা গ্রহণের ‘দুই সেকেন্ডের মধ্যে’ তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা পরিচালনাকারী কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথকে চাকরিচ্যুত করবেন। বিশেষ কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয়ার চেষ্টার অভিযোগে এবং গোপনীয় তথ্যের ভুল ব্যবস্থাপনার অভিযোগে দুটি পৃথক অভিযোগ করেছেন।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ কী?
ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে কিছু মামলার নিষ্পত্তি হতে পারে। সিবিএস নিউজের তথ্যমতে, ট্রাম্পের আইনজীবী দল এবং মামলা সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছু মামলা বন্ধের প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। আইনি বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের অনেক মামলার নিষ্পত্তি হতে পারে। তবে, কিছু ক্ষেত্রে তাকে দায়মুক্তির বাইরে রাখার ব্যবস্থা কার্যকর হলে তা আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
অধিকৃত ফিলিস্তিনে ইরানের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলায় ইসরায়েলে কমপক্ষে ৩১ হাজার ভবন এবং ৪ হাজার যানবাহন ধ্বংসসহ ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইরানের সংবাদমাধ্যম মেহের নিউজ জানিয়েছে, ইরানে হামলার জেরে মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলকে দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছে।
ইহুদিবাদী দেশটির এই ক্ষয়ক্ষতিই প্রমাণ করে যে, সংঘাতের সময় ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ইসরায়েলের কি বিশাল এবং অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। যদিও ইসরায়েল গত ১৩ জুন ইরানের বিরুদ্ধে আগে আগ্রাসন চালিয়েছিল এবং ১২ দিন ধরে ইরানের সামরিক, পারমাণবিক এবং আবাসিক এলাকায় আঘাত করেছিল।
ইসরায়েলকে সাহায়তা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২গত ২ জুন ইরানের নাতানজ, ফোরদো এবং ইস্পাহানে তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়েছিল। আগ্রাসনের পরপরই ইরানি সামরিক বাহিনী শক্তিশালী পাল্টা হামলা চালিয়েছিল। ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) অ্যারোস্পেস ফোর্স অপারেশন ট্রু প্রমিজ-৩-এর অংশ হিসেবে ইহুদিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ২২টি প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যার ফলে অধিকৃত অঞ্চল জুড়ে শহরগুলিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়াও, মার্কিন হামলার প্রতিক্রিয়ায়, ইরানি সশস্ত্র বাহিনী কাতারের আল-উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যা পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম আমেরিকান সামরিক ঘাঁটি। ২৪ জুন কাতারের মধ্যস্থতায় কার্যকর হয় যুদ্ধবিরতি।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গত রোববার একটি ধর্মীয় আদেশ বা ফতোয়া জারি করেছেন ইরানের শীর্ষ শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ নাসের মাকারেম শিরাজি। এই ফতোয়ায় তিনি ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুকে ‘ঈশ্বরের শত্রু’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি বা শাসক ইসলামের নেতা বা শীর্ষ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে হুমকি দেয়, সে ‘যুদ্ধপিপাসু’ বা ‘সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ব্যক্তি’ হিসেবে বিবেচিত হবে।
গ্র্যান্ড মুফতি আয়াতুল্লাহ নাসের মাকারেম শিরাজি এই ফতোয়ায় বিশ্বের সব মুসলমানের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা ওই দুই নেতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে। কারণ তারা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বকে হুমকি দিয়েছে। ফতোয়ায় বলেন, যে ব্যক্তি বা শাসক ইসলামের নেতা বা শীর্ষ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে হুমকি দেয়, সে ‘যুদ্ধপিপাসু’ বা ‘সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ব্যক্তি’ হিসেবে বিবেচিত হবে।
ইরানি আইন অনুযায়ী, যারা সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাদের শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদণ্ড, শূলবিদ্ধকরণ, অঙ্গচ্ছেদ অথবা নির্বাসন। ফতোয়ায় আরও বলা হয়েছে, এই শত্রুদের সঙ্গে মুসলিম বা কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে কোনও ধরনের সহযোগিতা বা সমর্থন অবৈধ এবং নিষিদ্ধ। সব মুসলমানের উচিত এই শত্রুদের কথাবার্তা ও কাজের জন্য তাদের অনুতপ্ত করা।
এছাড়াও এতে বলা হয়েছে, যদি কোনো মুসলমান তার ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের পথে ক্ষতি বা কষ্টের সম্মুখীন হয়, তাহলে সে সৃষ্টিকর্তার রাস্তায় সংগ্রামরত একজন যোদ্ধার পুরস্কার লাভ করবে, ইনশাআল্লাহ। এই ফতোয়ার পেছনে ইসরায়েল ও ইরানের সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনাকেই কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
ইরানি ধর্মীয় নেতারা এর আগেও ফতোয়া দিয়েছেন। ইরানের অন্যতম ভয়ংকর ফতোয়া জারি হয় ১৯৮৯ সালে। লেখক সালমান রুশদির ‘শয়তানের উক্তি’ বা দ্য স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাস প্রকাশের পর তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করা হয়। অনেক মুসলমান মনে করেছিলেন যে বইটি তাদের ধর্মকে অবমাননা করেছে। সেই ফতোয়ার পর রুশদিকে আত্মগোপনে যেতে হয়।
‘৭ দিনের মধ্যে ইরানে ফের হামলা চালাবে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল’
ইরানে ফের যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল হামলা চালাতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তেহরানের একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ইরানের ওপর আবার হামলা হতে পারে। গতকাল সোমবার ইরান ইন্টারন্যাশনালের লাইভ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
রোববার ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের প্রধান ইব্রাহিম মোত্তাকি বলেন, বর্তমান যুদ্ধবিরতি ইসরায়েল-আমেরিকার ‘সংঘবদ্ধ’ হওয়ার জন্য সংক্ষিপ্ত সময়কাল মাত্র, এবং তারা শিগগিরই ইরানের তাদের আক্রমণ পুনরায় শুরু করবে। সাক্ষাৎকারে মোক্তাকি আরও বলেছেন, প্রাপ্ত প্রমাণ ইঙ্গিত দেয় যে, মার্কিন সহায়তায় ইসরায়েল সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের মধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে তাদের আকস্মিক ও ধ্বংসাত্মক সামরিক অভিযান পুনরায় শুরু করবে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধবিরতিকে তাদের নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা পুনর্গঠন এবং সর্বোত্তম করার একটি উপায় হিসেবে দেখে বলে সতর্ক করেছেন ইরানি এই বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তৈরিতে সহায়তা করেছিলযুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তৈরিতে সহায়তা করেছিল। মোক্তাকি ইরানের কর্মকর্তাদের এই যুদ্ধবিরতি গুরুতরভাবে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইরানি কর্মকর্তারা এবার হামলার লক্ষ্যবস্তু হবেন।
আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে যে শর্ত দিল ইরান
ইরান বলেছে, কূটনৈতিক আলোচনা আবার শুরু করতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের ওপর নতুন করে হামলার চিন্তা বাতিল করতে হবে। দেশটির উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাজিদ তাখত-রাভানছি বিবিসিকে এ কথা বলেছেন। এক সাক্ষাৎকারে মাজিদ তাখত-রাভানছি বিবিসিকে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে জানিয়েছে যে, তারা আলোচনায় ফিরতে চায়। কিন্তু আলোচনা চলাকালে নতুন করে হামলার মতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র এখনো তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি।
ইরানে দখলদার ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শুরু হয়েছিলো গত ১৩ জুন। ওমানের রাজধানী মাস্কটে তার দুদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে ষষ্ঠ দফার আলোচনায় বসার কথা ছিল।
উত্তর মেক্সিকোর সিউদাদ জুয়ারেজের একটি বেসরকারি একটি শ্মশানে ৩৮১টি মৃতদেহ স্তূপীকৃত অবস্থায় সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। রোববার স্থানীয় প্রসিকিউটরের কার্যালয় এ তথ্য জানিয়েছে ।
মেক্সিকোর সিউদাদ জুয়ারেজ থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানায়।
চিহুয়াহুয়া রাজ্য প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের যোগাযোগ সমন্বয়কারী এলয় গার্সিয়া এএফপিকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা ৩৮১টি মৃতদেহের সন্ধান পেয়েিেছ এবং সেগুলো আমাদের কাছে আছে। মৃতদেহগুলো অনিয়মিতভাবে শ্মশানে জমা করা হয়েছিল এবং সেগুলোকে দাহ করা হয়নি।’
গার্সিয়া বলেন, শ্মশানের ভবনে বিভিন্ন কক্ষে মৃতদেহগুলো ‘স্তূপীকৃত’ অবস্থায় ছিল।
তিনি বলেন, ‘মৃতদেহগুলোএকটির ওপরে আরেকটি মেঝেতে রাখা হয়েছিল। ‘সমস্ত মৃতদেহকে সুগন্ধিকরণ করা হয়েছিল। গার্সিয়া বলেন, ছাইয়ের পরিবর্তে আত্মীয়দের ‘অন্যান্য উপকরণ দেওয়া হয়েছিল।
কর্তৃপক্ষ অনুমান করেছে, কিছু দেহাবশেষ দুই বছর পর্যন্ত সেখানে থাকতে পারে। গার্সিয়া শ্মশান কতৃপক্ষের ‘অবহেলা এবং দায়িত্বহীনতা কে দায়ী করেছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘আপনি যতটা প্রক্রিয়া করতে পারেন তার চেয়ে বেশি নিতে পারবেন না।’শ্মশানের একজন প্রশাসক ইতোমধ্যেই নিজেকে প্রসিকিউটরদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
তবে, কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট করেনি মৃতদেহগুলো অপরাধমূলক সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের কিনা। সংগঠিত অপরাধের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ মেক্সিকো বছরের পর বছর ধরে ফরেনসিক ব্যবস্থার সংকটে ভুগছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য মৃতদেহের সংখ্যাধিক্য, কর্মীদের অভাব এবং অর্থের সীমাবদ্ধতা।
ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কখনোই বন্ধ হবে না বলে দাবি করেছেন জতিসংঘে দেশটির রাষ্ট্রদূত আমির-সাঈদ ইরাভানি। তিনি বলেন, পরমাণু অস্ত্রবিস্তাররোধ চুক্তির অধীনে শান্তিপূর্ণ জ্বালানির উদ্দেশ্যে তাদের এই প্রকল্প অনুমোদিত।
রবিবার (২৯ জুন) সিবিএস নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সমৃদ্ধকরণ আমাদের অধিকার, এটি একটি অখণ্ড অধিকার এবং আমরা এই অধিকার বাস্তবায়ন করতে চাই।
তিনি আরও বলেন, ইরান আলোচনার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ আলোচনার নাম নয়, এটি আমাদের প্রতি একটি নীতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
তবে ইরাভানি বলেন, “তেহরান আলোচনার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু এই আগ্রাসনের পর নতুন করে আলোচনা শুরুর মতো কোনো উপযুক্ত পরিবেশ নেই এবং প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক বা আলোচনার জন্য কোনো অনুরোধও নেই।”
জাতিসংঘে ইরানের এই দূত আরও দাবি করেন, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি কিংবা সংস্থার পরিদর্শকদের প্রতি তাদের সরকারের পক্ষ থেকে কোনো হুমকি নেই।
যদিও কিছু ইরানি কর্মকর্তা এই পরিদর্শকদের অভিযুক্ত করেছেন ইসরায়েলের হামলাকে যৌক্তিকতা দিতে তারা সাহায্য করছে বলে। বর্তমানে আইএইএ পরিদর্শকরা ইরানে অবস্থান করছেন, তবে তারা দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছেন না।
ফিলিস্তিনের গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় গত শুক্রবার জানিয়েছে, মার্কিন-ইসরায়েলি ত্রাণ কেন্দ্রগুলো থেকে বিতরণ করা আটার ব্যাগে অক্সিকোডোন নামের মাদক বড়ি পাওয়া গেছে। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে তারা। এক বিবৃতিতে ওই কার্যালয় বলেছে, ‘আমরা এখন পর্যন্ত চারজনের সাক্ষ্য পেয়েছি। তারা আটার ব্যাগের ভেতরে এই বড়িগুলো পেয়েছেন।’ কার্যালয় সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ‘কিছু মাদক ইচ্ছাকৃতভাবে গুঁড়া বা দ্রবীভূত করে আটার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
অক্সিকোডোন একটি শক্তিশালী মাদক, যা মূলত ক্যানসার রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি ও তীব্র ব্যথা উপশমে ব্যবহার করা হয়। এ মাদক অত্যন্ত আসক্তিকর এবং এর জীবননাশক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এর মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসে জটিলতা, বিভ্রম ইত্যাদি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্টে গাজায় বিতরণ করা আটার ব্যাগে বড়ি পাওয়া যাওয়ার ছবি প্রকাশ হয়েছে। পরে গাজা কর্তৃপক্ষ ওই বিবৃতি দেয়।
গাজার একজন ফার্মাসিস্ট ওমর হামাদ এ ঘটনাকে ‘গণহত্যার সবচেয়ে জঘন্য রূপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ফেসবুকে গাজার চিকিৎসক খলিল মাজেন আবু নাদা লিখেছেন, ‘এই মাদক ‘আমাদের সামাজিক চেতনা ধ্বংস করার একটি অস্ত্র’।’ এভাবে ‘মাদকাসক্তি ছড়ানো ও ফিলিস্তিনি সমাজের বন্ধন ভেঙে দেওয়ার জঘন্য অপরাধের’ জন্য পুরোপুরি ইসরায়েলকেই দায়ী করছে গাজার গণমাধ্যম কার্যালয়।
কার্যালয় আরও বলেছে, ইসরায়েলি বাহিনী গাজার অবরুদ্ধ অবস্থাকে ‘সাহায্য ও সহায়তার’ ছদ্মাবরণে মাদক পাচারের উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল পরিচালিত সহায়তা কেন্দ্রগুলোকে ‘মৃত্যুকূপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে তারা।
জিএইচএফের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) একটি বিতর্কিত মার্কিন-ইসরায়েলি সংস্থা। বর্তমানে গাজায় ত্রাণ বিতরণে যুক্ত রয়েছে সংস্থাটি। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকার অভিযোগে জিএইচএফের তীব্র সমালোচনা করেছে।
গত বুধবার ১৫টি মানবাধিকার ও আইনি সহায়তা সংস্থা জিএইচএফের কার্যক্রম স্থগিতের দাবি জানিয়েছে। তারা বলেছে, এ সংস্থা আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত করছে এবং গাজায় ফিলিস্তিনিদের ‘জবরদস্তিমূলক বাস্তুচ্যুতি’ ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কিংবা গণহত্যার মতো অপরাধে সহায়তা করে থাকতে পারে।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, জিএইচএফের কার্যক্রম চলাকালে গত এক মাসে সহায়তা কেন্দ্রগুলোর আশপাশে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে ৫১৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
শুক্রবার ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজ জানায়, ইসরায়েলি সেনারা স্বীকার করেছেন যে তারা জিএইচএফ পরিচালিত সহায়তা কেন্দ্রে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছেন। মিডল ইস্ট আই জিএইচএফের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চেয়েছে।
গাজায় অপুষ্টিতে ৬৬ শিশুর মৃত্যু
সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার প্রশাসনের অভিযোগ দুধ, পুষ্টিকর খাদ্য এবং অন্যান্য মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দেয়াতেই এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এক বিবৃতিতে গাজার মিডিয়া প্রশাসন জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই অবরোধ একটি যুদ্ধাপরাধ। বেসামরিক লোকদের নির্মূল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্যই এমন ঘটনা ঘটছে।
এদিকে গাজার তুফাহ, দেইর আল বালাহ, রাফা, খান ইউনিসসহ বেশ কয়েকটি এলাকাতেই চলছে ইসরায়েলি বিমান হামলা। গত শনিবার একদিনে নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন, তাদের বেশিরভাগই শিশু ও নারী।
আল জাজিরা বলছে, গত শনিবার ভোরে গাজা সিটির আল তুফাহ এলাকায় ইসরায়েলের ভয়াবহ বিমান হামলায় কেঁপে ওঠে চারপাশ। বিস্ফোরণের সময় গাজাবাসী আশ্রয় নিচ্ছিল জাফা স্কুলের পাশে একটি বহুতল ভবনে। ভবনটির তিনটি তলা একসঙ্গে ধসে পড়ে। এ ঘটনায় শিশুসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো অনেকে। পরিবারের আহাজারি আর ক্লান্তিমাখা চেহারায় শোকের আবহ ছড়িয়ে পড়ে উপত্যকাজুড়ে।
ফিলিস্তিনের স্টেডিয়ামের পাশে আরও একটি আশ্রয় কেন্দ্রে ইসরায়েলি বোমা হামলায় বেশ কয়েকজন হতাহত হন। হামলায় আহতদের অনেকেই শিফা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান।
তবে সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলেও চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কেননা হাসপাতালের অর্ধেক কর্মী এরমধ্যেই নিহত বা গুম হয়েছেন। এছাড়া দেইর আল বালাহতে দুপুরের দিকে একটি রাস্তায় বোমার আঘাতে একসঙ্গে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন।
এদিকে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যায় প্রায় ১ লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যা অঞ্চলটির মোট জনসংখ্যার প্রায় চার শতাংশ। সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি, গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরোক্ষ প্রভাব যেমন: ক্ষুধা, ঠান্ডা এবং রোগ-ব্যাধির কারণেও অনেক মানুষ মারা গেছে।
‘হামাসের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়ায় আছেন নেতানিয়াহু’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তির বিষয়ে আলোচনার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। একটি দীর্ঘ পোস্টে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে যুদ্ধের নায়ক হিসেবে উল্লেখ করে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন ট্রাম্প। দুর্নীতির মামলায় নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চলমান মামলার নিন্দাও জানিয়েছেন তিনি। ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন। শনিবার রাতের ওই পোস্টে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর প্রশংসা করেছেন।
তিনি বলেন, ইরানের বিপজ্জনক পারমাণবিক হুমকি থেকে মুক্তি পেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দুর্দান্ত কাজ করেছেন নেতানিয়াহু। ট্রাম্প বলেন, তিনি (নেতানিয়াহু) এখন হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন, যার মধ্যে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এদিকে ইরানে ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার পর নিজের দেশে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিষয়ে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। গত মার্চে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এমন একটি যুদ্ধবিরতির প্রক্রিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন যেটি সুফল বয়ে আনছিল। তার এই সিদ্ধান্তকে ওই সময় ‘রাজনৈতিক আত্মহত্যা’ বলে বর্ণনা করেছিলেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। এটি ছিল গাজা যুদ্ধবিরতি।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী রোববার উত্তর গাজা উপত্যকার এলাকা থেকে অধিবাসীদের সরে যেতে সতর্কতা জারি করেছে। এরমধ্যে গাজা শহরের কিছু অংশ এবং আশেপাশের এলাকার কিছু অংশও রয়েছে। হামাসের সাথে যুদ্ধের ২০ মাসেরও বেশি সময় ধরে সংঘাত চলছে।
জেরুজালেম থেকে এএফপি এ খবর জানায়।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র আভিচায় আদরাই উত্তর গাজার মানচিত্রের সাথে এক্স-এ এক পোস্ট করে এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাসিন্দাদের নিরাপত্তার জন্য ‘অবিলম্বে দক্ষিণে আল-মাওয়াসির দিকে নাগরিকদের সরে যেতে’। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সক্ষমতা ধ্বংস এবং তাদের প্রতিহত করার জন্য ইসরাইলি বাহিনী এই এলাকাগুলোতে তীব্র শক্তি প্রয়োগ করবে এবং সামরিক অভিযানগুলো তীব্র এবং প্রসারিত হবে’।
শনিবার মার্কিন সিনেটররা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘বিগ বিউটিফুল’ ব্যয় বিল নিয়ে বিতর্ক শুরু করেছেন। বিলটি একটি বিশাল বিভেদ সৃষ্টিকারী প্রস্তাব যা মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভ্যন্তরীণ এজেন্ডার মূল অংশগুলো অর্জন করবে এবং একই সাথে সমাজকল্যাণ কর্মসূচিতে ব্যাপক কাটছাঁট করবে।
ওয়াশিংট থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানায়।
ট্রাম্প ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ দিয়ে তার উত্তরাধিকার সিলমোহর করার আশা করছেন, যা তার মেয়াদ শেষ হওয়া প্রথম-মেয়াদী কর কর্তনকে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ে প্রসারিত করবে এবং সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করবে।
তবে, আগামী ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী কংগ্রেস নির্বাচনের দিকে নজর রাখা রিপাবলিকানরা এই প্যাকেজ নিয়ে বিভক্ত, যা লাখ লাখ দরিদ্র আমেরিকানদের স্বাস্থ্যসেবা কেড়ে নেবে এবং দেশের ঋণে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি যোগ করবে।
শনিবার গভীর রাতে রিপাবলিকান সমর্থকরা প্রক্রিয়াগত ভোট বিলম্বিত করার পর সিনেট আনুষ্ঠানিকভাবে বিলটির ওপর বিতর্ক শুরু করে। যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রাম্পের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ভোটাভুটির প্রথম আহ্বানের কয়েক ঘন্টা পরেই সিনেটররা ৫১-৪৯ ভোটে বিতর্ক শুরু করার প্রস্তাবটি পাস করেন, যেখানে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স তার নিজের দলের হোল্ডআউটদের সাথে আলোচনায় যোগ দেন।
অবশেষে, দুই রিপাবলিকান সিনেটর উদ্বোধনী বিতর্কে ‘না’ ভোট দিয়ে ৪৭ জন ডেমোক্র্যাটের সাথে যোগ দেন।
ট্রাম্প তার দলকে ৪ জুলাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের মধ্যে বিলটি পাস করার জন্য এবং স্বাক্ষর করার জন্য তার ডেস্কে রাখার জন্য চাপ দিয়েছেন।
ডেমোক্র্যাটরা আইনটির এবং ট্রাম্পের এজেন্ডার তীব্র বিরোধিতা করছেন এবং বিতর্ক চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারা বিতর্ক শুরু হওয়ার আগে বিলটির সম্পূর্ণ অংশ চেম্বারে জোর দিয়ে শোনানোর মাধ্যমে শুরু করেছিলেন।
বিলটি প্রায় ১ হাজার পৃষ্ঠা দীর্ঘ এবং এটি পড়তে আনুমানিক ১৫ ঘন্টা সময় লাগবে।
সিনেটের ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার বলেন, ‘বিলে কী আছে, রিপাবলিকানরা আমেরিকাকে তা জানাবে না, ‘তাই ডেমোক্র্যাটরা এটিকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে বাধ্য করছে। এটি পড়ার জন্য প্রয়োজনে আমরা সারা রাত এখানে থাকব।’
এই সপ্তাহের শুরুতে তেহরানের এভিন কারাগারে ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৭১ জন নিহত হয়েছে বলে রোববার ইরানের বিচার বিভাগ জানিয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, দুই চিরশত্রুর মধ্যে ১২ দিনের যুদ্ধ বিরতি শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর এ হামলা চালানো হয় বলে দাবি করেছে তেহরান।
বিচার বিভাগের মুখপাত্র আসগর জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ওই হামলায় এভিন কারাগারে ৭১ জন নিহত হয়েছে।’
১৩ জুন ইসরাইলের বোমা হামলা শুরু করলে সোমবার তেহরানের উত্তরে অবস্থিত ভারী সুরক্ষিত কমপ্লেক্সে ৭১ জন নিহত হয়।
ইসরাইলি বাহিনী শনিবার ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের বিধ্বস্ত অঞ্চলে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে নয়জন শিশুসহ ৩৭ জনকে হত্যা করেছে। গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা এ তথ্য জানায়। গাজা সিটি থেকে এএফপি এ খবর জানায়।
বেসামরিক প্রতিরক্ষা মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল এএফপিকে জানান, বিভিন্ন স্থানে সাতটি ইসরাইলি ড্রোন ও বিমান হামলায় ৩৫ জন এবং গাজার মধ্যাঞ্চলীয় নেটজারিম জোনে খাদ্য সহায়তার জন্য অপেক্ষা করার সময় ইসরাইলের গুলিতে আরও দুজন নিহত হয়েছে।
তিনি বলেন, নিহতদের মধ্যে গাজার উত্তরাঞ্চলীয় জাবালিয়ায় একটি বাড়িতে বিমান হামলায় তিনজন শিশু নিহত হয়।
বাসাল বলেন, গাজা নগরীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি পাড়ায় কমপক্ষে ছয় শিশু নিহত হয়েছে, একটি স্কুলের কাছে আশ্রয় নেওয়া কিছু বাস্তুচ্যুত মানুষও বিমান হামলায় নিহত হয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ইসরাইলি সেনাবাহিনী মন্তব্যের অনুরোধের জবাব দেয়নি।
গাজায় বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন-নোয়েল ব্যারোট শনিবার বলেছেন ‘তার দেশ ও ইউরোপ গাজায় খাদ্য বিতরণের নিরাপত্তায় অবদান রাখতে প্রস্তুত।’
তিনি আরও বলেন, এই ধরনের উদ্যোগ হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাহায্য পাওয়ার ইসরাইলি উদ্বেগেরও সমাধান করবে।
গাজার বেসামরিক নাগরিকদের সাহায্য বিতরণে ফ্রান্স কীভাবে সহায়তা করতে পারে সে সম্পর্কে ব্যারোট কোনও বিবরণ দেননি।
গাজায় গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ এবং অনেক এলাকায় প্রবেশের অসুবিধার কারণে এএফপি স্বাধীনভাবে মৃতের সংখ্যা এবং উদ্ধারকারীদের দেওয়া বিবরণ যাচাই করতে পারছে না।
এএফপির ছবিতে দেখা গেছে গাজা নগরীর আল-শিফা হাসপাতালে সাদা কাফন ও কম্বলে মোড়ানো কমপক্ষে দুই শিশু সহ সাতজনের মৃতদেহ ঘিরে শোকাহতরা কাঁদছেন।
গাজা নগরী থেকে ধারণ করা অন্যান্য এএফপির ফুটেজে দেখা গেছে, হামলার পর ভবনগুলো থেকে ধোঁয়ার মেঘ উঠছে।
জাবালিয়ায়, একজন এএফপির আলোকচিত্রী বেসামরিক প্রতিরক্ষা উদ্ধারকারীদের পিঠে রক্তাক্ত অবস্থায় একজন ব্যক্তিকে সাহায্য করতে দেখেছেন।
পূর্ব ইউক্রেনের কৌশলগত শহর পোকরভস্ক দখলের চেষ্টার অংশ হিসেবে রাশিয়া সেখানে ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনের সেনাপ্রধান জেনারেল ওলেকসান্দর সিরস্কি। তার মতে, এই বিপুল রুশ সেনা মোতায়েন স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, পোকরভস্ককে ঘিরে রাশিয়া তাদের আক্রমণাত্মক তৎপরতা জোরদার করছে। অঞ্চলটি দোনেৎস্ক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর এবং দীর্ঘদিন ধরেই রুশ বাহিনীর নজরে রয়েছে।
সেনাপ্রধান সিরস্কি শুক্রবার জানান, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলজুড়ে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সামরিক ফ্রন্টলাইনের মধ্যে সবচেয়ে উত্তপ্ত লড়াই চলছে পোকরভস্ক ঘিরে। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, পোকরভস্ক দখলের লক্ষ্যে এক বছর ধরে একের পর এক হামলা চালিয়ে আসছে রুশ বাহিনী। তবে প্রচুর পরিমাণে সেনা ও অস্ত্র মোতায়েন করলেও এখন পর্যন্ত এটি দখল করতে পারছে না মস্কো।
ইউক্রেনের প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং শহরটির প্রতিরক্ষাবলয়কে এর কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। পূর্ব ইউক্রেনের পোকরভস্ক শহরকে কৌশলগত লক্ষ্য মনে করে মস্কো। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তার লক্ষ্য হলো দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক—এই দুই পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল পুরোপুরিভাবে রুশ নিয়ন্ত্রণে আনা, যেগুলোর কিছু অংশ এরই মধ্যে রুশ বাহিনীর দখলে রয়েছে।
সম্প্রতি ইউক্রেন ও এর পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে শান্তি উদ্যোগ ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করার অভিযোগ এনেছেন। তাদের দাবি, এই বিলম্ব কৌশলগত; এর মাধ্যমে রুশ বাহিনী আরও ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড দখলের চেষ্টা করছে।
যদিও পোকরভস্ক বড় কোনো শহর নয়, তবুও এটি পূর্ব ইউক্রেনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। শহরটি এমন এক প্রধান সড়ক ও রেলপথের সংযোগস্থলে অবস্থিত, যা অঞ্চলটির অন্যান্য সামরিক কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে।
পোকরভস্ক, কোস্তিয়ান্তিনিভকা, ক্রামাতোরস্ক ও স্লোভিয়ানস্ক—এই চার শহর মিলে দোনেৎস্কের কিয়েভ-নিয়ন্ত্রিত অংশে ইউক্রেনের প্রধান প্রতিরক্ষাবলয় গড়ে তুলেছে। পোকরভস্ক শহরে একসময় প্রায় ৬০ হাজার মানুষ বাস করতেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর গত তিন বছরে তাদের বেশির ভাগই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।
এই পোকরভস্কেই ছিল ইউক্রেনের শেষ সক্রিয় কোকিং কয়লাখনি। কোকিং একধরনের বিশেষ কয়লা, যা উচ্চ তাপে তাপ দেওয়ার পর কোকে পরিণত হয়। কোক প্রধানত ইস্পাত উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধ শুরু হলেও ওই খনির শ্রমিকের অনেকে শহর ছেড়ে যাননি, কারণ এটি সচল রাখতে তাদের দরকার ছিল। তবে চলতি বছরের শুরুতে খনিটি বন্ধ হয়ে গেলে তারাও একে একে শহর ত্যাগ করতে শুরু করেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংঘাত পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) গত বছরের শেষ দিকে জানিয়েছিল, পোকরভস্কে ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষামূলক তৎপরতা এতটাই শক্তিশালী যে, রুশ বাহিনী শহরটি সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে দখলের প্রাথমিক পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।
সামনাসামনি হামলা করে পোকরভস্ক দখলের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায়, রাশিয়া তাই এখন বিকল্প কৌশল গ্রহণ করেছে।
গাজায় চলমান যুদ্ধে প্রায় এক লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যা ভূখণ্ডটির মোট জনসংখ্যার প্রায় চার শতাংশ। ইসরায়েলের প্রভাবশালী দৈনিক হারেৎজ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
এই পরিসংখ্যান গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৩০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। হারেৎজ জানায়, শুধু ইসরায়েলি হামলায় নয়, গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে ক্ষুধা, ঠাণ্ডা ও রোগবালাইয়ের কারণেও বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা গেছেন।
পত্রিকাটি লিখেছে, ইসরায়েলি মুখপাত্র, সাংবাদিক ও প্রভাবশালীরা গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যকে বরাবরই অস্বীকার করে অতিরঞ্জন বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংখ্যা অতিমাত্রায় নয়, বরং বাস্তবের তুলনায় রক্ষণশীল হিসাব।
হারেৎজ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব হোলোওয়ের অর্থনীতিবিদ ও সংঘাতজনিত মৃত্যু নিয়ে গবেষণার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মাইকেল স্প্যাগাট গাজায় মৃত্যুর হার নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এতে গাজার দুই হাজার পরিবার অর্থাৎ প্রায় ১০ হাজার মানুষ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত গাজায় ৭৫ হাজার ২০০ মানুষ সরাসরি সহিংস মৃত্যুর শিকার হয়েছেন, যার বেশিরভাগই ইসরায়েলি অস্ত্রের কারণে। এই মৃত্যুর মধ্যে ৫৬ শতাংশই শিশু ও নারী। হারেৎজ বলেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় সব সংঘাতে এ ধরনের উচ্চ নারী-শিশু মৃত্যুহার বিরল।
প্রফেসর স্প্যাগাট গাজাযুদ্ধকে তিনি ২১ শতকের অন্যতম রক্তক্ষয়ী সংঘাত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সিরিয়া, ইউক্রেন ও সুদানের তুলনায় গাজায় নাগরিক ও সামরিক বাহিনীর নিহতের অনুপাত এবং জনসংখ্যার হারে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি।
তথ্য অনুযায়ী, সহিংস মৃত্যুর শিকার হওয়া নারীদের ও শিশুদের অনুপাত গাজায় ৫০ শতাংশের বেশি, যেখানে কসোভোতে তা ছিল ২০ শতাংশ, উত্তর ইথিওপিয়ায় ৯ শতাংশ, সিরিয়ায় ২০ শতাংশ ও সুদানে ২৩ শতাংশ। স্প্যাগাট বলেন, আমার ধারণা গাজার প্রায় ৪ শতাংশ জনসংখ্যা নিহত হয়েছে। ২১ শতকে এর চেয়ে বেশি জনসংখ্যার অনুপাতে মৃত্যু আর কোথাও ঘটেনি।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েল গাজায় চরম সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে, যা আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান সত্ত্বেও অব্যাহত রয়েছে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে সুখবর দিলেন ট্রাম্প
ভারত-পাকিস্তান ও ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের ইতি ঘটিয়ে এবার যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার সংঘাত নিরসনের সুখবর দিলেন ট্রাম্প। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে মনে করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে শুক্রবার কঙ্গো-রুয়ান্ডা চুক্তি নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
ট্রাম্প বলেন, তার বিশ্বাস, গাজায় এখন একটি যুদ্ধবিরতি খুব কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে। এ সংঘাত বন্ধে যারা কাজ করছেন, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে সদ্যই তার কথা হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি বিষয়ে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বলেছে, যুদ্ধ শেষ করার যেকোনো চুক্তির আওতায় গাজায় থাকা অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দিতে তারা প্রস্তুত। তবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুদ্ধ তখনই শেষ হবে, যখন হামাসকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ও বিলুপ্ত করা যাবে। অবশ্য হামাস অস্ত্র সমর্পণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় অব্যাহতভাবে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৫৬,৩৩১ পৌঁছেছে। আর আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৩২ হাজার ৬৩২ জন ফিলিস্তিনি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। এদিন তারা ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যার পাশাপাশি ২৫১ জনকে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে যায়।
হামাসের হামলার জবাব দিতে এবং জিম্মিদের মুক্ত করতে ওইদিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা অভিযান চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী দেশের মধ্যস্থতায় গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
কিন্তু বিরতির দুমাস শেষ হওয়ার আগেই গত ১৮ মার্চ থেকে ফের গাজায় অভিযান শুরু করে আইডিএফ। দ্বিতীয় দফার এ অভিযানে গত আড়াই মাসে গাজায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ৮ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন আরও ২০ হাজার ৫৯১ জন।
গাজায় মার্কিন-ইসরায়েলি ত্রাণের আটার বস্তায় আফিমজাত ট্যাবলেট
গাজায় যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল পরিচালিত ‘বিতর্কিত’ ত্রাণ সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) মাধ্যমে বিতরণ করা আটার বস্তায় আফিমজাত মেডিসিন অক্সিকোডন ট্যাবলেট পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদোলু, মিডল ইস্ট আই এবং ডেইলি সাবাহর প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানায়, ‘আমরা এখন পর্যন্ত চারজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি, যারা এই ট্যাবলেটগুলো আটার বস্তার ভেতর পেয়েছেন। সম্ভবত এই মাদকদ্রব্যগুলোর কিছু অংশকে গুঁড়ো করে ইচ্ছাকৃতভাবে আটার মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
মিডল ইস্ট আই বলছে, অক্সিকোডন একটি অপিওয়েড (আফিমজাতীয় ওষুধ), যা তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা উপশমের কাজ করে এবং সাধারণত ক্যানসার রোগীদের এই ওষুধ সেবন করতে দেওয়া হয়। এই ওষুধটি অত্যন্ত আসক্তিকর এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা ও দৃষ্টিবিভ্রমসহ প্রাণঘাতী প্রভাব ফেলতে পারে।
একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ত্রাণের আটার বস্তায় অক্সিকোডন ট্যাবলেট পাওয়ার ছবি ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে বিবৃতি দেয় গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস। ফিলিস্তিনি ফার্মাসিস্ট ওমর হামাদ এ ঘটনাকে ‘গণহত্যার সবচেয়ে নিকৃষ্ট রূপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ব্রিটেনের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সম্প্রসারণের পেছনে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অভিবাসনেরও প্রভাব রয়েছে। দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয়ের (অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস বা ওএনএস) সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্য অনুসারে এই খবর জানা গেছে।
২০২২ সালের মাঝামাঝি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে পরবর্তী দশ বছরের একটি পূর্বাভাস দিয়েছে ওএনএস। সেখানে দেখা গেছে, লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকায় ২০৩২ সাল নাগাদ প্রায় ২০ দশমিক ৩৮ শতাংশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি হতে পারে। সে অনুযায়ী, ২০২২ সালে জরিপকৃত জনসংখ্যা তিন লাখ ২৩ হাজার ৮৫৪ জন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে তা তিন লাখ ৮৯ হাজার ৮৪৫ জনের পৌঁছাতে পারে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এখানে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রায় ৩৩ শতাংশ মানুষের বাস।
টাওয়ার হ্যামলেটসের বাইরেও লন্ডনের অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। আর্সেনাল ফুটবল ক্লাবের জন্য বিখ্যাত ইসলিংটনে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে দুই লাখ ১৯ হাজার ৫৯৪ থেকে বেড়ে ২০৩২ সালের মাঝামাঝি সময়ে দুই লাখ ৪৮ হাজার ৮১৮ জনে উন্নীত হবে। ২০২১ সালের ওএনএস তথ্য অনুসারে, ইসলিংটনের ২ দশমিক ৮ শতাংশ বাসিন্দা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।
একইভাবে, প্রাণবন্ত বাজারের জন্য পরিচিত ক্যামডেনের জনসংখ্যা ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যা ২০২২ সালে দুই লাখ ১৭ হাজার ৩৬৫ থেকে বেড়ে ২০৩২ সালের মধ্যে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৫১ জনে দাঁড়াবে। ২০২১ সালে সেখানকার ২ দশমিক ৮ শতাংশ ছিলেন বাংলাদেশি।
বৃদ্ধির নেপথ্যে জন্মহার এবং ইউরোপীয় অভিবাসন
ব্রিটিশ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। যদিও যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশ বাংলাদেশি জাতিগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট জন্মহারের বিস্তারিত তথ্য সরকারিভাবে প্রকাশিত ওএনএস ডেটাতে ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায় না, তবে বৃহত্তর পরিসংখ্যান একটি চিত্র তুলে ধরে। ২০২২ সালে, যুক্তরাজ্যে জন্ম নেওয়া সাত হাজার সাতটি নবজাতকের মা ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। জন্মসূত্রে যুক্তরাজ্যের নাগরিক নন, এমন মায়েদের তালিকার বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে মোট জন্মের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তাদের দ্বারা হয়েছে। এটি যুক্তরাজ্যের অন্যান্য কিছু জনসংখ্যাগত গোষ্ঠীর তুলনায় তুলনামূলকভাবে উচ্চ জন্মহার নির্দেশ করে।
২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক হলেও তাদের সংখ্যাটি ছয় লাখ ৪৪ হাজার ৮৮১ জন। ২০০১ সালে যা ছিল দুই লাখ ৮৩ হাজার ৬৩ জন। অর্থাৎ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই বৃদ্ধির পেছনে আরেকটি কারণ হলো ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে যুক্তরাজ্যে বসতি স্থাপনকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা বৃদ্ধি। ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া) পূর্ববর্তী ইইউ'র অবাধ চলাচল এবং ইইউ সেটেলমেন্ট স্কিমে জাতিগত ভিত্তিতে তথ্য বিভাজন না করায় এই নির্দিষ্ট অভিবাসন পথের সঠিক ও হালনাগাদ পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। তবে, পূর্ববর্তী প্রতিবেদনগুলো একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা নির্দেশ করে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালের কিছু বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল যে গত পাঁচ বছরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ৫০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা যুক্তরাজ্যে বসতি স্থাপন করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ। এদের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার এসেছেন ইতালি থেকে। এই প্রবণতা প্রায়শই উন্নত সুযোগ এবং যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ের নেটওয়ার্কের সন্ধানে চালিত হয়েছিল। এদের মধ্যে অনেকেই ইইউ সেটেলমেন্ট স্কিমের অধীনে সেটলড বা প্রি-সেটলড স্ট্যাটাসের জন্য আবেদন করেছেন।
২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত, ইইউ সেটেলমেন্ট স্কিমে ৬৩ লাখ ব্যক্তির জন্য ৮৪ লাখ আবেদন জমা পড়েছে, যার মধ্যে ৪১ লাখকে সেটলড স্ট্যাটাস এবং ২৯ লাখকে প্রি-সেটলড স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে। যদিও এই পরিসংখ্যান আবেদনকারীদের জাতিসত্তা অনুসারে বিভক্ত নয়, তবে এটা বোঝা যায় যে ইউরোপীয় পাসপোর্টধারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তি এই আবেদন প্রক্রিয়ার অংশ ছিলেন।
ওএনএস আরও উল্লেখ করে যে, যদিও ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ অংশে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন জনসংখ্যা পরিবর্তনের প্রধান কারণ, তবে লন্ডনের মতো অনেক শহুরে এলাকায় আন্তর্জাতিক অভিবাসনই মূল চালিকাশক্তি। এটি টাওয়ার হ্যামলেটসের পূর্বাভাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে বেশিরভাগ জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিদেশ থেকে আসা মানুষের কারণে ঘটছে।
ওএনএসের পূর্বাভাস অনুসারে, লন্ডনে তরুণদের অনুপাত কমতে থাকবে, যখন প্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়বে। এই জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ইতোমধ্যেই লন্ডনের জুড়ে পরিকল্পিত স্কুল বন্ধের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, যার মধ্যে ইসলিংটনে দুটি, ল্যাম্বেথে চারটি এবং হ্যাকনিতে ছয়টি স্কুল বন্ধ রয়েছে, যা মূলত শিক্ষার্থী সংখ্যা হ্রাসের কারণে ঘটছে। এটি টাওয়ার হ্যামলেটস, ক্যামডেন এবং ইসলিংটনের মতো দ্রুত বর্ধনশীল ব্রিটিশ বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় পরিবার এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পরিষেবাগুলোর চলমান চাহিদার বিপরীত চিত্র তুলে ধরে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুক্রবার দাবি করেছেন, তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু তার কৃতজ্ঞতার অভাব দেখিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন, যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে অগ্রসর হয়, তাহলে আবারও বোমা হামলা চালানো হবে।
ওয়াশিংটন থেকে এএফপি জানায়, ট্রাম্পের নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ দেওয়া এক বিস্ফোরক বিবৃতিতে তিনি তেহরানের ‘যুদ্ধজয়’ দাবি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিলের কাজ বন্ধ করার ঘোষণা দেন।
এই বক্তব্য এমন এক সময়ে এসেছে, যখন ইরান ইসরাইলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে নিহত প্রায় ৬০ জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে শেষকৃত্যানুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
ইরান বলেছে, নিহত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আরও অন্তত ৬২৭ জন বেসামরিক নাগরিকও এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন।
ট্রাম্প বলেন, ‘ইরান সামরিক মানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে, এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া গেলে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই আবার ‘বিনা প্রশ্নে’ বোমা হামলা চালাবে।’
যদিও ইরান সব সময়ই পরমাণু অস্ত্র তৈরির অভিপ্রায় অস্বীকার করে আসছে।
ট্রাম্প বলেন, খামেনেয়ী যুক্তরাষ্ট্রকে ‘চড়’ মারার কথা বলেছেন এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি ‘অতিরঞ্জিত’ বলেই দাবি করেছেন। এ প্রসঙ্গে ট্রাম্প অভিযোগ করেন, খামেনেয়ী তার প্রতি অকৃতজ্ঞ আচরণ করেছেন।
তিনি লেখেন, ‘আমি জানতাম তিনি কোথায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, এবং আমি ইসরইল কিংবা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর হাতে তার জীবন শেষ হতে দিইনি।’
‘আমি তাকে এক জঘন্য ও অপমানজনক মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছি। এবং তিনি আমাকে ‘ধন্যবাদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প!’ বলতেই চাইলেন না।’
ট্রাম্প আরও জানান, তিনি সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করছিলেন। কিন্তু এখন তা থেকে সরে এসেছেন।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু না, বরং আমি পেয়েছি ক্ষোভ, ঘৃণা ও ঘৃণাসূচক বক্তব্য এবং সঙ্গে সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কাজসহ সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছি।’ তিনি ইরানকে পুনরায় আলোচনার টেবিলে ফিরতে আহ্বান জানান।
ট্রাম্প দাবি করেন, ইরানের সঙ্গে আবারও পরমাণু আলোচনা শুরু হতে যাচ্ছে। তবে ইরান সরকার তা অস্বীকার করেছে।
জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু ইরান তা প্রত্যাখ্যান করে জানায়, এতে ‘অসৎ উদ্দেশ্য’র ইঙ্গিত রয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি গ্রোসিকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে এক্স (পূর্বতন টুইটার)-এ বলেন, হামলার বিরুদ্ধে গ্রোসি কোনো মন্তব্য না করায় তিনি তার দায়িত্বের ‘রীতিমতো বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছেন।
শুক্রবার হোয়াইট হাউস সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ না হলে তিনি কি আবারও বিমান হামলার কথা বিবেচনা করবেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই, নিঃসন্দেহে।’
তিনি আরও বলেন, ‘খামেনেয়ী এবং ইরানকে আমরা দফায় দফায় পরাজিত করেছি।’
এমন উত্তপ্ত বাক্যযুদ্ধের মধ্যেই ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের পর সম্পাদিত অস্ত্রবিরতির বাস্তবায়ন চলছে।
অস্ত্রবিরতির পর খামেনেয়ীর প্রথম প্রকাশ্য বক্তব্য ছিল বৃহস্পতিবারের এক টেলিভিশন ভাষণ।
সেখানে খামেনেয়ী বলেন, ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরান বিজয় অর্জন করেছে এবং তিনি কখনও যুক্তরাষ্ট্রের চাপে নতি স্বীকার করবেন না।
তিনি বলেন, ‘আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যেভাবে ঘটনাবলী অতিরঞ্জিত করেছেন, তা প্রমাণ করে যে তিনি নিজেই এই অতিরঞ্জনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন।’
মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর ‘অন্যায় কর’ আরোপের অভিযোগ এনে কানাডার সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কানাডার নতুন এই ডিজিটাল করকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সরাসরি ও প্রকাশ্য আক্রমণ বলে অভিহিত করেছেন তিনি।
শুক্রবার (২৭ জুন) রাতে ট্রাম্প ব্যক্তিগত সামাজিকমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালের এক পোস্টে বলেন, ‘কানাডা খুবই কঠিন এক বাণিজ্যিক অংশীদার। এখন দেশটি আমাদের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর ডিজিটাল কর বসাচ্ছে। এটি আমাদের দেশের ওপর সরাসরি ও স্পষ্ট আক্রমণ।’
তিনি বলেন, ‘তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইউ) পথ অনুসরণ করছে। ইউ একই কাজ করেছিল এবং বর্তমানে তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছে। এই অনৈতিক করের কারণে, আমরা কানাডার সঙ্গে সমস্ত বাণিজ্য আলোচনা এখনই বাতিল করছি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে তাদের কী পরিমাণ শুল্ক দিতে হবে, তা আগামী সাত দিনের মধ্যে কানাডাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।’
যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দুর্লভ খনিজ সরবরাহ নিয়ে সফল চুক্তির ঘোষণা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরেই দেশটির শেয়ার বাজারে ব্যপক উন্নতি দেখা গেছে। এর মাঝেই ট্রাম্পের কানাডা বিষয়ক ঘোষণাটি এল।
এর আগে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি চলতি মাসে অ্যালবার্টায় অনুষ্ঠিত জি৭ সম্মেলনে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর বলেছিলেন, ‘আগামী ৩০ দিনের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা এগিয়ে নিতে দুই দেশই সম্মত হয়েছে।’
তবে আগামী সোমবার থেকে কার্যকর হতে যাওয়া কানাডার নতুন ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স নিয়ে আলোচনার অগ্রগতি থমকে গেছে। এতে গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট, অ্যামাজন, মেটাসহ মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টদের বছরে আনুমানিক ৩০০ কোটি ডলার গুনতে হতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে উত্তর আমেরিকার দুই বড় অর্থনীতি ও অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক সহযোগী বা অংশীদারের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হলো বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।