ঢাকায় ২০১৪ সালে চার বছর বয়সী জিহাদের গভীর নলকূপের পাইপে পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে ভিয়েতনামে। সেখানে ১০ বছর বয়সী এক শিশু নির্মাণাধীন একটি সেতুর কংক্রিট পাইলের (খুঁটি) খাদে পড়ে গেছে। প্রায় ৩৫ মিটার গভীর ওই খাদ থেকে তাকে বের করে আনতে তিন দিন ধরে রুদ্ধশ্বাস তৎপরতা চালাচ্ছেন শতাধিক উদ্ধারকর্মী।
ভিয়েতনামের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ দং থাপের একটি সেতু নির্মাণস্থলে শনিবার নববর্ষের সকালে লোহা বা রডের টুকরো খুঁজতে গিয়ে শিশুটি ওই খাদে পড়ে যায়। তার নাম থাই লি হাও ন্যাম।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, শনিবার দুর্ঘটনাটির খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে ছুটে আসে উদ্ধারকারী দল। পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু হাও ন্যাম সাহায্য চেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে বাড়ে উদ্ধারকারীর সংখ্যা। এখন ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী, পুলিশ, চিকিৎসাকর্মী, সড়ক ও সেতু বিশেষজ্ঞসহ শতাধিক উদ্ধারকর্মী শিশুটিকে বের করে আনতে ঘাম ঝরাচ্ছেন। রাখা হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম। তবে খাদে পড়ে থাকা শিশুটির এখন কোনো সাড়া মিলছে না। ভেতরে ক্যামেরা পাঠিয়ে তার অবস্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন উদ্ধারকারীরা।
দং থাপ প্রদেশের পরিবহন বিভাগের পরিচালক লে হোয়াং বাও সংবাদমাধ্যমকে বলেন, মাত্র ১০ ইঞ্চি পুরু ওই পাইলের খাদ দিয়ে শিশুটি কীভাবে ভেতরে পড়লো তা আমি বুঝতে পারছি না।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ক্রেন ও এক্সাভেটর দিয়ে পাইলটি তোলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ফল মেলেনি। উদ্ধারকারীরা এখন পর্যন্ত শিশুটির অবস্থানই চিহ্নিত করতে পারেননি।
উদ্ধারকারী দল বিশেষ পন্থায় ভেতরে অক্সিজেন সরবরাহ করছে। পাশাপাশি পাইলের আশপাশের মাটি নরম করার চেষ্টা করছে, যাতে পাইলটি ওপরের দিকে উঠে যেতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন তৎপরতার কারণে পাইলটি কিছুটা কাঁত হয়ে গিয়ে উদ্ধার কার্যক্রমকে জটিল করে ফেলেছে।
সাউ নামে একজন উদ্ধারকারী মোবাইল ফোনে সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘আমরা উদ্ধারের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু এখনো শিশুটির অবস্থা বলতে পারছি না।’
সোমবার প্রধানমন্ত্রী ফাম মিন চিন শিশুটিকে বের করে আনতে স্থানীয় উদ্ধারকারীদের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে কেন্দ্রীয় সংস্থাকেও নির্দেশ দিয়েছেন।
ঢাকায় জিহাদের যে ঘটনা ঘটেছিল
২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহজাহানপুর রেল কলোনিতে খোলা থাকা কয়েকশ ফুট গভীর এক নলকূপের পাইপে পড়ে যায় চার বছরের জিহাদ। প্রায় ২৩ ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস অভিযান চালায় ফায়ার সার্ভিস। অনেক নিচে ক্যামেরা নামিয়েও কোনো মানুষের ছবি না পাওয়ায় পাইপে জিহাদের অস্তিত্ব থাকা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। ওই সন্দেহের মধ্যেই উদ্ধার অভিযান স্থগিতের ঘোষণা দেয়া হয়।
কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েকজন তরুণের তৎপরতায় তৈরি করা যন্ত্রে পাইপের নিচ থেকে উঠে আসে অচেতন জিহাদ। কিন্তু হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা জানান, শিশুটি বেঁচে নেই।
এ ঘটনা দেশ-বিদেশে আলোচনা তৈরি করেছিল। ঘটনাস্থলে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি অনেক স্বেচ্ছাসেবী জিহাদকে জীবিত বের করে আনার চেষ্টা করেছে। টেলিভিশনের সামনে বসে উদ্ধার অভিযানে চোখ রেখেছিল দেশবাসী। ওই ঘটনায় জিহাদের বাবা অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর অভিযোগ এনে শাহজাহানপুর থানায় মামলা করলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
ইরান-ইসরায়েলের ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ থেমেছে, কিন্তু ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার মানুষের ভাগ্য এখনো পরিবর্তন হয়নি। তবে সেই সম্ভাবনা নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে। গাজায় নতুন যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতাকারীরা জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামসের এক কর্মকর্তা। এদিকে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের দাবি, চুক্তির ‘খুব কাছাকাছি’ রয়েছে হামাস ও ইসরায়েল। এদিকে বুধবার সকালে ইসরায়েলের হামলায় আরো বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহতের খবর পাওয়া গেছে। তাদের অনেকেই ত্রাণ সংগ্রহের অপেক্ষায় ছিলেন বলে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। অন্যদিকে মঙ্গলবার হামাসের দাবি করা বোমা হামলায় সাত ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
হামাস জানিয়েছে, গাজায় নতুন যুদ্ধবিরতি ও বন্দি ফেরতের বিষয়ে আলোচনা করতে তোড়জোড় করছেন মধ্যস্থতাকারীরা। তবে, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
ইসরায়েল ও ইরানের ১২ দিনের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘গাজা নিয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে’। ব্রাসেলসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের এই (ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায়) আক্রমণের কারণেই গাজায় বড় অগ্রগতি হচ্ছে। আমি মনে করি আমরা শিগগিরই ভালো কিছু শুনতে পাব।
তিনি জানান, তার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে কথা হয়েছে এবং তিনি বলেছেন, ‘গাজায় সমঝোতা খুবই কাছাকাছি।’এর কিছুক্ষণ পরই হামাসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, মধ্যস্থতাকারীরা যুদ্ধবিরতি নিয়ে জোরালো প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে এখনও নতুন কোনো প্রস্তাব আসেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ইসরায়েলের এক কর্মকর্তা দেশটির সংবাদমাধ্যম হারেৎজকে জানিয়েছেন, আলোচনায় এখনও কোনো অগ্রগতি নেই এবং বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়ে গেছে।
এর আগে, মে মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের সমর্থনে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তাতে হামাস গ্রহণযোগ্য নয়—এমন কিছু সংশোধনী দাবি করলে আলোচনা স্থবির হয়ে যায়। ইসরায়েল ১৮ মার্চ গাজায় আবারও সামরিক অভিযান শুরু করে। বর্তমানে সেখানে অন্তত ৫০ জন ইসরায়েলি জিম্মি রয়েছে, যাদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জন জীবিত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সেই সঙ্গে মার্চের শুরু থেকে ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের মানবিক সহায়তা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তিন মাস পর এটি আংশিক শিথিল করা হয়। এরপর ইসরায়েলের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচটি) নামে নতুন ত্রাণ বিতরণ কাঠামো চালু হয়েছে।
জিএইচটি দাবি করেছে, ২৬ মে থেকে এখন পর্যন্ত তারা ৪ কোটি ৪০ লাখের বেশি খাবারের প্যাকেজ বিতরণ করেছে। এমনকি, বুধবার ৩টি কেন্দ্রে ২৪ লাখের বেশি খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। নতুন এই ত্রাণ ব্যবস্থার সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা। হামাসকে সহায়তা না দিয়ে ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর এই বিষয়টিকে তারা মানবিক নীতিমালার পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জিএইচটি কার্যক্রম শুরুর পর থেকে ত্রাণ সংগ্রহের সময় ৫৪৯ জন নিহত এবং ৪ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। বুধবারও কেন্দ্রীয় গাজায় জিএইচটির একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ইসরায়েলি গুলিতে ছয়জন এবং দক্ষিণের রাফায় আরও তিনজন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে হামাসের সিভিল ডিফেন্স। তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, এসব ঘটনায় তারা কোনো হতাহতের খবর পায়নি।
ইউনিসেফের মুখপাত্র জেমস এল্ডার গাজা সফর শেষে বলেন, যতদিন মানুষকে খাবার থেকে বঞ্চিত করা হবে, তারা এই মৃত্যুফাঁদে যেতে বাধ্য হবে।
গাজায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে গুলি, নিহত ৩৩
গাজায় আবারও ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ ঝরল ফিলিস্তিনিদের। ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র ও আশপাশের এলাকায় জড়ো হওয়া ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর উপর গুলি চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে অন্তত ৩৩ জন নিহত হয়েছেন।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বাহিনী গাজার বিভিন্ন এলাকায় হামলা অব্যাহত রাখলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, উপত্যকায় যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে বড় অগ্রগতি হচ্ছে। কাতার জানিয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনায় বসতে পারে ইসরাইল ও হামাস। আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুধবার গাজাজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৭৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। যাদের মধ্যে ৩৩ জনই ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে অপেক্ষা করার সময় প্রাণ হারান।
স্থানীয় হাসপাতালগুলো বলছে, ত্রাণ নিতে যাওয়া মানুষদের লক্ষ্য করে হামলা অব্যাহত রয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গত ২৭ মে থেকে এ পর্যন্ত এমন হামলায় সাড়ে পাঁচশ’র বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘ বলছে, এসব সহায়তা কেন্দ্র এখন মৃত্যুকেন্দ্রে রূপ নিয়েছে।
এদিন গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বাসিন্দাদের আশ্রয় নেয়া ভবন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কোনো আগাম সতর্কতা ছাড়াই ভবনটি গুঁড়িয়ে দেয় ইসরাইলি সেনারা। হামলায় ধসে যায় ভবনের ছাদ। নিচে চাপা পড়েন অনেকে। উদ্ধারকারীরা বলছেন, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় তারা হাতে খুঁড়েই মরদেহ উদ্ধারে বাধ্য হচ্ছেন।
এদিকে গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেই কূটনৈতিক আলোচনায় গতি এসেছে। বুধবার কাতার জানায়, কয়েকদিনের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনায় বসতে পারে ইসরায়েল ও হামাস। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন জানিয়েছে, এ বিষয়ে কাতার ও মিসরের সঙ্গে আলোচনা চলছে, যদিও কোনো নতুন প্রস্তাব এখনও আসেনি।
ইরানে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ বোমা হামলা, যুদ্ধবিরতি, কূটনৈতিক আলোচনা- সব কিছুতেই উত্তাল মধ্যপ্রাচ্য। এর মধ্যেই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির এক সপ্তাহেরও বেশি সময় জনসমক্ষে অনুপস্থিত থাকা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা, উদ্বেগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের এক উপস্থাপক পর্যন্ত সম্প্রচারে প্রশ্ন তুলে দেন: মানুষ খুব উদ্বিগ্ন, তারা জানতে চায়- আয়াতুল্লাহ খামেনি কেমন আছেন? এই প্রশ্ন আজ ইরানের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে ক্ষমতার মঞ্চেও ঘুরপাক খাচ্ছে।
খামেনির দপ্তরের আর্কাইভ প্রধান মেহেদি ফাজায়েলি এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য না দিয়ে বলেন, আমার কাছেও অনেক ফোন এসেছে, সবাই চিন্তিত। আমরা সবাই দোয়া করছি। নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের সর্বোচ্চ নেতার সুরক্ষায় যথাযথ কাজ করছে। ইনশাআল্লাহ, জনগণ তার পাশে দাঁড়িয়ে বিজয় উদযাপন করবে।
বিস্ময়করভাবে, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলা, কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও ট্রাম্প-উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির পুরো সময়জুড়ে খামেনির কোনো ভিডিও, অডিও বা লিখিত বক্তব্য আসেনি।
সরকারি সূত্র বলছে, খামেনি একটি সুরক্ষিত বাঙ্কারে অবস্থান করছেন ও যেকোনো সম্ভাব্য ইসরায়েলি গুপ্তহত্যা রোধে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ থেকেও বিরত রয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও খামেনির উপদেষ্টা হামজেহ সাফাভি বলেন, ইরানি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন, ইসরায়েল এখনো খামেনিকে হত্যা করার চেষ্টা করতে পারে, এমনকি যুদ্ধবিরতির সময়েও। তাই এখন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বাইরের জগৎ থেকে যোগাযোগে কঠিন বিধিনিষেধ। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয় রাজনৈতিক অভ্যন্তরীণ মহল।
খানেমান পত্রিকার সম্পাদক মোহসেন খালিফে বলেন, কয়েকদিন ধরে খামেনির অনুপস্থিতি আমাদের, যারা তাকে ভালোবাসি, তাদের সবাইকে খুবই চিন্তিত করে তুলেছে। যদি সত্যি তিনি মারা যান, তবে তার জানাজা হবে ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময়।
যেহেতু খামেনিই সামরিক সিদ্ধান্তে চূড়ান্ত স্বাক্ষরকারী, তাই ইসরায়েল বা আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ বা যুদ্ধবিরতির মতো বড় সিদ্ধান্ত তার অনুমোদন ছাড়া হওয়া অসম্ভব। প্রশ্ন উঠছে- এই সিদ্ধান্তগুলোতে তিনি আদৌ যুক্ত ছিলেন কি না?
আশুরায় খামেনির উপস্থিতির গুরুত্ব
চ্যাটহ্যাম হাউজের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, খামেনির অনুপস্থিতি প্রমাণ করে ইরানের নেতৃত্ব নিরাপত্তা বিষয়ে কতটা সতর্ক। তবে আশুরার দিনে তিনি যদি না আসেন, তা হবে খুবই খারাপ বার্তা।
আসন্ন আশুরা (জুলাইয়ের শুরু) অনেকাংশেই হয়ে উঠেছে খামেনির রাজনৈতিক জীবিত-বোধের পরীক্ষামূলক দিন। কারণ বহু সমর্থক বলছে, তারা ততক্ষণ যুদ্ধজয়ের আনন্দ উদযাপন করবে না, যতক্ষণ না খামেনিকে নিজের চোখে দেখে বা কণ্ঠে শোনেন।
পরিবর্তনের ডাক ও রাজনৈতিক বিভক্তি
ইরানের চারজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, খামেনির অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক ও সামরিক অভিজাতদের মধ্যে জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। অনেকে কূটনৈতিক সমঝোতার পথে হাঁটতে চাইলেও, কেউ কেউ কঠোর অবস্থান বজায় রাখতে চাইছেন। এই মুহূর্তে মধ্যপন্থি একটি পক্ষ এগিয়ে আছে। এদের নেতৃত্বে আছেন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। তিনি বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার পক্ষে ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই পক্ষের মিত্রদের মধ্যে রয়েছেন বিচার বিভাগের প্রধান গোলাম-হোসেইন মোহসেনি-এজেই ও সেনাবাহিনীর নতুন প্রধান মেজর জেনারেল আবদুর রহিম মুসাভি। গত বুধবার এক মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান বলেন, যুদ্ধ ও জনগণের ঐক্য আমাদের শাসনব্যবস্থা এবং কর্মকর্তাদের আচরণে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখিয়েছে। এটি একটি স্বর্ণালী সুযোগ।
সরকার যুদ্ধকালে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদী আবেগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। উদাহরণ স্বরূপ, আজাদি স্কয়ারে জাতীয় সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার পারফরম্যান্স ও জরুরি সেবাকর্মীদের সম্মানে লাইট শো অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে পেজেশকিয়ানের এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন কট্টর রক্ষণশীল রাজনীতিক সাঈদ জালিলি। তার নেতৃত্বাধীন একটি গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পেজেশকিয়ানের আলোচনার আগ্রহকে ‘রাজনৈতিক অযোগ্যতা’ আখ্যা দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর কিছু অংশ ও সংসদের বেশিরভাগ সদস্য এই কট্টরপন্থি শিবিরের ঘনিষ্ঠ।
জালিলির ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফোয়াদ ইজাদি সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, এই মুহূর্তে আলোচনা শুরু করার কথা বলায় প্রেসিডেন্ট প্রমাণ করেছেন, তার হাতে দেশের শাসনভার দেওয়ার মতো রাজনৈতিক দক্ষতা নেই। প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র আলি আহমাদনিয়া পাল্টা জবাবে বলেন, আমরা ১২ দিন ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি, এখন আপনাদের মতো লোকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেই হবে? আপনারা কলম দিয়ে শত্রুর কাজ সহজ করছেন।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ভবিষ্যৎ
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি ও পারমাণবিক সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি বলেছেন, ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় গড়ে তুলবে ও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ অব্যাহত রাখবে।
ইসরাইলি কমান্ডোরা ১২ দিনের যুদ্ধ চলাকালে ইরানের অভ্যন্তরে গোপনে কাজ করেছে। ইসরাইলের সেনা প্রধান বুধবার এ কথা বলেন।
জেরুজালেম থেকে এএফপি জানায়, ইসরাইলি সেনা প্রধান ইয়াল জামির টেলিভিশনে এক ভাষণে বলেন, ‘আমরা ইরানের আকাশসীমা ও আমাদের পছন্দের প্রতিটি স্থানে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছি।’ তিনি বলেন, আর তা সম্ভব হওয়ার কারণ হলো, আমাদের বিমান বাহিনী ও স্থল কমান্ডো ইউনিটগুলোর সমন্বয় ও তাদের কৌশল।
‘বাহিনীগুলো শত্রু অঞ্চলের গভীরে গোপনে কাজ করে আমাদের অবাধ কর্মক্ষমতা প্রয়োগের পথ তৈরি করে।’
মঙ্গলবার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে উভয় দেশই সংঘাতে বিজয়ের দাবি করেছে।
১৩ জুন ইসরাইল একটি আকস্মিক বোমা হামলার মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু করে, যার লক্ষ্য ছিল ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখা। তবে ইরান ধারাবাহিকভাবে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা অস্বীকার করে।
জামির প্রথম ইসরাইলি কর্মকর্তা যিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ইসরাইলি সৈন্যরা ইরানের স্থলভাগে অভিযান চালিয়েছে।
তিনি আরও বলেন ‘অভিযান এখনও শেষ হয়নি।’ ‘অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’
ইসরায়েল অধিকৃত জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরের ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিনি জনপদ থেকে ব্যাপক হারে জোরপূর্বক ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দপ্তর (ওএইচসিএইচআর)। এটিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী জাতিসংঘ যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
ওএইচসিএইচআরের তথ্যমতে, মাসাফের ইয়াত্তা অঞ্চল থেকে ১২০০ ফিলিস্তিনি নাগরিকের জোরপূর্বক স্থানান্তরের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘের দপ্তরটি এক বিবৃতিতে জানায়, দক্ষিণ হেবরনের মাসাফের ইয়াত্তা এলাকায় ফিলিস্তিনিদের সব ধরনের নির্মাণ ও পরিকল্পনার অনুমতি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক প্রশাসন।
তাদের দাবি, ওই এলাকাটি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হবে।
ওএইচসিএইচআর আরও জানায়, গত কয়েক মাসে ইসরায়েল ব্যাপকভাবে বাড়িঘর ভাঙচুর, ফিলিস্তিনি নাগরিক ও মানবাধিকারকর্মীদের নির্বিচার গ্রেপ্তার ও নির্যাতন, পাশাপাশি মাসাফের ইয়াত্তার ভেতর ও আশপাশে চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে, যার মাধ্যমে সেখানকার ফিলিস্তিনিদের বাধ্যতামূলকভাবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে ওই এলাকায় বসবাসরত অবৈধ ইহুদি বসতি থেকে আসা দখলদাররা প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনি নারী, শিশু ও প্রবীণদের ওপর হামলা ও হয়রানি চালাচ্ছে যেন তারা বাধ্য হয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
গাজায় মানবিক সহায়তা বন্ধের দাবি ইসরায়েলি মন্ত্রীর
এদিকে, ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির গাজায় চলমান মানবিক সহায়তাকে ‘সম্পূর্ণ লজ্জাজনক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং এই সহায়তা অস্থায়ীভাবে নয় বরং সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন।
সামাজিকমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে কট্টর ডানপন্থি এই মন্ত্রী দাবি করেন, হামাসই গাজায় খাদ্য ও পণ্যের নিয়ন্ত্রণ করছে। সহায়তা বন্ধ করলেই দ্রুত বিজয় অর্জন সম্ভব।
ইসরায়েলি মন্ত্রিসভায় বেন-গভিরের মতো কট্টর ডানপন্থি নেতারা শুরু থেকেই গাজায় সহায়তা পাঠানোর বিরোধিতা করে আসছেন। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় মানবিক বিপর্যয় রোধে সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে আসছে।
ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ থামলেও দীর্ঘদিনের ফিলিস্তিন সংকটে কোন অগ্রগতি নেই। এ অঞ্চলে ইসরায়েলি হামলা ও আগ্রাসন চলমান।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৯০ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন।
মন্ত্রণালয় অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ইসরায়েলি আগ্রাসনে ৫৬ হাজার ১৫৬ জন হাজার নিহত ও ১ লাখ ৩২ হাজার ২৩৯ জন ফিলিস্তিনি নাগরিক আহত বা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন।
সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধে ইসরাইলকে সহযোগিতার অভিযোগে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ফার্স জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ক’দিন পর তাদের গ্রেপ্তার করা হল। তেহরান থেকে এএফপি এ খবর জানায়।
বুধবার ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ফার্স বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, ‘গোয়েন্দা সংস্থা হযরত ওয়ালি আছর কোর এই ব্যক্তিদের ইহুদিবাদী শাসনব্যবস্থার পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি এবং বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করেছে।’
সংস্থার এক বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে এটি আরও জানায়, ‘তাদের বেশিরভাগই নিরাপত্তা বিরোধী কার্যকলাপ, জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে দেওয়া ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছে।’
ইসরাইলের সামরিক প্রধান বুধবার বলেন, ১২ দিনের যুদ্ধের সময় তাদের কমান্ডোরা ইরানের অভ্যন্তরে গোপনে কাজ করে এবং এর গোয়েন্দা প্রধানও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তার প্রশংসা করেছেন।
ইসরাইলি সামরিক প্রধান ইয়াল জামির টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘আমরা ইরানের আকাশসীমা এবং আমাদের পছন্দের প্রতিটি স্থানে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘এটি সম্ভব হওয়ার অন্যান্য কারণ হলো আমাদের বিমান বাহিনী ও স্থল কমান্ডো ইউনিটগুলোর সমন্বয় ও কৌশল।’
‘বাহিনীগুলো শত্রু অঞ্চলের গভীরে গোপনে অভিযান চালায় এবং আমাদের কর্মক্ষমতার স্বাধীনতা তৈরি করে।’
ইরান বুধবার জানিয়েছে, তারা ইসরাইলের সহযোগিতায় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
তেহরান নিয়মিত ভাবে চিরশত্রু ইসরাইলসহ বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় কাজ করায় সন্দেহভাজন এজেন্টদের গ্রেপ্তার করে এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘোষণা দেয়।
মঙ্গলবার থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে উভয় দেশই সংঘাতে জয়ের দাবি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী বা স্টুডেন্ট ভিসার আবেদনকারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গোপনীয়তা ‘পাবলিক’ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাংস্কৃতিক বিনিময় ভিসার ক্ষেত্রেও এই নির্দেশনা কার্যকর হবে।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার অ্যাফেয়ার্স বিভাগের বরাতে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছে।
ওই পোস্ট অনুযায়ী, যারা ‘এফ’, ‘এম’ বা ‘জে’ ক্যাটাগরির ভিসার জন্য আবেদন করেছেন, তাদের নিজের সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্টের প্রাইভেসি (গোপনীয়তা) ‘পাবলিক’ অর্থাৎ সর্বজনীন অবস্থায় রাখার অনুরোধ করা হয়েছে।
পোস্টে বলা হয়, কর্তৃপক্ষ যেন আপনার পরিচয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশযোগ্যতা যাচাই করতে সহজে প্রয়োজনীয় তথ্য পর্যালোচনা করতে পারে, তাই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভিসা আবেদনকারীদের জন্য তাদের সোশ্যাল মিডিয়া আইডেন্টিফায়ার বা ব্যবহারকারীর নাম বাধ্যতামূলক করেছে, যা অভিবাসী ও অধিবাসী (ইমিগ্র্যান্ট ও নন-ইমিগ্র্যান্ট)—উভয় ভিসার আবেদনপত্রে দিতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনের আওতায় ভিসা যাচাই এবং নিরাপত্তা পরীক্ষার জন্য সকল উপলব্ধ তথ্য ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে দেশটিতে প্রবেশে অযোগ্য ব্যক্তি, বিশেষ করে যারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে, তাদের শনাক্ত করা সহজ হয়।
গত ১২ দিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বাজার পর অবশেষে পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। ইরান-ইসরায়েল এগিয়েছে একটি ভঙ্গুর অস্ত্রবিরতির দিকে।
ইরানের পারমাণু কর্মসূচি বন্ধের নামে গত ১৩ জুন ইরানে হামলা চালায় ইসরায়েল। ইরানও শুরু করে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। এরপর তেল আবিবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিশোধ নিতে কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায় তেহরান।
এরপর পরিস্থিতি যেন আরও খারাপ না হয়, এজন্য এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা। অবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিহিত ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ আপাতত বন্ধ হয় যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে।
যুদ্ধবিরতির কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় থাকলেও আপাতদৃষ্টিতে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সেই সংঘাত আপাতত শেষ হয়েছে।
এদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ইরানের নেতারা সবাই এ যুদ্ধে নিজেদের জয়ী দেখাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। তাছাড়া ট্রাম্পসহ সবার দাবি, যুদ্ধবিরতির এই মুহূর্তটি ঘটেছে তাদের নিজ নিজ শর্তে।
এখন প্রশ্ন হলো— বাস্তবতা আসলে কী? ইসরায়েল কী অর্জন করল? ইরান কি তাদের কৌশলগত সম্পদ রক্ষা করতে পারল? আর এই যুদ্ধবিরতি কি সত্যিই শান্তির পথে নিয়ে যেতে পারে?
ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটল?
রবিবার (২২ জুন) ভোরে ইসরায়েলের অনুরোধে ইরানের ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্পের ভাষ্যে, তাদের হামলায় এসব স্থাপনা ‘সম্পূর্ণভাবে’ ধ্বংস করা হয়েছে।
এর জবাবে, সোমবার (২৩ জুন) কাতারের আল-উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। এটি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি।
মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় ও দীর্ঘ যুদ্ধের আশঙ্কা তখন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। তবে এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন, ‘ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে।’
তিনি এটিকে ১২ দিনের যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন। এই যুদ্ধ বছরের পর বছর চলতে পারত এবং পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস করে দিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণার চার ঘণ্টা পরই ইরান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর দাবি করে ইসরায়েল। পাল্টা হামলায় তেহরানের কাছে একটি রাডার স্টেশন ধ্বংস করে তেলর আবিব।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘ইসরায়েল যে আজ সকালেই বেরিয়ে পড়েছে, তাতে আমি খুবই অসন্তুষ্ট। দুটি দেশ যারা এতদিন ধরে লড়াই করেছে, তারা জানে না কী করছে!’
ইরান অবশ্য ওই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের অভিযোগ অস্বীকার করে। এরপর স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে ১১টায় যুদ্ধবিরতি পুনরায় কার্যকর হয় এবং ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেন।
পরে ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লেখেন, “ইসরায়েল আর ইরানে হামলা করবে না। সব বিমান ফিরে আসবে এবং ইরানকে একটি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ উড়ন্ত অভিবাদন’ জানাবে। কেউ আহত হবে না, যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে!”
ইসরায়েল কী অর্জন করল?
ইসরায়েল বহুদিন ধরে দাবি করে আসছে, ইরান তাদের অস্তিত্বের জন্য প্রধান হুমকি। তবে এর আগে কখনো ইরানের মূল পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায়নি তেল আবিব।
১৩ জুন ইসরায়েল সেই সীমারেখা অতিক্রম করে নাতাঞ্জের ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট ও ইসফাহান পারমাণবিক প্রযুক্তি কমপ্লেক্সে হামলা চালায়। জবাবে ইরানও ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইসরায়েলের দিকে।
এর ফলে সিরিয়া ও ইরাকে পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালালেও এবার আরও দূরবর্তী ও জটিল অভিযানে সফল হয়েছে ইসরায়েল।
আন্তর্জাতিক আইনি বৈধতা নিয়ে সমালোচনার মুখেও নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে তারা। ইসরায়েল দাবি ছিল, এই হামলা একটি আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ।
যদিও ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে বা সেটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে যাচ্ছিল বলে অভিযোগ করেছে তেল আবিব, তবে অনেকেই তা বিশ্বাস করেন না।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হলো— এই অভিযানে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসরায়েল চাইলে যুক্তরাষ্ট্রকে এমন অভিযানেও জড়াতে পারে যেখানে তারাই প্রথম আঘাত হেনেছে।
১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র শুধু উপকরণ সরবরাহ করেছিল; সরাসরি অংশ নেয়নি।
ট্রাম্পের এই ভূমিকার জন্য অবশ্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও কার্পণ্য করেনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন নেতানিয়াহু।
ইসরায়েল ইরানে পরিচালিত ওই হামলার নাম দিয়েছে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। এমন এক সময় এই অপারেশেন চালানো হয়, যখন ইসরায়েল ইতোমধ্যে ইরানের আঞ্চলিক মিত্র—হুথি, হামাস ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে।
ইরান কি পারমাণবিক কর্মসূচি রক্ষা করতে পেরেছে?
ইসরায়েল দৃশ্যত ইরানের ভূ-উপরিভাগের স্থাপনাগুলোতে বড় ক্ষতি করেছে, আর যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে তারা ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করেছে।
উপগ্রহ চিত্রে ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার চিহ্ন দেখা গেলেও, সত্যিকারের ক্ষয়ক্ষতি কতটা হয়েছে তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা যায়নি। এর জন্য ওইসব স্থাপনা পরিদর্শনের প্রয়োজন হবে।
সোমবার আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেন, ‘এই মুহূর্তে কেউ, এমনকি আইএইএ-ও ফোরদোয় ভূগর্ভস্থ ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণ মূল্যায়ন করতে পারেনি। তবে বিস্ফোরণের মাত্রা ও সেন্ট্রিফিউজের স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।’
এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে আরও একটি প্রশ্ন রয়ে গেল— ইরানের ৪০০ কেজি উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম কোথায় আছে?
আইএইএ বলেছে, এই মজুদের অবস্থান তারা জানে না।
ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ ইসলামি দাবি করেছেন, তাদের কর্মসূচিতে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না এবং কারণ হামলার আগেই তাদের প্রস্তুতি নেওয়া ছিল।
এদিকে, যুদ্ধবিরতির সাড়ে তিন ঘণ্টা পর ইসরায়েল যে দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের কথা বলেছে, সেগুলোর উৎস নিয়েও ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। কারণ ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে এর দায় অস্বীকার করেছে।
তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়— কে ছুঁড়ল সেগুলো? সেগুলো কি ভুলবশত ছোড়া হয়েছিল?
কিন্তু এখন পর্যন্ত ইরান কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
সোমবার (২৩ জুন) ইরানের সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি একটি বিল অনুমোদন করেছে, যেখানে আইএইএয়ের সঙ্গে তেহরানের সহযোগিতা সম্পূর্ণভাবে স্থগিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিলটি এখন প্লেনারি অধিবেশনে অনুমোদনের অপেক্ষায়।
তবে মঙ্গলবার ট্রাম্প ফের ঘোষণা দিয়েছেন, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় শুরু করতে দেওয়া হবে না।’
এ পরিস্থিতিতে বলা চলে, মূল উত্তেজনা যদি বজায় থাকে, তবে নতুন করে পাল্টা-পাল্টি হামলা কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
টানা ১২ দিনের সংঘাতে ইসরায়েলজুড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতটা ভয়াবহ তা তেমনভাবে সামনে আসেনি। কারণ, ইসরায়েল সরকার ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছিল। তবে দখলদার দেশটিতে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটি অনেকটাই অনুধাবন করা যায় সম্প্রতি সামনে আশা ইসরায়েলিদের ক্ষতিপূরণ চাওয়ার তথ্যের ভিত্তিতে।
গত মঙ্গলবার বার্তা সংস্থা আনাদোলুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংঘাত শুরুর পর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর পর্যন্ত ১২ দিনে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির জন্য জনগণের কাছ থেকে ৩৯ হাজার ক্ষতিপূরণের আবেদন পেয়েছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের পত্রিকা ইয়েদিয়থ আহারোনোথের মতে, ১৩ জুন ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি কর কর্তৃপক্ষের প্রায় ৩৮ হাজার ৭০০টি ক্ষতিপূরণের দাবি পেয়েছে। এই দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ভবনের ক্ষতির জন্য ৩০ হাজার ৮০৯টি, যানবাহনের ক্ষতির জন্য ৩ হাজার ৭১৩টি এবং সরঞ্জাম ও অন্যান্য জিনিসপত্রের ক্ষতির জন্য ৪ হাজার ৮৫টি।
ইসরায়েলের দৈনিক সংবাদপত্রটি আরও জানিয়েছে, অনুমান করা হচ্ছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বহু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সেগুলোর ক্ষতিপূরণ দাবি করে আবেদন জমা পরেনি।
ইতোমধ্যে, ইসরায়েলি ওয়েবসাইট বেহাদ্রেই হারেদিম জানিয়েছে, শুধুমাত্র মধ্য ইসরায়েলের তেল আবিবেই ২৪ হাজার ৯৩২টিরও বেশি আবেদন জমা পড়েছে এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আশকেলনে জমা পড়েছে ১০ হাজার ৭৯৩টি আবেদন। তবে প্রত্যাশিত ক্ষতিপূরণের আর্থিক পরিমাণ কত হতে পারে সে বিষয়ে বিস্তারিত হিসাব দেয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, তেহরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে এমন অভিযোগে গত ১৩ জুন ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। তবে সেই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে ইরান। এরপর ইসরায়েল ভূখণ্ডে তেহরানের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা শুরু হয়। পরে তিনটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও সংঘাতে যোগ দেয়।
দুই আঞ্চলিক শত্রুর মধ্যে ১২ দিনের সংঘাতের পর অবশেষে গত মঙ্গলবার সকালে উভয় পক্ষের সম্মতিতে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৪ জুন) মার্কিন কংগ্রেসের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি বাডি কার্টার নরওয়ের নোবেল কমিটির কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ট্রাম্পের মনোনয়ন সুপারিশ করেন।
চিঠিতে তিনি বলেন, ‘সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে ঐতিহাসিক চুক্তি সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়নে ট্রাম্পের অসাধারণ ভূমিকা বিশ্ব শান্তির জন্য এক মাইলফলক।’
কার্টার আরও বলেন, ‘অনেকের কাছে যা অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল, সেই যুদ্ধবিরতি চুক্তি ট্রাম্পের দৃঢ় নেতৃত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছে।’
সোমবার (২৩ জুন) ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন ট্রাম্প। যদিও দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে তা লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে। তবে, ট্রাম্পের প্রচেষ্টাকে আন্তর্জাতিক মহলে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই বিবেচনা করা হচ্ছে।
কার্টার আরও উল্লেখ করেন, ‘ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থামাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রটি যাতে পরমাণু অস্ত্র অর্জন করতে না পারে, তা নিশ্চিত করেছেন।’
এর আগেও ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে ‘আব্রাহাম চুক্তি’ বাস্তবায়নের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য আলোচনায় ছিলেন। এবার ইরান-ইসরায়েল সংকটে তার ভূমিকা তাকে আবারও আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।
সবশেষ ২৪ জুন ইরানে হামলা চালিয়ে দুই জেনারেলসহ দেশটির অভিজাত বাহিনী আইআরসিজির সাত সদস্যকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েল। এখন পর্যন্ত দেশ ইসরায়েলের হামলায় ৬১০ জন ইরানি নিহত হয়েছেন। অপর দিকে ইরানের মিসাইল হামলায় ২৪ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে উভয় পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনা।
উল্লেখ্য, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে তা ধ্বংসের দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিক্রিয়ায় কাতারে থাকা মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে মিসাইল হামলা চালায় ইরান।
সূত্র: বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা
ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে অব্যাহত যুদ্ধে গাজায় ৭ জন ইসরাইলি সৈন্য নিহত হয়েছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী বুধবার এ তথ্য জানায় ছিল।
জেরুজালেম থেকে এএফপি জানায়, সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইটে একই ব্যাটালিয়নের পাঁচজন সৈন্য এবং একজন প্লাটুন কমান্ডারের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। দক্ষিণ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধের সময় নিহত তারা হন।
এতে আরও বলা হয়েছে যে সপ্তম সৈন্যও নিহত হয়েছে, তবে তার পরিবার তার নাম প্রকাশের অনুমতি দেয়নি।
গত ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের আক্রমণের ফলে সংঘটিত যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৪৩০ জনেরও বেশি ইসরাইলি সৈন্য নিহত হয়েছে।
সরকারি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এএফপির হিসাব অনুযায়ী, হামাসের ওই হামলায় ১,২১৯ জন নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।
এতে ২৫১ জনকে জিম্মি হিসেবে আটক করে হামাস, যাদের মধ্যে ৪৯ জন এখনও গাজায় বন্দী। আটককৃতদের ২৭ জন নিহত বলে ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইলি প্রতিশোধমূলক সামরিক অভিযানে কমপক্ষে ৫৬ হাজার ৭৭ জন এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। জাতিসংঘ তাদের পরিসংখ্যান নির্ভরযোগ্য বলে মনে করে।
অধিকার গোষ্ঠীগুলোর মতে, মার্চের শুরু থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত ইসরাইলের সমস্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া এবং বিধিনিষেধ আরোপ অব্যাহত রাখার পর ২০ লক্ষাধিক মানুষের এই অঞ্চল দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে।
মঙ্গলবার ইরানের সাথে যুদ্ধবিরতিতে ইসরাইলের সম্মতির পর, ইসরাইলের সামরিক প্রধান ইয়াল জামির বলেছেন, এখন মনোযোগ গাজার দিকে ফিরে যাবে।
সাম্প্রতিক হামলার পর আলোচনার টেবিলে ফিরতে সরাসরি ও মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইসরায়েল-ইরান আলোচনা শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ।
ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আলোচনা নিয়ে আমরা আশাবাদী। এখন ইরানিদের সঙ্গে বসে একটি সামগ্রিক শান্তিচুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে।’ তবে আলোচনার বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি তিনি।
উইটকফ জানান, যুক্তরাষ্ট্র যে লক্ষ্যে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল, তা পূরণ হয়েছে। ইরানের অস্ত্র উৎপাদনের জন্য বিদ্যমান অথবা ভবিষ্যতে উৎপাদিত হতে পারে—এমন অস্ত্র-গ্রেড ইউরেনিয়ামকে বাস্তব অস্ত্রে রূপান্তরের সক্ষমতা নির্মূল এবং দেশটির ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিকে কয়েক বছর পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে ওয়াশিংটন।
এদিকে, ইরানের সঙ্গে বিশ্বের ৬ পরাশক্তির করা ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির মেয়াদ শেষে হতে চলেছে চলতি বছরের ১৮ অক্টোবর। এ নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বৈঠকে জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডরোথি শি বলেন, ‘ইরান ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি লঙ্ঘন করে ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণসহ একাধিক পারমাণবিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।’
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারা ওই চুক্তিটি অনুমোদিত ছিল। তবে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
শি অভিযোগ করেন, ‘ইরান জাতিসংঘের প্রস্তাবনাগুলো লঙ্ঘন করে ইয়েমেনের হুথি, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ২০২২ সালে রাশিয়াকে শত শত ড্রোন সরবরাহ করেছে, যেগুলো ইউক্রেনে হামলার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।’
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে ব্যর্থতা বহু বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য ও তার বাইরেও সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করেছে এবং অস্থিরতা বাড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইরানের এসব চুক্তির লঙ্ঘন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার হুমকির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র চোখ বন্ধ করে রাখবে না বলেও সতর্ক করেন শি।
তিনি আরও বলেন, ‘শনিবার (২১ জুন) ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েল, পুরো অঞ্চল এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি দেশটির হুমকি হ্রাস করা। পাশাপাশি তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা ধ্বংস করা।’
এ সময় ইরানকে শান্তি ও সমৃদ্ধির এই সুযোগ গ্রহণ ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে উৎসাহিত করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ফ্রান্সের হুঁশিয়ারি
এদিকে, যত দ্রুত সম্ভব জাতিসংঘের পরমাণু পরিদর্শকদের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে প্রবেশের অনুমতি দিতে আহ্বান জানিয়েছে ফ্রান্স, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায়—ইরানের ইউরেনিয়াম মজুদ অন্যত্র সরানো হয়নি। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থাকে (আইএইএ) পুনরায় পূর্ণ সহযোগিতা শুরু করার জন্য ওই বৈঠকে আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘে ফরাসি দূত জেরোম বোনাফঁট।
একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয়ে তেহরানকে একটি জবাবদিহিমূলক ‘দৃঢ়, যাচাইযোগ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক সমাধানে’ ফের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আশঙ্কা, ইরান গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথে এগোচ্ছে।
নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তিনি আরও জানান, ২০১৫ সালের ইরান চুক্তির ওপর ভিত্তি করে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম ও স্থানান্তরের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ চলতি বছরের ১৮ অক্টোবরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে যদি গ্রীষ্মের মধ্যে কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে ইতালি, ব্রিটেন ও জার্মানি ২০১৫ সালের প্রস্তাবের সেই ধারা ব্যবহার করতে প্রস্তুত, যার মাধ্যমে জাতিসংঘের পুরনো নিষেধাজ্ঞাগুলো আবার ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল’ করা সম্ভব।
জেরোম বলেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও ইউরোপীয় নিরাপত্তা স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই ইরানের সঙ্গে যেকোনো চুক্তি হতে হবে।’
আলোচনায় ফেরার আহ্বান ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতির পর দ্রুত কূটনৈতিক সমাধানে ফিরে যাওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত স্তাভরোস লামব্রিনিদিস।
নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠকে তিনি বলেন, ‘ইরানের পারমাণু কর্মসূচি নিয়ে কেবল তখনই সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এতে যথাযথভাবে জড়িত থাকবে।’
ইরান যাতে কখনো পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন বা উন্নয়ন না করতে পারে, তা নিশ্চিত করাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা অগ্রাধিকার বলে জোর দেন তিনি।
একমাত্র নিরপেক্ষ ও স্বাধীন আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে আইএইএয়ের ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বাস্তবায়ন ও যাচাইয়ের দায়িত্বে থাকা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যুদ্ধবিরতি বিপর্যয়কর উত্তেজনা এড়ানোর সুযোগ: জাতিসংঘ
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতিকে ‘বিপর্যয়কর মাত্রার সংঘাত এড়ানোর একটি সুযোগ’ হিসেবে দেখছে জাতিসংঘ।
সংস্থাটির রাজনৈতিক ও শান্তি বিষয়ক উপপ্রধান রোজমেরি ডিকার্লো সোমবার নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, ‘এই যুদ্ধবিরতি আরও বড় ধরনের সংঘর্ষ এড়াতে সাহায্য করতে পারে—যা গোটা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ভয়াবহ প্রভাব ফেলত।’
তিনি বলেন, ‘কূটনীতি, সংলাপ ও যাচাই—এগুলোই ইরানের পরমাণু কর্মসূচির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করার এবং ইরানি জনগণের জন্য প্রকৃত অর্থনৈতিক সুফল আনার সর্বোত্তম পথ।’
কূটনৈতিক সমাধানে যেতে রাজি ইসরায়েলও
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির পর ‘খুব শিগগিরই কূটনৈতিক আলোচনা শুরু হবে’ বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই এখন কথা বলতে হবে, আলোচনায় বসতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে আমরা যেন ১২ দিন আগের পরিস্থিতিতে আর ফিরে না যাই, যেখানে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদিও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলার পূর্ণ প্রভাব এখনও নির্ণয় করা হয়নি, তবে আমরা জানি যে আমরা তাদের কর্মসূচিকে পিছিয়ে দিতে পেরেছি, তাৎক্ষণিক হুমকিটিও সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।’
এ সময় গাজায় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতির আহ্বানের বিষয়ে ড্যানন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফ যে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছেন, তা নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে চায় ইসরায়েল।’
তিনি আরও দাবি করেন, সাম্প্রতিক সংঘাতে ইসরায়েল যে (সামরিক) সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে, তা অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে নতুন সুযোগ এনে দেবে।
এ সময় ট্রাম্পের প্রশংসা করে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য।’
ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত ও রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিরসনে ঘনিষ্ঠ সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। মঙ্গলবার রাতে হেগে অনুষ্ঠিত ন্যাটো সম্মেলনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে এ কথা বলেন তিনি।
প্রচেষ্টায় ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে অর্জিত যুদ্ধবিরতিতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এবং এটি স্থায়ী হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
মঙ্গলবার ভোরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ইরান ও ইসরাইল একটি পর্যায়ক্রমিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। যা তাদের ১১ দিনব্যাপী সংঘাতের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ডেকে আনবে।
এর আগে রোববার যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের অভিযানে যোগ দিয়ে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর উপর হামলা চালায়। এর জবাবে সোমবার গভীর রাতে কাতারে একটি মার্কিন ঘাঁটিতে ইরান একটি প্রতিক্রিয়াশীল হামলা চালায় যা এই সংঘাতের অবসানের ইঙ্গিত দেয়।
গাজা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার কথা বলেন এরদোয়ান।
তিনি বলেন, গাজায় মানবিক বিপর্যয় যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি করতে ঘনিষ্ঠ সংলাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এরদোয়ান আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগিতা বাড়ালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে সহায়ক হবে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে গত সপ্তাহে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে হামলার প্রাথমিক মূল্যায়নে জানা গেছে, হামলা চালানো তিনটি স্থাপনার মধ্যে দুটিই ধ্বংস হয়নি। তাছাড়া, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সম্ভবত মাত্র কয়েক মাসের জন্য পেছনে ঠেলে দিতে পেরেছে এই মার্কিন হামলা।
পেন্টাগনের গোয়েন্দা শাখা হিসেবে কাজ করা ‘প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা’ (ডিআইএ) এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (২৪ জুন) ওই প্রাথমিক তদন্ত-সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তি এ তথ্য জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় (সেন্ট্রাল কমান্ডে) পরিচালিত যুদ্ধ-পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির ওপর ভিত্তি করে এই প্রাথমিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছে ডিআইএ। মূলত মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কার্যক্রম তদারকি করে থাকে এই সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে করা ওই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পারমাণু কর্মসূচির প্রধান উপাদান, যেমন: সেন্ট্রিফিউজগুলো কয়েক মাসের মধ্যেই পুনরায় চালু করা সম্ভব।
প্রতিবেদরে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হতে পারে— এমন উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের অনেকটা অংশ হামলার আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেগুলো ইরানের গোপন অন্যান্য পারমাণবিক স্থাপনায় স্থানান্তর করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ‘পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে’ বলে ট্রাম্প যে দাবি করেছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শনিবার (২১ জুন) রাতে ট্রাম্প জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, নাতাঞ্জ, ফোরদো ও ইসফাহানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই হামলা ছিল এক অসাধারণ সামরিক সাফল্য। ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণ ও চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দখলদার ইরান এখন শান্তির পথ বেছে নিতে বাধ্য।’
যদিও ডিআইএয়ের প্রতিবেদনটি ছিল একটি প্রাথমিক মূল্যায়ন, তবে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা গোয়েন্দা তথ্য কয়েক দিনের মধ্যেই ফোরদো ধ্বংস হয়নি বলে নিশ্চিত করে, তাহলে পরবর্তী মূল্যায়নে আরও কম ক্ষয়ক্ষতির কথা উঠে আসতে পারে।’
ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত ফোরদোর ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। এটি জাগরোস পর্বতমালার নিচে অবস্থিত।
এই কেন্দ্রটি প্রায় ৪৫ থেকে ৯০ মিটার (১৪৫ থেকে ৩০০ ফুট) পাথরের নিচে নির্মিত, যার বেশিরভাগই লাইমস্টোন ও ডোলোমাইট।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন প্রথমে এই গোয়েন্দা মূল্যায়নের কথা জানালেও হোয়াইট হাউস তা প্রত্যাখ্যান করে।
প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলাইন লেভিট এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এই তথাকথিত মূল্যায়ন ফাঁসের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে হেয় ও সাহসী ফাইটার পাইলটদের অবদানকে অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়েছে, যারা নিখুঁতভাবে পরিচালিত এক অভিযানে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করেছেন।’
তবে রবিবার (২২ জুন) মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র জানে না ইরানের উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ কোথায় আছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী কয়েক সপ্তাহে নিশ্চিত করব; কীভাবে ওই জ্বালানির ব্যবহার রোধ করা যায়।’
এদিকে, সোমবার (২৩ জুন) আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসিও বলেন একই কথা। তার মতে, ইরানের ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ৪০০ কেজি ইউরেনিয়ামের মজুদ কোথায় আছে, তা এখন আর তারা নির্ধারণ করতে পারছে না।
এর আগে, গত বুধবার (১৮ জুন) দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে পেন্টাগনের শীর্ষ রাজনৈতিক কর্মকর্তা-কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছিল, ফোরদোয় ব্যবহারের জন্য তৈরি ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ‘বাংকার বাস্টার’ জিবিইউ-৫৭ বোমাগুলো ওই স্থাপনাটি পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারবে না।
জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ওই ব্রিফিংয়ে পেন্টাগনের ডিফেন্স থ্রেট রিডাকশন এজেন্সি জানায়, জিবিইউ-৫৭ বোমা ভূমির পর্যাপ্ত গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। কেবল একটি কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রই ফোরদোকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে সক্ষম।
মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের বরাতে প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলায় বি২ বোমারু বিমানে করে ফোরদোয় ১২টি, নাতাঞ্জে ২টি জিবিইউ-৫৭ বোমা ফেলা হয় এবং একটি মার্কিন সাবমেরিন ইসফাহানে প্রায় ৩০টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ট্রাম্পের দাবি পুর্নব্যক্ত করে বলেন, পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
তবে অপারেশনের তত্ত্বাবধায়ক মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ার জেনারেল ড্যান কেইন তার মন্তব্যে কিছুটা সংযত ছিলেন।
কেইন বলেন, তিনটি পারমাণবিক স্থাপনাতেই ‘গুরুতর ক্ষতি ও ধ্বংস’ হয়েছে। তবে সামরিক অভিযানের চূড়ান্ত যুদ্ধ-পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন এখনও বাকি রয়েছে বলেও সে সময় সতর্ক করেছিলেন তিনি।