ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়ে খুন হয়েছেন না জীবিত আছেন সে বিষয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের কাছ থেকে তিনি নিখোঁজের তথ্য থাকলেও তার খুন হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ভারতে গিয়ে ৮ দিন নিখোঁজ থাকার পর কলকাতার নিউ টাউনের বিলাসবহুল আবাসন সঞ্জিভা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে (বিইউ) ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় এই এমপির হত্যার খবর পাওয়া গেল।
এদিকে কলকাতার নিউ টাউন থানায় হত্যার বিষয়ে মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সংশ্লিষ্ট পুলিশ। তারা বলছে, মরদেহ পাওয়া যায়নি, কিন্তু রক্তের দাগ পাওয়া গেছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এ রক্ত কার? মরদেহ কোথায় গেল? এখন কী অবস্থায় আছেন এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার? তিনি জীবিত না মৃত?
এমপি আনোয়ারুল আজিম কলকাতায় তার যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন, সেই গোপাল বিশ্বাস বুধবার সকালে জানিয়েছেন, তিনি পুলিশের কাছ থেকে এমপি আনার হত্যার খবর পেয়েছেন বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন।
প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় পুলিশের ধারণা, এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে। তবে তাকে কে বা কারা, কেন খুন করেছে; এ বিষয়ে এখনো স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি। এরই মধ্যে নিউ টাউন থানার পুলিশ ও বিধান নগর গোয়েন্দা শাখার পুলিশ এবং এইচডিএফ কর্মকর্তারা তদন্তে নেমেছেন। ওই আবাসিক এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখছেন তারা।
গতকাল রাত পৌনে ১০টার দিকে দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার শাবান মাহমুদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, এখন পর্যন্ত ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে হত্যার বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অফিসিয়ালি কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন জানিয়েছে, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের মরদেহ উদ্ধারের বিষয়ে অফিশিয়ালি বা আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য তাদের জানানো হয়নি। তদন্তকারী সংশ্লিষ্টরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে এ বিষয়ে কাজ করছেন।
এদিকে, বুধবার আনোয়ারুল আজিম হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর ধানমন্ডির নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, এমপি আনোয়ারুল আজিমকে বাংলাদেশিরাই হত্যা করেছে। কারা তাকে খুন করেছে, খুনের মোটিভ কী? তা জানতে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এ সময় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ উপস্থিত ছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এমপি আনোয়ারুল আজিমকে কলকাতার একটি বাসায় পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। এ বিষয়ে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে।
আনোয়ারুল আজিমকে হত্যার ঘটনায় তিনজনকে ধরা হয়েছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আরও কয়েকজনকে ধরার চেষ্টায় আছি। তাকে (আনোয়ারুল আজিম) হত্যা করা হয়েছে। এখানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরবে, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। ভারতের কেউ এখানে জড়িত নন। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে আমাদের দেশের মানুষই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে, তা তদন্তের স্বার্থে এখনই প্রকাশ করছি না। তদন্ত শেষ হলে জানানো হবে, তিনি কেন খুন হয়েছেন, কে কে খুন করেছে, কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মরদেহ এখনো আসেনি। দুই দেশের পুলিশ তদন্ত করছে। ভারতের পুলিশ আমাদের জানিয়েছে যে, তিনি খুন হয়েছেন, এটা নিশ্চিত।
এ ঘটনায় আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘তদন্ত চলছে। যারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল, আমরা পরে সেগুলো প্রকাশ করব।’
এদিকে, গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে মামলা করেছেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। সন্ধ্যায় শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আহাদ আলী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে (মামলা নম্বর ৪২)। তদন্ত করে আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হকও মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এমপি আনোয়ারুল আজিম সংসদ ভবন এলাকায় থাকতেন। সেখান থেকেই তিনি ভারতে গেছেন। এ কারণে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরামর্শে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেন তার মেয়ে ডরিন।
অন্যদিকে বুধবার সকালে রাজধানীর বাড্ডায় এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ভারতে গিয়ে নিখোঁজ বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মরদেহ উদ্ধারের খবর পেয়েছি গণমাধ্যম সূত্রে। তবে ইন্ডিয়ান বা কলকাতা পুলিশ আমাদের এখনো কিছু নিশ্চিত করেনি। তিনি জীবিত নাকি মৃত তা এখনো অফিশিয়ালি নিশ্চিত নই। আমরা যৌথভাবে কাজ করছি। এ ঘটনায় বাংলাদেশের পুলিশ কলকাতার পুলিশের সঙ্গে কাজ করছে। তারা যোগাযোগ রাখছে। কোনো অগ্রগতি থাকলে জানানো হবে।
এমপি আনার চিকিৎসা করাতে গত ১২ মে দুপুরে দর্শনা-গেদে সীমান্ত হয়ে ভারতের কলকাতায় যান। প্রথম দুই দিন যোগাযোগ থাকলেও ১৪ মে থেকে পরিবারের সদস্যরা তার খোঁজ পাচ্ছিলেন না। পরে আনোয়ারুলের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হয়। পরে ভারতের দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও কলকাতায় বাংলাদেশ উপ- হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এরপর থেকে ওই সংসদ সদস্যের খোঁজে তদন্ত শুরু করে কলকাতা পুলিশ। সংস্থাটি জানায়, দিল্লি ও কলকাতা হাইকমিশনের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পরই তার খোঁজে তৎপরতা শুরু করে পুলিশ।
জানা গেছে, এমপি আনার কলকাতায় যাওয়ার পর শহরের অদূরে ব্যারাকপুর এলাকার বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে পৌঁছান তিনি। পরে ১৪ মে তিনি ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন বলে গোপালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এরপর থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় লিখিত নিখোঁজ বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেন গোপাল বিশ্বাস।
জিডির তথ্য অনুযায়ী, আনোয়ারুল আজিম বের হয়ে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ফেরেননি। আনোয়ারুল আজিমের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে গোপালকে একটি বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয়, বিশেষ কাজে তিনি দিল্লি যাচ্ছেন। সেখানে পৌঁছে তিনি ফোন করে গোপাল বিশ্বাসকে জানাবেন, গোপাল বিশ্বাসের ফোন করার দরকার নেই। পরে ১৫ মে স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ২১ মিনিটে আনোয়ারুল আজিমের নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে আরেকটি বার্তা আসে। তাতে আনোয়ারুল আজিমের দিল্লি পৌঁছানোর কথা জানিয়ে বলা হয়, ‘আমার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন, ফোন করার দরকার নেই।’ আনোয়ারুল আজিমের নম্বর থেকে একই বার্তা বাংলাদেশে তার বাড়ির লোকজন এবং ব্যক্তিগত সহকারীকে (পিএস) পাঠানো হয়।
পরে ১৬ মে আনোয়ারুলের নম্বর থেকে তার ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রউফের নম্বরে একটি ফোন আসে বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত সহকারী ফোন ধরতে পারেননি। পরে আনোয়ারুল আজিমকে তিনি (ব্যক্তিগত সহকারী) ফোন করেও আর যোগাযোগ করতে পারেননি। পরদিন ১৭ মে আনোয়ারুলের মেয়ে গোপাল বিশ্বাসকে ফোন করে জানান, তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। তারপর তিনি আনোয়ারুলের পরিচিতজনের ফোন করেন। কিন্তু তার কোনো সন্ধান মেলেনি।
এ ছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার বিষয়ে জানতে নিবিড়ভাবে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
গতকাল বুধবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘নিহত এমপির মেয়ে ডরিন আমাদের কাছে এসেছেন। তার বাবা বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন, এরপর আর তাকে পাওয়া যায়নি। সেখানে কী ঘটেছে, এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করার জন্য এসেছেন ডরিন। মামলা কীভাবে কোথায় করবেন। তার বাবা সংসদ ভবন এলাকায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি ভারতে গেছেন। আমরা তাকে বলেছি, শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করতে। মামলা করতে আমাদের কর্মকর্তারা তাকে সহযোগিতা করছেন। মামলাটি আজকের মধ্যেই হবে।’
হারুন অর রশীদ বলেন, ‘এই ঘটনাটি মর্মান্তিক। তিনি ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ এলাকার জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি। আমরা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। তিনি তিনবারের সংসদ সদস্য। আমরা নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। কয়েকজন আমাদের কাছে আছে, তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা সবকিছু বলতে পারছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন সংসদ সদস্যকে বাংলাদেশি অপরাধীরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি যারা আছে, তাদের প্রত্যেককে আমরা আইনের আওতায় আনব। বিচারের মুখোমুখি করব। তদন্তের স্বার্থে নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না।’
কী কারণে হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তা জানা গেছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবিপ্রধান বলেন, ‘আসলে এটা কী কারণে ঘটেছে জানতে আমাদের তদন্ত চলছে। এটা পারিবারিক নাকি আর্থিক, অথবা এলাকায় কোনো দুর্বৃত্ত দমন করার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে কি না, সবকিছু আমরা তদন্তের আওতায় আনব।’
আনোয়ারুল আজিম ভারতে গিয়ে নিখোঁজের ঘটনায় তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি পুলিশ সূত্র জানায়, এ ঘটনায় সন্দেহভাজন দুজনকে আটক করা হয়েছে। আটক হওয়া ওই দুই ব্যক্তি সম্প্রতি কলকাতা থেকে ফিরেছেন। দুইজনের মধ্যে একজনের নাম আমানুল্লাহ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ‘গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারী বিভাগের একটি দল কেরানীগঞ্জ থেকে শুরুতে আমানুল্লাহ নামের একজনকে আটক করে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যগুলো ভারতের একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে জানালে তারা জানায়, আনোয়ারুল আজিম খুন হয়েছেন।’
এদিকে বুধবার সন্ধ্যায় আনোয়ারুল আজিমের মরদেহ উদ্ধার না হলেও তাকে হত্যার প্রমাণ পেয়েছে বলে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ জানিয়েছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের মহাপরিদর্শক (সিআইডি) অখিলেশ চতুর্বেদী বুধবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের মরদেহ এখনো পায়নি পুলিশ। তবে কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
এ ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত হাতে নিয়েছে বলে জানান এই সিআইডি কর্মকর্তা। এক প্রশ্নের জবাবে অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি, যার ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছে যে ওনাকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, পূর্ব কলকাতার নিউ টাউন অঞ্চলে যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজিম উঠেছিলেন, সেটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি দপ্তরের (এক্সাইজ) কর্মকর্তা সন্দীপ কুমার রায়ের। তার কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি।
আখতারুজ্জামানই ওই ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজিমের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আনোয়ারুল আজিমের সঙ্গে কয়েকজন ব্যক্তি এই ফ্ল্যাটে এসেছিলেন। কিন্তু তারা কবে বেরিয়ে গেলেন, সে বিষয়ে তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলতে পারছি না। এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, ১৩ মে উনি এখানে এসেছিলেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর ও শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে কর দাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগে ৫ সদস্য ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এক নিয়মিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান দুদকের উপ-পরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম।
তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাগণ নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য নির্ধারিত পরিমাণ কর আদায় না করে তাদের করের পরিমাণ কমিয়ে দিতেন বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এক্ষেত্রে, প্রতি বছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে কর্মকর্তাগণ ঘুষ না পেয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার মিথ্যা মামলা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মালিককে হয়রানি করেন বলে জানা যায়।
তিনি আরও বলেন, অনেক করদাতা আগাম কর দেন। আবার কেউ কেউ বেশি কর দেন। নিয়ম হচ্ছে এই কর হিসাব-নিকাশ করার পর বেশি দেওয়া হলে তা ওই করদাতাকে ফেরত দিতে হয়। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, করের বাড়তি টাকা ফেরত পেতে আরো অন্তত অর্ধেক টাকা ঘুষ বা উপহারে খরচ হয়। অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর কর্মকর্তারা করের টাকা ফেরত দিতে নিজেরাও কামিয়ে নিচ্ছেন মোটা টাকা।
অভিযুক্তদের বিষয়ে তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন স্টেশনে চাকুরিকালীন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক, ভ্যাট ও ক্ষেত্র বিশেষে আয়কর ফাঁকির সুযোগ করে দিয়ে ও নিজে লাভবান হয়ে রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে দুর্নীত, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ঢাকা পূর্বের কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনার কাজী মোহাম্মদ, বেনাপোল স্থল বন্দরের কমিশনার মোঃ কামরুজ্জামান, রাজশাহী সার্কেল-৭-এর উপ কর কমিশনার মো: মামুন মিয়া, আয়কর গোয়েন্দা ইউনিটের অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা ও ঢাকা কর অঞ্চল-২-এর কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক তথ্যানুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালে গত ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুলে গুলি করে ছয় জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে দ্বিতীয় দিনের শুনানি শুরু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আসামি পক্ষে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চাওয়ার শুনানি শুরু হয়। ট্রাইব্যুনালে এই মামলায় গ্রেফতার চার আসামি হাজির রয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠন সংক্রান্ত প্রথম কোন শুনানি শুরু হওয়ায়, সে দিনটিকে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর।
এর আগে, এই মামলার পলাতক চার আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে গত ৩ জুন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দেয়া হয়।
তবে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরেও পলাতক আসামীরা হাজির না হওয়ায়, তাদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. কুতুবউদ্দিনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এই মামলার অভিযোগে বলা হয়, রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আসামিগণ কর্তৃক নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয় এবং শহীদ শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, শহীদ মো ইয়াকুব, শহীদ মো রাকিব হাওলাদার, শহীদ মো ইসমামুল হক ও শহীদ মানিক মিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার, তার দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধ সংগঠিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে।
জাজ্বল্যমান এ সব অপরাধের বিচার এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
ফেসবুকে অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে বিতর্কিত স্ট্যাটাস দেওয়ায় লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সাবেক সহকারী কমিশনার (বর্তমানে ওএসডি সহকারী সচিব, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া) তাপসী তাবাসসুম ঊর্মিকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
বিভাগীয় মামলায় তাকে ‘চাকরি হতে বরখাস্তকরণ’ গুরুদণ্ড দিয়ে বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
এর আগে, গত বছরের ৬ অক্টোবর তাপসী তাবাসসুম ঊর্মিকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। পরের দিন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
তাপসী তাবাসসুমকে চাকরিচ্যুতির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গত বছরের ৬ অক্টোবর তিনি নিজ ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় তার বিরুদ্ধে ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ এর বিধি ৩(খ) মোতাবেক ‘অসদাচরণ’ এর অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়। এরপর তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। তিনি নিরাপত্তার কারণে ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ না নিয়ে লিখিতভাবে জবাব দেন। তার জবাব গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।
তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী তাকে গুরুদণ্ড দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। এরপর তাকে দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। তদন্ত প্রতিবেদন, দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর জবাব, পারিপার্শ্বিকতা এবং বিভাগীয় মামলার নথি পর্যালোচনায় তার বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণ’ এর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বিধিমালা অনুযায়ী ‘চাকরি হতে বরখাস্তকরণ’ সূচক গুরুদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনও গুরুদণ্ড দিতে কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে পরামর্শ দেয়। রাষ্ট্রপতিও তাকে চাকরিচ্যুতির গুরুদণ্ড দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন।
আদালত অবমাননার একটি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার অপসারণের পর এটাই প্রথম কোনো আদালতের রায়, যাতে তাকে দণ্ডিত করা হয়েছে।
বুধবার (২ জুলাই) আইসিটির চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
একই মামলায় গাইবান্ধা জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা শাকিল আকন্দ বুলবুলকে দুই মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এই ধরনের মামলায় পলাতক আসামির জন্য আইনজীবী নিয়োগের পূর্ব নজির না থাকলেও ন্যায়বিচারের স্বার্থে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে একজন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়।
মামলার বিবরণ অনুযায়ী, গত বছরের ২৫ অক্টোবর শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ নেতা শাকিলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন।
সেই অডিও ক্লিপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘২২৬ জনকে মারার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’—যা বিচারব্যবস্থার প্রতি সরাসরি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে আদালত। পরে এই ঘটনায় আইসিটিতে মামলা করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
গত ৩০ এপ্রিল এ-সংক্রান্ত শুনানিতে দুই আসামিকে ২৫ মে ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। ধার্য তারিখে তারা হাজির হননি। কিংবা আইনজীবীর মাধ্যমেও ব্যাখ্যা দেননি। সেদিন ট্রাইব্যুনাল দুই আসামিকে সশরীর হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে জবাব দেওয়ার জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিতে নির্দেশ দেন।
পরদিন দুটি সংবাদপত্রে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞপ্তিতে দুজনকে গত ৩ জুন ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে জবাব দিতে বলা হয়। সেদিনও তারা হাজির হননি। পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্য ১৯ জুন তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
১৯ জুন এই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামানকে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের আইনি সহায়তাকারী) হিসেবে নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। মামলার পরবর্তী শুনানি ধার্য করা হয় ২৫ জুন।
২৫ জুন মামলায় প্রস্তুতি নিতে অ্যামিকাস কিউরি মশিউজ্জামানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে এক সপ্তাহ সময় দেন ট্রাইব্যুনাল। সেদিনই এই মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করা হয় ২ জুলাই। আজ দুই আসামিকে কারাদণ্ড দিয়ে রায় দিলেন ট্রাইব্যুনাল।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে সাভারের আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনুষ্ঠানিকভাবে (ফরমাল চার্জ) অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
বুধবার সকালে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার বরাবর প্রধান প্রসিকিউটরের পক্ষে প্রসিকিউটর ফারুক আহমেদ ও মো. সাইমুম রেজা তালুকদার এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এই মামলায় এখন পর্যন্ত ৭ জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছে প্রসিকিউশন।
মামলা দায়েরের পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, গত ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছয় তরুণকে গুলি করে হত্যার পর, তাদের মরদেহ একটি পুলিশ ভ্যানে রেখে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, আগুন দেওয়ার সময় অন্তত একজন তরুণ জীবিত ছিলেন এবং তার শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো হয়।
তিনি আরো বলেন, এটি ছিল একটি ভয়াবহ ও নৃশংস ঘটনা, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় বিচারযোগ্য।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে প্রাথমিকভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান আব্দুল মোমেন।
মঙ্গলবার দুদকের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকার পরও এই মামলা পরিসমাপ্তি করা হয়। গেল জানুয়ারিতে শুরু হওয়া অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে প্রাথমিকভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণও মিলেছে।’
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, গায়ের জোরেই পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় আসামিদের অব্যাহতি দিয়েছিল তৎকালীন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সংস্থাটির চেয়ারম্যানের দাবি, বেশকিছু দুর্নীতির তথ্য মিলেছে। এই মামলায় আসামির অব্যাহতির পেছনে তৎকালীন কমিশনের দায় আছে কি না তাও খতিয়ে দেখার কথা জানান তিনি।
আব্দুল মোমেন বলেন, নতুন তদন্তে কারো সংশ্লিষ্টতা মিললে, তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে করা মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘ একযুগ পর; গত জানুয়ারি মাসে সেই মামলা পুনরায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। গঠন করা হয় উচ্চ পর্যায়ে কমিটি।
জানা যায়, ২০১২ সালে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে সাতজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে মামলা করে দুদক। তবে ২০১৪ সালে অদৃশ্য কারণে মামলাটি পরিসমাপ্তি করে তৎকালীন বদিউজ্জামান ও শাহাবুদ্দিন চুপ্পু কমিশন।
প্রহসনের নির্বাচন ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে শেরেবাংলা নগর থানার মামলায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
মঙ্গলবার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিয়াদুর রহমানের আদালতে এ জবানবন্দি দেন তিনি।
এর আগে দুই দফায় চার দিন করে আট দিনের রিমান্ড শেষে নূরুল হুদাকে আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার। এরপর নূরুল হুদা স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মতি হওয়ায় তা রেকর্ড করার আবেদন করেন এই তদন্তকারী কর্মকর্তা।
আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
নূরুল হুদার পক্ষে অ্যাডভোকেট তৌহিদুল ইসলাম সজিব এ এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, নূরুল হুদার রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করেন পুলিশ। আমরা তার জামিনের দরখাস্ত নিয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতে উপস্থিত হই। এরপর আদালতে এসে জানতে পারি তিনি দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিচ্ছেন।
গত ২২ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরে নূরুল হুদার বাড়িতে গিয়ে ‘স্থানীয় জনতা’ তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পরদিন প্রভাব খাটিয়ে প্রহসনের নির্বাচন করার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। চার দিনের রিমান্ড শেষে একই মামলায় গত ২৭ জুন আবারও চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার সিএমএম আদালত।
একই মামলায় গত ২৯ জুন তিন দিনের রিমান্ড শেষে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালকে কারাগারে পাঠানো হয়।
গত ২২ জুন দশম থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করা তিন সিইসি যথাক্রমে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, নূরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটিয়ে প্রহসনের নির্বাচন করার অভিযোগে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহ উদ্দিন খান। পরবর্তীতে গত ২৫ জুন এ মামলায় নতুন করে রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ধারা যুক্ত করা হয়।
সাবেক আমলা নূরুল হুদা ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দেশের দ্বাদশ সিইসি। তার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের সব ভোট হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আরও পাঁচ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা অবৈধ সম্পদ অর্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং পক্ষপাতিত্বের সঙ্গে জড়িত। মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দুদক এই তথ্য জানিয়েছে।
এতে বলা হয়, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে এই কর্মকর্তারা বড় পরিসরে কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এতে করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের উল্লেখযোগ্য রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
এমন সব অভিযোগে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে তারা হলেন— বড় করদাতা বিভাগের (ভ্যাট) অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশিদ মিয়া, সদস্য মো. লুৎফুর আজিম, কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (সিআইআইডি) সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আলমগীর হোসেন, ঢাকার কর অঞ্চল-১৬ এর উপকর কমিশনার মো. শিহাবুল ইসলাম এবং যুগ্ম কমিশনার মো. তারেক হাসান।
এর আগে ২৯ জুন দুদক এনবিআরের আরও ছয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। যাদের বিরুদ্ধে কর্তৃত্বের অপব্যবহার ও গত দুই দশক ধরে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ছয় কর্মকর্তা হলেন— আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য একেএম বদিউল আলম, ঢাকা কর অঞ্চল-৮ এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মির্জা আশিক রানা, বিসিএস কর একাডেমির যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দিন খান, ঢাকার কর অঞ্চল-১৬ এর উপকর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, অডিট-গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর-ভ্যাটের ঢাকার অতিরিক্ত কমিশনার হাসান তারেক রিকাবদার এবং কাস্টমস-আবগারি ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ) এর অতিরিক্ত কমিশনারসাধন কুমার কুন্ডু।
এই ছয় কর্মকর্তার মধ্যে হাসান তারেক এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হিসেবে পরিচিত। তার নেতৃত্বাধীন পরিষদটি রাজস্ব বোর্ড ভেঙে দেওয়ার পরিবর্তে এর অভ্যন্তরে কাঠামোগত সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছে।
দুদকের মুখপাত্র আক্তারুল ইসলাম বলেন, অভিযুক্ত কর্মকর্তারা কর দায় কমানোর বিনিময়ে ঘুষ গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার কেউ কেউ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাও দায়ের করেছেন—যারা তাদের অবৈধ দাবি পূরণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও রয়েছে যে, করদাতাদের কর ফেরত ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে করদাতাদের তাদের পাওনা পেতে ঘুষ দিতে বা উপহার দিতে বাধ্য করা হয়েছে। কখনো কখনো এই ঘুষের পরিমাণ ছিল করদাতাদের পাওনার অর্ধেকের সম পরিমাণ।
প্লট বরাদ্দে জালিয়াতির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছোট বোন শেখ রেহানা ও ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়সহ ১০০ জনকে আদালতে হাজির হতে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত।
আজ ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন। এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২০ জুলাই দিন ধার্য করেছেন আদালত।
দুদক প্রসিকিউটর মীর আহমেদ আলী সালাম বাসস’কে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির ছয়টি মামলার আজ ধার্য তারিখ ছিল। পাঁচ মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামিরা পলাতক অবস্থায় রয়েছেন মর্মে প্রতিবেদন এসেছে। অপর এক মামলায় শেখ হাসিনাসহ ১২ জন আদালতে হাজির হতে গেজেট প্রকাশের করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আজ দিন ধার্য ছিল। এদিন গেজেট প্রকাশ হয়ে আসেনি। আদালত ছয় মামলারই গেজেট প্রকাশের জন্য নির্দেশ দেন। ছয় মামলারই আগামী ২০ জুলাই পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এসব মামলায় চার্জশিট আমলে নিয়ে শেখ হাসিনাসহ ১০০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এরপর গ্রেফতার সংক্রান্ত তামিল প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করেন আদালত। আসামিদের গ্রেফতার করতে পারেনি বলে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করে। এরপর আইনুযায়ী আসামিদেন আদালতে হাজির হতে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন আদালত। গেজেট প্রকাশ হয়ে আসলে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হবে।
শেরেবাংলা নগর থানার সন্ত্রাস বিরোধী আইনে করা মামলায় ঢাকা মহানগর উত্তর যুব মহিলা লীগের সাবেক সভাপতি ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাবিনা আক্তার তুহিনের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ঢাকার একটি আদালত।
অপর দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর ধানমন্ডি থানার আব্দুল মোতালেব হত্যা মামলায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কার্যনির্বাহী সদস্য শাহে আলম মুরাদের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
আজ কারাগার থেকে তাদের ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ।
এরপর তুহিনের সাত দিন ও শাহে আলম মুরাদের পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
এ সময় তাদের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিলের আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পার্থ ভদ্র এ আদেশ দেন।
গত ২২ জুন গভীর রাতে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার শোল্লা ইউনিয়নের আওনা গ্রামে বাবার বাড়ি থেকে তুহিনকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ।
গত ১৭ এপ্রিল সকালে উত্তরা এলাকা থেকে শাহে আলম মুরাদকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।
তুহিনের মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত ৪ এপ্রিল সকাল ৭টার দিকে যুব মহিলা লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ইশরাত জাহান নাসরিনসহ অজ্ঞাতনামা ১৪ থেকে ১৫ জন দুষ্কৃতকারীরা শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সামনে নিষিদ্ধ সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও যুব মহিলা লীগের নেতা-কর্মীরা মিছিল করে।
পরে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা পালিয়ে যায়। আসামিরা নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের কার্যক্রমকে গতিশীল ও সন্ত্রাসী সংগঠনকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্য প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের পদত্যাগের দাবি করে স্বাধীন দেশের সংহতি, জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার ষড়যন্ত্র করে।
এ ঘটনায় ৪ এপ্রিল রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ।
মোতালেব হত্যা মামলার সূত্রে জানা যায়, গত ৪ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে থাকা আবদুল মোতালেব নামের এক কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরে ২৬ আগস্ট তার বাবা আব্দুল মতিন বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা করেন।
মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ১৭৬ জনকে আসামি করা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হয়েছে।
চিফ প্রসিকিউটরের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার বরাবর আজ এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেওয়ার জন্য উপস্থাপন করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত সংস্থা আবু সাঈদ হত্যার যে তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের কাছে জমা দিয়েছে, সেখানে ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই করে ট্রাইব্যুনাল-২ এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।
এই মামলায় গ্রেফতার চার আসামির মধ্যে পুলিশের সাবেক সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়কে আগামী ১৮ জুন এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী আকাশকে ১৯ জুন জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন ট্রাইব্যুনাল-১।
২০২৪ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আবু সাঈদ (২৫)। তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
আবু সাঈদ কোটা সংস্কার আন্দোলনের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের গুলিতে তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেই সোচ্চার হন ছাত্র-জনতা। এতে আরও গতিশীল হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।
অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধি অনুমোদন ও গ্রহণ করে ২০১৮ সালের আপিল বিভাগের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে যে আদেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ, সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দিয়েছেন সর্ব্বোচ আদালত।
রবিবার (২৯ জুন) সকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই আদেশ দেয়।
এই আদেশের ফলে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে হাইকোর্টে যে রিট শুনানি চলছে, তা নিষ্পত্তি করতে আর কোনো বাধা থাকলো না বলে জানিয়েছেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
এ সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
এর আগে, গত ২৬ জুন নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধির বহুল আলোচিত গেজেট গ্রহণ করে ২০১৮ সালে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞার নেতৃত্বাধীন ৫ বিচারপতির আপিল বিভাগ যে আদেশ দিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে করা রিভিউ আবেদনের রায়ের জন্য আজকের দিন ধার্য করা হয়।
আদালতে সেদিন রিভিউ আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
রিভিউ শুনানির পর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, আজ শুনানিকালে বলেছি যে বিচার বিভাগকে ‘অ্যাসল্ট করে’ এই শৃঙ্খলাবিধি গ্রহণ করা হয়েছিল তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে। কারণ, তার আগে নয়জন বিচারপতি এ বিষয়ে ভিন্ন আদেশ দিয়েছিলেন। এটি বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে তৎকালীন সরকার বাধ্য করেছিল নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের গেজেট-সংক্রান্ত আদেশ দিতে। এটি দ্রুত রিভিউ করা প্রয়োজন বলেই আদালতের অনুমতি নিয়ে রিভিউটি করা হয়।
১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন। ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল।
১২ দফা নির্দেশনার মধ্যে ছিল
১. সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অব রিপাবলিকের ভেতরে পড়বে। তবে বিচার বিভাগের কাজ ও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের অনেক ভিন্নতা রয়েছে। বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে একত্রিত করা যাবে না।
২. বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা এবং নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক কাজ করতে পারবেন না।
৩. সিভিল সার্ভিস অর্ডার ১৯৮০ অনুযায়ী সব ম্যাজিস্ট্রেটকে পিএসসির অধীনে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয়। একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থি।
৪. এই রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা এবং কমিশন গঠন করতে হবে।
৫. সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়ারির সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন।
৬. রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবে।
৭. সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে।
৮. বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন।
৯. জুডিশিয়ারির (নিম্ন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না। এই বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন এবং বরাদ্দ করবে।
১০. জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন।
১১. এই রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ পৃথককরণের জন্য সংবিধানে কোনো সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে পৃথককরণ আরও অর্থবহ করতে যদি সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যাবে।
১২. জুডিশিয়াল পে-কমিশন জুডিশিয়ারির সদস্যদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী তার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।
২০০৫ সালে এই রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আগামী ছয় মাসে কমপক্ষে ২০ হাজার মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলা প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে। এর ফলে এই সব মামলায় জড়িত ব্যক্তিরা চিরতরে সকল কলঙ্ক ও কষ্ট থেকে মুক্তি পাবেন।
বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমি মনে করি, মন্ত্রণালয় আগামী ছয় মাসে কমপক্ষে ২০ হাজার মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার মিথ্যা বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলা প্রত্যাহারের একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ইতোমধ্যেই প্রায় ১২ হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে, যা কমপক্ষে ৩ লাখ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে।’
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি এ পর্যন্ত (২৮ মে পর্যন্ত) ১৬টি বৈঠকে ১১ হাজার ৪৪৮টি রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছে এবং এ বিষয়ে আরও কাজ চলছে।
ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হয়রানির উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তাও চেয়েছিল তারা।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারে সরকার কর্তৃক অবহেলার অভিযোগের প্রেক্ষাপটে মন্ত্রণালয় এই আহ্বান জানিয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জেলা পর্যায়ের কমিটি ও আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর শাখা প্রেরিত তালিকা ও সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা করে কমিটি রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করছে।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজনৈতিক দলগুলোও প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটিতে রাজনৈতিক মামলার তালিকা পাঠাতে পারে।
এর আগে ড. আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘এই পরিপ্রেক্ষিতে, বিএনপি ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার মামলার তালিকা পাঠিয়েছিল এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ২৭ এপ্রিল, ২০২৫ সালের মধ্যে ১ হাজার ২০০টি মামলার তালিকা পাঠিয়েছিল।’
তবে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি, নিজস্ব উদ্যোগে কাজ করে, ইতোমধ্যেই প্রায় অর্ধেক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে।
আইন উপদেষ্টা রাজনৈতিক দল দুটিকে তাদের মামলার তালিকার সঙ্গে প্রাথমিক তথ্য প্রতিবেদন (এফআইআর) ও চার্জশিট (যেখানে প্রযোজ্য) এর মতো প্রাসঙ্গিক নথি না পাঠানোর জন্যও দোষারোপ করে বলেছেন যে, এটি মামলা প্রত্যাহার বিলম্বিত হওয়ার প্রধান কারণ।
উপদেষ্টা সম্প্রতি তার যাচাইকৃত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্টে বলেছেন, ‘অন্যদিকে, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, ২০ মে, ২০২৫ তারিখে ৪৪টি মামলার তালিকা দাখিল করেছে। মামলাগুলোর নথি পর্যালোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
ইতোমধ্যে এই মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মামলার তালিকাসহ এফআইআর ও চার্জশিট জমা দিতে আইন মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে।