রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে অগ্নিনিরাপত্তা মাপকাঠিতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ৫৮টি মার্কেট। এর মধ্যে অতিঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় রয়েছে ৯টি। মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ১৪টি। আর ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে ৩৫টি মার্কেট। সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের এক জরিপে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
রোববার দুপুরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মেইন্টেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরী।
সম্প্রতি দেড় সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ দুই মার্কেট বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস এই তালিকা প্রকাশ করল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কেট ও শপিংমলের অগ্নিঝুঁকি নিরসন এবং অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে তারা কাজ করছেন।
ফায়ার সার্ভিসের জরিপ বলছে, অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকায় রয়েছে নিউ মার্কেট এলাকার গাউছিয়া মার্কেট, ফুলবাড়িয়া এলাকায় বরিশাল প্লাজা মার্কেট, টিকাটুলী এলাকায় রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট, লালবাগ এলাকায় আলাউদ্দিন মার্কেট, চকবাজার এলাকায় শাকিল আনোয়ার টাওয়ার ও শহীদুল্লাহ মার্কেট এবং সদরঘাট এলাকায় শরীফ মার্কেট ও মায়া কাটারা ২২ মার্কেট।
মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকায় রয়েছে জুরাইন এলাকার আলম সুপার মার্কেট, খিলগাঁও রেলগেট বাজারের উত্তরা মার্কেট, ডেমরা সারুলিয়ার সালেহা শপিং কমপ্লেক্স ও মনু মোল্লা শপিং কমপ্লেক্স, দোহার জয়পাড়া বাজারের লন্ডন প্লাজা শপিংমল, ওয়ারীর এ কে ফেমাস টাওয়ার ও রোজ ভ্যালি শপিংমল, নিউ মার্কেট এলাকার মেহের প্লাজা, প্রিয়াঙ্গন সুপার মার্কেট, নিউ চিশতিয়া মার্কেট, চিশতিয়া মার্কেট, মিরপুর রোডের নেহার ভবন, এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্স ও ইসমাইল ম্যানশন সুপার মার্কেট, সুবাস্তু অ্যারোমা শপিংমল।
ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকায় রয়েছে জুরাইনের বুড়িগঙ্গা সেতু মার্কেট, খিলগাঁও তালতলা সিটি করপোরেশন সুপার মার্কেট, খিলগাঁও সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজার মার্কেট, তিলপাপাড়া মিনার মসজিদ মার্কেট, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকার হাজি হোসেন প্লাজা, ডেমরা সারুলিয়ার ইসলাম প্লাজা, ডেমরা কোনাপাড়ার নিউ মার্কেট, দোহার জয়পাড়ার আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স ও এ হাকিম কমপ্লেক্স, নবাবগঞ্জ বাঘাবাড়ীর শরীফ কমপ্লেক্স, কাফরুলের বাচ্চু মিয়া কমপ্লেক্স ও ড্রিমওয়্যার, মিরপুর-১ নম্বর এভিনিউ এলাকার এশিয়ান শপিং কমপ্লেক্স, মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেট, ফেয়ার প্লাজা, তেজগাঁও শিল্প এলাকার শেপাল এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড, বেগুনবাড়ীর নাসা মেইনল্যান্ড, পুরান ঢাকার দীন মোহাম্মদ রোডের জাকারিয়া ম্যানশন, লালবাগের হাজি আব্দুল মালেক ম্যানশন, ওয়ারীর ইপিলিয়ন হোল্ডিং লিমিটেড, মিরপুর রোডের গ্লোব শপিং সেন্টার, নিউ মার্কেট এলাকার চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট ও চাঁদনী চক মার্কেট, নিউ সুপার মার্কেট, নূরজাহান সুপার মার্কেট, হযরত বাকুশাহ হকার্স মার্কেট, ইসলামিয়া বই মার্কেট, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-১, সিদ্দিকবাজারের হান্নান ম্যানশন, ফুলবাড়িয়ার সিটি প্লাজা, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২, নগর প্লাজা, সিদ্দিকবাজারের রোজ মেরিনাস মার্কেট ও দুকু টাওয়ারের সাতটি ভবন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এসব মার্কেটে অনেক ক্ষেত্রেই অগ্নিনিরাপত্তা আইন মানার ক্ষেত্রে চরম অবহেলা দেখা গেছে। এ ছাড়া অধিকাংশ মার্কেটের লোকজনের মধ্যে প্রাথমিকভাবে আগুন নেভানোর ধারণা নেই। সেখানে অগ্নিনিরাপত্তা মহড়াও হয় না। এসব অবহেলার কারণে আগুন লাগছে এবং সম্পত্তি ও জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মার্কেটে আগুন লাগার বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মার্কেটের নন-ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন নির্মাণ, নকশাবহির্ভূত এক্সটেনশন, মার্কেটের দোকানে গাদাগাদি করে কার্টনে মালামাল রাখা, নিয়ম না মেনে মার্কেটের দোকানের ভেতর রাত্রিযাপন, ধূমপান করা, গ্যাস ব্যবহার করে খাবার রান্না করা ইত্যাদি কারণে আগুন লাগছে। আমরা আজকেও (গতকাল) সকাল থেকে চারটি মার্কেটের মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের এ বিষয়ে ধারণা দিয়েছি।’
ঈদের আগেই দোকান চালুর চেষ্টা নিউ সুপার মার্কেটে
এদিকে গত শনিবার ভোরে পুড়ে যাওয়া নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা ঈদের আগেই দোকান চালু করতে চান। এ জন্য তারা নিজেরাই গতকাল সকাল থেকে মার্কেটের পুড়ে যাওয়া আবর্জনা পরিষ্কার করেছেন। এর আগে সকাল ৯টায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আগুন পুরো নিভে গেছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর ব্যবসায়ীরা একযোগে পুড়ে যাওয়া দোকানগুলো থেকে বর্জ্য পরিষ্কার শুরু করেন।
গতকাল দুপুরে নিউ সুপার মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তৃতীয় তলায়। দ্বিতীয় তলার দোকানপাটও পুড়েছে। তবে নিচতলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কম। নিচতলার ৪ নম্বর গলির সিঁড়ির পাশের তিনটি দোকান পুড়েছে। তিন দোকানের একটির মালিক মুজিবুর রহমান মিরাজ জানান, কয়েক দিন আগে ৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দোকানে থ্রি-পিস তুলেছিলেন। থরে থরে সাজানো সব কাপড় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মার্কেটের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার পাঁচটি দোকানের মালিক মোস্তফা কামাল। তিনি জানান, অল্পের জন্য তার সব দোকান রক্ষা পেলেও দুর্ঘটনার কারণে বন্ধ রয়েছে বেচাকেনা। তিনি বলেন, ‘মার্কেটে আগুন লাগার খবরে আমরা দ্রুত মালামাল সরিয়ে নিতে পেরেছি।’
ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে (দ.) বণিক সমিতির অ্যাডহক কমিটির সদস্য সচিব আবুল খায়ের বলেন, ‘আমাদের মার্কেটে মোট দোকান ১ হাজার ২৭৫টি। এর মধ্যে ২৪৩টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিচতলার ৩টি, দ্বিতীয় তলায় ৩০ থেকে ৩৫টি এবং বাকিগুলো তৃতীয় তলায়। আগুন নিভে যাওয়ার পর আমরা এখন দ্রুত পরিষ্কার করতে কাজ করছি। আশা করছি দ্রুত পরিষ্কারের কাজ শেষ করতে পারব। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুতের লাইন মেরামত করে আগামী দুই দিনের মধ্যে দোকান খুলতে চাই।’
ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ছিল নিউ সুপার মার্কেট
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, তারা ঢাকা ও দোহারে জরিপ চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের যে তালিকা তৈরি করেছিল, সেই তালিকায় নিউ সুপার মার্কেটও ছিল। কিন্তু মার্কেট কর্তৃপক্ষ অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। ফায়ারের পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, বারবার ঝুঁকিপূর্ণর বিষয়টি তাদের জানানো হয়েছে।
সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে ফায়ার পরিচালক বলেন, ‘বর্তমানে দেশের তাপমাত্রা বেশি, যদি অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে মার্কেটের কোনো দাহ্য পদার্থে আগুন লাগে তারা প্রাথমিকভাবে আগুন নেভাতে কাজ করবে।’ এ ছাড়া তিনি দেশের মার্কেটগুলোতে রাতে থেকে ধূমপান না করা ও রান্না না করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
ডিএসসিসির তদন্ত কমিটি
নিউ সুপার মার্কেটের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কারণ অনুসন্ধান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রণয়ন এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে ৯ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ডিএসসিসির অঞ্চল-১-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীনকে আহ্বায়ক এবং প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দীনকে সদস্যসচিব করে এই কমিটি গঠন করা হয়। গতকাল ডিএসসিসির সচিব আকরামুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক আদেশের মাধ্যমে এই কমিটি গঠন করা হয়।