রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পাওয়ার দৌড়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশনের প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকেছে এক ডজন দল। তবে দৈনিক বাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, টিকে যাওয়া এসব দলের চার ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ তিনটি দলের ঠিকানা ঠিক নেই। প্রকাশিত তালিকায় উল্লিখিত ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে দলগুলোর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দেখা পাওয়া যায়নি।
এদিকে নিবন্ধন পাওয়া এক ডজন দলের তিন ভাগের এক ভাগ দলের অর্থাৎ চারটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভরদুপুরে পাওয়া গেছে তালাবদ্ধ। বাকি পাঁচ দলের মধ্যে দুটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুবই সংকীর্ণ পরিসরে।
ঠিকানা ঠিক না থাকা দল তিনটি হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি) ও বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টির (বিএমজেপি)। অবশ্য এসব দলের নেতাদের দাবি, প্রকাশিত তালিকায় ভুল ঠিকানা ছাপা হয়েছে। এটা নির্বাচন কমিশনের ভুল।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের লোকেরা এখনো মাঠে যায়নি। তারা দেখবে, কাদের ঠিকানা ঠিক আছে, কাদের নেই। নিবন্ধনপ্রত্যাশী দলগুলোর কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠি পাওয়ার ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন পাঠাতে হবে।’
প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকল যে ১২টি দল
সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন দলগুলোকে নিবন্ধন দিতে আবেদন আহ্বান করার বিধান আছে। গত বছরের ২৬ মে আবেদন আহ্বান করে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল বর্তমান কমিশন। পরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অনুরোধে সময় দুই মাস বাড়ানো হয়েছিল। ইসির নিবন্ধন পেতে ৯৩টি রাজনৈতিক দল আবেদন করলেও তিন দফার ছাঁকুনি শেষে গত ১১ এপ্রিল প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে যাওয়া ১২টি দলের তালিকা প্রকাশ করে আউয়াল কমিশন।
এসব দল হলো এবি পার্টি (আমার বাংলাদেশ পার্টি), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট পার্টি (বিএইচপি), গণ-অধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ সনাতন পার্টি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজেপি), বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি), ডেমোক্রেটিক পার্টি ও বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি)।
এখন এসব দলের মাঠ পর্যায়ের যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচন অফিসকে ১৫ দিনের মধ্যে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঈদের ছুটির পর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচন অফিস এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল এ-সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের চিঠি পেয়েছে। কমিশনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী জুনের মধ্যে উত্তীর্ণ দলগুলোর নিবন্ধন চূড়ান্ত করতে চায় সাংবিধানিক এ সংস্থা।
ঠিকানা নেই যে তিন দলের
নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ঠিকানা ৫৫/১, পুরানা পল্টন, ঢাকা। গত বৃহস্পতিবার পুরানা পল্টনের এই ভবনে গিয়ে বিএনএমের কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। ভবনের কোথাও দলটির নামে কোনো সাইনবোর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। কথা হয় ভবনের এক নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে। তিনি তিন বছর ধরে এই ভবনে কাজ করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘চার বছর হইছে (বিএনএম) চইলা গেছে। অনেকেই আইছিল খুঁজতে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনএম সদস্য সচিব অবসরপ্রাপ্ত মেজর মো. হানিফ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ওইখানে আমাদের অফিস ছিল। পরবর্তী সময় আমরা অফিস শিফট করেছি। এটা ওনারা (নির্বাচন কমিশন) ভুল করেছেন। তারা পুরোনো ঠিকানা দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘ঠিকানা পরিবর্তনের বিষয়ে ২০২১ সালে চিঠি দিয়েছি।’ কিন্তু ওই সময় নির্বাচন কমিশনকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়ার সুযোগ ছিল না- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অবসরপ্রাপ্ত মেজর মো. হানিফ বিষয়টি নিয়ে দলের আরেক নেতার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর মো. হানিফের পরামর্শে দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ৫৫/১ পুরানা পল্টনে তাদের অফিস ছিল। এখন তাদের অফিস মহাখালীতে। তিনি জানান, বিএনএমের ৩৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে ১২ জন ব্যারিস্টার। পাঁচজন বিভিন্ন বিষয়ে পিএইচডি, ১০ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। সদস্য পদে রয়েছেন ৫০ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (বিএলডিপি) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা ৩৭৩, দিলু রোড। তবে প্রাচীরঘেরা এ ভবনে গিয়ে এই দলের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। বরং সেখানে দেখা মেলে বাংলাদেশ গণ-আজাদী লীগের রাজনৈতিক অফিসের। ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী আব্দুল মজিদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘(বিএলডিপি) আগে এখানে ছিল, এখন অন্য জায়গায় চলে গেছে। দুই মাসের বেশি সময় হবে। বৃদ্ধ একজন মানুষ আগে বসত এখানে, এখন বসে না।’
বিএলডিপি চেয়ারম্যান এম নাজিম উদ্দীন আল আজাদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘এখন আর দিলু রোডে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় নেই। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় ৬৪/বি ঠিকানায় অফিস নিয়েছি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে অবহিত করেছি। গত বছরের ডিসেম্বরে কার্যালয় স্থানান্তর করেছি।’
এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী ৪৩/এ, ইন্দিরা রোড, তেজগাঁও বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টির (বিএমজেপি) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা। কিন্তু সেখানে গিয়েও এই দলের কার্যালয়ের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। দলটির সভাপতি সুকৃতি কুমার মণ্ডল। নির্বাচন কমিশনের তালিকায় দেয়া ফোন নম্বরে একাধিকবার ফোন ও মেসেজ দিয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
বিএমজেপির প্রকাশিত ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে ‘ঝুনা’ নামক ভবনটির সামনে প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষার পর এক বয়স্ক নারীকে প্রবেশ করতে দেখা যায়। তার সঙ্গে কথা হয় দৈনিক বাংলার। মোমেনা খাতুন নামে ওই গৃহিণী বলেন, তারা এ মাসেই এই ভবনে উঠেছেন। বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজেপি) নামের কোনো দলের নাম তিনি শোনেননি।
ভরদুপুরে তালাবদ্ধ চার রাজনৈতিক কার্যালয়
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার ঘুরে দেখা যায়, ভরদুপুরেও তালাবদ্ধ প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে যাওয়া চার রাজনৈতিক দল নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ সনাতন পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির (বিপিপি) কার্যালয়। তিনটি দলের কার্যালয়ের বাইরে সাইনবোর্ড থাকলেও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কোনো সাইনবোর্ড দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে দলগুলোর নেতারা দাবি করেছেন, নতুন দল হওয়ায় তাদের লোকবল কম। অচিরেই অফিসে লোকজন রাখার চেষ্টা করবেন। কেউ কেউ দাবি করেছেন, ফোন দিয়ে গেলে ভালো হতো। যে সময় এই প্রতিবেদক কার্যালয় অনুসন্ধানে গিয়েছিলেন, সে সময় তারা সাংগঠনিকভাবে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
সংকীর্ণ অফিসেই কেন্দ্রীয় কার্যালয়
নগরীর পল্টনে বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট পার্টির (বিএইচপি) কেন্দ্রীয় কার্যালয়। যেখানে একটি অফিস রুম। একটি টেবিল ও কম্পিউটার এবং পাঁচটি চেয়ার দেখা যায়। দলটির ৫৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি থাকলেও তাদের কার্যালয়ে বসতে দেয়ার জায়গা নেই। রাজধানীর হাতিরপুলের ইস্টার্ন প্লাজায় অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয় ডেমোক্রেটিক পার্টির। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অন্য একটি সাইনবোর্ডের ওপর ডেমোক্রেটিক পার্টির একটা স্টিকার মেরে দেয়া হয়েছে। এক রুমের অফিসকে তিন ভাগে ভাগ করে অফিস করা হয়েছে। তবে সেখানে ১০ জনের বেশি বসার জায়গা নেই। এ ছাড়া মিরপুরে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির অফিসে গিয়ে দুই রুমের একটি অফিস দেখা যায়। যেখানে তিন-চারটি টেবিল ও আটটি চেয়ারের দেখা মেলে।
তবে এবি পার্টি ও গণ-অধিকার পরিষদের কার্যালয় বাকি ১০টি দলের তুলনায় বেশ বড়। জামায়াতের বহিষ্কৃত নেতাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে এবি পার্টি। রাজধানীর বিজয়নগরে ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে এই দলের কার্যালয়ের দেখা মেলে। আর পল্টনের প্রিতম জামান টাওয়ারে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে গণ-অধিকার পরিষদের ব্যানার-পোস্টার। লিফট থেকে দলের কার্যালয়ে প্রবেশ করতেই দেখা যায় অনেকগুলো টেবিল গোল করে সাজানো। দলীয় নেতা-কর্মীদের পদচারণে কার্যালয় বেশ সরগরমও দেখা গেছে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবির) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। তথ্য যা প্রকাশ করেছে তার সঙ্গে বাস্তবতার সামঞ্জস্য না থাকলে সেটা খুবই প্রতারণামূলক আচরণ, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’
নিবন্ধনের যেসব শর্ত আছে, সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন দেয়া উচিত বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে চাপে পড়ে নিবন্ধন দেয়ার অভিযোগ আছে। এগুলো যেন না হয়। সেগুলো হলে ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হয়।’
সার্বিক বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিক বাছাইয়ে কাগজপত্রে ঠিক পাওয়া গেছে তাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এতেই টিকে গেছে বললে হবে না। এখন মাঠ পর্যায়ে জরিপ হবে। মাঠ জরিপ যাচাই-বাছাই শেষে বলা যাবে কোনগুলো টিকবে।’