গত ১০ বছরে দেশের তিনটি গভীর সমুদ্রে ব্লক ইজারা দেয়া হয়েছিল দুটি বিদেশি কোম্পানিকে, সেখানে গ্যাসও মিলেছে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তির (পিএসসি বা প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট) বেশি গ্যাসের দাম বাংলাদেশ দিতে রাজি না হওয়ায় ওই দুটি কোম্পানিই দেশ ছেড়ে চলে যায়। বর্তমানে গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লক ফাঁকা রয়েছে, এই ১৫টি ব্লক ইজারা পেতে সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসভিত্তিক জায়ান্ট তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি এক্সনমোবিল। এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রয়েছে। সরকার রাজি থাকলে এই ১৫টি ব্লকই দেয়া হবে এক্সনমোবিলকে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এক্সনমোবিলকে সাগরের ১৫টি ব্লক ইজারা দেয়ার আগে ২০১৯ সালের করা মডেল পিএসসি সংশোধন করবে সরকার। ২০১৯ সালের মডেল পিএসসি সংশোধনের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ অনুমোদন দিলেই নতুন পিএসসি অনুমোদন পাবে। শিগগিরই সংশোধিত ‘মডেল পিএসসি ২০২৩’ অনুমোদন দেবে সরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসভিত্তিক এক্সনমোবিলের প্রস্তাবটি ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে সম্মতি পেলে সমঝোতা স্মারক সই হবে। এরপর এক্সনমোবিল সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জরিপ চালাবে। সেই জরিপের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তারা চূড়ান্ত চুক্তি করবে। এখনই সে কারণে তেল-গ্যাস উত্তোলনে চূড়ান্ত চুক্তি করতে চায় না এক্সনমোবিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘এক্সনমোবিলের প্রস্তাবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার সরকারের। আমাদের কাছে যে নির্দেশনা আসবে আমরা সেটাই পালন করব।’
তিনি বলেন, ‘মডেল পিএসসি ২০২৩’ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া আছে। পেট্রোবাংলা থেকে যা সংশোধন করার দরকার আমি সেটা শেষ করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। এ বিষয়ে সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে।’
সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, এক্সনমোবিলের মতো জায়ান্ট কোম্পানি যুক্ত হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। তা না হলে গ্যাস উত্তোলনে বাংলাদেশকে অপেক্ষাই করে যেতে হবে।
তেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ১২ নম্বর ব্লকটি সমুদ্র ব্লকের সব থেকে সম্ভাবনাময়ী। এটি পসকো দাইয়ুকে ইজারা দেয়া উচিত হয়নি। এই ব্লকের লাগোয়া অঞ্চল মিয়ানমার থেকে পসকো দাইয়ু অপারেটর হিসেবে গ্যাস তুলছে। পসকো দাইয়ু বাংলাদেশে তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য এসেছে নাকি এখানকার তথ্য নিতে এসেছে, এটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। তারা এখানে জরিপ করে জেনেছে যে তেল-গ্যাস আছে এরপর তারা চলে গেছে, এটাই তাদের দরকার ছিল। এখন তারা মিয়ানমার অংশ থেকে গ্যাস তুলে চীনে রপ্তানি করছে, সেটাই অব্যাহত রাখবে।
তিনি বলেন, গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লক ফাঁকা রয়েছে। এর মধ্যে ১০, ১১ ও ১২ নম্বর ব্লকে গ্যাস পাওয়া গেলেও উত্তোলন করা হয়নি। এক্সনমোবিল তাদের প্রস্তাবে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাসপ্রাপ্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে বলেছে, গভীর সমুদ্র এলাকায় তেল-গ্যাস সঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি স্ট্র্যাটিগ্রাফিক ফাঁদে ঘটতে পারে। এক্সনমোবিল গায়ানার গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান সফলতার সঙ্গে করেছে এবং এই জাতীয় ফাঁদগুলো খুঁজে পাওয়ার সব থেকে ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে এক্সনমোবিলের।
কী প্রস্তাব আছে এক্সনমোবিলের
বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রের ব্লকগুলোতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন করতে চেয়ে একটি প্রস্তাব সম্প্রতি পেট্রোবাংলাকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান এক্সনমোবিল। এ জন্য আট বছর মেয়াদে তিন ভাগে তারা কাজ করবে। প্রথম দুই বছরে এক্সনমোবিল পিএসসি চুক্তি সই ও টুডি সার্ভে (দ্বিমাত্রিক জরিপ) করবে। এর পরের তিন বছরে তারা থ্রিডি সার্ভে (ত্রিমাত্রিক জরিপ) করবে। আর শেষ তিন বছরে তারা কূপ খনন করবে। এক্সনমোবিলকে বিনা দরপত্রে সাগরের তেল-গ্যাসের ব্লকের ইজারার পিএসসি চুক্তি করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমেই পিএসসি সই করতে চায় এক্সনমোবিল।
দেশে বর্তমানে সাগরবক্ষে ২৬টি তেল-গ্যাসের ব্লক রয়েছে। আর স্থলভাগে রয়েছে ২২টি। এর মধ্যে ১১টি ব্লক অগভীর সমুদ্রে ও গভীর সমুদ্রে রয়েছে ১৫টি ব্লক। অগভীর সমুদ্রে ১১ নম্বর ব্লক সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি এবং অগভীর সমুদ্রের ৪ ও ৯ নম্বর ব্লক ভারতের দুটি কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া (ওআইএল) ইজারা নিয়েছিল। এর মধ্যে সান্তোস দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক জরিপ করার পর কূপ খনন না করেই বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়।
আর গভীর সমুদ্রের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লক ইজারা পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কনোকো-ফিলিপস আর ১২ নম্বর ব্লক পেয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার পসকো দাইয়ু করপোরেশন। এই তিনটি ব্লকে গ্যাস পাওয়া গেলেও তারা উত্তোলন না করেই দেশ ছেড়েছে। এর ফলে গভীর সমুদ্রের সবগুলো ব্লকই এখন ফাঁকা রয়েছে। এক্সনমোবিল গভীর সমুদ্রের এই ১৫টি ব্লকই ইজারা চায়। ২০১৯ মডেল পিএসসিতে অগভীর সমুদ্রের প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৬ ডলার আর গভীর সমুদ্রে এই দাম ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ২৫ ডলার। এবারের উৎপাদন অংশীদারি চুক্তিতে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ১০ ডলার রাখা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের গ্যাসের ওপর মালিকানার হার বা হিস্যা কিছুটা কমতে পারে।
জরিপেও অংশ নিতে চায় এক্সনমোবিল
বাংলাদেশের সাগরভাগের তেল-গ্যাসের মজুত জানতে সরকার দুটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে করার কাজ দিয়েছে। এ দুটি কোম্পানি হলো নরওয়ের টিজিএস ও যুক্তরাষ্ট্রের এসএলবি (সাবেক স্লামবার্জার)। এই দুটি প্রতিষ্ঠান গত ৪ জানুয়ারি থেকে বঙ্গোপসাগরের ৩২ হাজার লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক জরিপ শুরু করেছে। এই জরিপের জন্য সরকার তাদের কোনো অর্থ দেবে না। তবে জরিপের তথ্য বা ডেটা এই দুটি প্রতিষ্ঠান তেল-গ্যাস উত্তোলন করতে চায়, এমন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে অর্থ তুলে নিতে পারবে।
এক্সনমোবিল মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। তারা টিজিএস ও এসএলবির সঙ্গে যৌথভাবে সাগরের তেল-গ্যাস জরিপে অংশ নিতে চায় বলে পেট্রোবাংলার কাছে প্রস্তাবে জানিয়েছে।
গভীর সমুদ্রের ব্লক কতটা সম্ভাবনাময়
গভীর সমুদ্রের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লক ইজারা পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি কনোকো-ফিলিপস। ২০১১ সালের ১৬ জুনে পেট্রোবাংলার সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী কনোকো-ফিলিপসকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ৬ দশমিক ৫ ডলার দেয়ার কথা ছিল। এরপর ২০১৪ সালে সাগরের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে ৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দেয় কনোকো-ফিলিপস। এরপর তারা সরকারকে চাপ দিতে শুরু করে, গ্যাসের মূল্য প্রতি হাজার ঘনফুটে ৮ ডলার করে দিতে। গ্যাসের দাম না বাড়ালে বিদেশে গ্যাস রপ্তানির অনুমতি দিতে হবে। সরকার এ শর্তে রাজি না হওয়ায় কনোকো-ফিলিপস তখন দেশ ছেড়ে চলে যায়।
এরপর ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান পসকো দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে সব থেকে সম্ভাবনাময় গভীর সমুদ্রের ১২ নম্বর ব্লকে পিএসসি সই করে পেট্রোবাংলা। এই ব্লকের সঙ্গে লাগোয়া মিয়ানমারের সমুদ্র ব্লক থেকে গ্যাস তুলছে পসকো দাইয়ু। সেখান থেকে তারা চীনে গ্যাস রপ্তানিও করছে। এখানে দাইয়ু সরকারকে গ্যাস পাওয়ার কথা জানিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। কিন্তু চুক্তিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সুযোগ না থাকায় পসকো দাইয়ু দেশ ছেড়ে চলে যায়।
দেশে গ্যাসের মজুত কত?
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্যমতে, দেশে আবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ মোট ২৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট বা টিসিএফের চেয়ে কিছু বেশি। গত ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে গ্যাস উত্তোলনের পর বর্তমানে ৯ দশমিক শূন্য ৬ টিসিএফ অবশিষ্ট রয়েছে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক গড়ে প্রায় ২ হাজার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে বিবেচনায় অবশিষ্ট মজুত গ্যাস দিয়ে প্রায় ১১ বছর চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। এই হিসাব আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র দিয়ে করা হয়েছে।
এই হিসাব দিয়ে বলা হচ্ছে দেশের গ্যাস আগামী ১০ থেকে ১২ বছরে ফুরিয়ে যাবে। তবে বিশ্ববিখ্যাত তেল-গ্যাস জরিপ সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে ভিন্নকথা। সারা দুনিয়ার তেল-গ্যাসের মজুতের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) তথ্য প্রকাশ করে থাকে। ইউএসজিএস ও পেট্রোবাংলার যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৮ সালে দেশের তেল-গ্যাসের মজুতের ওপর একটি সমীক্ষায় বলা হয়, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ সম্ভাবনায় অনাবিষ্কৃত গ্যাস মজুত ৩২ দশমিক ৫ টিসিএফ, এর মধ্যে ৮ দশমিক ৫ টিসিএফ পাওয়ার সম্ভাবনা ৯৫ শতাংশ।
নরওয়ের সরকারি সংস্থা নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট (এনপিডি) ও বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান হাইড্রোকার্বন ইউনিট দেশের তেল-গ্যাসের মজুতের সমীক্ষায় বলা হয়, দেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসের মজুত আছে ৪২ টিসিএফ, এই পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ। ডেনমার্কভিত্তিক তেল-গ্যাস পরামর্শক প্রতিষ্ঠান র্যাম্বল এক সমীক্ষায় বলেছে, বাংলাদেশে ৩৪ টিসিএফ গ্যাসের মজুত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরেকটি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠান গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটসকে দিয়ে ২০১৭ সালে সরকার একটি সমীক্ষা করে। সেই সমীক্ষা প্রতিবেদনে ৯২ শতাংশ সম্ভাবনা আছে, এমন মজুতের পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ। তবে এসব জরিপ গভীর সমুদ্রের ওপর করা হয়নি।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে প্রতিবছর এক টিসিএফ গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। স্থলভাগ ও সাগরভাগের মজুত ইঙ্গিত দিচ্ছে দেশের গ্যাস দিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ বছর অনায়াসে পার করতে পারবে বাংলাদেশ। কিন্তু এসব গ্যাস উত্তোলনে উদ্যোগের অভাব রয়েছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম বলেন, তেল-গ্যাস উত্তোলন দরকার। তেল-গ্যাস উত্তোলনে সর্বোচ্চ গুরুত্বও দিতে হবে। তবে তা যেন প্রতিযোগিতামূলক হয়, সেটিও দেখতে হবে।