রেলের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশের সব রেললাইনকে মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রূপান্তর করা হবে। তবে সে মহাপরিকল্পনা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে এখন রেললাইন মেরামত প্রকল্পে জোর দিয়েছে, যার প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। দুই ভাগে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এক ভাগ শেষ করার কথা ২০২৫ সালের ৩০ জুনের মধ্যে, আরেকটির মেয়াদ ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০৩৫ সালের মধ্যে রেলের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বর্তমানে যে মেরামত প্রকল্পের তোড়জোড় চলছে, তার সিংহভাগ কাজ অপচয়ের খাতায় পড়ে যাবে। কারণ মিটারগেজ লাইনগুলো মেরামতের পর পরই সেগুলো আবার ব্রডগেজে রূপান্তর করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, দেশের রেল ব্যবস্থাপনা দুই অঞ্চলে বিভক্ত। একটি পূর্বাঞ্চল, অন্যটি পশ্চিমাঞ্চল নামে পরিচিত। দুই অঞ্চলে ৪৩ জেলায় মোট রেললাইন আছে প্রায় ৩ হাজার ৯৩ কিলোমিটার। এসব রেললাইনের যেসব সেকশনের অবস্থা খারাপ, সেই অংশে রক্ষণাবেক্ষণ বা পুনর্বাসন করতে ওই মেরামত প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুই অঞ্চলের রেললাইনের কোথায় কী অবস্থা, তার সমীক্ষাও হয়েছে। তাতে রেললাইন পুনর্বাসন প্রকল্পে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের রেললাইনের পুনর্বাসনের বিষয়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফেসিলেশন কোম্পানি (আইআইএফসি) নামের দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠান সমীক্ষা করেছে। সেই সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পূর্বাঞ্চলের রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসনে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৬০ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আর পশ্চিমাঞ্চলের রেললাইন পুনর্বাসনে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ২৩১ কোটি ২০ লাখ টাকা।
রেলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রকল্পের বিষয়ে দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘রেললাইনের সেকশনে সেকশনে মেরামত না করে একবারে যদি ব্রডগেজ বা ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা যায়, তাহলে অপারেটিং ক্ষমতা বাড়বে এবং যাতায়াতের সময় কমবে। রেললাইন পুনর্বাসনে যে টাকা ব্যয় হবে, সেটি অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। রেললাইন মেরামত করে খুব একটা উপকার পাওয়া যাবে না। খরচ বেশি হলেও একবারে যদি নতুন ব্রডগেজ লাইন করা হয়, তাহলে সেটির সুবিধা আগামী ৩০ বছর পাওয়া যাবে। কিন্তু লাইন মেরামত করে সেই সুবিধা পাওয়া যাবে না।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসনের জন্য আমরা একটি প্রকল্প নিতে যাচ্ছি। এখন সেটিই ডিপিপি তৈরির কাজ চলছে। এতে আমাদের রেললাইন যেখানে যে ধরনের মেরামত প্রয়োজন হবে সেটি করা হবে।’
বেহাল দুই অঞ্চলের রেললাইনই
পূর্বাঞ্চলের রেলপথ পুনর্বাসন সমীক্ষা প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় পূর্বাঞ্চলের মোট ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ সম্পূর্ণ নবায়ন করা হবে, ৪০০ কিলোমিটার রেলপথের রেল বসানো হবে, প্রায় ২০০ কিলোমিটার রেলপথের স্লিপার, ফিটিং পরিবর্তনসহ মোট ৫ লাখ কিউবিক মিটার ঘাটতি ব্যালাস্ট পূরণ ও অন্যান্য রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করা হবে। পূর্বাঞ্চলে মোট রেললাইন আছে ১ হাজার ৩৩০ কিলোমিটার।
পশ্চিমাঞ্চলে রেললাইন নিয়ে করা প্রকল্পের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পশ্চিমাঞ্চলে ১ হাজার ৬৯০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে বিভিন্ন সেকশনে প্রায় ৩২৬ কিলোমিটার রেললাইন অত্যধিক পুরোনো, যার ক্ষয়প্রাপ্তের হার প্রায় ৫ থেকে ১৫ শতাংশ। ফলে প্রতিনিয়ত রেল ভেঙে যাচ্ছে, নিরাপদ ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। এ ছাড়া সারা পশ্চিমাঞ্চলে বিভিন্ন সেকশনে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ স্লিপার নষ্ট হয়ে গেছে। রেলের পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন সেকশনে প্রায় ৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার ব্ল্যাক কটন সয়েল আছে, যেখানে গতি নিয়ন্ত্রণ করে ট্রেন চলাচল করছে।
তাই এসব সেকশনে সমগতিতে ট্রেন পরিচালনা করতে ওই ৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার রেললাইনের ব্ল্যাক কটন সয়েল ট্রিটমেন্ট করা জরুরি। এ ছাড়া গোটা পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিটি সেকশনে ব্যালাস্টের ঘাটতি রয়েছে। নিরাপদ ও দ্রুতগতিতে ট্রেন চলাচলের জন্য ক্ষয়প্রাপ্ত রেল, অকেজো স্লিপার পরিবর্তন, ব্যালাস্টিং, টেম্পিং, স্যালো স্ক্রিনিংসহ অন্য আনুষঙ্গিক কাজ করতে হবে। রেলপথ নবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণসংশ্লিষ্ট রেল ও ফিটিংস, স্লিপার ও ব্যালাস্ট ব্যয়বহুল হওয়ায় রেভিনিউ বাজেটের আওতায় বিদ্যমান রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় রেলপথ নবায়ন ও ক্ষতিগ্রস্ত স্লিপার, অধিক ক্ষয়প্রাপ্ত রেল ও অন্যান্য ফিটিংস পরিবর্তনসহ ঘাটতি ব্যালাস্ট পূরণ ও মেকানাইজড মেইনটেন্যান্স কাজ সম্পন্ন হলে দুর্ঘটনা এড়িয়ে সুষ্ঠু ও নিরাপদে ট্রেন চলাচল সম্ভব হবে বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করার পর কারিগরি কমিটি সেটির অনুমোদন দিলে তা পাঠানো হবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে। পুনর্বাসন প্রকল্পে পূর্বাঞ্চলের ডিপিপি নিয়ে ইতিমধ্যে একটি মিটিং হয়েছে।
এদিকে পূর্বাঞ্চলের রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পটি ২০২৫ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা রাখা হচ্ছে ডিপিপিতে। পশ্চিমাঞ্চলের রেললাইন পুনর্বাসন প্রকল্পটি ২০২৭ সালের ৩০ জুন মেয়াদ রাখা হচ্ছে এই ডিপিপিতে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ রেলের ৭০ শতাংশ বা দুই হাজার কিলোমিটার রেললাইন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখন দুই হাজার কিলোমিটার রেললাইন একবারে ব্রডগেজে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। এত ফান্ডিং পাওয়া যাবে না। ফলে রেললাইন পুনর্বাসন প্রকল্প অনেক আগেই নেয়া দরকার ছিল। এটি অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, পুনর্বাসন প্রকল্পে মিটারগেজ লাইন মেরামত করে যদি মিটারগেজই রাখে, সেটি হবে সবচেয়ে বড় ভুল। যেখানে মিটারগেজ লাইন মেরামত হবে, সেটি যেন অবশ্যই ডুয়েলগেজ করা হয়। রেল কখনো সুদূরপ্রসারী ছিল না। ব্রিটিশ আমল থেকেই রেলের এই সমস্যা। লাইনের আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি রেললাইন পরিবর্তন করত, তাহলে এই সমস্যায় পড়তে হতো না। বরাবরই রেলওয়ে রক্ষণাবেক্ষণে খুব একটা মনোযোগী নয়। তাই তাদের ট্রেডিশনাল পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক পদ্ধতিতে রেললাইন নির্মাণ করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তিতে রেললাইন করলে লাইনের মাঝে ফাঁকা রাখার দরকার হয় না।