ভোট চলাকালীন কোনো বড় ধরনের অনিয়ম হলে নির্বাচন কমিশন চাইলেই পুরো সংসদীয় আসনের ভোট বাতিল করতে পারত। তবে ভোট শেষ হয়ে গেলে প্রাথমিক ফল প্রকাশের পর কোনো অভিযোগ এলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ইসির কোনো ক্ষমতা ছিল না। তা নিশ্চিত করতেই আরপিওর সংশোধন চেয়েছিল কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন। গেজেট প্রকাশ করার আগ পর্যন্ত পুরো সংসদীয় আসন বাতিলের যে ক্ষমতা চেয়েছিল কমিশন, তা না পেলেও সুনির্দিষ্ট কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করতে পারবে সাংবিধানিক এ সংস্থা।
ফলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ সংশোধনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা হারানোর যে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে তাও অমূলক। সংশোধনে নির্বাচন কমিশনের পুরো প্রস্তাব গ্রহণ না হলেও কিছুটা অর্জন হয়েছে বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা। তবে তিনি এও বলেন, ‘ফলাফল ঘোষণার পর বা গেজেট হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরো নির্বাচন বাতিলে ইসি যে প্রস্তাব দিয়েছিল সেটা পেলে ভালো হতো। কেননা যারা অনিয়ম করে তাদের একটা ভয় থাকত যে ভোট বাতিল হয়ে আবার হ্যাপাটা নিতে হবে।’
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) অধ্যায় ৭-এর ৯১ ক-তে উল্লেখ আছে, ‘যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি-প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করিতে সক্ষম হইবেন না, তাহা হইলে ইহা যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমত, সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করিতে পারিবে।’
৯১(ক)-এর সঙ্গে নতুন করে ৯১(ক)(ক) উপধারা যুক্ত করে বলা হয়েছে, ফলাফল ঘোষণার পর কিন্তু গেজেট হওয়ার আগে কমিশন যদি কোনো কেন্দ্রের অনিয়মের প্রমাণ পায় তাহলে সেই কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল বা স্থগিত করতে পারবে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এ প্রস্তাব পাঠানোর দরকার ছিল না বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তার মতে, ‘ওনারা (নির্বাচন কমিশন) এখনো কপি পায় নাই। যা কথা বলছে তা অনুমাননির্ভর।’ অন্যদিকে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আরপিও সংশোধনের পর ইসির কিছু ক্ষমতায়ন অবশ্যই হবে। তবে ৩৯ ধারাসহ সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোতে তার প্রতিফলন না ঘটলে এর প্রয়োগে আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ফলাফল প্রাপ্তির পর গেজেট করতেই হবে, গেজেট হলেই নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারধীন হয়ে যাবে।’
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ওনারা কপি পায় নাই। যা কথা বলছে তা অনুমাননির্ভর।’
এই প্রস্তাব পাঠানোর দরকার ছিল না জানিয়ে এ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের এই ক্ষমতা আগে থেকেই আছে। নুর হোসেন বনাম নজরুল ইসলাম মামলার রায়ে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যদি নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে নিশ্চিত হয়, তাহলে নির্বাচন বাতিল করতে পারে। যেহেতু সুনির্দিষ্ট নেই, সেহেতু গেজেটে প্রকাশের পরও ইসি পারবে। তাই আমি মনে করি, এই প্রস্তাব তাদের পাঠানো উচিত হয় নাই।’
গত ২৮ মার্চ আরপিও সংশোধনী প্রস্তাবটি নীতিগতভাবে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হয়। তাতে উল্লেখ ছিল, ভোটের পর কোনো কেন্দ্রে, এমনকি পুরো নির্বাচনী এলাকার (আসন) ভোটে বড় ধরনের অনিয়ম, কারসাজি ও ভোটের প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়ার প্রমাণ পেলে গেজেট প্রকাশ স্থগিত এবং ভোট বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দেশ দিতে পারবে ইসি।
গত ১৮ মে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন জানান, নির্বাচনে কোনো ভোটকেন্দ্রে বড় ধরনের অনিয়ম, কারসাজি ও ভোটপ্রক্রিয়ায় বাধা দেয়ার প্রমাণ পেলে নির্বাচন কমিশন সেই কেন্দ্রের ভোট বা ফল বাতিল করে পুনরায় ভোট গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবে। পুরো আসনের ভোট বাতিল করতে পারবে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচন আইনের এমন বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ সংশোধনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সংশোধনী প্রস্তাবে ইসি ভোটে অনিয়ম হলে পুরো আসনের নির্বাচন বা ফল বাতিলের ক্ষমতা চেয়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, এর ফলে গাইবান্ধার মতো ভোট বন্ধ করতে পারবেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো উত্তর দেননি। এর পরই সৃষ্টি হয় বিতর্ক। ইসি কি তাহলে গাইবান্ধার মতো ভোট বন্ধের ক্ষমতা হারাতে বসেছে। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার ইসি সচিবকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। তবে গতকাল রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইসি রাশেদা সুলতানা এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। তার মতে, ভোট বাতিলের ক্ষমতা হারায়নি নির্বাচন কমিশন।
রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘আমি যতটুকু বুঝি যে আমরা পারব। কারণ আমরা ৯১(ক) নিয়ে কোনো প্রস্তাবনাই দিইনি। যে প্রস্তাবনা যায়নি, সেটা তো বাতিল হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।’
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) নির্বাচন বন্ধ করার প্রধান অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ টেনে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছেন, ‘সেটা কিন্তু ৯১-এর ক। একটা নির্বাচনে তিনটা পর্যায়। প্রথম হলো নির্বাচনপূর্ব, আরেকটা হলো নির্বাচন চলাকালীন, একটা নির্বাচনের পরবর্তী; এই তিনটা ধাপের মধ্যে ৯১-এর ক যেটা আছে, সেটা কিন্তু নির্বাচনপূর্ব পর্যন্ত, নির্বাচন চলা পর্যন্ত। ওইখানে কমিশনের একটা ক্ষমতা দেয়া আছে। সেই ক্ষমতায় কমিশন কোনো রকম অনিয়ম, কারচুপি যেটাই হোক, নির্বাচন কমিশনের নজরে এলে যদি দেখে এ রকম, তাহলে নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে। এইটা তো আছেই আইনে, এক্সিসটিং।’
বিভ্রান্তির প্রসঙ্গ টেনে রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘অনেকে মনে করছেন যে ৯১(ক)তে যে ক্ষমতাটা ছিল, নির্বাচন চলাকালীন নির্বাচন বন্ধ করে দেয়ার যে সুযোগটা, সেটা বোধহয় খর্ব হয়েছে। বিষয়টা তা নয়। আমি যতটুকু বুঝি, ওইটা তো হবেই না। কেননা আমরা তো ওইটা চাই-ই নাই। সেখানে প্রস্তাবনা হলো ৯১(ক)-এর সঙ্গে ক (ক) বলে আরেকটা উপ-অনুচ্ছেদ যোগ দেয়া। রিটার্নিং অফিসার ফলাফল প্রকাশের পর থেকে গেজেট হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়টা অনিয়ম হলে যেন ব্যবস্থা নেয়া যায়, সেই ক্ষমতাটা চাওয়া হয়েছে।’
গাইবান্ধার ভোট প্রসঙ্গে এই কমিশনার বলেন, ‘আমরা ৯১(ক) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে নির্বাচনটা বন্ধ করেছি। এখন আমরা চাচ্ছি এক বা একাধিক কেন্দ্র যেখানেই হোক, রিটার্নিং কর্মকর্তার ফলাফল ঘোষণার পর এবং গেজেট হওয়ার আগ পর্যন্ত, এই মধ্যবর্তী সময়ে অভিযোগ এলে সেটা যেন তদন্ত করে বন্ধ করতে পারি এবং সেখানে নতুন করে ভোট হবে। যেখানে ছিলই না, সেখানে তো কিছুটা হলেও বাড়ল। পুরোটা না হলেও কিছুটা তো অর্জন হয়েছে। ফলাফল ঘোষণার পর পুরোটা বাতিলের ক্ষমতা পেলে ভালো হতো। কেননা যারা অনিয়ম করে তাদের একটা ভয় থাকত যে ভোট বাতিল হয়ে আবার হ্যাপাটা নিতে হবে।’
ভোট গ্রহণের জন্য নির্বাচনী শিডিউল চলাকালীন থেকে ভোট চলাকালীন পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে নির্বাচন স্থগিত, বাতিল করার বিধান আরপিওতে আগে থেকেই আছে বলে জানান নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘৯১(ক)তে বিশেষ ক্ষমতাও প্রদান করা আছে। তবে তা ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। তাই গাইবান্ধা-৫ আসনের মতো নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা ইসির অক্ষুণ্ন আছে।
৯১(ক)(ক) ধারা যোগ করে বর্তমান কমিশন ফলাফল ঘোষণা ও গেজেট প্রকাশের পর ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা পাওয়ার প্রস্তাব করে জানিয়ে তিনি বলেন,‘ মন্ত্রিপরিষদ সম্পূর্ণ আসনের ফলাফল বাতিল কারার প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। শুধু অভিযোগ প্রমাণিত কেন্দ্রগুলোর ফলাফল করার ক্ষমতা প্রদানে সম্মতি দিয়েছে। এতে ইসির কিছু ক্ষমতায়ন অবশ্যই হবে। তবে ৩৯ ধারাসহ সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোতে তার প্রতিফলন না ঘটলে এর প্রয়োগে আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ফলাফল প্রাপ্তির পর গেজেট করতেই হবে, গেজেট হলেই নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারধীন হয়ে যাবে।