বিশ্বজুড়ে অস্ত্র কেনার প্রতিযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘এখন কেন এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা (চলছে), অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্য যে অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে তা ক্ষুধার্ত শিশু ও মানুষের জন্য ব্যবহার করা হবে না কেন? এই অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্য হাজার হাজার শিশু ও নারী বিশ্বজুড়ে অমানবিক জীবনযাপন করছে।’
রোববার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। খবর বাসস।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ আর কোনো সংঘাত চায় না, বরং জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি চায়। আমরা আর কোনো অশান্তি, সংঘাত চাই না। আমরা মানুষের জীবনকে উন্নত করতে চাই এবং আমরা সর্বদা এটি কামনা করি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে দেশে বিরাজমান শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ গত ১৪ বছরে বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়মী লীগ জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন থেকে অব্যাহত শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশের কারণে বাংলাদেশ আর্থসামাজিক উন্নয়নে সক্ষম হয়েছে। সরকার ২০০৮ সালের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর পরিকল্পিতভাবে দেশের মানুষের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘এর ফলে, আমরা দারিদ্র্যের হার এবং মাতৃমৃত্যু হ্রাস করতে, শিক্ষার হার এবং মানুষের গড় আয়ু বাড়াতে সক্ষম হয়েছি। দেশে বিরাজমান টেকসই ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশই বাংলাদেশের অভূতপূর্ব আর্থসামাজিক অগ্রগতির একমাত্র কারণ। একটি শান্তিপূর্ণ টেকসই পরিবেশ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে সহায়ক এবং সবাইকে এটি মনে রাখতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আলোচনার মাধ্যমে সব বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বাংলাদেশ যে কাজটি ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ১০ লাখের বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে, যারা নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছিল যা তাকে ১৯৭১ সালের পরিস্থিতি স্মরণ করিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই পৃথিবীতে শান্তি ফিরে আসুক, (পৃথিবীতে) কোনো ধরনের অশান্তি থাকবে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা দেশের স্বাধীনতা চায়নি তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে। ‘প্রতি মুহূর্তে আমাদের তাদের (স্বাধীনতা বিরোধীদের) বাধা অতিক্রম করতে হচ্ছে।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন, সারাজীবন শান্তির বাণী প্রচার করেছেন, কিন্তু তাকে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে।
‘আমাদের কী দুর্ভাগ্য, যে মানুষটি সারাজীবন শান্তির কথা বলেছেন তাকে তার জীবন দিতে হয়েছিল। আজ তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই, তবে আমরা চাই যে তার দেশ উন্নত এবং সমৃদ্ধ হিসেবে গড়ে উঠুক।’
দেশে-বিদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যারা কাজ করছেন তাদের স্বীকৃতি দিতে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শান্তি পুরস্কার’ প্রবর্তনেরও ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘কারণ আমরা শান্তি চাই এবং আমরা অবশ্যই শান্তির পথে এগিয়ে যাব।’
‘জনগণই শক্তি, জনগণই শক্তির উৎস’- বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সেই বিশ্বাসে বিশ্বাসী এবং সেই বিশ্বাস নিয়েই আমার পথচলা।’
বাংলাদেশ আজ বিশ্বব্যাপী শান্তি রক্ষায় অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করছে- উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে এক নম্বর দেশ হিসেবে আমরা বিশ্বজুড়ে শান্তি বজায় রাখছি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, সব সময় শান্তিতে বিশ্বাস করি। আমরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১ শতাংশ। কিন্তু আজ সরকার তা ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে দারিদ্রের সংখ্যা ছিল ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ, তা আজ ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ, এ দেশে কোনো মানুষ দরিদ্র, গৃহহীন বা ভূমিহীন থাকবে না। প্রতিটি মানুষ অন্তত তাদের মৌলিক অধিকার- খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান পাবে। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশের আজকের এই আর্থসামাজিক উন্নয়নকে ধারাবাহিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশের অবদান বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশের পরিবেশ বিশৃঙ্খল ছিল ও প্রতি রাতে কারফিউ দেয়া হয়েছিল। ২১ বছর পর আমরা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা অন্তত এটা বলতে পারি যে আমরা একটি ভিত্তি তৈরি করেছি। মাঝখানে একটি অশান্ত পরিবেশ ছিল (২০০১ থেকে ২০০৮)।’
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন এবং মূল বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও গবেষক মোনায়েম সরকার।
মূল বক্তব্যের ওপর আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও বিশিষ্ট লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক। অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতি মোজাফফর হোসেন পল্টু।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু ও তার জুলিও-কুরি শান্তি পদক প্রাপ্তির ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও-কুরি শান্তি পদক প্রদানের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট ও প্রথম দিনের কভার উন্মোচন করেন। তিনি দিবসটি উপলক্ষে একটি স্যুভেনির প্রকাশনার প্রচ্ছদও উন্মোচন করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক জুলিও-কুরি শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। বিশ্ব শান্তি পরিষদের পুরস্কারটি ছিল বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। জুলিও-কুরি শান্তি পুরস্কার ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার।