দেশের কিছু জেলায় তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। বাকি অংশের ওপর দিয়ে মৃদু ও মাঝারি দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। আগামী পাঁচ থেকে ছয় দিন আবহাওয়ার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে। তীব্র গরমের কারণে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস ৫ থেকে ৮ জুন পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। শিগগির বৃষ্টির কোনো লক্ষণ নেই। তীব্র দাবদাহের মধ্যে জনজীবন অসহনীয় করে তুলেছে লোডশেডিং। খোদ রাজধানীতে দিন-রাত মিলিয়ে ৬ থেকে ৮ বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। গ্রামপর্যায় এ পরিস্থিতি আরও অসহনীয়।
আগামী পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। জুনের শুরুতে সারা দেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক ছিল। রোববার দেশের বাতাসে ক্ষুদ্রকণার পরিমাণও ছিল বেশি। এতে বাতাসে দূষণের মাত্রাও বেড়ে যায়। চলতি সপ্তাহে দেশে বড় ধরনের বা ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা তেমন নেই বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৩ হাজার কোটি টাকা বকেয়া ৬ মাস পার হলেও দিতে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। দফায় দফায় দেনদরবার করেও ডলার পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে সম্প্রতি ২ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ডলার পরিশোধ করেছে চীনা কয়লা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সিএমসিকে। কিন্তু তত দিনে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব মজুত কয়লা শেষের দিকে। এখন কয়লা আমদানি করলেও ২৫ জুনের আগে কেন্দ্রটি চালু হবে না। পায়রা কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ ঢাকায় সরবরাহ করত। এ কারণে ঢাকায় বেড়েছে লোডশেডিং।
দাবদাহে পুড়ছে দেশ
সোমবার আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। এর মধ্যে গতকাল রোববার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল দিনাজপুরে ৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় রাত-দিন মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ বার বিদ্যুৎ চলে যায়। নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলাগুলোর ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। রংপুর বিভাগের অবশিষ্টাংশসহ ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও বান্দরবান জেলাগুলোর ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসমতে, সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
গ্রীষ্মের এই গরমে মধ্যরাতেও বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। দিন-রাত মিলিয়ে বিদ্যুতের দেখা মিলছে কম। পাখা চলছে না। ভ্যাপসা গরমে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে।
পরিস্থিতি উন্নতি হবে জুনের শেষ সপ্তাহে
জ্বালানির অভাবে ধুঁকে ধুঁকে বন্ধ হচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে প্রতিদিনই বাড়ছে লোডশেডিং। বর্তমানে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট জ্বালানি ব্যয় ৫ টাকা ৫০ পয়সা। অন্যদিকে ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রের ব্যয় ইউনিটপ্রতি ৩০ টাকার বেশি আর ফারনেসের উৎপাদন ব্যয় ১৪ টাকার কিছু বেশি। এ পরিস্থিতিতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি চালালে সরকারকে প্রতিদিন অন্তত বাড়তি গুনতে হবে ১৫০ কোটি টাকা। কয়লা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে না আসা পর্যন্ত দেশের বিদ্যুতের পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। কয়লা আসতে সময় নেবে ২৫ জুন পর্যন্ত। এ পর্যন্ত থাকবে লোডশেডিং।
গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ এত বিপর্যয়ের বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গতকাল রোববার সচিবালয়ে লোডশেডিং সম্পর্কে সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘লোডশেডিং পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে গেছে।’
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘কয়েক সপ্তাহ লাগবে লোডশেডিং কমতে। বেশ কিছুদিন ধরে গ্রাহকরা দেখছেন যে লোডশেডিং বেড়ে গেছে। জ্বালানি হিসেবে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেলের জোগান দিতে কষ্ট হচ্ছিল। এ কারণে লোডশেডিং ধীরে ধীরে বেড়ে গেছে। লোডশেডিং পরিস্থিতিও অসহনীয় হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কত দ্রুত কয়লা নিয়ে আসা যায়, তার চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। দ্রুত সমাধানে বিদ্যুৎ বিভাগ চেষ্টা করছে।’
তবে গত বছরের জুলাইয়ের মতো সূচি করে পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের চিন্তা আপাতত নেই বলে জানিয়েছেন নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘তাপপ্রবাহ চলছে, তাই বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে গেছে। আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে।’
বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনের জন্য তৈরি আছে। দুই মাস আগে থেকেই চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু জ্বালানি আসার পেছনের বিষয় সব সময় তাদের হাতে থাকে না। অর্থনৈতিক বিষয়, জ্বালানি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার বিষয় থাকে; সব সমন্বয় করতে হয়। সমন্বয় কোথাও বাধাগ্রস্ত হলেই সমস্যা হয়। এবারও তাই হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, কয়লার অভাবে আজ রাত ১২টার পরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে দেশের সব থেকে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা। এর আগে ২৫ মে কেন্দ্রটির ৬৬০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিটটি বন্ধ হয়ে যায় কয়লার অভাবে। নতুন করে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা ২৫ জুনের আগে আসবে না। এ সময় পর্যন্ত কেন্দ্রটি বন্ধ থাকবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেরিতে বকেয়া পরিশোধ করায় পায়রা বন্ধ হলো
৬ মাসের বাকিতে চীনা প্রতিষ্ঠান সিএমসি কয়লা দিত পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে। কয়লা দেয়ার ৬ মাস পর অর্থ পরিশোধ করত পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ২৩ মার্চ পর্যন্ত ছয় মাসে সিএমসি বকেয়া কয়লা বাবদ প্রায় ৩০ কোটি ডলার বা ৩ হাজার কোটি টাকা বকেয়া হয়। এই অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। এরপর সিএমসি পায়রাকে আরও প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার কয়লা বাকিতে সরবরাহ করে। এর পরও অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় চীনের বৈদেশিক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ইন্দোনেশিয়ার পিটি বায়ান্স রিসোর্স টিবিকের কাছ থেকে কয়লা বাংলাদেশের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করার বিষয়ে সিএমসির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে কয়লা আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
গত ২৭ এপ্রিল বিসিপিসিএল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিদ্যুৎ সচিবকে চিঠি দিয়ে অবহিত করে। এরপর কয়েক দফা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ৩ হাজার কোটি টাকা বকেয়ার মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। এরপরই দুই মাসের কয়লা সরবরাহে রাজি হয়েছে সিএমসি।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রেখে দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিকই ডলারের সংস্থান করল। কিন্তু যখন তারা ডলার দিল তখন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশ দেশের লোডশেডিংয়ের পরিস্থিতি অবনমের পেছনে অন্যতমভাবে দায়ী।’
লোডশেডিং
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দেশে বিদ্যুতের চাহিদার কথা যখন বলা হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। আর তখন সরবরাহ করা হচ্ছে ১২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি গড়ে প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) দুজন প্রকৌশলী পরিচয় গোপন রেখে দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘দেশে পিক আওয়ার সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১১টা পর্যন্ত প্রকৃত চাহিদা থাকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট। আর এ সময় ১৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করতে গিয়ে পিডিবির নাভিশ্বাস ওঠে যাচ্ছে। ঘাটতি থাকছে ৪ হাজার মেগাওয়াট। এটি মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ ভাগ। এই বিপুল পরিমাণ ঘাটতির কারণে লোডশেডিং বেড়েছে।’ ঢাকার চেয়ে গ্রামে এই পরিস্থিতি আরও অনেক খারাপ বলেও ওই দুই কর্মকর্তার মত।