গত ১৪ বছরের বেশি সময় পর এসে সরকার সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে তারা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায়। এ জন্য দেশের স্থলভাগে ৪৬টি গ্যাসকূপ খননকাজ এ বছরই শুরু করতে যাচ্ছে। শিগগিরই কূপ খননের অনুমতি নিতে প্রধানমন্ত্রী এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন নেয়া হবে। এ ছাড়া চলতি গ্রীষ্মে নতুন করে আর লোডশেডিংয়ের বিপর্যয়ে যেন না পড়ে তার জন্য ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
গ্যাস, ফার্নেস তেল, কয়লা, সৌর ও জলবিদ্যুৎ থেকে সরকার ১৫ হাজার ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনতে চায়। এ দিয়ে গ্রীষ্ম মোকাবিলা করতে চায়। ডিজেলভিত্তিক এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রস্তুত রাখা হবে, ডিজেলভিত্তিক এসব কেন্দ্র জরুরি চাহিদা না হলে চালানো হবে না। গ্রীষ্মে তীব্র দাবদাহ না থাকলে গড়ে ১৫ থেকে ১৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন থাকে। আর তীব্র দাবদাহ অর্থাৎ ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা উঠলে চাহিদা গিয়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৫০০ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট। নির্বাচনের আগে সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে চায়। বিরোধী দলগুলো বিদ্যুৎসংকট নিয়ে রাজপথে যাতে নামতে না পারে, সেদিকেই সরকারের বড় নজর রয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা দৈনিক বাংলাকে জানিয়েছেন, ৪০ মাসে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বাপেক্সের অধীনে থাকা ক্ষেত্রগুলোতে ২০টি কূপ খনন করা হবে। এর মধ্যে সংস্কার কূপ বা ওয়ার্কওভার কূপ দুটি, অনুসন্ধান কূপ ৯টি ও উন্নয়ন কূপ ৯টি। চারটি কূপ খনন করা হবে শ্রীকাইলে, ভোলার নর্থে ৪টি, ভোলার শাহবাজপুরে দুটি এবং সেমুংতাংয়ে দুটি। বাকিগুলো ফেঞ্চুগঞ্জ, নোয়াখালীর চরজব্বারপুর, শরীয়তপুর ও জকিগঞ্জে। শুধু বাপেক্সের নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে ২০টি কূপ খনন করলে চার বছরে অন্তত ২৮ কোটি লাখ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়বে।
বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের (বিজেএফসিএল) নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্ষেত্রগুলোতে চার বছরে ১২টি কূপ খনন করা হবে। এতে গ্যাসের উৎপাদন বাড়বে ১৭ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র তিতাসে সাতটি কূপ খনন করা হবে। বাকি পাঁচটি খনন করা হবে বাখরাবাদ-১, কামতা-১ ও ২, মেঘনা ও হবিগঞ্জ-৬।
সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিএফএল) আওতায় থাকা ক্ষেত্রগুলোতে ১৪টি কূপ খনন করা হবে। এর মধ্যে সংস্কার কূপ রয়েছে আটটি বাকি ছয়টি অনুসন্ধান কূপ। কৈলাশটিলা, বিয়ানীবাজার, রশীদপুর ও সিলেট ক্ষেত্রগুলোতেও কূপ খনন করা হবে। এটি দেশের পুরোনো গ্যাসক্ষেত্র। এতে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়বে। এ ছাড়া রশীদপুর-১৪, কৈলাশটিলা-৯ ও বাতচিয়াতে-১ উত্তোলন কূপ এবং রশীদপুর-৭ ও কৈলাশটিলা ১/৩ দুটি ওয়ার্কওভার কূপ খনন করা গেলে অন্তত পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাপেক্সের এই মুহূর্তে রিগ আছে ছয়টি। এর মধ্যে চারটি কূপ খননের রিগ ও দুটি ওয়ার্কওভার করার জন্য। এই রিগ দিয়ে এক বছরে অন্তত ১০টি কূপ খনন করা সম্ভব। আর জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাপেক্স বছরে অন্তত আটটি কূপ খনন করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি যদি আরও দুটি রিগ ভাড়া করে আনে, তাহলে বছরে আরও চার-পাঁচটি কূপ খনন করা সম্ভব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল বুধবার সচিবালয়ে তার কার্যালয়ে দৈনিক বাংলাকে বলেন, ৪৬টি কূপ খননের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দ্রুতই পাঠানো হবে। অনুমোদন পেয়ে গেলে বাপেক্স, বিজেএফসিএল ও এসজিএফএলের আওতাধীন ক্ষেত্রগুলোয় এই কূপ খনন করা হবে। বাপেক্স যতগুলো পারে তারা ততগুলো কূপ খনন করবে। বাকিগুলো ঠিকাদার নিয়োগ করে কূপ খনন করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য সাশ্রয়ী মূল্যের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ করা, যাতে কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এ জন্য কূপ খননের সুনির্দিষ্ট বড় পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সারা দুনিয়ায় জ্বালানিসংকট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। চলতি গ্রীষ্মে গ্যাস, কয়লা, তেল, সৌর ও জলবিদ্যুৎ মিলিয়ে আমরা প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করেছি, এ ছাড়া ডিজেলভিত্তিক আরও এক হাজার মেগাওয়াট আমরা বাড়তি রেখেছি। প্রয়োজনে ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোও উৎপাদনে রেখে লোডশেডিং মুক্ত করা হবে।’
১৬ হাজার মেগাওয়াটের প্রস্তুতি
বিদ্যুৎ বিভাগের দুই কর্মকর্তা দৈনিক বাংলাকে বলেন, হুট করে যে লোডশেডিংয়ের মুখে পড়েছিল ঢাকাসহ সারা দেশ, তার পেছনে ডলারসংকট কাজ করেছে।
তারা বলেছেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে কয়লা সরবরাহকারী চীনা প্রতিষ্ঠানের ৯ মাসের বকেয়া ছিল ৪২৯ মিলিয়ন ডলার। এই অর্থ দিতে গড়িমসি করে সরকার। পরে ১৩১ মিলিয়ন ডলারের জোগান দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর সিএমসি আট লাখ টন কয়লার ব্যাংক ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট বা এলসি) খোলে। সেই কয়লা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে আসতে ২৫ জুন পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। অবশ্য প্রথম ইউনিটটি এর আগে ২৫ মে কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পায়রা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর তেল আমদানি করতে পারেনি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এতে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোও তীব্র জ্বালানিসংকটে পড়ে মাত্র ৩০ শতাংশ সক্ষমতায় চালিয়েছে। এর ফলে তীব্র লোডশেডিংয়ে পড়ে গোটা বাংলাদেশ।
তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানির অর্থ জোগানে কড়া পদক্ষেপ নেয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষাধীন কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর নির্দেশ দেয়ার পরই লোডশেডিংয়ের পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
সূত্র জানায়, সরকার গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সুযোগ হাতে রেখেছে, এর পরই রয়েছে ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। ভারতের ঝাড়খন্ডের আদানি থেকে ৯০০ মেগাওয়াট, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এস আলম থেকে ৫০০ মেগাওয়াট, বরগুনার আমতলী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৩০০ মেগাওয়াট ও রামপাল থেকে ৩০০ মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রগুলো সবই কয়লাভিত্তিক, এ থেকে আসবে ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে পায়রা ২৫ জুন থেকে চালু হওয়ার কথা রয়েছে, আর এস আলমের কেন্দ্রটি আগামী ১৭ জুন থেকে চালু হতে পারে। এ ছাড়া সৌরবিদ্যুৎ থেকে আসবে ৪০০ মেগাওয়াট ও জলবিদ্যুৎ থেকে ৫০ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে ১৫ হাজার ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুনির্দিষ্ট ক্ষমতা তৈরি করেছে সরকার।
তারা বলছেন, এ ছাড়া এক হাজার মেগাওয়াটের ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্র উৎপাদনের জন্য তৈরি রাখা হয়েছে। যদি পরিস্থিতির অবনতি হয় এই এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ডিজেল থেকে আসবে। যদি বিশেষ প্রয়োজন না পড়ে, তাহলে ডিজেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে না সরকার। চলতি গ্রীষ্মে বিদ্যুতের বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে এভাবেই রক্ষা পেতে চায় সরকার।
যদি তীব্র দাবদাহ শুরু হয় দেশে, তাহলে বিদ্যুতের চাহিদা পিক আওয়ার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৭ হাজার মেগাওয়াট। অবশ্য সরকারের দাবি সে সময় চাহিদা থাকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। আর এই ১৬ হাজার মেগাওয়াটের পুরোটা যাতে উৎপাদন করতে পারে, সে জন্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করেছে সরকার।
গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর দিকে নজর
সরকার গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে সর্বোচ্চ জ্বালানি সরবরাহের চেষ্টা করছে। গড়ে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২৭ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে। এ পরিমাণ গ্যাস দিয়ে ৬ হাজার ৩০০ থেকে ৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। সরকার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহ করতে চায়।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর জোর দিয়েছে সরকার। এ জন্য প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে দ্রুত গ্যাস দিতে চায় সরকার। এই কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিক-মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডের ৬০০ মেগাওয়াট, ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপের ৭১৮ মেগাওয়াটের একটি ও সামিট পাওয়ার ৫৮৩ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র। এই তিনটি কেন্দ্রের কাজ প্রায় শেষ, তিনটিই মেঘনাঘাটে। এর মধ্যে ইউনিক-মেঘনাঘাট পাওয়ারের ৬০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শেষের পথে। কেন্দ্রটির সব যন্ত্রাংশ ইতিমধ্যে সংযোজন করা হয়েছে। এখন কেন্দ্রটির শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে। এই কেন্দ্রটিতে সরকার যন্ত্রপাতি পরীক্ষার জন্য দ্রুতই গ্যাস সরবরাহ করবে। এ ছাড়া খুলনায় নর্থওয়েস্ট পাওয়ার কোম্পানির ৮০০ মেগাওয়াটের একটি গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র রয়েছে। এই কেন্দ্রেও সরকার দ্রুত গ্যাস সরবরাহ করতে চায়।