নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার পর নির্বাচনের পরিবেশ মূল্যায়ন করতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদল।
রোববার রাজধানীর গুলশানে ইইউ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এসব বৈঠকে দেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে মানবাধিকারকর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বর্তমান সময়ের নানা প্রতিবন্ধকতা, আশঙ্কার পাশাপাশি আশার কথা তুলে ধরেন। বৈঠকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব খাটানোসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়টিও তুলে ধরেন তারা। পাশাপাশি আগামী নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সহিংসতামুক্ত করার বিষয়েও নিজেদের মতামত জানান তারা।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দেশে সহিংসতার আশঙ্কা আছে কি না, সে বিষয়েও বৈঠকে জানতে চায় ইইউ প্রতিনিধিদল। সহিংসতামুক্ত পরিবেশে কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, এ বিষয়েও নিজেদের মতামত তুলে ধরেন বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন ছাড়া পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব নয় বলে মত দেন তারা।
এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা কীভাবে বিরোধী মতামত দমন করেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করা নিপীড়ন চালিয়ে সেসব বিষয় তুলে ধরেন মানবাধিকারকর্মীরা। তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে অনুমতি না পেলেও সম্প্রতি মার্কিন ভিসানীতির পর বিরোধীরা সভা-সমাবেশের অনুমতি পেতে শুরু করেছে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ গত সপ্তাহে একই দিনে রাজধানীতে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠান। তবে এটা কিছুটা লোক দেখানো উল্লেখ করে তারা বলেন, নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, বিরোধীপক্ষের ওপর ক্ষমতাসীনদের নিপীড়ন আবারও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দুই সপ্তাহের সফরে আসা ছয় সদস্যের এই পর্যবেক্ষক দল গতকাল সকাল ১০টার দিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবিরের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করে। ঘণ্টাখানেকের এই বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ড. মাহফুজ কবির।
তিনি জানান, বৈঠকে বর্তমান নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চান ইইউ প্রতিনিধিরা।
ড. মাহফুজ বলেন, ‘আমি বলেছি, এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ ও সহিংসতামুক্ত। নির্বাচনে আগে ইইউর একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠানো উচিত।
তিনি আরও বলেন, ‘তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর বিষয়েও জানতে চায়। তাদের জানাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা একটি ছোট দল পাঠাতে পারে।’
এরপর সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ইইউ ডেলিগেশনের সঙ্গে বৈঠক করেন মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, মানবাধিকার সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, এটাই আমি প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি।’
পরবর্তী সময়ে বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ইইউ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
বৈঠক শেষে তিনি বলেন, ‘দেশের অবস্থা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক কি না তারা জানতে চেয়েছে, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমি কোনো প্রস্তাব দিইনি। তবে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছি নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা সঠিক হতে হবে।’
সুজন সম্পাদক বলেন, ‘মানুষের বিকল্প বেছে নেয়ার স্বাধীনতা যেন থাকে, পুরো প্রক্রিয়াটা যেন স্বচ্ছ হয়, কোনো রকম কারসাজি যেন না হয় সেটা বলেছি। এসব প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।’
এ ছাড়া দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ইইউর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তবে তিনি বৈঠকের বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং নির্বাচনপূর্ব পরিবেশ মূল্যায়ন করতে ১৬ দিনের সফরে গত ৮ জুলাই ঢাকায় পৌঁছায় ইইউ নির্বাচনী অনুসন্ধান মিশনের দলটি। আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত সফর করবেন দলটির সদস্যরা।
ঢাকায় ইইউ মিশনের তথ্য অনুসারে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য ইইউ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের ‘পরামর্শযোগ্যতা, উপযোগিতা এবং সম্ভাব্যতা’ মূল্যায়ন করাই এর মূল উদ্দেশ্য। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইইউ কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না, প্রতিনিধিদল সে বিষয়ে সুপারিশ করবে। তাদের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করেই ইইউ এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।