বাংলাদেশে গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করছে সে বিষয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছে সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। বিশেষ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কাভারে সাংবাদিকদের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন তারা। বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বেগ জানান সাংবাদিকরা।
সোমবার সফরের দশম দিনে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে ইইউ পর্যবেক্ষক দল। ঢাকার গুলশানে ইইউ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এসব বৈঠকে পেশাগত দায়িত্ব পালনে নানা ধরনের ঝুঁকির বিষয়টিও উঠে আসে। তবে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যে গণমাধ্যম প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ও উল্লেখ করেন সাংবাদিকরা।
জানা যায়, ঢাকা সফরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল দৈনিক গড়ে ৭টিরও বেশি বৈঠক করছে। সোমবার পর্যন্ত ৭০টির বেশি বৈঠক করেছে তারা।
বিভিন্ন পেশার এবং সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে তাদের জানার আগ্রহ ছিল, দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মনোভাব।
সোমবার কয়েক দফায় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে তাদের আগ্রহ ছিল ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন এবং গণমাধ্যমের বাস্তবতা নিয়ে।
প্রথম ধাপে হওয়া এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ডেইলি অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, নিউএজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির, দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক ইনাম আহমেদ এবং প্রথম আলোর ইংরেজি সংস্করণের সম্পাদক আয়েশা কবির।
বৈঠকের পরে ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, তারা প্রথমে ডিএসএ সম্পর্কে আলাদাভাবে জানতে চায়নি। তারা বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারছে কি না জানতে চেয়েছেন তারা।
ইকবাল সোবহান বলেন, ডিএসএ প্রসঙ্গে সরকারের কাছে পাঠানো সুপারিশগুলো আমরা তাদের জানিয়েছি। গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সবারই উদ্বেগ আছে বলে ইইউ প্রতিনিধিদের জানানো হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য গণমাধ্যম ভূমিকা রাখবে বলেও তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে।
ইকবাল সোবহান চৌধুরী আরও বলেন, সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কার করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী। আমরা সেখানে আমাদের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন দেখতে চাই।
বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি সাংবাদিকদের আহ্বান ছিল, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেন অবস্থান না নেয়া হয়।
বৈঠক শেষে নিউএজের সম্পাদক নুরুল কবির বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিশ্চিতে ইইউ প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে আসতে হচ্ছে, বিষয়টি দুঃখজনক। তবে তাদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি, যাতে ফিরে গিয়ে তারা এমন রিপোর্ট যেন না দেয়, যা বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যাশা করে না।
পরে কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন ডিকাবের পাঁচ সদস্যের সঙ্গে বৈঠক করে ইইউ প্রতিনিধিদল।
বৈঠক শেষে ডিকাবের সদস্যরা গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে ইইউকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে, ২০১৪ সালে ইইউ পার্লামেন্টে জামায়াতকে সহিংসতাকারী দল হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও ঢাকায় গত রোববার জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক কেন- এই প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিকাবের সাবেক সভাপতি মাসুদ করিম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ইইউ প্রতিনিধিদল মূলত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কাভারে সাংবাদিকদের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমরা জানিয়েছি, অনেক দিক থেকেই বর্তমানে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভালো সময় পার করছে। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অন্যতম একটি বড় প্রতিবন্ধক। এ ছাড়া মিডিয়া মালিকদের প্রভাব ও প্রত্যন্ত এলাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর হামলার কারণে সাংবাদিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের অভাবও রয়েছে সাংবাদিকদের। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
আগামী নির্বাচন কাভারের সময় সাংবাদিকরা যাতে অবাধে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেন সে বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে বলে জানান মাসুদ করিম।
তিনি বলেন, আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের বলেছি, যাতে তারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠায়।
এর আগে গত বুধবার সচিবালয়ে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ইইউ প্রতিনিধিদল। তথ্যমন্ত্রীর কাছে প্রতিনিধিদলের প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীন কি না এবং নির্বাচনে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী হবে?
সে সময় তথ্যমন্ত্রী বলেন, ইউরোপের মতো বাংলাদেশে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিবন্ধিত না। কাজেই এসব মাধ্যমে ছড়ানো গুজব ঠেকানোই এখানে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া বিদেশে যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তারাই নির্বাচন পরিচালনা করে। আইন অনুসারে আমাদের দেশেও তাই হবে।
সোমবার বিকেলে গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন এনজিওর প্রতিনিধির সঙ্গে মতবিনিময় করেন ইইউ প্রতিনিধিরা। এ সপ্তাহে আরও একবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে তাদের।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, মঙ্গলবার ফিরে যাবেন ইইউ প্রতিনিধদলের প্রধান রিকার্ডো কেলেরি। তবে দলের বাকি সদস্যরা ২৩ জুলাই পর্যন্ত অবস্থান করে বাংলাদেশের নির্বাচনের নানা বিষয়ে নিজেদের মতো করে তথ্য সংগ্রহ করবেন।
এর আগে গত ৮ জুলাই ১৬ দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছায় ইইউ অনুসন্ধানী দল।