ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল সফর শেষে রোববার ঢাকা ছেড়েছে। দুই সপ্তাহের সফর শেষে ঢাকা ছাড়ার আগে সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে শতাধিক বৈঠক করেছেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
এসব বৈঠকে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন তারা।
ইইউ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেন। সে সময় তারা নির্বাচনীব্যবস্থা, নির্বাচনের সময় সহিংসতা, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, ভোটার তালিকা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে কীভাবে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যায়, তারা সে উত্তর খুঁজেছেন।
ইইউ প্রতিনিধিদলটি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
ইইউ প্রতিনিধিদলকে আওয়ামী লীগ জানায়, তারা দেশের সংবিধান ও আইনি কাঠামোর ওপর নির্ভর করে নির্বাচন করতে চায়। সংলাপ, সংসদ বিলুপ্তি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে কোনো আলাপ হয়নি। এদিকে বিএনপি নেতারা ইইউ প্রতিনিধিদলকে জানান, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। দেশে সংলাপের কোনো পরিবেশ নেই, পরিবেশ তৈরি হলে সংলাপের কথা ভাববে বিএনপি।
বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায় এবং আমরাও বলেছি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সম্ভব। বাংলাদেশের সংবিধান ও বিধিবিধান অনুসারে আগামী নির্বাচন হবে।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব, আইনি ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে তারা একটি নির্বাচন দেখতে চায়। তারা নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারে আশ্বস্ত।
সংলাপ নিয়ে প্রতিনিধিদল কোনো কথা বলেনি। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা সংসদ বিলুপ্তির বিষয় নিয়েও প্রতিনিধিদল কোনো কথা বলেনি।’
সরকারের পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন হবে। এখানে পার্লামেন্ট বিলুপ্তির প্রশ্নই ওঠে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নই ওঠে না।
ইইউ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ঢাকা সফরকালে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীন, এ নিয়ে জানতে চান ইইউ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘দেশে সংলাপের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নেই। পরিবেশ তৈরি হলেই কেবল সংলাপের প্রশ্ন আসতে পারে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই। মানবাধিকার, গণমাধ্যম, আইনের শাসন, জীবনের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ। এখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অনুপস্থিত।’
জাতীয় পার্টি প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছে, ‘এখন পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ না হয়ে এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার। এ ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচন যেন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয় তার জন্য ইইউকে উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানায় ইইউকে।’
জামায়াত বলেছে, আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা বা দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। জামায়াতের পক্ষ থেকে কেয়ারটেকার বা নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে।
নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠকে দেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
মানবাধিকারকর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বর্তমান সময়ের নানা প্রতিবন্ধকতা, আশঙ্কার পাশাপাশি আশার কথা তুলে ধরেন। বৈঠকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব খাটানোসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়টিও তুলে ধরেন তারা। পাশাপাশি আগামী নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সহিংসতামুক্ত করার বিষয়েও নিজেদের মতামত জানান তারা।
আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দেশে সহিংসতার আশঙ্কা আছে কি না, সে বিষয়েও বৈঠকে জানতে চায় ইইউ প্রতিনিধিদল। সহিংসতামুক্ত পরিবেশে কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, এ বিষয়েও নিজেদের মতামত তুলে ধরেন বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন ছাড়া পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব নয় বলে মত দেন তারা।
এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা কীভাবে বিরোধী মতামত দমন করেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করা, নিপীড়ন চালিয়ে- সেসব বিষয় তুলে ধরেন মানবাধিকারকর্মীরা। তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে অনুমতি না পেলেও সম্প্রতি মার্কিন ভিসানীতির পর বিরোধীরা সভা-সমাবেশের অনুমতি পেতে শুরু করেছে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ গত সপ্তাহে একই দিনে রাজধানীতে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠান। তবে এটা কিছুটা লোক দেখানো উল্লেখ করে তারা বলেন, নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, বিরোধীপক্ষের ওপর ক্ষমতাসীনদের নিপীড়ন আবারও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সফরকালে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা আদিবাসী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। নির্বাচনকালে তারা কী কী সমস্যায় পড়েন, সেসব বিষয়ে জানতে চান ইইউ প্রতিনিধিরা। এ সময় নিজ নিজ প্রতিনিধিরা নির্বাচনকালে তাদের সমস্যা তুলে ধরেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন ইইউ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। আগামী জাতীয় নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কীভাবে শান্তি বজায় রাখবে সে জবাবও খুঁজেছেন তারা। এ ছাড়া বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন, সে বিষয়েও অনুসন্ধান করেছেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
ইইউ প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধিদলটির সফর ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ঢাকার বাইরে সিলেটে গিয়েও প্রতিনিধিদল সফর করে।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ছয় সপ্তাহের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা সফর করতে চেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ সময় তারা পার্বত্য এলাকার নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করবে।
ইইউ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি সরকারের কাছে এই প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ইইউকে এখনো জানানো হয়নি।
ইইউ প্রতিনিধিদল ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন ব্রাসেলসের ইইউ অফিসে পেশ করবে। তবে আগামী নির্বাচনে প্রতিনিধিদল পাঠাবে কি না, সে বিষয়ে ব্রাসেলস অফিস চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত না হলেও পর্যবেক্ষক প্রতিনিধিদলের জন্য একটি অফিস খুঁজছে ঢাকার ইইউ অফিস। ব্রাসেলস থেকে পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত এলে দ্রুত যেন অফিস নেয়া যায়, সে জন্য আগেভাগেই অফিস খোঁজা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, রিকার্ডো কেলেরির নেতৃত্বে ছয় সদস্যের ইইউ প্রতিনিধিদল গত ৯ জুলাই ঢাকায় আসে। তবে প্রতিনিধিদলের নেতা রিকার্ডো কেলেরিসহ দুজন সদস্য ১৭ জুলাই ঢাকা থেকে ফিরে যান। পরবর্তী সময়ে বাকি চার সদস্য ঢাকায় অবস্থান করেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইইউ কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না, প্রতিনিধিদল সে বিষয়ে সুপারিশ করবে। তাদের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করেই ইইউ এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।