সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মডেল পিএসসি (উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি) অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে চলতি বছরের শেষ নাগাদ দরপত্র আহ্বান করতে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা। মডেল পিএসসি অনুমোদন হওয়াটা জরুরি ছিল। গতকাল বুধবার অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় পিএসসি অনুমোদন দেয়া হয়।
দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে গভীর ও অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ জোরেশোরে কাজ শুরু করতে চাইছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার এবং ভারত তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাসের বড় মজুত পেয়েছে।
পিএসসি বা উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তির ভিত্তিতে সাগরে তেল-গ্যাসের হিস্যা, দরসহ অন্য সব বিষয় নির্ধারিত হয়। এতদিন মডেল পিএসসিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল। এখন প্রতিবেশীদের চেয়ে মডেল পিএসসিতে বেশি সুবিধা দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলাকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের সমুদ্রে আহ্বান করা হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম বলেছেন, ‘আমরা মডেল পিএসসিতে বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর (আইওসি) জন্য সবচেয় বেশি সুবিধা রাখতে যাচ্ছি।’
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, মডেল পিএসসির তিনটি জায়গা নিয়ে তারা কাজ করেছে। প্রথমত, আগের তুলনায় নতুন পিএসসিতে দাম বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে কস্ট রিকভারি (গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন খরচ তুলে নেয়ার পরিমাণ) বৃদ্ধি করা হয়েছে। একই সঙ্গে গভীর এবং অগভীর সমুদ্রে গ্যাস রপ্তানির বিধান রাখা হয়েছে।
এখনকার পিএসসিতে গভীর সমুদ্রে প্রতি ইউনিট সোয়া ৭ ডলার ও অগভীর সমুদ্রে গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ ডলার। এখন পিএসসিতে গভীর সমুদ্রে সোয়া ৭ ডলারের সঙ্গে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে তার কর দিয়ে দেয়া এবং প্রতিবছর দেড় ভাগ হারে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির বিধান সংযোজন করা হয়েছে। তবে অগভীর সমুদ্রে এই দুই সুযোগের কোনোটি নেই।
সূত্র বলছে, নতুন পিএসসিতে গ্যাসের হিস্যা হবে অর্ধেক অর্ধেক। অর্থাৎ আইওসি যা-ই উত্তোলন করুক না কেন, তারা সেই গ্যাসের অর্ধেক ভাগ পাবে।
আগের পিএসসি অনুযায়ী ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করলে পেট্রোবাংলা পেত ৫৫ ভাগ, আইওসি পেত ৪৫ ভাগ। এভাবে ১৫০ মিলিয়ন উত্তোলনে পেট্রোবাংলা ৬০ ভাগ, আইওসি ৪০ ভাগ এবং ২৫০ মিলিয়নের ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা ৬৫ ভাগ, আইওসি ৩৫ ভাগ গ্যাস পেত। এভাবে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন হলে পেট্রোবাংলা ৮০ ভাগ ও আইওসি ২০ ভাগ গ্যাস পেত। অর্থাৎ আইওসি যত বেশি গ্যাস উৎপাদন করত, তারা তত কম গ্যাস পেত। এখন সেটিকে সমান করে দেয়া হয়েছে।
গতকাল বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ দেশের উত্তরোত্তর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে গভীর ও অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে প্রণীত খসড়া ড্রাফট বাংলাদেশ অফসোর মডেল পিএসসি অনুমোদন দেয়া হয়েছে।’
বঙ্গোপসাগরে স্থলভাগের সমান জায়গা রয়েছে বাংলাদেশের। বিপুল এই জলসম্পদের মধ্যে তেল-গ্যাস বা অন্য মূল্যবান সম্পদ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে এখনো বিলুপ্ত সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো সাফল্য নেই।
গত এক দশকে মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপস গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ ফেলে চলে গেছে। কোরিয়ান কোম্পানি দাইয়ু বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ইজারা নিয়েও কাজ শেষ করেনি। ভারতের ওএনজিসি সম্প্রতি অগভীর সমুদ্রে একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করে হতাশ হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আদালতে ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সর্বমোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্রসীমার ওপর বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে গভীর ও অগভীর সাগরে মোট ২৬টি ব্লক রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে সাগরে দরপত্র আহ্বান করার আগ্রহ জানিয়ে আইওসির সঙ্গে আলোচনায় বসলে পেট্রোবাংলাকে প্রথমে পিএসসি সংশোধন করার আহ্বান জানায় তারা। পেট্রোবাংলা পরে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়। সবশেষ অনুমোদন হতে প্রায় আড়াই বছরের ওপর সময় লাগাল পেট্রোবাংলার। তবে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু হলে পাঁচ থেকে সাত বছরের আগে তা গ্রিডে আনা সম্ভব নয়।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার সম্প্রতি জানান, চলতি বছরের শেষ নাগাদ সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বান করতে চান তারা।