টানা ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে দেশের অন্তত ৯টি জেলা। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। বৃষ্টির পানিতে তলিয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও। গতকাল মঙ্গলবার থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাতকানিয়া এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ আছে। টানা চার দিনের বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম মহানগরী তলিয়েছে। একদিকে মহানগর, অন্যদিকে তিন পার্বত্য জেলাতেও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ঝালকাঠি জেলার ৫০ গ্রাম, ফেনীর দুই উপজেলার ৪০ গ্রাম, চট্টগ্রামের আনোয়ার ও বাঁশখালী উপজেলার ৪০টির বেশি গ্রাম ও বরগুনার ৩০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বগুড়ার কয়েকটি এলাকা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্লাবিত, বন্ধ যান চলাচল
ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের কিছু অংশ তলিয়ে গেছে। এতে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। কক্সবাজারে আটকা পড়া দূরপাল্লার যানবাহনগুলো চকরিয়া, পেকুয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী হয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ঢুকছে।
বৃষ্টিতে সাঙ্গু নদীর ও ডলু খালের পানি সাতকানিয়ার কেরানীরহাট, চন্দনাইশ ও দোহাজারী এলাকার মহাসড়ক প্লাবিত হয়েছে। মানুষ নৌকা নিয়ে নিরাপদ স্থানে ছুটছেন। ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। আনুমানিক চার-পাঁচ ফুট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন আরাফাত জানান, টানা বর্ষণে সাতকানিয়ায় মহাসড়কসহ পুরো এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। যান চলাচল বন্ধ থাকায় পুরো এলাকার মানুষ কার্যত জলাবদ্ধ।
আনোয়ারা-বাঁশখালীর ৪০-এর অধিক গ্রামে জলাবদ্ধ
চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও বাঁশখালী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ৪০টির বেশি গ্রামে জলাবদ্ধতা হয়েছে। পাহাড়ি পানির ঢল বাঁশখালীর সাধনপুর, বৈলছড়ি, বাহারছড়া, কাথরিয়াসহ খানখানাবাদ ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা পানির নিচে তলিয়েছে।
এদিকে আনোয়ারা উপজেলা নিম্নাঞ্চল হওয়ায় বৃষ্টির পানি নামতে না পেরে পরৈকোড়া ইউনিয়নের পুরোটাই প্লাবিত হয়েছে।
বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কে এম সালাহউদ্দিন কামাল বলেন, পাহাড়ি ঢলে গত শনিবার দেয়ালচাপা পড়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এদিকে আনোয়ারা উপজেলার চাতরী ইউনিয়নের ডুমুরিয়া, রূদুরা, কেঁয়াগড়, সিংহরা ও বারখাইন ইউনিয়নের পূর্ব বারখাইন গ্রামেও জলাবদ্ধতা দেখা গেছে।
বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এনামুল হক বলেন, ‘জলকদর খালের শাখা সোনাইছড়ি খালের তিনটি স্লুইস গেটের দুটির দুই পাশে মাটি ভরাট হয়ে পানি চলাচলে বিঘ্নিত হওয়ার কারণে আমার ওয়ার্ডের রাস্তাঘাট কোমর পানির নিচে। জলমগ্ন হয়ে আছে ২০ থেকে ৩০টি পরিবার।’
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইশতিয়াক ইমন বলেন, ১৫ টন চাল, শুকনা খাবার, স্যালাইন ও ওষুধসামগ্রী উপজেলার ১১ ইউনিয়নে বিতরণ করা হয়েছে। দুর্গত এলাকাগুলো পরিদর্শন করে আরও বরাদ্দ দেয়া হবে।
এদিকে বাঁশখালীর ইউএনও সাইদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, উপজেলার পুকুরিয়া, শেখেরখীল, সাধনপুর, চাম্বল ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ১৫ টন চাল ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
পুরো সাতকানিয়া ডুবেছে
পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা। পানিবন্দি রয়েছে তিন উপজেলার লক্ষাধিক বাসিন্দা। সাতকানিয়া উপজেলা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্কও।
সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন এলাকার বহুতল স্কুল ভবন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তুলনামূলক উঁচু এলাকা উপজেলা পরিষদ ও কেরানীহাটে কোমরপানি হওয়ায় পুরো সাতকানিয়া পানিতে ডুবে গেছে বলে ধারণা করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস।
তিনি বলেন, ‘গতকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ। তাই সমন্বয় করা যাচ্ছে না।’
সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় উপজেলার বাইরে যোগাযোগ করতে পারছেন না সাতকানিয়ার বাসিন্দারা। সাতকানিয়া পৌরসভার ভোয়ালিয়া পাড়ার ফজিলাতুন্নেছা চৌধুরী বলেন, ‘গতকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই, বাড়িতে পানি ঢুকেছে। বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না।’
সাতকানিয়ার পার্শ্ববর্তী দুই উপজেলা চন্দনাইশ ও লোহাগাড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চন্দনাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মহাসড়কে ছোট ও মাঝারি যান চলতে পারছে না। পাঠানিপুল এলাকায় পানি বেশি, কিছু গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। একটা একটা গাড়ি পার হচ্ছে। এলাকার নিচু অঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে।’
বান্দরবান বিচ্ছিন্ন, নিহত ২
টানা ছয় দিনে ভারী বর্ষণে জেলা সদরে ৬০ শতাংশ ও লামা উপজেলায় শতভাগ বন্যাকবলিত হয়েছে। বান্দরবানের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়ার এই সময়ে এক বিদেশি নাগরিকসহ দুজন নিহত হয়েছেন ও আহত শতাধিক বলে জানা গেছে।
জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সড়ক, বসতবাড়িসহ পাহাড় ধসে পড়েছে। জেলার ২০৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে সাড়ে ৯ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করছে।
বৃষ্টির এই সময়ে বান্দরবানের খাদ্যসামগ্রীর দাম দ্বিগুণ বেড়েছে- এ বিষয়ে বান্দরবান বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি বিমল কান্তি দাশ জানিয়েছেন, খাদ্যদ্রব্যের সংকট না থাকলেও বাজারে ডিম ও মোমবাতির সংকট দেখা দিয়েছে।
জেলা প্রশাসন জানায়, পাহাড়ধসে আলীকদম উপজেলায় একজন ও নাইক্ষ্যংছড়িতে একজন মারা গেছেন। নিহতদের মধ্যে একজন বিদেশি নাগরিক। তবে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত পরিচয় জানাতে পারেননি জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, সদরের চেয়েও লামা উপজেলায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উপজেলা পরিষদ ও খাদ্যগুদাম পানিতে তলিয়ে গেছে। ৮৫ মেট্রিক টন চাল, ত্রাণ ও অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অতিদ্রুত ক্ষয়ক্ষতির নিরূপণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঝালকাঠির ৫০ গ্রাম প্লাবিত
ঝালকাঠি জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলার ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া প্লাবিত হয়েছে নলছিটি ও রাজাপুর উপজেলার ১৮টি গ্রাম। এ ছাড়া সদর উপজেলার অন্তত ১৭টি গ্রাম পানির নিচে। গত সোমবার পর্যন্ত পুরো জেলায় ৫০টি গ্রাম পানিতে ডুবে গেছে। কাঁঠালিয়া উপজেলার প্রায় সাত হাজার বাসিন্দা পানিবন্দি।
গত তিন দিনের বৃষ্টিতে কাঁঠালিয়া উপজেলার ডালি খালের মাটির বাঁধ ভেঙে গেছে। বিষখালী নদীর কাঁঠালিয়া অংশে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের দেড় যুগ ধরে।
ভারী বৃষ্টি, পূর্ণিমার জোয়ারের পানিতে এবারও ডুবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁঠালিয়া সদর, শৌলজালিয়া, আওরাবুনিয়া ও আমুয়া ইউনিয়ন।
বীনাপানি গ্রামের মাদ্রাসাশিক্ষক এনায়েত মোল্লা বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে ত্রাণ চাই না, এই বাঁধটির টেকসই উন্নয়ন চাই, যাতে বন্যার সময় আমাদের দুশ্চিন্তায় পড়তে না হয়।’
পাউবোর ঝালকাঠির নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম নিলয় পাশা বলেন, ‘বিষখালীর তীরে কাঁঠালিয়া অংশে বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য প্রস্তাব ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হলেই ডিজাইনের ডাটা পাঠানো হবে।’
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক ফারাহ্ গুল নিঝুম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘পানিবন্দিদের সব প্রয়োজনীয় সুবিধা দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কাঁঠালিয়া বেড়িবাঁধ নির্মাণের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কথা বলব।’
ফেনীর ৩০টি গ্রাম জলাবদ্ধ
চার দিনের ভারী বৃষ্টিতে ফেনীর আমতলী ও তালতলী উপজেলার ৩০টি গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। বিভিন্ন এলাকার শতাধিক গাছ উপড়ে পড়েছে। বৃষ্টি দীর্ঘায়িত হলে পুকুর, ঘেরসহ আমনের বীজতলার ক্ষতির আশঙ্কায় কৃষকরা। কৃষকের আমনের বীজতলাও রয়েছে দেড় থেকে দুই ফুট পানির নিচে।
আমতলী সদর ইউনিয়নের সেকান্দারখালী গ্রামের ঘেরের মালিক সবুজ জানান, ভারী বৃষ্টিতে বাড়ির ঘের ও পুকুর তলিয়ে গেছে। বৃষ্টি আরও বাড়লে মাছ ভেসে যাবে।
আমতলী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. রাসেল জানান, উপজেলায় ১ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমিতে আমনের বীজতলা রয়েছে। অধিকাংশ বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। বীজ পচে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বরগুনার আমতলী-তালতলীর ৩০টি গ্রাম জলাবদ্ধ
চার দিনের ভারী বৃষ্টিতে বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলার ৩০টি গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিতে মাটি নরম হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকার শতাধিক গাছ উপড়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। বৃষ্টি দীর্ঘয়িত হলে পুকুর, ঘেরসহ আমনের বীজতলার ক্ষতির আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন কৃষকরা।
গত শনিবার থেকে মুষলধারে টানা ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে আমতলী ও তালতলী উপজেলার অধিকাংশ নিচু এলাকা তলিয়ে গেছে। পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। অনেক জায়গায় খাল-বিল উপচে বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে পানি। পুকুর ও মাছের ঘের তলিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে দিন কাটছে চাষিদের। কৃষকের আমনের বীজতলাও রয়েছে দেড় থেকে দুই ফুট পানির নিচে।
আমতলী সদর ইউনিয়নের সেকান্দারখালী গ্রামের ঘেরের মালিক সবুজ জানান, তিন দিনের বৃষ্টিতে বাড়ির ঘের ও পুকুর তলিয়েছে। বৃষ্টি আরও বাড়লে মাছ ভেসে যাবে।
আমতলী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. রাসেল জানান, আমতলী উপজেলায় ১ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমিতে আমনের বীজতলা আছে। অধিকাংশ বীজতলা পানিতে তলিয়েছে। বীজ পচে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।