অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে সাধারণ মানুষের আবাসন নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে বাগিয়ে নিচ্ছেন প্লট-ফ্ল্যাট। প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য ও ঠিকাদারদের সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা। তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে বেদখল হয়ে যাচ্ছে জমি ও সম্পদ। রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে দেখার যেন কেউ নেই! কারণ এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হচ্ছেন চেয়ারম্যান। এই পদে ঘন ঘন পরিবর্তন করা হয়। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেট ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বাংলাদেশ (সিএজি)-এর এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিরপুরের বিভিন্ন সেকশনে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মোট জমি ৩ হাজার ৬১৫ দশমিক ৬৫ একর, যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫৪ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ৪৭৪টি আবাসিক প্লটের তালিকা বা হিসাব দিয়েছে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। বাকি প্রায় ২ লাখ ১৭ হাজার ৭৭১ কাঠা জমির কোনো ধরনের বরাদ্দ, বণ্টন ও বিক্রির তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি এগুলো কর্তৃপক্ষের দখলে থাকারও কোনো প্রমাণ পায়নি সিএজি। বছরের পর বছর এসব জমি বেদখল থাকলেও উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি বেদখল হওয়া জমি-সম্পর্কিত কোনো তথ্যও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। অনেক ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এসব জমি ভোগ করছে প্রভাবশালীরা। এতে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছে। ইতোমধ্যে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের উচ্চমান সহকারী ও কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে দুদক। ওই কর্মচারীর নামে-বেনামে কয়েক শ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। সম্প্রতি তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুধু দেলোয়ারই নয়, নামে-বেনামে প্লট-ফ্ল্যাট দখলের মাধ্যমে এমন অসংখ্য কোটিপতি তৈরি হয়েছে। তারা নিজ নামে প্লট-ফ্ল্যাট নেয়ার পাশাপাশি স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের নামেও একাধিক বরাদ্দ নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শক্তিশালী সিন্ডিকেট এসব কাজ করছে। সিএজির প্রতিবেদন অনুসারে এর নেতৃত্বে রয়েছেন গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়) মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ। তিনি খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) অধ্যয়নরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেও অভিযোগ আছে। বর্তমান সরকারের আদর্শবিরোধী অবস্থানের কারণেই তিনি উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত করছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব প্লট-ফ্ল্যাট নেন। অথচ মন্ত্রণালয়ের বিধিতেই বলা হয়েছে, একটির বেশি কেউ বরাদ্দ নিতে পারবে না। আবার চাকরির মেয়াদ দুই বছর না হলে বরাদ্দ নেয়া যাবে না। এদিকে অনেকে নিজ নামে প্লট-ফ্ল্যাট না নিয়ে কৌশলে তা নিয়েছেন স্বজনদের নামে। পাশাপাশি ঘুষ এবং তদবির বাণিজ্য থেকে আয় করেছেন বিপুল অর্থ। আবার অনেকে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের জমি বাজার মূল্যের থেকে কয়েকগুণ কমে বিক্রি করে লাভবান ক্রেতার কাছ থেকে বাগিয়ে নিচ্ছেন কমিশন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিরপুর-১৪ নম্বর সেকশনে ১১২ কাঠা জমি রয়েছে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের। বাজারদর অনুযায়ী ওই এলাকায় কাঠাপ্রতি জমির দাম প্রায় কোটি টাকা। কিন্তু সেখানে পানির দরে জমি বিক্রি করেছে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানকে সেই জমি কাঠাপ্রতি প্রায় ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রায় ১১২ কাঠা জমি ১৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬ হাজার ২৫০ টাকায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যথাযথ বিধান মেনে বাজারদর যাচাই করে এ জমি বিক্রি করলে প্রায় ১০০ কোটি টাকা পাওয়া যেত। অথচ সেই জমি সস্তায় বরাদ্দ দিয়ে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ প্রায় ৮৬ কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করলেও ঠিকাদারকে ১৭ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করেছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। আর বিল পরিশোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আয়কর, ভ্যাট ও জামানত বাবদ ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা কর্তন দেখানো হলেও সংশ্লিষ্ট খাতে তা জমা না করে ব্যাংক থেকে উত্তোলনের মাধ্যমে তা আত্মসাৎ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। চুক্তি অনুযায়ী নির্মাণ কাজ সম্পাদন না করায় কাজ বাতিল করা হলেও চুক্তির শর্ত মোতাবেক অবশিষ্ট কাজের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় না করায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। অন্যদিকে বাতিল করা কাজের জন্য আরোপ করা লিকুইডেটেড ড্যামেজেস ও অতিরিক্ত খরচের টাকা আদায় না করায় আরও ক্ষতি হয়েছে ২৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
অভিযোগ উঠেছে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ অনুযায়ী জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ‘চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন নিয়েও। ২০১৮ সালে ১৬ দশমিক ১৯ একর জমিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরে দুই একর বাদ দিয়ে ১৪ দশমিক ১৯ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি), আইএমইডি, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সার্ভে ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ছাড়পত্র গ্রহণ করে ১৩২ কেভি বৈদ্যুতিক লাইন ও উঁচু টিলার অংশ বাদ দিয়ে প্রকল্প এলাকা নির্ধারণ করা হয়। ২০২১ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনও কাজই শুরু হয়নি। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি ৫ বছরেও বুঝিয়ে দিতে পারেনি।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়) মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে প্রকল্পের ধীরগতি চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ‘রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ছাড়পত্র দিয়েছে। এখন আবারও ছাড়পত্র চাওয়া হচ্ছে। এতে বিস্মিত হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। কারণ একই প্রকল্পে দুবার ছাড়পত্র দেয়ার প্রশ্নই আসে না। এ ছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রকল্পটি হাতে নেয়ার প্রথম থেকেই পাহাড়/নিচু টিলা না কেটে মোচনের পক্ষে মত দেন। কিন্তু প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের পাহাড় কাটার দিকেই ঝোঁক। দ্বিতীয়বার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র চাওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্টদের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। এ ছাড়া রাউজানে তিন ফসলি আবাদি কৃষি জমির ওপরই প্রকল্পটি করা হচ্ছে। এতে ধারণা করা হয়, সংশ্লিষ্টদের কৃষিজমির ওপরই প্রকল্প করার প্রবণতা বেশি। অথচ ফসলি জমি রক্ষার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু তা মানছে না গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ, জমি অধিগ্রহণসহ সামগ্রিক বিষয়ে তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। অথচ মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে কর্মরত প্রবাসীরা এই প্রকল্পের দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু ‘চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্পই নয়, মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদের অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতায় থমকে গেছে গৃহায়ণের আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ বলেন, ‘প্রকল্পের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার এখতিয়ার আমার নেই। চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের বিষয়ে কথা বলার কোনো সুযোগ আমার নেই। প্রকল্পের বিষয়ে বিস্তারিত চেয়ারম্যান জানেন।’
কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান দাবি করেন, ‘এই প্রকল্পে কোনো ধরনের কালক্ষেপণ হচ্ছে না। আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। এখানে প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, এর কোনো কারণ আমার জানা নেই। প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক ছাড়পত্র নিতে হয়।’
তবে, তাদের বক্তব্য সঠিক নয় বলে মনে করেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার সাধারণ জনগণ। প্রকল্পের বিষয়ে খোঁজ নিতে ঢাকায় আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কার্যালয়ের সামনে। তারা দাবি করেন, বারবার মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে এই প্রকল্প থেকে সংশ্লিষ্টরা বাড়তি আর্থিক সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছেন। এ জন্য তারা প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। ফলে কাজে কোনো অগ্রগতি নেই।
অনুসন্ধানে যায়, চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাইয়ের সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প, মিরপুর-৯ নম্বর সেকশনে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ১৫টি ১৪ তলা আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ (স্বপ্ননগর-২), হবিগঞ্জ সদর উপজেলার স্বল্প ও মধ্য আয়ের লোকদের জন্য সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প এবং মিরপুর-১৫ সেকশনের জয়নগর আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে চলছে। সব প্রকল্পেরই মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের হালিশহরে আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ, ঝালকাঠির সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস, ময়মনসিংহের স্বল্প আয়ের মানুষের আবাসিক ফ্ল্যাট, ঝিনাইদহের সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস এবং মিরপুর-১৬ নম্বর সেকশনের আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পেও ধীরগতি চলছে। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষে কর্মরত কিছু কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি করেছেন, বিভিন্ন প্রকল্পের ধীরগতি এবং মেয়াদ বৃদ্ধির পেছনে মূল কারিগর হিসেবে কাজ করছে মোসলেই উদ্দীন আহাম্মদের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট।