ডিসেম্বরে ফল প্রকাশের দিনে যখন রেজাল্ট কার্ড হাতে পেল নাবিলা সে দিনই তার উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। থ্রি থেকে এবার ফোরে উঠে গেছে সে। মায়ের ফোন থেকে দাদা-দিদু, নানা-নানি সবার সঙ্গে তার ফোনালাপে নতুন ক্লাসে ওঠার খবর। আর তখন থেকেই মায়ের কাছ প্রতিদিনই জানতে চাইত কবে সে পাবে নতুন বই। কবে আসবে পহেলা জানুয়ারি! অবশেষে নাবিলার জন্য নতুন ক্লাসের নতুন বই নিয়ে এসেছে পহেলা জানুয়ারি। সারা দেশে নাবিলার মতো প্রাক্-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীর হাতে পহেলা জানুয়ারি উঠেছে নতুন বই। শিশুদের উচ্ছ্বাস আর আনন্দে মাখামাখি হয়ে রঙিন বই উৎসব হয়েছে রঙিনতর।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের (মাউশি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের সবশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ আর উল্লাসে মেতে উঠেছে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী। এবার প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্তরে তিন কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার ৩২৪ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭টি বই বিতরণ করা হবে। গতকালই এর সিংহভাগ বই বিতরণ হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আগত শিক্ষার্থীদের মাঝে।
এর আগে ২০২৩ সালের শেষ দিন গত রোববার সকালে প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার থেকে সারা দেশে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বিতরণ শুরু হয়।
তবে নাবিলাদের মতো শিশুরা যখন নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকার আনন্দে মাতোয়ারা, কেউবা বই হাতে পেয়েই তা অনেক যত্নে রেখে দিচ্ছে ব্যাগে, কেউবা উল্টেপাল্টে দেখছে নতুন নতুন ছবি- তখন মিমুদের আনন্দ দেখে পুরোপুরি আনন্দিত হতে পারছেন না অভিভাবকরা। কারণ, এবার থেকে নতুন সিলেবাস। তাতে কী না কী আছে, শিশুরা তা পারবে কি না, কীভাবে তাকে পড়ানো হবে- এসব নিয়েই অনেক টেনশনে অনেক অভিভাবক। মহাখালীর একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন অভিভাবক শাম্মী আখতার তার মেয়ের নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের বিষয় নিয়ে অনেক চিন্তিত। তিনি বলেন, ‘পুরোপুরি নতুন সিলেবাস। শুনেছি মুখস্ত করতে হবে কম। কিন্তু ক্লাসে কাগজ কাটতে হবে বেশি। এবার নাকি প্রচুর খরচ। ওর বাবার সামান্য আয়। এত খরচের পড়াশোনা করাব কী করে?
তবে উপমা রহমান নামে স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, গত বছর সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন সিলেবাসে পড়েছে। সে সময় শিক্ষক নির্দেশিকাতে ক্লাসে একবার ব্যবহার করা কাগজ দিয়ে আবারও ক্লাসের কাজ করার কথা বলা হলেও অনেক শিক্ষক ও অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ সে নিয়ম মানেনি বলে বেশি খরচের অভিযোগগুলো উঠেছে। শিক্ষকরা যত্নশীল হলে এ অভিযোগ তেমন আর হবে না।
এদিকে, বই উৎসবে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিতরণ হয়েছে পাঠ্যবই। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
রাজশাহী ব্যুরো জানিয়েছে, রাজশাহীতে বই উৎসবে শিক্ষার্থীদের ঢল নামে স্কুলগুলোতে। সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে এ উৎসবের সূচনা করেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ন কবির।
রাজশাহী মাধ্যমিক ও আঞ্চলিক শিক্ষা অধিপ্তরের উপপরিচালক শরমিন ফেরদৌস চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার।
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গোপালগঞ্জে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার মাধ্যমে বই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ উপলক্ষে গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের হলরুমে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে বই উৎসবের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম। কোটালীপাড়া উপজেলার মদনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আজিম উদ্দিন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেন।
যশোর প্রতিনিধি জানান, নতুন বছরের প্রথম দিনে যশোরে উৎসবমুখর পরিবেশে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে নতুন বই। জেলায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৫০ লাখ ২০ হাজার ৭৯১টি বই তুলে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের হাতে। বিনা মূল্যের নতুন পাঠ্যপুস্তক পেয়ে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা। আর তাদের হাতে বই তুলে দিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, বছরের প্রথম দিনেই সারা দেশের মতো পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার শিক্ষার্থীরা হাতে পেয়েছে নতুন বই।
বই হাতে পেয়ে দারুণ খুশি খুদে শিক্ষার্থীরা। সবাই মেতে উঠেছে আনন্দ-উল্লাসে। তাদের মাঝে বইছে অন্যরকম আনন্দের জোয়ার। উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসাগুলোতে ‘বই উৎসব’ পালিত হয়েছে। নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে, নতুন শ্রেণিতে একটি নতুন শিক্ষা বছর শুরু করেছে এখানকার শিক্ষার্থীরা। নতুন বই হাতে খুদে শিক্ষার্থীদের উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, সারা দেশের মতো দিনাজপুরের হাকিমপুরের হিলিতে ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনা মূল্যে নতুন বই বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সকাল ১০টায় বাংলাহিলি পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজে বই উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার অমিত রায়। নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন বই হাতে পেয়ে দারুণ খুশি শিক্ষার্থীরা। ভালোভাবে পড়ালেখা করার প্রত্যাশা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।
ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, সকাল থেকে ফরিদপুর শহর এবং গ্রামে গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়েছে বই উৎসব। ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করে সকালেই স্কুলে হাজির হয়ে যায় শিক্ষার্থীরা, মেতে ওঠে বই উৎসবে।
সকাল ১০টায় ফরিদপুর জিলা স্কুলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বই বিতরণের মাধ্যমে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক আফরুজা বানু।
উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে ৪৬৪ কোটি ৭৮ লাখ ২৯ হাজার ৮৮৩টি বই বিনা মূল্যে বিতরণ করেছে। ২০১৭ সাল থেকে সরকার সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের তাদের মাতৃভাষায় অধ্যয়নের জন্য চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো এবং সাদরি ভাষার বই বিতরণের পাশাপাশি অন্ধ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বই বিতরণ করছে।