অনুমোদন না থাকলেও রাজধানীজুড়েই নিয়ম ভঙ্গ করে বহু আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক ভবনে চলছে রমরমা রেস্টুরেন্টের ব্যবসা। প্রতিটি রেস্টুরেন্টে ঝুঁকিপূর্ণভাবে একাধিক গ্যাস সিলিন্ডার পাশাপাশি রেখে দিনভর চলে রান্না।
অনেক আবাসিক ভবনের সব তলাতেই রয়েছে নামীদামি রেস্টুরেন্ট। প্রায় সব জায়গাতেই একটির সঙ্গে আরেকটি ভবন লাগোয়া।
অনেক ৭-৮ তোলা ভবনে দেখা গেছে ওঠানামার জন্য একটি সরু সিঁড়ি। তার পাশেই একটা চার কিংবা ছয়জনের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটা লিফ্ট। সিঁড়ি দিয়ে একসঙ্গে দুজন আসা-যাওয়াও কষ্টকর। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কী হবে তা সহজেই অনুমেয়।
রাজধানীর নামীদামি- গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, বসুন্ধরা এলাকাতেও রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ এমন অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। বাইরে চাকচিক্য হলেও ভেতরে মৃত্যুফাঁদ।
কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। কিছুদিন গেলেই সবাই চুপসে যায়। নগর পরিকল্পনাবিদরা বারবার অননুমোদিত রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিলেও তা কোনো কাজে আসছে না।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর নগরবাসী শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তাদের এখন একটাই দাবি যত্রতত্র রেস্টুরেন্টের ব্যবসা বন্ধ করা।
আবাসিক ভবনের রেস্তোরাঁ বন্ধের দাবিতে রিট
বেইলি রোডসহ ঢাকার আবাসিক ভবনের সব রেস্তোরাঁ বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। গতকাল রোববার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ এ রিট করেন।
রিটে বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
এদিকে বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ বিল্ডিংয়ে ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জন নিহতের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে আরেকটি রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইসরাত জাহান সান্ত্বনা।
বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে আবেদনটি করা হয়।
রিটে গণপূর্ত সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রদের বিবাদী করা হয়েছে।
বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চে রিট আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবী।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে লাগা আগুনে এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০ জন পুরুষ, ১৮ জন নারী ও আটজন শিশু।
পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান, আটক ৩৫
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। যেসব রেস্টুরেন্টে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা বা যথাযথ অনুমোদন নেই সেসব রেস্টুরেন্টের মালিক বা ম্যানেজারকে আটক করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে উত্তরা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ধানমন্ডি, খিলগাঁও, পুরান ঢাকায় এই অভিযান শুরু করেছে পুলিশ।
গতকাল রাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে ৩০-৩৫ জনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃত বেশির ভাগই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার। তাদের কাছে রেস্টুরেন্ট পরিচালনার বৈধ সব ডকুমেন্টস চাওয়া হয়েছে। এসব ডকুমেন্টস দেখে যাচাই-বাছাই করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জানান, যেসব রেস্টুরেন্ট যথাযথ নিয়ম-কানুন না মেনে ও আইন ভঙ্গ করে পরিচালিত হচ্ছে সেসব রেস্টুরেন্টে অভিযান চালানো হচ্ছে। আইন অনুযায়ী এসব রেস্টুরেন্ট মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেউ দায় এড়াতে পারে না
রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার দায় কেউ এড়াতে পারে না। ভবন মালিক, রেস্তোরাঁ মালিক কিংবা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি বা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর সবারই দায় রয়েছে। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব মো. ইমরান হাসান রোববার (৩ মার্চ) বেইলি রোডে পুড়ে যাওয়া ভবন পরিদর্শনে এসে এসব কথা বলেন।
ইমরান হাসান বলেন, ‘আমরা এ ঘটনা থেকে দূরে সরে যেতে চাই না। আর এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সে জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের কাছে আহ্বান জানাব- বাংলাদেশের সব রেস্তোরাঁ মনিটরিং করা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা সবার সঙ্গে কাজ করতে চাই। সে জন্য আমরা বিভিন্ন দপ্তরে এক হাজারের বেশি চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কোনো সুরাহা পাইনি। আমাদের কেউ সহযোগিতা করেনি।’
৪৮ জন নাগরিকের বিবৃতি
একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু সেসব দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার বা প্রতিকার মানুষ আজও পাননি। এমন অব্যবস্থা, বিচারহীনতা, প্রতিকারবিহীন অবস্থা অব্যাহতভাবে চলতে পারে না। বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় প্রাণহানিতে শোক জানিয়ে এবং এর পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যবস্থা দাবি করে দেশের ৪৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেছেন।
গতকাল বিবৃতিতে এই নাগরিকরা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডে ২০১০ সালে নিমতলীতে ১২৪ জন, ২০১৯ সালে চকবাজারে ৭১ জন ও বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৭ জন প্রাণ হারান। এ ছাড়া হাসেম ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, তাজরীন ফ্যাশনসহ এর আগে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা থেকে বেইলি রোডের দুর্ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ভাবার উপায় নেই। আগের দুর্ঘটনাগুলোরই ধারাবাহিকতা।
নাগরিকরা বলেন, আগের দুর্ঘটনাগুলো থেকে জানা যায়, এসব দুর্ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তব্যে চরম অবহেলাই মূলত দায়ী।
বেইলি রোডে দুর্ঘটনার শিকার ভবনটিকে রাজউক শুধু বাণিজ্যিক ব্যবহারের শর্তে অনুমোদন দিয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ ভবনটিকে অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে তিনবার নোটিশ পাঠিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, নোটিশ পাঠানোর পরও কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নাগরিকদের প্রশ্ন, শুধু নোটিশ দিয়েই কি ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? তাদের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও ক্ষমতা রয়েছে, তা তারা কেন করল না?
নাগরিকরা আরও বলেন, নকশা অনুযায়ী ভবন হয়েছে কি না, তা রাজউকের তদারক করার কথা। কিন্তু লোকবল নেই, এই অজুহাতে রাজউক কোনো অবস্থায় দায় এড়াতে পারে না। দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, তা মানুষকে জানানো, জবাবদিহি করা এখন সময়ের দাবি।
বেইলি রোডের ঘটনাসহ সব দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বিবৃতিদাতারা। তারা আরও কিছু দাবি জানিয়েছেন, ভবনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা খতিয়ে দেখা এবং সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষের অবহেলা, ব্যর্থতা শনাক্ত করা, উচ্চ আদালতের নির্দেশনার বাস্তবায়ন তদারকি, দায়ীদের শাস্তি প্রদান, অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধ নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন, ভুক্তভোগীদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
বিবৃতিদাতারা হলেন মানবাধিকারকর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদের সচিব আলী ইমাম মজুমদার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, সেন্ট্রাল উইমেন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, বিএনডব্লিউএলএর নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল, আলোকচিত্রী ও সমাজকর্মী শহিদুল আলম, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, মানবাধিকারকর্মী মো. নুর খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, নারীপক্ষের সদস্য শিরিন হক, ব্লাস্টের অনারারি নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাংস্কৃতিক কর্মী অরূপ রাহী প্রমুখ।