বাংলাদেশের স্বাধীনতা হঠাৎ কোনো বাঁশির হুইসেল কিংবা কোনো আকস্মিক ঘটনার প্রাপ্ত ফলাফল নয়। স্বাধীনতা অর্জনে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ অতিক্রম করতে হয়েছে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের পর ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারত ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে যাওয়ার আগে তারা ভারতকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যায়।
এতে তৎকালীন পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ) পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। ফলে তথাকথিত স্বাধীনতার নামে বাঙালিরা মূলত পরাধীনই রয়ে গেল।
শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা চরম শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হতে থাকে বাঙালিরা। সর্বপ্রথমেই তারা আমাদের মাতৃভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বাঙালিরাও তাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আর এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বোপিত হয়েছিল।
দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানি শাসকদের সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনা, বৈষম্য-নিপীড়ন এবং বিমাতাসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে বাঙালি জাতি। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচক্ষণ ও দুঃসাহসী নেতৃত্বে সুদীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে অনেক রক্তের বিনিময়ে তারা স্বাধীনতা অর্জন করে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা প্রস্তাব, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন সর্বোপরি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। আর এই সব আন্দোলনেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য ভূমিকা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিজয় লাভ করে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুর হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। এমতাবস্থায়, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু হরতাল, অসহযোগ আন্দোলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, এ ধরনের অন্যায়-অবিচার, নিপীড়ন ও বঞ্চনার অবসানে স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। এবং তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় থাকেন।
একাত্তরের মার্চে যতই দিন গড়াচ্ছিল, ততই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল বাঙালির বিক্ষোভ-বিদ্রোহ। একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকালে বোঝা যায়-বাঙালি জাতি ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। এবং এর সার্বিক নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বাংলার অবিসাংবাদিত নেতা ‘হ্যামিলনের বংশীবাদক’জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এমন পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি’ বলে বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করে সংক্ষিপ্তভাবে ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বাঙালির প্রতি তাদের শোষণ-বঞ্চনা ও বাংলার করুণ চিত্র তুলে ধরেন।
বঙ্গবন্ধু জানতেন বাঙালির জন্য স্বাধীনতা ভিন্ন অন্য কোনো পথ নেই। আর এই স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। তাই তিনি বক্তব্যে ‘আসন্ন’ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও যুদ্ধ পরিচালনার দিকনির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, ‘আর যদি একটি গুলি চলে, যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এরপর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা’ বলে তিনি ভাষণ শেষ করেন। কথাগুলো পর্যালোচনা করলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ৭ মার্চের ভাষণ শুধু মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনাই নয়, প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল স্বাধীনতার প্রকাশ্য কিন্তু অনানুষ্ঠানিক বা পরোক্ষ ঘোষণা।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, বঙ্গবন্ধু জাতির নেতা হিসেবে উপস্থিত জনতাকে প্রথমে ‘আপনি’ সম্বোধন করেন। এবং একপর্যায়ে তিনি জাতির নেতা থেকে অভিভাবকত্ব তথা পিতার দায়িত্ব নিয়ে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে তাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন।
‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’, ১৯৪৪ সালে বার্মায় আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যবাহিনীর উদ্দেশে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দৃপ্তকণ্ঠের এই ভাষণটি যেমন তৎকালীন পরাধীন ভারতবাসীর মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল, তেমনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণ বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার চেতনায় জাগ্রত, উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত করেছিল।
৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু যেন একটি রাজনৈতিক মহাকাব্য রচনা করলেন। বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য নিউজউইক ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল এক নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ বলে অভিহিত করে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ করে প্রবন্ধে বলা হয়েছে: ‘একটি নতুন বাঙালি জাতির সংগ্রামী নেতা হিসেবে মুজিবের আবির্ভাব বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য তার আজীবন লড়াইয়ের যৌক্তিক ফলাফল।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণের সঙ্গে তুলনা করা হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের বিখ্যাত গ্যাটিসবার্গ অ্যাড্রেস ও আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর ঐতিহাসিক ‘I have a dream’ ভাষণের সঙ্গে।
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জনগণ চূড়ান্ত বার্তা পেয়ে দেশকে পাকিস্তানের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে গোপনে বাংলদেশে অস্ত্র সরবরাহ বাড়াতে থাকে।
একপর্যায়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নিরস্ত্র ও নিরীহ বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ওই রাতেই তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়।
গ্রেপ্তারের আগেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিআর-এর ওয়্যারলেস-এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তখনকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার খবর প্রকাশ করেছে।
উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতা ঘোষণা করার বৈধ অধিকার বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারও ছিল না। কেননা ১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে একমাত্র তিনিই সেই ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন।
২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার সব আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে ১৩ বছরেরও অধিক সময় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছে। তাই আজ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক হয়ে উঠেছে।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে বাঙালি জাতি। সে দিন ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ-ভারত মিত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।