এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলে আগুন লাগার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে চিনির বাজারে। আগুন লাগার কারণে বাজারে চিনির সরবরাহ ও দামে কোনো সমস্যা হবে না বলে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ও এস আলম গ্রুপ জানালেও বাস্তব চিত্র উল্টো। দেশের অন্যতম বৃহৎ বাজার খাতুনগঞ্জে চিনির দাম এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। প্রতি মণ চিনির দাম বেড়েছে ৬০-৭০ টাকা। নগরীর খুচরা বাজারগুলোতে পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ২-৩ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানাটিতে আগুনে এক লাখ টন অপরিশোধিত চিনি পুড়ে গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে সেগুলো পরিশোধিত হয়ে বাজারে আসতে সময় লাগত। এর মধ্যে দিনে দিনে চিনির দাম বাড়া অযৌক্তিক।
বুধবার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল বুধবার ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা চিনি বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৭৫০ টাকায়। তবে এস আলম চিনিকলের গুদামে আগুনের দিন গত সোমবার সারা দিন বাজারটিতে চিনি বিক্রি হয়েছিল ৬ হাজার ৬৮০ টাকায়। ফলে আগুন লাগার খবরে মঙ্গলবার থেকে চিনির পাইকারি ব্যবসায়ীরা বস্তাপ্রতি দাম বাড়িয়েছেন ৭০ টাকা। সরকারের চিনি নিয়ে ব্যাপক তৎপরতার মধ্যেই এই দাম বৃদ্ধি সব নজরদারিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে।
একইভাবে চিনির খুচরা বাজারেও পণ্যটির দাম কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়েছে। সোমবার প্রতি কেজি চিনি ১৪২ টাকা বিক্রি হলেও দুদিন পর গতকাল তা কেজিপ্রতি ১৪৫-১৪৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গুদামে আগুন লেগে এক লাখ টন অপরিশোধিত চিনি পুড়ে যাওয়ার কথা বললেও রোজা সামনে রেখে চিনির বাজারে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছিল এস আলম গ্রুপ।
গত মঙ্গলবার দুপুরে পুড়ে যাওয়া গোডাউন দেখতে এসে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ সাংবাদিকদের বলেন, আগুনে গুদামের ক্ষয়ক্ষতি হলেও কারখানার কোনো ক্ষতি হয়নি। ফলে দু-এক দিনের মধ্যে উৎপাদন শুরু করা যাবে।
তিনি বলেন, এখনো পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। রমজানের চাহিদা মেটানোর মতো চিনি মজুত আছে। দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ওই দিন দুপুরে এস আলম গ্রুপের জিএম (কমার্শিয়াল) মো. আকতার হাসান বলেন, আগুনে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি কত, তা বলতে পারব না। সেটা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে নিশ্চিত করতে পারি, বাজারে কোনো প্রভাব পড়বে না। আমাদের এখনো ১০-১৫ দিনের মতো ফিনিশড (পরিশোধিত) চিনি হাতে আছে। কিন্তু এরপরও চিনির দাম বেড়েছে বাজারে। যদিও এর পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারছেন না পাইকারি চিনি ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এস আলম গ্রুপের মিলে আগুন একটি দুর্ঘটনা। এ সুযোগ পুঁজি করে ঢাকার মিল মালিকরা চিনির দাম বাড়াচ্ছেন। বড় মিল মালিকরা সরবরাহ কমিয়ে সংকট তৈরি করলে পাইকারি কিংবা খুচরা উভয় বাজারে প্রভাব পড়বে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এস আলম সুগার মিলে আগুন লাগার ঘটনার পর চিনির দাম কিছুটা বেড়েছে। প্রতি মণে ২০ টাকা বেড়েছে। দুদিন আগে এস আলমের রেডি চিনি বিক্রি হয়েছে মণপ্রতি পাঁচ হাজার ৫০ টাকা। গত সোমবার এ চিনি ছিল প্রতি মণ ৪ হাজার ৯৭০ টাকা। একইভাবে অন্যান্য চিনির দামও একই হারে বেড়েছে।
খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ও চিনির বড় ব্যবসায়ী আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, এস আলম সুগার মিলে আগুন লেগে অপরিশোধিত চিনি পুড়লেও অন্য মিলগুলোতে চিনির সংকট হওয়ার কথা নয়। সব মিলেই চিনি রয়েছে। কিন্তু এ সুযোগ নিচ্ছে ঢাকার মিলগুলো। তারাই সরবরাহ কমিয়ে বাজারে সংকট তৈরি করছে।
তিনি বলেন, খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে-কমাতে পারে না। মূলত ঢাকার মিলাররা দাম বাড়িয়ে দিলে খাতুনগঞ্জেও দাম বাড়ে।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মো. সালাউদ্দিন বলেন, আগুনের ঘটনার পর থেকেই চিনির ডিও ব্যবসায়ীরা লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে পণ্যটির দাম মণে ৫০ থেকে ৭০ টাকা বেড়েছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তারা কোনো একটি অজুহাত পেলেই দাম বাড়িয়ে দেয়। এখন তারা সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করেছে অর্থাৎ দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ গুদামে যেসব চিনি ছিল সেগুলো অপরিশোধিত।
এর আগে সোমবার বিকেল পৌনে ৩টার দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন ইছানগর এলাকার এস আলম সুগার রিফাইন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানায় আগুন লাগে। চিনির কাঁচামালের গোডাউন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনে প্রায় এক লাখ টন ‘র’ চিনি পুড়ে গেছে বলে দাবি করেছে এস আলম গ্রুপ। দুদিন অতিবাহিত হলেও এখনো মিলের ১ নম্বর গোডাউনের আগুন পুরোপুরি নেভানো যায়নি। বর্তমানে কারখানায় চিনির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, দেশে বছরে কমবেশি ১৮ থেকে ২০ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো থেকে আসে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টনের মতো। অবশিষ্ট চিনি আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর প্রায় ৯৮ শতাংশের বেশি চিনি আমদানি করতে হয়। দেশে ব্যক্তিখাতের পাঁচ শিল্পগ্রুপ সিটি, মেঘনা, এস আলম, আবদুল মোনেম লিমিটেড ও দেশবন্ধু সুগার মিল অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। পরে নিজেদের মিলে পরিশোধন করে এসব চিনি বাজারজাত করা হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, রমজানকে সামনে রেখে গত দুই মাসে চিনির আমদানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। এ দুই মাসে চিনি আমদানি হয়েছে ৪ দশমিক ৭৪ লাখ টন যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ২৭ লাখ টন।
গত দুই মাসে আমদানি হওয়া ৪ দশমিক ৭৪ লাখ টন চিনির মধ্যে এস আলম গ্রুপ আমদানি করেছে ১ দশমিক ১২ লাখ টন। এ ছাড়া সিটি গ্রুপ ১ দশমিক ৬১ লাখ টন, মেঘনা গ্রুপ ১ দশমিক ৫৬ লাখ টন, আবদুল মোনেম গ্রুপ ২১ হাজার ৫০০ টন এবং দেশবন্ধু গ্রুপ আমদানি করেছে ২০ হাজার ৫৯৫ টন।