দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে চাতক প্রতীক্ষার পর অবশেষে বুড়িমারী-ঢাকা রুটে যাত্রা শুরু করল নতুন আন্তঃনগর ট্রেন ‘বুড়িমারী এক্সপ্রেস’।
আজ মঙ্গলবার রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে লালমনিরহাট স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় যাত্রীদের কাঙ্ক্ষিত এই ট্রেনটি। এটি চালুর মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলবাসীকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম একটি প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটল।
এর আগে একই দিন দুপুরে ফিতা কেটে ট্রেনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতাহার হোসেন।
এ সময় লালমনিরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও লালমনিরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান এবং রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম, পশ্চিমাঞ্চল রাজশাহী) অসীম কুমার তালুকদার উপস্থিত ছিলেন।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লালমনিরহাট জেলার তিনবিঘা করিডর, দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা পরিদর্শনে এসে বুড়িমারী থেকে ঢাকার সঙ্গে সহজে এবং সরাসরি যোগাযোগে একটি আন্তঃনগর ট্রেন চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। পরে ২০১৮ সালের ১৬ জুন এই রুটের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে লালমনিরহাট বুড়িমারী রেলপথ পরিদর্শন করেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক।
এরপর ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন লালমনিরহাট স্টেশন পরিদর্শনে এসে ট্রেনটি চালুর আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময়েও।
পরে হতাশ হয়ে উত্তরাঞ্চলের বিশেষ করে গাইবান্ধা-লালমনিরহাট জেলাবাসী আন্দোলনে নামেন। এছাড়া পূর্বের প্রস্তাবিত এই ট্রেনটি গাইবান্ধার ওপর দিয়ে চলাচলসহ দ্রুততম সময়ে চালু করতে দীর্ঘদিন থেকেই মানববন্ধন, মিছিল-মিটিং এবং নানাভাবে আন্দোলন করে আসছিল গাইবান্ধার সচেতন মহলসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দরা। ট্রেনটি চালুর দাবিতে সর্বশেষ গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রচণ্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে গাইবান্ধা রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ব্যানার নিয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে ‘গাইবান্ধা সামাজিক সংগ্রাম পরিষদ’।
এরপর ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনটির জন্য ১৪টি কোচ লালমনিরহাট স্টেশনে আসার পর ৬ ডিসেম্বর ওই স্টেশন থেকেই গাইবান্ধা স্টেশন পর্যন্ত পরীক্ষামূলক চলাচল করে বুড়িমারী এক্সপ্রেস।
এদিকে, কাঙ্ক্ষিত এই ‘বুড়িমারী এক্সপ্রেস’ ট্রেনের উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারিত ছিল গত বছরের ৩০ নভেম্বর। পরে সেটি পরিবর্তন করে ৬ ডিসেম্বর এবং পরে ১৬ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। সেদিনও উদ্বোধন করা যায়নি এই ট্রেন। এরপর চলতি বছরের ১লা জানুয়ারি, এরপর ১৮ ফেরুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করা হলেও সেদিনও উদ্বোধন হয়নি এই ট্রেনটি। অবশেষে গত ৯ মার্চ শনিবার রিপোর্টাস ফর রেল অ্যান্ড রোড (আরআরআর) রেল ভবনে আয়োজিত রেলওয়ের পরিচালন ও উন্নয়নবিষয়ক এক কর্মশালায় সব ঠিকঠাক থাকলে ১২ মার্চ মঙ্গলবার ট্রেনটি চালু কথা জানায়। ওইদিন থেকেই নতুন এই ট্রেনের টিকিটও বিক্রি শুরু করে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। আর ট্রেনটি গাইবান্ধার ওপর দিয়ে চলাচলের এমন খবরে সন্তোষ প্রকাশ করেন এ জেলার যাত্রী, সচেতনমহলসহ জেলার ওপর দিয়ে ট্রেনটি চলাচলের জন্য বিভিন্ন সময়ে করা আন্দোলনকারীরাও।
রেলের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন বুড়িমারী এক্সপ্রেস ৮০৯/৮১০ নম্বর ট্রেনটি একটি 'খ' শ্রেণির আন্তঃনগর ট্রেন। ১৪টি কোচের এই ট্রেনের মোট আসন সংখ্যা ৬৫৩টি। ঢাকা কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা বুড়িমারী-৮০৯ নম্বর ট্রেনটি যাত্রা বিরতি করবে-ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন, ঈশ্বরদী বাইপাস, নাটোর, সান্তাহার, বগুড়া, বোনারপাড়া, গাইবান্ধা, কাউনিয়া, লালমনিরহাট, তুষভান্ডার, হাতিবান্ধা, বড়খাতা ও পাটগ্রাম রেল স্টেশনে। অন্যদিকে বুড়িমারী থেকে ছেড়ে যাওয়া-৮১০ নম্বর ট্রেনটি পাটগ্রাম স্টেশন বড়খাতা, হাতিবান্ধা, তুষভান্ডার, লালমনিরহাট, কাউনিয়া, গাইবান্ধা, বোনারপাড়া, বগুড়া, সান্তাহার, নাটোর ও ঢাকা বিমানবন্দর রেল স্টেশনে।
এরমধ্যে ট্রেনটি ঢাকা কমলপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সকাল সাড়ে ৮টায় ছেড়ে এসে গাইবান্ধার বোনারপাড়ায় প্রবেশ করবে বিকেল ৪ টা নাগাদ। এছাড়া গাইবান্ধা রেল স্টেশনে ৪টা ২৪ মিনিট এবং লালমনিরহাট স্টেশনে পৌঁছাবে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে। তবে, লালমনিরহাট-বুড়িমারী পর্যন্ত আপাতত একটি শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা রয়েছে।
অপরদিকে, লালমনিরহাট স্টেশন থেকে রাত ৯টা ১০ মিনিটে ছেড়ে এসে বুড়িমারী এক্সপ্রেস গাইবান্ধা স্টেশনে পৌঁছাবে পৌনে ১১টায় এবং ১২টা ১০ নাগাদ বোনারপাড়া অতিক্রম করে ঢাকায় পৌঁছাবে সকাল ৭টায়।
এছাড়া বুড়িমারী এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক বন্ধ থাকবে সোমবার এবং বুড়িমারী-লালমনিরহাট থেকে এটি সাপ্তাহিক বন্ধ থাকবে মঙ্গলবার।
এদিকে, রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, গাইবান্ধা থেকে ঢাকার সাথে সরাসরি রেল যোগাযোগে "আন্তনগর লালমনি এক্সপ্রেস" ও "আন্তনগর রংপুর এক্সপ্রেস" নামের দুইটি ট্রেন সপ্তাহে ছয়দিন চলাচল করছে। এর মধ্যে আন্তনগর "লালমনি এক্সপ্রেস" ২০০৪ সালের ৭ মার্চ ১৪ টি বগিতে ৫৯৩ টি আসন নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ওই ট্রেনে জেলার গাইবান্ধা স্টেশনসহ তিন স্টেশনের জন্য বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যা ১৬৬ টি। এছাড়া অপর ট্রেন "আন্তনগর রংপুর এক্সপ্রেস"। যা লালমনি এক্সপ্রেস চালুর সাত বছর পর ২০১১ সালের ২১ আগস্ট যাত্রা শুরু করে। ১৪ টি বগিতে এই ট্রেনের আসন সংখ্যা ৮৪০ টি। ওই ট্রেনে গাইবান্ধার গাইবান্ধা রেল স্টেশনসহ তিন স্টেশনের জন্য বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যা ১৪১ টি। এ নিয়ে এ জেলার এপর দিয়ে সরাসরি ঢাকার যোগাযোগে প্রতিদিন তিনটি আন্তনগর ট্রেন চলবে।
গাইবান্ধায় ট্রেনের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে জড়িত গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের আহবায়ক এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু দৈনিক বাংলাকে বলেন, ট্রেনটি গাইবান্ধার উপর দিয়ে চালু হওয়ায় আজ আমরা তথা গাইবান্ধাবাসী উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত।
গাইবান্ধা রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টার আবুল কাশেম দৈনিক বাংলাকে বলেন, এই রুটে ট্রেনটি চালু হওয়ায় যাত্রীদের মাঝে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যাত্রীদের অনেকটাই দুর্ভোগ লাগব হবে। তবে, এ জেলার বামনডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার হাইয়্যুল ইসলাম মুঠোফোনে দৈনিক বাংলাকে বলেন, এখানেও যাত্রীদের টিকিটের যথষ্ট চাহিদা রয়েছে। যে দুটি ট্রেন এই রুটে চলে, সেখানে সব সময়ই টিকিটের সংকট দেখা যায়। যদি যাত্রীদের সুবিধার্তে এখানে বুড়িমারী এক্সপ্রেস যাত্রা বিরতি করে তাহলে যাত্রীদের অনেকটাই চাহিদা পূরণ হবে।
এসব বিষয়ে রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম, পশ্চিমাঞ্চল, রাজশাহী) অসীম কুমার তালুকদার মুঠোফোনে দৈনিক বাংলাকে বলেন, ট্রেনটি চালু হওয়ায় বুড়িমারী থেকে ঢাকার রেল যোগাযোগে উত্তারাঞ্চল বিশেষ করে গাইবান্ধা-লালমনিরহাট জেলার মানুষের নতুন দিগন্তের সূচনা হলো। এসময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ট্রেনটির যাত্রা বিরতি চাওয়া দাবির বিষয়টি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।