রাজধানীর খিলগাঁও বাজারে নিয়মিত বাজার করেন বেসরকারি চাকরিজীবী এনামুল খান। রোজার দিনে ইফতারের কিছু সময় আগে বাজারে এসে পরিবারের প্রয়োজন মতো পণ্য নেওয়া আর পকেটের হিসাবে তিনি কোনোভাবেই মেলাতে পারছেন না। ইফতারের জিনিস কিনতে গেলে পরিবারের অন্য জিনিস কিনতে পারছেন না, আবার পরিবারের অন্যান্য জিনিস কিনতে গেলে ইফতারের পণ্য কেনা বাদ দিতে হচ্ছে। সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলার সময় তিনি বেশ কষ্ট নিয়েই নিজের অভিমানের ক্ষোভটা ঝাড়লেন। বললেন, ‘টাকার পরিমাণ বড় হচ্ছে, দিনকে দিন পণ্যের সাইজ ছোট হচ্ছে। বাজারে এসে দু-তিনটা জিনিস কিনে ১ হাজার টাকার একটা নোট ভাঙালেই সেটা কয়েক মিনিটে হাওয়া হয়ে যায়। দোষটা মনে হয় আমাদেরই। আমরা কেন খাই? না খেলেই সব ঝামেলা চুকে যেত!’
শহরের অন্য আরেক এলাকা হাতিরপুল বাজার। সেখানে মাছের বাজারে কথা হয় স্বল্প বেতনে চাকরি করা মধ্যবয়সি খালেক আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাজারে কোনো জিনিসের ওপর একটা দাম স্থির থাকে না। আজ দেখে যাই এক দাম, কাল আসলে হয়ে যায় আরেক দাম। আমার কথা হচ্ছে- কোনো পণ্যের দাম বাড়লে সেটা তো পাইকারি মার্কেট থেকে খুচরা বাজারে আসতে দু-এক দিন সময় লাগে। তাহলে কোন দৈত্য রাতের মধ্যেই দোকানে স্টক থাকা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় জানতে চাই। রমজানে পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশে পণ্যের দাম কমে, আর আমাদের দেশে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতা করে সব পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। সরকারের আসলেই কোনো নিয়ন্ত্রণই নাই বাজারে। সংবাদমাধ্যমে দেশের নীতিনির্ধারকদের কথা, আর বাজারে পণ্যের দাম সবাই আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
নগরীর এই দুই বাজারের মতোই আজ সারা দেশের বাজারে ক্রেতাদের এমন দৃশ্য বলা যায়। বাজার করতে গিয়ে মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস অবস্থা বলা যায়। আজ শুক্রবার পবিত্র রমজান মাসের ১১তম দিনে শহরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবজির দাম কিছুটা কমলেও মাছ, মাংসের দাম বাড়ছেই। রোজার সময় ফলের বাজারের দামেও প্রতিদিন ভীষণ ওঠানামা। কয়েকদিন আগে সরকার ২৯টি নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে। তবে সেই দামে মিলছে না বেশিরভাগ খাদ্যপণ্য। সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রিতে ভীষণ অনীহা খুচরা বিক্রেতাদের। তাদের আছে কেবল অজুহাত আর অজুহাত।
সবজির বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বর্তমানে সবচেয়ে দামি সবজির তালিকায় রয়েছে শজিনা ও বরবটি। এগুলো ১০০ থেকে ১৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য সবজি ৪০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে গরু-খাসি-মুরগিসহ সব ধরনের মাংস বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
ক্রেতাদের অভিযোগ, দুয়েকটি সবজির দাম কমলেও বেশির ভাগ সবজিরই মৌসুম অনুযায়ী দাম বাড়তি রয়ে গেছে। সেই সঙ্গে গরু-খাসি-মুরগিসহ সব ধরনের মাংস বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারে আমরা যেমন দামে কিনতে পারি, সেই হিসাবেই খুচরা বাজারে বিক্রি করি।
বাজারে করলা প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, পটল কেজি ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে মুলার কেজি ৪০ টাকা, শসা ৩০-৫০ টাকা, ঝিঙা ৫০ টাকা, কচুর লতি ৮০ টাকা, বেগুন ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি, কাঁচাকলা প্রতি হালি ৪০ টাকা, জালি প্রতি পিস ৫০-৬০ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৪০ থেকে ৬০ টাকা, ঢেঁড়স প্রতি কেজি ৭০ টাকা, শিম প্রতি কেজি ৪০ টাকা, পেঁপে প্রতি কেজি ৫০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া কেজি ৩০ টাকা, টমেটো ৬০ টাকা, গাজর ৪০ টাকা এবং কাঁচামরিচ মানভেদে প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আজ মানভেদে দেশি পেঁয়াজ ৬০-৮০ টাকা, লাল ও সাদা আলু ৪০ টাকা, নতুন দেশি রসুন ১২০ টাকা, চায়না রসুন ২২০ টাকা, ভারতীয় আদা ২২০, চায়না আদা ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গত সপ্তাহের তুলনায় পেঁয়াজের দাম আবারও কমেছে ১০-২০ টাকা। আর দেশি রসুনের দাম কমেছে ৩০ টাকা এবং চায়না রসুনের দাম বেড়েছে ২০ টাকা।
মাছের বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ইলিশ মাছ ওজন অনুযায়ী ২০০০-২৮০০ টাকা, রুই মাছ ৪৫০-৫৫০ টাকা, কাতল মাছ ৪০০-৫৫০ টাকা, কালিবাউশ ৫০০-৮০০ টাকা, চিংড়ি মাছ ৯০০-১৫০০ টাকা, কাঁচকি মাছ ৫০০ টাকা, কৈ মাছ ৬০০-১২০০ টাকা, পাবদা মাছ ৫০০-৬০০ টাকা, শিং মাছ ৪০০-১২০০ টাকা, টেংরা মাছ ৬০০-১০০০ টাকা, মেনি মাছ ৫০০-৮০০ টাকা, বেলে মাছ ১২০০ টাকা, বোয়াল মাছ ৭০০-১২০০ টাকা, রূপচাঁদা মাছ ১০০০-১৩০০ টাকা, কাজলী ১৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে আজ মুদি দোকানের পণ্যের দামও রয়েছে অপরিবর্তিত। তবে এক লাফে ৪০ টাকা বেড়ে গেছে খেসারির ডালের দাম। ছোট মসুর ডাল ১৪০ টাকা, মোটা মসুর ডাল ১১০ টাকা, বড় মুগ ডাল ১৬০ টাকা, ছোট মুগ ডাল ১৮০ টাকা, খেসারি ডাল ১২০ টাকা, বুটের ডাল ১১৫ টাকা, ছোলা ১১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে খেসারির ডাল ছিল ১৬০ টাকা কেজি, গতকাল তা বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজি।
অন্যদিকে বাজারে সব ধরনের মাংসের দামই বাড়তি যাচ্ছে। কিছুদিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গরুর মাংস ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৭৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া খাসি প্রতি কেজি ১১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পাশাপাশি বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দামও, এটির এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকা দরে। যা রোজার আগেও ১৯০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে ছিল। এ ছাড়া সোনালি মুরগির দামও বেড়ে প্রতি কেজি এখন ৩৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে কক মুরগি প্রতি কেজি ৩৬০ টাকা, লেয়ার মুরগি প্রতি কেজি ৩০০ টাকা এবং দেশি মুরগি প্রতি কেজি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বেঁধে দেওয়া দামে মিলছে না ২৯ পণ্য
রোজার আগে বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে চাল, চিনি, তেল ও খেজুরে শুল্ক-কর কমায় সরকার। এরপরও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। রমজান মাসকে ঘিরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। বাধ্য হয়ে সম্প্রতি গরুর মাংস, ছোলা, ব্রয়লার মুরগিসহ ২৯টি নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দেয় সরকার। তাতেও সুফল মেলেনি। বাজার ঘুরে দেখা যায়, আগের মতোই বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বাজারে কোনো পণ্যই মিলছে না।
এ নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ। বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এমন অভিযোগ তাদের। ক্ষুব্ধ ক্রেতারা বলছেন, শুধু দাম নির্ধারণ করে দিয়েই দায় সারছে সরকার। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে সরকার শুধু কঠোর হুঁশিয়ারির কথা বলে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই বাজারে। নিয়মিত তদারকি বাড়ানো, প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরও সক্রিয়ভাবে বাজার মনিটরিংয়ে নামানোর দাবি জানান তারা।
স্বস্তি নেই ফলের বাজারেও
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ছোঁয়া লেগেছে ফলের বাজারে। রমজান মাসে ফলের চাহিদা বেশি হওয়ায় দাম নিয়ে একরকম অস্থিরতায় আছেন ক্রেতারা। কেউ দিচ্ছেন সিন্ডিকেটের দোষ, আবার কেউবা দোষ দিচ্ছেন শুল্ক বা ডলার ক্রাইসিসের দিকে।
রাজধানীর খিলগাঁও, বাসাবো, মাদারটেক, সিপাহীবাগসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে সব ধরনের ফলের দামই অনেক বেশি। বিশেষ করে রমজান মাস আসার পরই এসব ফলের দাম বেশি হয়েছে। যেই আপেল রমজানের আগে বিক্রি হতো ২৪০-২৬০ টাকায় সেই আপেল রমজানের শুরু থেকেই বিক্রি হচ্ছে ৩৬০-৩৮০ টাকায়। এভাবে বাজারে থাকা সব ধরনের ফলের দামই এখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। তাই তো বেশির ভাগ ক্রেতারা কেজি হিসেবে ফল না কিনে পিস হিসাবে কিনতে দেখা যায়।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি পিস মাঝারি সাইজের তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়। আপেল মানভেদে ৩৪০ থেকে ৩৮০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। নাশপাতি ৩২০ টাকা, ছোট কমলা ২৬০ টাকা। ডালিম ৪২০-৪৫০ টাকা, আঙুর ৩৪০ থেকে ৩৬০ টাকা, মাল্টা ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা। এক হালি কলা বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৩০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত।
চট্টগ্রামের কাঁচাবাজার
চট্টগ্রাম নগরের কাঁচাবাজারে ৪০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না অধিকাংশ সবজি। দাম বেড়েছে মাছ-মাংসেরও। রোজার মধ্যে বাড়তি দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার বেশ কিছু নিত্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও তা মানার ব্যাপারে অনীহা খুচরা বিক্রেতাদের। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আলু ২৮ টাকা, কাঁচা মরিচ ৬০ টাকা, বাঁধাকপি ২৮ টাকা, ফুলকপি ২৯ টাকা, বেগুন ৪৯.৭৫ টাকা, শিম ৪৮ টাকা, টমেটো ৪০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ২৩ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা।
নগরীর চকবাজার, বহদ্দারহাট, কাজীর দেউড়ি, রিয়াজউদ্দিন বাজার ও কর্ণফুলী কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন কাঁচাবাজারে গতকাল শুক্রবার আলু ৪৫ টাকা, বাঁধাকপি ৩০ টাকা, ফুলকপি ৫০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৬০-৭০ টাকা, বেগুন ৫০ টাকা, শিম ৫০-৫৫ টাকা, টমেটো ৪০-৫০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
এ ছাড়া গাজর ও শসা ৪০ টাকা, পেঁপে ও ধনেপাতা ৫০ টাকা, ধুন্দল, ক্ষিরা ও চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, ঢেঁড়স, বরবটি ও তিতকরলা ৮০ টাকা, লাউ ৪০ টাকা, সবুজ কেপসিকাম ১০০ টাকা, শিমের বিচি ৭০ টাকা, লেটুস পাতা ১০০ টাকা, এক ডজন লেবু ১২০-১৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। শাক নেই ২০ টাকার নিচে।
অধিদপ্তরের তালিকায় খুচরা মূল্য না গরুর মাংস ৭০০-৯০০ টাকা, ছাগলের মাংস ১১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২১০-২২০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩৩০-৩৫০ টাকা, দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৬২০ টাকা কেজি দরে। কাতাল ৩৬০ টাকা, পাঙ্গাশ ২০০ টাকা, তেলাপিয়া ২০০-২৩০ টাকা, রুই ২৫০-৩৩০ টাকা, পাবদা ৪০০ টাকা, সুরমা ৩২০-৬৫০ টাকা, বাগদা চিংড়ি ৮০০ টাকা, রূপচাঁদা আকারভেদে ৬০০-৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি ডজনের দাম পড়ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা।
তবে ভারত থেকে আমদানির খবরে কমেছে পেঁয়াজের দাম। বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৭০ টাকা। আদা ও রসুনের কেজি ১৭০ থেকে ২০০ টাকা। ছোলা ৯৫-১০৫ টাকা, খেসারি ডাল ১২০-১২৫ টাকা, চিনি ১৩৫ টাকা, লবণ ৪০ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৫-১৭০ টাকা, প্যাকেটজাত আটা ৬০ থেকে ৬৭ টাকা, সাধারণ মানের খেজুর ৩০০-৩৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দামও বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৪ টাকা। নাজিরশাইল ও সরু চাল ৬২ থেকে ৭৫ টাকা, পাইজাম ৫২ থেকে ৫৬ টাকা, স্বর্ণা ও ইরি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫২ টাকা দরে।
রমজানে চট্টগ্রামে সব পণ্যের অবাধ সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ৪০টি বাজার, মার্কেট ও শপিংমলগুলোতে জেলা প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া সিন্ডিকেট ও কালোবাজারি রোধে বাজার মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আবদুল মালেক।