মেঘ, পাহাড়, নদী ও ঝর্ণার মিলনে অপরূপ জেলা বান্দরবান। এসব নান্দনিক দৃশ্যে চোখ জুড়াতে সারা দেশ থেকে পর্যটক আসেন এখানে। কিন্তু পাহাড়ে নতুন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) উত্থানের কারণে নিরাপত্তা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে দীর্ঘদিন কয়েক দফায় পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে পর্যটন শিল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
দেশের তিনটি পার্বত্য জেলার মধ্যে একটি বান্দরবান। জেলাটির দক্ষিণ-পশ্চিমে কক্সবাজার, উত্তর-পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা, উত্তরে রাঙামাটি ও পূর্বে মিয়ানমার।
নিষেধাজ্ঞার টাইমলাইন
২০২০ থেকে ২১ সাল পর্যন্ত কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই কেএনএফের তৎপরতার কারণে ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে স্থানীয় প্রশাসন।
এরপর ধারাবাহিকভাবে থানচি ও আলীকদম উপজেলাও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে দফায় দফায় উপজেলাভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রশাসন। নিষেধাজ্ঞা বাড়ানোও হয়েছে কয়েক দফায়।
এরপর ২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তবে, সে বছরের ১৬ মার্চ সে নিষেধাজ্ঞা আবারও জারি করা হয়। পরে, আবারও ২০২৪ সালের ৮ অক্টোবর বান্দরবান ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এরপর ৬ নভেম্বর জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে চার উপজেলায় ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও তিন উপজেলা—রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচিতে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা হয়।
চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি রোয়াংছড়ির দেবতাখুম থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় পর্যটকেরা বর্তমানে সেখানে ভ্রমণ করতে পারছেন। ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ থেকে দুই বছরেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর চলতি ৬ জুন থেকে রুমায় বগা লেক পর্যন্ত এবং থানচিতে তুমাতুঙ্গি ও তিন্দু পর্যন্ত ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে, নির্দেশিত স্থানের বাইরে কোথাও যেতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
কেএনএফের উত্থান যেভাবে
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কেএনএফ সংগঠনটি গড়ে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী নাথান বম সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো এমন তথ্যই দিয়েছে।
প্রথমে ২০১২ সালে কুকি-চিন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন্স (কেএনডিও) নামে সংগঠন করেন তিনি। পরে ২০১৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে, যদিও সংগঠনটির লোগোতে প্রতিষ্ঠাকাল উল্লেখ করা আছে ২০০৮ সাল।
শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিবাদ করত তারা। এ ছাড়া বম, লুসাই, পাংখো, খিয়াংসহ পিছিয়ে পড়া নৃগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা ও মারমাদের ব্যাপক বৈষম্যের প্রতিবাদ করছিল সংগঠনটি। তবে, কিছুদিন পর কেএনএফ আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যায়।
একপর্যায়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে তারা। রাঙামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের ছয়টি জাতিগোষ্ঠী—বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমিদের প্রতিনিধিত্ব করছে বলে নিজেদের ফেসবুক পেজে দাবি করে তারা।
গোষ্ঠীটি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম এবং রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি—মোট ৯টি উপজেলা নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করে। এমনকি, কল্পিত রাজ্যটির মানচিত্রও তাদের পেজে আপলোড দেয় তারা।
কেএনএফের দাবি, তাদের সামরিক শাখার শতাধিক সদস্য গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে পাড়ি জমান বছর তিনেক আগে। ২০২১ সালে প্রশিক্ষণ শেষে একটি দল ফিরে এসে আত্মগোপনে চলে যায়। তবে তখন হয়তো ১৫ থেকে ২০ জনের মতো সদস্য ছিল বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
কেএনএফ শুরুতে তাদের ফেসবুক পেজে সরকারের কোনো দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নয়, বরং সব ক্ষোভ আঞ্চলিক পরিষদ, জেএসএস ও চাকমাদের ওপর চাপায়। এমনকি, বিভিন্ন মহল্লায় হামলা চালিয়ে চাকমাদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার নানা বার্তা দেয় তারা। এ সময়, তারা রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের একটি ত্রিপুরা গ্রামে দুজন জুম চাষিকে হত্যাও করে।
শুরুতে পাহাড়ে নতুন রাজ্যের দাবি করলেও বর্তমানে সেই অবস্থান থেকে সরে এসে স্বায়ত্বশাসন চাচ্ছে কেএনএফ। তবে, জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), আঞ্চলিক পরিষদ ও চাকমাবিদ্বেষের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাদের মতে, পাহাড়ে ‘চাকমা কর্তৃত্ব’ চলমান রয়েছে।
কেএনএফের তৎপরতা
ফেসবুকে পেজে ঘোষণা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল কেএনএফ। এরপর থেকে চাঁদাবাজি ও গুম-খুন অপহরণের মাধ্যমে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করে তোলার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে।
একপর্যায়ে অভিযোগ পাওয়া যায়, দুর্গম পাহাড়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) গোপন আস্তানায় প্রশিক্ষণশিবির স্থাপন করেছে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার জঙ্গিরা।
এই তথ্যের ভিত্তিতে ২০২২ সালের ৩ অক্টোবর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযান শুরু হয়। এরপর একই বছরের ১৭ অক্টোবর থেকে পর্যটক ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
পরে সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসার কথা থাকলেও ২০২৪ সালে বান্দরবানের দুই উপজেলায় ১৭ ঘণ্টার ব্যবধানে দুই ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতি করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
আত্মপ্রকাশের পর থেকে অন্তত নয়টি বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে কেএনএফ। একই বছর পাহাড়ের আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সঙ্গে সংঘর্ষে রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাংপাড়া এলাকায় ৮ জন ও রুমা উপজেলার মুয়ালপিপাড়া একজন নিহত হন।
এ ছাড়া, ২০২৩ সালের ৮ মে রোয়াংছড়ি উপজেলা পাইংখিয়ংপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগের একজন নেতাসহ বম জনগোষ্ঠীর তিনজন এবং ২০২৩ সালের ২২ মার্চ একই উপজেলার রামথারপাড়ায় থংচুল বম নামের এক কারবারিকে (পাড়াপ্রধান) গুলি করে হত্যা করা হয়।
২০২২ সালের ২১ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় তিন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে তারা।
জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানের সময় কেএনএফের অনেক সদস্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের মিজোরামে চলে যান। এতে বম জাতিগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ পড়েন বিপাকে। এর সুযোগ নেয় কেএনএফ। তখন নতুন করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যুবকদের তারা দলে ভেড়ায় বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
২০২৩ সালে পাহাড়ে যৌথ অভিযানের সময় কেএনএফের ২ সদস্য ও কেএনএফের গুলিতে সশস্ত্র গ্রুপ মগ পার্টির ৩ জন নিহত হন। একই বছরের ১২ মার্চ দুপুরে কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যদের গুলিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং দুজন সেনা সদস্য আহত হন। তার একদিন আগে থানচি থেকে কেএনএফ ১২ জন নির্মাণ শ্রমিককে অপহরণ করে। তাদের মধ্যে একজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হন এবং বাকিদের জিম্মি করে রাখা হয়।
২০২৪ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল রুমা ও থানচিতে তিনটি ব্যাংকে ডাকাতি করে কেএনএফ। তারপর ৬ এপ্রিল থেকে সন্ত্রাস দমনে নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান শুরু করে।
বান্দরবান পুলিশ সুপার কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, কেএনএফের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ২৮টিরও বেশি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রুমা থানায় ১৮টি, থানচিতে ৬টি, রোয়াংছড়িতে ৩টি ও সদর থানায় একটি মামলা হয়েছে।
এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে রুমায় ১১ জন, রোয়াংছড়িতে ৫ জন, বান্দরবান সদরে ২ জন ও থানচিতে ১ জনসহ মোট ১৯ জন কেএনএফ সদস্য নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া, পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ২৬টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।
কয়েক বছরেও ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব না!
বান্দরবান হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বান্দরবান সদরে ৭৪টিসহ মোট দেড় শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট-কটেজ রয়েছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে দীর্ঘদিন বান্দরবানে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছে সেখানকার পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো।
বান্দরবান হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা ও এরপর পাহাড়ের অভ্যন্তরীণ কিছু গ্রুপ, বিশেষ করে কেএনএফের কারণে আমাদের অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমরা কয়েক বছরেও এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারব না।’
তিনি বলেন, ‘তবে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে পর্যটক আসতে না পারায় এবারের কোরবানি ছুটিতে প্রচুর পর্যটক এসেছে।’
কুকি-চিন নিয়ে নিরাপত্তা হুমকি নেই জানিয়ে পর্যটকদের বান্দরবান ভ্রমণে যাওয়ার আমন্ত্রণও জানিয়েছেন এ ব্যবসায়ী।
বর্তমান পরিস্থিতি
চলতি বছরের ২ জুন কেএনএফের ইউনিফর্ম তৈরির জন্য কাপড় সরবরাহের অভিযোগে চট্টগ্রামে ওয়েল কম্পোজিট নিট নামের একটি ফেব্রিক্স কারখানায় অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরিকুল ইসলামসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এর আগে, গত ১৭ মে নয়াহাটের রিংভো অ্যাপারেলস থেকে ২০ হাজার ৩০০ পিস এবং পরের দিন একটি গোডাউন থেকে ১১ হাজার ৭৮৫ পিস কেএনএফ ইউনিফর্ম জব্দ করা হয়। সর্বশেষ ২৮ মে পাহাড়তলীর নূর ফ্যাশন কারখানা থেকে আরও ১৫ হাজার পিস ইউনিফর্ম জব্দ করা হয়।
এ পর্যন্ত কেএনএফের ৪৭ হাজারের বেশি ইউনিফর্ম জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত এক মাসে কেএনএফের এক হাজার ৯৭৯ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তারদের সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে। গত ২৬ মে সেনাসদরে আয়োজিত বিশেষ ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানানো হয়।
বান্দরবানে পর্যটন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, ‘দর্শনীয় স্থানগুলোতে এখন কোনো পর্যটন নিষেধাজ্ঞা নেই। যেসব জায়গা পর্যটকদের জন্য খোলা হয়েছে, সেসব জায়গায় নিরাপত্তাজনিত কোনো শঙ্কাও নেই।’
সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যৌথ অভিযান এখনো চলমান রয়েছে।’