রাজধানীতে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় নাটক বন্ধ করতে আসা ব্যক্তি এবং গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সমাবেশে হামলাকারীদের পরিচয় শনাক্ত করে এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি উঠেছে।
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ বলেছেন, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে প্রতিবাদ কর্মসূচি দেওয়া হবে।
ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ বলেন, ‘আমরা তো নাট্যকর্মী, আমাদের পরিচয় স্পষ্ট। তবে যারা নাটক বন্ধ করতে চায়, তারা কারা? আমরা তাদের পরিচয় জানতে চাই। তারা যেভাবে আমাদের ওপর হামলা করেছে, তা সন্ত্রাসী আচরণ। আমরা এর বিচার চাই।’
শনিবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কামাল বায়েজীদ বলেন, ‘যারা হামলা করেছে, এই চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় এনে শিল্পচর্চার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’
সংবাদ সম্মেলনে আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত করে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সারা দেশের নাট্যকর্মীদের নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও জানিয়েছেন কামাল বায়েজীদ।
গত ২ নভেম্বর দেশ নাটক প্রযোজিত ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই দিন টিকিট বিক্রি শুরু হয় বিকাল থেকে। এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে একদল লোক শিল্পকলার গেটের সামনে দেশ নাটকের সদস্য এহসানুল আজিজ বাবুকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।
পরে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক জামিল আহমেদ গিয়ে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করলে যথারীতি নাটকের প্রদর্শনী শুরু হয়। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা ফের সংগঠিত হয়ে নাট্যশালার গেটের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে তারা গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে মহাপরিচালক ‘দেশ নাটকের’ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে প্রদর্শনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দেন।
পরদিন এক ব্রিফিংয়ে জামিল আহমেদ বলেন, দর্শকের ‘নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে’ নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি দেখে তার আশঙ্কা হয়েছিল, শিল্পকলা একাডেমিও ‘আক্রান্ত হতে পারে’।
এ ঘটনায় উদীচী, দেশ নাটক বিবৃতি দিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীরা।
নাটক বন্ধের ঘটনায় শুক্রবার বিকেলে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। শিল্পকলা একাডেমির সামনে সমাবেশ চলাকালীন কয়েকজন লোক এসে পেছন থেকে ‘ডিম ছুড়ে’ মারে এবং নাট্যকর্মীদের ধাওয়া খেয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
পরে নাট্যকর্মীরা নাট্যশালার সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে ‘নাটক মোদের অধিকার/রুখবে নাটক সাধ্য কার’।
এর আধা ঘণ্টা পর ৪০-৫০ জন বিক্ষোভকারী সংগঠিত হয়ে আবারও এসে নাট্যশালার সামনে স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যারিকেড তৈরি করেন।
নাট্যকর্মীরা অবস্থান নেন নাট্যশালার মেইন গেটের সামনে। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীরা অবস্থান নেন দুর্নীতি দমন কমিশনের গেটের সামনে। উভয়পক্ষের পাল্টাপাল্টি স্লোগানে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নাট্যশালার সামনের চত্বর। সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় বিক্ষোভকারীরা নাট্যশালার সামনে থেকে চলে যান।
শনিবার সংবাদ সম্মেলনে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের অনুষ্ঠান সম্পাদক খন্দকার শাহ আলম বলেন, ‘যারা এই হামলা করেছে, তারা নিজেদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা বলে পরিচয় দিচ্ছে। নাট্যাঙ্গনেও তো অনেকেই জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিল, আহতও হয়েছে।
‘যে দলের নাটক তারা বন্ধ করার দাবি তুলেছে, সেই দলেও আন্দোলনে অংশ নেওয়া আছে। নাট্যদলে তো নানা রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ আছে। একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ, কিন্তু নাটক বন্ধ করতে চায়। তারা আসলে কি চায়?’
বিক্ষোভকারীদের দাবি স্পষ্ট নয় জানিয়ে কামাল বায়েজীদ বলেন, ‘তারা এসে বলছে ‘দেশ বাংলা’র নাটক বন্ধ করতে হবে। তারা নাটকের দলের নামও জানে না। বলছে, বাংলা একাডেমিতে নাটক করতে দেওয়া হবে না। এটা যে শিল্পকলা একাডেমি, এটাও তারা জানে না। তাহলে তারা কারা? নাটক বন্ধ করার মতো দাবি তুলে যে সন্ত্রাসী আচরণ করছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। তাদের কারা মদদ দিচ্ছে, তাদের পরিচয়ও সামনে আনতে হবে।’
আলোচনায় বসে সমাধান করার চিন্তা আছে কি-না প্রশ্নে কামাল বায়েজীদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘তারা কারা, এটাই তো আমরা জানি না। তাদের তো একটা প্ল্যাটফর্ম থাকতে হবে। তারপর তাদের সঙ্গে কথা বলা যায়। কয়েকজন ব্যক্তি একটা ‘মব’ সৃষ্টি করে নাটক বন্ধ করার দাবি তুলবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন ঝুনা চৌধুরী, তপন হাফিজ, ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের নির্দেশক ও নাট্যকার মাসুম রেজা, অভিনেতা কামাল আহমেদ।
সংবাদ সম্মেলনের বাইরে বিক্ষোভ, চারজন থানায়
এদিকে, শনিবার গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সংবাদ সম্মেলন চলাকালীন শিল্পকলা একাডেমির মেইন গেটের সামনে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ১০ থেকে ১৫ জন বিক্ষোভকারী।
প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ/শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘তুমি কে আমি কে বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। তাদের কাছে পরিচয় জানতে চাইলে, তারা নিজেদের ‘সাধারণ জনতা’ হিসেবে পরিচয় দেন। তবে তাদের বেশির ভাগই নিজেদের নাম বলতে রাজি হননি।
তাদের মধ্যে মহিউদ্দিন হৃদয় নামে একজন নিজেকে ‘জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সমর্থক’ বলে পরিচয় দিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এহসান বাবু দেশ নাটকের পৃষ্ঠপোষক, সে আওয়ামী লীগের দালাল। আমাদের উপদেষ্টাদের নিয়ে কটূক্তি করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে। আমরা তার নাটক এখানে করতে দেব না।’
এহসান বাবুর কোনো নাটক তিনি দেখেছেন কি-না বা কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন কি-না প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি মালিবাগে থাকি, সংস্কৃতি অঙ্গনের কেউ না।’
হৃদয় বিএনপির দায়িত্বশীল কোনো পদে আছেন কি-না জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি সমর্থক, বিএনপির কোনো পদে নাই।’
এ সময় প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ানোদের মধ্য থেকে চারজনকে রমনা থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। তাদের মধ্যে হৃদয়ও ছিলেন।
সেখানে দায়িত্বরত মোস্তফা নামের একজন পুলিশ সদস্য জানান, ‘তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেওয়া হচ্ছে। তবে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি।’
এদিকে শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে আরণ্যক নাট্যদলের ‘কোম্পানি’ নাটকের প্রদর্শনী বাতিল করা হয়েছে।
আরণ্যক নাট্যদল জানিয়েছে, শুক্রবার নাট্যকর্মীদের সমাবেশে হামলার প্রতিবাদে তারা এ প্রদর্শনী বাতিল করেছে। (তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ)