জানুয়ারি মাসে এমনভাবেই শীত পড়ার কথা। মাসের শুরুতেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভব করছে মানুষ। পৌষ মাস। কনকনে শীত, সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস- দুই মিশেলে যেন শীতের পুরো প্যাকেজ। রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশ কাঁপছে শীতে। কারও কাছে এ ঋতু ফ্যাশনেবল আবার কারও কাছে বেশ অভিশাপ। কেননা তীব্র এই শীতে গরম জামা-কাপড় না থাকলেই তো বিপদ। খেটে খাওয়া অসহায় মানুষের জন্য শীত মানেই কষ্টের ঋতু।
দিনমজুর আর গরিবদের শীত উপভোগ করার বিষয় নয়। তাদের ঠিকই কাজের সন্ধানে ছুটতে হয়। তাই তো দিনভর সূর্য না দেখা রাজধানীতে খুব সকালেই দেখা মিলেছে রিকশা-ভ্যানচালকসহ খেটে খাওয়া মানুষ।
শাহবাগ মোড়ে বসে শীতে কাঁপা অটোচালক মোখলেস বললেন, ‘এমন শীতে টিকা মুশকিল। আমাগো কাজ কম্ম করতেই হয়। তাই তো বউ পোলাপানের লাইগ্যা রাস্তায় বাইর হইছি।’ ঠিক তাই- শীত তো আর পেটের ক্ষুধা বোঝে না।
এদিকে রাজশাহী জেলার ওপর দিয়ে শুক্রবার বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। দিনের বেলায় রোদ উঠলেও কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস শীতের তীব্রতা আরও বাড়িয়েছে। দেশের যে ১৩ জেলায় গতকাল শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়, এর মধ্যে রাজশাহী একটি। সেখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ১ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তা মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে ধরা হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, নওগাঁ, কুষ্টিয়া এবং রংপুর বিভাগে বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। রংপুর বিভাগের জেলার সংখ্যা ৮। তাই সব মিলিয়ে গতকাল ১৩ জেলায় বইছে শৈত্যপ্রবাহ।
শুধু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়া জেলাগুলোতেই নয়, রাজধানীসহ দেশের প্রায় সর্বত্রই তীব্র শীতের প্রকোপ ছিল। এর মধ্যে শুরু হওয়া ঘন কুয়াশা শীতের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার যেসব এলাকায় রোদ উঠেছে, সেখানে তীব্রতা কমেনি শীতের। এ কারণে জনজীবনে অনেক স্থানেই নেমে এসেছে স্থবিরতা।
গতকাল ছুটির দিন এমনিতেই রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল কম থাকে। তীব্র শীত তা আরও কমিয়ে দিয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের বিপত্তি বেড়েছে; কারণ, তাদের এই শীতেও কাজের সন্ধানে বাইরে বেরোতে হয়েছে। ঘন কুয়াশার কারণে যানবাহন চলাচলে বিপত্তি দেখা দিয়েছে অনেক স্থানে। শীতজনিত নানা অসুখে হাসপাতালসহ চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে রোগী বেড়েছে।
রাজধানীতে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে সূর্যের দেখা নেই। আজ শনিবারও রাজধানীতে কুয়াশা থাকতে পারে। তবে রোদ ওঠারও সামান্য সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তর।
মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পঞ্চগড়
দৈনিক বাংলার প্রতিনিধির তথ্যমতে, শুক্রবার পঞ্চগড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে, যা এই মৌসুমের সবচেয়ে কম তাপমাত্রা।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এদিকে বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার দিনে ও রাতের তাপমাত্রা কমলেও শুক্রবার সকাল থেকে রোদ উঠলেও বেশ ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। বিশেষ করে দুস্থ অসহায় দরিদ্র দিনমজুর পরিবারগুলো দুর্ভোগে পড়েছে বেশি।
কুয়াশা ও হিমেল বাতাসে পঞ্চগড়ের জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলেছে। গরম কাপড়ের অভাব ও আয় কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক মো. রোকনুজ্জামান জানান, শুক্রবার সকাল ৬টায় ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এ ছাড়া সকাল ৯টায় ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ১০০ শতাংশ এবং বাতাসের গতি ঘণ্টায় ১২-১৩ কিলোমিটার ছিল।
শৈত্যপ্রবাহে কাঁপছে উত্তরের জনপদ
দেশব্যাপী আগামী ৭২ ঘণ্টা ঘন কুয়াশা অব্যাহত থাকতে পারে। শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত আবহাওয়ার পূর্বাভাসের তথ্যে জানানো হয়, সিনপটিক অবস্থা সম্পর্কে জানানো হয়েছে, উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। আর এর বর্ধিতাংশ উত্তরপূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।
এ ছাড়া আগামী ৩ দিন অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারা দেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। তবে মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং তা কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নদী পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
অন্যদিকে সারা দেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা দেশের পশ্চিমাংশে ১-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র তা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। একই সঙ্গে ঘন কুয়াশার কারণে সারা দেশের কোথাও কোথাও দিনের বেলা শীতের অনুভূতি বিরাজ করতে পারে।
আজ শনিবার ও আগামীকাল রোববার সারা দেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। তবে ওইদিন ঘন কুয়াশার কারণে সারা দেশের কোথাও কোথাও দিনের বেলা শীতের অনুভূতি বিরাজ করতে পারে।
বর্ধিত ৫ দিনের আবহাওয়ার অবস্থা পর্যালোচনায় এ সময়ের শুরুর দিকে দেশের উত্তরাংশে হালকা বৃষ্টি বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে বলেও জানানো হয়েছে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে।
শিশুদের বাড়ছে ঠাণ্ডাজনিত রোগ
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) এক রিপোর্টে জানা যায়, প্রচণ্ড শীতে ঠাণ্ডাজনিত রোগে কাবু হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। চিকিৎসকদের মতে, শীতে শিশুদের ডায়রিয়া, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের রোগ দেখা দেয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল, আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, কলেরা হাসপাতালসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডায়রিয়া, সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত রোগীর চাপ বেড়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে আসা সর্দি-জ্বরে আক্রান্তদের অধিকাংশই শিশু। এ ছাড়া সেখানে বহির্বিভাগে প্রতিদিন সেবা নিতে আসা জ্বর, ঠাণ্ডা ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
চিকিৎসকরা বলছেন, চলতি বছরে হঠাৎ করে শীত বেড়ে যাওয়ার কারণে দুই থেকে তিনগুণ বেড়েছে ঠাণ্ডাজনিত রোগ। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা বেশির ভাগই শিশু। বাচ্চারা শ্বাসতন্ত্রের নানা ধরনের সংক্রমণ ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। বাচ্চাদের অ্যাজমাও বেড়ে গেছে। আক্রান্ত অনেক শিশুকে দেরিতে তাদের কাছে আনা হচ্ছে। আগেই অভিভাবকরা স্থানীয় ফার্মেসির ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। এতে শারীরিক জটিলতা বাড়ছে।
আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেছে, কামরাঙ্গীরচর থেকে চিকিৎসা নিতে এসেছে ৭ মাস বয়সি শিশু খালিদ হাসান। গত ১৮ ডিসেম্বর শিশু বিভাগে ভর্তি করা হয় তাকে। এখনো চলছে তার চিকিৎসা। সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। প্রতিদিন তিনবার নেবুলাইজার করার ফলে অবস্থা আগের থেকে কিছুটা উন্নত।
শুধু খালিদ নয়, এমন প্রায় শতাধিক শিশু ঠাণ্ডা, কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছে হাসপাতালটিতে।
আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক ডা. রাবেয়া সুলতানা জানান, বর্তমানে শীতের সঙ্গে বায়ুদূষণও যোগ হয়েছে। যা শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু শিশু বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। শীতের প্রকোপ বাড়লে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের (ঢাকা শিশু হাসপাতাল) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল আলম বলেন, শুধু শীতে নয়, এখন বায়ুদূষণেও আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। জ্বর-সর্দি-কাশি গলায় ইরিটেশন হচ্ছে। দুই বছরের কম বয়সি শিশুদের ব্রংকিউলাইটিস এবং দুই বছরের বেশি বয়সি শিশুদের নিউমোনিয়া দেখা দিচ্ছে। যাদের অ্যাজমা আছে, শীতে তা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। শীতে শিশুদের ডায়রিয়ার ঝুঁকিও থাকে।
গরমের তুলনায় শীতকালে শিশুদের তুলনামূলক পানি কম খাওয়ানো হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। যাতে শিশুরা শীতে পর্যাপ্ত পানি পান করে। বাসায় বড়দের যদি জ্বর-সর্দি-কাশি হয়, তাহলে তারা যেন বাসায় মাস্ক ব্যবহার করেন। কারণ তারা যখন হাঁচি, কাশি দেবেন তা দ্বারা শিশুরা যেন সংক্রমিত না হয়। শিশুদের বিষয়ে বিশেষ যত্ন নিতে হবে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু রেসপিরেটরি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাবিলা আকন্দ বলেন, নিউমোনিয়ার লক্ষণ হচ্ছে- কাশি, তার সঙ্গে জ্বর, শ্বাসতন্ত্রের জটিলতার জন্য শ্বাসকষ্ট হতে পারে। খেতে না পারা, বমি করে দেওয়া। নবজাতকের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি যদি মিনিটে ৬০ বার থাকে, নবজাতক পরবর্তী এক বছর বয়সি শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি যদি ৫০ বার বা তার অধিক হয় এবং এক বছর থেকে ৫ বছর বয়সি শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি মিনিটে যদি ৪০ বার বা তার বেশি হয় তাহলে ধরে নিতে হবে অবশ্যই ঝুঁকি আছে। তখন বাসায় বসে না থেকে অবশ্যই শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
ছয় মাসের কম বয়সি শিশুদের জন্য বুকের দুধ খাওয়ানো খুবই জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু বুকের দুধপানে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। সময়মতো টিকাগুলো দিতে হবে। যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, দুর্বল প্রকৃতির শিশু, যাদের নিউমোনিয়া বারবার হয় বা হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাদের জন্য সরকারি টিকার পাশাপাশি প্রতিবছর ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নিতে পারলে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি কমে আসবে।