প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধন হয়েছে পহেলা ফেব্রুয়ারি শনিবার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্বোধনের পর বিকাল থেকেই মেলায় ছিল বইপ্রেমী পাঠক তথা দর্শনার্থীদের ভিড়। আজ রোববার মেলার দ্বিতীয় দিনেও উচ্ছ্বাস নিয়ে মেলায় এসেছিলেন হাজারও দর্শনার্থী। সবাই নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিয়েছেন, উল্টেপাল্টে দেখেছেন নানা স্টলের নতুন-পুরোনো বই। যদিও দ্বিতীয় দিনে বরাবরের মতো নতুন বইয়ের খোঁজ নিতেই ব্যস্ত ছিলেন তারা, প্রকাশনা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, দ্বিতীয় দিনে বিক্রি ছিল একেবারেই সামান্য।
এদিন মেলার প্রতিটি প্রবেশদ্বারে ছোট-বড় সব বয়স ও শ্রেণির মানুষকে মেলায় ঢুকতে দেখা গেছে। বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিবারবর্গ নিয়ে অনেকেই এসেছেন মেলায় ঘুরতে। ক্রেতাদের আকর্ষণ বাড়াতে মনোরমভাবে স্টলগুলো সাজানো হয়েছে।
মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, বইমেলার আকর্ষণীয় স্টলগুলোর সামনে ছিল দর্শনার্থীদের ছবি তোলার হিড়িক। যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা জানান দিতে চান মেলায় তার উপস্থিতির কথা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই মেলায় বাড়তে থাকে দর্শনার্থীদের আনাগোনা। আড্ডা-গল্প আর সেলফি তোলায় তাদের ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে। যদিও বই কেনার প্রতি তাদের যেন কোনো ঝোঁকই ছিল না।
প্রকাশকদের অনেকেই বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকৃত ক্রেতাদের অনেকেই মেলায় এখনো আসতে শুরু করেননি। সময় গড়ালে দর্শনার্থীদের পাশাপাশি ক্রেতাদের ভিড়ও বাড়বে বলে আশা তাদের।
ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী হাসেম আলী বলেন, বেচা বিক্রি নেই বললেই চলে। মানুষ আসছে, দেখছে, ছবি তুলছে পরে চলে যাচ্ছে। আমরা মোটামুটি আমাদের সব বই গুছিয়ে এনেছি। সামনে আরও বই আসবে। বাকিটা সময়ই বলে দেবে।
বইয়ের দাম নিয়ে অন্বেষা প্রকাশনীর জ্যেষ্ঠ বিক্রয়কর্মী মোসাদ্দেক হোসেনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, আমাদের কাজ বই বিক্রি করা। দামের বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারবো না। এখন তো সবকিছুর দামই বেশি। সম্ভবত কাগজের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বইয়ের দামও বেশি।
মেলায় ঘুরতে আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেজোয়ান আহমেদ বলেন, মেলায় এসেছি মূলত ঘুরতে। আসছি তাই ছবিও তুলছি, ঘুরছি আর দেখছি। বই পছন্দ হলে কিনবো।
অন্বেষার প্রকাশক শাহাদাৎ হোসেন বলেন, প্রথম দিন অনেকেই এসেছেন, আজকেও আসছেন। বই বিক্রি হচ্ছে তবে অল্প। ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থী বেশি। আশা করছি এবারে আমরা সবাই মিলে একটা সুন্দর বইমেলা উপভোগ করতে পারবো।
রোববার মেলা ৩ টায় শুরু হয়ে চলে রাত ৯ টা পর্যন্ত। মেলায় নতুন বই এসেছে ১৩টি।
এদিন বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘হেলাল হাফিজের রাজনৈতিক পাঠ’শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. কুদরত—ই—হুদা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মৃদুল মাহবুব। সভাপতিত্ব করেন সুমন রহমান।
প্রাবন্ধিক বলেন, উনসত্তরের গর্ভ থেকে যেসব কবির জন্ম হয়েছিল, কবি হেলাল হাফিজ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর কবিতার উচ্চারণ ছিল রাখঢাকহীন, স্পষ্ট, অনাবিল ও অভাবিত। কবিতা তাঁর কাছে কেবল ব্যক্তিগত দীর্ঘশ্বাসের বিষয় ছিল না। তিনি মনে করতেন, সমষ্টির জন্যও কবিতার একটা দায় আছে। সত্তর থেকে চুয়াত্তরের মধ্যে যে রাজনৈতিক কবিতাগুলো তিনি লিখেছেন, সেগুলোর মূল সুর কখনো মুক্তিযুদ্ধ, কখনো স্বাধীনতাত্তোর রাজনৈতিক পরিস্থিতিজাত হতাশা, আশাবাদ, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। আলোচক বলেন, কবি হেলাল হাফিজের কবিতার কথা বললেই পাঠকের মানসপটে ভেসে ওঠে-‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ পঙক্তিটি। বাংলা ভাষার যেসব কবি কবিতা, নিজস্ব জীবনদর্শন ও জীবনযাপন দিয়ে মিথ হয়ে উঠতে পেরেছেন, কবি হেলাল হাফিজ তাঁদের একজন। কবিতার ভেতর প্রেম, বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক চেতনা কবিকে মানুষের অনুভূতির কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।
সভাপতির বক্তব্যে সুমন রহমান বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঊনসত্তর ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি সময়। কবি হেলাল হাফিজ তাঁর কবিতায় সেই সময়টিকে ধারণ করেছেন। পাশাপাশি, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় উদ্ভূত দ্রোহ, সংগ্রাম, আশাবাদ, বিষাদ সব কিছুই তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন।
এদিকে মেলায় লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন- কবি রাসেল রায়হান, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন শফিক এবং শিশুসাহিত্যিক আশিক মুস্তাফা।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন- কবি হাসান হাফিজ এবং জাকির আবু জাফর। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী অনন্যা লাবণী এবং শিপন হোসেন মানব। সুমন মজুমদারের পরিচালনায় ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সঙ্গীতমঞ্জুরী শিল্পীগোষ্ঠী’-র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী রিজিয়া পারভীন, প্রিয়াংকা গোপ, ইসরাত জাহান, মিজান মাহমুদ রাজীব, মো. মাইদুল হক এবং নাফিজা ইবনাত কবির।
আগামীকাল সোমবার মেলার তৃতীয় দিনে বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘হায়দার আকবর খান রনো’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সোহরাব হাসান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতন এবং জলি তালুকদার। সভাপতিত্ব করবেন দীপা দত্ত।
বইমেলার সেই পোস্টার সরিয়ে নিল বাংলা একাডেমি
সমালোচনার মুখে অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে প্রদর্শিত একটি পোস্টার সরিয়ে নিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। তারা বলেছে, পোস্টারটি বাংলা একাডেমি তৈরি করেনি। অন্য একটি পক্ষের করা এই পোস্টার নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছে তারা।
‘৫২–এর চেতনা ২৪–এর প্রেরণা’ স্লোগান লেখা বইমেলা উপলক্ষে তৈরি করা এই পোস্টার টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পথে কয়েকটি জায়গায় লাগানো হয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে উপস্থাপন করতে এখানে যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তোলা ছবি। শনিবার বইমেলার উদ্বোধনের পর অনলাইনে এই পোস্টারের ছবির পাশে ১৯৭১ সালে শহীদ মিনারের সমাবেশের ছবি দিয়ে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তোলেন কেউ কেউ।
‘৫২–এর চেতনা ২৪–এর প্রেরণা’ লেখা পোস্টারটি তৈরি করা হয় একটি সাদা–কালো ছবি ব্যবহার করে। এই ছবিতে দেখা যায়, স্লোগানসংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে বসে আছেন তরুণী, নারীরা। তাঁদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘মা বোনেরা অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। সেখানে বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে বসে থাকা তরুণী বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী ফেরদৌস হক লিনু।
বইমেলার এই পোস্টার নিয়ে শনিবার রাতেই ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন কাজী ফেরদৌস হক লিনু। তাতে তিনি লেখেন, ‘সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এই ছবি ব্যবহারের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ১৯৭১–এর ছবি ৫২–এর ছবি বলে উল্লেখ করছে, ধিক্কার জানাই। ছবিতে লাঠি হাতে আমি। ১৫ মার্চ ১৯৭১–এর ছবি। তাদের ইতিহাস সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই। ৫২–তে স্বাধীনতার স্লোগান ছিল না। রাষ্ট্রভাষা মাতৃভাষা বাংলার স্লোগান ছিল।’
এরপর বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হয়।