প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দেশ টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ হাসানসহ সিকদার পরিবারের বিরুদ্ধে ৪টি মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দায়েরের অনুমোদন দিয়েছে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন।
তিনি বলেন, সিকদার পরিবার ও দেশ টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ হাসান পরস্পর যোগসাজশে চারটি প্রতিষ্ঠানের নামে এক হাজার ৪১৪ কোটি ৪৭ লাখ ৩৫ হাজার ৭৩৮ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
মো. আক্তার হোসেন জানান, সিকদার পরিবার ও দেশ টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ হাসান পূর্বপরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে দেশ টেলিভিশন লিমিটেডের কতিপয় কর্মচারীর নামে ভুয়া তথ্য দিয়ে ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামের একটি কাগুজে ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত করেন। এ কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জমিতে ১৬ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকের মহাখালী শাখায় ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের নামে ৪৯০ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। প্রকল্পের জমি কোম্পানির নিজস্ব জমি না হওয়া সত্ত্বেও নিজস্ব জমি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে একই ব্যাংকের শাখা থেকে হাসান টেলিকম লিমিটেডের নামে গৃহীত ঋণের মর্টগেজ করা সম্পত্তির তথ্য গোপন করে তা মর্টগেজ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। পরে ব্যাংকিং নীতিমালা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংকের নির্বাহী ও কিছু অসৎ কর্মকর্তার সহযোগিতায় অবৈধভাবে ৪৯০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর ও তা উত্তোলন করে ভিন্ন খাতে স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে ঋণের আসল ৪৯০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত অনাদায়ে সুদ ও অন্যান্য চার্জ বাবদ ১৭৮ কোটি ৮৯ লাখ ১১ হাজার ৪১২ টাকা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি সাধন করেন। এতে তারা দণ্ডবিধি, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এসব অপরাধে ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ মামলার আসামিরা হলেন- ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শরীফ উজ্জামান খান, চেয়ারম্যান মো. ইসমাইল, পরিচালক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, পরিচালক তওসিফ সাইফুল্লাহ্, দেশ টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হাসান টেলিকম লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্রডওয়ে রিয়েলে এস্টেটের শেয়ার হোল্ডার আরিফ হাসান, ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক ও ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ রইস উদ্দিন, ন্যাশনাল ব্যাংকের কোম্পানি সেক্রেটারি ও সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম বুলবুল, একই ব্যাংকের সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ ওয়াদুদ, ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোসতাক আহমেদ (সি এম আহমেদ), ন্যাশনাল ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ পরিচালক মনোয়ারা সিকদার, সাবেক পরিচালক পারভীন হক সিকদার, পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন, সাবেক পরিচালক খলিলুর রহমান, সাবেক পরিচালক মাবরুর হোসেন ও সাবেক সাব রেজিস্টার মো. রজব আলী।
অন্যদিকে আসামিরা পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে মরিয়ম কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের নামে অবৈধভাবে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করে। পরে সেই অর্থ উত্তোলনের মাধ্যমে সুদ-আসলসহ ৫৮৩ কোটি ১৩ লাখ ৩ হাজার ৮৪৮ টাকা আত্মসাৎ করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এজন্য ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ মামলার আসামিরা হলেন- মরিয়ম কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলম আহমেদ, পরিচালক বাবু হরিদাস বর্মন, ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি আরীফ মো. শহীদুল হক, ব্যাংকের সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক এ এস এম বুলবুল, এম এ ওয়াদুদ, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোসতাক আহমেদ (সিএম আহমেদ), সাবেক পরিচালক রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার, মোয়াজ্জেম হোসেন, সাবেক সতন্ত্র পরিচালক এ কে এম এনামুল হক শামীম, সাবেক পরিচালক আলহাজ্ব খলিলুর রহমান, সাবেক পরিচালক জাকারিয়া তাহের, এবং মাবরুর হোসেন।
তৃতীয় মামলাটি প্রকৃতি অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ন্যাশনাল ব্যাংকের মহাখালী শাখা থেকে ৮০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ দেখিয়ে ঋণের অর্থ স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তর করে আত্মসাৎ করেন। অনাদায়ে সুদসহ ২১ কোটি ২৪ লাখ ১৯৯ টাকা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি সাধন করায় ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মামলার আসামিরা হচ্ছেন- প্রকৃতি অ্যাসোসিয়েটস-এর প্রোপাইটর মো. শরীফ-উজ্জামান খান, দেশ টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ হাসান, ব্যাংকটির সাবেক ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ রইস উদ্দিন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোসতাক আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ ওয়াদুদ, সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এ এস এম বুলবুল, সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জহিরুল ইসলাম, সাবেক-ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ক্রেডিট কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবু রাশেদ নোয়াব, পরিচালনা পর্ষদের সাবেক পরিচালক মনোয়ারা সিকদার, সাবেক সংসদ সদস্য ও ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক পারভীন হক সিকদার, সাবেক পরিচালক খলিলুর রহমান, সাবেক পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন, রন হক শিকদার, এবং মো. মাবরুর হোসেন।
চতুর্থ মামলাটি দায়েরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ঋনের নামে ৬১ কোটি ২১ লাখ ২০ হাজার ২৭৯ টাকা আত্মসাতের জন্য। ভিউ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেডের নামে পূর্বপরিকল্পিত ও প্রতারণামূলকভাবে পটুয়াখালীর ন্যাশনাল ব্যাংকের কুয়াকাটা শাখা থেকে ৪০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করে সেটা উত্তোলন করা হয়। পরে সুদ ও আসলসহ মোট ৬১ কোটি ২১ লাখ ২০ হাজার ২৭৯ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ ঘটনায় ১১ জনকে আসামি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আসামিরা হলেন, ভিউ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাহিদ সারওয়ার, পরিচালক মোস্তফা মঈন সারওয়ার, ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার রুমি ইমরোজ রশিদ, উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ্ সৈয়দ আব্দুল বারী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোসতাক আহমেদ, সাবেক পরিচালক মনোয়ারা সিকদার, খলিলুর রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন, রিক হক সিকদার, মাবরুর হোসেন, এবং সাবেক সতন্ত্র পরিচালক নাঈমুজ্জামান ভূইয়া।