চলতি বছর প্রাণের মেলায় এত দর্শনাথীদের আনাগোনা এবারই প্রথম। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় এত উপচেপড়া ভিড় ছিল। মেলা শুরুর পর থেকে প্রতিদিনই পাঠক ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখর ছিল। তবে শুক্রবার এই ভিড়ের মাত্রা ছিল অত্যধিক। লোকে লোকারণ্য ছিল বইমেলার প্রতিটি প্রাঙ্গণ। তবে অন্যদিনের তুলনায় এদিন বিক্রি বাড়লেও অন্যান্য শুক্রবারের মতো বিক্রি হয়নি বলে অভিমত দিয়েছেন প্রকাশক তথা বিক্রেতারা।
আজ সন্ধ্যায় বইমেলায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রচুর লোকসমাগম। প্রবেশমুখে অনেক অবৈধ ভ্রাম্যমাণ দোকান বসায় বইমেলায় প্রবেশে বেগ পেতে হয় দর্শনার্থীদের। পরে পুলিশের সহায়তায় একাডেমি কর্তৃপক্ষ এসব দোকান তুলে দিলে কিছুটা সহজ হয় যাতায়াত।
মেলার সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গণে ঢুকে দেখা যায়, জনপ্রিয় স্টলগুলোর সামনে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়। কেউ বই দেখছেন আর কেউ ছবি তুলছেন। আবার অনেকেই জানতে চাচ্ছেন নতুন কোন বই এসেছে কি না।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক দর্শনার্থীদের ভিড় হয়েছে। তবে আশানুরূপ বিক্রি হয়নি। অনন্যা প্রকাশনীর প্রোডাকশন ম্যানেজার প্রীতম আদনানন বলেন, অনেক বেশি ভিড়। প্রথম ছয়দিনের তুলনায় শুক্রবার ভালোই বিক্রি হয়েছে। তবে শুক্রবার হিসেবে যেরকম হওয়ার কথা সেরকম হয়নি। প্রতিবছর শুক্রবারে অনেক ভালো বিক্রি হয়। আজকে সেরকম হচ্ছে না। এটা আমার জন্য অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এরকম সাধারণত হয় না।
অন্যপ্রকাশের বিক্রয় প্রতিনিধি ফরহাদ বলেন, বিক্রি ভালো হচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য শুক্রবারের তুলনায় কম হয়েছে আজকে। হয়ত রাজনৈতিক কোন কারণ।
আবার কিছু বিক্রেতা বলছেন ভিন্ন কথাও। ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি আল আমিন বলেন, হতাশ না। অনেক ভালো বিক্রি হচ্ছে।
আদর্শের বিক্রয় প্রতিনিধি মো. ফাইজুল্লাহ বলেন, বেচা বিক্রি ভালো হচ্ছে। এখন থেকে মেলা জমজমাট হচ্ছে। ফলে সামনের দিনগুলোতেও ভালো হবে আশা করা যায়।
ইকরি, হালুমদের ছাড়াই শিশুপ্রহর
শুক্রবার বইমেলায় ছিল প্রথম শিশু প্রহর। মেলার শিশুপ্রহরে অন্যান্য বছরের মতো সব আয়োজন থাকলেও দেখা মেলেনি সিসিমপুরের। এ নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন অনেক শিশু ও অভিভাবক।
শিশুপ্রহর উপলক্ষে মেলা শুরু হয় সকাল ১১টায়। দুপুর ১টা পর্যন্ত চলে শিশুপ্রহর। মেলায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতি বছর যেখানে সিসিমপুরের স্টেজ বানানো হতো সেই জায়গাটি এবার ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে বসেনি কোনও বইয়ের স্টলও। শুধু বই কিনেই ফিরে যেতে হয় শিশুদের।
রাজধানীর কমলাপুর থেকে আসা সাত বছরের শিশু সিতাংশা মজুমদার বলেন, আমি গতবছরও মায়ের সঙ্গে মেলায় এসেছিলাম। এবার বাবার সাথে এসেছি। কিন্তু এবার আমার প্রিয় ইকরি, হালুমকে পেলাম না। তাদের খুব মিস করছি। বাবাকে বলেছি তাদের এনে দিতে। বাবা বলেছে আরেকবার মেলায় আসলে ইকরি, হালুম থাকবে।
লাবিব ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, বইমেলায় অধীর আগ্রহে আমার সন্তান ইকরি ও হালুমদে দেখার জন্য আসছিল। কিন্তু এসে দেখি সিসিমপুর নেই। আমি আগে যদি জানতাম সিসিমপুর থাকবে না তাহলে এই জ্যাম ঠেলে আসতাম না। শুক্রবার বইমেলার ৭ম দিনে মেলা ১১টায় শুরু হয়ে চলে রাত নয়টা পর্যন্ত। এদিন নতুন বই এসেছে ১৮৪টি।
অমর একুশে উদ্যাপনের অংশ হিসেবে সকাল সাড়ে আটটায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তার। এতে ক-শাখায় ৩০৩, খ-শাখায় ৩২৫ এবং গ-শাখায় ১২২ জন সর্বমোট ৭৫০জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন।
সকাল দশটায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ক-শাখায় ১৪১ জন, খ-শাখায় ২০৭ জন এবং গ-শাখায় ৮৫ জন সর্বমোট ৪৩৩ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন। বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. তারিক মনজুর, অধ্যাপক শায়লা আহমেদ এবং বাচিকশিল্পী শফিকুর রহমান বাহার।
বিকেল চারটায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দর্পণে গোলাম মুরশিদ পাঠ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সামজীর আহমেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন স্বরোচিষ সরকার এবং গাজী মো. মাহবুব মুর্শিদ। সভাপতিত্ব করেন মোরশেদ শফিউল হাসান।
প্রাবন্ধিক বলেন, গোলাম মুরশিদের ইতিহাসভিত্তিক আলোচনা বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস-চর্চায় পথিকৃৎ সমতুল্য। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ইতিহাস প্রাতিষ্ঠানিকতা পেলে গোলাম মুরশিদ হবেন তার পুরোধা ব্যক্তি। বাংলাদেশে প্রথাগত ইতিহাস-চর্চায় তাঁর নাম যতটা উজ্জ্বল, এর চেয়ে সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তিনি দারুণ শক্তিমান। আলোচকদ্বয় বলেন, গোলাম মুরশিদের গবেষণা ও লেখালেখির জগৎ ছিল বিস্তৃত এবং বৈচিত্র্যময়। তিনি ছিলেন গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এবং প্রজ্ঞাময় একজন গবেষক।
সভাপতির বক্তব্যে মোরশেদ শফিউল হাসান বলেন, বৈচিত্র্যসন্ধানী, গভীরস্পর্শী ও পরিশ্রমী গবেষক গোলাম মুরশিদ বাংলাদেশের গবেষণা জগতে শ্রেষ্ঠ গবেষকদের একজন। বিদ্যাচর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি আমাদের ও ভবিষ্যৎ গবেষকদের জন্য বাতিঘর হয়ে থাকবেন।
জুলাইয়ের গল্প মঞ্চ: জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর শহীদ স্মরণে অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। সঞ্চালানায় ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক জুবায়ের ইবনে কামাল।
লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি ও কথাসাহিত্যিক ইকতিজা আহসান ও কবি মৃদুল মাহবুব। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি মোসা. ইসমত আরা এবং কবি মুহাম্মদ ইসমাইল। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আরিফুল হাসান এবং আফরোজা পারভীন।
আজকের পরিবর্তিত সময়সূচি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা জনিত কারণে আগামীকাল শনিবার সকাল ১১টার পরিবর্তে অমর একুশে বইমেলা শুরু হবে দুপুর দুইটায় এবং চলবে রাত নয়টা পর্যন্ত। মেলায় থাকবে না পূর্বঘোষিত শিশুপ্রহর।
এদিন চারটায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন আবদুস সেলিম এবং মোহাম্মদ হারুন রশিদ। সভাপতিত্ব করবেন খালিকুজ্জামান ইলিয়াস।
সকাল সাড়ে নয়টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার প্রাথমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।