এ যেন তারুণ্যের এক মিলনমেলা। তরুণদের পদচারণায় প্রাণের এই মেলা পেয়ে থাকে পূর্ণতা। কেননা বাংলা ভাষা তথা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় এ উৎসবে তরুণদের আধিপত্য না থাকলে নিঃসন্দেহে তার জৌলুস হারাত। বাংলা ভাষার দাবিতে যেমন তরুণরাই ছিলেন সর্বাগ্রে তেমনি বাংলা ভাষার সর্ববৃহৎ এই বই উৎসবে অংশগ্রহণের দিক থেকে তারাই এগিয়ে। তারুণ্যের মিলনে বইমেলা যেন পরিপূর্ণতা পেয়েছে। তাই তো মেলায় দলেবলে আসেন তরুণরা। দেখেন বই উল্টিয়ে পাল্টিয়ে। কিনেন নতুন বই। আর এতেই যেন চেতনাময় এ মেলা ক্রমেই স্বার্থক হয়ে উঠছে।
মেলাপ্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, সাহিত্যের এই মিলনমেলায় দর্শনার্থী কিংবা ক্রেতাদের দিক থেকে তরুণরাই এগিয়ে রয়েছে। প্রায় প্রতিটি স্টলেই তরুণ দর্শনার্থীদের ভিড়। এখানে এসে তারা প্রেরণা পায় বিশ্বকে জানার, বিশ্বকে জয় করার।
মেলায় লেখক ও প্রকাশকদের কাছেও গুরুত্ব পান তরুণ পাঠকরাই। এজন্য তাদের মেলার প্রাণই বলা যায়। তরুণদের চাহিদা পছন্দের কথা মাথায় রেখে বই লেখা থেকে প্রকাশ সবই হয় গুরুত্ব সহকারে। আবার মেলার অধিকাংশ লেখকই থাকেন তরুণ। ফলে তারা তরুণদের চাহিদা মতো লিখতেও প্রচেষ্টার ত্রুটি করেন না।
এদিকে সরকারি ছুটি থাকুক আর নাই থাকুক বইমেলায় তরুণ-তরুণীরা চলে আসেন। কেউ কেউ দল বেঁধে আবার কেউবা যুগলবন্দি হয়ে মেলায় ঘুরতে আসেন। কোথাও কোথাও তারুণদের কয়েকটি দল মেলার ভিতর হাটতে হাটতে সমস্বরে গানও ধরতে দেখা যায়। মেলায় তরুণ এসব দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে একুশের বইমেলা।
জানা গেছে, তরুণ পাঠকদের হাতে তাদের পছন্দনীয় বিষয়ের বই তুলে দিতে প্রকাশকরা চেষ্টা করেন। বইমেলায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে কিশোর উপন্যাস, থ্রিলার ও আত্মউন্নয়নমূলক বই। এগুলোর ক্রেতা মূলত কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা। বইমেলাতে তরুণ লেখক-প্রকাশকের স্বচ্ছন্দ উপস্থিতিও লক্ষণীয়। লেখালিখির পাশাপাশি প্রকাশক হিসেবেও তরুণদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। ক্রেতাদের একটা বড় অংশ কিশোর-কিশোরী হওয়ায় প্রকাশক-স্টল মালিকরা বিক্রয়কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেন তরুণ-তরুণীদের।
শনিবার সরকারি ছুটির কারণে বইমেলায় ছিল উপচেপড়া ভিড়। এদিন ভর্তি পরীক্ষা থাকায় বেলা ২টায় মেলার দুয়ার খোলার আগেই টিএসসি ও দোয়েল চত্বর মোড় থেকে জনস্রোত চলছিল গ্রন্থমেলা চত্বরে। প্রবেশদ্বারে এদিনও সারি ধরতে হলো দর্শনার্থীদের। তবে তাতে ভাটা পড়েনি উৎসাহে। শুক্রবারের তুলনায় শনিবারের মেলায় ভিড় অনেকটা কম হলেও সন্ধ্যার পর প্রাণবন্ত ছিল মেলামাঠ। এদিন বইমেলায় আসা তারুণ্যের উচ্ছ্বাসও ছিল বাঁধভাঙা।
প্রকাশকরা জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনের তুলনায় শনিবার বেচাকেনা কিছুটা কম। তবে মেলার উচ্ছ্বাস আর আনন্দে কোনও ঘাটতি ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদমান, আশিক ও রাফিয়া জানান, এবার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিনই তারা মেলায় এসেছেন। প্রতিটি দিনই তারা মেলায় আসবেন বলে জানিয়েছেন।
ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শ্রাবণী সেনরা মেলায় এসেছিলেন দলবেঁধে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণের রচনা সমগ্র কিনতে কিনতে শ্রাবণী বলেন, ‘ক্লাসের ফাঁকে মেলায় আসার ফুরসত পাই না। তারপর সেমিনার, অ্যাসাইনমেন্ট তো আছেই। আজ যা একটু বের হতে পেরেছি। আজ বন্ধুরা দলবেঁধে মেলায় চলে এলাম।’
শিরিন, বিথী আর শাকিল এসেছেন গাজীপুর থেকে। নতুন আসা বইগুলোর দিকেই তাদের ঝোঁক। তরুণদের দলটি খুঁজছিলেন তরুণদের কথাসাহিত্য, কবিতা ও অনুবাদ।
আসিফুর রহমান ও সাবার পছন্দ প্রেমের বই। আর মুবিনের পছন্দ গোয়েন্দা-থ্রিলার আর অনুবাদের বই। অন্যদিকে সামিয়ার ভালো লাগে হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাস।
কাগজের দাম বৃদ্ধির কারণে পাঠকদেরও বই কিনতে ভাবতে হচ্ছে দুবার। আর কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের হাতে টাকাপয়সা কম থাকার কারণে তাদের অবস্থা আরও সঙ্গীন।
তারুণ্যনির্ভর বই বেচাকেনা নিয়ে অন্যধারা প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী লুবনা জানান, তরুণদের জন্য যেসব বই বিক্রি হয় তার চেয়ে বেশি বই বিক্রি হয় যেসব বইয়ের নাম ভাইরাসহয় সেগুলো। সেগুলো আবার সেই তরুণরাই বেশি কেনে। যেমন গতবছর ‘পদ্মজা’ বইয়ের শেষ ভাগ ‘আমি পদ্মজা’ এবার বেশি বিক্রি হচ্ছে।
অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ছুটির দিন এলে মেলা যেন পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। আর সেখানে পূর্ণতা দেয় আমাদের নতুন প্রজন্মের তরুণরা। দেখতে দেখতে মেলার শুরুটা শেষের দিকে। এখন প্রকাশনীগুলো তাদের ভালো ভালো বইগুলো মেলায় নিয়ে আসবে। তারুণ্য নির্ভর বই যেমন থ্রিলার, প্রেম সাহিত্য এসব বই মেলায় বেশি আসে৷ কেননা দর্শনার্থীদের পাশাপাশি ক্রেতাদের একটা বিরাট অংশ থাকে তরুণরা।
শনিবার ১০২টি নতুন বই এসেছে। এদিন বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার প্রাথমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘একজন মোহাম্মদ হারুন—উর—রশিদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রফিক—উম—মুনীর চৌধুরী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আবদুস সেলিম এবং মোহাম্মদ হারুন রশিদ। সভাপতিত্ব করেন খালিকুজ্জামান ইলিয়াস।
লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন- কবি ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ এবং কবি জব্বার আল নাইম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন- কবি ফরিদ সাইদ এবং কবি প্রদীপ মিত্র। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী কামাল মিনা এবং ফারহানা পারভীন হক তৃণা। আজ ছিল আরিফুজ্জামান চয়নের পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘উদ্ভাস নৃত্যকলা একাডেমী’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ফারাহ দিবা খান লাবণ্য, সুষ্মিতা দেবনাথ সূচি, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী, গার্গি ঘোষ, শার্লি মার্থা রোজারিও এবং মো. রেজওয়ানুল হক।
আগামীকাল রোববার মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: মাকিদ হায়দার’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন চঞ্চল আশরাফ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন আসিফ হায়দার এবং সৈকত হাবিব। সভাপতিত্ব করবেন আতাহার খান।