দেশের বনভূমি সংলগ্ন ও পার্বত্য এলাকায় মানুষ ও হাতির সহাবস্থান উভয়েরই ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। হাতির পদদলনে যেমন কৃষিজমি নষ্ট ও প্রাণহানি হচ্ছে, তেমনই বন্যপ্রাণীটির উৎপাত ঠেকাতে মানুষের স্থাপিত বৈদ্যুতিক ফাঁদ ও গুলিতে মারা পড়ছে হাতি। এমন বাস্তবতায় মানুষ ও হাতির মধ্যে দূরত্ব তৈরির মাধ্যমে দ্বন্দ্ব কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
দুই পরিকল্পনা
হাতি ও মানুষের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে দুই পরিকল্পনা—বনভূমি পুনরুদ্ধার ও ইকো-ট্যুরিজমের বিকাশ—সামনে রেখে এগোচ্ছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এর মধ্য দিয়ে পরিবেশ ও জলবায়ু সংকট মোকাবিলা সহজতর এবং হাতিদের নিজস্ব আবাসে বিচরণ নিশ্চিত করতে চায় সরকার।
মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনের পাশাপাশি ইকো ট্যুরিজম দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তুরস্কের অভিজ্ঞতায় আস্থা
এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে, বিশেষ করে ইকো-ট্যুরিজম খাতে তুরস্কের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ।
রাজধানীর পান্থপথের পানি ভবনে ২৭ মে নিজ দপ্তরে এক বৈঠকে এ কথা জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত রামিস সেনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ওই বৈঠকে অংশ নেয়। ওই সময় মানুষ-হাতি দ্বন্দ্বপ্রবণ এলাকাগুলোতে বন পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন উপদেষ্টা রিজওয়ানা।
হাতি নিধন ও মানুষ হত্যা
চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই হাতি নিধন ও হাতির মাধ্যমে মানুষের প্রাণহানির একাধিক ঘটনা ঘটেছে।
গত ৫ জানুয়ারি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং রেঞ্জের হরিখোলা গহিন পাহাড়ের সংরক্ষিত বনে একটি হাতি মারা যায়। পরে ১৮ জানুয়ারি একই উপজেলার সংরক্ষিত বনে একটি বাচ্চা হাতির মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
পরের মাসে ১২ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের চকরিয়ায় বৈদ্যুতিক ফাঁদে পড়ে আরও একটি হাতি নিহত হয়। পাহাড়-সংলগ্ন তামাকখেত থেকে মৃত হাতিটি উদ্ধার করে বন বিভাগ। স্থানীয়রা জানান, তামাকখেত রক্ষা করতে পাতা বৈদ্যুতিক ফাঁদে পড়েই হাতিটি মারা যায়।
মার্চ মাসে ফের আসে হাতি মৃত্যুর খবর। সে সময় প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, অসুস্থতাজনিত কারণে সেটির মৃত্যু হয়েছে, তবে পরের দিন ময়নাতদন্তে জানা যায়, হাতিটিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
এর ঠিক এক সপ্তাহ আগে উখিয়ার জুমছড়ি সংরক্ষিত বনে একটি বন্যহাতি রক্তবমি করতে করতে মারা যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
তার দুই দিন পর ২০ মার্চ শেরপুরের নালিতাবাড়ীর গারো পাহাড়ে ঘটে আরও একটি বন্যহাতি মৃত্যুর ঘটনা। পাহাড়ের পূর্ব সমশ্চুড়া এলাকায় ধানখেতের পাশে স্থাপিত বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রাণ যায় হাতিটির।
এরপর এক মাস বিরতি দিয়ে গত সপ্তাহে মানুষ-হাতি দ্বন্দ্বের বিষয়টি আরও একবার খবরের শিরোনাম হয়। এবারও মৃত্যুর খবর, তবে হাতির নয়; মানুষের।
গারো পাহাড়ের গজনীতে বন্যহাতির আক্রমণে দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে দুজনের মৃত্যু হলে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের না হওয়ার এবং সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে বন বিভাগ।
এতসব ঘটনার পরও হাতি নিধন থেমে নেই। বন বিভাগ বারবার নিরুৎসাহিত করলেও এসব কর্মকাণ্ড ঘটেই চলেছে। আবার আত্মরক্ষার্থে অনেক সময় অবধারিতভাবেই মানুষ কিংবা হাতির প্রাণ যাচ্ছে
ইকো ট্যুরিজমে কি পদচারণার ঝুঁকি বাড়বে?
ইকো ট্যুরিজমের কারণে স্বভাবতই বনাঞ্চলে মানুষের পদচারণা বাড়বে। এতে করে হাতিসহ সব বন্যপ্রাণীর জন্য নিরাপদ আবাসস্থল গড়তে সরকারের যে পরিকল্পনা, তা ভেস্তে যাবে কি না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম মনিরুল এইচ খানের কাছে।
এ ধরনের আশঙ্কার অনেকটাই উড়িয়ে দিয়ে বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাসস্থল নিয়ে গবেষণা করা এ শিক্ষক বলেন, ‘ইকো ট্যুরিজম মানে তো পুরো পাহাড় বা বনাঞ্চলই মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া নয়। অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা বনের মোট অংশের কেবল ১০ থেকে ২০ শতাংশ ইকো-ট্যুরিজমের জন্য উন্মুক্ত করেছে। বাকি অংশে দর্শনার্থীরা ঢুকতেই পারেন না।’
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ইকো ট্যুরিজম খুব বেশি বড় সমস্যা হয়ে উঠবে না বলে মনে করেন এ প্রাণিবিদ, তবে বাংলাদেশে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সীমানা নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারের মনোযোগ রাখা উচিত বলে পরামর্শ দেন তিনি।
এ বিষয়ে মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত নিয়ে কাজ করা এ বিশেষজ্ঞ জানান, ইকো ট্যুরিজম বাস্তবায়নের সময় হাতির আবাসস্থলের নিরাপত্তার বিষয়টি সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ইকো ট্যুরিজমের জন্য সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি যদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে তা সম্ভব এবং স্থানীয় জনগণের জন্যেও তা কল্যাণ বয়ে আনবে।
তার ভাষ্য, ‘ইকো ট্যুরিজমের কারণে কিছু এলাকায় হয়তো (হাতি চলাচল) বিঘ্নিত হবে, কিন্তু এর ফলে স্থানীয় জনগণও তো আর্থিকভাবে লাভবান হয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি সেটিকে পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিভাবে করা যায়, তাহলে সব পক্ষই উপকৃত হবে।’
মানুষ-হাতির দ্বন্দ্বের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘মানুষ-হাতির এ দ্বন্দ্ব আসলে হয়ে থাকে ফসলের মৌসুমে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ধানের মৌসুমে। ধান খাওয়ার উদ্দেশ্যে হাতিরা খেতে হানা দেয়, অন্যদিকে নিজেদের কষ্টের ফসল বাঁচাতে মানুষও মরিয়া হয়ে যায়।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাতি মৃত্যুর ঘটনাগুলো বেড়ে যাওয়ার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে আগুন জ্বালিয়ে কিংবা বর্শা দিয়ে হাতিকে আক্রমণ করে তাড়ানোর চেষ্টা করতেন স্থানীয়রা। তবে কয়েক বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে হাতি মারার কৌশল। ফসলের খেতের পাশে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুতের তার দিয়ে ফাঁদ পেতে রাখা হয়, আর হাতিগুলো বিদ্যুতের সংস্পর্শে এসে মারা পড়ছে।’
হাতি মৃত্যুর হার কমাতে বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতার কৌশল দমনের বিকল্প নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বন বিভাগের উচিত, হাতি তাড়ানোর এসব বৈদ্যুতিক উপায় কঠোর হাতে দমন করা।’
প্রচলিত হাতি তাড়ানোর যেসব পদ্ধতি, সেগুলো হয়তো অবলম্বন করা যেতে পারে, কিন্তু বিদ্যুতায়িত করার কৌশল যেকোনো মূল্য থামাতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
টেকসই বন ব্যবস্থাপনায় জোর
বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষক মনিরুল এইচ খানের কথার সঙ্গে সুর মিলে যায় পরিবেশ উপদেষ্টারও। বনভূমি সংকোচন ও খাদ্য ঘাটতিকে এ ধরনের সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন উপদেষ্টা রিজওয়ানা। তাই টেকসই বন ব্যবস্থাপনায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাম্প্রতিক বৈঠকে পরিবেশ সংরক্ষণের পাশাপাশি টেকসই পর্যটন ও উন্নয়ন কার্যক্রমে তুরস্কের সহযোগিতা কামনা করেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘উপযুক্ত বৃক্ষপ্রজাতি রোপণ এবং প্রকৃতি-কেন্দ্রিক পর্যটন উন্নয়নে কারিগরি সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
এ সময় প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আগ্রহের প্রশংসা করেন রাষ্ট্রদূত সেন।
উপদেষ্টার অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি জানান, তুরস্কের সহযোগিতা ও সমন্বয় সংস্থা টিআইকেএ (টিকা) ঢাকায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন খাতে মধ্যম পরিসরের প্রকল্পে সহযোগিতায় প্রস্তুত রয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় টেকসই পর্যটন খাতে তুরস্কের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে প্রয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
রাষ্ট্রদূত জানান, টিকার ঢাকা অফিস ও উপদেষ্টার দপ্তরের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন এবং সম্ভাব্য প্রকল্প চিহ্নিত ও বাস্তবায়নে তিনি সহযোগিতা করবেন।
বৈঠকটি বন পুনরুদ্ধার ও ইকো-ট্যুরিজম খাতে কার্যকর ও দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প গ্রহণে উভয় পক্ষের আন্তরিক সহযোগিতার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
এ ছাড়াও সিলেটসহ দেশের কিছু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা অঞ্চলে এমন ইকো ট্যুরিজম সাইট গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে, যা পরিবেশের ওপর সর্বনিম্ন প্রভাব ফেলবে বলে জানান পরিবেশ উপদেষ্টা।
বৃক্ষরোপণের বিষয়টিতে আলোকপাত করে ড. খান বলেন, ‘পাহাড়ে বা বনভূমিতে সরকারের পক্ষ থেকে যদি বৃক্ষরোপণ করা হয়, তাহলে তা যেন স্থানীয় বা দেশি প্রজাতির গাছ হয়—সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। তা ছাড়া মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।’
এ প্রসঙ্গে হাতি রক্ষার বিষয়টি আরও একবার সামনে নিয়ে আসেন তিনি।
হাতি নিয়ন্ত্রণে টেকসই ব্যবস্থায় জোর
হাতি বাঁচাতে কেবল এ প্রাণীটির ওপর আক্রমণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেই হবে না জানিয়ে এই প্রাণিবিদ বলেন, হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থলে মানুষের কর্মচাঞ্চল্য বেড়েই চলেছে। আগে দেখা যেত, সমতলে ধানসহ অন্যান্য ফসলের চাষ হচ্ছে এবং হাতিরা পাহাড়ি বনাঞ্চলে নিরাপদে বিচরণ করতে পারছে; কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই।
স্থানীয়দের অনেকেই পাহাড়ের ওপরে পকেটের মতো জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে সবজি চাষ করছেন। আবার পাহাড়ের ঢালে কোথাও পানি জমলে সেখানে মাছ চাষ হয়। ফলে আবাস্থলের নিরাপত্তা হারিয়ে হাতির লোকালয়ে ঢোকার প্রবণতা বেড়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থলে কৃষিকাজ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে তা কার্যকর হবে বলে মনে করেন ড. খান।
তিনি বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে সরকারি জমি, অর্থাৎ বন বিভাগের জমির ভেতরে যেন কোনোপ্রকার কৃষিকাজ না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। জলাভূমি যাতে জলাভূমিই থাকে, অর্থাৎ সেখানে যাতে মাছ চাষ না হয় এবং পাহাড়ে যাতে প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় থাকে, তা নিশ্চিত করা জরুরি।’
তবে শুধু হাতির আবাসস্থল রক্ষার কথা ভাবলেই হবে না। হাতিতে নষ্ট করা ফসলের ক্ষতিপূরণ যথাসময়ে দেওয়াও জরুরি বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তার বক্তব্য, ‘ক্ষতিপূরণের বিষয়টি দ্রুততম সময়ে নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ মানুষের কল্যাণের বিষয়টিও একইসঙ্গে মাথায় রাখতে হবে।’