বাংলাদেশে বড় কৃষকের সংখ্যা মোট কৃষকের শতকরা ২ ভাগ। মাঝারি কৃষক ১৮ ভাগ। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা শতকরা ৮০ ভাগ। এই ৮০ ভাগ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকই কৃষির মূল চালিকা শক্তি। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) বলছে, এনজিও, আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক ও দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে কৃষক ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ গ্রহণ করে। এসব ঋণের সুদ ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ। আর সরকারের কৃষি ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে যে কৃষিঋণ দেয়, তার পরিমাণ মাত্র ৬ শতাংশ। এ থেকেই বোঝা যায় সিংহভাগ কৃষক সরকারি বিশেষায়িত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ফসল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিঋণ পান না।
আবার এটা ঠিক যে, অনেকে কৃষক না হয়েও কৃষিঋণ গ্রহণ করছেন। সেই ঋণ তারা ব্যবহার করছেন অন্য কোনো অলাভজনক খাতে। এরাই পরে যখন খেলাপিতে পরিণত হন তখন দায় পড়ে কৃষকের ওপর।
দেশের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সরকার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কৃষকের দরজায় ঋণ নিয়ে যাবে ব্যাংক; ব্যাংকের শাখায় চালু করতে হবে কৃষিঋণ বুথ এবং এনজিওর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কমাতে হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। চিনিকলে কৃষকদের মধ্যে উপকরণ ও নগদ টাকা হিসাবে যে ঋণ বিতরণ করা হয়, তা আখ উন্নয়ন কর্মীরা (সিডিএ) কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দেন। সিডিএরা শুধু ঋণই দেন না। কৃষকের আখ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি হাতে-কলমে শিখিয়ে দেন। আখ বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি পত্র (পুর্জি) প্রদানের ক্ষেত্রেও মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ফলে প্রতিটি চিনিকলেই এখন শতভাগ কৃষিঋণ আদায় হয়।
বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংক সরাসরি কৃষিঋণ বিতরণ করে না। বরং ঋণ বিতরণের জন্য বেসরকারি সংস্থাকে নিয়োগ করে। এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের সুদ ২৪ শতাংশ পর্যন্ত হয়। বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের কৃষিঋণের ৭০ শতাংশ বিতরণ করে এনজিওর মাধ্যমে। অন্যদিকে সরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করছে ৮ শতাংশ সুদে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বলা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব এনজিওগুলোর ঋণ বিতরণের হার ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। কারণ যখনই এনজিওগুলো ঋণ বিতরণ করে, তখনই সুদের হার বেড়ে যায়। এনজিওগুলোর সুদের হার কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবস্থা নিতে বলা হয় বৈঠকে। দেশের সব ব্যাংক শাখায় একটি কৃষিঋণ বুথ খুলতে বলা হয়, যাতে কৃষক বুঝতে পারেন কোথায় যেতে হবে ঋণের জন্য? সভায় অংশ নেয়া ব্যাংকগুলোকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কৃষিঋণ মেলার আয়োজন করতে বলা হয়েছে, যেখানে ব্যাংকার ও কৃষক অংশ নেবেন। কারণ কৃষকরা মাঠে ব্যস্ত থাকেন। ব্যাংকে যাওয়ার সময় তাদের নেই। তাই মেলায় অংশ নেয়া ব্যাংকগুলো কৃষকদের মাঝে তাৎক্ষণিক আবেদনপত্র বিতরণ ও গ্রহণ এবং ঋণ অনুমোদন করবে।
কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে মোট ঋণের ২.১০ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণ করতে হবে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ ফসল, ১০ শতাংশ মাছ চাষ, ১০ শতাংশ পশুসম্পদ এবং ২০ শতাংশ অন্যান্য কৃষি উপখাতে বিতরণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরে ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা গত অর্থবছরে ছিল ২৮ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছিল ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা।
কিছুদিন আগে ঋণের দায়ে কৃষকদের জেলে পুরে দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের মনে কৃষিঋণ নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন জেগেছে- যে কৃষক করোনার ভয়াবহ সময়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ফসল ফলিয়ে আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন, তারা সামান্য ঋণের দায়ে জেলে যাবেন কেন? কেন তাদের কোমরে রশি পরানো হবে? আর যারা তথাকথিত ব্যবসার নামে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে খেলাপি হয়ে বুক ফুলিয়ে বাংলার সবুজ প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়, তাদের নামে কেন মামলা হবে না- বিষয়টি মোটেও বোধগম্য নয়।
তবে এটাও পরিষ্কার যে, ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রে একজন লোক আদৌ কৃষক কি না বা কৃষিকাজ করার ক্ষেত্রে তার কোনো প্রশিক্ষণ আছে কি না, তা যাচাই না করেই ঋণ বিতরণ করে থাকে। তাই আমাদের কথা, কৃষি, মৎস্য ও পশুপালন খাতে ঋণের সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগকারীকে দিতে হবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর থাকতে হবে পূর্ব অভিজ্ঞতা। এ ছাড়া উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কৃষককে বাঁচানোর জন্য থাকতে হবে কৃষি বিমার ব্যবস্থা। এসব ছাড়া কৃষিঋণ বিতরণ একবারেই অর্থহীন।
লেখক: সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন
পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। বর্তমানে দেশে পাটচাষির সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার সংস্থান হচ্ছে পাট চাষে। পাটশিল্পে ও পাটপণ্য রপ্তানির কাজে জড়িত আছেন প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক। জিডিপিতে পাটের অবদান শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। কৃষি জিডিপিতে পাটের শরিকানা ১ দশমিক ৩ শতাংশ। মোট রপ্তানি আয়ের ৩ শতাংশ উপার্জন হয় পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি থেকে। তৈরি পোশাকশিল্পের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। পাট থেকে আহরিত মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে সরকারি সংস্থা বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণে থাকা পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল যে, তাতে পাটের চাহিদা হ্রাস পাবে এবং কাঁচা পাটের দাম কমে যাবে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষক। অন্যদিকে পাটপণ্য রপ্তানি কমে গিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় হ্রাস পাবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার বিপরীত। বিদেশে পাটের এবং পাটপণ্যের রপ্তানি ও আয় বেড়েছে। গত দুই বছর স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি মূল্যে কাঁচা পাট বিক্রি করছেন দেশের পাটচাষিরা। তাতে বেজায় খুশি ছিলেন দেশের কৃষক। অবশ্য গত বছর পাটের রপ্তানি আয় কমেছে। বৈশ্বিক মন্দা এর প্রধান কারণ। এবার পাটের দরও কম। ময়ালে ২ হাজার ৫০০ টাকা মণ দরেও অনেক সময় পাট বিক্রি করা যাচ্ছে না। পাটের সুদিন ফেরাতে হলে পাটপণ্যের বস্তুধাকরণ ও রপ্তানি বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন।
স্মরণাতীতকাল থেকেই বাংলাদেশে পাট চাষ হয়ে আসছে। এটি এক প্রকার দ্বিবীজপত্রী আঁশযুক্ত গাছ। এর ছাল থেকে আসে সোনালি আঁশ আর ভেতরে থাকে কাঠি। প্রাচীনকালে একে বলা হতো নালিতা। অনেকের মতে, উড়িয়া শব্দ ‘ঝুট’ বা সংস্কৃত ‘জট’ শব্দ থেকে ইংরেজি ‘জুট’ শব্দের উৎপত্তি। প্রধানত দুই প্রকার পাট বাণিজ্যে ব্যবহার হয়। এ দুটি হলো করকরাস ক্যাপসুলারিজ (সাদা) এবং করকরাস অলিটোরিয়াস (তোষা)। সাদা পাটের আদি নিবাস হলো চীন। তোষা পাটের আদি নিবাস হলো মিসর। এ দুই জাতের পাটই বাংলাদেশে আবাদ হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। সাদা পাট হয় নিচু জমিতে। এ পাট পানিসহিষ্ণু। এতে কার্টিংস বা গোড়ার অংশ বেশি। তোষা পাট জলাবদ্ধতা সইতে পারে না। তাই এর চাষ হয় উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে। এ পাটে কার্টিংস বা গোড়ার অংশ কম। একসময় এ দেশে উৎপাদিত অধিকাংশই ছিল সাদা পাট। এখন তোষা পাটের উৎপাদন বেশি। এ ছাড়া বাংলাদেশের সমস্যাবহুল মাটিতে কিছু নিম্নমানের পাট কেনাফ (চীন ও থাইল্যান্ড এর উৎপত্তিস্থল) এবং মেস্তা (ভারত এর উৎপত্তিস্থল) চাষ করা হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেন্ট্রাল জুট কমিটির হিসাবমতে, ১৯৫৮ সালে এ দেশে সাদা পাটের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল ৭৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং তোষা ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। বর্তমানে তোষা পাট প্রায় ৮৮ শতাংশ, সাদা পাট প্রায় ৫ শতাংশ এবং মেস্তা ও কেনাফ প্রায় ৭ শতাংশ জমিতে চাষ করা হয়। তোষা পাটের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ১০ দশমিক ৬৬ বেল, সাদা পাটের উৎপাদন ৭ দশমিক ৬৪ বেল এবং মেস্তা ও কেনাফের গড় উৎপাদন ৬ দশমিক ৯২ বেল। সারা দেশে হেক্টরপ্রতি পাটের গড় উৎপাদন ১০ দশমিক ২৫ বেল। উৎকৃষ্টতার দিক থেকে তোষা পাট বেশি মানসম্পন্ন। এর দৈর্ঘ্য, উজ্জ্বলতা, কোমলতা ও মসৃণতা বেশি। বাজারে এর দাম বেশি। দেশের বিভিন্ন জেলার মাটির ধরন, বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়ার পার্থক্যের কারণে পাটের মোট উৎপাদন, গুণাগুণ ও মানের তারতম্য ঘটে। পাট পচানোর ওপর নির্ভর করে এর রং ও ঔজ্জ্বল্য। পরিষ্কার ও ধীরে চলমান পানিতে পাট পচালে এবং ধুলে এর রং ভালো ও উজ্জ্বল হয়। ঘোলা পানিতে ও বদ্ধ পানিতে পচালে এবং ধুলে এর রং ময়লা হয়। বর্তমানে আমাদের কৃষকদের বড় সমস্যা পাট পচানো। বর্ষার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় এবং প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে অনেক সময় ঠিকভাবে পাট জাগ দিতে পারেন না কৃষকরা। পুকুর, ডোবা, খাল, বিল, দিঘি ও নালায় পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এ সমস্যা হয় কৃষকদের। বিকল্প হিসেবে রিবন রেটিং বা পাটের ছালকরণ ও পচানো পদ্ধতির শরণাপন্ন হন অনেক কৃষক। পাটবীজের অপ্রতুলতা এ দেশে পাট চাষের আরেকটি সমস্যা। দেশে উৎপাদিত বীজে চাষ হয় প্রায় ২০ শতাংশ জমি। বাকি জমির চাষ হয় আমদানীকৃত বীজ দিয়ে, যার গুণগত মান সম্পর্কে অনেক সময় কোনো নিশ্চয়তা থাকে না।
অতীতে পাটের চাষ হতো প্রায় ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। ক্রমেই তা নেমে আসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ হেক্টরে। এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ হেক্টরে। তা ছাড়া হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে। তাতে পাটের মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে বছরে কমবেশি ৮০ লাখ বেলে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাটের মোট উৎপাদন হয়েছে ৮৪ লাখ বেল। এ বছর পাটের উৎপাদন ভালো। নিয়মিত বৃষ্টিপাত হওয়ায় এবং বন্যার প্রাদুর্ভাব না থাকায় পাটের ফলন বেশি পেয়েছেন চাষিরা। পাট গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক সাফল্য আছে। এ নাগাদ সাদা পাটের ১২টি উচ্চফলনশীল জাত পাওয়া গিয়েছে। তোষা পাটের আটটি, কেনাফের চারটি ও মেস্তার তিনটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর সম্প্রসারণ চলছে মাঠপর্যায়ে। বর্তমানে পাটের গড় ফলন পৃথিবীর পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বেশি। অর্ধশতাব্দী ধরে এ দেশে পাটের ফলন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। এর পেছনে কৃষিবিজ্ঞানীদের এবং বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবদান অনস্বীকার্য। সম্প্রতি পাটের বংশগতিবিন্যাস (জেনম সিক্যুয়েন্স) উদ্ভাবন হয়েছে। তাতে রোগ ও পোকা প্রতিরোধক আরও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে এ দেশে কৃষি পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এখন আমাদের এমন পাটের জাত উদ্ভাবন করতে হবে, যা খরা, লবণাক্ততা ও শীতসহিষ্ণু। সারা বছর উৎপাদন উপযোগী পাটজাত উদ্ভাবন এখন সময়ের দাবি। ইতোমধ্যেই বছরে দুবার অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে পাট বোনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাতে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তবে গবেষণার মাঠে নতুন উদ্ভাবিত পাটজাতের ফলন যত বেশি, কৃষকের মাঠে তত বেশি নয়। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে উদ্ভাবিত পাটজাতগুলোর গড় ফলন সক্ষমতা ৩ দশমিক ৫ টন প্রতি হেক্টরে। কৃষকের মাঠে তার প্রকৃত ফলন প্রায় দুই টন। অর্থাৎ গবেষণা ও কৃষকের মাঠে প্রাপ্ত উৎপাদনে বড় ধরনের ফারাক বিদ্যমান। এটি কমাতে হবে। এর জন্য গবেষণা ও সম্প্রসারণের মধ্যে জোরালো সমন্বয় প্রয়োজন। পাট গবেষণা ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন।
বাংলাদেশে পাটের ব্যবহার নানাবিধ। প্রথমে এর ব্যবহার ছিল সবজি হিসেবে। তখন পাটপাতা ছিল দরিদ্রের খাদ্য। প্রাচীন গ্রিসদের কাছে পাট করকরাস নামে পরিচিত ছিল। এর অর্থ চক্ষুরোগ বিনাশক। তাতে বোঝা যায়, ঔষধিগুণের জন্যও পাটের আবাদ হতো। প্রাচীনকালে রচিত মহাভারতে পাটবস্ত্রের উল্লেখ থাকায় তখন থেকেই বয়নযোগ্য আঁশ হিসেবে পাটের ব্যবহারের সন্ধান পাওয়া যায়। মধ্যযুগের সাহিত্যেও পাটবস্ত্রের প্রচুর উল্লেখ আছে। গৃহস্থালির কাজেও পাট ও পাটকাঠির ব্যবহার জনপ্রিয় ছিল সুদূর অতীতকাল থেকেই। অর্থাৎ বাংলাদেশে পাটচাষ, পাটনীতি, পাটদ্রব্য উৎপাদন ও এর ব্যবহার এবং বাণিজ্যিক ইতিহাস সুপ্রাচীন। তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে অষ্টাদশ শতকে। এ দেশে ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইউরোপীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদের পাটের আঁশ ও পাটজাত দ্রব্য। ক্রমেই পাটের বহির্বাণিজ্য বিকাশ লাভ করে। বিশ্বে এখন পাটের মোট উৎপাদন প্রায় চার মিলিয়ন টন। গত ১২ বছরে বার্ষিক গড় উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। এখন ভারতের গড় উৎপাদন বছরে প্রায় দুই মিলিয়ন টন এবং বাংলাদেশের উৎপাদন দেড় মিলিয়ন টন। বাংলাদেশ ও ভারত মিলে বিশ্বের ৯৩ শতাংশ পাট উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে পাট উৎপাদন প্রায় ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। হেক্টরপ্রতি পাটের ফলনও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে এখনো বাংলাদেশের আধিপত্য বিরাজমান। বিশ্বের মোট পাট রপ্তানির ৭৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ। তা ছাড়া ভারত ৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং তাঞ্জানিয়া, বেলজিয়াম, কেনিয়া ও মালয়েশিয়া মিলে ১৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কাঁচা পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শরিকানা ৯৭ শতাংশ এবং পাটজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশি কাঁচা পাট প্রধানত রপ্তানি করা হয় ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইউরোপ, আইভরিকোস্ট, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে। পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি হয়। ইউরোপ, তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, জাপান, সুদান, ঘানা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৩৫টি দেশে। বর্তমানে পাটের বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে পৃথিবীর অনেক দেশে। তার কারণ পলিথিন ও সিনথেটিকের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী নিরুৎসাহিত করছেন পরিবেশবাদীরা। পলিথিন ও সিনথেটিক দ্রব্য পচনশীল নয়। পরিবেশের জন্য এগুলো মারাত্মক ক্ষতিকর। অন্যদিকে পাট পরিবেশবান্ধব। তাই এর চাহিদা বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারেও পাটের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে ১৯টি পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যাগ/থলে/বস্তা ব্যবহারের আইন প্রণয়ন করার কারণে। তবে এই আইনটি সব ক্ষেত্রে এখনো প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। উদাহরণস্বরূপ পোলট্রি এবং মৎস্য ফিডের মোড়কীকরণের কথা বলা চলে। সেখানে প্রায় ২০ কোটি পাটের ব্যাগ ব্যবহার করা যায়। যদি তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা ওঠানামা করে। দেশে পাটের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেলে আন্তর্জাতিক চাহিদা হ্রাসের ঝুঁকি সামলানো যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পাটের আরেকটি সমস্যা অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিওটি আরোপ। এর একটা বড় কারণ উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম মূল্যে পণ্য রপ্তানি। তাতে আমদানিকারক দেশে প্রতিযোগিতার পরিবেশ ক্ষুণ্ন হয়। এ কারণে ২০০৫ সালের পর ব্রাজিলে এবং ২০১৭ সালে ভারতে অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিওটির মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। তাতে সুতা, চট ও ব্যাগের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ১৯ থেকে ৩৫২ মার্কিন ডলার শুল্ক অতিক্রম করতে হয় পাটপণ্যের। এই শুল্ক বাধার আগে ভারতে প্রতিবছর পাটপণ্য রপ্তানি হতো ৩০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের। এখন তা ৫০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আগে বিজেএমসি উৎপাদন খরচের কম দামে পাটপণ্য রপ্তানি করত বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য। এখন বিজেএমসির মিলগুলো বন্ধ রয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন মিলগুলো পাটপণ্য রপ্তানি করে লাভজনক মূল্যে। সুতরাং অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিওটি আরোপ অযৌক্তিক।
করোনা মহামারির কারণে মানুষের আয় হ্রাস, সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়া এবং ভারত কর্তৃক অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ সত্ত্বেও বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানির পালে হাওয়া লাগে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে মোট আয় হয়েছিল ৮৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ১৬১ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তাতে অভ্যন্তরীণ বাজারে বৃদ্ধি পেয়েছে কাঁচা পাটের দাম। ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঁচা পাটের দাম ছিল প্রতি মণ ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা। ২০২০-২১ সালে তা বিক্রি হয় ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৪০০ টাকায়। তবে এবার কিছুটা কমে বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ প্রায় ২ হাজার ৫০০ টাকায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাটপণ্য রপ্তানির আয়ও কমে গেছে ২০২১-২২ সালের ১ হাজার ১২৮ মিলিয়ন ডলার থেকে ৯১২ মিলিয়ন ডলারে। দেশের পাটচাষিদের জন্য তা শঙ্কার কারণ।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মোট ৭৯টি পাটকল নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। তখন পাকিস্তানিরা চলে গেলে পাটকলগুলো রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। পাট ব্যবসা, পাট রপ্তানির সব দায়িত্ব নেয় সরকার। দেশের অভ্যন্তরে পাট কেনা ও পাটপণ্য উৎপাদনের একচেটিয়া দায়িত্ব নেয় বিজেএমসি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৪৮ বছরে সংস্থাটি লাভ করেছে চারবার। লোকসান গুনেছে ৪৪ বার। এ সময় বিজেএমসিকে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা এর অধীনস্ত মিলগুলোর লোকসান মেটানোর জন্য। ১৯৭৫-পরবর্তী সরকার বিজেএমসির পাটকলগুলো বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু করে। বেসরকারি খাতকে পাট ব্যবসা ও পাট রপ্তানির অনুমতি দেয়া হয়। ২০০২ সালে ক্রমাগত লোকসানের মুখে বন্ধ করে দেয়া হয় আদমজী, নিশাত ও দৌলতপুর জুট মিল। ২০২০ সালের ১ জুলাই ধারাবাহিকভাবে লোকসানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকলও বন্ধ করে দেয়া হয়। এ পাটকলগুলো ক্রমাগতভাবে লোকসান গোনার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বিজেএমসির পরিচালনায় পেশাদারত্ব ও দক্ষতার অভাব, প্রয়োজনীয় তদারকির অভাব, স্থায়ী শ্রমিকের আধিক্য, পাট কেনায় দুর্নীতি সংস্কারবিহীন সেকেলে যন্ত্রপাতি, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় চাহিদা মোতাবেক পণ্য উৎপাদনে অক্ষমতা ও বৈচিত্র্যহীনতা, সিবিএর দৌরাত্ম্য এবং সরকারি আমলাদের মাধ্যমে মিলগুলো পরিচালনা করা। জানা যায়, শ্রমিক আন্দোলন থামাতে বিজেএমসিকে বছরে ব্যয় করতে হয়েছে ৬৬ কোটি টাকা। এ কারণগুলো মিলে সরকারি পাটকলগুলো নতুন ব্যবস্থাপনায় রূপান্তরের লক্ষ্যে। সাময়িক বন্ধ করে দেয়া ছিল যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। তবে এখন বন্ধ থাকা পাটকলগুলো অতি দ্রুত আধুনিকীকরণ এবং দীর্ঘমেয়াদে লিজ প্রদানের মাধ্যমে উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ; পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেছেন, মার্কিন ভিসানীতি নতুন কোন বিষয় নয়। এটি এ বছরের ২৫শে মে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল। এই ভিসানীতি তারা প্রয়োগ শুরু করেছে। এই ভিসানীতি বিরোধী দলের ওপরও প্রযোজ্য। শুধু তাই নয়, এই নীতির ফলে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়ছে বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী। কারণ এই ভিসানীতির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নির্বাচনকে যারা বাধাগ্রস্ত করবে তাদের ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাধাগ্রস্থ করছে না, নির্বাচনও প্রতিহত করছে না। তাই এই নীতি প্রয়োগের ফলে আওয়ামী লীগের কোনো অসুবিধা নেই। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। বাংলাদেশের এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং এর স্থিতিশীলতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অবদান। এদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তার মাধ্যমেই পুনরুদ্ধার হয়েছে। তিনি এদেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। শেখ হাসিনা একটি টেকসই সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার করেছেন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি মোট ৮২টি সংস্কার করেছেন। এদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কারও গণতন্ত্রের জন্য মায়া কান্না মানায় না।
সেলিম মাহমুদ বলেন, মার্কিন ভিসানীতির প্রয়োগের ফলে কয়েকটি কারণে বিএনপির রাজনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির কারণে আওয়ামী লীগের কোন অসুবিধা হবে না। ভিসা নীতি ঘোষণার পর যে চারটি কারণে বিএনপির রাজনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সেই কারণগুলো হচ্ছে:
এক. এতোদিন বিএনপি বলে আসছিল, তারা কোনো অবস্থাতেই শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। প্রয়োজনে যে কোনো মূল্যে নির্বাচন প্রতিরোধ করবে তারা। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন নতুন নীতি অনুযায়ী নির্বাচন প্রতিরোধ করা সবচেয়ে বড় অপরাধ। তাই শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন প্রতিহত করার বিএনপির সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়েছে। নির্বাচন প্রতিহত করার লক্ষ্যে বিএনপির যেকোনো সন্ত্রাস ও নাশকতা মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়বে।
দুই. বিএনপি'র বিগত কয়েক বছরের রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। তারা বলে আসছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া শেখ হাসিনার অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন নীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিএনপির আন্দোলনের প্রতি সহায়ক কিংবা সহানুভূতিশীল কোনো বক্তব্য নেই। এই নীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কোনো স্বীকৃতি নেই। মার্কিন এই নীতির ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিএনপি'র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি ভেস্তে গেল। অথচ বিএনপি এতো বছর দেশের রাজনীতির মাঠ ছেড়ে শুধু বিদেশিদের ওপরই নির্ভর করেছিল।
তিন. বিএনপি প্রায় দুই বছর ধরে বলে আসছিল, নির্বাচনের আগে এমন একটি বিদেশি স্যাংশন আসবে যার ফলে আওয়ামী লীগ সরকার লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। এর ফলে বিএনপি তাদের সুবিধা জনক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসবে। নির্বাচন চলে আসলো। কোনো স্যাংশন আসলো না। বরং যে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আসলো, সেটি তাদের নির্বাচন প্রতিহত করার ষড়যন্ত্র অনেকটা নস্যাৎ করে দিল।
চার. বিএনপি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বলে আসছিল, বিএনপি নির্বাচনে না আসলে সে নির্বাচন আন্তর্জাতিক মহলে অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার কারণে গ্রহণযোগ্য হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতির ফলে বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের নীতিতে একটি বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপি স্বেচ্ছায় নির্বাচনে না আসলে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না- এই ধরনের কোনো বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতিতে নেই। তারা নিজে থেকে নির্বাচন বর্জন করলে এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না- এই বক্তব্য সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতির ফলে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন তারা পাবে না - এটি পরিষ্কার।
মোটা দাগে বলতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতির কারণে বিএনপি'র নির্বাচন ভণ্ডুল করার ষড়যন্ত্র ভেস্তে গেল। পাশাপাশি শেখ হাসিনার অধীনে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যাবে- এরকম অপপ্রচার যারা করছিল, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতির কারণে তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়েছে।
সাধারণত জোরপূর্বক শ্রম, যৌন দাসত্ব অথবা পাচারকৃত মানুষদের ব্যবসায়িক যৌনশোষণমূলক কাজে নিয়োজিত করার জন্য সংঘটিত অবৈধ মানব বাণিজ্যকে মানব পাচার বলে। মানব পাচার একটি দেশের অভ্যন্তরে বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে সংঘটিত হতে পারে। তবে মানব পাচার যেখানে এবং যেভাবেই সংঘটিত হোক না কেন, তা বড় ধরনের অপরাধ। মানব পাচার আইন-২০১২ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির অধিকার হরণ করে জবরদস্তিমূলক শ্রম আদায়, দাসত্বমূলক আচরণ, পতিতাবৃত্তি বা যৌন শোষণ বা নিপীড়নের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে শোষণ বা নিপীড়ন করা হলে তা মানব পাচার হিসেবে গণ্য হবে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী, মানব পাচার হচ্ছে মানুষের অধিকারের লঙ্ঘন। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে, যা দুঃখজনক। অভাবের তাড়নায় কিংবা অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে অথবা উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশ থেকে নারী-পুরুষ মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় প্রতিনিয়ত পাচারের শিকার হচ্ছেন। উন্নত জীবন আর ভালো চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পাচার করার পর শেষ পর্যন্ত তাদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। অর্থলোভী, অসৎ ব্যক্তি এবং দালালদের খপ্পরে পড়ে এভাবেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে অনেক মানুষের জীবন। সম্প্রতি ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গায় অভিযান চালিয়ে মানব পাচার চক্রের প্রধানসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। সেই সঙ্গে উদ্ধার করা হয় পাচার হতে যাওয়া ২৩ নারীকে। বিদেশে চাকরিসহ নানা প্রলোভনে তাদের পাচার করা হচ্ছিল। গত বছরের ২৭ মে লিবিয়ায় ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশের নাগরিক এবং তাদের অধিকাংশই ছিল মানব পাচারের শিকার। ২০১৫ সালের ১ মে থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্যে পাওয়া গিয়েছিল গণকবর। তারপর মালয়েশিয়াতেও পাওয়া যায় গণকবর। আর ওই সব গণকবরে পাওয়া যায় অনেক বাংলাদেশির মরদেহ, যারা অধিকাংশই মানব পাচারের শিকার। ওই বছর ওই দুটি দেশ আর ইন্দোনেশিয়া থেকে মানব পাচারকারীদের নির্যাতনের শিকার ১৭৫ জনকে দেশে ফিরে আনা হয়। এর পরও থেমে নেই মানব পাচার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানব পাচারকারীরা ইউরোপে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দেশের মানুষকে লিবিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে। শীত মৌসুমে সাগর শান্ত থাকায় এ সময় মানব পাচারকারীদের অপতৎপরতা বেড়ে যায়। বর্তমানে মানব পাচারকারীদের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মিয়ানমার থেকে নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। পাচারকারীরা রোহিঙ্গা পুরুষদের চাকরি ও মেয়েদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে পাচারের চেষ্টা করে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলা থেকেই পাচার হয়েছে এক লাখের বেশি লোক। পরবর্তী সময়ে মেয়েদের বিক্রি করে দেয়া হয় যৌনপল্লিতে, আর শিশুদের নিযুক্ত করা হয়েছে অবৈধ ও জবরদস্তি শ্রমে। এমনও দেখা গেছে, ইউরোপে যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে নির্যাতনের কারণে এবং খাদ্যের অভাবে সাগরেই মর্মান্তিকভাবে মারা গেছে। আর এভাবেই উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন ভেসে যায় সাগরে, কখনোবা সেই স্বপ্নের কবর রচিত হয় গহিন বনে অথবা গণকবরে কিংবা পতিতাপল্লিতে।
বাস্তবতা হচ্ছে, মানব পাচারসংক্রান্ত ঘটনায় অনেক মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত এসব মামলার তদন্ত এবং বিচার এগোয় না। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১২ সালে দেশে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মানব পাচারসংক্রান্ত প্রায় ছয় হাজার মামলা করা হয়। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয় ৯ হাজার ৬৯২ জন। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এসব মামলায় সাজা হয় মাত্র ৫৪ জনের। আর মানব পাচারসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির হার খুব-ই কম। মূলত পাচারের শিকার অধিকাংশ পরিবারগুলো সমস্যা আর ভোগান্তির মধ্য দিয়ে দিন যাপন করে। মানব পাচারকারী ও দালালরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিনেমার ‘দাদাভাই’-এর মতো পর্দার অন্তরালে থাকে। ফলে মানব পাচার বন্ধ হয় না। অনেক সময় মানব পাচারসংক্রান্ত মামলার তদন্তে ঘাটতি থাকায় আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। বলাবাহুল্য, আইনের প্রকৃত শাসন থাকলে এত মানুষ পাচারের শিকার হতো না। এটা বন্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার প্রয়োজন। বর্তমানে মানব পাচারের সবচেয়ে বড় রুট হচ্ছে কক্সবাজার। এখানে মানব পাচারের মামলা হয়েছে ৬৩৭টি। কিন্তু নিষ্পত্তি হয়েছে দু-একটি। অর্ধেক মামলা তদন্তাধীন রয়েছে আর খারিজ হয়ে গেছে ১৬টি মামলা। ইতিপূর্বে দেশে মানব পাচারবিষয়ক কোনো সুনির্দিষ্ট আইন ছিল না। তখন দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মানব পাচারসংক্রান্ত অপরাধের বিচার করা হতো। সর্বশেষ ২০১২ সালে ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’ নামক আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৬ ধারায় মানব পাচার নিষিদ্ধ করে এর জন্য অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। আইনটির ৭ ধারায় সংঘবদ্ধ মানব পাচার অপরাধের দণ্ড মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কমপক্ষে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এ আইনের অধীনে কৃত অপরাধগুলো আমলযোগ্য এবং তা আপস ও জামিনের অযোগ্য অপরাধ।
মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর গত ৯ বছরে এ-সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ৫ হাজার ৭১৬টি। এ পর্যন্ত মাত্র ২৪৭টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাৎ মামলা নিষ্পত্তির হার মাত্র ৪ শতাংশ। অনেক বিচার এখনো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেই হচ্ছে। মানব পাচারসংক্রান্ত মামলা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকার পেছনে এটিও একটি কারণ। আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, মানব পাচার মামলায় আদালতে পুলিশ কর্তৃক সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হওয়া। মানব পাচার মামলায় সাধারণত নিয়মিতভাবে সাক্ষী পাওয়া যায় না। ভুক্তভোগীরা সহায়তা না করলে শেষ পর্যন্ত মামলা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে সবচেয়ে বড় কথা, মানব পাচার রোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ ঘটানো হলে, সরকারিভাবে দেশে বিভিন্ন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে এবং জনগণ কর্তৃক দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার মানসিকতা পরিহার করলে মানব পাচারের সংখ্যা নিঃসন্দেহে কমে আসবে। যেহেতু দেশে মানব পাচারের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে, তাই মানব পাচার রোধে এখন আইনের কঠোর প্রয়োগের বিকল্প নেই। পাশাপাশি মানব পাচার রোধে গণমাধ্যমসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অধিকতর তৎপর হতে হবে। অন্যথায় মানব পাচার বন্ধ হবে না এবং মানব পাচারকারীরাও শাস্তি পাবে না।
লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; ভিজিটিং প্রফেসর, চণ্ডীগড় ইউনিভার্সিটি (ভারত) এবং লাইসিয়াম অব দ্য ফিলিপিন্স ইউনিভার্সিটি, ফিলিপাইন
সারাবিশ্বে অসংক্রামক ব্যাধি নীরব ঘাতকের মতো ধেয়ে আসছে এবং আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অসংক্রামক ব্যাধি এখন মানব জাতির বেঁচে থাকার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে কলেরা, ডায়রিয়া, বসন্ত, যক্ষ্মা, হামের মতো বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি সহজেই চিকিৎসায় নিরাময় হচ্ছে এবং প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপদ পানি, খাদ্য সরবরাহ, রোগ নির্ণয়ে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা পদ্ধতি, কার্যকরী টিকা কর্মসূচি, সর্বোপরি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংক্রামক ব্যাধি কমছে এবং মানুষের গড় আয়ুও বাড়ছে।
অসংক্রামক ব্যাধি কোনো জীবাণুর মাধ্যমে হয় না এবং একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায় না, অর্থাৎ ছোঁয়াচে না। প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে ছড়ায় না। অসংক্রামক ব্যাধি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন বয়সজনিত কারণে বার্ধক্যজনিত রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, অস্টিওপরোসিস, অস্টিওআর্থাইসিস, উচ্চরক্তচাপ, ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের প্রদাহ এবং মানসিক রোগ। এ ধরনের রোগের প্রকোপ মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, হয়ে উঠছে বড় ঘাতক। ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মানুষের পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনীতির ওপর প্রভাব ও চাপ পড়তে শুরু হয়েছে। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্মেলনে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, যেভাবে অসংক্রামক ব্যাধি বেড়ে চলছে তাতে অর্থনীতির ওপর বিরাট প্রভাব পড়ছে। এর মূল কারণ এ ধরনের রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। গরিব বা নিম্নবিত্ত, এমনকি অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষেও এ রোগের চিকিৎসার ব্যয় বহন করা অসম্ভব। এর আরেকটি অন্যতম কারণ হলো এ ধরনের রোগে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চালাতে হয়।
এ ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে তাদের পূর্ব পুরুষের রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে। পারিবারিক বা জিনগত (জেনেটিক) ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে যোগ হয় পরিবেশগত উপাদান, যেমন পরিবেশ দূষণ, অস্বাস্থ্যকর ও বাজে খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রমের অভাব, ধূমপান, মানসিক চাপ ইত্যাদি। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান সময়ে অনেক কম বয়সেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, সারা পৃথিবীজুড়ে অনেকেই কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে এবং চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। সময়মতো সচেতন হলে বংশ পরম্পরায় থাকা এসব রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সংক্রামক ব্যাধির চেয়ে অসংক্রামক ব্যাধির ব্যাপকতা অনেক বেড়ে গেছে এবং বর্তমানে বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৬৫ ভাগের জন্য দায়ী। পূর্বে ধারণা করা হতো, অসংক্রামক ব্যাধি শুধু ধনী দেশে বসবাসকারীদের এবং বয়স্ক লোকের হয়। প্রকৃতপক্ষে এ রোগে আক্রান্তদের অর্ধেকই কম বয়সী এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এ ধরনের ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ দেশে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ৬৫ ভাগ অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত। হাসপাতালে ভর্তির রোগীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে অসংক্রামক ব্যাধি। মৃত্যুর প্রধান দশটি কারণের মধ্যে অধিকাংশই এসব ব্যাধির জন্য দায়ী, যেমন- কিডনি, ফুসফুস ও লিভার প্রদাহ, হৃদরোগ, ক্যানসার, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, সি.ও.পি.ডি বা শ্বাসকষ্টজনিত রোগ ইত্যাদি।
অসংক্রামক ব্যাধির কারণ
মানুষের জীবনযাত্রার মান, সামাজিক অস্থিরতা, খাদ্যাভ্যাস, যান্ত্রিক জীবন সবকিছু মিলিয়েই অসংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির জন্য দায়ী। আর্থিক অসচ্ছলতা, অশিক্ষা এবং চিকিৎসার অপ্রতুলতা এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলছে।
আরও কিছু কারণ যেমন:
* কায়িক শ্রম ও হাঁটাচলা বা ব্যায়াম না করা। ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে।
* অলস জীবনযাপন করা, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া। অধিক ওজন সম্পন্ন লোকদের উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ কোলেস্টোরেলও বেড়ে যেতে পারে।
* খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, শাক-সবজি, ফল-মূল কম খাওয়া, অধিক ক্যালরিসমৃদ্ধ ও অধিক চর্বি-শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস, ফাস্টফুডে আসক্তি, চিনি ও মিষ্টি জাতীয় এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমলপানীয় গ্রহণ।
* ধূমপান, তামাকপাতা, জর্দা, গুল লাগানো, মাদক সেবন।
* অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, এর ফলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে।
* খাদ্যে কেমিক্যাল ও ভেজাল।
* খেলার মাঠের অভাব, বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা বা খেলাধুলার সংস্কৃতির বিলোপ।
* মোবাইল, ইউটিউব, টিকটক, ইন্টারনেট, টেলিভিশন, কম্পিউটার গেম ও ফেসবুকের অপব্যবহার। এগুলো ব্যবহারে বাচ্চাসহ যেকোনো বয়সের মানুষের অলস জীবন-যাপনের প্রবণতা বাড়ছে।
* গাড়ি-লিফট-চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহারের প্রবণতা।
* বায়ুদূষণ। ফলে শ্বাসজনিত রোগ, যেমন হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইছিমা বা সিওপিডি, এমনকি জন্মগত ত্রুটি, ক্যান্সার ও হৃদরোগ বেড়ে যাচ্ছে।
* অতিরিক্ত টেনশন, মানসিক চাপ, অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভয়ভীতি, এসবগুলো রক্তচাপ বাড়াতে পারে।
* মানুষের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। শারীরিকভাবে অসুস্থতাবোধ না করলে কেউ চিকিৎসকের কাছে যায় না এবং নিয়মিত চেকআপ করায় না। এ কারণেই অসংক্রামক ব্যাধি মানুষের ওপর ভর করছে।
কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে
এসব ব্যাধির চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল এবং অনিরাময়যোগ্য হয়ে থাকে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিকার-প্রতিরোধ করার বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
* আমাদের সামাজিক জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কম চর্বি ও কম কোলেস্টোরেলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম, চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন শরবত, গ্লুকোজ, পায়েস ইত্যাদি পরিহার বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
* লবণ নিয়ন্ত্রণ: তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।
* কায়িক শ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত হাঁটাচলা, হাটে বাজারে কোথাও গেলে অল্প দূরত্বে রিকশা বা গাড়ি ব্যবহার না করা, অল্প কয়েক তলার জন্য লিফট ব্যবহার না করা। সম্ভব হলে সাঁতার বা জগিং করা, ব্যয়ামাগারে গিয়ে ব্যায়াম করা।
* অতিরিক্ত মোবাইল, ইউটিউব, ফেসবুক, টেলিভিশন আর কম্পিউটার ব্যবহারের প্রবণতা কমাতে হবে।
* যারা বয়স্ক বা অবসরপ্রাপ্ত তারাও নিয়মিত হাঁটাচলা করতে পারেন। এর সঙ্গে বাগান করা এবং পরিচর্যা করতে পারেন।
* নগরবাসীর জন্য ব্যায়াম ও হাঁটার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা।
* বাড়তি ওজন কমাতে হবে। এর জন্য খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করতে হবে।
* ধূমপান, মদ্যপান, মাদকদ্রব্য, তামাকপাতা ও জর্দা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
* বায়ুদূষণের কারণগুলো চিহ্নিত করে এগুলো প্রতিরোধে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে। সবুজায়ন বৃদ্ধির জন্য প্রচুর গাছপালা লাগাতে হবে।
* মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে। নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, নিজের শখের কাজ করা, নিজ ধর্মের চর্চা করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি বেশি হবে।
* শিক্ষা ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা, পাঠ্যপুস্তকে এ সম্পর্কে অন্তর্ভুক্তি করা, মিডিয়ার ব্যবহার, শিক্ষক, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং সামাজিক নেতাদের প্রশিক্ষণ, সমাজকর্মীদের সচেতন করে তোলা, সচেতনতা ক্যাম্প ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
* নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া, নিয়মিত ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি পরীক্ষা করা জরুরি। এমনকি বয়স ৪০ পার হলে প্রতি বছর মেডিকেল চেকআপ করা উচিত।
আমাদের স্বাস্থ্য খাতে সফলতা আছে, সীমাবদ্ধতাও আছে। অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে আমাদের সঠিক পরিকল্পনা করে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ এসব ব্যাধি আজ মারাত্মক জনস্বাস্থ্যের সমস্যা, যেগুলো কখনো নির্মূল করা যাবে না। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। রোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের ব্যাপারে বেশি যত্নবান হতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যেহেতু একবার আক্রান্ত হলে এ ধরনের ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না, তাই সচেতনতা ছাড়া প্রতিরোধের বিকল্প নেই।
উপসংহার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার এবং অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রামক রোগ-ব্যাধি সম্বন্ধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। পাশাপাশি এ সমস্ত রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি সাধনে আমরা ইতোমধ্যে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেছি এবং এ ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে এখন হার্টের সার্জারিসহ উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। মানসম্পন্ন নিউরোসার্জিক্যাল চিকিৎসা এবং সার্জারিও বাংলাদেশে এখন পাওয়া যাচ্ছে। অচিরেই বিভিন্ন সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় এ দেশে উল্লেখযোগ্য আরো উন্নতি হবে বলে আমি আশা করি।
লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক
প্রধানমন্ত্রীর দশটি অসাধারণ উদ্যোগের অন্যতম একটি কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। সমগ্র বিশ্বের স্বাস্থ্যসেবার জন্য এটি যে একটি অনন্য সাধারণ মডেল ও উদ্যোগ তা জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। ‘কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অর্জনের লক্ষ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি’ শিরোনামে জাতিসংঘে উত্থাপিত ঐতিহাসিক রেজ্যুলেশনটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক মডেল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ কর্তৃক প্রস্তাবিত রেজ্যুলেশনটিতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল উদ্ভাবনী উদ্যোগের ব্যাপক স্বীকৃতি দিয়ে এই উদ্যোগকে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে উল্লেখ করে। ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’কে আরও একবার সম্মানে ভূষিত করল যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়ারেন অ্যালপার্ট মেডিকেল স্কুল। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্যবিষয়ক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ওয়ারেন অ্যালপার্ট মেডিকেল স্কুল অব ব্রাউন ইউনিভার্সিটির মেডিসিন অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের ডিন মুকেশ কে জৈন দ্য লোটে এই উদ্যোগকে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, এটি কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার একটি সফল মডেল। এটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, কমিউনিটি সম্পৃক্ততা উন্নয়নের মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিধির জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি।
প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশজুড়ে স্থাপিত হয়েছে চৌদ্দ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক, যা গ্রামীণ সমাজের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এনেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। বাংলাদেশের সব মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে এই অনন্য কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যা সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের দোরগোড়ায় সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সুফল সরবরাহে বিপ্লব ঘটিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই বিপ্লব প্রচেষ্টায় অনুপ্রেরণা হিসেবে ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথ। প্রধানমন্ত্রী যে জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়নের জন্য বদ্ধপরিকর তা আরও একবার প্রমাণ করলেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই প্রতিটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে বঙ্গবন্ধু সরকার। তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে বিকেন্দ্রীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মাধ্যমে ধাপে ধাপে তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠনের পর কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প গ্রহণ করেন। গ্রামীণ প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে ক্লিনিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। প্রাথমিকভাবে সাড়ে ১৩ হাজার ক্লিনিক নির্মাণের কথা ভাবা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের পর থেকে এই উদ্যোগ দ্রুত অগ্রসরমান হতে থাকে। ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন।
তবে ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগ ম্লান হতে শুরু করে। স্বাস্থ্য খাতে দলীয় রাজনীতির উদাহরণ হয়ে আছে কমিউনিটি ক্লিনিক। জোট সরকারের শাসনামলে এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সেখানে তখন দিনে গবাদিপশু চরানো হতো আর রাতে বসত মদ আর জুয়ার আসর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ দেশে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে আবারও রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব পেলে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। একে একে চালু করা হয় বিএনপির সময় বন্ধ করে দেয়া ক্লিনিকগুলো আর পাশাপাশি স্থাপন করা হয় আরো নতুন নতুন কমিউনিটি ক্লিনিক। ক্ষমতা গ্রহণের পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মস্তিষ্কপ্রসূত জনকল্যাণমুখী দুটি বিশেষ উদ্যোগ আশ্রয়ণ ও কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিশেষ উদ্যমী হয়ে ওঠেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য উন্নত বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন যা ইতোমধ্যেই শেখ হাসিনার মেধালব্ধ উদ্যোগ হিসেবে কপিরাইট স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার সর্বজনীন মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার উদ্যোগ হিসেবে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার মডেল আন্তর্জাতিকভাবে হলো সমাদৃত। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, আর তা বাস্তবায়ন করেছেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ’ নামের প্রকল্পের আওতায় ক্লিনিকগুলো মেরামত, নতুন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ এবং ওষুধ সরবরাহ করার মাধ্যমে ক্লিনিকগুলো চালু করা হয়েছিল। কমিউনিটি ক্লিনিক হচ্ছে সরকারের সর্বনিম্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো। তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুসারে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা নারী প্রসবপূর্ব (প্রতিষেধক টিকাদানসহ) এবং প্রসবপরবর্তী (নবজাতকের সেবাসহ) সেবা প্রদানকারী কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সময়মতো যক্ষ্মা রোগের প্রতিষেধক টিকাদান, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ, কালা-জ্বর, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করছে। এছাড়া জ্বর, ব্যথা, কাটা/পোড়া, হাঁপানি, চর্মরোগ, ক্রিমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসাও প্রদান করা হচ্ছে। এখান থেকে স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিসেবা দেয়া হয়। এখান থেকে বিনা মূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ পায় মানুষ। সেখানে রয়েছে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী, ইন্টারনেট সার্ভিস, ই-হেলথ, টেলিমেডিসিনসহ আনুষঙ্গিক সহায়তা। ক্লিনিকগুলো পরিচালনা করেন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার। এ পদে স্থানীয় নারী কর্মীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রেও এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। প্রধানমন্ত্রীর আরও একটি বিশেষ উদ্যোগ ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ বাস্তবায়নের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করছে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।
বাড়ির কাছেই সহজে, বিনামূল্যে নির্ভরযোগ্য, আস্থাশীল সেবা পাওয়ার কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো গ্রামের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং পরিবারের হাসপাতাল হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ক্লিনিকে প্রতিবছর ১ লাখ ৭০ হাজার টাকারও বেশি ওষুধ বিনা মূল্যে দেয়া হচ্ছে। গত জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত ক্লিনিকগুলোতে মোট ভিজিট হয়েছে প্রায় সাড়ে সাত কোটিরও বেশি। ১০ কোটিরও বেশি মানুষ পেয়েছেন বিনা মূল্যের এই স্বাস্থ্যসেবা। প্রতিদিন প্রতিটি ক্লিনিকে ৭০-৮০ জনেরও বেশি ভিজিট করেন। এর ৮০ শতাংশ নারী ও শিশু। এ পর্যন্ত ৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রায় এক লাখ মায়ের নিরাপদ স্বাভাবিক ডেলিভারি হয়েছে। ৩ কোটি ৭০ লাখেরও বেশি রোগীকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে জরুরি ও জটিলতার কারণে উচ্চতর চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে স্বাস্থ্যসেবাকে ঘিরে সরকার গৃহীত উদ্যোগগুলো। করোনা মহামারিতে সর্বস্তরের জনগণের জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে বিনা মূল্যে করোনার টিকার ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ সরকার সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অন ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন’ প্রধানমন্ত্রীকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিসেবে ভূষিত করে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটের গবেষণায় স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ও মানসূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্তানের ওপরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যুহার হ্রাস, শিশুমৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক আরও বলেছেন, ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ সব উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবার মান সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ মডেল হিসেবে কাজ করবে।
একসময় স্বাস্থ্য খাতে প্রায় সব সূচকে তলানিতে ছিল বাংলাদেশ। সেই দেশ এখন মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় টপকে গেছে ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ আরো বহু দেশকে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের এই ক্রমোন্নতি পুরো বিশ্বের কাছেই বিস্ময় হয়ে উঠেছে। ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ এখন যেন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য স্বাস্থ্য খাতকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি আদর্শ ‘ব্লুপ্রিন্ট’। কমিউনিটি ক্লিনিক দেশের সর্বিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ সরকার ভবিষ্যতে এ সেবা কার্যক্রম আরও আধুনিকায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ আরো বাড়ছে। নিশ্চিত হচ্ছে প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার মৌলিক অধিকার।
লেখক: ট্রেজারার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশি পণ্যের বড় বাজার। বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানির ৪৮ শতাংশের গন্তব্য ইইউভুক্ত ২৭ দেশ। বছরে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলার। তার বিপরীতে ইইউ থেকে আমদানি ৪০০ কোটি ডলারের কম। ফলে ইইউর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বেশ এগিয়ে বাংলাদেশ। ইইউতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ৯৩ শতাংশই তৈরি পোশাক। অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপির কল্যাণে গত দুই দশকে এই বাজারে পোশাকশিল্প শক্ত জায়গায় পৌঁছেছে।
২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল তালিকায় যুক্ত হলেও পরের তিন বছর সুবিধাটি থাকবে। তারপর ইইউতে শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস পেতে হবে। যদিও বর্তমান নিয়মনীতিতে তা সম্ভব নয়। এ জন্য ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের দেনদরবার চলছে। এমন প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব কণ্ঠভোটে গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারচর্চার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, মানবাধিকারকর্মী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাজের নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য ইইউর অবাধ বাজার সুবিধা ‘এভরিথিং বাট আর্মসের’ (ইবিএ) পরিসর আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সনদ লঙ্ঘনের মাধ্যমে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মামলাটি একটি পশ্চাৎগামী পদক্ষেপ, যা উদ্বেগের। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা। প্রসঙ্গত, ইবিএ কর্মসূচির মাধ্যমে জিএসপি সুবিধা দেয়া হয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গৃহীত প্রস্তাব দুশ্চিন্তার। মনে রাখতে হবে, এটি বিচ্ছিন্নভাবে আসেনি। ইইউর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় এসব বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।
সেসবের ধারাবাহিকতায় এই প্রস্তাব এসেছে। ইইউ আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের বড় অংশীদার। তারা বড় বিনিয়োগকারী। ঋণ সহায়তাও দেয়। ইইউ বাংলাদেশি পণ্যের বড় বাজার (একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশি পণ্যের শীর্ষ আমদানিকারক হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র)। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইইউতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫২৩ কোটি ডলার। ছয় বছর আগে অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই বাজারে রপ্তানি ছিল ২ হাজার ১৩৩ কোটি ডলার। পরের বছর রপ্তানি ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তারপর করোনার কারণে রপ্তানি কমে আসে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এই বাজারে রপ্তানি ঘুরে দাঁড়ায়। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির বাজারে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে মোট রপ্তানি ১৩ শতাংশ বা ৭০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় জার্মানিতে। তারপর স্পেনে ৩৬৮, ফ্রান্সে ৩২৯, পোল্যান্ডে ১৮৫, নেদারল্যান্ডসে ২০৯, ইতালিতে ২৩৯, ডেনমার্কে ১৩১ ও বেলজিয়ামে ৯৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।
বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্য হলেও ইইউ থেকে আমদানি তুলনামূলক কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের মোট পণ্য আমদানি ছিল ৭ হাজার ৫৬০ কোটি ডলারের। এই আমদানির ২৫ শতাংশ চীন থেকে এসেছে। দ্বিতীয় ভারত, ১৮ শতাংশ। আর ইইউ থেকে আমদানি ৫ শতাংশের কম। ইউরোপিয়ান কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে ইইউ বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ইউরোর আমদানির বিপরীতে রপ্তানি করেছে মাত্র ২২০ কোটি ইউরোর পণ্য। তখন ইইউর বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ১৩০ কোটি ইউরো। পরের বছর সেই ঘাটতি বেড়ে ১ হাজার ২৯০ কোটি ইউরোতে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২২ সালে বাণিজ্য ঘাটতি পৌঁছেছে ২ হাজার ২০ কোটি ইউরো। ইইউতে বাংলাদেশি পণ্যের মোট রপ্তানির মধ্যে ৯৩ শতাংশই হচ্ছে তৈরি পোশাক।
গত অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের পোশাক, যা মোট পোশাক রপ্তানির ৫০ শতাংশের বেশি। তৈরি পোশাক ছাড়াও এই বাজারে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতা, বাইসাইকেল ইত্যাদি জিএসপি সুবিধার আওতায় পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি হয়। ইইউর দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১১৬ কোটি ডলার। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ ৪১০ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছে। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নেদারল্যান্ডস থেকে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে, ১২৬ কোটি ডলার। ২০২৯ সালের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাসের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তবে ২০২৪-৩৪ সালের জন্য জিএসপির নতুন নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে ইউরোপীয় কমিশন। সেটি ইইউ পার্লামেন্টে এখনো অনুমোদন হয়নি।
জিএসপি প্লাসের খসড়াটি হুবহু ইইউ পার্লামেন্টে অনুমোদিত হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এই সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শর্তেই আটকে যাবে। তখন প্রায় ১২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ইইউতে পোশাক রপ্তানি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র উভয় দেশের উচ্চপর্যায়ে সমঝোতার মাধ্যমেই সম্ভব। জিএসপি প্লাস না পেলে পোশাক রপ্তানির কী হবে? জিএসপি সুবিধা না থাকলে ইইউর বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ধস নামবে। কারণ, বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ১-২ শতাংশ দাম কমবেশির কারণে আমরা ক্রয়াদেশ হারাই। সেখানে জিএসপি সুবিধা না থাকলে শুল্কের কারণে তৈরি পোশাকের দাম ১০-১২ শতাংশ বেড়ে যাবে। এই বাড়তি দাম কেন দিতে চাইবে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ইইউর বাজারে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, উজবেকিস্তান, বলিভিয়াসহ আটটি দেশ জিএসপি প্লাস সুবিধা পায়।
আর বাংলাদেশসহ ৪৬টি স্বল্পোন্নত দেশ জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে। দেশের মোট রপ্তানি আয়ে সমজাতীয় পণ্যসহ তৈরি পোশাকের হিস্যা এখন ৮৬ শতাংশ। এ পণ্যগুলোর প্রধান বাজার ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। বাংলাদেশের পোশাকের বাজার হিসেবে ইইউর হিস্যা ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইইউ বাজারের গুরুত্ব প্রমাণ করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বেশ কিছু সুবিধায় ইইউতে পোশাক রপ্তানি আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এমনকি মাত্র সাত বছর অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যেই এটি ৬ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইইউতে ২ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে।
ইইউ জোটে পোশাক রপ্তানি বাড়াতে একসঙ্গে এখন অনেক সম্ভাবনার দুয়ার বাংলাদেশের সামনে খোলা। যেমন ইইউভুক্ত দেশগুলোতে পোশাকের চাহিদা গড়ে ৩ শতাংশ হারে বাড়ছে। বর্তমান বাজার ২০০ বিলিয়ন ডলারের। বর্ধিত এ চাহিদায় বাংলাদেশের হিস্যা একরকম একচেটিয়া। কারণ জোটে চীনা আধিপত্য ক্রমে কমছে। মার্কিন বৈরিতা সূত্রে তাদের মিত্র ইইউর বাজারে চীনা পণ্য অনুৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রায় একই নিয়তি বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনামেরও। নিজস্ব নীতির কারণেও পোশাক বাণিজ্য থেকে সরে আসছে চীন। সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যান সে কথাই বলছে। গত ২০২২ পঞ্জিকা বছরে ইইউ জোটের দেশগুলোতে পরিমাণে বেশি পোশাক রপ্তানিতে প্রথমবারের মতো শীর্ষস্থান দখলে এনেছে বাংলাদেশ। বছরটিতে ১৩৩ কোটি কেজি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। চীন করেছে ১৩১ কোটি কেজি। পরিমাণের হিসাবে বাংলাদেশের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির হার চীনের প্রায় দ্বিগুণ। পরিমাণের হিসাবে আগের বছরের চেয়ে গত বছর রপ্তানি বেশি হয়েছে ২১ শতাংশ, চীনের যা ১২ শতাংশের কম। অর্থমূল্যে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে চীনের দ্বিগুণ হারে।
অর্থমূল্যে গত বছর বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ, যেখানে চীনের এ হার ১৭ শতাংশ। ইইউতে রপ্তানিতে সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিই সবচেয়ে বেশি। পোশাকের রপ্তানি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলা ভিয়েতনাম আরও বড় ব্যবধানে পিছিয়ে আছে। ইইউতে পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামের অবস্থান পঞ্চম। ইইউতে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের মজবুত ভিত্তির আরও একটি উদাহরণ হচ্ছে দরের হিসাব। সাম্প্রতিক সময়ে চীন-ভিয়েতনামের পোশাকের চেয়ে বাংলাদেশের পোশাকের দাম বেড়েছে বেশি হারে। আগের বছরের চেয়ে গত বছর ইইউতে বাংলাদেশের পোশাকের দাম বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। যেখানে চীনের পোশাকের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশের কিছু কম। ভিয়েতনামের বেড়েছে ৩ শতাংশের মতো। ওই বছর ইইউভুক্ত দেশগুলোতে পোশাকের দাম বেড়েছে গড়ে ৩ শতাংশ হারে। অর্থাৎ দেশের চেয়ে ইইউতে বাংলাদেশের পোশাকের দাম বেশি হারে বাড়ছে। ইইউর সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের প্রতিবেদন ঘেঁটে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশের মজবুত এ ভিত্তির পেছনে অন্যতম শক্তি পোশাকের পশ্চাৎসংযোগ শিল্প। বিশেষ করে নিট ক্যাটেগরির পোশাকই ইইউতে বেশি রপ্তানি হয়। নিটের সুতা ও কাপড়ের প্রায় শতভাগ স্থানীয়। পোশাক খাতের জন্য ইইউ শুধু বড় বাজারই নয়; একই সঙ্গে সুবিধাজনক বাজার। কারণ নিট পোশাক সাধারণত ওজনে কিছুটা ভারী হয়ে থাকে। এ কারণে ফ্রেইট কস্ট বা পরিবহন ব্যয় বেশি। সেদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা দীর্ঘ পথের অন্যান্য দেশে পরিবহন সাশ্রয়ী হয় না। তুলনামূলক কাছের হওয়ায় ইউরোপে রপ্তানি সুবিধাজনক। এ ছাড়া শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানিতে ইইউতে উৎস বিধির শর্ত অন্য যেকোনো বাজারের চেয়ে অনুকূল। যেকোনো দেশের কাঁচামাল এনে পোশাক রপ্তানি করা যায়। ইইউর মতো বড় বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার এখনো করতে পারেনি বাংলাদেশ। সম্ভাবনার অন্তত ৪০ শতাংশ এখনো অব্যবহৃত। রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য না থাকায় এত বড় বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগছে না।
২০৩০ সালের মধ্যে ইইউর বাজারে ৬০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করা সম্ভব। বর্তমান অবস্থায়ও ইইউতে বাড়তি ১৮ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। তবে সক্ষমতার অভাব এবং পণ্যের বৈচিত্র্যহীনতার কারণে সুযোগ কাজে লাগছে না। ইইউ জোটে রপ্তানি পণ্যের ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। পোশাকবহির্ভূত বড় পণ্যের সম্ভাবনার ২৫০ কোটি ডলার কম রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এসব পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাদুকা, চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইলস, চিংড়ি ও মাছ। ইইউর বাজার সম্পর্কে তথ্য-উপাত্তের অভাব রয়েছে। জোটের কোন দেশে কী সম্ভাবনা, কোন মৌসুমে কী রঙের পোশাকের চাহিদা থাকে- এ বিষয়ে জানা-বোঝার স্বল্পতা রয়েছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানের প্রশ্নে উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টিও বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আবার রপ্তানির বিপরীতে সরকারের দেয়া নগদ সহায়তা সব পণ্যের ক্ষেত্রে সমান নয়। এ কারণে অনেক পণ্যের উদ্যোক্তা রপ্তানিতে উৎসাহিত নন। তুলনামূলক লাভজনক দামে স্থানীয় বাজারেই বিক্রিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তারা। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) ক্ষেত্রে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। সরবরাহ চেইনে বিভিন্ন সেবার সহজলভ্যতার অভাবেও বৈচিত্র্য আনার বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এলডিসি হিসেবে পাওয়া শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা আর থাকবে না। রপ্তানি উৎসাহিত এবং সক্ষমতা বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া নগদ সহায়তা বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে তিন ধরনের কাঠামোতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হয় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে। আটটি পণ্যে ২০ শতাংশসহ ৩৮টি পণ্যে বিভিন্ন হারে নগদ সহায়তা রয়েছে। এসব বিধিবিধান পরিপালনের কারণে রপ্তানি সক্ষমতা কমতে পারে। ২০২৬ সালে এলডিসির পরিচয় ঘুচবে বাংলাদেশের। ইইউ জোটের ২০২৯ সাল পর্যন্ত এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) কর্মসূচির অধীন যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকবে। ইবিএ হচ্ছে সবচেয়ে সহজ শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধা, যা এলডিসিগুলো পেয়ে থাকে। পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ এলডিসি-উত্তর পরবর্তী সময়ে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়েছে।
রাষ্ট্রদূত এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফোরামের সঙ্গে আলোচনায় বিজিএমইএ এ দাবি তুলে ধরেছেন। তারা আশাবাদী, শেষ পর্যন্ত একটি স্বস্তিদায়ক অবস্থায় যেতে পারবেন। বিজিএমইএর এ আবেদন আমলে নেয়া না হলেও ‘জিএসপি প্লাস’ নামে ইইউর আরেকটি শুল্কমুক্ত সুবিধার স্কিম রয়েছে, যাতে প্রায় একই রকম সুবিধা ভোগ করার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। তবে এ জন্য কিছুটা কঠিন শর্ত পরিপালন করতে হবে। এ-সংক্রান্ত ৩২টি কনভেনশন অনুমোদন করার শর্ত রয়েছে। এ পর্যন্ত ২০টি কনভেনশন অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ। বাকি ১২টিও অনুমোদন করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা, নির্যাতন ও অন্যান্য নৃশংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি।
সুশাসন, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের পাশাপাশি পরিবেশ, সামাজিক ও সুশাসন (ইএসজি) কমপ্লায়েন্সের শর্ত যদি জুড়ে দেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়বে। বাংলাদেশ ইইউতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেলে তারপর তা রক্ষা করার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। মানবাধিকার, শ্রম অধিকার কিংবা অন্য যেকোনো ইস্যুতে অগ্রগতি সন্তোষজনক মনে না করলে যেকোনো সময় শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহারের এখতিয়ার রয়েছে ইইউর। এ ছাড়া কার্বন করও বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের হুমকি। ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৫৫ শতাংশ কমানো এবং ২০৫০ সালের মধ্যে তা শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি পথনকশা করেছে ইইউ। ‘ইইউ গ্রিন ডিল’ নামের এ পদক্ষেপের আওতায় কয়েকটি খাতের পণ্যের ওপর কার্বন কর আরোপ করার কাজ চলছে। ২০২৬ সালে আমদানি পর্যায়ে এ শুল্ক আরোপ করা হবে।
আটটি আমদানি পণ্যের ওপর এটি আরোপ করা হতে পারে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা প্রাথমিক তালিকায় রাখা হয়নি। তবে ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের এই তিন পণ্যে কার্বন কর আরোপ হতে পারে। এ কর আরোপ হলে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। ইইউ কখনোই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক ইস্যুকে জড়ায়নি। যদিও এবারের বিষয়টি কোন দিকে যাচ্ছে, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের প্রত্যাশা, তারা (ইইউ) রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য জড়াবে না।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাব নিয়ে ইইউর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে ইইউ পার্লামেন্টে জিএসপি সুবিধা চালু রাখা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সেটি অবশ্যই অস্বস্তিকর। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গৃহীত প্রস্তাবটি সরকারের গুরুত্ব নেয়া উচিত। তৈরি পোশাকশিল্পের মাধ্যমে আমরা প্রত্যন্ত এলাকার নারীদের পাশাপাশি বিশাল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছি। আমরা মনে করি, ইইউর নেতৃত্ব চাইবে না এ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হোক। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবের কারণে জিএসপি প্লাসের আলোচনায় বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে থাকতে পারে।
লেখক: রেজাউল করিম খোকন, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক
ইসলামি অর্থনীতির লক্ষ্য সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর মাধ্যম হতে পারে ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা। ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দারিদ্র্য সমস্যার সমাধানকেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অধীনে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদান করা হয়। এর মাধ্যমে উল্লিখিত জনগোষ্ঠী মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং নতুন ব্যবসা শুরু ও বৃদ্ধি করতে পারে। যাই হোক, প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো দারিদ্র্য সমস্যার সমাধানে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারেনি। প্রচলিত ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা দারিদ্র দূরীকরণের লক্ষ্যে ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত হচ্ছে। মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) তথ্য অনুসারে, গ্রামীণ ব্যাংক, সরকারি ও বে-সরকারি ব্যাংকের অধীনে পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দেশে প্রায় ৭৩৯টি প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধীনে ৬ কোটি ৬৪ লাখ সদস্য ঋণ গ্রহণ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতার স্বাক্ষর রাখলে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি পরিলক্ষিত হতো। কিন্তু তা হয়নি। বরং ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা ঋণগ্রহীতার ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে আসছে। দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র হওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে বেশির ভাগ।
কার্যত প্রচলিত ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা বা এনজিওগুলো সফল না হলেও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (আরডিএস) সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আরডিএস প্রকল্প সফল হওয়ায় ২০১২ সাল থেকে শহুরে দরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এটি ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়নে বিশ্বের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান। এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রমে ক্রমবর্ধমান প্রকল্প। ২০১৮ সালে এ প্রকল্পের আওতায় সদস্য ছিল ১১ লাখ দরিদ্র মানুষ, যা ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৬ লাখ। যাদের অনেকেই বিনিয়োগ নিয়ে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটির ৪৬২টি শাখা, উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে ৬৪টি জেলায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রকল্পের অধীনে বিনিয়োগ আদায়ের হার ৯৯.০৩ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ছিল ৯৮.৯৩ শতাংশ দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য সফলতা নির্দেশ করে।
দেশের প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা সুদভিত্তিক। ইসলাম সুদকে হারাম করেছে, আর ব্যবসাকে করেছে হালাল। ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থায় ইসলামী শরিয়াহ প্রদত্ত মডেল যেমন ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান চুক্তির মধ্যে রয়েছে ক্রয়-বিক্রয়ভিত্তিক ব্যবস্থা যেমন বাই-মুরাবাহা, বাই-মুআজ্জাল, বাই-সালাম, বাই ইসতিসনা ইত্যাদি; ব্যবসায়িক সহযোগিতাভিত্তিক চুক্তি মুশারাকা ও মুদারাবা; ইজারাভিত্তিক চুক্তি যেমন হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক। ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থায় মুনাফার হারও তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকের ক্ষুদ্র বিনিয়োগের প্রধান লক্ষ্য হলো সুযোগ সৃষ্টির জন্য আর্থিক সুবিধা প্রদান করা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে গ্রামীণ জনগণের আয় বৃদ্ধি। গ্রামীণ এলাকায় কৃষি এবং অ-কৃষি কার্যক্রমে বিনিয়োগ সুবিধা প্রসারিত করা। এই ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রকল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো-প্রকল্পটির কার্যক্রম ব্যাংকের নিকটবর্তী শাখাগুলোর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ বিশেষ করে বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প থেকে দেখা গেছে যে, দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ছোট বিনিয়োগ গ্রহীতারা এগিয়ে; তার পরে মাঝারি ও বড় বিনিয়োগ গ্রহীতারা। দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে একটি ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি। ইসলামী ব্যাংকগুলো কোনো অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে অর্থায়ন করতে সক্ষম। ইসলামী ব্যাংকসমূহ আরও দক্ষতার সঙ্গে সুবিধাজনকভাবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রদান করতে পারে ।
একটি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কর্মসূচির সাফল্য নির্ভর করে এর সদস্যদের আয় বৃদ্ধিতে এবং শেষ পর্যন্ত দরিদ্রদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার তুলনায় ইসলামি ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর ভূমিকা রাখে।
এই প্রকল্পের অধীনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগের জন্য কোনো জামানত প্রয়োজন নেই। সর্বমোট ঋণ (মূল পরিমাণ এবং মুনাফা) সাপ্তাহিক কিস্তিতে এক বছরে পরিশোধ করতে হয়। ইসলামি মাইক্রো ফাইন্যান্সের অন্যতম একটি দিক হলো তদারকি কার্যক্রম। বিনিয়োগ দিয়ে শুধু আদায় নয় বরং তার সফল ও সার্থক ব্যবহার হচ্ছে কি না তা তদারকি করা হয়। প্রায় শতভাগ ঋণ আদায়ের অন্যতম রহস্য এটি। এই স্কিমের সব সদস্যকে ন্যূনতম পরিমাণ সাপ্তাহিক সঞ্চয় করতে হয়। এ ছাড়াও ফিল্ড অফিসাররা সদস্যদের নিয়ে সততা, দায় পরিশোধের গুরুত্বসহ ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ফলে বিনিয়োগ গ্রাহকরা দায় পরিশোধে অনীহা নয় বরং সৎ ও নৈতিকতাসম্পন্ন উদ্যোক্তা হয়ে বিনিয়োগের অর্থ পরিশোধে তৎপর থাকেন।
ইসলামী ব্যাংকের এই প্রকল্পকে সারাবিশ্বে ইসলামী মাইক্রো ফাইন্যান্সের জন্য মডেল হিসেবে গ্রহণ করে অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এ জন্য বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থার পথিকৃৎ বলা হয়। ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো গত প্রায় তিন দশকে দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য এ ধরনের আর কোনো প্রকল্প বা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে আরো ৯টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। এই ব্যাংকগুলো ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু করলে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মতো ইসলামী মাইক্রো ফাইন্যান্সেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সম্ভব। ব্যাংকগুলোর জন্য তুলনামূলক কম মুনাফায় বিনিয়োগ দেয়া সম্ভব। কেননা বিদ্যমান অবকাঠামোতেই এ প্রকল্প পরিচালিত হবে। এ ছাড়াও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোও ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু করতে পারে। এতে একদিকে সুদমুক্ত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে অর্থনীতির প্রকৃত সুফল সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে; সম্ভব হবে সম্পদের সুষম বণ্টন।
এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুদারাবা ও মুশারাকার মতো আদর্শ বিনিয়োগ পদ্ধতিগুলোর ওপর জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে কিস্তি পরিশোধের শুরুর সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে পৃথক ‘ইসলামী মাইক্রো ফাইন্যান্স ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে নতুন মাত্রা নিয়ে আসবে। সরকার ইসলামি ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে সহায়তা করলে ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও ২০৪১ সালের লক্ষ্য অর্জনে এক ধাপ এগিয়ে থাকবে। এ জন্য সহায়ক নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার
গত ২৩ আগস্ট ভারতের নিজেদের তৈরি চন্দ্রযান-৩ সফলভাবে চাঁদের দক্ষিণভাগে অবতরণ করে। তার আগে ১৪ জুলাই ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের হরিকোটায় অবস্থিত সতিশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে নভোযানটি উৎক্ষেপণ করা হয়। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইসরো) চন্দ্রযান-৩ পৃথিবী ও চন্দ্রের কক্ষপথ পেরিয়ে প্রায় ৪২ দিনে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রথম দেশ ও চন্দ্রপৃষ্ঠে নভোযান নামানো চতুর্থ দেশ। এর আগে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন চন্দ্রপৃষ্ঠে নভোযান অবতরণ করেছে। চন্দ্রযান-৩ সফল অবতরণের পর ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, বাংলাদেশের মানুষের উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া ও পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দিতে দেখা যায়।
পাকিস্তানের জনগণের দাবি, পাকিস্তানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (সুপারকো) কেন সাস্কসেস হতে পারল না? অনেকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ভারত চাঁদে গেছে তো কি হয়েছে, আমরা তো চাঁদেই আছি। চাঁদে তো জল নেই, গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, পাকিস্তানের বহু এলাকাতেও এখন সেরকমই অবস্থা। তাহলে ভারতের দেখাদেখি হিংসা করে কি এবার পাকিস্তানও সুপারকোর উন্নতির জন্য লেগে পড়বে? আবার বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকে দাবি করেন, আমরা ৫২ হাজার কোটি টাকার মেট্রো রেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। যার খরচ দিয়ে মোট ৫৭টারও বেশি চন্দ্রযান পাঠাতে পারি বিভিন্ন মেরুতে। আবার ৩৬ হাজার কিমি দূরে স্যাটেলাইট পাঠিয়েই ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে আমাদের সক্ষমতা দেখিয়েছি। আরও কত কি?
পাঠক, তিন দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করলেই আমরা বুঝতে পারব, মহাকাশ গবেষণায় কার কতটুকু সক্ষমতা আছে বা গবেষণায় এগিয়ে আছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত দক্ষ বলা যায়। সারা বিশ্বেই এখন ভারতের শিক্ষিত আইটি পেশাদারদের মেধাবৃত্তিক কাজে দেখা যাচ্ছে। ভারতের বর্তমান আইটি সেক্টরের অংশ ভারতের জিডিপির প্রায় নয় শতাংশ। ভারতের আইটি বাজারের মূল্য ১৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৫ সাল নাগাদ সাড়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই পটভূমিতে পাকিস্তানের গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে, ভারতের চন্দ্রযান-৩ তো চাঁদে পৌঁছেছে, তাহলে পাকিস্তানের চন্দ্রযান কোথায়?
বর্তমানে পাকিস্তান মহাকাশ গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যান একজন সেনাকর্মকর্তা এবং তার অধীনে ১৫-২০ জনের অবৈজ্ঞানিক জনবল নিয়ে সংস্থাটি টিকে আছে। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠা হয় পাকিস্তানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। ‘স্পেস অ্যান্ড আপার অ্যাটমুস্ফিয়ার রিসার্চ কমিশন’, যার সংক্ষেপে নাম (সুপারকো), পদার্থবিদ ও নোবেল বিজয়ী ড. আব্দুস সালামের নেতৃত্বে এই গবেষণা কেন্দ্র শুরু হয়েছিল। কিন্তু চীনের সাহায্য ছাড়া মহাকাশ গবেষণার উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ করেনি পাকিস্তান। পাকিস্তান ১৯৬২ সালে এশিয়ার তৃতীয় দেশ হিসেবে রকেট রেহবার-১ উৎক্ষেপণ করে। পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারমাণবিক গবেষণা চালিয়েছে অনেক বছর।
নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তান পারমাণবিক গবেষণায় সাফল্য পেলেও সেই ধারাবাহিকতা অন্যসব ক্ষেত্রে পাকিস্তান সামগ্রিকভাবে স্থির হয়ে আছে। প্রথমদিকে এত এগিয়ে থাকার পরও ইসরো থেকে কয়েকশ গুণ পিছিয়ে সুপারকো। শিক্ষা খাতে তহবিল বরাদ্দের অভাব ও বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য অর্জনে সামরিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বের বারবার হস্তক্ষেপের কারণে আজ এই হাল। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কলহের কারণে বিকাশ কম হচ্ছে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহরু মহাকাশ গবেষণার উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কাজ শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ভারত মহাকাশ গবেষণার জন্য জাতীয় কমিটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। ভারত ১৯৬৯ সালের ১৫ আগস্ট, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) প্রতিষ্ঠা করেছিল। নাসার চন্দ্র বিজয়ের মাত্র ২৫ দিনের মধ্যেই ‘ইসরো’ (ইসরো) চালু হয়। এই গবেষণা সংস্থার মূল উদ্দেশ্য মহাকাশ প্রযুক্তির বিকাশ ও মহাকাশ অধ্যয়নের জন্য গবেষণা ও জ্ঞান প্রয়োগ করা। এ ছাড়া বিভিন্ন খেয়াযান উৎক্ষেপণ বা উৎক্ষেপণ-উপকরণের প্রয়োজন মেটাতে কাজ করার লক্ষ্যে এর যাত্রা। বহুমুখী স্যাটেলাইট কক্ষপথে প্রেরণ থেকে শুরু করে কল্পবিজ্ঞানের বহির্জাগতিক জীবন অনুসন্ধানের জন্য মহাকাশ মিশন পাঠানোর লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা এক হন (ইসরো)-এর মাধ্যমে। বর্তমানে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম মহাকাশ সংস্থা এটি।
তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ভারত ‘ইসরো’-কে অনেক বছর ধরেই শক্তিশালী করে তুলছে। ইসরো স্যাটেলাইট যোগাযোগ, স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং ও ন্যাভিগেশন, রিমোট সেন্সিইন, মহাকাশ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ, গ্রাউন্ড স্টেশন অপারেশন ও ডেটা বিশ্লেষণ এবং প্রক্রিয়াকরণে সহায়তানির্ভর নানান কাজে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছে। চন্দ্রযান-৩ যা বিক্রম ল্যান্ডার নামে পরিচিত, যার পেট থেকে প্রজ্ঞান নামে একটি রোভার বের হয়ে ১৪ দিন চাঁদের মাটিতে অন্বেষণ করে মিশন শেষ করবে।
পাকিস্তান বহু আগে চীনের সহযোগিতায় ৬টি স্যাটেলাইট আকাশে প্রেরণ করেছে। সেখানে বাংলাদেশ এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ব্যবহার শুরুর কাজ। দেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর ধরন নির্ধারণের জন্য ফ্রান্সের প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার স কে নিয়োগ দিয়েছে বিএসসিএল। ২০১৮ সালে ১২ মে নাসার সাহায্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের অভিজাত ক্লাবে নাম লেখায় বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশের খরচ হয় ২ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ হাইব্রিড স্যাটেলাইট হতে পারে। এই স্যাটেলাইট আবহাওয়া, নজরদারির বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত হবে। সেই ষাটের দশকে টাটা ইন্ডাস্ট্রিজের সাহায্যে ভারতে আইটি শিল্পের বিকাশ ঘটে ১৯৬৭ সালে মুনবাইতে। সান্তাক্রজ ইলেকট্রনিক্স এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন নামে প্রথম সফটওয়্যার রপ্তানি অঞ্চল ১৯৭৩ সালে মুনবাইতে যাত্রা শুরু করে। এই স্থাপনাগুলো হলো আধুনিক দিনের আইটি পার্কের অগ্রদূত।
বাংলাদেশ শুধু মহাকাশ নয়, সব ধরনের গবেষণাতেই পিছিয়ে আছে। একমাত্র কৃষি গবেষণাতে তুলনামূলক একটু ভালো অবস্থায় আছে। এই পিছিয়ে থাকার মূল কারণ হচ্ছে-গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা এবং পর্যাপ্ত ফান্ডের অভাব ও কাঠামোগত সমস্যা তাদের নিরুৎসাহিত করে। অন্যান্য দেশ যেখানে তাদের বাজেটের একটি বড় অংশ গবেষণার পিছনে খরচ করে, সেখানে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাৎসরিক বাজেটের দিকে তাকালেই দৈন্যদশা চোখে পড়ে। সরকারি প্রণোদনা ছাড়া গবেষণা চলে না, কারণ বাংলাদেশের মতো দেশে বেসরকারি খাত কখনই গবেষণায় খুব একটা খরচ করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার জন্য প্রণোদনা তো দূরের কথা, গবেষণা কাজ চালানোর জন্য সরকারের তরফ থেকে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ খুবই নগণ্য।
এবার আসি মহাকাশ গবেষণার দিকে, বাংলাদেশে এর প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় ৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে। বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন কেন্দ্র, সংক্ষেপে যার নাম ‘স্পারসো’ গঠিত হয় ১৯৮০ সালে। কিন্তু তার পরের ৪০ বছরে প্রতিষ্ঠানটির দিকে কতটুকু নজর দেওয়া হয়েছে তা তাদের পোর্টফলিও দেখলেই বোঝা যায়। তাদের উইকিপেডিয়া পেজে তাদের বলার মতো কোনো প্রজেক্ট খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তবে হাঁ একটি আর্টিকেল খুঁজে পাওয়া গেছে যাতে ‘স্পারসো’র দৈন্যদশাই ফুটে উঠেছে। পাকিস্তানে যেমন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যানের পদ অলংকৃত করে আছে একজন সেনাকর্মকর্তা, বাংলাদেশেও গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যানের পদ অলংকৃত করে আছে এক কৃষিকর্তা। কাজেই গবেষণার ক্ষেত্রে কতটুকু এগিয়ে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
এবার তাদের পোর্টফলিওটি দেখা যাক, অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১৬৯টি। বর্তমানে কর্মরত আছেন ৮৪ জন। শূন্যপদের সংখ্যা ৮৫টি। মোট পদের অর্ধেকেরও বেশি পদ শূন্য। এরকম পরিস্থিতিতে চলছে প্রায় ১৫ বছর। জনবলের অভাবে প্রতিষ্ঠানটির চেইন অফ কমান্ড প্রায় ভেঙে পড়েছে। মহাকাশ গবেষণাতেও নেই কোনো উদ্যোগ। টানা ১৫ বছর প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো ধরনের নিয়োগ হয়নি। অন্যদিকে ভারতের ইসরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে, বাংলাদেশের ‘স্পারসো’ গঠিত হওয়ার ১১ বছর আগে। কিন্তু তারও আগে থেকেই ভারতে মহাকাশ গবেষণায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছিল। ইসরোর মাধ্যমে ভারত সরকার সব প্রজেক্টকে সেন্ট্রালাইজ করে।
পরবর্তী দশকগুলোতে ভারতে মহাকাশ গবেষণার ভালো ক্ষেত্র তৈরি হয়, দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয়, তাতে অনেক সময় যথেষ্ট ফান্ড না থাকলেও সংশ্লিষ্টদের দৃঢ়তায় কাজ এগিয়ে যায়। আর এখনকার সময়ে ইসরো বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে, আর একসঙ্গে নানামুখী প্রোজেক্ট চলমান। ২০২১-২২-এ তাদের বাজেট প্রায় ১৪ হাজার কোটি রুপি, আর তাদের অ্যামপ্লয়ির সংখ্যা ১৭০০০-এর অধিক। .৮৪ জন আন্ডরফান্ডেড অ্যামপ্লয়ি নিয়ে কি ১৭০০০ জনের সঙ্গে পাল্লা দেয়া যায়? এহেন পরিস্থিতিতে, সরকার যদি মহাকাশ গবেষণায় পর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দের পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও আইটি সেক্টরে জোর দেন। সেই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও ঢেলে সাজিয়ে এবং পাঠ্যপুস্তকে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে অন্তর্গত করে ব্যবস্থা নিলে আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তন সম্ভব, এমনই মত পোষণ করেন বিশেষজ্ঞরা।
লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী শিক্ষাবিদ ও গবেষক
স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছরে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছে। বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরামে বাংলাদেশ এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় অনুযায়ী এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। আয়তনে ছোট ও সীমিত সম্পদ নিয়ে ৫১ বছরের মাথায় অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করেছে। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যাওয়ার সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর চাপ উপেক্ষা করে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সই করেছে বাংলাদেশ। ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা- ওআইসিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বের অন্যতম মুসলিম দেশ হিসেবে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ৫২ বছরে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গেও কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। বাংলাদেশ এখন রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা করছে। ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশটি বর্তমানে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির দেশ। অর্থনীতির গতিময়তায় দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন সারা বিশ্বে তার পরিচিতি। গত বছর শ্রীলঙ্কার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তামূলক ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ। একটি দরিদ্র সাহায্যপ্রার্থী দেশ থেকে আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশ হওয়ার পথে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। ১৯৭১-এ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সময় বাংলাদেশ ছিল আপাত সম্ভাবনাহীন পৃথিবীর দরিদ্রতম একটি দেশ, যাকে হেনরি কিসিঞ্জার তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ ১৮ কোটি মানুষের একটি সমৃদ্ধ দেশ।
যাদের আছে রপ্তানিনির্ভর এক বিশাল অর্থনীতি। দারিদ্র্য দূর করায় তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতির স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৩ সালে ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড’ পায়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পিডব্লিউসির পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০৫০-এর মধ্যে বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। এ ছাড়া, দ্য গোল্ডম্যান স্যাচ পূর্বাভাস দিয়েছে, ব্রিকসের পর যে ১১টি দেশ আগামী পৃথিবীর অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ তার একটি। এদিকে ভারতের অর্থনীতির চেয়ে চীনের অর্থনীতি কয়েক গুণ বড়। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হওয়ার পরও কখনোই কোনো সূচকে চীনকে টপকাতে পারেনি ভারত। বাংলাদেশের অর্থনীতির ১০ গুণ বড় ভারতের অর্থনীতি। অথচ কয়েকটি সূচকে ভারতকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। নারীর ক্ষমতায়ন, নারী শিক্ষার হার, নবজাতক ও ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনায় বাংলাদেশের সূচক ভারতের চেয়ে অনেক ওপরে। বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠা এবং করোনাকালে উন্নয়নধারাকে অব্যাহত রাখার পারদ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ ওপরে। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস দিয়েছে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে পেছনে ফেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ এবং ২০০৯ সাল থেকে বিচক্ষণ আর্থিক ও ঋণ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে গত চার দশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে। ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার গড় জিডিপি ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। অথচ সে বছর বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ এখন ভারতের তুলনায় রাজস্ব ঘাটতি, বাণিজ্য ভারসাম্য, ঋণ ও জিডিপির সঙ্গে আনুপাতিক বিনিয়োগ হারের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে।
বাংলাদেশের জিডিপিতে সাধারণ কৃষি খাতের অবদান ছিল এক-তৃতীয়াংশ। তবে ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তা কমে জিডিপির ১৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। অন্যদিকে একই সময় জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান এক-পঞ্চমাংশের কম থেকে বেড়ে এক-তৃতীয়াংশ হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে জিডিপিতে উৎপাদন খাতের অবদান দ্বিগুণ হয়েছে। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশক থেকে রপ্তানি ২০ গুণ বেড়ে ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। অধিক রেমিট্যান্স থেকে কম মজুরির শ্রমিকরাও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। ২০১৯ সালে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৬৪০ কোটি ডলার। এ ছাড়া শক্তিশালী রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও কৃষির কল্যাণে বাংলাদেশ ২০২৬ সাল পর্যন্ত মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২ হাজার ৯৮ ডলার থেকে কমে হয় ১ হাজার ৯২৯ ডলার। অর্থনীতির আকার ২ লাখ ৮৭ হাজার কোটি থেকে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি ডলারে। একই বছর মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। টানা ১৫ বছর ধরে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ওই বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৩৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। আর মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৯৬১ ডলার। ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এভাবে বাড়তে থাকে। এর আগে শুধু ২০১৭ সালে যখন ভারতের প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে, তখন ভারতের চেয়ে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার আগে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ভারতের অর্ধেক। তবে ২০১৪ সালের মধ্যে তা ৭০ শতাংশ বাড়ে। ২০২০ সালে করোনার কারণে ভারতের অর্থনীতির ৭ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। তবে একই বছর বাংলাদেশর অর্থনীতির আকার বাড়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন কর্মসূচি, বিশেষত মেয়েদের শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে জন্মহার ও বাল্যবিবাহ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। গড় আয়ু, জন্মহার ও শিশুপুষ্টির মতো মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির ব্যাপক সুফল পাচ্ছে। সেই তুলনায় ভারত অনেকটা পিছিয়ে। বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে এ দেশের জনগণের জীবনমান বৃদ্ধি পেয়েছে, যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বিগত ৫০ বছরে প্রায় ২৭০ গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ অথবা এর কম থাকছে। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। রপ্তানিভিত্তিক শিল্প-কলকারখার সংখ্যা বৃদ্ধির কল্যাণে বাংলাদেশ এমন অবস্থানে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের অধিকাংশই বস্ত্র, তৈরি পোশাক ও পাদুকা পণ্য (ফুটওয়্যার)। তবে এসব শিল্পের অধিকাংশ শ্রমিক অদক্ষ বা আধা দক্ষ।
বাংলাদেশের অধিকাংশ রপ্তানিপণ্য মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সুবিধা ভোগ করছে। উদ্ভাবন ও স্বল্প বেতন হওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক ক্রেতা ভারতের বদলে বাংলাদেশকে বেছে নিচ্ছে। ভারতের ষষ্ঠ বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৮০ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯৫০ কোটি ডলার। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির আলোকে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বাণিজ্য সম্ভাবনা রয়েছে, তার সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর। সম্প্রতি নিত্যপণ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি, সেবা ও জ্বালানি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও আন্তসীমান্ত বিনিয়োগ উৎসাহিত করাসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ভারতের ছোট প্রতিবেশী হয়েও বাংলাদেশ এভাবে উন্নতি করছে। তবে উন্নতি করার মতো আরও অনেক বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার তারকার খ্যাতি উপভোগ করছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সামরিক সক্ষমতাও বৃদ্ধিতেও সহায়তা করছে। চীন-রাশিয়ার মতো পুরোনো উৎস বাদ দিয়ে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী কিছু বড়সড় কেনাকাটা করতে যাচ্ছে। তারা ইতোমধ্যে তুরস্ক থেকে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সামরিক যান কিনেছে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী আমেরিকান এফ-১৬ অথবা ইউরো ফাইটার টাইফুন কেনার চিন্তা করছে।
এদিকে ধীরে ধীরে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক হাব হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বড় বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর ফলে লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনীতির উন্নতি হবে। এতে বদলে যাবে দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ২০১৮ সালে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস আইন প্রণীত হয়েছে, ফলে বিনিয়োগকারীরা একই পয়েন্ট থেকে সব ধরনের সেবা পাবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা তিন মেয়াদের সরকার ও জনগণের দূরদর্শী পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ ও কঠোর পরিশ্রম বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের সাফল্য এনে দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ ভারতকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং বন্ধুপ্রতিম দেশ বলেই গণ্য করে। প্রতিবেশী এ দেশসহ অন্যান্য ক্ষমতাধর দেশের সঙ্গে গঠনমূলক সুসম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে বাংলাদেশ আস্থাশীল। দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ দেশগুলোকে অংশীদার হিসেবে মনে করে। এমন প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের এই উত্থানের কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটি বুঝতে হলে পেছন ফিরে তাকাতে হবে।
তবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুটিরশিল্পগুলোকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে দেশের মানুষ বহুমুখী কর্মযজ্ঞে সচল রাখবে দেশের অর্থনীতির চাকা। গ্রামের জিনিস শহরে আসবে-যাবে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে। সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের ধনী দেশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আশপাশের দেশগুলোকে তাদের যোগাযোগ রক্ষা করতে হলে বাংলাদেশকে মাধ্যম হিসেবে নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অথচ আমরা জানি মাত্র ৫০ বছর আগেও সিঙ্গাপুর ছিল একটি হতদরিদ্র দেশ। সে সময় সিঙ্গাপুরকে কলোনি অব কুলিজ বলে উপহাস করত। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান নিজের লেখা বইতে বলেছেন, মালয়েশিয়া যখন সিঙ্গাপুরকে পৃথক করে দিল, তখন মনে হলো ইট বিকাম এ হার্ট উইদাউট বডি। কিন্তু সেই অনিশ্চিত সিঙ্গাপুর দরিদ্র অবস্থান থেকে কতটা ওপরে উঠে এসেছে, তা রীতিমতো অভাবনীয়। এখন দুনিয়ায় সিটি স্টেট বলতে সিঙ্গাপুরকেই বোঝায়। সিঙ্গাপুরের এমন ঈর্ষণীয় সাফল্যের মূলে রয়েছে ব্যবসাকেন্দ্র, যার দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি। বলা যায়, সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধির নেপথ্য মূলত বন্দরকে কেন্দ্র করেই। আমাদের বাংলাদেশেরও সমুদ্র বন্দর আছে। আমরা চাইলে এই বন্দরগুলোকে বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আর সত্যিই যদি তা পারা যায় তাহলে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের ধনী রাষ্ট্র হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
মঙ্গোলিয়া থেকে বিরল খনিজ পদার্থ ক্রয় হোক, আর বাংলাদেশে এয়ারবাস উড়োজাহাজ বিক্রয় হোক, এশিয়া অঞ্চলে ফ্রান্সকে তৃতীয় পরাশক্তি বা তৃতীয় পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেকদূর এগিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। বাংলাদেশে দুদিনের সফরের মাধ্যমে এশিয়া অঞ্চলে ফ্রান্সের কৌশলের নতুন রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন তিনি।
এশিয়ায় চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যখন মত্ত, তখন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে বিকল্প সহযোগী ও অংশীদার পরাশক্তি হিসেবে ফ্রান্সকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্রিয় মাখোঁ। মাখোঁর ভাষ্যমতেই, নব্য সাম্রাজ্যবাদের সম্মুখীন এ অঞ্চলকে ফ্রান্স একটি তৃতীয় পথের প্রস্তাবনা দিতে আগ্রহী। তাহলে বুঝতেই হয় যে, ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিবলয়ের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। বিষয়টি আরেকটু পর্যালোচনা করা যাক।
ইউরোপের সার্বভৌমত্ব ও কৌশলগত স্বতন্ত্রতা বৃদ্ধির কথা প্রেসিডেন্ট মাখোঁ বেশ অনেক সময়ব্যাপীই জোর দিয়ে বলে আসছেন। ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও পরাশক্তিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষাপট যখন বিস্তর পরিবর্তনশীল, তখন কৌশলগত স্বতন্ত্র ইউরোপের অপরিহার্যতা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলেই মনে করেন ফরাসি কূটনীতিকরা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক ভূমিকার ক্ষেত্রে এ বিষয়টা আরো জরুরি হয়ে উঠেছে বলেই ফরাসি প্রশাসনের বিশ্বাস। ২০১৯ সালেই মাখোঁ ন্যাটো সংস্থার অকার্যকারিতার কথা বলেছিলেন। একই সুরে ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে ইউরোপের স্বতন্ত্রতা বৃদ্ধির প্রতি জোর দিচ্ছিলেন তিনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ন্যাটো নিয়ে তার মতবাদ কিছুটা পরিবর্তন হলেও ইউরোপের কৌশলগত স্বতন্ত্রতার বিষয়ে ফ্রান্সের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো অপরিবর্তিত। তবে, ইইউর অন্যান্য রাষ্ট্রের এই মতবাদে সন্তুষ্ট করতে ফ্রান্সকে এখনো অনেক বেগ পেতে হবে। কিছুদিন আগেই মাখোঁ ও জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্যারেনবাওয়ারের মধ্যে মতবিরোধের মধ্য দিয়েই ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মতভেদের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর গত প্রায় পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিবর্তনের ফলে ফ্রান্স অধিকতর সার্বভৌম ও কৌশলগত স্বতন্ত্র ইউরোপের কথা আরো জোর দিয়ে বলে এসেছে। তার মূল কারণ হলো ফ্রান্সের মতে, ভূরাজনৈতিক বিবর্তনের ফলে ইউরোপের নিরাপত্তা পরিস্থিতির কেবল অবনতিই হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের মাটিতে রাশিয়া সর্ববৃহৎ যুদ্ধের অবতারণা করাতে ইউরোপিয়ানদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতার দুর্বলতাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে বিষয়টা যেমন ইউরোপ নিয়ে ফ্রান্সের মতামতকে পোক্ত করে, তেমনি ন্যাটো নিয়ে ফ্রান্সের সন্দেহ ও শঙ্কা এখন অত্যন্ত অসঙ্গত ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আর যাই হোক, এখন আপাতত ইউরোপের সামরিকভাবে ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তাই বলে মাখোঁ পরোক্ষভাবে এখনো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মধ্যবর্তী টানাপোড়েনে ইউরোপের অযথা শিকার হওয়ার বিষয়টি ক্রমশই বলে চলেছেন। অর্থাৎ ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত এই বিশাল খেলায় ইউরোপ যে কেবল একটি দাবার গুটি, হয়তো গুরুত্বপূর্ণ একটি গুটি হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটা মাখোঁ যতটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছেন, সেটা হয়তো অন্যরা অনুধাবনই করতে পারছে না। ফ্রান্সের এই পররাষ্ট্রনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মতভেদের সঙ্গে আফ্রিকায় ফ্রান্সের প্রভাবের সংকোচন ফ্রান্সের জন্য আরো মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আফ্রিকায় প্যারিসের যেমন দৌরাত্ম্যের অবনতি হয়েছে, তেমনি ফ্রান্সের প্রতি আফ্রিকানদের ক্ষোভের বহির্প্রকাশ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর নেপথ্যে অনেক কারণই রয়েছে। গত কয়েক দশকব্যাপী আফ্রিকার ওপর ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ও অনেকাংশে সাংস্কৃতিক শোষণ অবশ্যই এর প্রধান কারণ। আফ্রিকায় ফরাসি উপনিবেশ-পরবর্তী সময়েও ফ্রান্স আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর ওপর যে অসঙ্গতিপূর্ণ ও অন্যায় শোষণ প্রক্রিয়া প্রণয়ন করেছে, তার ব্যাখ্যার জন্য আরো যে সময় ও জায়গা প্রয়োজন, সেটা এই লেখার পরিধিবহির্ভূত। তা নিয়ে আরেক লেখায় কথা বলা যাবে। এটা ছাড়া ফ্রান্সে ক্রমশ ডানপন্থিদের উত্থান এবং ফরাসি ভাষাভাষি আফ্রিকান রাষ্ট্র টোগো, চাদ, ক্যামেরুন, কঙ্গো-ব্রাজাভিল, গাবন- এসব রাষ্ট্রের একনায়কতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক আফ্রিকাতে ফ্রান্সের স্ববিরোধী আচরণের প্রমাণ বহন করে। একদিকে ফ্রান্স গণতন্ত্রের কথা বলে আরেকদিকে একনায়কতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করে। অদক্ষ ও অপ্রিয় সরকারের সঙ্গে একদিকে ফ্রান্স সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করে, অন্যদিকে ওই দেশের সুশীল সমাজ ও যুবক সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে। ফ্রান্সের এই বিপরীতমুখী আচরণ আফ্রিকানদের মুগ্ধ নয়, বৈকি বিরক্তই করে তুলেছে। আফ্রিকার যুবক সমাজ ফ্রান্সকে এখন দুর্নীতিবাজ সরকারব্যবস্থার ধারকবাহক মনে করে যে কেবল নিজ স্বার্থ সিদ্ধির প্রতি নিবিষ্ট। আফ্রিকার ও আফ্রিকান সমাজের সঠিক ও সম্যক উন্নয়নের বাস্তবায়ন যে ফ্রান্সের পক্ষে সম্ভব নয়, সেটা আফ্রিকানরা ক্রমশই অনুধাবন করতে পেরেছে।
মধ্যপ্রাচ্যেও পরিস্থিতি জটিল। লেবাননে পরিস্থিতি সমাধানের কোনো সঠিক পথ বা উত্তর আপাতত মাখোঁ কাছে নেই। লেবাননের সমস্যার জন্য মাখোঁ দেশটির রাজনৈতিক অভিজাতগোষ্ঠীকে দোষারোপ করায় ফ্রান্সের প্রতি তাদের মনোভাবের অবনতিই হয়েছে কেবল, কারণ তারাই এখন দেশটির শাসন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ধারকবাহক। আলজেরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও ফ্রান্সের সঙ্গে আলজেরিয়ার সম্পর্কের অবনতি করেছে। আর ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সমস্যা সমাধানের চেষ্টা ফ্রান্স অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। সুতরাং ফ্রান্স এখন আর গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার মূল্যবোধের কথা অতটা জোর দিয়ে বলতে পারে না। সৌদি আরব কিছুটা ও আরব আমিরাতের সঙ্গে বেশ সুসম্পর্ক বিদ্যমান ফ্রান্সের। এটুকুই ইতিবাচক কেবল! কিন্তু ফ্রান্সের ক্রমশ মুসলিমবিরোধী ঘরোয়া নীতিসমূহ সেখানে চিড় ধরাতে পারে। যেমনটা মুসলিম বিশ্বে ইতোমধ্যেই অনেকটা করেছে। আর সাম্প্রতিক স্কুলে মুসলিম পোশাক নিষিদ্ধ করা মুসলিমবিরোধী আরেকটি নীতি এই সুসম্পর্কে নতুন সমস্যার উদ্রেক করবে।
ফ্রান্সের রাজনৈতিক আলোচনায় এখন শরণার্থী ও অভিবাসীরা ফরাসি শত্রু, এবং ইসলাম ফরাসি মূল্যবোধের জন্য হুমকি- এ দুটো বার্তাই লক্ষণীয়। মানবাধিকারের প্রসারে সচেষ্ট ফ্রান্স এখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষী নীতি প্রবর্তনকারী হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠেছে।
মাখোঁর জন্য তাই প্রাধিকার হলো বৈশ্বিক পর্যায়ে ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কিছু নতুন ইতিবাচক পদক্ষেপ ও প্রয়াসের অবতারণা করা। জলবায়ু পরিবর্তন কাজ করার চেষ্টা করছে ফ্রান্স। বৈশ্বিক পর্যায়ে যুবক সমাজের জন্য পরিবেশ ও জলবায়ু গুরুত্বপূর্ণ প্রাধিকার। এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিয়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ফ্রান্সের সুখ্যাতি কিছুটা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন মাখোঁ। একই সঙ্গে বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার প্রসারের বিষয়টা মাখোঁর জন্য আরেকটি প্রাধিকার উদ্যোগ। ক্রমশ মেরুকরণের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার টেকসই ও স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্নের ও শঙ্কার কোনো শেষ নেই। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স এক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারলেও এককভাবে কোনো টেকসই পরিবর্তন করতে পারবে না। সুতরাং অন্যান্য রাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে বৈশ্বিক মতবাদ সৃষ্টিতেও ফ্রান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এই লেখাকালীনই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তুতি চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে নিশ্চয়ই ফ্রান্স এ বিষয়ে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব এড়িয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ের সংঘাত থেকে বিরত রাখতে ফ্রান্স, জার্মানির মতোই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এসব ক্ষেত্রেই মাখোঁ ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট। তবে বৈশ্বিক পর্যায়ে অবনতি হওয়া ফ্রান্সের সফট পাওয়ার পুনরুদ্ধার করতে হবে আগে।
এ জন্যই ফ্রান্স এখন এশিয়ার প্রতি মনোনিবেশ করেছে। মঙ্গোলিয়া, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও পাপুয়া নিউগিনি- এই চার দেশে এ বছর সফর করে ফ্রান্স এশিয়াতে তার প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশের যেসব খাতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের বিনিয়োগ রয়েছে, সেসব খাতে ফ্রান্সের বিনিয়োগ অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। পাঠকরা সে বিষয়ে ভালোই অবগত। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, মাখোঁর সফর করা বাকি তিন এশীয় রাষ্ট্র প্রায় একই রাজনৈতিক, এমনকি অর্থনৈতিকভাবেও বাংলাদেশের মতোই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
সেখানেও সরকারদলীয় নেতারা জনগণ ও বিশ্ববাসীর সমর্থন সংগ্রহ করতে মরিয়া। শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি রাজনৈতিক সমস্যায়ও জর্জরিত। মঙ্গোলিয়া ও পাপুয়া নিউগিনিতেও সুশাসনের সংকট ও সরকার পক্ষের সমর্থন ও অনেক ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পাপুয়া নিউগিনিতে অনুষ্ঠিত গত বছরের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই। নির্বাচনের ন্যায্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। মঙ্গোলিয়ার আর্থিক খাত বাংলাদেশের মতোই অপরিশোধিত ঋণে জর্জরিত। চীন ও রাশিয়ার মাঝখানে অবস্থিত মঙ্গোলিয়া তার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে যেমন দুশ্চিন্তায়, তেমনি সরকার পক্ষ জ্বালানি খাতে দুর্নীতির জন্য অভিযোগে জর্জরিত। ফ্রান্সের মাখোঁ যে সফরের জন্য এ চারটি দেশকে বেছে নিয়েছেন, তার নেপথ্যে একটি পরিষ্কার ছক লক্ষণীয়- যেসব সরকার পশ্চিমা সমর্থন পেয়ে নিজ রাজনৈতিক ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পারবে, ফ্রান্স সেসব রাষ্ট্রই বেছে নিয়েছে। ফ্রান্সের এই কৌশল বাছাইকৃত রাষ্ট্রগুলোর জন্য অনেক অর্থনৈতিক সুযোগ বয়ে আনার পাশাপাশি সরকার পক্ষের জন্য রাজনৈতিক সুবিধাও প্রদান করবে। বিশ্ব রাজনীতির চলমান মেরুকরণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফ্রান্সের এ কৌশল অবশ্যই ফলাফল বয়ে আনবে। যেমনটা আমরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি। এই কৌশল দিয়ে ফ্রান্স নিজেকে এশিয়াতে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ছাড়া তৃতীয় অংশীদার হিসেবে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে।
লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন’ বাংলা ভাষার দুর্দশার কথা চিন্তা করেই হয়তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন উক্তি করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলা ভাষা একটি পরিশুদ্ধ এবং পরিশীলিত ভাষা হোক। তাই আজ শত বছর পরও এই কথা অতি প্রাসঙ্গিক। বাংলা ভাষা কখন থেকে শুরু হয়েছে এবং কারা প্রথম শুরু করেছেন তার সঠিক কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। এটা থাকার কথাও না। কারণ ভাষার উৎপত্তি তো কোনো আনুষ্ঠানিতার মধ্য দিয়ে শুরু হয়নি। শুধু বাংলা ভাষা কেন, পৃথিবীর কোনো ভাষারই উৎপত্তিস্থলের কোনো সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ নেই। তখন ভাষার আদান-প্রদান বলতে যা বোঝানো হতো তা ছিল মুখের ভাষা এবং শরীরের ভাষা। কালে কালে তা সাংকেতিক ভাষা এবং লেখ্য ভাষায় রূপ নিতে থাকে। তা সেটা পাথরে খোদাই করেই হোক আর পাতায় লেখাই হোক। হোক তা ছালে-বাকলে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রসঙ্গ বইয়েও এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো দালিলিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে বাংলা ভাষা যে অতি প্রাচীন এবং হাজার বছরের প্রাচীন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রসঙ্গ বইয়ে বাংলা ভাষাতত্ত্বের ইতিহাস অংশে তা প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর বাঙালি যখন তার আবেগ-অনুভূতি ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে শুরু করেছে সেই সময়টিকে প্রায় ১৩ শ বছরের পুরোনো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত বাংলা ভাষার গাঁথুনি তখন থেকেই শুরু। আর সেটাকেই বলা যায় চর্চাপদ। যা পণ্ডিত হরপ্রসাদ সাস্ত্রী আবিষ্কার করেছেন।
নদী যেমন বহমান, ভাষাও তদ্রূপ। পরিবর্তিত হয়, পরিশীলিত হয়, ঋদ্ধ হয়। তাই বাংলা ভাষার পণ্ডিতগণ ভাষার গতি-প্রকৃতি-অবস্থানকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। শ্রেণিবিন্যাস করেছেন। এখন আমরা বাংলা ভাষাকে যে অবস্থানে পেয়েছি, যেভাবে ব্যবহার করছি এই সময়টাকে বলা হয় নব্য যুগ। মানে আধুনিক যুগ। এর আগে যে যুগ ছিল তার নাম ছিল মধ্য যুগ। মধ্য যুগের আগে যে যুগ ছিল সেটি ছিল সন্ধি যুগ। সন্ধি যুগের আগে যে যুগ ছিল তার নাম প্রাচীন যুগ। সব যুগেরই একটিই প্রয়াস ছিল, সেটা হলো বাংলা ভাষাকে লালন করা এবং মনে-প্রাণে ধারণ করা।
বাংলা সাহিত্যের চরমতম উত্থান ঘটে নব্য যুগে বা আধুনিক যুগে। এই যুগেরই শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি ১৫৭টি গীতি কবিতা সংকলিত করে নাম রাখেন গীতাঞ্জলি। যা ১৯১০ সালে কাব্যগ্রন্থ রূপে প্রকাশিত হয়। এটিই পরে ‘সং অফারিংস’ নামে ইংরেজি অনুবাদ করা হলে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করে। যার মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন বিশ্ব কবি, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি। বাংলা ভাষাকে গানের মাধ্যমে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ছাড়া আরও যারা অবদান রেখেছেন তারা হলেন লালন শাহ, কাজী নজরুল ইসলাম, হাসন রাজাসহ নানা সংগীত সাধক, কবি ও সাহিত্যিক।
ভাষা ও সংস্কৃতি একটি জাতির প্রধান অনুষঙ্গ। পৃথিবীর কোনো দেশই তার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বাইরে নয়। তাই পৃথিবীতে দেখা যায় শত শত জাতি-গোষ্ঠী শত শত ভাষা-সংস্কৃতি। এটাই ঐতিহ্য, এটাই তার অস্তিত্ব। আর সেই অস্তিত্বে আঘাত বা অবক্ষয় কোনোভাবেই ঘটতে দেয়া হয় না। মানুষ তার নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষায় ব্যাপৃত হয়ে ওঠেন।
পৃথিবীতে নানা সময়ই নানা আগ্রাসন দেখা দিয়েছে। সেই আগ্রাসন আগেও ছিল এখনো আছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ধুয়া তুলে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালেই আমাদের পূর্ব বাংলার ওপর শুরু হয় ভাষার আগ্রাসন। ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। ২১ মার্চ এ কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে পাকিস্তানের প্রধান কায়েদে আজম জিন্নাহ মূলত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ তখন সারা পাকিস্তানে উর্দু ভাষাভাষির লোকের সংখ্যা ছিল খুবই কম। মাত্র ছয় শতাংশের কাছাকাছি। সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হলো, যে জিন্নাহ ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রাভাষা হবে উর্দু সেই জিন্না নিজেও উর্দু ভাষায় কথা বলতেন না। তার মানে এটা পরিষ্কার যে, তার বাংলা ভাষার প্রতি বিরোধিতা ছিল শুধুই বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা। তাই বাঙালি জাতি এটা আঁচ করতে পেরে তার এই অযাচিত চাপিয়ে দেয়া অগ্রহণযাগ্য উর্দু ভাষা মেনে নিতে পারেনি। তাই জিন্নার এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই শুরু হলো ভাষার জন্য আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন। বাংলা ভাষার আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সেই ভাষা আন্দোলনে শহীদ হলেন আমাদের নিরীহ বাঙালি । প্রতিষ্ঠা লাভ করল বাংলা ভাষা। কিন্তু আগ্রাসন থেমে থাকল না। এবার ভিন্ন আগ্রাসন দেখা দিল। এই আগ্রাসন আমাদের স্বাধীনতার ওপর আগ্রাসন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তারও অবসান হয়। আমরা হই স্বাধীন জাতি।
বাংলা ভাষাকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় প্রথম ভাষণ দেন। যা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেন। বঙ্গবন্ধুর পর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
আধুনিককালে এসে বাংলা ভাষা যে আন্তর্জাতিকা লাভ করবে তা আমাদের কারও ধারণায় ছিল না। ভিন দেশে থেকেও যে মানুষ স্বদেশের ভাষার জন্য কাজ করবে সেটাও ছিল ধারণার বাইরে। রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম দুজনেই বাস করেন কানাডার ভ্যাংকুবার শহরে। নিজেদের তাড়না থেকেই তারা ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য জাতিসংঘের মহাসসচিব কফি আনানের কাছে আবেদন করেন। সেই আবেদন বিফলে যায়নি। পরের বছরই ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর প্যারিস অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আর ২০১০ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বিশ্বব্যাপী তা পালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে দাপ্তরিক কাজে যাতে সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয় তার জন্য ১৯৮৭ সালে একটি আইন সংসদে পাস করা হয়। সেই আইনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব ও অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিতে হবে। এবং বাংলা বাদে অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করলে তা বেআইনি বা অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে।’ এই আইন পাস করার পরও ৩৭ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। কিন্তু এই আইনের যথাথ প্রয়োগ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। এখানে ভাষা শহীদদের আত্মদানকে অবমাননা করা হয়েছে। যা মোটেও কাম্য নয়।
‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বর্তমান বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ভাষার মাসে মাসব্যাপী চলে বইমেলা। পৃথিবীর মধ্যে এটাও একটা বড় নজির যে, ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে মাসব্যাপী বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। শত শত প্রকাশক তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে হাজির হন একুশের বইমেলায়। বইমেলা সারা মাস প্রাণবন্ত থাকে লেখক-প্রকাশক-পাঠক আর দর্শনার্থীদের ভিড়ে। প্রতি বছর শত শত নতুন বই প্রকাশিত হয়, আর হাজার হাজার বই বিক্রি হয় এ মেলায়। যা বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার এক চিরন্তন প্রয়াস।
ভাষার জন্য সংগ্রাম করা, ভাষার জন্য জীবন দেয়া এবং সেই ভাষাকে মাতৃভাষা বা রাষ্ট্রভাষায় প্রতিষ্ঠিত করার নজিরও পৃথিবীতে হয়তো আর দ্বিতীয়টি নেই। একুশ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ তথা সারা বিশে^ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। যেটা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়, অনন্য মর্যাদায়। এখন দরকার এই ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করা, আরও ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটানো। মনে সন্তুষ্টি জাগে এই ভেবে যে, নিজ দেশে ভাষা বিকৃতির নৈরাজ্য চলার পরও পৃথিবীর নানা দেশে বাংলা ভাষা চর্চার আগ্রহ বাড়ছে। যেখানে পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, সেখানে বাংলা ভাষা চর্চার আগ্রহ বাড়া সুখবরই বটে। একটা গানে আমরা শুনতে পাই ‘আমরা বাঙালি ছিলাম রে’। ভিন দেশি বাদ্যযন্ত্রনির্ভর ভিন দেশি গানচর্চার আধিক্যের কারণেই এই গান গাওয়া। যা আমাদের ভিন দেশি সংস্কৃতি থেকে ফিরে আসতে আহ্বান করে। আমরা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি লালন করব এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি প্রদান করে বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে হুলস্থূল কাণ্ড ফেলে দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন বিবৃতিদাতারা। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও আইন-কানুনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকি প্রদানের জন্যই বিবৃতিটি এসেছে। এ কথাও বাস্তবিক অর্থে সত্য যে, ড. ইউনূসের প্রত্যক্ষ আবেদন ও অনুরোধে বিবৃতিটি বিবৃতিদাতারা প্রদান করেছেন। তবে বিবৃতিটি যদি ড. ইউনূসকে নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে বিষয়টিকে একটি দৃষ্টিকোণ দিয়ে আলোচনা করা যেত। কিন্তু এর সঙ্গে যখন বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে ইঙ্গিত প্রদান করা হয়, সে ক্ষেত্রে বিষয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের সংযুক্তির বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। যেহেতু বিবৃতি ড. ইউনূসের অনুরোধে এসেছে কিংবা বিশ্বনেতাদের পক্ষ থেকে ড. ইউনূসের বিষয়ে এসেছে, সেহেতু নির্বাচনের ব্যাপারেও ইউনূসের আগ্রহকে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বনেতারা মন্তব্য প্রদান করেছেন।
এর মানে বিষয়টি দাঁড়ায়- বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইউনূসের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে, বিদেশি হস্তক্ষেপে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে চান। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ড. ইউনূসের কাছে প্রস্তাব এসেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হওয়ার, কিন্তু এত অল্প সময়ের জন্য তিনি সরকারের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তার মানে দাঁড়ায়, রাজনীতিতে ড. ইউনূস ব্যাপক আগ্রহ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়নের সময় শীর্ষ রাজনীতিবিদরা যখন জেলে সে সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে ড. ইউনূস রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করেন এবং পত্রিকাতে খোলা চিঠি লিখে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তার এ বিষয়টিকে চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং শেষমেষ তিনি তার আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে সরে আসেন এবং দেশে ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রামের ভিত্তিতে ৩ মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২ বছর অতিক্রান্ত করে নির্বাচন আয়োজনে বাধ্য হয়।
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় বিবৃতিকে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছেন এ দেশের জনতা। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন ড. ইউনূস, এ ধরনের কাজ একজন নোবেলবিদ কীভাবে করতে পারেন, সে বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আপামর জনসাধারণ। দেশের বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে প্রকাশ্যে বিশ্বনেতাদের বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক সময় দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গোপনীয়তা রক্ষা করে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সঙ্গে বিশ্বনেতাদের আলাপচারিতা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু যেভাবে একেবারে প্রকাশ্যে বিচারকাজ বন্ধে বিশ্বনেতাদের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রদান করা হলো তা চরম ধৃষ্টতার শামিল। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন এবং অ্যাটর্নি জেনারেল সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ঘটনার ফ্যাক্ট না জেনেই বিশ্বনেতারা এমন মন্তব্য করেছেন। মামলার প্রকৃত ঘটনা জানলে বিশ্বনেতারা কখনোই এ ধরনের বিষয়ের সঙ্গে জড়িত হতেন না।
ড. ইউনূস একজন সম্মানিত ব্যক্তি, তিনি কীভাবে এ ধরনের কাজ করেন বিষয়টা কোনোভাবেই মেনে নেয়ার মতো নয়। যে বিষয়গুলো নিয়ে মামলা হয়েছে, মামলার ফ্যাক্ট বুঝে তিনি আইনজীবী নিয়োগ করে আইনগত প্রক্রিয়ায় মামলা মোকাবিলা করবেন- বিষয়টি এমন হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি উল্টো কাজটি করলেন, দেশের বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মানসেই তিনি বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে বিবৃতি নিয়ে আসলেন। অথচ কিছুদিন আগে রাজস্ব বোর্ডের মামলায় কর ফাঁকির অভিযোগে ড. ইউনূসকে সাড়ে ১২ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। তাহলে ধরে নেয়া যায়, চলমান মামলাতেও তিনি পরাজিত হবেন সে আশঙ্কা থেকেই তিনি বিবৃতি নিয়ে এসেছেন। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতাদের দায় রয়েছে এবং তাদের ইমেজও ক্ষতিগ্রস্ত ও খাটো হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, অন্যান্য জায়গায় তাদের ভূমিকা নিয়ে মানুষ প্রশ্ন তুলছে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে- ড. ইউনূস বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের নাগরিক। তিনি বাংলাদেশে রাজনীতি করবেন এটা একটি স্বাভাবিক ইচ্ছা এবং কোনোভাবেই দোষের নয়। কিন্তু দোষের হচ্ছে তিনি বাংলাদেশে রাজনীতি করবেন বিদেশিদের ফর্মুলায়। এটি কি কোনোদিন বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে, যেমনটি মেনে নেয়নি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ড. ইউনূসের প্রচেষ্টাকে। আবার এটিও বলা যায়, রাজনীতিতে আগ্রহের বিষয়ে তিনি যে সময়কালকে বেছে নেন, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বনেতাদের বিবৃতিতে এটি খুব সহজেই প্রতীয়মান হয়, রাজনীতিতে ইউনূসের আগ্রহ রয়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রণীত হলে ইউনূসের রাজনীতিতে সম্পৃক্তায়নের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। না হলে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচার বন্ধের পাশাপাশি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিশ্বনেতাদের বিবৃতি প্রদানের কথা নয়। কাজেই বিষয়গুলো কিন্তু একটির সঙ্গে অন্যটি পরিপূরক এবং বাংলাদেশের মানুষ এ বিষয়গুলোতে অবগত যে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় প্রত্যেককে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, দেশের স্বার্থে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।
তা না হলে বিদেশিরা বাংলাদেশকে আঁকড়ে ধরতে পারে, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে পারে। মোটামুটিভাবে বাংলাদেশের মানুষ এ ক্ষেত্রে সজাগ ও সচেতন, বিদেশি প্রভাবকে তারা কখনোই মেনে নেবে না। বাংলাদেশের সরকারপ্রধানও সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, দেশ পরিচালিত হবে দেশের আইন-কানুনের মাধ্যমে, কোন বিদেশি ফর্মুলায় দেশ পরিচালিত হতে পারে না। বিদেশিরা ড. ইউনূসের পক্ষে বিৃবতি দিয়েছেন সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার কিন্তু বিদেশিদের বিবৃতিতে বিচারকাজ কখনো বন্ধ হতে পারে না। উল্টো তিনি বিদেশিদের ইউনূসের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের পরামর্শ প্রদান করেছেন।
বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে একটি পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জায়গায় বিদেশিরা সরাসরি তত্ত্বাবধায়কের কথা না বলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজনের জন্য দেন-দরবার করছেন। আবার এর মধ্যে পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় অনেকেই বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানাচ্ছে। পক্ষগুলোর দাবি মূলত অনির্বাচিতদের হাতে সরকারের শাসনভার ন্যস্ত করে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করা। অবশ্য নির্বাচন নিয়ে কাজ করে দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে অভিজ্ঞ এমন অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পূর্ব অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়কে ফিরে যাওয়া কোনোভাবেই সমীচীন হবে না।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও বারবার বলছেন, দেশের প্রচলিত আইন মেনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়কের কোনো বিধান নেই, সরকার নির্বাচন কমিশনের জন্য নতুন আইন করেছে। নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা রয়েছে এবং ইতোপূর্বে বর্তমান কমিশন গ্রহণযোগ্য বেশ কিছু নির্বাচন আয়োজন করেছে। সে জায়গায় বিদেশিদের নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার তাগাদার ব্যাপারটি সরকার আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ড. ইউনূসের পক্ষে বিদেশিদের বিবৃতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন উঠে আসায় বিষয়টিতে অনেকেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে। বিষয়টি যদি ড. ইউনূসকে নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে এক কথা ছিল কিন্তু বিষয়টি আরও অনেকদূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে বিধায় ষড়যন্ত্রের আভাস পরিলক্ষিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। আবার লবিস্টের মাধ্যমে বিবৃতি প্রদানের বিষয়ে প্রায় সবাই অবগত, এ জায়গায় এমনটিও হয়ে থাকতে পারে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশের জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচন সামনে রেখে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হতে পারে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই এ দেশের জনসাধারণকে সচেতন থাকতে হবে, দেশবিরোধী চক্রকে প্রতিহত করতে হবে। সরকারকেও দুষ্ট চক্র দমনে উদ্যোগী হতে হবে, যেকোনো মূল্যে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত রাখতে হবে। বিদেশি কোনো অপশক্তির হাতে বাংলাদেশ কখনোই মাথা নত করতে পারে না। শিরদাঁড়া উঁচু করে বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত সোপানে অগ্রসর হবে আগামী দিনে- আমাদের এমনটিই প্রত্যাশা।
লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমরা আজ যে গৌরবের বাংলাদেশ নিয়ে গর্ব করছি, সেই দেশ জন্মের শুরু থেকেই গৌরবের বাংলাদেশ হিসেবে পথচলা শুরু করে অর্ধ শতাব্দী পার করে সামনে এগিয়ে চলছে। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক নেতৃত্বে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে যেভাবে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, তার নজির পৃথিবীতে বিরল। এটিই গৌরবের বাংলাদেশ এবং এখান থেকেই আজকের গৌরবের বাংলাদেশের পথচলা। তবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে, এই গৌরবের বাংলাদেশেও কিছু কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার কলঙ্কজনক অধ্যায়ের গ্লানি আমাদের বয়ে চলতে হবে আজীবন। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারার উল্টোপথে চালিত করা এবং মাঝের দেড় দশকের সামরিক শাসন না থাকলে গৌরবের বাংলাদেশ আরও উন্নত অবস্থানে থাকতে পারত। তার পরও অনেক উত্থান-পতনের পর এবং অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের হাল ধরায়, বিশেষ করে বিগত দেড় দশক একটানা রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পাওয়ায় দেশের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। এক সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তকমা দেয়া তলাবিহীন ঝুড়ি তার জীবদ্দশাতেই আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে এবং এটাই হচ্ছে আমাদের গৌরবের বাংলাদেশ।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব এবং সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক খাতে ব্যাপক উন্নতি সাধন করতে পেরেছে। এই উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে দেশের সর্বত্র। প্রায় সব সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে যথেষ্ট সন্তোষজনকভাবে। জিডিপির আকার যেমন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই সঙ্গে মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় তিন হাজার ডলারের কাছে পৌঁছে গেছে। যদিও বিগত তিন বছর উন্নয়নের গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে, কারণ দুই বছরের করোনা মহামারি এবং গত বছর থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সমগ্র বিশ্বই একটি সংকটকাল অতিক্রম করছে, যার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক এবং পড়েছেও। বিশেষ করে ডলার সংকট এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে। তারপরও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে এবং প্রবৃদ্ধির হার এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ছয় শতাংশের ওপরেই আছে, এটাই আশার কথা।
একটি বিষয় এখানে খুবই প্রণিধানযোগ্য, তা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে, তা মূলত সম্পন্ন হয়েছে বিগত ১৫ বছরে। অথচ এই ১৫ বছরে বিশ্ব অর্থনীতি যে পুরোমাত্রার ভালো অবস্থানে ছিল তা মোটেই বলা যাবে না। ২০০৮ সালের আমেরিকায় সারপ্রাইম মর্টগেজ কেলেঙ্কারির কারণে সেখানে মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, যা মুর্হূতের মধ্যে সমগ্র বিশ্বে, বিশেষকরে ইউরোপের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। উন্নত দেশগুলোর সরকার সর্বশক্তি নিয়ে এই মন্দা মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বেইল-আউট প্যাকেজের নামে শত শত বিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে ঢেলে শেষ রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। এত ব্যাপক সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে মন্দা আটকানো গেলেও অর্থনীতি সেভাবে আর কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। অধিকাংশ উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতি সুদের হার বা বেঞ্চমার্ক রেট শূন্যের কাছে রেখেছিল সেই ২০০৮ সাল থেকে, কিন্তু তারপরও তাদের অর্থনীতি মন্দা-পূর্ববর্তী অবস্থায় কখনোই ফিরে যায়নি। এ রকম একটি প্রতিকূল বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থায় বাংলাদেশ এই অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। এখানেই বাংলাদেশের উন্নতির বিশেষত্ব, যা অনেকেই সেভাবে বিবেচনায় নেয়ার চেষ্টা করে না।
দেশের এই অভূতপূর্ব উন্নতি যে এমনি এমনি হয়েছে, তেমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এই উন্নতির পেছনে রয়েছে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্ত। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর নেতৃত্বে ছিলেন এবং তিনি যথেষ্ট সাহসিকতার সঙ্গে কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ উন্নতির এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছে। বিশেষ করে তিনি দেশে অবকাঠামো নির্মাণে বৈপ্লবিক সব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অসংখ্য সাধারণ মানের অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি প্রায় এক ডজনেরও বেশি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদি সব অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এসব মেগা প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে (১) পদ্মা সেতু, (২) ঢাকায় মেট্রোরেল, (৩) এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, (৪) বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল, (৫) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, (৬) পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, (৭) কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ, (৮) চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, (৯) যমুনা নদীর ওপর পৃথক স্বতন্ত্র রেলওয়ে ব্রিজ নির্মাণ, (১০) দেশের মহাসড়ক চার এবং ছয় লেনে রূপান্তর, (১১) দেশের অধিকাংশ অঞ্চল রেলপথের আওতায় নিয়ে এসে ডাবল লাইন নির্মাণ, (১২) কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক মানের বৃহত্তম বিমানবন্দর নির্মাণ, এবং (১৩) দেশব্যাপী ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট লাইন স্থাপন। এসব মেগা প্রকল্প যে শুধু গৃহীত হয়েছে এবং উদ্বোধন করা হয়েছে এমন নয়, যা একসময় আমাদের দেশে চিরাচরিত রেওয়াজ ছিল। এসব দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্যে গৃহীত মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত গতিতে একযোগে এগিয়ে চলেছে। বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে চালুও হয়েছে। যার মধ্যে পদ্মা সেতু, ঢাকার মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অন্যতম। খুব শিগগির কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের কাজ এবং বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ হবে এবং জনগণের ব্যবহারের জন্য খুলেও দেয়া হবে বলেই জানা গেছে।
এক দশক সময়ের মধে এতগুলো দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করার নজির সমসাময়িক বিশ্বের আর কোনো দেশে আছে কি না আমার জানা নেই। উন্নত-অনুন্নত অনেক দেশ একটি বা দুটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতেই হিমশিম খায়। আমার জানামতে বাংলাদেশ ছাড়া বর্তমান সময়ে বিশ্বের আর দুটি দেশে আধুনিক ট্রানজিট সিস্টেম নির্মাণের উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছিল এবং সেগুলো হচ্ছে কানাডার টরন্টোতে লাইট-রেল এবং চিলির রাজধানী সান্টিয়াগোতে মেট্রোরেল। টরন্টো লাইট-রেল প্রকল্প শুরু হয় ২০০৭ সালে। ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল নেটওয়ার্ক নির্মাণ করার ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩.৫০ বিলিয়ন ডলার এবং নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে এবং সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। একাধিকবার পিছিয়ে ২০২২ সালে চালু হওয়ার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হয়নি। এখন কর্তৃপক্ষ আর নির্দিষ্ট করে জানাতে পারছে না যে, কবে নাগাদ এটি চালু হবে। ইতোমধ্যে এর নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৪০ বিলিয়ন ডলার। চিলির রাজধানী সান্টিয়াগোতে ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০১৭ সালে। নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২.৫০ বিলিয়ন ডলার। এই লাইন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৭ সালে। এর বাইরে সে রকম উল্লেখযোগ্য বৃহৎ এবং দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের খবর আমরা সেভাবে শুনিনি।
অবকাঠামো সম্পর্কে অর্থনীতিতে একটি তত্ত্ব আছে যে, অবকাঠামো হচ্ছে দেশের উন্নয়নের সোপান। অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়ে থাকে। অবকাঠামো কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি শুধু নিশ্চিতই করে না, এই উন্নতি ত্বরান্বিতও করে। যত বেশি অবকাঠামো, তত বেশি উন্নতি। অবকাঠামো তৈরি করতে পারলে, তাকে কেন্দ্র করে বাকি উন্নতি এমনিতেই হতে থাকবে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি অনেক বেশি পরিষ্কার হবে। একটি হতদরিদ্র এবং পশ্চাৎপদ গ্রাম, যেখানে একটি ভালো রাস্তাও নেই, সে রকম একটি গ্রামে যদি একটি ভালো রাস্তা করে দেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে সেই গ্রামের বাসিন্দারাই নিজ উদ্যোগে রাস্তায় অনেক যানবাহন নামাবে ভাড়ায় চালানোর জন্য। সেখানকার মানুষের চলাচলে গতি আসবে, রাস্তার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠবে অনেক হাটবাজার, গ্রামের উৎপাদিত পণ্য অনেকে শহরে নিয়ে বিক্রি করবে, আবার অনেকে শহর থেকে শিল্পজাত পণ্য এনে গ্রামে বিক্রি করবে। এতসব কর্মকাণ্ডের কারণে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে। ফলে সেই গ্রামে দ্রুত উন্নতির ছোঁয়া লাগবে এবং গ্রামের চেহারাই বদলে যাবে। একই অবস্থা একটি দেশের ক্ষেত্রে। যে দেশে অনেক বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব হবে, সেই দেশ তত বেশি উন্নতি করবে এবং দেশের চেহারাই একসময় বদলে যাবে। অর্থনীতির এই মূলমন্ত্রটি পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো খুব ভালোভাবে রপ্ত করতে পেরেছে এবং তারা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নতমানের দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এই কারণে সেসব দেশ উন্নতিও করেছে যথেষ্ট। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনীতির এই মূলমন্ত্র সেভাবে রপ্ত করতে পারেনি। এদিক থেকে বিগতদের যুগে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই ব্যতিক্রম। এই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটানা দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছেন এবং তিনি যথার্থই অর্থনীতির এই তত্ত্বের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। আর এ কারণেই তিনি অসংখ্য মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে উন্নত বিশ্বের আদলে সব অবকাঠামো নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে একটি-দুটির বেশি দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি, সেখানে বাংলাদেশ এতগুলো দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্যে মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে তার সফল বাস্তবায়ন কাজ শেষ করে এনেছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি চালুও হয়ে গেছে এবং জনগণ তা থেকে ব্যাপক সুবিধা পেতে শুরু করেছে। বাকিগুলোর অগ্রগতি দৃশ্যমান এবং খুব সহসাই চালু হবে, ফলে সেখান থেকেও জনগণ সুবিধা পেতে শুরু করবে। গৌরবের বাংলাদেশের জন্য কিছু বিশেষ বিশেষ সময় আছে, যা নিয়ে সত্যিকার অর্থেই গর্ব করার মতো। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সময়কাল ছিল আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের দশক। আবার ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সময়কাল ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দশক। ঠিক তেমনি ২০১০ থেকে ২০২৩ সময়কাল হচ্ছে দেশে অবকাঠামো নির্মাণের দশক। বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, আর সেই স্বাধীন দেশে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিয়ে নির্মাণ করে দিয়েছেন অসংখ্য অবকাঠামো। বঙ্গবন্ধু চরম ত্যাগের বিনিময়ে যে গৌরবময় বাংলাদেশ আমাদের এনে দিয়েছেন, সেই গৌরবময় বাংলাদেশেই তাঁর সুযোগ্য কন্যা গড়ে তুলেছেন গর্ব করার মতো সব অবকাঠামো। এক কথায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত আমাদের গৌরবের বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্মিত গৌরবের অবকাঠামো।
লেখক: সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা