মানুষের মৃত্যু অবধারিত। যেকোনো বয়সেই মানুষ মারা যেতে পারে। অসুখ-বিসুখে ভুগে বা কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতিনিয়তই মারা যাচ্ছে অসংখ্য শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা ও অন্যান্য আপনজনের কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কিন্তু যখন বিষয়টি হয় আত্মহত্যার এবং সন্তান-সন্ততিরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তখন হিসাব একদম ভিন্ন। কারণ এই অপমৃত্যুর জন্য যতটা না দায়ী ওই শিক্ষার্থী, তার চেয়ে বেশি দায়ী মূলত অভিভাবক ও শিক্ষকরা।
গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এরা স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। এদের মোট সংখ্যা ৪৪৬। এই তথ্য জানিয়েছে বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন। তারা জানিয়েছে, এদের মধ্যে ২৭.৩৬ ভাগ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে পরিবারের সঙ্গে মান-অভিমান করে, ২৩.৩২ ভাগ প্রণয়ঘটিত কারণে, আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার কারণে ৪ ভাগ, শিক্ষকদের দ্বারা অপমানিত হয়ে ৬ ভাগ, গেম খেলতে বাধা দেয়ার জন্য ৭ ভাগ, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে না পেরে ২৭ ভাগ, মোবাইল ফোন না কিনে দেয়ার জন্য ১০ ভাগ এবং মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ার জন্য ৬ ভাগ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেয়। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, প্রায় ৬০ ভাগ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার সঙ্গে অভিভাবকদের আবেগ ও অজ্ঞতা কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে। শিক্ষকদের ভূমিকাও কম নয় এবং পরিবেশ-পরিস্থিতও শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখছে।
একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখব, ২০১৬ সালের ১ মার্চ সুদীপ্ত দত্ত অর্জুন মারা যায়। তার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না, আবার কেউ তাকে মেরেও ফেলেনি। তাহলে কী ঘটেছিল সুদীপ্তর জীবনে? ২ মার্চ দৈনিক পত্রিকায় সুদীপ্তকে নিয়ে একটি সংবাদ বেরোয়, যার মর্মকথা হলো- পিলখানার বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ত সুদীপ্ত। সামনেই ছিল তার এইচএসসি পরীক্ষা। কিন্তু পরিবার-পরিজন ও সহপাঠীদের সঙ্গে অভিমান করে সে ধানমন্ডি লেকের জলে ডুবে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সংবাদে খুব তাৎপর্যপূর্ণ তিনটি বিষয়ে ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছিল। প্রথমত, তার শারীরিক গড়নে সমস্যা ছিল। তাই সহপাঠীরা তাকে খোঁটা দিত। নিশ্চয়ই কোনো কোনো সহপাঠী তাকে নিয়ে ক্লাসে হাসাহাসিও করত। দ্বিতীয়ত, মা পড়াশোনার জন্য তাকে চাপ প্রয়োগ করতেন এবং তৃতীয়ত, কিশোরটি ছিল অন্তর্মুখী স্বভাবের। এসব বিরূপ পরিস্থিতির শিকার সুদীপ্ত দত্ত অর্জুন। আত্মহননের মাধ্যমে সে মুক্তির পথ খুঁজে নিয়েছিল। আর ২০১৮ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রি অধিকারী দু-একজন শিক্ষকের অদূরদর্শিতা ও অশিক্ষকসুলভ আচরণের এবং মা-বাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষার বলি হয়।
একজন সুদীপ্ত বা অরিত্রি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। কিন্তু আরও অনেক সুদীপ্ত-অরিত্রি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আমাদের প্রতিটি পরিবারে, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবং এই ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে এসে জানা গেল, ২০২২ সালে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে ৪৪৬ জন শিক্ষার্থী। কেন আমাদের এসব শিশু, কিশোর-কিশোরি আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে? এ ব্যাপারে অভিভাবকদের দায় কতটুকু এবং শিক্ষকদের ভূমিকাই বা কী?
তথ্য বলছে নানা রকম মানসিক চাপের মধ্যে এদের ওপর মূল চাপটি আসে পড়াশোনা নিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাসার ভেতরে পড়াশোনা নিয়ে মা-বাবা প্রচণ্ড চাপ দেন। এ ছাড়া ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পাড়ার চাপ, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনির্ভাসিটি এবং ভালো ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি হতে না পারা, প্রত্যাশিত বিষয়ে পড়তে সুযোগ না পাওয়া এবং কর্মসংস্থান না হওয়া বা বেকারত্বের যন্ত্রণাসহ নানা রকম চাপের মধ্যে থেকে কেউ কেউ এতটাই হতাশ হয়ে পড়ে যে, শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
বিবিসি থেকে নেয়া তথ্যের আলোকে বলি, ঢাকার একটি প্রখ্যাত স্কুলে পড়ে সাহানা ইসলামের মেয়ে। সাহানা জানিয়েছেন, তিনি না চাইলেও স্কুল আর সামাজিক চাপের কাছে অনেক সময়ই মাথা নত করতে হয় অভিভাবকদের। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে যে স্কুলে পড়ে, সেখানে প্রত্যেকটা স্টুডেন্টের নম্বর নিয়ে ভীষণ চাপ দেয়, সামান্য খারাপ করলেই বাবা-মাকে ডেকেও কথা শোনানো হয়। আর বাড়ি ফিরে আমরা বাবা-মায়েরা সেই চাপটাই আবার বাচ্চাদের ওপরে চাপিয়ে দিই - আরও পড়, আরও পড় বলতে থাকি।’
আরেকজন অভিভাবক বলেন, ‘এখন সমাজটাই এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে ভালো চাকরি, ভালো বেতন এগুলোই বাচ্চাদের বা তাদের বাবা মায়েদের লক্ষ্য হয়ে উঠছে। তাই ওই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বাচ্চারা সবসময়ই একটা চাপের মধ্যে থাকে। আবার বাবা-মায়েরাও নিজেদের অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলো সন্তানদের মধ্য দিয়ে পূরণ করতে চায়। যেটা আমরা করতে পারিনি, সেটা যেন ওরা করে দেখায়। সব মিলিয়ে বাচ্চাগুলোর জন্যে একটা ভয়ংকর অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে।’
ভালো রেজাল্টের সঙ্গে যেমন মা-বাবার মর্যদা জড়িত তেমনি স্কুলের মর্যাদা জড়িত। তাই তথাকথিত ভালো স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ বেশি থাকে। শিক্ষকদেরও অভিযোগ আছে। একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকা তার দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, বাচ্চাদের পড়াশোনা অথবা বড় হয়ে ওঠার প্রতি বাবা-মায়েদের নজরদারির অভাব এবং কোনো ক্ষেত্রে স্পষ্ট অবহেলাও থাকে। তিনি বলেছেন, ‘অভিভাবকদের সঙ্গে আমাদের বৈঠকগুলোতে দেখি, অনেক সময় বাবারা প্রায় আসেনই না। অনেক বাবা-মা তো আবার এটাও খেয়াল রাখেন না যে মেয়ের পরীক্ষা চলছে বা রেজাল্ট হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষায় খারাপ করলে যখন আমরা বাবা-মাকে ডেকে কথাগুলো বলি, তখন তারা বাড়ি ফিরে বাচ্চাদের বকাবকি করেন। একটা কথা অনেক বাবা-মাকেই বলতে শুনি যে, এত খরচ করার পরও কেন এ রকম খারাপ ফল হলো! এই কথাটা একটু বড় বাচ্চারা একদম নিতে পারে না।’ তিনি আরও বলছিলেন, ‘ওদের মনে তখন একটা জিনিস কাজ করে, যখন আমার প্রয়োজন ছিল বাবা-মায়ের সাহায্যের, তখন তারা কিছু বলেননি, কিন্তু ফল খারাপ হতেই খরচের প্রসঙ্গ তোলা হচ্ছে। স্কুলের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনই বাবা-মায়েদেরও নজর রাখা উচিত বাচ্চাদের বড় হয়ে ওঠার ওপরে।’
কলকাতার একজন শিশুমন বিশেষজ্ঞ সময়িতা ব্যানার্জি। তিনি গ্রাফোলজি, মানে হাতের লেখার সাহায্যে শিশুমনের চিকিৎসা করেন। বিবিসির অমিতাভ ভট্টশালী (২১ মার্চ, ২০১৮) তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘পড়াশোনার চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ কেন বেছে নিচ্ছে ভারতের হাজার হাজার শিশু’? সময়িতা ব্যানার্জি বলেছেন, “যে শিশু তার বাড়ির পরিবেশ নিয়ে খুশি, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটায় আনন্দে, মোটের ওপরে যার একটা ‘সুইট হোম’ আছে, তার যদি কখনো পরীক্ষায় খারাপ ফল হয়, সেটা সে সহ্য করে নিতে পারে। কিন্তু যেসব বাড়ির বা স্কুলের পরিবেশটাতেই গণ্ডগোল, বা যারা ইলেকট্রনিক মিডিয়াÑটিভি ইত্যাদি বেশি দেখে, এ রকম বাচ্চাদের স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়। এদের যখন ছোটখাটো ব্যর্থতা মোকাবিলা করতে হয়, তখন তাদের কাছে সেটা খুব কঠিন হয়ে যায়। আর সমস্যাটা যদি বড়সড় কিছু হয়, তাহলে সে আর মোকাবিলাই করতে পারে না। তখন চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।”
শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আবেগের জগৎকে মোটেই গুরুত্ব দেন না। অনেক সময় তারা অবিবেচকের মতো আচরণ করেন। তারা বুঝতেই চান না যে, আজকের অতি সংবেদনশীল শিক্ষার্থীর মনে তার উন্যাসিক আচরণ কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। একজন মোটা দেহের শিক্ষার্থীকে যখন স্কুল-কলেজের বিভিন্ন কর্নার থেকে ‘হাতি’ বলে অপদস্ত করা হয়, তখন শিক্ষকদের কষ্ট পেতে দেখিনি। এই উৎপীড়কদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও তারা গ্রহণ করেননি। অধিকন্তু কেউ কেউ খুব মজা পেয়েছেন এবং স্টাফ রুমে এসে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে হেসে কুটি কুটি হয়ে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন। আর সেই বিবরণের মধ্যে সব অপরাধ ওই শিক্ষার্থীর। আর ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী নিত্যদিনের এই যন্ত্রণা নিয়ে কী পড়ালেখা করবে, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কার কাছে আশ্রয় নেবে, কার কাছে বিচার চাইবে? এসব কিছুর দিকদিশা না করতে পেরে একসময় সে পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এসব ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কাছ থেকে যে মমত্ববোধ ও সহযোগিতা পাওয়ার কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা তা পায় না। ফলে তাদের পড়ালেখা বিঘ্নিত হয়, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করে এবং এমনকি কেউ কেউ আত্মহননের পথও বেছে নেয়। শিক্ষাঙ্গনের এই অপমানজনক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কী পরিমাণ শিক্ষার্থী প্রতি বছর স্কুল-কলেজ ছেড়ে চলে যায়, তার কোনো হিসাব আমাদের কাছে নেই। অথচ শিক্ষকগণ যদি সামান্য সচেতন হন তাহলেই রক্ষা পেতে পারে বিপুল শিক্ষার্থী।
আমাদের এই সব দুর্ভাগা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে একমাত্র শিক্ষকরা। এসব নিরাশ্রয়ী শিক্ষার্থীর খুব নির্ভরযোগ্য আশ্রয় হয়ে উঠতে পারেন শিক্ষকরা। আর এর অনিবার্য অস্ত্র হলো স্নেহ, ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। শিক্ষকদের স্নেহের হাত যদি আমাদের প্রতিটি শিক্ষার্থীর মাথা স্পর্শ করে তাহলে তাদের বিপথগামী হওয়ার আর কোনো পথ থাকবে না। অধিকন্তু তারা সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করার শক্তি অর্জন করবে এবং সুন্দরভাবে বিকশিত হওয়ার পথ খুঁজে পাবে।
অনেক শিক্ষার্থীর জন্য আবার নিজের পরিবারই একটি ভয়ংকর স্থান হয়ে ওঠে। পরীক্ষায় খুব ভালো ফলাফল করার জন্য তারা ছেলে-মেয়েদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। দিনের অধিকাংশ সময় তারা পোষ্যদের যন্ত্রণার মধ্যে রাখেন। ফলাফলভিত্তিক শিক্ষার এই কুফল সর্বদাই বর্তায় শিক্ষার্থীদের ওপর। অভিভাবকগণ অনেক সময় ভুলেই যান যে, তার পোষ্যটির জন্য বিশ্রামের প্রয়োজন আছে, বিনোদনের প্রয়োজন আছে, আছে তাদের সান্নিধ্য ও স্নেহের। স্নেহ ও ভালোবাসা বিবর্জিত পরিবেশে একজন শিক্ষার্থীর কী পরিণতি হতে পারে, তার পরিচয় আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক চরিত্রে। আপনজনদের কী বিস্ময়কর অনাদর, অবহেলা আর শিক্ষক ও সহপাঠীদের নিষ্ঠুর আচরণে তাকে পাড়ি জমাতে হয়েছে পরপারে। প্রায় শতাধিক বছর পরে আজও আমাদের পরিবারে এবং শিক্ষাঙ্গনে সেই অনুদার পরিবেশের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
কিন্তু এখন সময় এসেছে বিষয়গুলো ভেবে দেখার। আর কোনো শিক্ষার্থীকে, সন্তানকে হারিয়ে ফেলার পূর্বেই আমাদের পারিবারিক অঙ্গন ও শিক্ষাঙ্গনকে শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীরা যেন সর্বত্রই একটি আনন্দমুখর পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ঘরে শিশু-কিশোরদের উপযোগী প্রচুর বই ও পত্রপত্রিকা থাকা দরকার আর দরকার সন্তানদের প্রতি সহানুভূতি প্রসংশিত পরিবেশ। সন্তানদের প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভাববার দরকার আছে। কিন্তু তা যেন দুর্ভাবনা না হয়, সন্তানদের জন্য পীড়াদায়ক না হয়।
আমরা আমাদের সন্তানদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি। নিশ্চয়ই তারা ভালো মানুষ হবে এবং ভালো কিছু করবে। সুদীপ্তদের আমরা আর ফিরে পাব না। কিন্তু আমরা যেন তার বিদেহী আত্মাকে এইটুকু বলতে পারি, “সুদীপ্ত, সোনা আমাদের। তোমাকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। ক্ষমা করো আমাদের। তোমার মতো নিরানন্দ আর স্নেহবির্বজিত অবস্থায় আর যেন কেউ চলে যেতে না পারে তার জন্য আমরা একটি আনন্দিত গৃহাঙ্গন আর একটি আনন্দিত শিক্ষাঙ্গন তৈরি করব।”
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক
বিগত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের অর্জন কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে সবার প্রথমে যে কথাটি আসবে তা হলো ‘উন্নয়ন’। ১৫ বছরে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার যে কাজ করেছে, তার প্রশংসা বিশ্বজুড়ে। সরকারের এই অর্জনে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কালিমা লেপনের চেষ্টাও ছিল শুরু থেকেই। পদ্মা সেতু দুর্নীতি নিয়ে গুজব তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কিন্তু সব সমালোচনা ছাপিয়ে বিশ্বের বুকে ও সাধারণ মানুষের মুখে একটি কথা বেশ স্পষ্ট, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন করে দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ’।
নিশ্চিতভাবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্যভাবে যে বিষয়টি আসছে তা হলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য। কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর (পূর্বে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) নেতৃত্বাধীন ভয়ংকর ইসলামী শক্তিগুলো দেশের উন্নয়ন চায় না। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করতে পথে নেমেছে। গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে চলেছে, সেটা তাদের সহ্য হচ্ছে না।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতায় আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। ২০০৯ সাল থেকেই টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রেখেছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময়টুকু বাদ দিলে রপ্তানি বৃদ্ধিতে নতুন প্রতিবছর রেকর্ড গড়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিশ্ব অর্থনীতিতেই একটি বিরল কীর্তি স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। কারণ এই সময়কালে চীন বা প্রতিবেশী ভারতের রপ্তানিও উত্থান-পতনের সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল স্থিতিশীল ও টেকসই উন্নয়নের পথে।
বিএনপি-জামায়াত দেশকে অশান্ত করতে চায়। ২০২১ সালে যখন বিশ্ব অর্থনীতি ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন পর্যায় অতিক্রম করছিল, ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে বিবেচিত সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে লুট, অগ্নিসংযোগ এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে এই জামায়াত-বিএনপি। এখনো সেই চেষ্টা চলমান। বাংলাদেশে জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। তাই বিএনপি ও জামায়াতের হাত ধরে এ বছর সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চতুর্থ মেয়াদে পুনরায় নির্বাচন করার আর বাকি মাত্র দুই মাস। তাই ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশকেই রণাঙ্গনের চেহারা দিতে চায় তারা। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে সহিংসতা চালিয়েছে জনবিচ্ছিন্ন বিএনপি। নিরাপত্তাকর্মীদের হত্যা, সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহনে বাধা দেওয়া ও ধ্বংস- সবই করেছে তারা। তাদের আক্রোশ থেকে বাদ যায়নি অ্যাম্বুলেন্স অথবা শিশুখাদ্য বহনকারী ভ্যান। বাংলাদেশে শেষবার এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল ২০১৩-১৪ সালে। ২০১৫ সালেও চলে কিছু ধ্বংসযজ্ঞ। তখনো ছিল জাতীয় সংসদের নির্বাচন। সেই বছর জামায়াতকে দেশের সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে নিষিদ্ধ করেছিল।
এটা নিয়েও আপত্তি রয়েছে পশ্চিমা কিছু দেশের। তারা জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে সরকারের কাছে। অর্থাৎ সরকারকে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কথা বলছে তারা। কিন্তু এই একই দাবি কি তারা নাৎসি বাহিনীর জন্যও প্রদান করবে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিক দল হিসেবে সরাসরি তাদের নেতা-কর্মীরা খুন, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও জাতিগত নিধন থেকে শুরু করে জাতিসংঘ সনদ অনুসারে যতগুলো যুদ্ধাপরাধ রয়েছে তার প্রত্যেকটি করেছে জামায়াত ইসলামী। নাৎসি বাহিনীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের মিত্র বাহিনী যেই শাস্তির বিধান করেছে, তা যদি জামায়াতে ইসলামীর ওপর প্রয়োগ করা হয়, তাহলে শুধু রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না সেই শাস্তি। তাদের পরবর্তী বংশধররাও রাজনীতি বা দেশের নীতি-নির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। তারা করতে পারবে না কোনো সরকারি চাকরি। আর সেনা বাহিনীতে চাকরি পাওয়া তো অনেক পরের বিষয়। কিন্তু এত কঠোর শাস্তি কি জামায়াতে ইসলামকে দিতে পেরেছি আমরা? জামায়াতে ইসলামীর যদি খুনি হিসেবে মানবাধিকার থাকে এবং রাজনৈতিক অধিকার থাকে, তাহলে যারা খুনের শিকার হয়েছে তাদের মানবাধিকার কোথায়? সেটা কারা নিশ্চিত করবে? এ বিষয়ে পশ্চিমারা চুপ কেন? ইহুদিদের হলোকাস্ট নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি করলে বা বিকৃত করে কোনো তথ্য উপস্থাপন করলে ইউরোপের ১৩টি দেশে সরাসরি জেল এবং শাস্তির বিধান রয়েছে। তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যারা বিকৃতি করবে, তাদের জন্য শাস্তির বিধান কেন থাকবে না। ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার এই দেশে শহীদের সংখ্যা নিয়ে যারা বিভ্রান্ত ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির আইন ও তার প্রয়োগ আমরা কবে করব? মানবাধিকার কি শুধু পশ্চিমারা যা চায় তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ?
গণতন্ত্রের নামে সহিংসতা অবলম্বন অবশ্যই জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের অংশ এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতোই অপরাধ। বিএনপি-জামায়াত জোট জাতির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিরুদ্ধে কাজ করেছে এবং করে যাচ্ছে। আর এটি করার জন্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের আশ্রয় নেওয়ার ইতিহাস তাদের বহুদিনের। বিএনপি গঠন করেছিলেন সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমান (১৯৭৭-১৯৮১)। এটি এখন তার বিধবা স্ত্রী (খালেদা জিয়া) এবং ছেলে (তারেক রহমান) দ্বারা পরিচালিত হয়। উভয়ই আদালত কর্তৃক দুর্নীতিসহ একাধিক অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) দ্বারা সমর্থিত। জিয়াউর রহমান ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বরকে দমন করতে মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে দ্রুত বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের একটি ধারা তৈরি করেছিলেন জিয়া। পরবর্তীতে সামরিক শাসক এরশাদও ক্ষমতায় টিকে থাকার উদ্দেশ্যে ইসলামপন্থিদের সহায়তা অব্যাহত রেখেছিলেন। বিএনপিও একই উদ্দেশ্যে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে রেখেছে এবং ব্যবহার করেছে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিল জামায়াত। জামায়াতের ৫-৬ শতাংশ ভোট না থাকলেও এ সময় থেকে তাদের ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে তোলে বিএনপি। জামায়াত বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া অনেক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের স্নায়ুকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। হুজি-বি, জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ইত্যাদি সংগঠনের সঙ্গে জামায়াত ও বিএনপির যোগাযোগ ছিল। জঙ্গিবাদীদের অবাধ কার্যকলাপের রাস্তা করে দেয় এই জোট।
হুজি-বি ১৯৮০-এর শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা এবং ২০০১ সালের এপ্রিলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সময় বোমা হামলার জন্য জামায়াত তাদের ব্যবহার করে। জেএমবির জন্ম ১৯৯৮ সালে। তারা ২০০৫ সালের আগস্টে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। সরকারি কর্মকর্তা, বিচারক, এবং শিক্ষাবিদ, যারা গণতন্ত্র রক্ষা করছিলেন তারাই এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো দ্বারা আক্রান্ত হন। সমান্তরালভাবে জামায়াত ভারতেও সন্ত্রাস রপ্তানি করেছে। সরকারের অংশ হিসেবে, ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ সময়কালে, জামায়াত ভারতের উত্তর-পূর্বের জঙ্গিবাদীদের আশ্রয় দিয়ে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। আন্তর্জাতিক সতর্কতায় ২০০৪ সালে বাংলাদেশ থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে পাঠানোর সময় ১০ ট্রাক অস্ত্র বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
বাংলাদেশে গজিয়ে ওঠা জঙ্গিগোষ্ঠী নিয়ে যখন দেশের সব গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয় তখনো জামায়াত-বিএনপির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল- ‘বাংলা ভাই বলে কিছু নেই’। জঙ্গিদের অত্যাচারে দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ যখন ঘর বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে সে সময় সাংবাদিকরা এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন- ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুস’।
বাংলাদেশের দুইবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিএনপির খালেদা জিয়া জামায়াতকে তার সন্ত্রাসী ব্যবসা চালাতে সরাসরি সমর্থন দিয়েছিলেন এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকে হত্যা করেছিলেন। ২০০৪ সালে ভারতের একটি বড় সংস্থা বাংলাদেশে বহু বিলিয়ন ডলারের ইস্পাত কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিল। এখন পর্যন্ত এটি বাংলাদেশে দেওয়া সবচেয়ে বড় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই। খালেদা জিয়া প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করার আগে দুই বছর প্রস্তাব নিয়ে বসেছিলেন। অনানুষ্ঠানিক সূত্র বলছে, খালেদার ছেলে তারেক রহমান এই প্রকল্পের জন্য বিশাল অর্থ ঘুষ হিসাবে চেয়েছিলেন। সেই টাকা দিতে রাজি হয়নি ভারতীয় সংস্থাটি। তাই টালবাহানা করা হয়।
তারেক রহমানের দুর্নীতির প্রমাণ বাংলাদেশকে প্রদান করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এবং সিঙ্গাপুরের পুলিশ। দেশের আদালতে এ বিষয়ে এফবিআইয়ের পক্ষ থেকে সাক্ষ্যও প্রদান করা হয়। দেশের সব খাত থেকে চাঁদাবাজির জন্য তারেক রহমান ‘মি. টেনপার্সেন্ট’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এ বিষয়ে গোপন তার বার্তা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে অবহিত করে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি। উইকিলকসের ফাঁস হওয়া তার বার্তা থেকে এই তথ্য মেলে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে দেশে দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ ও দুঃশাসনে ভীত হয়ে সেই তার বার্তায় তারেক রহমানকে বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য হুমকি স্বরূপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। টানা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।
দুর্নীতি, দুঃশাসন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসসহ সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াতের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে একটি বেহাল অর্থনীতি পেয়েছিলেন। কিন্তু গত ১৫ বছরে সেই বেহাল অর্থনীতিকে হাসিনা পাঁচ গুণ বড় করেছেন। দমন করেছেন দুর্নীতি, দুঃশাসন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে। বাংলাদেশ আজ ভারতের পর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আইটিসি ট্রেড ম্যাপ মিররের তথ্যানুসারে, দেশের রপ্তানি ২০০৯ সালে ১৭ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২ সালে ৬৭ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ রপ্তানি প্রায় চারগুণ বেড়েছে। ২০২২ সালের জুনে বিশ্ব বাণিজ্য মন্দার সম্মুখীন হয়েছিল। এই সময়কালে বাংলাদেশ রপ্তানিতে প্রায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। ২০০৮ সালে ১০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি থেকে, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মুখে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ২৭ বিলিয়ন ডলারে স্থির হওয়ার আগে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়নে পৌঁছেছিল।
এটা বাস্তব, গত এক দশকে দেশটি অবকাঠামোয় বড় ধরনের সংস্কার করেছে। এর সবচাইতে বড় উদাহরণ পদ্মা সেতু। রাস্তা এবং রেলপথ থেকে শুরু করে বেসামরিক বিমান চলাচল পর্যন্ত, অবকাঠামোর প্রতিটি অংশ নতুন করে ভবিষ্যতের জন্য বিশাল বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করেছে। বিএনপি-জামায়াত এই সাফল্যই নষ্ট করতে চায়। তারা সহিংসতা ছড়িয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের বিদেশি ক্রেতাদের যাতায়াত বন্ধ করতে চায়। ডলারের প্রবাহ স্থগিত করারও চেষ্টা করছে তারা। চাইছে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দেশবাসীর সঙ্গে বেইমানি করে ফেলার জঘন্য পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। এখন অর্থনীতির যাবতীয় ক্ষতি সাধনের চেষ্টা রুখে দেওয়াটাই বড় কাজ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে জয়ী করার পাশাপাশি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শত্রু জামায়াত ও বিএনপির যাবতীয় ষড়যন্ত্রকেও প্রতিহত করাও জরুরি।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সময়কালে বাংলাদেশের অফুরান অর্জন, যা ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সদর্পে এগিয়ে চলছে ইউএনডিপির টেকসই লক্ষ্যমাত্রায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ’৭৫-পরবর্তী সময়ে উল্টোপথে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবারও উন্নতির শিখরে উঠতে শুরু করে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকার গঠন করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায় থাকার ফলে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায়, দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। গত ১৩ বছরে দেশের প্রতিটি খাতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মর্যাদাশীল উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ অর্জন করেছে। এটা আমাদের জন্য এক বিশাল অর্জন। বহু কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রায় বিশ্বের বিস্ময়।
দেশের অর্থনীতিকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি বর্তমান সরকারের অদম্য সাফল্য। গত এক দশকে বাংলাদেশের স্থিতিশীল জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন, এমনকি মহামারির সময়ও এ দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারাবাহিকতাকে নির্দেশ করে। আমরা এখন উন্নয়ন মহাযজ্ঞের সুবিশাল যাত্রা অতিক্রমের মহাসন্ধিক্ষণে অবস্থান করছি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানান সূচকে তার বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তিন হাজার ডলার। এ দেশের গড় জিডিপি ৭% প্রায়। শিক্ষার হার ৭৫% এবং শিশু শিক্ষার হার প্রায় ৯৯%। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, যার হার প্রায় শতভাগ। ১২১টি মেগা প্রকল্প এখন চলমান। জিডিপির আকার ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। আগামী ২০২৫ সালে তার আকার হবে ৫০০ বিলিয়ন ডলার।
অনেক অবধারিত উন্নয়ন শোভাবর্ধন করছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য অনেক। লিঙ্গ সমতা, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুন্দ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পগুলো সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপের কারণে।
শত বাধা-প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে দেশ আজ অনন্য স্থানে অভিষিক্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের দিন বদল হয়েছে। তিনিই বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছিলেন ‘রূপকল্প ২০২১’। গত দশকে দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক কর্মপরিকল্পনা দুর্বার গতিতে শুরু হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ, ঘরে-ঘরে বিদ্যুৎ এসবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ ও অবিচল নেতৃত্বে দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে উন্নয়ন কৌশল ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের ফলে। রূপকল্প ২০২১-এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয়েছে রূপকল্প-২০৪১। রূপকল্প-২০৪১-এর প্রধান অভীষ্ট হলো ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যেখানে আজকের মূল্যে মাথাপিছু আয় হবে ১২,৫০০ মার্কিন ডলারেরও বেশি এবং বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যেখানে দারিদ্র্য হবে সূদুর অতীতের ঘটনা।
চলতি বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে সারা জাতি এক পরম আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লড়াকু জীবন একসূত্রে গাঁথা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। আমাদের দেশের রপ্তানি পণ্য বলতে ভরসা ছিল শুধু পাট, অন্যটি চামড়া। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। মোট রপ্তানিতে পাট ও পাটপণ্যের অবদান ছিল ৮৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ডলারের মোট রপ্তানির মধ্যে পোশাকশিল্প খাত থেকে আয় হয়েছে ৩ হাজার ১৪৬ কোটি ডলার। বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে তৃতীয় অবস্থানে। ব্যবসাবান্ধব বর্তমান সরকার গার্মেন্ট সেক্টরে অনেক প্রণোদনা দিয়ে আসছে। যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে এই শিল্প। আমাদের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক খাত হচ্ছে প্রবাসীদের অর্জিত আয়। প্রতিদিন, প্রতি মাসে, প্রতি বছরে প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। তাতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রবাসীদের আয়ের হিসাবে সপ্তম স্থানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে প্রবাসী আয় হচ্ছে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯৪ ডলার। আর ২০২১-২২ সালে আমাদের মাথা পিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২৮২৪ মার্কিন ডলার। মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পরপর দুই বছর ধরে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্য বিমোচনে আমাদের অগ্রগতি হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৯ শতাংশ। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে তা দাঁড়ায় ২০ শতাংশ।
৫২ বছরে এসে জাতীয় বাজেটের আকার অনেক বেড়েছে। ১৯৭২-৭৩ সালে বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ সালের জাতীয় বাজেট হচ্ছে ৬ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। বৃহৎ এই বাজেট দেশের উন্নয়নে কাজে আসবে। উন্নয়নের ধারায় বাজেটের এই বৃদ্ধি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আমাদের জিডিপি ২.৫ শতাংশ। করোনা মহামারিকালেও আমাদের ২০২০-২১ সালে জিডিপি অর্জিত হয়েছে ৫.৪৭ শতাংশ। আমাদের রাজস্ব আয় বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের ১৯৭২-৭৩ সালে সর্বমোট রাজস্ব আয় হয় ১৬৬ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে আমাদের রাজস্ব অর্জিত হয় ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিশাল অর্জন। রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে ১ হাজার ৫৬৬ গুণ।
গত ৫২ বছরে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে কৃষিতে বিপ্লব হয়েছে। খাদ্যশস্য ১৯৭২ সালে উৎপাদিত হয় ১ দশমিক ২০ কোটি টন। আর ২০২০ সালে উৎপাদিত হয় ৪ দশমিক ২৫ কোটি টন। সবজি উৎপাদনে আমরা পৃথিবীর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছি। সবজি উৎপাদনে পৃথিবীতে প্রথম চীন এবং দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত। বর্তমানে আমরা নিজেদের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে সবজি রপ্তানি করছি। পাট উৎপাদনে এখন আমরা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছি। দেশে এখন নানা রকম পাট পণ্য তৈরি হচ্ছে, রপ্তানিও হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। করোনা মহামারির সময় স্বাস্থ্য খাতের চিত্র বিশ্বে ছিল অনুকরণীয়। শিশু সুরক্ষায় বাংলাদেশ এগিয়ে। বাংলাদেশের শিশুরা জন্ম নেয়ার পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ৯৭ শতাংশ বেঁচে থাকে। নবজাতক ও শিশুর মৃত্যুর হার কমেছে। বাংলাদেশের শিশু জন্ম নিতে প্রতি এক লাখ মায়ের মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে ১৭৩ জন। আমাদের গড় আয়ু বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু অনেক বেশি। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০২৩ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ দশমিক ৬ বছর। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু যথাক্রমে ৬৭ দশমিক ৭ বছর ও ৬৭ দশমিক ৩ বছর। বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতের সুফল মিলছে গড় আয়ুতে।
শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছে নানা পদক্ষেপ। শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম, নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত উপবৃত্তি ব্যবস্থা প্রশংসার দাবি রাখে। বর্তমান সরকার ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করেছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা প্রায় শত ভাগে।
সারা দেশ এখন উন্নয়নের বহুমাত্রিক কর্মপ্রকল্পে এগিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু টানেল জাতির ইতিহাসের এক ভিন্নমাত্রার নতুন চমক। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে দেশের ৪৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫০০০। দেশের সবকটি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় অনুষ্ঠিত ২৬তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৬) মূল অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সাহসী বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় দেশের এনডিসি আপডেট, ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশি বিনিয়োগে ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল এবং ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে নিজস্ব শক্তির ৪০ শতাংশ নেওয়াসহ তাঁর সরকার কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরেন। এ ছাড়াও তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ চালুকরণ প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন। বিশ্ব দরকারে শেখ হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা দিনে দিনে বাড়ছে, তিনি বিশ্বনেত্রীতে পরিণত হচ্ছেন।
সামনে বৈশ্বিক যে সংকট আসছে, এ নিয়ে উন্নত দেশগুলোও উদ্বিগ্ন। আমরা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অনেকটাই স্পর্শ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তাঁর উদাত্ত আহ্বানে ন্যূনতম কোনো ভূমি অনাবাদি না রেখে প্রতি ইঞ্চি জমির উর্বরতার যথার্থ ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া আগামী দিনের সম্ভাব্য খাদ্য সংকট উত্তরণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব বৈশ্বিক সংকট কাটিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, স্বাধীনতার পর গত ৫২ বছরে বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, তার সিংহভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের হাত ধরেই হয়েছে। আমাদের গর্ব ও গৌরবের এই ধারা অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। তাঁরই সুযোগ্য নেতৃত্বে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যেই ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে পরিণত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্যোতির্ময় অভিযাত্রা যেন কালো অধ্যায়কে আলোক ঝরনাধারায় উদ্ভাসিত করে দিল। এক অদম্য গতিতে অশুভ সংকেতের বাধা-বিপত্তিকে দুমড়ে-মুচড়ে উপড়ে ফেলে যেন নিষ্কণ্টক পথে অপ্রতিহত গতিতে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে চলছে।
লেখক : উপর্চায (চলতি দায়িত্ব), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমানে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা বাঙালি একটি সংগ্রামী ও সংগ্রামে ঐতিহ্যমণ্ডিত জাতি। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, গৌরব, সুখ, দুঃখ এবং বাংলার মাটি ও মানুষের সম্মিলিত রূপকে আত্মস্থ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি-বাংলাদেশের চূড়ান্ত মুক্তির যে পথ দিয়েছেন, সে পথের পূর্ণাঙ্গ তত্ত্বের নাম মুজিববাদ। সোনার বাংলা তার চূড়ান্ত রূপ। মুজিববাদের আলোকে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রভাবশালী ও নির্ভীক সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি। বঙ্গবন্ধুর পর তিনিই মুজিববাদের প্রধান ধারক-বাহক, তাত্ত্বিক ও প্রচারক। ১৯৩৯ সালে ৪ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় শেখ ফজলুল হক মণি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ নূরুল হক এবং মাতা শেখ আছিয়া বেগম। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ ইচ্ছায় রাজনীতিতে এসেছেন, বঙ্গবন্ধু মুজিব নিজে তাকে রাজনৈতিক দীক্ষা দিয়েছেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও তাকে স্নেহ করতেন। শেখ ফজলুল হক মণিও আজীবন রাজনৈতিক শিক্ষক মুজিবের দর্শন বাস্তবায়নে সচেষ্ট থেকেছেন।
১৩ মার্চ, ১৯৭৩ সালে একটি নিবন্ধে শেখ ফজলুল হক মণি বলেছেন, ‘এ সংগ্রাম অতি দুস্তর, মুজিববাদ কায়েমের সংগ্রাম অতি কঠোর সংগ্রাম।’ সেই কঠিন সংগ্রামকেই তিনি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। এ জন্য স্বাধীনতার সময় ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষকতার প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেননি, স্বাধীনতার পর মন্ত্রিত্ব বা ক্ষমতার চেয়ারেও বসেননি। মুজিববাদ বাস্তবায়নের জন্য তিনি আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, মুজিববাদের তত্ত্বীয় রূপ বিশ্লেষণের জন্য বারবার কলম ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের তরুণ নেতা-কর্মীদের মধ্যে পড়াশোনা, দেশসেবার দীক্ষা ও সাংস্কৃতিক চেতনা ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন।
শেখ ফজলুল হক মণির মৌলিকত্ব হচ্ছে তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পাশাপাশি স্বাধীন সমাজব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা মুজিববাদের অন্যতম দর্শন। তার মতে, ‘মুজিববাদের অন্যতম উৎস হচ্ছে সমাজবাদ।’ বঙ্গবন্ধুর ‘প্রস্তাবিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে গণতান্ত্রিক অধিকারকে বিলোপ করার প্রশ্ন ওঠেনি। তাকে সংরক্ষণ করার বিষয়টি অনুভূত হয়েছে সর্বতোভাবে। তাই মুজিবের সমাজবাদী বাংলাদেশ মূলত গণতান্ত্রিক। তার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সমাজবাদী। এটা ইতিহাসের এক নতুন ধারা। সামাজিক দর্শনের একটা নতুন সমন্বয়। এটা কোনোক্রমেই মার্কসবাদী নয়। কারণ মার্কস শুধু বস্তুবাদী, গণতান্ত্রিক নন। জাতীয়তাবাদী নন। এটা মাওবাদী নয়, কারণ মাও মূলত বস্তুবাদী ও জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক নন। এটা লিংকনবাদীও নয়। কারণ লিংকন জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক; সমাজবাদী নন। এটা নতুন এবং সে নতুনত্ব শেখ মুজিবের অবদান। তাই এটা মুজিববাদী।’ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মুজিববাদের চার মূলনীতি।
মুজিববাদের অন্যতম স্তম্ভ ছয় দফা। ১৯৭২ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘স্লোগান ছিল ছয় দফা, এখন চারটা স্তম্ভ।’ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছয় দফা কর্মসূচিকে জনপ্রিয় ও সফল করতে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন শেখ ফজলুল হক মণি। ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনসহ বাঙালির অধিকার বাস্তবায়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তিনি ’৭০-এর নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ওই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জয়লাভের অন্যতম কাণ্ডারিও বলা হয় শেখ মণিকে। মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে তিনি যে মুজিববাহিনী গঠন করেছিলেন, সে বাহিনীরও অন্যতম লক্ষ্য ছিল মুজিববাদের পথে স্বাধীনতা ও যুগপৎ সমাজ বিপ্লব বাস্তবায়ন করা।
মুজিববাদ একটি বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক মতবাদ। শেখ ফজলুল হক মণি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে একটি যুদ্ধ ও একটি সমাজ বিপ্লব যুগপৎ অনুষ্ঠিত হয়েছে।’ সোনার বাংলা কায়েম করার জন্য প্রয়োজন সেই বিপ্লবের সফলতা, যার একমাত্র পথ মুজিববাদ। মুজিববাদকে যথাযথ ব্যাখ্যার জন্য ‘মুজিববাদ দর্শন ও বাস্তবে’ শিরোনামে তিনি নিয়মিত কলাম লিখেছেন। পুঁজিবাদের অসম বিকাশ ও তার ক্ষতিকর দিক এবং ক্ষমতাচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্তদের ভুলত্রুটি চিহ্নিত করে তিনি মুজিববাদী মতবাদের আলোকে সমাধান ও মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। শেখ মণি অপ্রিয় হলেও সত্য ও স্পষ্ট কথা বলতেন। মিমিক্রি ভূমিকার সুবিধাবাদী ও মুখোশধারী রাজনীতিকদের তিনি চরমভাবে ঘৃণা করতেন। ৩০ নভেম্বর, ১৯৭৪ সালে এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘সাবোটাজকারীরা ক্ষমতার আশপাশে এমনই সুকৌশলে ও সুসজ্জিতভাবে জমজমাট বসিয়া রহিয়াছে যে, সাহায্য করিতে গেলেও দণ্ড ভোগ করিতে হইবে।’
সুবিধাবাদীরা অপব্যাখ্যা করলেও শেখ ফজলুল হক মণির সোনার বাংলা এবং মুজিববাদের পথ ধীরÑসংঘাতহীন। এ পথের বিপ্লব রক্তপাতহীন। এ বিপ্লবে সফলতার জন্য প্রয়োজন ধাপে ধাপে অগ্রসর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যাকে ‘সিস্টেম চেইঞ্জ’ বা ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ‘সোনার বাংলা’ ছিল তার লক্ষ্য এবং মুজিববাদ ছিল তার অন্তর্মূলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গৃহীত নতুন পদক্ষেপ বা দ্বিতীয় বিপ্লব বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই একদল খুনি, সামরিক-বেসামরিক ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে, স্ববান্ধব হত্যা করেছিল। ঘাতকরাও বুঝতে পেরেছিল, শেখ মণি জীবিত থাকলে মুজিবাদর্শবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্র বাংলার মাটিতে বাস্তবায়ন করতে পারবে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার কিছু আগে ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী আরজু মণিকে হত্যা করে খুনি ঘাতকচক্র। ভাগ্যগুণে প্রাণে বেঁচে ছিলেন দুই শিশু পরশ ও তাপস। খুনি হায়েনা দল ও তাদের দোসরদের হত্যা, লুটতরাজ ও সন্ত্রাসের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে কখনো আত্মীয়ের বাসায়, কখনো পলাতক থেকে, কখনো অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়ে বড় হয়েছেন শেখ মণির দুই সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস। তারা মানুষ হয়েছেন, ক্ষমতা পেয়েও মা-বাবার হত্যাকারীদের বিচার আইনের মাধ্যমে চেয়েছেন।
স্বল্পজীবনে শেখ ফজলুল হক মণি আমাদের অনেক দিয়েছেন। ছয় দফা আন্দোলনে, অসহযোগিতার সংগ্রামে, ’৭০-এর নির্বাচনে, মুক্তিযুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধোত্তর রাজনীতি, শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণ সর্বোপরি ‘সোনার বাংলা’ গঠনে। তার জীবনকাহিনি এবং দেশপ্রেমের সাহসী রাজনীতি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বরূপ, মুজিববাদের পরিপূরক এবং ‘সোনার মানুষ’ তৈরির অনন্য পথ। তার প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গ্রন্থ শুধু মুজিববাদের ঐতিহাসিক সম্পদ নয়, সে সময়ের রাজনীতি বিশ্লেষণেরও প্রামাণ্য দলিল। তাকে নতুন প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরা হলে জাতি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আরও বেশি শানিত, মুজিববাদের পথিকরা হবে সমৃদ্ধ, ‘সোনার বাংলা’ ও ‘সোনার মানুষ’ তৈরির পথ হবে পরিশীলিত। শেখ ফজলুল হক মণির জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ
খাদ্যনিরাপত্তা সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক উন্নয়ন ভাবনার আলোচনার শীর্ষে রয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে সহস্রাব্দের উন্নয়ন অভিলক্ষ ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে। এ দুটি অভিলক্ষের মূল উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী ‘ক্ষুধার অবসান’। এসডিজির ১৭টি অভিলক্ষের মধ্যে দুই নম্বরে স্থান পেয়েছে ‘ক্ষুধার অবসান’। অর্থাৎ পৃথিবীর সব মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে। খাদ্যের জোগানের পর্যাপ্ততা, খাদ্য পুষ্টিগুণসম্পন্ন ও নিরাপদ হওয়া এবং সব নাগরিকের খাদ্যের অধিগম্যতা বা প্রাপ্তি- এ চার মাত্রার সমন্বয়ই হলো খাদ্যনিরাপত্তা। এ ক্ষেত্রে খাদ্যের জোগানব্যবস্থা অটুট থাকা ও নাগরিকদের বাজার থেকে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনে খাওয়ার সামর্থ্য অর্জনই মূল কথা। খাদ্যের জোগান কেবল দেশজ উৎপাদননির্ভর নয়, অনেকাংশে তা বৈশ্বিক বাজার ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বসবাস। যারা ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি ভূখণ্ড থেকে এ বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের সংস্থান করা নিঃসন্দেহে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে সেই অসাধ্য সাধন করেছে বাংলাদেশ। দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় উন্নতি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্জন। খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিনিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা সরকারের আগামীর লক্ষ্য। বাংলাদেশের কৃষির এরই মধ্যে খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর ঘটেছে। আগামী দিনে রপ্তানিমুখী কৃষিতে আমরা অবস্থান করে নিতে চাই, যার জন্য বিপুল বিনিয়োগ তথা ঋণ প্রয়োজন। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাত্র চার শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণে গত বছর ৫ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে এবং এ তহবিল থেকে বড় ঋণ দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। এমন অবস্থায় প্রকৃত কৃষকদের ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করতে এখন থেকে এ তহবিলে সর্বোচ্চ ঋণ সীমা ২০ লাখ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ-সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সব ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা হয়। এ তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে এরই মধ্যে কিছু ব্যাংক বড় ঋণ দিয়েছে। এখন থেকে অধিক সংখ্যক প্রকৃত কৃষকের ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রাণিসম্পদ খাতে একজন গ্রাহকের অনুকূলে সর্বোচ্চ ঋণসীমা ২০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হলো।
ডলারসংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে গত বছরের নভেম্বরে এ পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখান থেকে ব্যাংকগুলো মাত্র শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ হারে সুদে অর্থ পায়। কৃষকপর্যায়ে সর্বোচ্চ সুদ নির্ধারিত আছে ৪ শতাংশ। বর্তমানে যেখানে কৃষি ঋণের সুদহার প্রায় ১০ শতাংশ। আর ব্যাংকগুলো তহবিল সংগ্রহে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। আবার কৃষি উৎপাদন বাড়াতে চলতি অর্থবছরে কৃষকদের ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেবে সরকারি-বেসরকারি সব বাণিজ্যিক ব্যাংক। নীতিমালা অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণের লক্ষ্য যা গত অর্থবছরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে কৃষি ঋণের লক্ষ্য ছিল ৩০ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। এবার চাহিদা বিবেচনায় চলতি অর্থবছরে মোট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ১২ হাজার ৩০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা, বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকগুলো মোট ৩২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণ করেছে, যা অর্থবছরের মোট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। টেকসই উন্নয়নের নির্ধারিত লক্ষ্যের প্রথম ও প্রধান তিনটি লক্ষ্য তথা দারিদ্র্যবিমোচন, ক্ষুধা মুক্তি এবং সুস্বাস্থ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে কৃষিঋণ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে ৩৩ লাখ ৪ হাজার ৮১১ জন কৃষক কৃষি ও পল্লি ঋণ পেয়েছেন। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব নেটওয়ার্ক ও এমএফআই লিংকেজের মাধ্যমে ৩৬ লাখ ১৮ হাজার ৫৪৫ জন ঋণ পেয়েছেন। ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৯৩৩ জন নারী ১২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লি ঋণ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ৫০ শতাংশ হতে হবে। আগে তা ছিল ৩০ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের কৃষি ও পল্লি ঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচিতে নতুন করে কয়েকটি বিষয় যুক্ত করা হয়। এর মধ্যে নতুন কৃষকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ বিতরণ করতে হবে। পল্লি অঞ্চলে আয়-উৎসারী কর্মকাণ্ডে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা হবে ৫ লাখ টাকা। ছাদ কৃষিতে অর্থায়ন করতে পারবে ব্যাংক। অর্থাৎ বাড়ির ছাদে বাগান করতে ঋণ পাবেন গ্রাহক। এ ছাড়া চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুঁচিয়া চাষে ঋণ বিতরণ করতে পারবে। মৎস্য খাতে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৩ শতাংশ এবং প্রাণিসম্পদ খাতে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে হবে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনা করে ব্যাংকগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ করতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর লক্ষ্যমাত্রার বাইরে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেড এবং বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন বোর্ড তাদের নিজস্ব অর্থায়নে যথাক্রমে ২৬ কোটি টাকা ও ১ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব নেটওয়ার্ক (শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং, কনট্রাক্ট ফার্মিং, দলবদ্ধ ঋণ বিতরণ এবং ব্যাংক-এমএফআই লিংকেজ) ব্যবহার করতে পারবে। এবারে প্রথমবারের মতো বেশ কিছু কৃষিপণ্যের জন্য ঋণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ছাদকৃষি, ভেনামি চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুঁচিয়া চাষ। শস্য ও ফল চাষের আওতায় কালো ধান, অ্যাভোকাডো ফল ও পাতি ঘাসের জন্যও ঋণ দেয়া যাবে। নারীসহ চরাঞ্চল, হাওর ও অনগ্রসর প্রত্যন্ত এলাকায় কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণে দেয়া হবে অগ্রাধিকার। বিশ্বব্যাপী বিরাজমান মন্দাবস্থা। ২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাসহ খাদ্যসংকট দেখা দেয়ার সতর্ক বার্তাও উচ্চারিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মহল থেকে। সেই আশঙ্কা আমলে নিয়ে বর্তমান সরকার সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে দেশেই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর। ধান-চাল-শাকসবজি-ফলমূল ও মাছ উৎপাদনে প্রায় স্বনির্ভর হলেও গম-ভোজ্যতেল-চিনি-ডালসহ কিছু নিত্যপণ্য আমদানি করতে হয় এখনো। সরকার পর্যায়ক্রমে এসব ঘাটতিও অন্তত কমিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না। ধান-চালের পাশাপাশি গম, তেলবীজ ও অন্যান্য সহযোগী ফসল উৎপাদনে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষি ও জনবান্ধব এ আবেদনের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, দেশে কৃষিঋণ বিতরণে গতি বেড়েছে ইতোমধ্যেই। স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ পদ্ধতিও সহজ করা হয়েছে কৃষকের জন্য। এর পাশাপাশি সরকার গত বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রায় ১৭০ কোটি টাকা নগদ প্রণোদনা দিয়েছে ২৭ লাখ কৃষককে। এর আওতায় প্রত্যেক কৃষক বিঘাপ্রতি চাষের জন্য ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার পেয়েছেন বিনা মূল্যে। দেয়া হয়েছে কৃষিযন্ত্রের সুবিধাও। সবাইকে সবসময় মনে রাখতে হবে, কৃষকরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির জীবনীশক্তি এবং মূল চালক। করোনা অতিমারীর ভয়ংকর দুর্বিপাকসহ বিভিন্ন জাতীয় অর্থনৈতিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মন্দাবস্থা সর্বোপরি খাদ্যাভাব মোকাবিলায় দিন-রাত উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশের মানুষকে। কৃষি ও কৃষকরাই নিরন্তর অবদান রেখে চলেছেন দেশের মানুষের কল্যাণে। দেশ বর্তমানে খাদ্য বিশেষ করে ধান-চাল উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য মজুতও সন্তোষজনক। ফলে, খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা নেই দেশে। সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বাধিক জোর দিয়েছেন খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর।
এখন প্রশ্ন উঠেছে অর্থনীতিতে খাতওয়ারি এত বিনিয়োগ হওয়া সত্ত্বেও এ কৃষি খাতে ঋণের বিনিয়োগ এত কম কেন এবং জাতীয় বাজেটের আলোকে এ খাতের বরাদ্দ অগ্রাধিকার তালিকায় আসে না কেন? সাম্প্রতিক এক তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের ৬১টি ব্যাংকের প্রায় ১০ হাজার শাখার অর্ধেকেরই বেশি গ্রামাঞ্চলে, যাদের কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে অনীহা রয়েছে। সরকারি এক হিসাবে দেখা যায়, গ্রামে ঋণগ্রহণকারী কৃষক পরিবারের শতকরা ৭৫ ভাগই চড়া সুদে ২০ থেকে ৩০ শতকরা হারে ঋণ নিয়েছে এনজিওদের কাছ থেকে। ব্যাংকগুলো কাগজে-কলমে গ্রামীণ শাখা খুললেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো শহরের মতো গ্রামীণ মানুষের বাণিজ্য, শিল্প ও ভোক্তা ঋণ বিতরণ করছে। সরকারি এক হিসাবে বলা হয়েছে, দেশে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে যাদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পেয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ, যা সংখ্যায় ৬৫ লাখ মাত্র। যাদের মধ্যে ৫০ লাখ ঋণ নিয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এনজিও থেকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে, দেশের ৪১ লাখ গ্রামের পরিবার ঋণের জন্য ব্যাংকে আবেদন করলেও সফল হতে পারেনি এবং এর কারণ হিসাবে ব্যাংকের অনীহা ও প্রচারের অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। এরপরও ঋণ প্রক্রিয়ায় জটিলতা, পদ্ধতিতে ত্রুটি ও অলিখিত লেনদেন খরচ ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাওয়ায় কৃষক আর এ কৃষ্টির সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারছে না। অথচ কৃষকদের ঋণ-সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক যেমন- বিকেবি ও রাকাব রয়েছে। তা ছাড়া অন্য ব্যাংকগুলোর জন্য মোট ঋণের কমপক্ষে ৫ শতাংশ কৃষি খাতে দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর কৃষি-সংশ্লিষ্ট শিল্পকে দেয়া ঋণ কৃষিঋণ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে এ নিয়ম পরিচালনা হয়েছে বলে দেখায়। বর্তমানে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের ওপরে সুদহার নির্ধারণ করে দিয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিন্তু ব্যাংকগুলো একে লাভজনক বলে মনে করে না বিধায় ব্যাংকগুলো এজেন্সি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এনজিওদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর ব্যাংকগুলো লাভবান হয়।
এ অবস্থা উত্তরণের জন্য কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের কৃষি নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকার জন্য যতটুকু সম্ভব খাদ্যোৎপাদনে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারির দুটি ঢেউয়ের পর এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব আরেকটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। তাই আমাদের নিজেদের ব্যবস্থা তৈরি রাখতে হবে এবং সে জন্য এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা উচিত নয়, বরং আমরা যে যা পারি তা উৎপাদন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের প্রতিটি নাগরিকের উচিত তার জমি থেকে কিছু না কিছু উৎপাদন করা। যা শুধু তাদের চাহিদাই মেটাবে না, দেশকে খাদ্যোৎপাদনে স্বনির্ভর হতেও সাহায্য করবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্বসংকটের কারণে দেশ যাতে কোনো সংকটের সম্মুখীন না হয়, সে জন্য আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।’ তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বার্তা প্রচার করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না।’ বাংলাদেশে মোট ১ কোটি ৬১ লাখ হেক্টর ফসলি জমির মধ্যে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ রয়েছে ৮৬ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ৪ লাখ ৩২ হাজার হেক্টর। দেশে রোপা আমন-পতিত-বোরো ধান শস্যবিন্যাসে প্রায় ২২ লাখ হেক্টর জমি সাময়িক পতিত থাকে। এসব আবাদযোগ্য পতিত জমি যদি আবাদের আওতায় আনা যায়, তাহলে আমাদের খাদ্যসংকট মোকাবিলায় তা সহায়ক হিসাবে কাজ করবে। এ সাময়িক পতিত জমিতে ভোজ্যতেল ফসল সরিষা আবাদের এক অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে তেলের আমদানিনির্ভরতা কমে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। আমাদের আছে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ বসতভিটা। দেশের বসতবাড়ির গড় আয়তন শূন্য দশমিক শূন্য ২ হেক্টর। কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১৬৫ দশমিক ৬২ লাখ এবং আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ২ দশমিক ২৩ লাখ হেক্টর। এ জমিগুলো আবাদের আওতায় আনতে পারলে পারিবারিক পুষ্টিচাহিদা মেটানোর পাশাপাশি পরিবারের আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প কাজ করছে। বসতভিটার ক্ষুদ্র এক খালি জায়গায় পরিকল্পিত উপায়ে শাক-সবজি, ফলমূল চাষ করে সারা বছরের পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব। অথচ দেশের সার্বিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় পরিমাণের দিক থেকে কৃষি ও পল্লি ঋণ একেবারেই নগণ্য এবং সেই হিসাবে বৃহদাকার ঋণের ঝুঁকি তথা আদায় বা অনাদায়ী সংকট দেশের ঋণখেলাপির বিরাট অংশ জোড়া রয়েছে। এ অবস্থায় আনুপাতিক হারে কৃষি/পল্লি ঋণ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। তাই কৃষিঋণ নীতিমালায় উল্লিখিত অধ্যায় বা ধারাগুলোকে সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন, খাদ্যনিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি তথা দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যাপারে তফসিল ব্যাংকগুলোকে নীতি-সহায়তা দিয়ে যাবে এ প্রত্যাশা রইল।
লেখক: গবেষক, উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা।
ইউরিয়া বহুল ব্যবহৃত একটি দ্রুত ফসল উৎপাদনের রাসায়নিক সার, গাছের সবুজ অংশের বৃদ্ধিতে এর প্রধান ভূমিকা। সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হয় ধান, গম, ভুট্টা চাষের জমিতে। পৃথিবীতে যত ইউরিয়া উৎপাদন হয় তার প্রায় ৯০% ব্যবহার কৃষিক্ষেত্রে। কারখানাটি দেশের কৃষি উৎপাদন, কৃষি অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে ইতিবাচক অবদান রাখবে। মাটিতে (ইউরিয়া) নাইট্রোজেন পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হলে ক্লোরোফিল সংশ্লেষণের হার কমে যায়। ফলে ফসলের স্র্যসবুজ বর্ণ হারিয়ে ফেলে। পাতার আকার ছোট হয় এবং শাখা-প্রশাখার বৃদ্ধি হ্রাস পায়, ফলে গাছ খর্বাকার হয়র্যটে। তাই কৃষিতে ইউরিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
নরসিংদী জেলার পর্য উপজেলায় নবনির্মিত ‘ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা’ নামক এ কারখানাটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ কারখানায় বার্ষিক ৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদিত হবে। বিশ্বের ভালো ভালো জায়গা যেমন- ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপান থেকে যন্ত্রপাতি এনে এখানে স্থাপন করা হয়েছে। কারখানাটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর, শক্তি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। জাপানের এমএইচআই ও চায়না সিসি সেভেন কোম্পানি কারখানাটি নির্মাণ করেন।
এটি চালু হলে শিল্প খাতে এক নতুন দ্বার উন্মোচন হবে। দেশের বাইরে থেকে সার আমদানি হ্রাস পাবে ফলে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। মানুষের নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ কারখানার বার্ষিক সার উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছে ৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন, শক্তিসাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব গ্রানুলার ইউরিয়া উৎপাদনে সক্ষম এ সার কারখানা দেশে ইউরিয়া সারের স্বল্পতা ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
দেশে কম-বেশি প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন সারের চাহিদা রয়েছে। ৬ থেকে ৭ লাখ মেট্রিক টন সার আমদানি করতে হবে প্রতি বছর। দেশের অভ্যন্তরীণ ইউরিয়া সারের চাহিদা মেটানো এবং সুলভমূল্যে কৃষকদের কাছে সার সরবরাহ নিশ্চিতে নরসিংদীর পলাশে স্থাপিত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ পরিবেশবান্ধব ‘ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা’। এটি চালু হলে দৈনিক ২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন করে বছরে গড়ে ৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদন সম্ভব হবে। ফলে সারের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সারের জোগান বাড়ানো সম্ভব হবে।
দেশের ইউরিয়া সারের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালে বার্ষিক ৩ লাখ ৪০ হাজার এবং ১৯৮৫ সালে ৯৫ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন যথাক্রমে ঘোড়াশাল এবং পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপিত হয়। কারখানা দুটি পুরাতন হওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস এবং ডাউন টাইম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারখানা দুটির স্থানে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন, শক্তিসাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি সার কারখানা নির্মাণের নির্দেশনা দেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে বার্ষিক ৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন গ্রানুলার ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে ‘ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পটি নেয়া হয়। জাপানি প্রতিষ্ঠান এমএইচআই-এর কাছে কারখানাটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়।
এদিকে ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজারের প্রকল্পের কারখানাটি যখন টোটাল অপারেশনে যাবে, তখন ৯৬৮ জন লোকের পার্মানেন্ট কর্মসংস্থান হবে। এ ছাড়া ১৫০০ থেকে ২ হাজার লোক কারখানায় ডেইলি বেসিসে কাজ করবে বিভিন্নভাবে। সার কারখানায় লোডিং-আনলোডিং সার বস্তাবন্দি করা, প্যাক করা, ট্রাকে, ট্রেনে ওঠানো এসব জায়গায় কমপক্ষে ২ হাজার লোক কাজ করবে। এ ছাড়া এ ফ্যাক্টরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।
জাপানিজ কনসালট্যান্টদের মাধ্যমে কারখানার প্রত্যেকটা অফিসার, অপারেটরকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, দেশে এবং বিদেশে। বর্তমানে অপারেশন সিস্টেম নিজ দেশের লোকেরা চালাচ্ছে, বিদেশিরা দাঁড়িয়ে থাকে। এতে নিজ দেশের লোকদের কনফিডেন্স গ্রো হয়েছে। কোনোরকম ভুল হলে তারা সেটা ধরিয়ে দিচ্ছে, দেখিয়ে দিচ্ছে। হাতে- কলমে ট্রেনিং দিচ্ছে। কারখানার অফিসার, অপারেটররা ক্যাপাবল, তারা তাদের সামর্থ্য দেখাচ্ছে, তাদের যথেষ্ট সাফিসিয়েন্ট ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। কারখানাটি এখন ট্রায়াল রানে আছে, কোনোরকম সমস্যা হচ্ছে কি না সবকিছুই নজরদারিতে রাখছেন। ট্রায়াল রান কারখানাটির সাকসেসফুলি কমপ্লিট হয়েছে।
৪৩৬ একর জায়গার মধ্যে ১১০ একর জায়গা নিয়ে স্থাপিত কারখানাটি নির্মাণে ব্যয় হবে ১৫ লাখ ৫২০ কোটি টাকা। দেশের মোট সারের সিংহভাগ পূরণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে উৎপাদনে যেতে আর অপেক্ষা অল্প সময়ের। এটি চালু হলে দেশের অন্যান্য কারখানায় চাপ কমার পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানিনির্ভরতা কমবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ সার কারখানা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। যা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বিরাট ভূমিকা রাখবে। এ কারখানাটি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করবে। পাশাপাশি সার আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাবে একই সঙ্গে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বৃদ্ধি পাবে। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
লেখক: লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, ঢাকা।
একটি ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা করছি। একই সঙ্গে বিখ্যাত ও প্রবল সমালোচিত এক শিশুর ছবি তুলেছিলেন বিশ্বখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী কেভিন কার্টার ১৯৯৩ সালে সুদানে দুর্ভিক্ষের সময়। দুর্ভিক্ষে খেতে না পেয়ে হাড্ডিচর্মসার একটি শিশু মাটিতে পড়ে আছে, মৃত্যুর অপেক্ষায়। আর তার অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে একটি শকুন, খাদ্যের অপেক্ষায়। শিশুটি মুমূর্ষু, কোনো শক্তি নেই। শকুনটি ধীরস্থির, কোনো তাড়া নেই। শিশুটির মৃত্যু হলো বলে, শকুনের খাবারও এল বলে। একই সঙ্গে বিখ্যাত আর প্রবল সমালোচিত এই ছবিটি ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়, আর ১৯৯৪ সালে জিতে নেয় পুলিতজার পুরস্কার। কিন্তু ভয়াবহ বিতর্ক তৈরি হয় ছবিটি নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে সেদিন ছবি না তুলে কেভিন শিশুটিকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টা করেছিলেন কি না। একসময় কেভিন নিজেও নিজেকে এই প্রশ্ন করা শুরু করেন। নিজেকে অপরাধী মনে করে কেভিন প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় নিমজ্জিত হয়ে ১৯৯৪ সালেই আত্মহত্যা করেন। যদিও নিয়ং কিং নামের শিশুটি মারা গিয়েছিল আরও পরে, ২০০৭ সালে।
ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালা। পূর্ণিমার চাঁদও হয়ে যায় ‘ঝলসানো রুটি’। কিন্তু সবাইকে তো আর এই যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয় না। তাই সমাজের একদিকে যখন খাবারের জন্য হাহাকার, অন্যদিকে পাকস্থলী উপচে খাবার আঁস্তাকুড়ে পরে যাওয়ার নিদর্শনও কম নয়। খাদ্যের এমন অপচয় আজ এক সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাকে খাদ্যের অপচয় বলব? সাধারণ অর্থে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার নিয়ে তা খেতে না পেরে ফেলে দেয়াকেই অপচয় বলা যায়। কিন্তু বড় পরিসরে চিন্তা করলে দেখব, খাদ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার প্লেটে যাওয়া পর্যন্ত যেকোনো স্তরে, যদি তা আর খাবার যোগ্য না থাকে, সেটাও আসলে অপচয়।
ব্যক্তি পর্যায়ে খাবার অপচয়ের সবচেয়ে নগ্ন উদাহরণ বিভিন্ন দাওয়াত বা অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাদ্য প্লেটে নেয়া, আত্মীয়স্বজন বা অনেকে জোর করে বেশি খাবার প্লেটে দেয়া, পরে অল্প খেয়ে বা খেতে না পেরে বাকিগুলো রেখে দেয়া, যার স্থান হয় ডাস্টবিনে। বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিন, পারিবারিক, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, উৎসব, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কনফারেন্স, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বড় বড় রেস্টুরেন্ট হোটেলে দেখা যায় প্রত্যেকের প্লেটে খাবারের পাহাড়, সেই এভারেস্ট জয় করে সে সাধ্য কার! তাই এর সিংহভাগেরই গন্তব্য হয় ভাগাড়। এসব নানারকম উৎসবের দিনগুলোতে খাবার অপচয়ের একটা মারাত্মক প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। দেখা যায় অপরিকল্পিত খাবার ব্যবস্থাপনায় প্রচুর খাবার অপচয় হয়। রান্না করা হয় প্রয়োজনের চেয়ে অধিক খাদ্য। মানুষ যতটুকু খেতে পারবে, প্লেটে নিচ্ছে তার চেয়ে বেশি। অনেক সময় প্লেটে অতিরিক্ত খাবার দেয়া হয় এবং ওয়েটারদের জোর করে অতিরিক্ত খাবার তুলে দেয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষের মাঝে বিশেষ করে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবসহ অতিথিদের প্লেটে জোর করে বেশি খাবার তুলে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। দেখা যায় ব্যক্তিটি এত বেশি পরিমাণ খাবার না খেতে পারায়, সে খাবার চলে যাচ্ছে ডাস্টবিনে, এতে অযথাই খাবারের অপচয় হয়।
একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। অনেক দিন আগে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। খাবার টেবিলে আমার পাশে এক ভদ্রলোক তার ৮-১০ বছরের ছেলেকে নিয়ে বসেছেন। ছেলেটি ছোট বলে বেয়ারা তার প্লেটে খাবার একটু কম দেয়ায় ভদ্রলোক রেগেই গেলেন, বেয়ারাকে রাগতস্বরে আরও খাবার দেয়ার আদেশ করলেন, তারপর নিজেই বাটি হাতে নিয়ে মাংস আর তরকারি ছেলের প্লেটে ঢেলে দিলেন। বাচ্চা ছেলে সাধ্যমতো খেল। খাওয়া শেষে তারা হাত ধুতে উঠে গেলেন। ছেলেটার প্লেটে তখনো যে খাবার পড়ে রয়েছে তাতে আরেকজনের খাওয়া হয়ে যাবে, অথচ তা গেল ডাস্টবিনে।
‘পেটে যত জায়গা, প্লেটে তার চেয়ে বেশি’ সামাজিক অনুষ্ঠানে ফ্রি খাবার পেলে এটা আমাদের নীতি। আসলে পেটের নয় বরং আমরা চোখের ক্ষুধা মেটানোর জন্যই এভাবে বেশি বেশি খাবার নেই। দাওয়াতে গিয়ে পেট ভরে গেলেও দাওয়াতকারী প্রায়ই ‘প্লেট খালি কেন’ বলে জবরদস্তি করে খাবার তুলে দেয়, যা শেষ পর্যন্ত ভুঁড়িতে নয়, যায় ভাগাড়ে। এতে খাবারের অপচয় হলেও আতিথেয়তার ষোলকলা পূর্ণ হয়। মুখে ‘খাব না’ বললেও আমরা মনে মনে জানি যে আরও খাবার আসছে। আয়োজনকারীও তাই জোর করে একের পর এক খাবার তুলে দেন মেহমানের পাতে, সামাজিকতা রক্ষার আনন্দ লাভ করেন। এর মধ্যে একধরনের প্রদর্শনবাদিতাও কাজ করে। অগুনতি পদের খাবার আর মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণের আয়োজন যেন ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে আর্থিক সামর্থ্য আর খানদানি ঐতিহ্য, দুই-ই প্রকাশ পায়।
শুধু শহরে নয়, গ্রামগঞ্জেও আজকাল গায়েহলুদ, বিয়ে, জন্মদিন, আকিকা, কুলখানি ইত্যাদি অনুষ্ঠানে প্রচুর খাবারের অপচয় হয়। গ্রামের মানুষও তথাকথিত আধুনিকতার পেছনে ছুটছে। প্রচুর আয়োজন আর প্রচুর অপচয় খুবই সাধারণ দৃশ্য হয়ে উঠেছে। মানুষ আর এতে বিচলিত হয় না, বরং স্বাভাবিক মনে করে। খাবারের অপচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বিলাসিতা। একদিকে খাবার অপচয়ের উৎসব হয়, আর অন্যদিকে গরিব প্রতিবেশীরা খাবারের মিষ্টি ঘ্রাণ শুঁকে এক টুকরা মাংসের অপেক্ষায় থাকে। মানবতার কী নির্মম পরিহাস!
হোটেলগুলোতে দেখা যায় আরেক দৃশ্য, কতটুকু খেতে পারব, তা আমরা অনেকেই বুঝি না, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্ডার করে ফেলি, কিছুটা খাই, বাকিটা ফেলে দেই। ‘বুফে’ পেলে বিভিন্ন জানা-অজানা খাবারের আইটেম নিয়ে প্লেটে খাবারের পিরামিড তৈরি করি, শেষমেশ তার অল্পই গলাধঃকরণ করতে পারি, বাকিটা যায় ডাস্টবিনে।
খাবার ফেলে দেয়ার এই মচ্ছবের পাশাপাশি একই সমাজে এর বিপরীত রূপটাও দেখি। যেই ডাস্টবিনে খাবার ফেলছে, সেখান থেকেই সম্বলহীন ক্ষুধার্ত মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে খাবার জোগাড় করছে। একদিকে ভুঁড়িভোজ করেও খাবার শেষ হচ্ছে না, অন্যদিকে গরিব প্রতিবেশী খাবারের ঘ্রাণ দিয়ে ‘অর্ধভোজনে’ বাধ্য হচ্ছে, পেটে কিছুই পড়ছে না। প্রায়ই দেখা যায় রাস্তার পাশের ডাস্টবিন থেকে বেশ কিছু ক্ষুধার্ত মানুষ ফেলে দেয়া খাবারগুলো জোগাড় করছে, আর সেগুলোই তৃপ্তি সহকারে খেয়ে তাদের জঠরজ্বালা নিবারণ করছে। সম্প্রতি এক বুফেতে হিসাব করে দেখা গেছে যে ফেলে দেয়া খাবারের পরিমাণ এত বেশি যে, তা দিয়ে ৮০-৯০ জন মানুষকে খাওয়ানো যেত।
আরেকটা অদ্ভুত রীতি আছে আমাদের। কোথাও গেলে কিছু খেতে দিলে পুরোটা খাওয়া যাবে না, কিছুটা রেখে দিতে হবে, এটাকেই আমরা মনে করি ভদ্রতা (আসলে মুর্খতা)। পুরোটা খেলে লোকে কী বলবে! কিন্তু প্লেটে রেখে দেয়া সেই খাবার আর কেউ কি খায়? সেটা যায় ডাস্টবিনে। আবার অন্যদিকে নিজ বাসায় খাওয়ার সময় বাচ্চাদের শেখানো হয়, খাবার ফেলে দেয়া অন্যায়, তাই যতটুকু নেয়া হয়েছে তার পুরোটাই খেতে হবে, তা সে পেটে জায়গা হোক বা না হোক। দেখা যায় ছোট বাচ্চা পারছে না, তবু তাকে জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে। এটাও একধরনের অপচয় বৈকি, খাবার নেয়ার সময় সংযমী হলে এই খাবারটুকুও বেঁচে যেত।
আরেকটা কথা বলা দরকার। রান্না করা খাবারেই শুধু অপচয় হয়, তা নয়। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে রান্না পর্যন্ত সব স্তরেই অপচয় হয়ে থাকে। জমিতে চাষাবাদের সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার না করা, ফসল বা খাদ্যশস্য তোলার পর তা যথার্থভাবে সংরক্ষণ, সঠিকভাবে সরবরাহ এবং প্রয়োজন আর সমন্বয় না করতে পারলে খাবার অপচয় হওয়ার ঝুঁকি থাকে। দেখা যায় দেশের এক এলাকায় খাবার উদ্বৃত্ত, চাষি ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না, আর অন্য এলাকায় সেই খাবারই সোনার দামে কিনতে হচ্ছে। কোথাও মানুষ খেতে পাচ্ছে না, কোথাও ফসল গুদামে নষ্ট হচ্ছে। এসব অপচয়েরই নামান্তর।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর যে পরিমাণ খাবার উৎপাদন হয়, তার একটি বড় অংশ মাঠ থেকে আর খাবার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছায় না। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ‘ফুড ওয়েস্টেজ ফুটপ্রিন্ট: ইম্প্যাক্টস অন ন্যাচারাল রিসোর্সেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে বছরে প্রায় ১৩০ কোটি টন খাদ্য নষ্ট হয়, যা বিশ্বের মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। খাদ্যের এই অপচয়ে উন্নত দেশ আর উন্নয়নশীল দেশ কেউই বাদ যায় না।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেপ’ ২০২১ সালে ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স নামে রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ১ কোটি ৬ লাখ টন খাদ্য অপচয় হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত আর পাকিস্তানের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ খাদ্য অপচয় হয় বাংলাদেশে। শুধু খাবার টেবিলের অপচয় রোধ হলেই ৪২ লাখ ৬২ হাজার মানুষের সারা বছরের ভাতের চাহিদা মিটত।
আজ দুনিয়াব্যাপী খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে, অথচ অপচয় কমছে না। নাকি অপচয়ের কারণেই খাদ্যে টান পড়ছে, মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। মানবতার প্রতি এ কী নির্মম পরিহাস! খাদ্যের অপচয় খাদ্যসংকটকে তীব্রতর করে তোলে, দুর্ভিক্ষ হয় আসন্ন।
ইসলাম কী বলে?
খাবার অপচয়কে ইসলাম মোটেও সমর্থন করে না। বিশ্বনবী রাসুলুল্লাহ (সা.) খাবার অপচয় রোধে খুব শক্ত হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। খাবার নষ্ট থেকে বাঁচতে দস্তরখানা বিছিয়ে খাওয়ার কথা বলেছেন, যা সুন্নত। তিনি নিজেও দস্তরখানা বিছিয়ে খাবার গ্রহণ করতেন, যাতে খাবার পাত্র থেকে পড়ে নষ্ট না হয়। কেননা খাবার হলো মহান আল্লাহর নেয়ামত। এর অপচয় কোনোভাবেই কাম্য নয়। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) খাওয়ার পর তাঁর তিনটি আঙুল চেটে নিতেন। তিনি বলতেন, ‘তোমাদের কারও খাবারের লোকমা নিচে পড়ে গেলে সে যেন তার ময়লা দূর করে তা খেয়ে নেয় এবং শয়তানের জন্য তা ফেলে না রাখে।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘আমাদের তিনি থালাও চেটে খাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘খাদ্যের কোন অংশে বরকত রয়েছে, তা তোমাদের জানা নেই (তিরমিজি: ১৮০৩)। খাবার নষ্ট করা যেমন অন্যায় তেমনি গোনাহের কাজ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা কোরআন কারিমে ইরশাদ করেন, ‘(তোমরা) খাও, পান কর ও অপচয় কর না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না’ (সুরা আরাফ: ৩১)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই’ (সুরা ইসরাইল: ২৭)।
আমাদের করণীয় কী?
খাদ্যাভাবে কত মানুষ মারা যায় তার সঠিক হিসাব করা দুষ্কর। ২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের এক হিসাব অনুযায়ী বছরে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। অন্য আরেক তথ্যে জানা যায় প্রতিদিন বিশ্বে গড়ে ৮ হাজার ৬৪০ জন মারা যায় খাদ্যাভাবে, যার বেশির ভাগই শিশু। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এভাবে খাবার অপচয় রোধে আমাদের করণীয় কী? আমরা কি এমনটাই চলতে দেব? টাকা থাকলেই কি অতিরিক্ত খাওয়া আর খাবার ফেলে দেয়ার অধিকার জন্মায়? সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আছে সমাজের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নিজেদের সচেতন হতে হবে, আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীদের সচেতন করতে হবে। ছোটদের শেখাতে হবে খাবার শেষ করাই শুধু নয়, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার পাতে না নেয়াও একটা দায়িত্ব। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাড়াবাড়ির যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা পরিহার করা উচিত। আমাদের সবার প্রতিজ্ঞা করতে হবে, জীবনে যতদিন বেচে আছি একটা দানাও অপচয় করব না, যতটুকু পারি ক্ষুধার্তকে খাওয়াব। যদি খাওয়াতে না পারি, অন্তত নিজের খাবারের ব্যাপারে মিতব্যয়ী হব। একই সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ আর বণ্টনে যেন অপচয় না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। চাষির ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি আর দরিদ্রের সুলভে পর্যাপ্ত খাবার প্রাপ্তি দুই-ই নিশ্চিত করতে হবে। আর অপচয় রোধে উদ্যোগ না নিয়ে যদি তামাশাই দেখি, তাহলে অভুক্ত মানুষের কষ্টের দায়ভার আমাদের কাঁধেই এসে পড়বে। পুলিতজার জয়ী আলোকচিত্রীর মতো আমরাও কি তখন আত্মহত্যা করব? আল্লাহ আমাদের বোঝার তৌফিক দান করুন, যাতে আমরা খাদ্য অপচয় না করে পরিমিত ভোগে সন্তুষ্টচিত্তে তার শুকরিয়া আদায় করি।
লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক
গত সপ্তাহেই ভারতীয় গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করে, প্রতীক্ষা বাংলোটি কন্যা শ্বেতা বচ্চনের নামে লিখে দিয়েছেন বলিউডের শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চন। এরপরই জানা যায়, নিজের সব সম্পত্তি সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দিচ্ছেন ‘বিগ বি’। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে মুখ খুলেছেন অমিতাভ নিজেই। খবর ভারতীয় গণমাধ্যম ফ্রি প্রেস জার্নালের।
কয়েক মাস ধরেই ক্রমাগত আলোচনায় রয়েছে বচ্চন পরিবার। তবে সম্পত্তির ভাগাভাগি নয়, আলোচনার কারণ ছিল ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনের সঙ্গে বচ্চন পরিবারের কথিত দূরত্ব। এমনকি ঐশ্বরিয়া-অভিষেকের বিচ্ছেদের গুঞ্জনও চাউর হয়েছিল। তবে এবার সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনায় বচ্চন পরিবার। তবে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ২ হাজার ৮০০ কোটি রুপির (প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা) সম্পত্তির ভাগ কীভাবে হবে, জানালেন অমিতাভ বচ্চন।
অমিতাভ জানান, তার সম্পত্তি দুই সন্তানের মধ্যে সমান ভাগ করে দিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই ছেলে ও মেয়ের মধ্যে কোনো তফাৎ করেননি। তাই সম্পত্তির ক্ষেত্রেও দুই সন্তান সমান ভাগ পেয়েছেন।
সদ্য দীপাবলির উপহার হিসেবে অমিতাভ ‘প্রতীক্ষা’ বাংলোটি মেয়ের নামে লিখে দেন, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৫০ কোটি রুপি। শোনা যায়, এ বাংলো বেশ পছন্দের ছিল ঐশ্বরিয়া রাইয়ের। তবে ‘বিগ বি’ নিজের মেয়ে শ্বেতাকে দিলেন ‘প্রতীক্ষা’।
মুম্বাইয়ের ভিট্টালনগর কো-অপারেটিভ হাউসিং সোসাইটির ‘প্রতীক্ষা’ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ ৬৭৪ বর্গমিটারের, আরেকটি ৮৯০ বর্গমিটারের। এটিই নাকি বিগবির প্রথম সম্পত্তি। মা-বাবার সঙ্গে এখানেই বেড়ে ওঠা অভিনেতার। এ বাংলো ছাড়াও জুহুতে তিনটি বাংলো রয়েছে বচ্চনদের। তবে ছেলে অভিষেকের ভাগ্যে পড়েছে কোন কোন সম্পত্তি, তা গোপন রেখেছে বচ্চন পরিবার।
যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বর্ণিল জীবনাচার, ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি পার্বত্য অঞ্চলের রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি- এই তিন জেলাকে বিশেষভাবে করেছে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ অঞ্চলকে নিয়ে বারবার বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন সময় শান্তির পরিবর্তে সংঘাতকে উসকে দিয়েছিল। এই সংঘাতময় পরিস্থিতি নিরসনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী, সুদক্ষ ও প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্বে কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটির পক্ষে তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে পার্বত্য জেলাসমূহে বিরাজমান দীর্ঘ সংঘাতের অবসান হয় এবং অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন পরিবেশের অবতারণা হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও আন্তরিকতার কারণেই অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সেখানকার বিভিন্ন ভাষাভাষী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ সবার জীবনে শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির অভিযাত্রায় পাহাড়ি জনপদে বর্তমানে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলে ১৫ জুলাই ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। সেই থেকেই গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। সংসদ সদস্য আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে আহ্বায়ক (মন্ত্রী পদমর্যাদা) করে ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি তিন সদস্যবিশিষ্ট চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কমিটি ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে। গঠন করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ ছাড়া গঠন করা হয় ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন-সংক্রান্ত টাস্কফোর্স। পার্বত্য চট্টগ্রামকে উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে ইতোপূর্বে গঠন করা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ইতোমধ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৪টি ধারার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং বাকি ধারাগুলোর বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে বাকি ধারাগুলোরও বাস্তবায়ন চলমান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম তার অনন্য সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলাদেশের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এই অঞ্চলের সম্ভাবনা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়ে পাহাড়ে বসবাসকারী জনগণের জীবনকে উন্নত করার প্রতিশ্রুতিতে অটল রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনকেন্দ্রিক উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবনে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। উন্নয়ন কৌশলের অন্যতম ভিত্তি হলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন। রাস্তা, সেতু এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যক সংযোগ প্রকল্পগুলো কেবলমাত্র পরিবহনের সুবিধাই দেয়নি বরং প্রত্যন্ত অঞ্চলকেও সংযুক্ত করেছে এবং শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে ব্যবধান কমিয়েছে। অবকাঠামোর উন্নতি শুধু পার্বত্যবাসীদের জীবনকে সহজ করেনি বরং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিয়েছে। বিশেষ করে উঁচু-নিচু পাহাড়ের গা ভেসে সরীসৃপের মতো নির্মিত হয়েছে শত শত কিলোমিটারের ঝিগঝাগ পিচঢালা মসৃণ পাহাড়ি সড়ক। সড়কের পাশাপাশি বড় বড় ব্রিজ-কালভার্ট এক পাহাড়কে আরেক পাহাড়ের সঙ্গে যুক্ত করেছে। যারা বান্দরবানের থানচি ভ্রমণ করেছেন, তারা এর স্বাদ গ্রহণ করেছেন। থানচিতে যেখানে যাওয়া-আসায় দুই-তিন দিনের পথ ছিল, এখন সে পথ মাত্র দুই-তিন ঘণ্টার ব্যবধানে দাঁড়িয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির দলিল স্বাক্ষরের কারণে। পাহাড়ি জনপদের কাছে তা এখন স্বপ্নের মতো। যাত্রীবাহী চাঁদের গাড়ি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস, মাইক্রোবাস, জিপ অনায়াসেই চলাচল করছে এ সড়কগুলোয়। পার্বত্য দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। আর এর সুফল ভোগ করছেন স্থানীয় জনগণ। সরকারের ২০০৯-২০২৩ শাসনামলে অসংখ্য স্কুল, কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যা এ অঞ্চলের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান এবং জ্ঞান দিয়ে তাদের ক্ষমতায়ন করেছে। পার্বত্যাঞ্চলের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অবদানের কারণেই পার্বত্যবাসীরা পার্বত্যাঞ্চলের বিশাল উন্নয়নের সমঅংশীদার হতে পেরেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১৬১টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বিগত ২৬ বছরে পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলায় নানামুখী অবকাঠামে উন্নয়ন হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় নারী উন্নয়ন, আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। ৪ হাজার ৮০০ পাড়াকেন্দ্রে শিশু ও তাদের পরিবারের নিকট মৌলিক সামাজিক সেবাগুলো পৌঁছে দিতে পাড়াকেন্দ্র নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীরা আধুনিক প্রযুক্তির সহযোগিতায় এখন সরকারের সব সেবা ভোগ করতে পারছে, যা গত এক যুগ আগেও সম্ভব ছিল না। ১ লাখ ২০ হাজার শিশুকে প্রাক শৈশব স্তরের শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ২ লাখ ৬ হাজার পাহাড়ি পরিবারের শিশু, কিশোরী ও মহিলাদের রক্তস্বল্পতা ও পুষ্টি ঘাটতিজনিত সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে সরকারের সেবা প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। চারটি আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আয়বর্ধক কর্মসূচি হিসেবে উন্নত জাতের বাঁশ উৎপাদন, অসচ্ছল ও প্রান্তিক পরিবারের নারী উন্নয়নে গাভী পালন প্রকল্প, সুগারক্রপ চাষাবাদ জোরদারকরণ প্রকল্প, কফি ও কাজু বাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প, তুলা চাষ বৃদ্ধি ও কৃষকদের দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প, প্রত্যন্ত এলাকায় সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ, মিশ্র ফল চাষ, উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থানের জন্য সরকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য এক অপার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ১ হাজার ২১২ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৭০০ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে- যা পরবর্তীতে পাকাকরণের মাধ্যমে জনগণের যাতায়াতের দুর্গম পথকে সুগম করে দিতে বদ্ধপরিকর রয়েছে এ সরকার।
৬১৪ কিলোমিটার বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে। পার্বত্য তিন জেলায় ৯ হাজার ৮৩৯ মিটার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু রাঙামাটি জেলাতেই নির্মাণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৯২৮ মিটার ব্রিজ। একই সঙ্গে কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে ১৪১ মিটার। ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক দুর্গম পাহাড়ি জনপদের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপকে বাস্তবায়ন করেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার।
পার্বত্য চুক্তির আগের পার্বত্যাঞ্চল ও চুক্তি উত্তর পার্বত্যাঞ্চলের চিত্র সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে তুলে ধরা হলো:
পার্বত্য চুক্তির আগে পার্বত্য তিন জেলায় উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১৯৬টি। চুক্তির ২৬ বছরে সেখানে উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৪টিতে। কলেজ ছিল যেখানে ২৫টি, সেখানে এখন কলেজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১টি। পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিন পার্বত্য জেলায় নতুনভাবে গড়ে উঠেছে তিনটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। রাঙামাটিতে একটি মেডিক্যাল কলেজ এবং বান্দরবান জেলায় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়। পার্বত্য তিন জেলায় চুক্তির আগে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ছিল মাত্র ৯১টি। চুক্তির পর স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২১২-তে উন্নীত করা হয়। ছোট-মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল মাত্র ১৭টি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর মাঝারি-বড় ৪৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। ক্ষুদ্র-কুটির শিল্পের সংখ্যা যেখানে ছিল ২ হাজার ২৬৬টি মাত্র, চুক্তির পর সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ২৯৯টি। এ ছাড়া মসজিদ, মন্দির, কিয়াং, গির্জা সমহারে স্থাপনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক এ সরকার সব ধর্মের প্রতি সমান আন্তরিকতার পরিচয় রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শিশু পার্ক, বিনোদন পার্ক, বাস টার্মিনাল, ঈদগাহ্, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, বাঁধ, স্টেডিয়াম, ফুড বেকারি, হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, পর্যটনকেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপনের মাধ্যমে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাসহ সব প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে দিয়েছে সরকার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে শান্তিচুক্তির পটভূমিতে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, পর্যটন ইত্যাদি সব দিক থেকে পার্বত্য অঞ্চল এখন আরও বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত হয়েছে বলে দাবি রাখে।
লেখক: তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়
আপনি কেমন জীবন চান? স্রষ্টা যদি আপনাকে এই প্রশ্নটা করতেন এবং আপনাকে চারটি অপশন দিতেন, যার প্রত্যেকটি অপশনই কষ্টের। তাহলে আপনি কোন অপশনটি বেছে নিতেন? গভীরভাবে চিন্তা করুন, একটি বাচ্চা যখন স্কুলে যাচ্ছে, তখন সে স্কুলে যেতে চায় না। যিনি চাকরি করছেন, তার অফিসে যেতে ভালো লাগে না। কিন্তু বেকার থাকাটা আরও অনেক বেশি কষ্টকর। একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য গর্ভকালীন সময়টা খুবই কষ্টকর। অন্য একজন মহিলা যার কোনো সন্তান নেই, কিন্তু সন্তান চাচ্ছেন। সেটা তার জন্য আরও বেশি কষ্টকর। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখুন, দেখবেন আমাদের জীবনের অপশনগুলো সব সময় কষ্টের। তাহলে জীবনের কোন কষ্টটা নেব? বা আদৌ কষ্টটা নেব কেন? আমি কষ্টটা নেব, কারণ এ ছাড়া আমার কোনো বিকল্প নেই। আমি সেই কষ্টটাই নেব, যেটা আমার জীবনকে অর্থবহ করে তোলে।
তরুণ বয়সে অনেকেরই মনে হয়, পড়ালেখাটা অনেক কষ্টকর। কিন্তু এই কষ্টটা একজন মানুষের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। তাই এই কষ্ট করাটা বুদ্ধিমানের কাজ। পড়া, লেখা, বই-জীবনের এই তিনটি অনুষঙ্গ শ্বাস, প্রশ্বাস ও অক্সিজেনের সঙ্গে তুলনীয়। পড়া হচ্ছে শ্বাস নেয়া, লেখা হচ্ছে প্রশ্বাস, আর বই হচ্ছে অক্সিজেন। জীবকোষে অক্সিজেনের ঘাটতি হলে যেমন কোষে পচন ধরে, তেমনি বই পড়া কমিয়ে দিলে আত্মার পরিশুদ্ধতার পরিসমাপ্তি ঘটে। একজন শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকের মধ্যে পার্থক্য হলো শিক্ষিত ব্যক্তি তার জ্ঞান, চিন্তাভাবনা, অভিব্যক্তি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিপিবদ্ধ করে যেতে পারেন; কিন্তু অশিক্ষিত ব্যক্তিরা তা পারেন না।
বই জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার অন্যতম মাধ্যম কেন? একটি ভালো মানের বই লেখা নিরন্তর সাধনার বিষয়। এ কাজে লেখকের মাস, বছর, এমনকি যুগ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। বই অনুরাগী হলে সে বইটি আমরা দুই দিন থেকে ১ সপ্তাহের মধ্যে পড়ে শেষ করতে পারি। শেষ করার অর্থ হলো একজন জ্ঞানী এবং বিচক্ষণ মানুষের বহুদিনের নিরবচ্ছিন্ন ভাবনার সংকলনকে আমরা নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারলাম। শিক্ষকতা পেশায় আমি দীর্ঘদিন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ‘কোর্থ’-এর লেখা ‘ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ বইটি পড়িয়েছি। বইটি লেখকের অনেক বছরের তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক গবেষণার প্রতিফলন। অথচ মাত্র এক অ্যাকাডেমিক সেমিস্টারে লেখকের অভিজ্ঞতালব্ধ এই জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠদানের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। এর ফলে লেখকের বহু বছর ধরে গবেষণালব্ধ জ্ঞান শিক্ষার্থীর মানসিক বয়সকে বাড়িয়ে দেয়। সে জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়।
শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিতে গিয়ে আমি শিক্ষার্থীদের প্রায়ই বলতাম, বই যত মোটা বা স্বাস্থ্যবান হোক না কেন তার মধ্যে মূল বিষয় বা চুম্বক অংশ থাকে ৩০ শতাংশ। আর ওই চুম্বক অংশ ফুটিয়ে তোলার জন্য আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয় বাকি ৭০ শতাংশ। সুতরাং তোমাদের মনে রাখতে হবে ৩০ শতাংশ। এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মন ওইভাবে ভাবতে শুরু করত। ফলে বই পড়াটা তাদের কাছে আনন্দঘন হয়ে উঠত। আমার মতে পাঠ্যবইকে পড়ে এর সারাংশ বের করতে পারাটাই সৃজনশীলতা।
ইতিহাস বলে, ইতিবাচক কর্মের দ্বারা সফল মানুষগুলো তাদের জীবদ্দশায় প্রচুর বই পড়তে পছন্দ করতেন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন বারো বছর বয়সে জীবনযুদ্ধে নামতে বাধ্য হন। পোর্ট হেরন থেকে ডেট্রয়েটের মধ্যে প্রতিদিন চলাচলকারী ট্রেনে তিনি খাবার ও পত্রিকা বিক্রি করতেন। ডেট্রয়েটে ট্রেনটি অনেকক্ষণ অবস্থান করত। সে সময় তিনি সেখানকার একটি লাইব্রেরিতে বসতেন এবং বই পড়তেন। এভাবে তিনি ওই লাইব্রেরির সমস্ত বই পড়ে শেষ করেছিলেন। তার প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মূলে রয়েছে বইয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।
গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে আলো, বাতাস ও পানির প্রয়োজন। আর অন্তরকে বাঁচিয়ে রাখতে পড়াশোনার প্রয়োজন। অন্তরকে সজীব ও প্রসারিত রাখার মাধ্যম হলো শিক্ষা। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের মিলিওনিয়ার ও বিলিওনিয়ারদের শতকরা ৮৫ ভাগ প্রথম প্রজন্মের। শুধু ১৫ ভাগ উত্তরাধিকার সূত্রে ধনী। প্রথম প্রজন্মের ধনীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ‘এত অল্প সময়ে কীভাবে আপনারা আর্থিক সফলতা অর্জন করেছেন’? তারা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমরা বই পড়ি’। ওয়ারেন বাফেট দিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা বই পড়েন। বিল গেটস একজন ভালো পাঠক। ইলন মাস্ক রকেট সায়েন্সের বিদ্যা বই পড়ার মাধ্যমেই অর্জন করেছেন। বই পড়া স্বল্প সময়ে অনন্য সাধারণ মানুষের ভাবনার সারাংশ আত্মস্থ করার মাধ্যমে আত্মোন্নয়ন ঘটায়। আলোকিত মন জীবন ধারণের জন্য যেকোনো ইতিবাচক সৃজনশীল কর্ম খুঁজে নিতে পারে।
আমরা বইয়ে যা পড়ছি, তা মূলত কারও বিশেষ জ্ঞান কিংবা অভিজ্ঞতা থেকেই লেখা। সেই জ্ঞান আমাদের সফলতাকে ত্বরান্বিত করবে। বইয়ে একটি সঠিক পথ অবলম্বন করার জন্য আমাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়। জীবনের ভুলগুলোকে চিহ্নিত করে দেয়া হয়। বিভিন্ন বইয়ে লেখক তার জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করেন। আমরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে জানতে পারি কোন পথে গেলে ভুলের সম্ভাবনা কমে আসে। জীবন খুব ছোট, ভুলের পুনরাবৃত্তি করা সফলকাম হওয়ার অন্তরায়। সফলদের একজন হতে চাইলে তাদের অতীত থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্যও বই অপরিহার্য।
তরুণ প্রজন্মের যাকেই জিজ্ঞাসা করি, সেই-ই জানায় সে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করবে। পৃথিবীতে তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়াও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য অনেক বিষয় রয়েছে। নবপ্রজন্মের মধ্যে এই উপলব্ধিবোধ জাগ্রত করতে হবে। যেকোনো বিষয়েই মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলে মাস্টার্স বা পিএইচডির মতো গবেষণা অন্য বিষয়েও করা সম্ভব। এ সম্পর্কে আমি নোবেল বিজয়ী ফরাসি অধ্যাপকের কথা বলছি। নাম তাঁর ড. জ্যঁ তিরল। তিনি সমাবর্তন বক্তা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। তাঁর স্নাতক ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, কিন্তু তিনি পিএইচডি করেছেন অর্থনীতিতে। পরবর্তীতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন অর্থনীতিতে। পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকলে স্নাতক ডিগ্রি এক বিষয়ে হলেও অন্য বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ভূগোল বিষয়ে অধ্যয়ন করে পরবর্তী সময়ে নাসাতে গবেষণার সুযোগ পেয়েছেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, যেকোনো বিষয়ে পড়াশোনা করেই জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। যদি থাকে অদম্য ইচ্ছাশক্তি।
বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে শিশুকাল থেকে। পাঠ্যবইসহ গল্প-উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, বিজ্ঞান ও গণিতভিত্তিক যেকোনো বই-ই মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ জন্য প্রতিটি পরিবারে গড়ে তুলতে হবে সর্বোপরিসরে ছোট আকারের পাঠাগার। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে অনুশীলন করতে হবে সফলতার সঠিক জীবনবোধ। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলেই মানুষকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব। সে নিজেই হতে পারে জ্ঞানের বিশ্বকোষ। এভাবেই গড়ে উঠবে জাতি, সমৃদ্ধ হবে দেশ। সফলতার সুষমায় উদ্ভাসিত হবে প্রতিটি জীবন ও পরিবার।
লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
বিদ্যুতের সমস্যা শুধু আমাদের দেশেই নয়, উন্নয়নশীল সব দেশেই আছে। আর এর কারণ হিসেবে সহজ একটি উত্তর সচরাচরই শোনা যায়, চাহিদা অনুযায়ী/বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না বা সরবরাহ হচ্ছে না ইত্যাদি। বিদ্যুতের এ সমস্যা প্রতিরোধে বিজ্ঞানীরা ইউরোপে সমুদ্রপৃষ্ঠ ও সমুদ্রের গভীরে তাপমাত্রার পার্থক্য কাজে লাগিয়ে নতুন একটি প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করে তারা সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বাস্তবে পরিণত করেছেন। বিশেষ করে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য ও জ্বালানির মূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বার্থেই বিকল্প জ্বালানির চাহিদা ও ব্যবহার বেড়েই চলেছে। জ্বালানির জন্য বিকল্প শক্তি ব্যবহারের ভাবনা নতুন নয়। শুধু বিভিন্ন কারণে তা বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। জার্মানির মতো দেশে বিদ্যুতের মূল্য যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে এসব বিকল্প পথে বিদ্যুৎ উৎপাদনের আগ্রহ বাড়ছিই। সমুদ্রের উত্তাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা ভাবছেন তারা। সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা সাধারণত ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর চেয়েও বেশি। অন্যদিকে ১ হাজার মিটার গভীরে সমুদ্রের তাপমাত্রা প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ দুই স্তরের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য ২০ ডিগ্রিরও বেশি। বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের এ পার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব বলে জানিয়েছেন।
সমুদ্রশক্তি থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করার এ প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘ওশান থার্মাল এনার্জি কনভার্শন’ বা ‘ওটেক’। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদ্ধতিও বেশ সহজ। প্রথমে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পাইপের মধ্য দিয়ে সমুদ্রের গভীরের ঠাণ্ডা পানি সমুদ্রপৃষ্ঠে পাম্প করা হয়। এ ঠাণ্ডা পানি এক বিশেষ ধরনের গ্যাসকে তরল পদার্থে পরিণত করে। পরিশেষে এ তরল গ্যাস সমুদ্রপৃষ্ঠের গরম পানির সংস্পর্শে এসে ফুটতে থাকে। এ প্রক্রিয়া চালু রাখলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার টার্বাইন বা বিশাল চাকা ঘোরানো সম্ভব। কয়লার সাহায্যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রায় একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তবে ‘ওটেক’-এর ক্ষেত্রে তাপমাত্রা অনেক কম থাকে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় কোনোরকম কার্বন-ডাই অক্সাইডের নির্গমন ঘটে না। আর তাই এ প্রযুক্তিটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। সমুদ্রের উষ্ণতা বা সমুদ্রশক্তি থেকে বিদ্যুৎ তৈরিতে যারা কাজ করছে তাদের মধ্যে আছে ফ্রান্সের একটি জাহাজ নির্মাণ সংস্থা ‘ডিসিএনএস’। এর প্রতিনিধি এমানুয়েল ব্রশার বলেন, বায়ুশক্তি বা সৌরশক্তির ক্ষেত্রে সব সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। অপেক্ষা করতে হয় বাতাস বা রোদের জন্য। অথচ সমুদ্রের এ শক্তি কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই টানা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।
সমুদ্রশক্তিচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ উদ্যোগটি সর্বপ্রথম শুরু হয় আশির দশকে। বেশ কিছু প্রাথমিক যন্ত্রও তৈরি হয়েছিল সে সময়; কিন্তু তেলের দাম কম থাকায় খরচে পোষায়নি। এখন তেলের দাম বেড়ে চলায় ও পরিবেশের ক্ষতির কারণে ‘ওটেক’ পদ্ধতি আবার আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। তারা প্রাথমিক স্তরে একটি কেন্দ্র গড়ে তুলেছে, যা থেকে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। ২০১৫ সালে কেন্দ্রটি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে সক্ষম হয়েছে। প্রকল্পটি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ মিটার ব্যাসের এক কৃত্রিম দ্বীপের মতো। এতে রয়েছে একটি লম্বা পাইপ, যা সমুদ্রের নিচে প্রায় ১ হাজার মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এ ছাড়া আছে বাষ্পচালিত একটি টার্বাইন যন্ত্র। এমন এক উৎপাদন কেন্দ্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এমন এক প্ল্যাটফর্ম ঠিক কোথায় বসানো হচ্ছে, সে অনুযায়ী প্ল্যাটফর্মের আকার ও আয়তন স্থির করতে হয়। যেমন ভারত মহাসাগরে সমুদ্রের ঢেউয়ের উচ্চতা ক্যারিবীয় সাগরের তুলনায় অনেক বেশি। ভাসমান এই এক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সেই ধাক্কা সামলাতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পাইপ নিয়ে, যা দিয়ে সমুদ্রের গভীরের ঠাণ্ডা পানি তোলা হবে। এ পাইপ হতে হবে স্থিতিশীল এবং দামেও সস্তা। সমুদ্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে নিঃসন্দেহে তা হবে একটি চমৎকার ও উজ্জ্বল প্রযুক্তি; কিন্তু এ প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে সেই এলাকার উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। তবে যেসব বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কঠিন, এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়।
লেখক: বিজ্ঞানবিষয়ক কলামিস্ট
প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক, বক্তা এবং শিক্ষাবিদ স্যার কেন রবিনসন তার সাড়া জাগানো Out of Our Minds-(2011) গ্রন্থে বলেছেন, ‘The more complex the world becomes, the more creative we need to be to meet its challenges’- অর্থাৎ পৃথিবী যতই জটিল হয় তার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য আমাদের ততই সৃষ্টিশীল হওয়া দরকার। বর্তমান বিশ্বের শিক্ষাঙ্গনে এবং কর্মক্ষেত্রে রবিনসনের এই তত্ত্ব বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। সফল হতে হলে মানুষকে এখন সৃষ্টিশীল হতেই হয়। কিন্তু সাফল্যের ধারণা যেহেতু পরিবর্তনশীল তাই শিক্ষা পদ্ধতিকেও বারবার পরিবর্তিত অর্থাৎ যুগোপযোগী করতে হয়। বিশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থায় অবশ্য সৃষ্টিশীলতার চাইতে অনুবর্তিতা (Compliance) এবং সাদৃশ্য (Comformity)-এর গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। একটা পেশাদার করপোরেট পরিবেশে যুগ যুগ ধরে ভালো চাকরির নিশ্চয়তার জন্য বিশ্বস্ত গুণাবলি হিসেবে কাজ করেছে এই অনুবর্তিতা এবং সাদৃশ্য। কিন্তু দ্রুততম পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তির অভাবিত উন্নয়নের যুগে এবং প্যানডেমিকের মতো বৈশ্বিক বিপর্যয়ের চরম অনিশ্চয়তার যুগে জীবন ও জগৎ টিকিয়ে রাখতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার।
আমরা এক নজিরবিহীন প্রযুক্তিগত উন্নয়নের যুগে বাস করছি। আমাদের হাতে রয়েছে এক বিশাল ও বিস্ময়কর তথ্যবিশ্বের চাবি। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ (প্রায় ৫ বিলিয়ন) ইন্টারনেট ব্যবহার করে। প্রায় ৪ বিলিয়ন গুগল সার্চ হয় প্রতি মিনিটে। প্রতি দুই দিনে আমরা এত তথ্য সৃষ্টি করি, যা সভ্যতার শুরু থেকে ২০০৩ পর্যন্ত সৃষ্ট তথ্যরাশির সমান অর্থাৎ ৫ এক্সাবাইট। বিশ্ব তথ্যভাণ্ডারের ৯০ শতাংশ সৃষ্টি হয়েছে মাত্র গত দুই বছরে। এই দ্রুতমভাবে বর্ধনশীল সংযোগ ব্যবস্থা, নজিরবিহীন প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণ ক্ষমতা, সীমাহীন তথ্য প্রবেশাধিকার এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবোটিকস, ইন্টারনেট অব থিংস, অটোনোমাস ভেইকেলস, থ্রিডি প্রিন্টিং ন্যানোটেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রভৃতি যুগান্তকারী প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন মানুষের অস্তিত্ব ও বিকাশের অনুকূলে কাজে লাগাতে হলে উচ্চশিক্ষাকে সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ হিসেবে দেখতে হবে।
একুশ শতকের শিক্ষাঙ্গনে সব স্তরে শিক্ষার্থী হিসেবে যারা জ্ঞানর্জন করছে, তাদের বলা হচ্ছে ডিজিটাল অধিবাসী (Digital Natives)। এরা দুটো প্রজন্ম ধরে গড়ে উঠেছে। প্রথমটি জেনারেশন জেড- যারা ১৯৯৫ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে জন্মলাভ করেছে এবং স্কুলজীবন থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, আইপ্যাড, স্মার্টবোর্ড প্রভৃতি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করছে। দ্বিতীয়টি জেনারেশন আলফা- যারা ২০১০-এরপর জন্মলাভ করেছে। এই প্রজন্মের কাছে ডিজিটাল ডিভাইস ডাল-ভাতের মতো ব্যাপার। এই দুই জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের আঙুলের ডগায় রয়েছে বিশ্ব-তথ্যভাণ্ডার। দেশভেদে এই ডিজিটাল নেটিভদের অবস্থাগত তারতম্য থাকলেও পৃথিবীর সব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে যুগপ্রসূন এই প্রজন্মদ্বয়ের কথা মাথায় রাখতে হবে।
সময়ের পরিবর্তন ও পরিস্থিতির অনিবার্যতার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের অস্তিত্ব ও বিকাশের অনুষঙ্গী হিসেবে শিক্ষার তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, দ্রুত এবং নিয়ত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন শিক্ষার্থীদের হস্তান্তরযোগ্য/স্থানান্তরযোগ্য দক্ষতার (transferable skills) অধিকারী করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রাপ্ত তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং তৃতীয়ত, ২১ শতকের বৈশ্বিক লোকবলের (Digital workforce) উপযোগী করে পুরো প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে। এই তিন মূল লক্ষ্যকে মাথায় রেখেই উচ্চশিক্ষার রূপরেখা প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন প্রাজ্ঞ শিক্ষাবিদরা। তাই বলে, দেশ-সমাজ ও সংস্কৃতিভেদে নতুন সংযোজনকে নিরুৎসাহিত করা হয়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগ ২১ শতকের দক্ষতাকে শিক্ষায় রূপান্তরিত করার জন্য ‘Partnership for 21st Century Learning’ নামে একটি মডেল (P21 Framework) প্রস্তাব করে, সেখানে আজকের শিক্ষার্থীদের জন্য চারটি মৌলিক দক্ষতার কথা বলা হয়। এক. সৃজনশীলতা/উদ্ভাবন (Creativity/Innovation) দুই. সমালোচনামূলক চিন্তন (Critical Thinking), তিন. যোগাযোগ (Communication) এবং চার. সহযোগিতা (Collaboration)। সৃষ্টিশীলতা বলতে তথ্য ও উদ্ভাবনকে নতুনভাবে প্রয়োগ করা বোঝাবে। সমালোচনামূলক চিন্তার দ্বারা নানা মাত্রিকভাবে তথ্য বিশ্লেষণ এবং উত্থাপিত দাবিগুলোকে সমালোচনা করা হয়। তথ্য সরবরাহ অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করার জন্য যোগাযোগ দরকার। আর সহযোগিতা বলতে টিমওয়ার্ক বা পার্টনারশিপ বোঝায়, যা যেকোনো অর্জনকে টেকসই করার জন্যে এক অনিবার্য উপাদান। সে কারণেই সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ১৭ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে পার্টারশিপ। এসব দক্ষতা অর্জনের সুতিকাগার হলো উচ্চশিক্ষাঙ্গন অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়। এই চারটি দক্ষতা অর্জন করা ছাড়া একজন শিক্ষার্থী নিজেকে ২১ শতকের উপযোগী শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে না।
সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী দক্ষতাসম্পন্ন সমালোচনামূলক চিন্তনের অধিকারী যোগাযোগক্ষম এবং সহযোগিতার মান এবং মানসিকতাসম্পন্ন শিক্ষার্থী উৎপাদন উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের অপরিহার্য উপাদান। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে কিংবা শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ কিংবা স্মার্ট বাংলাদেশ কিংবা ডেলটা প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নের কারিগর হিসেবে কাজ করবে এই চার দক্ষতায় ঋদ্ধ শিক্ষার্থীরা। শেখ হাসিনা সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ একটি সুপরিকল্পিত, সুসমন্বত এবং সুদূরপ্রসারী শিক্ষানীতি। এখানে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন, বাংলাদেশ সংবিধানের আর্টিকেল ১৭, জাতিসংঘের এডুকেশন ফর অল পলিসি, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস এবং অন্যান্য শিক্ষাসংক্রান্ত বৈশ্বিক ঘোষণাপত্রের প্রভাব রয়েছে। এই শিক্ষানীতির মৌলিক দিকগুলো অক্ষুণ্ন রেখে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বায়নের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বাংলাদেশের স্নাতকদের একুশ শতকের উপযোগী ওয়ার্ক ফোর্স হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের উচ্চশিক্ষা কাঠামোকে বারবার আধুনিকায়ন করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিকীকরণ এবং শিক্ষার্থীর বিশ্বায়ন ছাড়া সম্ভবপর নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ মূলত চারটি স্তম্ভের ওপর নির্ভরশীল: এক. মানবসম্পদ উন্নয়ন, দুই. নাগরিকদের সংযুক্তকরণ, তিন. ডিজিটাল প্রশাসন এবং চার. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন।
মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য ইতোমধ্যে অনেক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। দক্ষ ও ডিজিটাল-রেডি লোকবল সৃষ্টির জন্য প্রতি বছর ৫ লাখ স্নাতকের মধ্যে ৭০ হাজারকে ITES (Information Technology Enabled Services) পেশাদার হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অনলাইন লোকবল সরবরাহ করে। নাগরিক সংযুক্তকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে শতভাগ সংযুক্তি স্থাপনে সক্ষম হবে বলে আশাবাদী। বর্তমানে ৯৫ মিলিয়ন ইন্টারনেট এবং ১৬৫ মিলিয়ন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী জনসংখ্যা বাংলাদেশকে এশিয়া প্যাসিফিকের মধ্যে পঞ্চম মোবাইল মার্কেট এবং বিশ্বের মধ্যে নবম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (BSCCL) বাংলাদেশের মানুষকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ফাইবার অপটিক সাবমেরিন ক্যাবল ব্যান্ডউইথ এবং সর্বাধুনিক ইন্টারনেট ট্রানজিট সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্তি করেছে। আরও উত্তেজনাকর খবর হলো বাংলাদেশ অচিরেই তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে সংযুক্ত হতে যাচ্ছে, যার ফলে আমরা প্রতি সেকেন্ডে ৬ টেরাবাইট (৬০০০ গিগাবাইট) ব্যান্ডউইথ পাব, যা প্রায় অবিশ্বাস্য। ই-গভর্ন্যান্সেও আমরা ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটির স্বীকৃতি পেয়েছি। দেশজুড়ে ৮ হাজার ২৮০টি ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে, যা ডিজিটাল ডিভাইস সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের চতুর্থ স্তম্ভ আইসিটি ক্ষেত্রেও অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে, যা জনগণকে আর্থিক, টেলিযোগাযোগ এবং স্বাস্থ্যসেবায় সহায়তা দিচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ১২০টি কোম্পানি বিশ্বের ৩৫টি দেশে ICT দ্রব্যাদি রপ্তানি করে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করছে, যা অতিশিগগিরই ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। ICT শিল্পের টেকসই উন্নয়ন বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল অর্থনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে জ্ঞান অর্থনীতিতে (knowledge economy) উন্নীত করবে।
বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত সময়ের আগেই উন্নয়নশীল দেশের স্ট্যাটাস পেয়েছে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শিল্পোৎপাদনে গতিশীলতা এসেছে। কিন্তু কেবল কৃষি আয় শিল্পোন্নয়ন দিয়ে উন্নত দেশে উত্তরণ সম্ভব নয়। সার্ভিস সেক্টরের উন্নয়ন দরকার। বিশ্ব অর্থনীতির বৃহত্তম খাত হলো সেবা খাত। বাসন পরিষ্কার করা থেকে বিমান চালনা, রক কনসার্ট থেকে ব্রেইন সার্জারি কিংবা সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সবই সার্ভিস সেক্টরের ভেতরে পড়ে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সবগুলোই অর্থনৈতিক ভিত, মূলত এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের যে বিশাল জনশক্তি রয়েছে, তাকে বৈশ্বিক জনসম্পদে রূপান্তরিত করে বাংলাদেশের সার্ভিস সেক্টরের উন্নয়ন ঘটানো যাবে। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নতুন নতুন ভূমিকা পালন প্রয়োজন। ইনোভেশন হার, একাডেমিক ইনকিউবেটর হিসেবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রস্তুত করতে যাবে। সিলিকন ভ্যালি স্পিরিট অর্থাৎ হাইটেকনোলজি, ইনোভেশন, ভেনচার ক্যাপিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়ার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উদ্ভাবক, গবেষক, উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। কেবল সার্টিফিকেটধারী সরকারি চাকরিপ্রত্যাশী সনাতনী স্নাতক বনে থাকার দিন অনেক আগেই শেষ হয়েছে। চারটি মৌলিক প্রবণতা বর্তমান বিশ্বের সমাজ-সভ্যতা-রাষ্ট্র সবকিছুকে প্রভাবিত করছে। প্রথমত, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা; দ্বিতীয়ত, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দায়; তৃতীয়ত, দ্রুত নগরায়ণের প্রকোপ মোকাবিলা এবং চতুর্থত, চতুর্থ শিল্পবিপ্লরের অভিঘাত মোকাবিলা। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার নীতিনির্ধারণে এবং বাস্তবায়নে বিষয়গুলো মাথায় রাখাতে হবে।
মোদ্দা কথা হলো, বাংলাদেশে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর সর্বজনীন মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে কোর্স-কারিকুলাম আমাদের জাতীয় ভিশন-মিশন-লক্ষ্য-পরিকল্পনা প্রভৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে প্রণীত হবে। এর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য থাকবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবসহ সব অনিবার্য বিশ্বপরিস্থিতির মোকাবিলা করা- বাংলাদেশের উন্নয়নেরে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এবং বৈশ্বিক জ্ঞান অর্থনীতিতে অবদান রাখা। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তাহলে উচ্চশিক্ষা জাতির মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক পরিচালনা করে সব দেহকাণ্ডকে। মস্তিষ্ক আবার সক্রিয় থাকে চর্চায়, অনুশীলনে। আর সেই অনুশীলনের সবচাইতে উপযুক্ত ক্ষেত্র হোলো উচ্চশিক্ষা।
ড. রাশিদ আসকারী: দ্বিভাষিক লেখক, অনুবাদক এবং সাবেক উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
রক্ষণশীলতা আর কুসংস্কারে আচ্ছন্নতাই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাল হচ্ছে। একুশ শতকে এসেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত ভয় হয়ে জেঁকে আছে পোলিও। অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের আরও ছয়টি জেলার পরিবেশগত নমুনায় নতুন করে পোলিও ভাইরাস নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, গত ১০ নভেম্বর করাচি থেকে চারটি এবং চমন থেকে দুটি নমুনায় পোলিও ভাইরাস নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া পেশোয়ার, কোহাট এবং নওশেরা থেকে একটি করে নমুনায়ও ভাইরাসটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এমন স্বাস্থ্যসংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও পোলিও টিকাবিরোধী একটার পর একটা পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বকে হতবাক করে চলেছে দেশটির কট্টরপন্থিরা। খুব সম্ভবত পাকিস্তানের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তানকেও ছাড়িয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য এটি বড় এক উদাহরণ। মৌলবাদীদের প্রশ্রয় না দেয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কতটা এগিয়ে দিয়েছেন তার এক দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচনা করা যায় পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রণহীন পোলিও সংক্রামণের বিষয়টি।
চলতি বছরেই আগস্টে পাকিস্তানে পোলিও টিকাদান প্রচারাভিযানে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, শিশুদের পোলিওমুক্ত করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে পাকিস্তান এখন বিশ্বব্যাপী একটি হুমকি। রক্ষণশীল পাকিস্তানের গ্রামীণ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে পোলিও টিকা দেয়ার প্রচারণার বিরোধিতা করে আসছে কট্টরপন্থি ধর্মীয় দলগুলো। পোলিও টিকাদান কর্মসূচিকে তারা দেখেছে মুসলিম শিশুদের বন্ধ্যত্বকরণের একটি চক্রান্ত হিসেবে। এ ছাড়া পোলিও টিকাদানকারীদের সরকারি গুপ্তচর হিসেবে দেখে রাষ্ট্রবিরোধী জঙ্গিরা। পাকিস্তান এবং তার প্রতিবেশী আফগানিস্তানই বিশ্বের একমাত্র দুটি দেশ যেখানে শিশুদের স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলেছে পোলিও।
আবিষ্কৃত ভাইরাসের সর্বশেষ ধরনটি আফগানিস্তানের ‘ওয়াইবি৩এ’ ভাইরাস ক্লাস্টারের অন্তর্গত উল্লেখ করে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. নাদিম জান বলেন, প্রতিটি শিশু ভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের আজীবন পঙ্গু করে দিতে পারে ভাইরাসটি। গত ২ অক্টোবর অভিভাবকদের নিজেদের বাড়িতে পোলিওকর্মীদের স্বাগত জানাতে এবং তাদের সন্তানদের আজীবন অক্ষমতা থেকে রক্ষা করতে টিকা দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন তিনি। ৫ বছরের কম বয়সী ৪৪ মিলিয়ন শিশুকে টিকা দেয়ার প্রয়াসে দ্বিতীয়বারের মতো দেশব্যাপী পোলিওবিরোধী অভিযান চলছিল এ সময়। সম্প্রতি সংগৃহীত নয়টি পরিবেশগত নমুনার মধ্যে টাইপ-১ ওয়াইল্ড পোলিও-ভাইরাসও (ডব্লিউপিভি১) রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও পোলিওর প্রচারাভিযানে গিয়ে হামলার শিকার হচ্ছেন ভ্যাকসিনকর্মী ও তাদের সুরক্ষার জন্য নিযুক্ত পুলিশ। জঙ্গিরা এ টিকাদান কর্মসূচিকে প্রচার করছে পাকিস্তানি শিশুদের বন্ধ্যাকরণের একটি পশ্চিমা ষড়যন্ত্র বলে। মাত্র সপ্তাহ দেড়েক আগেই হাঙ্গুর উপকণ্ঠ সরোজাইতে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের হাতে নিহত হয়েছেন ওরাকজাই নামে পোলিও দলের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এক পুলিশ সদস্য। এর আগে, একই বছরের আগস্টে পোলিও টিকাদানকারীদের ওপর আরেকটি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানে। ওই হামলায় প্রাণ হারান দুই পুলিশ সদস্য। বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটায় জাতীয় টিকাদান অভিযানের সময় গুলি চালানোর এ ঘটনাটি ঘটে। স্থানীয় নাওয়া কিলি এলাকায় তখন শিশুদের পোলিওর ডোজ খাওয়াচ্ছিলেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। হঠাৎ একটি মোটরসাইকেলে এসে দুই ব্যক্তি তাদের ওপর গুলি চালায় এবং ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। গুলিতে দুই পুলিশ মারা গেলেও পোলিও টিকাদানকারীরা অক্ষত অবস্থায় রক্ষা পান। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা মারওয়াত জানান, ওই এলাকায় পোলিও অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। প্রাণঘাতী এ হামলার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কোনো দায় স্বীকার করা হয়নি, তবে পোলিওকর্মীদের ওপর জঙ্গি হামলা পাকিস্তানে অস্বাভাবিক নয়। সহিংসতায় বহু স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন এবং নিরাপত্তা বাহিনী তাদের রক্ষা করছে। পোলিও অভিযানে নারী-পুরুষ, পুলিশ এবং নিরাপত্তাকর্মীসহ ২০০ জনেরও বেশি পোলিও দলের কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন গত কয়েক বছরে। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক আহতও হয়েছেন এসব সহিংসতায়।
২০১২ সাল থেকে এক খাইবার পাখতুনখোয়া (কেপিকে) প্রদেশেই ৭০ জন পোলিওকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের মার্চে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনের একটি গবেষণা নিবন্ধে বিষয়টির উল্লেখ আছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে কোয়েটায় একটি আত্মঘাতী হামলায় মারা যান আরও কয়েকজন পোলিওকর্মী। একই শহরের আরেকটি হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ৬ জন নারী পোলিওকর্মী। পোলিও প্রচারাভিযানকালে ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সমগ্র পাকিস্তানজুড়ে ৬৮ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আরেকটি সূত্র। শুধু গোলাগুলিই নয়- পোলিও সচেতনতা ছড়ানোর দায়ে অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনাও নেহাত কম নয়। করাচি এবং কেপিকে প্রদেশে মৌখিক ও শারীরিক নির্যাতনের একাধিক ঘটনায় প্রতিবেদনও হয়েছে অতীতে। পোলিও অভিযানে জড়িত থাকায় খাইবার এজেন্সি থেকে অপহরণ করা হয়েছিল ১১ জন শিক্ষককে। এভাবে, সমস্যার স্কেল বেশ ভয়ংকর।
অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসটি নির্মূল করার জন্য চলতি বছরের আগস্ট থেকে তার সর্বশেষ পোলিও টিকাদান অভিযান শুরু করে পাকিস্তান। সপ্তাহব্যাপী অভিযানের লক্ষ্য ছিল বেলুচিস্তানসহ ৬১টি জেলাজুড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৮ মিলিয়ন শিশুকে টিকা দেয়া। লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ৬৫ হাজার কর্মী মোতায়েন করেছিল প্রাদেশিক সরকার। পাকিস্তানে ২০২৩ সালে এ পর্যন্ত পোলিও পক্ষাঘাতের তিনটি ঘটনা ঘটেছে। গত বছর আক্রান্ত হয়েছিল ২০ জন। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত পাকিস্তানে প্রতি বছর হাজার হাজার শিশুকে পঙ্গু করে দিত অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসটি। এতসব বাধা পেরিয়ে পোলিও নির্মূলে সরকার যখন টিকা প্রচারাভিযান শুরু করল ঠিক তখনই আরেকটি নতুন স্ট্রেইনের আত্মপ্রকাশ বড় এক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানের জন্য। একইসঙ্গে ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে প্রচারণা, জঙ্গি হামলা এবং মারাত্মক পঙ্গু রোগ নির্মূল করার জন্য পাকিস্তানের প্রচেষ্টাকেও পিছিয়ে দিয়েছে এ কারণটি। পোলিওবিরোধী টিকাদানে বাধা সৃষ্টিকারী প্রাথমিক কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের শিশুদের টিকা দিতে দ্বিধাগ্রস্ত। ২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি নিবন্ধ দুটি কারণের কথা উল্লেখ করেছে ল্যানসেট। পাকিস্তানে শিশুদের ডব্লিউএইচও দ্বারা সুপারিশকৃত সংখ্যার চেয়ে বেশি ডোজ দেয়া হয়। কিন্তু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বুস্টার ডোজের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা না থাকা এটি জনসাধারণের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা বাড়াচ্ছে। উপরন্তু, স্টোরেজ এবং পরিবহনের সময় ভ্যাকসিনের ভুল ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, পোলিও টিকা দেয়ার পরে শত শত শিশুকে পেটে ব্যথা ও বমির উপসর্গ দেখা দেয়ায় এবং অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে গুজব রটানো হয় ২০১৯ সালে। খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে একটি স্বাস্থ্য-পরিচর্যা কেন্দ্র পুড়িয়ে দিয়েছে ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা। পাকিস্তান সরকার পরে গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত মূল ষড়যন্ত্রকারীকে গ্রেপ্তার করে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এরপরও এ ঘটনার ফলে অনেক অভিভাবকের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। পোলিও টিকাদানকারীদের প্রতি এ বৈরী মনোভাব এবং ধর্ম ও পোলিও ভ্যাকসিন সম্পর্কে ভুল ধারণা একটি বড় জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তান সরকারের জন্য।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো রাষ্ট্রগুলোর কারণে পোলিওমুক্ত হওয়ার পরও ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০০৬ সালে (১৮ জন) পোলিও রোগী পাওয়া গিয়েছিল বাংলাদেশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার সফলতায় বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত হলেও এখনো ঝুঁকিমুক্ত নয়। কারণ, ভাইরাস বহনকারী শিশুটি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, ভাইরাসটি অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
ডব্লিউএইচও ২০১৪ সালে বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার ১১টি দেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করে। এ ছাড়া ২০০০ সালের আগে প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ জনের মতো প্যারালাইজড পোলিও রোগী পাওয়া যেত। ২০০০ সালের পর দীর্ঘদিন দেশে কোনো পোলিও রোগী পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন পোলিওমুক্ত ঘোষণার অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ডব্লিউএইচও বাংলাদেশকে তখনো একটি সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে। ২০০৬ সালে পোলিওমুক্ত ঘোষণার সময় এলেও সেই বছর হঠাৎই দেশে ১৮ জন পোলিও রোগী পাওয়া যায়। এরপর বাংলাদেশে আর কোনো পোলিও আক্রান্ত রোগী পাওয়া না গেলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পোলিও সংক্রমণ পাওয়া যাওয়ার কারণে আরও আট বছর লেগে যায় পোলিওমুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি পেতে। ১৯৭০-এর শুরু থেকে পোলিও নির্মূলে কাজ করে সফলতার মুখ দেখতে ২০ বছর লেগে যায় দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের। পাকিস্তানের মতো শিশুদের টিকা খাওয়ানোর ব্যাপারে অনাগ্রহ ও দ্বিধা ছিল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অভিভাবকদের মধ্যেও। পোলিওর বিরুদ্ধে সফলতা খুব একটা সহজ ছিল না। একটা সময় এমনও ছিল যখন মানুষ তার সন্তানকে টিকা খাওয়াতে চাইত না। গ্রামাঞ্চলের মানুষকে বিষয়টি সম্পর্কে অনুধাবন করাতে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। সঠিক ও সুকৌশলী কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে পোলিও নির্মূলে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের সফলতা এসেছে বেশ দ্রুতগতিতে। তা ছাড়া সতর্কতামূলক কার্যক্রম হিসেবে নিয়মিত প্রতি বছর টিকাদান কর্মসূচি চালু আছে, যাতে আর কোনো শিশু পোলিওতে আক্রান্ত না হয়। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে গড়া কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাপনা। মানুষের ঘরের কাছে টিকা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে এ কমিউনিটি ক্লিনিক। শুধু তাই নয়- নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিশুমৃত্যু হ্রাসে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে কমিউনিটি ক্লিনিক।
তবে এর মধ্যেও আশঙ্কাজনক ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে কিছু পোলিও রোগী এখনো পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবছর এখনো দুই থেকে তিনজন রোগী পাওয়া যাচ্ছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে অনেক মানুষ এ দেশে আসা-যাওয়া করে। এদের মধ্যে জীবাণু বহনকারী যে কারও মাধ্যমে পোলিও রোগ ছড়াতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যখন ১৯৮৮ সালে বিশ্ব পোলিও নির্মূলীকরণ উদ্যোগটি নেয়, তখন পর্যন্ত আনুমানিক ৩ লাখ ৫০ হাজার শিশু পোলিওর কারণে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। বর্তমান বিশ্বে শুধু পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেই স্থানীয়ভাবে ছড়ায় সংক্রামক ভাইরাসটি। ফলে বিশ্বের অন্যান্য অংশে পোলিও সংক্রমণের উৎস হতে পারে দেশ দুটি। পাকিস্তান অবশ্য বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতীয় জরুরি কর্মপরিকল্পনার অধীনে কার্যকর কৌশলের রূপরেখা দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এ পরিকল্পনায় পোলিওকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য কোনো নীতি ও কৌশলগত অগ্রাধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সর্বশেষ গৃহীত কার্যকর কৌশলের রূপরেখা সফল না হলে পোলিওর পরবর্তী ‘সুপার-স্প্রেডর’ হতে পারে পাকিস্তান।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আগের দিন মানুষের সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানি পানের জন্য পুকুর, জলাশয়, নদী-নালার পানিই ছিল একমাত্র ভরসা। সমাজে যারা বিত্তবান তারা কুয়া বানাতেন। ১০ থেকে ১৫ ফুট গোল গর্ত, ৫০ থেকে ৬০ ফুট নিচ পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে ইন্দারা, কুয়া বা কুপ তৈরি করা হতো। পুরোনো দিনে জমিদার, রাজা, বাদশা রানীরা তাদের প্রজাদের পানির ব্যবস্থা করে দিতেন পুকুর, কুয়া বা ইন্দারা স্থাপনের মাধ্যমে। ষাটের দশকেও যাদের জন্ম, তাদের অভিজ্ঞতায় সুপেয় পানির অভাব, পুকুরের জলাশয়ের পানি পান করে কলেরা, টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা থাকার কথা। কুয়া বা ইন্দারা সারাবিশ্বে পানীয় জলের একমাত্র উৎস হিসেবে জানত মানুষ। আমাদের নবী করিমের (সা.) বিভিন্ন বর্ণনায় কুয়া চলে এসেছে। নবী ইউসুফ (আ.)-কে ভাইদের দ্বারা কুপে নিক্ষেপের কাহিনি সর্বজন বিদিত। তার মানে কুয়া বা ইন্দারা অনেক ঐতিহ্যপূর্ণ পুরোনো এক সংস্কৃতি। যার মূল্যবান ইতিহাস পাওয়া যায়। দৈনন্দিন কাজে পান করা ছাড়াও পানির বহুবিদ ব্যবহার অস্বীকার করা যায় না। গ্রীষ্মকালে পুকুর, খাল, বিল, নদী-নালা শুকিয়ে যেত। তখন এসবের পানি নোংরা হয়ে যেত, যা পান করার মতো থাকত না। ফলে কুয়া নির্মাণ করার প্রয়োজন দেখা দিত।
যারা বিত্তবান, তারা সান বাঁধানো বিশাল পানির ইন্দারা বানিয়ে নিতেন।
কুয়া ও ইন্দারার মধ্যে পার্থক্য হলো, ইন্দারার নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত ইট বা মাটির তৈরি রিং যা ইটের মতো আগুনে পোড়ানো ও বেশ শক্ত হতো। আর কুয়া লম্বা করে গভীর গর্তই থাকত, কোনো রূপ বাঁধাই করা হতো না। ইন্দারা অনেক জায়গা ধারণ নিয়ে তৈরি হয়। শহরে, গ্রামে সব জায়গাতেই ইন্দারা ও কুয়া দেখা যেত। ইন্দারার ওপর চাকা লাগানো হতো, যা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ইন্দারা থেকে পানি উত্তোলনের জন্য কপিকল ব্যবহার করা হতো। সন্ধ্যা ও সকালে পাড়ার বৌ-ঝিরা কলসি কাঁকে নিয়ে ইন্দারা বা কুয়া পাড়ে জমা হতেন পানি নেয়ার জন্য। রশিতে ছোট বালতি বেঁধে কুয়া বা ইন্দারা থেকে পানি উঠানো হতো। পানির জন্য রশি পচে গিয়ে বালতিটি কুয়া বা ইন্দারার ভিতর কখনো বা কখনো পড়ে যেত। বালতি উঠানোর জন্য বড়শির মতো কাঁটাওয়ালা লোহার তৈরি হুক ব্যবহার করা হতো। হুকটি লম্বা কাঁটা মানে চিকন লম্বা নলি বাঁশের মাথায় বেঁধে কুয়ার ভিতর একদম নিচে আস্তে আস্তে ঘুরাতে থাকলে বালতিটি বড়শির মতো থাকা কাঁটায় আটকে যেত। তখন আস্তে আস্তে নলি বাঁশটি টেনে তুললে বালতিও সঙ্গে চলে আসত। গোল রিং দেয়া কাঁচা বা পাতি কুয়ার ভিতরের দিকে পা রাখার খাবিকাটা মানে রিংয়ের বধির্ত অংশ থাকত, যা দিয়ে সাহসীরা কুয়ার নিচে বেয়ে বেয়ে নামতে পারতেন।
ইন্দারা বা কুয়ার মুখে নিচ দিকে চেয়ে জোরে চিৎকার করে উঠলে সেই শব্দটা কুয়া বা ইন্দারার ভিতর প্রতিধ্বনি হতো, কুয়ার ভিতর কোনো কিছু ফেললে তার শব্দটাও ইকো হয়ে কানে লাগত, যা ছোটবেলার একটা খেলা বলে মনে হতো।
কুয়া বা ইন্দিরার পানি খুব ঠাণ্ডা থাকে। ফলে তীব্র গরমের দিনে ইন্দারা বা কুয়ার পানি উঠিয়ে গোসল করা খুব আরাম দায়ক ছিল। বৃটিশ আমলে প্রতিটা রেলস্টেশনে, আদালত চত্বরে, থানা চত্বরে সরকারিভাবে ইন্দারা বা কুয়া নির্মাণ করে দেয়া হতো। প্রতিটা হিন্দু বাড়িতে একটা কুয়া অপরিহার্যভাবে থাকত। পাশেই হয়তো করমচা গাছ, কামরাঙা গাছ, তুলসীর বেদী, জবাফুলের গাছ। কুয়ার কাজটায় সাধ্যমতো পাকা করে দেয়া হতো, পানি সংগ্রহে সুবিধার জন্য। সকাল-সন্ধ্যায় পাড়ার মহিলারা পানি নিতে কুয়া পাড়ে আসতেন। ফলে পুরো পাড়ার সব খবরাখবর এক কান থেকে দুই কান হয়ে ছড়িয়ে পড়ত। এখানেও চলত নানান সামাজিক দায় ও ভিলেজ পলিটিক্স।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনারা রাজাকারদের সহযোগিতায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে বড় কুয়া বা ইন্দারায় ফেলে দিয়েছিল। ফলে সেই সব ইন্দারা বা কুয়া আজও বধ্যভূমি হয়ে আছে। যদিও সেইসব কুয়া এমনিতেই ভরাট হয়ে গেছে। কুয়া বা ইন্দারা নিয়ে সাহিত্যে অনেক গল্প, উপন্যাস রচিত হয়েছে।
এখনকার দিনে সারা গ্রাম হেঁটে এলেও একটা কুয়া বা ইন্দারা খোঁজে পাওয়া যাবে না। সুপেয় পানির নিশ্চয়তায় টিউবওয়েল চলে এসেছে অনেক আগেই। বিদ্যুৎ আসায় এখন গ্রামেও পানির পাম্প ব্যবহার করে, ট্যাঙ্কে পানি ধারণ করে পাইপের দ্বারা পানির টেপের মাধ্যমে মানুষ সহজ করে নিয়েছে তাদের প্রাত্যহিক জীবন। অতীত সবসময়ই বর্তমানকে পথ দেখায়। কুয়া বা ইন্দারা আমাদের হাজার বছর আগের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এমন একদিন আসবে, পরবর্তী প্রজন্ম কুয়া বা ইন্দারা কি, কীভাবে তৈরি হয়, কি কাজে ব্যবহৃত হয়, তার আদ্যোপান্ত কিছুই জানবে না।
লেখক: শিশু সাহিত্যিক ও গবেষক