শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সাক্ষাৎকার

রিজার্ভ নিয়ে নেতিবাচক চিন্তার সুযোগ নেই

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। ছবি: সংগৃহীত
এম এ খালেক
প্রকাশিত
এম এ খালেক
প্রকাশিত : ১৬ মার্চ, ২০২৩ ০৮:৫৭

বীর মুক্তিযোদ্ধা, অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ পল্লি কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন ও ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ছাড়াও তিনি উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। সম্প্রতি তিনি দেশের মূল্যস্ফীতি, গ্রামীণ অর্থনীতি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভসহ নানা বিষয়ে অর্থনীতিবিষয়ক লেখক এম এ খালেক-এর মুখোমুখি হয়েছেন।

এম এ খালেক: বিশ্বব্যাপী যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে তার কারণ কি এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির প্রভাব কীভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব বলে মনে করেন?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: বিশ্বব্যাপী যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে প্রাথমিক দুটো কারণকে আমরা দায়ী করতে পারি। এর মধ্যে একটি হচ্ছে করোনা অতিমারির প্রভাব। করোনা অতিমারির কারণে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। মানুষের আয় কমে গেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা একই বিষয় লক্ষ করি। করোনার কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গেছে। মানুষের আয়রোজগার কমে গেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে।

করোনার প্রভাব কমে আসায় বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ঠিক সেই পর্যায়ে শুরু হয় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী নতুন করে সংকট সৃষ্টি হয়। করোনা অতিমারির সংক্রমণ থেকে বিশ্ব যখন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় ছিল ঠিক তখনই শুরু হয় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্ব অর্থনীতিকে আবারও সংকটে ফেলে দেয়। এই যুদ্ধের ফলে বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এর জের এখনো বিশ্বকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

এম এ খালেক: চলতি অর্থবছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কেমন হতে পারে বলে মনে করেন?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: করোনা অতিমারির পর আমাদের এখানে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া খুব ভালোভাবে শুরু হয়েছিল। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৪ শতাংশের মতো জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রাথমিক হিসাবে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখানো হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে তা ৭ দশমিক ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি বিকাশমান অর্থনীতি ৭ দশমিক ১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যেকোনো বিচারেই উল্লেখের দাবি রাখে। করোনা শুরু ওয়ার আগে এক বছর আমরা ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলাম। কাজেই আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার প্রায় করোনার পূর্বাবস্থায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আবারও আমরা পিছিয়ে পড়েছি। চলতি অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে প্রাক্কলন আছে তা অর্জন করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে উন্নয়ন সহযোগীরা জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করেছে তা খুব একটা খারাপ নয়।

এম এ খালেক: গ্রামীণ অর্থনীতির যে নীরব রূপান্তর চলছে সে সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: আমাদের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। সরকার গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশমান ধারায় প্রবহমান রয়েছে। আগামীতেও বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক অবস্থায় থাকবে বলে আশা করা যাচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে একধরনের নীরব রূপান্তর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম থেকেই যুবক শ্রেণি কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে যাচ্ছে। তারা দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। তাদের পাঠানো অর্থে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে। একসময় যারা গ্রামে দরিদ্র পরিবার হিসেবে পরিচিত ছিল আজ তাদের অনেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। শহরের সুবিধাদি এখন গ্রামীণ জনপদেও পাওয়া যাচ্ছে। সরকার শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাওয়ার যে পরিকল্পনা করেছে তা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আমাদের পণ্য রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে পণ্য রপ্তানি করে। এর মধ্যে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। রেমিট্যান্সও ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। ২০০৭-২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে আমি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, অর্থনৈতিক মন্দার সময় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়বে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে উন্নত দেশের ভোক্তাগণ দামি পোশাকের পরিবর্তে তুলনামূলক স্বল্প মূল্যের তৈরি পোশাক ক্রয় করে। বাংলাদেশ তুলনামূলক কম দামি পোশাক রপ্তানি করে থাকে। কাজেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমবে না। এবারও ঠিক সে কথাই আমি বলব। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাবে। রেমিট্যান্স বিনিয়োগে খুব একটা আসছে না। এগুলো মূলত ভোগ ব্যয়ে খরচ করা হয়। ভোগ ব্যয়ে খরচ বাড়লে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কাজেই এরও একটি ইতিবাচক দিক আছে। আমি মনে করি, চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করেছে তার কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে সত্যি কিন্তু অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতি আমাদের আশান্বিত করে।

এম এ খালেক: বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ নিয়ে নেতিবাচক কথা শোনা যায়। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ নিয়ে মাঝেমধ্যেই নেতিবাচক কথা শোনা যায়। বলা হয়, রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। রিজার্ভ কমার অনেকগুলো কারণ আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারেও আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বেড়েছে। ফলে রিজার্ভ ব্যয় হচ্ছে বেশি। কিন্তু রিজার্ভ থেকে অর্থ ব্যয় করলেও রিজার্ভে নতুন করে অর্থ যোগ হচ্ছে। কাজেই রিজার্ভ নিয়ে নেতিবাচক চিন্তার তেমন কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয় ইত্যাদি যাতে বৈধ পথে আসে সে ব্যাপারে সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসছে বলে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন। সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে রেমিট্যান্স যাতে বৈধ পথে দেশে আসে। পণ্য রপ্তানি আয় বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই তার সুফল আমরা পেতে শুরু করেছি। ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ আমদানি ব্যয় হয়েছিল সাড়ে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বছর শেষে সেটা ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। কাজেই আমদানি ব্যয় অনেকটাই কমেছে। আগামীতে আমদানি ব্যয় আরও হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমাদানি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে কোনোক্রমেই যেন ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি না কমে। এসব পণ্যের আমদানি কমলে দেশে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হবে, যা শেষ পর্যন্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট করে দারিদ্র্যবিমোচন প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করবে। অপ্রয়োজনীয় অথবা কম প্রয়োজনীয় অথবা আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনের সুযোগ আছে সেসব পণ্য আমদানি কমানো যেতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে সমস্যা কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এবং অনেক ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জিত হচ্ছে। এসব বিবেচনায় আমি মনে করি, ২০২৩ সাল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যতটা খারাপ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল তা হবে না।

এম এ খালেক: আপনি রেমিট্যান্সের কথা বললেন। গত অর্থবছরে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমতুল্য রেমিট্যান্স অবৈধ পথে দেশে এসেছে বলে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: গত বছর বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ বিদেশে গেছে কর্মসংস্থানের জন্য। সব দেশেই যে উন্নয়নমূলক বন্ধ হয়ে গেছে অথবা কমেছে তা কিন্তু নয়। অনেক দেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই হচ্ছে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির প্রধান গন্তব্য। সেখানে উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। যারা বিদেশে চাকরি করেন তারা কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেন। তারা যদি ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে কার্ব মার্কেটে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে বেশি অর্থ পান তাহলে অনেকের মধ্যেই কার্ব মার্কেটে মুদ্রা বিনিময় করবেন। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে তিন-চারটি রেট কার্যকর রয়েছে। মুদ্রা বাজারে তিন-চারটি বিনিময় হার থাকা উচিত নয়। আমি মনে করি,এ ক্ষেত্রে সমন্বয় করে দেয়া উচিত। কার্ব মার্কেটের বিনিময় হার বেশি হতে পারে, তবে তা কোনোভাবেই এক বা দুই টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। অনেকেই মনে করেন, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। যদি অন্য কিছু বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারও বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। কিছু বিষয় নিয়ন্ত্রণ করব, আবার কিছু বিষয় বাজারের ওপর ছেড়ে দেব, এটা ভালো ফল দেবে না। মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থাকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। সেই সীমার বাইরে চলে গেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। আর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সব ক্ষেত্রে এবং সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। এর চেয়েও খারাপ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে প্রেরণ করা হচ্ছে। রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হচ্ছে। এটা কঠোরভাবে রোধ করা প্রয়োজন। এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে অর্থ পাচার অনেকটাই কমে আসত। আমাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের অভাব প্রতিনিয়তই বাড়ছে।

এম এ খালেক: বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পেয়েছে। এই ঋণ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ছিল। ঋণের বিপরীতে বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। বাংলাদেশের পক্ষে এই শর্তগুলো কতটা পরিপালন করা সম্ভব বলে মনে করেন?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: আইএমএফ ঋণদানের সময় বাংলাদেশকে যেসব শর্ত দিয়েছে তা পরিপালন করা কতটা সম্ভব তার চেয়ে আমি বলব, এর অধিকাংশ শর্তই বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যেমন আইএমএফ ব্যাংকিং সেক্টরের সংস্কার ও খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলেছে। দুর্নীতি কমানোর কথা বলেছে। রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছে। এগুলো আমাদের অর্থনীতির স্বার্থেই করা প্রয়োজন। সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এগুলো সরকারও বলছে। কিন্তু বললেও এগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি রোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছে। কাজেই এসব শর্ত এমনিতেও পালন করতে হবে। জাতীয় স্বার্থেই এসব সংস্কার সাধন করা প্রয়োজন। কিন্তু আগে করা হয়নি। এখন যদি আইএমএফের শর্তের কারণে সংস্কারগুলো করা হয় তাহলে সেটা ভালোই হবে। আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে তার কোনোটি মানা হচ্ছে। আবার কোনোটি মানা হচ্ছে । আইএমএফের সব শর্তই যে মানতে হবে তা নয়। যেমন কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানোর কথা সম্ভবত বলা হয়নি। কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো হলে দেশের কৃষি সেক্টরের উন্নতি বিঘ্নিত হবে। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস এগুলোর ওপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে তা ভালো হবে বলে মনে হয় না।

এম এ খালেক: সম্প্রতি ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ভোক্তা ঋণের সুদের সর্বোচ্চ সীমা কিছুটা বাড়িয়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে সুদের আপার ক্যাপ প্রত্যাহার করা হয়নি। এই অবস্থায় নীতি সুদ হার বাড়িয়ে কি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ করে দেয়াটা কোনোভাবেই যৌক্তিক বলে মনে হয় না। কোনো কোনো খাতে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার প্রত্যাহার করা হবে। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বহাল রাখা হবে- এটা কাম্য নয়। কিছু স্বার্থান্বেষী মহলকে খুশি করার জন্যই সম্ভবত এটা করা হচ্ছে। যারা ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণ করেন তাদের যে সুদ প্রদান করা হচ্ছে তা মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম। ফলে তারা আমানত সংরক্ষণের ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছেন না। সাধারণভাবে আমানতের ওপর প্রদেয় সর্বোচ্চ সুদের হার প্রত্যাহার করা হলে সাধারণভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও প্রত্যাহার করা উচিত ছিল।

এম এ খালেক: আমাদের দেশের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যায়। আগামী নির্বাচনের আগে এ বছর কি অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: অর্থ পাচার তো চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে। এখন তো হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। মাঝেমধ্যেই পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয় অর্থ পাচারের। নির্বাচনের বছরে অনেকেই অর্থ পাচার করে থাকেন। তারা অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের নিরাপত্তা দিতেই এটা করে থাকেন। আসলে নির্বাচনের সঙ্গে অর্থ পাচারের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থ পাচার এমনিতেই হচ্ছে। দিন দিন তা বেড়ে যাচ্ছে।


তোমার পতাকা যারে দাও...

আপডেটেড ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ ১৮:৪৫
সজীব সরকার

‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি/তোমার সেবার মহান দুঃখ সহিবারে দাও ভকতি’ - রবীন্দ্রনাথের এ আকুলতা নিজের মধ্যে ভীষণরকম অনুভব করছি গত বুধবার টেলিভিশন ও গতকাল বৃহস্পতিবারের সংবাদপত্রগুলো দেখার পর। আবারো প্রমাণিত হলো, বাংলাদেশে সাংবাদিকতার জগতে ভীষণ রকমের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা চলছে। সাংবাদিকতার মূল আদর্শ থেকে গণমাধ্যমগুলোর বিচ্যুতি ঘটছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে খুলনা-বরিশাল মহাসড়কের ঝালকাঠিতে গাবখান সেতু টোলঘরের কাছে অপেক্ষারত ব্যাটারিচালিত তিনটি অটোরিকশা/ইজিবাইক ও একটি প্রাইভেটকারকে চাপা দেয় নিয়ন্ত্রণহীন একটি ট্রাক। এতে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে যার মধ্যে একাধিক শিশুও রয়েছে।
এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে দেখানো হয়েছে। গতকালকের একাধিক পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছে গাড়ির ভেতর পিষ্ট দুই শিশুসহ বাবা-মায়ের লাশের ছবি। যারা ওই ভিডিও ফুটেজ এবং বিশেষ করে গতকালকের পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত ওই ছবি দেখেছেন, কেবল তারাই বুঝবেন তা কতটা নিদারুণ যন্ত্রণা একজন সংবেদনশীল মানুষের মনে তৈরি করেছে। আর, ওই ছবি একটি শিশুর মনের ওপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, তা বড়দের বোধের বাইরে।
বুধবারের ওই ঘটনার ফুটেজ টেলিভিশনের খবরে প্রচার করা সাংবাদিকতার নীতিবিরুদ্ধ হয়েছে। শিশুদের লাশের এমন নির্মম ছবি প্রকাশ করে এসব পত্রিকা সাংবাদিকতার ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্ক তৈরি করেছে। যেসব গণমাধ্যম এ কাজটি করেছে, তাদের নিন্দা জানাচ্ছি। যারা এমনটি করেনি, তাদের ধন্যবাদ জানাই।
সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী লাশের ছবি, বীভৎস কোনো দৃশ্য, কাউকে নির্যাতনের কোনো ছবি- এগুলো প্রকাশের নিয়ম নেই। বিশেষ করে, যেসব ঘটনায় ভিকটিমের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হতে পারে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে কিংবা প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের (ট্রমা) কারণ ঘটতে পারে, সেসব ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের বাড়তি সতর্ক থাকার সুস্পষ্ট নিয়ম রয়েছে।
যৌন নির্যাতনের ঘটনা এবং শিশুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনার খবর প্রচার বা প্রকাশের ক্ষেত্রেও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের বিধি রয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো আসলে কী করছে?
আমার বক্তব্যের সমর্থনে গুটিকতক ঘটনা এখানে তুলে ধরছি।
বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনার ভিডিও ফুটেজ টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের খবরে দেখিয়েছে। গাড়িচাপায় সড়কে পিষ্ট রক্তাক্ত লাশের ফুটেজ দেখিয়েছে। বহুতল ভবনে আগুন লাগার পর জ্বলন্ত ভবন শুধু নয়- ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে মানুষের নিচে লাফিয়ে পড়ার ফুটেজ দেখিয়েছে বারবার। আগুন ধরা ভবন থেকে দড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে আহত-নিহত হওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। শিশু নির্যাতনের নানা ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও ছবি টিভি চ্যানেলের খবরে দেখানো হয়েছে। গ্রাম্য শালিসে বিচারের নামে নারীকে নির্যাতনের ভিডিও ও ছবি প্রচার করেছে। বয়স্ক নারীকে গাছে বেঁধে নির্যাতন কিংবা নারীকে বিবস্ত্র করে পেটানোর দৃশ্যও বিরল নয়। মুদ্রিত ও অনলাইন পত্রিকাগুলোও পিছিয়ে থাকেনি; এদের অনেকেই একইভাবে এসব ঘটনার ভিডিওচিত্র-স্থিরচিত্র প্রচার ও প্রকাশ করেছে।
পারিবারিক কলহ বা সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে অনেক শিশু হত্যার শিকার হয়। দারিদ্র্যের কারণে এবং বাবা-মায়ের পরকীয়া সম্পর্কের কারণে অনেক শিশু হত্যার শিকার হয়। প্রতিবেশীকে ফাঁসাতে নিজের সন্তানকে হত্যার ঘটনাও গণমাধ্যমে দেখা গেছে। সাংবাদিকদের এটি বোঝা দরকার, পরিবার একটি শিশুর জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হওয়ার কথা। কিন্তু, বাবা-মায়ের হাতেই যখন শিশুসন্তান নিহত হয়, তখন সেই খবর ঢালাওভাবে ও নির্বিচারে প্রচার করা কতটা যৌক্তিক?
এসব খবর যখন টিভি বুলেটিনে ‘চাঞ্চল্যকর’ ঘটনা হিসেবে প্রচার করা হয়, তখন তা শিশুদের নজর এড়ায় না। পত্রিকাগুলো যখন বড় হরফে রঙ-বেরঙের শিরোনাম দিয়ে এ খবরগুলো প্রকাশ করে, তা-ও শিশুদের চোখে পড়তে পারে। শিশুদের মনোজগতে এর কী ধরনের প্রভাব পড়ে, তা কি কখনো ভেবে দেখেন আমাদের দেশের সাংবাদিকরা?
‘সন্তানরা ঈদে নতুন জামা চাওয়ার পর তা কিনে দিতে না পেরে মনের দুঃখে তাদের নদীতে ফেলে দিয়েছেন বাবা’- কয়েক বছর আগে একটি টেলিভিশনের খবরে এভাবে ঘটনাটি প্রচার করা হয়েছে। পত্রিকাগুলোও তা-ই করেছে। ঘটনাটি এভাবে প্রচার করার মাধ্যমে এমন ‘অযোগ্য, অবিবেচক ও নৃশংস’ বাবার প্রতি কি এখানে অহেতুক সহমর্মিতা জানানো হলো না? সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুকে হাসপাতালে রেখে যাওয়া বা আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া কিংবা অর্থের জন্যে শিশুসন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার মতো খবরগুলো নির্বিচারে টিভিতে দেখানো বা পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা উচিত কি?
গণমাধ্যমগুলোর উপলব্ধি করা দরকার, এমন নির্বিচার প্রচারের কারণে খবরগুলো শিশুদেরও নজরে আসে। এতে তারা প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেতে পারে এবং আতঙ্কে ভুগতে পারে। এমনকি নিজের বাবা-মায়ের কাছেও তখন শিশুরা নিজেদের নিরাপদ মনে করবে না।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সময় সম্প্রচার ও মুদ্রিত- সব সংবাদমাধ্যম রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে অনৈতিক সাংবাদিকতা করেছে। ভিকটিমদের শিশুসন্তানকে সাংবাদিকরা বারবার তার বাবা-মায়ের হত্যাকাণ্ড ও হত্যাকারীদের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছেন। ‘কে মেরেছে, কারা মেরেছে, কী দিয়ে কুপিয়েছে - দেখেছো কি না’ - শিশুটিকে এমনসব প্রশ্নও করেছেন সাংবাদিকরা। এমনও শোনা গেছে, ঘুমন্ত শিশুটিকে চিমটি দিয়ে জাগানো হয়েছে এবং চিমটির আঘাতের কারণে ব্যথায় কাঁদতে থাকা শিশুটিকে ক্যামেরার সামনে ‘বাবা-মাকে হারিয়ে অনবরত কান্নারত শিশু’ হিসেবে তুলে ধরে ‘হিউম্যান ইন্টারেস্ট স্টোরি’ করার বাহবা নেওয়া হয়েছে।
বাবা-মাকে হত্যা করা ঐশীর ঘটনাতেও সাংবাদিকতার চূড়ান্ত নৈতিক বিপর্যয় দেখা গেছে। প্রথম দিন থেকেই ঐশী মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়েছে। সে অবশ্যই দোষী; কিন্তু, আদালতের রায়ের জন্যে আমাদের গণমাধ্যমগুলো অপেক্ষা করেনি; ঘটনার পর থেকেই সাংবাদিকরা খবরে বারবার ঐশীকে অবাধ্য, মাদকাসক্ত ও নৃশংস হিসেবে তুলে ধরেছেন। আত্মীয়-স্বজনের বরাত দিয়ে সাংবাদিকরাও বলেছেন, ‘চাওয়ার সাথে সাথেই তাকে টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোনসহ সবকিছু দেওয়া হয়েছে; এরপরও সে এমন নৃশংসভাবে নিজের বাবা-মাকে হত্যা করেছে।’ বলা হয়েছে, ‘সবকিছু দেওয়ার পরও ঐশী অবাধ্য ছিলো; মাদকসেবী ছিলো এবং বাজে বন্ধুদের সাথে মিশতো।’ ঐশীর ব্যাপারে সাংবাদিকদের এমন অবস্থান কোনোভাবেই যৌক্তিক ও নৈতিক হয়নি।
এখানে সাংবাদিকদের কি প্রথমেই বরং ঐশীর বাবা-মায়ের ভূমিকা ও দায়িত্বশীলতাকে প্রশ্ন করা উচিত ছিল না? ওইটুকু ছোট একটি শিশুকে চাওয়ামাত্রই এত টাকা আর ডিভাইস কেন দেওয়া হতো? এত টাকা দিয়ে সে কী করতো, বাবা-মা কি সেই খোঁজ রাখতেন? বাবা-মা কি তাকে যথেষ্ট সময়, সঙ্গ ও মনোযোগ দিয়েছিলেন - যা একটি শিশুর জন্যে সবচেয়ে বেশি দরকার? কেন ঐশী বাবা-মাকে মেরে ফেলার মতো এতটা নির্মম-নৃশংস হয়ে উঠল? কেন বাবা-মা এসবের কিছুই জানলেন না বা বুঝলেন না? - এসব প্রশ্ন সাংবাদিকরা করেননি।
এসবের বাইরেও, বয়সের বিচারে ‘শিশু’ হওয়ার কারণে সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী ঐশীর নাম বা ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার কথা নয়; কিন্তু প্রথমদিন থেকেই ক্যামেরা নিয়ে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন সাংবাদিকরা।
দাম্পত্য কলহ, পরকীয়া বা দারিদ্র্যের মতো কারণে শিশুসন্তানসহ মায়ের আত্মহত্যার খবরও এভাবে প্রচার করা হয়। পরিবার মেনে না নেওয়ায় প্রেমিক-যুগলের আত্মহত্যা, অভিমানে প্রেমিক বা প্রেমিকার আত্মহত্যা, পাবলিক পরীক্ষায় ফেল করায় আত্মহত্যা - এসব খবর গণমাধ্যমগুলো যেভাবে ‘গ্লামারাইজড’ করে প্রচার ও প্রকাশ করে, তাতে অন্যদের মধ্যে এসব আচরণ উৎসাহিত হতে পারে। সাংবাদিকদের উচিত এসব ঘটনার খবর প্রকাশে আরও কৌশলী হওয়া; এসব ঘটনাকে নিরুৎসাহিত করে এসব সমস্যার কার্যকর সমাধান সন্ধানে দিকনির্দেশনা দেওয়াই সাংবাদিকতার প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়ার কথা।
কোভিড১৯ মহামারির সময় পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো এমনভাবে খবর প্রচার করেছে, যা মানুষের মনে অহেতুক আতঙ্ক তৈরি করেছে। শুরু থেকেই দেখা গেছে, মৃত্যুর চেয়ে সুস্থ হওয়ার হার অনেক বেশি; কিন্তু, গণমাধ্যমগুলো প্রতিদিন মৃত্যুর খবরটিই এমন ঢালাওভাবে প্রচার করেছে যে সাধারণ মানুষ অযৌক্তিক আতঙ্কে ভুগেছে। এ ধরনের দুর্যোগের খবর এমনভাবে দিতে হবে, যেন মানুষ সতর্ক হয়; এগুলো এমনভাবে প্রচার বা প্রকাশ করা উচিত নয় যা অহেতুক আতঙ্ক ছড়ায়।
হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা এবং সম্প্রতি সোমালিয় জলদস্যুদের হাতে বাংলাদেশি নাবিকসহ জাহাজ জিম্মির ঘটনার উদাহরণও সাংবাদিকদের জন্যে শিক্ষণীয়। দুটি ঘটনাতেই গণমাধ্যমগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে। হোলি আর্টিজানে জঙ্গিদের দমনে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, গণমাধ্যমগুলো তখন সেই অভিযানের পরিকল্পনার বিস্তারিত খবর ও অভিযানের দৃশ্য লাইভ দেখিয়েছে। পুলিশ বারবার সতর্ক করেছে, জঙ্গিরা টিভিতে সব দেখছে এবং এতে অভিযান ব্যর্থ হবে; কিন্তু, কিছুতেই সাংবাদিকদের কাণ্ডজ্ঞান ফেরানো সম্ভব হয়নি। নাবিকদের জিম্মির ঘটনাতেও খবর প্রচারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল হতে সাংবাদিকদের অনুরোধ করেছে সরকার।
কোথাও আগুন লাগা, ভূমিকম্প বা এমন কোনো দুর্যোগে উৎসুক জনতার পাশাপাশি সাংবাদিকদের সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় উদ্ধারকর্মীদের। দমকল বাহিনীর পানির গাড়ির ওপর উঠে দাড়িয়ে সাংবাদিকরা লাইভ করেন, পিটিসি দেন। কয়েক বছর আগে খিলগাঁও এলাকায় একটি গর্তে পড়ে মারা যায় শিশু জিহাদ। ওই ঘটনার সময়ও উদ্ধারকর্মী ও পুলিশের সদস্যরা সাংবাদিকদের সামাল দিতে পারছিলেন না; সাংবাদিকরা সবাইকে ঠেলে সরিয়ে ওই গর্তের ভেতর তাদের ক্যামেরাও ঢুকিয়েছিলেন।
হত্যা, মৃত্যু, লাশ, নির্যাতন, আগুন, বীভৎসতা- এসব ঘটনার খবর প্রচার ও প্রকাশের সময় গণমাধ্যম তথা সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল হওয়া উচিত, স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করা উচিত। বিশেষ করে নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন এবং শিশু হত্যা বা মৃত্যুর ঘটনা, যৌন নির্যাতন ও এমন সহিংসতা - এসব ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নীতিমালার পাশাপাশি ব্যক্তিগত বোধের জায়গা থেকেও সাংবাদিকদের বাড়তি সতর্ক হওয়া দরকার। এ ধরনের খবর প্রচার ও প্রকাশের সময় কী ধরনের শব্দ-বাক্য-ভাষা এবং ভিডিও বা স্থিরচিত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক হওয়া দরকার। অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য নয়; মানুষ-সমাজ-রাষ্ট্রের কল্যাণই সাংবাদিকতার মূল দর্শন - এই সাধারণ জ্ঞানটুকু এবং নৈতিক বোধটুকু না থাকলে সাংবাদিকতা ছেড়ে দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবনের চেয়ে ‘খবর প্রচার’ বড় নয়।
গণমাধ্যমের প্রকৃত দায়িত্ব হলো ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে ক্ষমতা ও পুঁজির নিরপেক্ষ নিরীক্ষক হিসেবে ভূমিকা পালন করা। জনস্বার্থে কাজ করা। কিন্তু, এর বদলে গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে বরং ক্ষমতা ও পুঁজির আস্থাভাজন অর্থাৎ ‘ল্যাপ-ডগ’ হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সুবিধাপ্রাপ্ত বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব না করে সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমানুষের কল্যাণের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেওয়ার কথা যে গণমাধ্যমের, তা প্রকারান্তরে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে উঠছে।
মহাত্মা গান্ধী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে বুঝেছিলেন, পয়সার পেছনে ছুটলে সত্যিকার জনবান্ধব গণমাধ্যম হয়ে ওঠা সম্ভব নয়; এ কারণে তিনি বিজ্ঞাপন তথা পুঁজির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পত্রিকার প্রচারসংখ্যা (সাবস্ক্রিপশন) বাড়ানোর পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি অন্য পত্রিকার সাংবাদিকদের মধ্যে জনসেবার মনোবৃত্তি উৎসাহিত করার চেষ্টা করতেন। গান্ধী বলতেন, সাংবাদিকতাকে ‘জীবিকা’ হিসেবে দেখা ঠিক নয়; দেখতে হবে জনগণের সেবার দায়িত্ব হিসেবে। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকে আমাদের দেশেই কতো সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও দশের পক্ষে গঠনমূলক সাংবাদিকতা করেছেন। আশির দশক কিংবা এর কিছুকাল পরেও অনেক সাহসী ও জনমুখী সাংবাদিকতা হয়েছে। কিন্তু, ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা পুরনো পত্রিকাগুলোকেও আজ আর তাদের পূর্বতন চেহারার সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না। অপেক্ষাকৃত নতুন গণমাধ্যমগুলো ক্ষমতা, সস্তা জনপ্রিয়তা আর টাকার পেছনে ছুটছে। ফলে, গণমাধ্যমগুলোতে কল্যাণকামিতার বদলে বরং চাটুকারিতার ছাপ স্পষ্টতর হচ্ছে। নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার অভাব ক্রমবর্ধমান।
গণমাধ্যমের শতভাগকে নির্বিচারে এমন দোষ দিচ্ছি না; তবে, এমন ত্রুটি থেকে শতভাগ মুক্ত কোনো গণমাধ্যমও কি আসলে দেশে রয়েছে? কিছু গণমাধ্যম অবশ্যই এখনো একটি মান বজায় রেখেছে; তবে, তাদেরও আরও সতর্ক এবং আরো দায়িত্বশীল হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ক্ষমতার লেজুড়বৃত্তি, তথাকথিত জনপ্রিয়তার মতো অসার বস্তুর প্রতি মোহ এবং অর্থযোগের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ থেকে বেরিয়ে না এলে প্রকৃত সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। সাংবাদিকতার মৌলিক নীতিমালার পাশাপাশি অপরিহার্য মানবিক গুণাবলির প্রতি আগ্রহ, বিশ্বাস ও সততাই পারে দায়িত্বশীল ও গঠনমূলক সাংবাদিকতার অতীত দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনতে।
গণমাধ্যম দায়িত্ববোধহীন, অসার ও নীতিবিবর্জিত হলে একটি সমাজ টিকতে পারে না, রাষ্ট্র সঠিক দিকনির্দেশনা পায় না। তাই, একটি নৈতিক, মানবিক ও আদর্শ ‘হাউস পলিসি’ তৈরি এবং তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা প্রতিটি গণমাধ্যমের জন্যে খুব জরুরি।
মানুষের সেবার যে ব্রত গণমাধ্যমের মূল আদর্শ, সেই আদর্শের পতাকা বহনের শক্তি এবং সেই আদর্শের প্রতি ভক্তি - দুটোই আজ সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের মধ্যে খুব দরকার।
তাই, আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর সুবুদ্ধি হোক; সাংবাদিকদের মধ্যে শুভবুদ্ধি উদয় হোক।

লেখক: সজীব সরকার : সহযোগী অধ্যাপক, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।


প্রবাসীরা আমাদের প্রাণ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আহমদ কবির রিপন

প্রবাসীরা দেশের প্রতিটি পরিবারের প্রাণ। দেশের স্বার্থে প্রত্যেক প্রবাসীর মান, মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করুন ও সুবিধাদি বৃদ্ধি করুন। আশা করি, আমার প্রস্তাবিত বিষয়ের প্রতি সম্মিলিতভাবে একমত পোষণ করবেন। এখন থেকে ৫০ বছর আগে, এ দেশের মানুষ প্রবাসে যাত্রা শুরু করেন। তার আগেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষ গিয়েছে, তবে এই সংখ্যাটি খুবই অল্প ছিল। ব্রিটিশরা এশিয়ার খুবই উর্বর ভূমিতে নানা ধরনের ফসল উৎপাদন শুরু করেন। তাদের প্রধান প্রধান ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে গড়ে তোলেন, তখন আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগর দিয়ে এশিয়ার এই দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ ছিল। জাহাজে সিলেট ও চট্টগ্রামের যারা কাজ করতেন, তারা সুযোগ বুঝে অধিকাংশ লোক লন্ডনে ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আবার ডান কান ব্রাদার্সের কোম্পানিতে কাজের সুবাদে অনেকেরই লন্ডন যাওয়া সহজ হয়েছে। তা ছাড়া বিভিন্নভাবে লন্ডন ও ইউরোপে মানুষ গিয়েছে। হিসাব মতে- সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ এবং হবিগঞ্জ জেলার লোক বেশি লন্ডনে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকও লন্ডনে গিয়েছে। আশির দশকের কিছু দিন আগে থেকে মিডিল ইস্ট বা মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া শুরু হয়। তার পাশাপাশি ডিভি লটারিতে প্রচুর মানুষ আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বিগত ১০-১৫ বছরে শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে লন্ডন ও আমেরিকাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েছে। এখন বিশ্বের সব দেশে বাংলাদেশের মানুষ অবস্থান করছেন। দেশের অর্থনীতিতে সিংহভাগ অর্থ প্রবাসীদের রেমিট্যান্স থেকে আসে। আর এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে দেশের সার্বিক উন্নতি সাধিত হচ্ছে তাই সব প্রবাসীকে জানাচ্ছি, প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। প্রবাসীদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের দ্বারা এ দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রত্যেক পরিবারে ১-২ জন লোক বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে রয়েছে, এ দেশের বিবেকবান যেকোনো লোক বিষয়টি স্বীকার করে। তা যদি এমন হয়, তাহলে তারা (প্রবাসীরা) দেশে এসে প্রতিটা ক্ষেত্রে কেন এত ভোগান্তির স্বীকার হবেন। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি তৈরি, মৃত্যু সনদ নিতে গিয়ে কি পরিমাণ হয়রানির স্বীকার একজন ভুক্তভোগী খুব ভালো জানেন। পাসপোর্ট করতে গেলে কত সমস্যা। প্রবাসীরা দেশ থেকে যাওয়ার সময় এবং দেশে আসার সময় বিশেষ করে বিমানবন্দরে নানাবিধ হয়রানির শিকার হতে হয়। বাংলাদেশে জন্ম, আবার বাংলাদেশের অফিস, আদালতগুলো প্রত্যেক প্রবাসীর কাছে খুবই কষ্টের জায়গা হিসেবে পরিচিত। অথচ প্রবাসে কেউ নেই, আপনজন ছাড়া, প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজ ধারাবাহিক নিয়মে করতে পারছেন। নিজের আয়ের টাকাটা বালিশের নিচে রেখে প্রয়োজন সারছেন। ব্যাংক বিমার প্রয়োজন নেই। নামাজের সময় সবাই এক সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন। একে অন্যের কষ্টকে ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। আপদে-বিপদে পাশাপাশি আছেন। সুন্দর এক মনোরম পরিবেশ। বাংলাদেশের প্রবাসীদের সঙ্গে বিশ্বের সব দেশের লোকের স্বাভাবিক ব্যবহার সন্তোষজনক আছে। দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদর সেবা দেওয়ার শক্তিসার্মথ্য সবই আছে। শুধু সুন্দর মন-মানসিকতার অভাব। আর এ জন্য আজ পুরো জাতি জিম্মি। আমি দেশের সব অফিস-আদালতের কর্মকর্তা অথবা কর্মচারীদের বিনীত সুরে বলছি, একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের অধিকার সমান। আমার বক্তব্যে আমি কাউকে ছোট করতে চাই না। সবার প্রতি শ্রদ্ধাও ভালোবাসা সমান। আসুন সম্মিলিতভাবে দেশটা সুন্দর রাখি। দেশের মানুষকে ভালোবাসি। সবার প্রচেষ্টায় একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। বিশ্বে তার নাম সবার শীর্ষে থাকবে।

দেশের চলমান অবস্থা সম্পর্কে সবাই খুব ভালো অবহিত আছি। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার আমরা প্রতিষ্ঠিত করি। প্রতিটি নাগরিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে, দেশে অশান্তি বিরাজ করবে। তাতে দেশে শান্তি আসবে না। সরকার দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য বদ্ধপরিকর। জনকল্যাণে বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে, নির্দিষ্ট জনবল নিয়োগের মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থ ও জনবল নিযুক্ত করেছেন। তা হলে, জনগণ কেন সেই সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকবে। নাগরিকরা কেন পদে পদে হয়রানির শিকার হবেন। সবার কাছে, আমার এই মিনতি। তার প্রতিকার চাই।

লেখক: পরিবেশবিদ ও কলামিস্ট


ফুটওভারব্রিজ ও জনসচেতনতা

ফাইল ছবি
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

সারা দেশের প্রধান প্রধান শহরে, বিশেষ করে রাজধানী শহরে সর্বসাধারণের চলাচলের জন্য নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এলাকায় পথচারী ও বয়স্ক মানুষের কথা বিবেচনা করে সড়কে ফুটওভারব্রিজ ও ব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন করেছেন সড়ক ও জনপথ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। কিছু ফুটওভারব্রিজে নান্দনিক সৌন্দর্য ও দৃষ্টিনন্দন গাছগাছালীতে পরিপূর্ণ পরিবেশ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও মহতী উদ্যোগ কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সময় বাঁচাতে গিয়ে পথচারীরা প্রায়ই সড়কের মাঝখান দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে চলাচল করতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের অঙ্গহানিসহ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষ উদাসীন ও অসহায়। তারা কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।

জানা গেছে, সড়কের এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নগরীর জনবহুল এলাকায় বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ব্যাংক, বিমা কোম্পানিসহ বিভিন্ন অফিসগামী লোকজন, বড় বড় বহুতল মার্কেট ও শিল্পকারখানার শ্রমিকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ফুটওভারব্রিজ স্থাপন করেছেন সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এ ছাড়া এলাকার অসুস্থ রোগী ও বয়স্ক পথচারীদের রাস্তা পারাপারের সুবিধার্থে সিটি করপোরেশন মাঝে মধ্যে ফুটওভারব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি ও স্থাপন করেছেন।

এক শ্রেণির হকার ও ভীক্ষুকরা এই সকল ফুটওভারব্রিজ দখল করে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে জনগনের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে মারাত্মক ঝুঁকি ও পথচারীদের শংকার মধ্যে রেখেছেন । অনুসন্ধানে জানা গেছে, উত্তরার আব্দুল্লাহপুর থেকে শুরু করে বিমানবন্দর এলাকা পর্যন্ত ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কে বেশ কয়েকটি ফুটওভারব্রিজ রয়েছে। তার মধ্যে উত্তরা আজমপুর, রাজলক্ষ্মী, জসীমউদ্দীন রোড, বিমানবন্দর, কাওলা ও খিলক্ষেত। তার মধ্যে অধিকাংশ ব্রিজ বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। পাটাতন ভাঙাগড়া ও মাঝে মধ্যে ঝালাই দেয়া হয়। কিছু হকার ও পথশিশু ও পথচারীরা দিন ও রাতের বেলায় এসব ব্রিজগুলোর ঘুমিয়ে থাকতে দেখা গেছে। সকাল ও সন্ধ্যায় গাদাগাদি করে ব্রিজ পার হতে হয় মানুষকে। এ সময় ব্রিজে বাড়ে লোক সমাগম।

এদিকে উত্তরা বিমানবন্দর এলাকার অসুস্থ ও বয়স্ক লোকদের চলাচলের সুবিধার্থে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন হযরত শাহ্ জালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চৌরাস্তায় ফুটওভারব্রিজের দুই পাশে চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন করেছেন তবে, এই সিঁড়ি দুটি মাসের পর মাস অচল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পথচারীরা জানান, বিমানবন্দর সড়কের এই চলন্ত সিঁড়িটি বেশিরভাগ সময়ই নষ্ট থাকে। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হযরত শাহ্ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারী, সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি ও কাস্টম হাউসের শত শত বয়স্ক নারী-পুরুষকে এই ফুটওভারব্রিজ ও চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহার করে রাস্তা পারাপার হতে হয় । দীর্ঘদিন যাবত এই ফুটওভারব্রিজের চলন্ত সিঁড়িটি নষ্ট, এটিকে মেরামত করার কোনো উদ্যোগ নিতে কাউকে দেখা যায় না।

এ সড়কে চলাচলকারী পথচারীরা অভিযোগ করে জানান, গণমানুষের সেবায় সরকারের বিপুল অংকের টাকা খরচ করে এই চলন্ত সিঁড়িটি লাগানো হয়েছে, কিন্তু এটিকে রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব কাদের ওপর এটা আমাদের জানা নেই। হঠাৎ এটি ১০ থেকে ১৫ দিন চলে আবার দুই তিন মাস চলে না।বনানীর ১১ নং রোড়ের মাথায় সৈনিক ক্লাবের মোড়ের ফুটওভারব্রিজ ও চলন্ত সিঁড়ির ও ওই একই অবস্থা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের রাস্তা পারাপারের নিরাপদ মাধ্যম এখানকার ফুটওভারব্রিজ সংলগ্ন এলাকাগুলোতে কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে পথচারীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। উত্তরখান, দক্ষিণখান, আশকোনা, কাওলা ও সেক্টরে বসবাসকারী বাসিন্দাদের বিমানবন্দর সড়ক রাস্তার পূর্ব ও পশ্চিম পাশআশা যাওয়ার নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে বর্তমানে ৩টি ফুটওভারব্রিজ রয়েছে ।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তাটি চওড়া হওয়ার কারণে আজমপুর ফুটওভারব্রিজ, রাজলক্ষী ফুটওভারব্রিজ ও জসীমউদ্দীন ব্রিজ গুলো ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের পেটের ভিতর ডুকে গিয়াছে। এ অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসহায় সাধারণ জনগণকে রাস্তা পারাপার হতে হচ্ছে। সড়কের পেটে ঢুকে পরা ব্রিজের সংস্কার না করে গত ১ মাস যাবৎ কোনো ধরনের নোটিশ এবং ঘোষণা ছাড়াই সড়কের ওপর নির্মিত ব্রিজের দুইপাশের লেন খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বেশি যাত্রীর আশায় গণপরিবহন চালকরা মূল সড়ক ব্যবহার না করে নতুন লেনে চলাচল শুরু করে দিয়েছেন।

শত শত হাজার হাজার গাড়ি নতুন লেনে বেপরোয়া গতিতে চলাচল শুরু করায়, চাকরিজীবী সাধারণ জনগণ, উত্তরার বিভিন্ন স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফুট ওভার ব্রিজ পার হয়ে তাদের কর্মস্থলে যেতে হয় এবং ফিরতে হয় এ ছাড়া নিকটস্থ উত্তরা ৬নং সেক্টর কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল ও উত্তরা ১নং সেক্টরের জসিমউদ্দীন মহিলা মেডিকেলে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা গরিব অসহায় রোগীদেরও ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারা পার হতে হয় কারন এই মহাসড়কে রিকশা পারাপার নিষিদ্ধ ।

এই রাস্তার আশেপাশের জনগণকে বাস র্র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে চলার কারণে বিগত কয়েক বছর যাবৎ তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হতে হয়। নগরীর ব্যস্ততম এ সড়কে বর্তমানে পথচারীদের নিরাপদে রাস্তা পারাপারের ফুটওভারব্রিজ সংলগ্ন এলাকাগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ব্রিজ এলাকায় নিরাপত্তার অভাবে যে কোন সময়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের উপসহকারী এর সাথে যোগাযোগ করলে জানান, তারা উত্তরা আজমপুর ও বিএনএস সেন্টারের সামনে ফুটওভারব্রিজের কাজ শুরু করেছেন। তবে, তারা খুব দ্রুত বিমানবন্দর মহাসড়কের ফুটওভারব্রিজ গুলো সংস্কার করে এখানকার জনদুর্ভোগ কমাবে।

বিমানবন্দর গোল চক্কর এলাকার চলন্ত সিঁড়ি মেরামতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ এ রাস্তাটি বড় হওয়া এসড়কে যানজট কমবে। সাথে সাথে এখানকার ফুটওভারব্রিজ গুলোও দ্রুত সংস্কার করা দরকার।

উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায় দায়িত্বরত টি আই বলেন, এই ফুটওভারব্রিজটি নিয়ে তারা নিজেরাও আতংকে রয়েছে। ব্রিজের দুই পাশের সড়কে গাড়ি চলাচলের কারণে কখন কি ঘটনা ঘটে যায় এটা ভেবে প্রতিনিয়ন তারা ভয়ে অস্থির থাকেন। এখানে সিটি করপোরেশনের কোন লোকজন নিরাপত্তার দায়িত্বে না থাকলেও তিনি তার অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে মহিলা মেডিকেলে আগত অসুস্থ রোগী, শিশু ও বয়স্ক লোকজন এবং স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের রাস্তা পারাপারের সহায়তা করছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, হযরত শাহ্ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আব্দুল্লাহপুর সড়কে বি আর টি প্রকল্পের চলমান কাজকে সামনে রেখে রাস্তা বর্ধিতকরে যানবাহন চলাচলের জন্য দুটি লেন বাড়ানোর ফলে জসিমউদ্দীন, রাজলক্ষ্মী ও আজমপুর ফুটওভারব্রিজ ৩টি সড়কের ভিড় লেগে যায়। বর্তমানে পথচারীদের ব্রিজে উঠার আগেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেপরোয়া গতিতে চলা যানবাহনের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে ফুটওভারব্রিজে উঠতে হয় । এঘটনায় সড়কের পথচারীদের মাঝে দিন দিন ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, পথচারীদের চলাচল নিরাপদ ও নির্ভীক করতে বিমানবন্দর মহাসড়কের ফুটওভারব্রিজগুলো খুব দ্রুত সম্প্রসারণ করা দরকার এবং কিছু জায়গায় তা দ্রুত এগিয়ে চলছে ।

দৃষ্টি একটু ঢাকা শহরের অন্য রাস্তার দিকে দিতেই দেখতে পাবো তিলোত্তমা এই শহরের কুড়িল বিশ্বরোড থেকে রামপুরা হয়ে মৌচাক পর্যন্ত মহাসড়কের উপর যে কয়টি ফুটওভারব্রিজ রয়েছে তার ভেতর অতিব গুরুত্বপূর্ণ দুটি ব্রিজের কথা না বললেই নয় একটি যমুনা শপিং মলের সামনে আর অন্যটি নতুন বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে , পাশেই ভাটেরা থানা অথচ এই ফুটওভারব্রিজটি যেমন সরু তেমনি হকার ও ভিক্ষুকদের দখলে অথচ এই ব্রিজদিয়ে প্রচুর বিদেশিদের যাতায়াত করতে দেখা যায় , কিছু অনিয়মের কারনে বিদেশিদের মাধ্যমে আমাদের দেশের ভাবমূর্তী কোথায় যাচ্ছে তা সকলেরই ভাবা উচিত ।

মিরপুর শ্যামলী কলেজগেট, আসাদগেট সায়েন্স ল্যাব নিউমার্কেট আজিমপুর রোডের ফুটওভারব্রিজ থেকেও হকার ও ভিক্ষুকমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি, আবার মিরপুর ১নং মোড়ে ও ১০নং মোড়ের ফুটওভারব্রিজে সন্ধ্যার পর ভাসমান অশালীন হিজড়া ও অসামাজিক নারীদের দৃষ্টিকটু ইশারা অংগভংগী ও কুকাজের ইঙ্গিত ভদ্রবেশে চলাফেরা করা পথচারীদের জন্য প্রায়ই বিব্রত পরিস্থিতির শিকার হতে হয় ।

শহরের সকলের চলাচলের পথকে স্বাভাবিক রাখার স্বার্থ আমাদের আরও সচেতন ও দখলকারী হকার, ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন এবং এদের প্রশ্রয়দাতা একশ্রেণির চাঁদাবাজের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। এ ব্যাপারে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সুদৃষ্টি, সর্বস্তরের জনগণের সচেতনতা কামনা করছি ।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক


আল্লাহ অহংকারীদের পছন্দ করেন না

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আতিকুল ইসলাম খান

নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা গোপন ও প্রকাশ্যের সব বিষয়ে অবগত। নিশ্চয়ই তিনি অহংকারীদের পছন্দ করেন না। সূরা আন নাহল (আয়াত ২৩)। আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম আবিষ্কার ‘টাইটানিক জাহাজ’। এই নামটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। টাইটানিক জাহাজকে ঘিরে রয়েছে এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডিক ঘটনা । তারা সীমা অতিক্রম করে অহংকার করত। অহমিকা দ্বারা আল্লাহর ক্রোধকে কতটা কঠোর করেছিল যে, মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ তাদের পাকড়াও করে অহংকারের পতন ঘটিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের হাজার হাজার মিটার গভীরে তলিয়ে গিয়েছিল শতাব্দীর প্রথম দিকের অন্যতম গৌরব পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং বিলাসবহুল ‘টাইটানিক জাহাজ’। আল্লাহ তায়ালাকে অসন্তুষ্ট করে প্রযুক্তি এবং বুদ্ধিমত্তার অহংকারে টাইটানিক নির্মাতারা জাহাজটি ডিজাইন করার পর এর বিশালতার শক্তি ও টেকনোলজির ওপর এত বেশি আস্থাবান ছিল যে, তারা ভেবেছিল ৮৮২ ফুট লম্বা ১৭৫ ফুট উচ্চ ৯২ ফুট চওড়া এই জাহাজ কখনো ডুববে না, কেউ ডোবাতে পারবে না। এমনকি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা চাইলেও একে কখনোই ডুবাতে পারবে না। আর সত্যি সত্যি আল্লাহ তায়ালা এদের এত বড় স্পর্ধা দেখে যারপরনাই নারাজ হয়েছিলেন। এতটাই নারাজ হয়েছিলেন যে, তিনি তাদের দম্ভ ও অহংকারকে মুহূর্তেই আটলান্টিক মহাসাগরের পানিতে নিমজ্জিত করে হাজার হাজার মিটার গভীরে তলিয়ে দিয়েছিলেন এবং বিশ্ববাসীকে অহংকারের চূড়ান্ত করুন পরিণতির শিক্ষা দিয়ে আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনিই মহান শক্তিধর নভোমণ্ডল এবং ভূমণ্ডলের যা কিছু আছে সবকিছুই তার অধীনে, তারই হুকুমের ওপর সবকিছু নিয়ন্ত্রিত সুবহান আল্লাহ! টাইটান দেবতার নাম অনুসারে টাইটানিক জাহাজটি ভিআইপি প্যাসেঞ্জার নিয়ে মাত্র আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই ডুবে গিয়েছিল। কোনো আলৌকিক শক্তি বা পেশি শক্তির বলে নয় বরং পানির মধ্যে পানির জমাট করা বরফখণ্ডের সঙ্গে নিজেদের অবচেতনায় ধাক্কা লেগে শক্তিশালী স্বপ্নের সেই জাহাজটি খণ্ড খণ্ড হয়ে পানির নিচে তলিয়ে যায়। মহান স্রষ্টার সঙ্গে বেয়াদবির পরিণাম কী হতে পারে তা আমরা এ ঘটনা থেকেই শিক্ষা নিতে পারি। যুগে যুগে আমরা জেনে এসেছি, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইসলামের বিশাল ক্ষমতাসীন শত্রু নমরুদ, আব্রাহা, কারুন ও ফেরাউনদের চরম পরিণতি ঘটিয়েছেন সামান্য তুচ্ছ মশা, পাখি, মাটিতে দাবিয়ে এবং পানিতে ডুবিয়ে। সুবহান আল্লাহ! হজরত ইবনে আব্বাস (রহ.) বলেন, যে সরদার তার নেতৃত্ব, সংযম, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার সমস্ত গুণাবলিতে সম্পূর্ণ পূর্ণতার অধিকারী তিনিই হলেন সামাদ। পবিত্র কোরআনে আরও এরশাদ হয়েছে, যিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, যিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী, যাকে তন্দ্রা ও নিদ্রা স্পর্শ করতে পারে না, আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবকিছুই তার মালিকানাধীন। তার হুকুম ব্যতীত এমন কার সাধ্য আছে যে, তার নিকট সুপারিশ করতে পারবে? সৃষ্টির সামনে-পেছনে যা কিছু আছে সবকিছুই তিনি অবগত। তার জ্ঞানসমুদ্র হতে তারা কিছুই আয়ত্ত করতে পারবে না- কেবল যতটুকু তিনি দিতে ইচ্ছা করেন। তার আরশ কুরসি সমগ্র আসমান ও জমিন পরিবেষ্টন করে আছে, আর সেগুলোর তত্ত্বাবধায়ন তাকে মোটেও ক্লান্ত করে না, তিনি সর্বোচ্চ ও মহান। মহিমান্বিত তিনি, সর্বময় কর্তৃত্ব যার নিয়ন্ত্রণাধীন এবং যিনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান, যিনি জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন শুধু তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যে, তোমাদের মধ্যে কে আমলে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী এবং অত্যন্ত ক্ষমাশীল ।

যিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সাত আকাশ। দয়াময়ের সৃষ্টিতে তুমি কি কোনো খুঁত দেখতে পাও ? তুমি আবার দেখ, অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরাও তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে (সূরা মুলক ১-৪)। সুতরাং বান্দার জীবনের সার্থকতা হলো আল্লাহর পরিচয় জেনে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করবে, আল্লাহকে ভালোবেসে আল্লাহর হুকুম পালন করবে। অতঃপর পরকালে তাকে দেখে সীমাহীন তৃপ্তি লাভ করবে।

ইনশাআল্লাহ অহংকারবসে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা লোকমান- ১৮)

অহংকার ও দম্ভ সব আত্মিক রোগের মূল। আরবিতে একে উম্মুল আমরাজ বলা হয়।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ অহংকারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা: নাহল, আয়াত: ২৩) রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (মুসলিম শরিফ)।

অহংকার ও বিনয়, কোনটি ভালো? এ প্রশ্নের উত্তর জানার আগে আপনি প্রশ্ন করতে পারেন অহংকারীদের নামের তালিকায় কে কে আছেন? আর বিনয়ীদের নামের তালিকায় কারা আছেন?

আমরা দেখতে পাই অহংকারীদের ভেতর শীর্ষে আছে ইবলিস। ইবলিস শয়তান বলেছিল, আমি আদমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ বললেন, অহংকার করা তোমার উচিত নয়, যাও লাঞ্ছিত হয়ে বের হয়ে যাও এখান থেকে। (সূরা আরাফ)মানুষের ভেতর অহংকারী ছিল নমরুদ, ফেরাউন, আবু জাহেল। অহংকারে ফেরাউন বলেছিল, আমি তোমাদের বড় রব। নমরুদ আবু জাহেল আবু লাহাব উতবা শায়বা আরও অসংখ্য লোক দম্ভ ভরে সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল। এর বিপরীতে বিনয়ী ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সব মনীষীরা। হযরত আদম (আ.) থেকে নিয়ে আখেরি পয়গম্বর পর্যন্ত সব নবী রাসূল অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। সাহাবী তাবেয়ি ও আল্লাহর ওলিরা সবাই বিনয়ের চর্চা করতেন। অহংকার থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতেন।

দাম্ভিকদের শেষ পরিণতি মোটেও শুভ হয় না। বিনয়ী মানুষকে সবাই ভালোবাসে। মানুষের এবং আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে আমাদের অবশ্যই বিনয়ী হতে হবে।

বিনয়ী বিনয় প্রকাশ করার কারণে তার সম্মান কমে যায় না। যে আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। (তাবারানি)

আর যারা অহংকার করে কাল কেয়ামতে তাদেরকে বিন্দুর আকৃতি দেয়া হবে, সব মানুষ তাদেরকে পদদলিত করবে। আল্লাহর কাছে দাম্ভিক লোক এতটাই অপছন্দের।

অহংকার থেকেই হিংসা, ক্রোধ, বিদ্বেষ ও শত্রুতার দোষ ঘর করে মনের ভেতর। আভ্যন্তরীণ এমন অসংখ্য রোগ অহংকারীর ভেতরটাকে শেষ করে দেয়। ভালো কোনো গুণই আর সে ধরে রাখতে পারে না।

কারো কাছ থেকে ভালো কোনো উপদেশ গ্রহণের মত তার অবস্থা থাকে না। সবাইকে সে নিজের চেয়ে ছোট মনে করতে থাকে। নিজেকে বড় মনে করার রোগ একবার গেড়ে বসলে ধীরে ধীরে এটা বাড়তে থাকে।একপর্যায়ে সে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সা.-এর নির্দেশনা মান্য করার গুণ থেকেও বঞ্চিত হয়।

অহংকার হৃদয়ের রোগ হলেও এর প্রকাশ বাহ্যিক আচরণের মাধ্যমেই হয়। অন্যদের প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য প্রকাশের মাধ্যমে সে তার অহংকার প্রকাশ করতে থাকে। কপাল কুচকে থাকে সব সময়। চেহারায় অন্য রকম একটা ভাব নিয়ে আসে। অন্যদের প্রতি চরম এক ঘৃণা ফুটে ওঠে তার কথাবার্তা ও আচরণে।

হযরত ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, লোকে বলে আমি সম্ভ্রান্ত। অথচ সম্ভ্রান্ত হওয়া বা আভিজাত্য অর্জন করতে হয় তাকওয়ার মাধ্যমে।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, আল্লাহর নিকট তোমাদের ভেতর সবচেয়ে সম্মানিত হচ্ছে তাকওয়ার অধিকারী। (হুজুরাত, আয়াত: ১৩)

কেউ তাকওয়ার গুণ অর্জন ছাড়া অভিজাত হতে পারে না। সম্পদ, সৌন্দর্য, জ্ঞান, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও অন্য কোনো গুণ নয়, একমাত্র তাকওয়া মানুষকে অভিজাত করে।

আর তাকওয়া যার অর্জিত হবে সে কখনও অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে না। নিজেকে সে কখনও অভিজাত বা সম্ভ্রান্ত দাবি করবে না। কারণ গর্ব করা ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন আল্লাহর কাছে খুবই অপছন্দনীয়।

অবশ্য সুন্দর ভাবে চলা ও পরিপাটি হয়ে থাকার নাম অহংকার নয়। রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ সুন্দর, তাই সৌন্দর্য পছন্দ করেন। সুন্দর পোষাক পরার নাম অহঙ্কার নয়, অহঙ্কার হচ্ছে, সত্য অস্বীকার করা আর মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা। (তিরমিযি)

রাসূল (সা.) খুব বিনয়ী ছিলেন। খুব সাধারণভাবে চলা ফেরা করতেন। খাবার খাওয়ার সময় গোলামের মত বসে খাবার খেতেন। দীর্ঘ দিন যাবৎ নিজের জন্য পৃথক কোনো আসনও তিনি গ্রহণ করেননি। যার ফলে দূর থেকে কেউ এসে সাহাবিদের থেকে রাসূলকে (সা.) আলাদা করতে পারত না।

একটা বাদিও রাসূলকে (সা.) যদি মদীনার পথের মাঝে দাঁড় করিয়ে কথা বলত; রাসূল (সা.) তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।

হযরত আনাস বর্ণনা করেন, একবার মদীনা মুনাওয়ারায় এক সাধারণ দাসী রাসূলের (সা.) হাত ধরে তার একটি কাজে নিয়ে গেল, রাসূল (সা.) তার কাজ করে দিলেন। অহঙ্কারে হাত ছুটিয়ে নেননি।

মুহাদ্দিস ইবন ওয়াহাব বলেন, একবার আমি আব্দুল আযীয ইবন আবি রাওয়াদের (রহ.) মজলিসে বসলাম। তার পায়ের সঙ্গে আমার পা লেগে গিয়েছিল, আমি পা সরিয়ে নিলে তিনি আমার কাপড় ধরে তার দিকে টান দিলেন। আর বললেন, তোমরা আমার সঙ্গে এমন আচরণ করো কেন? আমি কি অহঙ্কারী রাজা বাদশাহদের মত? খোদার কসম, আমার চোখে তোমাদের ভেতর আমার চেয়ে অধম আর কেউ নেই।

মুসলিম মনীষীদের বিনয়ের অসংখ্য গল্প আছে। আজকে আমরা ইসলামের এ শিক্ষা কতটুকু ধারণ করতে পারছি?

কতটুকু বিনয়ের চর্চা রয়েছে আমাদের ভেতর? জান্নাত পেতে চাইলে অহংকার ত্যাগ করে বিনয়ী হবার বিকল্প কিছু নেই। আমাদের অবশ্যই বিনয়ী হতে হবে।

কারণ আমরা মুসলিম। আর একজন মুসলিম সবসময় উচু পর্যায়ের বিনয়ী ও বিনম্র।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ অহংকারিদের পছন্দ করেন না। (সূরা: নাহল, আয়াত: ২৩) রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (মুসলিম শরিফ)

আমরা আলোচনা করেছিলাম দাম্ভিক ও অভিশপ্ত নমরুদ এবং তার অকল্পনীয় পরিণতি সম্পর্কে।

ইনশাআল্লাহ এ অংশে আলোচনা করব দাম্ভিক ফেরাউন ও তার পরিণতি সম্পর্কে যথাসম্ভব সংশ্লিষ্ট আল্লাহর বাণী বা আয়াতগুলো উল্লেখ করে।

ফেরাউনের দম্ভ বা অহংকার অতুলনীয়, কারণ সে নিজেকে প্রভু বলে দাবি করেছে। তাছাড়া সে ছিল অত্যাচারী, অসংখ্য-অগণিত বনি ইসরাইলের পুত্রসন্তান হত্যাকারী। মূসা (আ.) ও দাম্ভিক ফেরাউন সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনে ধারাবাহিকভাবে অনেক আয়াত উল্লেখ আছে, যা নিম্নে বর্ণিত হলো।

আল্লাহর নির্দেশে মূসা (আ.)-এর মাটিতে ফেলে দেওয়া লাঠি যখন সাপ হলো, ফেরাউন ও তার বাহিনী তাতে বিস্মিত হলো।

আবার আল্লাহর নির্দেশে মূসা (আ.) যখন সাপটিকে ধরলেন, তা পুনরায় লাঠি হয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে মূসা (আ)-কে ফেরাউন ও তার বাহিনী ‘জাদুকর’ আখ্যায়িত করল। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিম্নরূপ, যা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে- আল্লাহর বাণী- সূরা আল কাসাস : ৩-১১ (কীভাবে শিশু মূসা আ. ফেরাউনের গৃহে স্থান পেল)। ‘আমি মূসা ও ফেরাউনের কাহিনি থেকে কিছু তোমার কাছে (মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে) সত্যিকারভাবে বিবৃত করছি বিশ্ববাসী সম্প্রদায়ের উদ্দেশে। বস্তুত ফেরাউন দেশে উদ্ধত হয়ে গিয়েছিল আর সেখানকার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করে তাদের একটি শ্রেণিকে দুর্বল করে রেখেছিল, তাদের পুত্রদেরকে সে হত্যা করত আর তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখত; সে ছিল ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী। দেশে যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল আমি তাদের প্রতি অনুগ্রহ করার ইচ্ছা করলাম, আর তাদেরকে নেতা ও উত্তরাধিকার করার (ইচ্ছা করলাম)। আর (ইচ্ছা করলাম) তাদেরকে দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফেরাউন, হামান ও তাদের সৈন্য বাহিনীকে দেখিয়ে দিতে যা তারা তাদের (অর্থাৎ- মূসা আ.-এর সম্প্রদায়ের) থেকে আশঙ্কা করত। আমি মূসার মায়ের প্রতি ওহি করলাম যে, তাকে (মূসাকে) স্তন্য পান করাতে থাক। যখন তুমি তার সম্পর্কে আশঙ্কা করবে, তখন তুমি তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করবে, আর তুমি ভয় করবে না, দুঃখও করবে না, আমি তাকে অবশ্যই তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব আর তাকে রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত করব। অতঃপর ফেরাউনের লোকজন তাকে উঠিয়ে নিল যাতে সে তাদের জন্য শত্রু ও দুঃখের কারণ হতে পারে। ফেরাউন, হামান ও তাদের বাহিনীর লোকেরা তো ছিল অপরাধী। ফেরাউনের স্ত্রী বলল- এ শিশু (মূসা) আমার ও তোমার চক্ষু শীতলকারী, তাকে হত্যা করো না, সে আমাদের উপকারে লাগতে পারে অথবা তাকে আমরা পুত্র হিসেবেও গ্রহণ করতে পারি আর তারা (ফেরাউন ও তার সাথীরা) কিছুই বুঝতে পারল না (তাদের এ কাজের পরিণাম কী)।

মূসা আ.-এর মায়ের অন্তর বিচলিত হয়ে উঠল। সে তো তার পরিচয় প্রকাশ করেই ফেলত যদি না আমি তার চিত্তকে দৃঢ় করতাম, যাতে সে আস্থাশীল হয়। মূসা আ.-এর মা মূসা আ.-এর বোনকে বলল, ‘তার (মূসার) পেছনে পেছনে যাও।’ সে দূর থেকে তাকে দেখছিল কিন্তু তারা (ফেরাউনের লোকজন) টের পায়নি।’ আল্লাহর বাণী- ফেরাউন বলল- ‘হে পারিষদবর্গ! আমি ছাড়া তোমাদের অন্য উপাস্য আছে বলে আমি জানি না। হে হামান! তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও এবং একটি সুউচ্চ প্রাসাদ তৈরি করো; হয়তো আমি তাতে উঠে মূসার মাবুদকে দেখতে পাব। তবে আমি অবশ্য মনে করি যে, সে মিথ্যাবাদী’ (সূরা আল কাসাস-৩৮)।

আল্লাহর বাণী- ‘ফেরাউন ও তার বাহিনী অকারণে পৃথিবীতে অহঙ্কার করেছিল আর তারা ভেবেছিল যে, তাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না’ (সূরা আল কাসাস-৩৯)। এ আয়াতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ফেরাউন অহংকারী বা দাম্ভিক ছিল।

আল্লাহর বাণী- ফেরাউন বলল, ‘হে মূসা তাহলে কে তোমার রব? মূসা আ. বললেন, ‘আমাদের প্রতিপালক তিনি যিনি সব (সৃষ্ট) বস্তুকে আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথনির্দেশ করেছেন।’ ফেরাউন বলল ‘তাহলে আগের যুগের লোকদের অবস্থা কী (সূরা ত্ব-হা : ৪৯-৫১)? অর্থাৎ প্রতিপালক বা আল্লাহ সম্পর্কে ফেরাউনের কোনো জ্ঞান ছিল না তাই সে আলোচ্য প্রশ্ন রেখেছিল।

আল্লাহর বাণী- সে (ফেরাউন) বলল ‘হে মূসা, তুমি কি আমাদের কাছে এ জন্য এসেছ যে, তোমার জাদুর দ্বারা আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বের করে দেবে? তাহলে আমরাও অবশ্যই তোমার কাছে অনুরূপ জাদু হাজির করব, কাজেই একটি মধ্যবর্তী স্থানে আমাদের ও তোমার মিলিত হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ কর, যার খেলাফ আমরাও করব না আর তুমিও করবে না’ (সূরা ত্ব-হা : ৫৭-৫৮)।

আল্লাহর বাণী- ফেরাউন বলল, ‘তোমরা প্রত্যেক বিজ্ঞ জাদুকরকে আমার কাছে নিয়ে এসো (মূসাকে পরাজিত করার জন্য)। জাদুকররা যখন এসে গেল, তখন মূসা আ. (সে নিজে তার লাঠি নিক্ষেপ না করে) তাদেরকে বলল, ‘নিক্ষেপ করো তোমরা যা নিক্ষেপ করবে’ (সূরা ইউনুস : ৭৯-৮০)।

আয় আল্লাহ! আমাদের কে অহংকারমুক্ত নেক হায়াত দান করুন । আমিন

লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ, সমাজসেবক

বিষয়:

পরিবেশ টিকে না থাকলে পৃথিবীর জন্য বিপর্যয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
লিয়াকত হোসেন খোকন 

পরিবেশের বিপর্যয় বা অবনতি বলতে বায়ু, পানি ও মাটি প্রভৃতি সম্পদ নিঃশেষের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষয়সাধন, বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংসসাধন, আবাস ধ্বংসকরণ, বন্যপ্রাণী বিলুপ্তকরণ এবং দূষণ বৃদ্ধিকে বোঝায়, যা রাষ্ট্রসংঘের উচ্চপর্যায়ের হুমকি, চ্যালেঞ্জ ও পরিবর্তন প্যানেল দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে দশটি হুমকির একটি হিসেবে সতর্ক করা হয়েছে। রাষ্ট্রসংঘ আন্তর্জাতিক বিপর্যয় প্রশমন কৌশল পরিবেশের অবনতিকে সংজ্ঞায়িত করেছে। সামাজিক ও পরিবেশগত উদ্দেশ্য এবং চাহিদা পূরণের জন্য পরিবেশের ধারণ ক্ষমতা হ্রাস হিসেবে। পরিবেশের অবনতি অনেক ধরনের হয়। প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হলে বা প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষ করা হলে পরিবেশের ক্ষয় হয়। এই সমস্যা প্রতিহত করতে পরিবেশ সুরক্ষা এবং পরিবেশগত সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন বলে বিশ্ব নেতৃত্ব চিহ্নিত হলেও এই সমস্যা আদৌ হ্রাস পাচ্ছে না। বরং করোনাকালেও পরিবেশের অবনতির হার বেড়েছে। তা ছাড়া বিশ্বের ২২৭ পরিবেশকর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। পরিবেশ ধ্বংসের বিপদের মধ্যে

যুক্ত হয়েছে দাবানলের বিষয়টিও। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন তো বটেই, ক্যালিফোর্নিয়া, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কমবেশি লেগে রয়েছে দাবানলের প্রকোপ। বনভূমি ধ্বংসের পাশাপাশি মানুষের কার্যকলাপে ক্রমাগত বদলাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। বদলাচ্ছে জলবায়ু। পরিবেশের নিরাপত্তা তো আজ প্রশ্নের মুখোমুখি- সেইসঙ্গে যারা প্রকৃতি রক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের পরিণতিও হচ্ছে ভয়ংকর। পরিবেশ ও মানবাধিকার সংস্থা গ্লোবাল উইটনেসের সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে তেমনটাই। সব মিলিয়ে ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে হত্যার শিকার হয়েছেন ২২৭ জন পরিবেশকর্মী। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ১৬৮। ২০১৯ সালে তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২০৭ জনে। ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে পরিবেশ রক্ষকদের ওপর নৃশংসতার পরিমাণ। গ্লোবাল উইটনেসের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৭০ শতাংশ ঘটনার শিকার হয়েছেন বনভূমি -রক্ষকরা। বৃক্ষচ্ছেদন, অবৈধ খনন, চোরা শিকার, পাচার, জুম চাষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়েই প্রাণ দিতে হয়েছে অধিকাংশ পরিবেশকর্মীকে। বাকি ৩০ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন নদীদূষণ, বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের প্রতিবাদীদের ওপর। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষ। তাদের সংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ হলেও ৩০ শতাংশ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ভূমিপুত্ররাই। এই ঘটনা যেন আরও বেশি করে প্রমাণ দিচ্ছে, বৃক্ষচ্ছেদন ও অরণ্যের ওপর অত্যাচার পরিবেশের পাশাপাশি বিপন্ন করে তুলেছে বাস্তুতন্ত্র এবং প্রকৃতিঘেঁষা মানুষকে; কিন্তু পরিবেশ ও পরিবেশকর্মী নিধনকারী আর অপরাধীদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রশাসন বিশেষ কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব দুর্নীতি ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে সেসব দেশের সরকার। সরকারি মদদেই চলছে বেআইনি খাদান থেকে শুরু করে পাচার। কোথাও কোথাও আবার এসব হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে বহুজাতিক সংস্থারাও। পরিবেশবিপর্যয় ধারণাটি গত শতাব্দীতে আবির্ভূত হলেও এর প্রকোপ চলতি শতাব্দীতেও প্রকট। বৃক্ষ নিধন, নদী ভরাট, পাহাড় কর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমান্বয়ে প্রক্রিয়ায় চলমান দুর্যোগগুলো বিশ্ব, আঞ্চলিক এবং স্থানীয় জীবনকেও পর্যুদস্ত করছে। বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, কার্বন নিঃসরণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ১২ বছরের মধ্যে পৃথিবীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। দাবানল, খরা, বন্যা ও ভয়াবহ তাপপ্রবাহের মতো মহাবিপর্যয় নেমে আসতে পারে। রাষ্ট্রসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেল এক বিশেষ প্রতিবেদনেও এমন সতর্কবাণী দিয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনই পদক্ষেপ না নিলে অবিলম্বে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে। উষ্ণতা বৃদ্ধির বিপর্যয় পূর্ণ এ মাত্রা এড়াতে সমাজের সর্বক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবেশের পক্ষে দ্রুত, সুদূরপ্রসারী ও নজিরবিহীন পরিবর্তনের অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন বিজ্ঞানীরা। সুতরাং সকলে সাবধান, পরিবেশ খারাপ হচ্ছে- পরিবেশ রক্ষা করুন।

লেখক: পরিবেশবিদ ও চিঠিপত্র গবেষেক


গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রেজাউল করিম খোকন

রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য ১৬ বছর আগে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর নেওয়া ‘এক জেলা এক পণ্য’ উদ্যোগটি মোটামুটি ব্যর্থ হওয়ার পর সেই ব্যর্থতার কারণ না খুঁজে এবার হাতে নেওয়া হয়েছে ‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ নামে নতুন উদ্যোগ। এক বছরের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে এ উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ উদ্যোগের পর ভবিষ্যতে এসংক্রান্ত প্রকল্প নেওয়া হবে। পরীক্ষামূলক উদ্যোগের অংশ হিসেবে গ্রামওয়ারি পণ্য নির্বাচনের জন্য দেশের সব জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। চিঠিতে এক মাসের মধ্যে পণ্যের নাম, উৎপাদনকারীর নাম-ঠিকানাসহ সংশ্লিষ্ট পণ্যের বিষয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামভিত্তিক এক বা একাধিক হস্তশিল্পজাত পণ্য বা ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের তালিকা থাকতে হবে। এত দিন এক জেলা এক পণ্য কর্মসূচিটি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এককভাবে চালিয়ে আসছিল। তাতে কিছু পণ্যও চিহ্নিত হয়েছিল। তবে সেটি খুব ভালোভাবে এগোয়নি। এখন যে প্রতিবেদন পাওয়া যাবে, তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। অন্তত এক বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখবে কোথায়, কী আছে এবং সেগুলোর রপ্তানি সম্ভাবনা কতটুকু। এদিকে রপ্তানি বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে সম্ভাবনাময় পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালে ‘হস্তশিল্পজাত পণ্য’কে বর্ষপণ্য ঘোষণা করেছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এ কর্মসূচি চালু করে। আর তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোকে। এক জেলা এক পণ্য বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি ছিল না। তারা চেষ্টা করেছে এর মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য কিছু পণ্য বের করে আনতে। তার আওতায় আগর, সুগন্ধি চাল, হস্তশিল্প কিছু রপ্তানিও হয়েছে। এক জেলা এক পণ্য কর্মসূচির আওতায় ৪১টি জেলা থেকে ১৪টি পণ্য নির্বাচন করা হয়। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে মৌলভীবাজারে আগরউড ও আগরবাতি; নাটোরের ভেষজ উদ্ভিদ; পঞ্চগড়ের অর্গানিক চা; দিনাজপুর, নওগাঁ ও কুষ্টিয়ার সরু ও সুগন্ধি চাল; খুলনার কাঁকড়া; বান্দরবানের রাবার; সুনামগঞ্জ, ফেনী, জামালপুর, ফরিদপুর, রংপুর ও কুড়িগ্রামের হস্তশিল্প; রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও রাঙামাটির হস্তচালিত তাঁতবস্ত্র; দিনাজপুরের পাপর; জয়পুরহাট, চাঁদপুর, বগুড়া, নীলফামারী, মুন্সীগঞ্জ, মেহেরপুর, যশোর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, ঝিনাইদহ ও নারায়ণগঞ্জের তাজা শাক-সবজি; নেত্রকোনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও নড়াইলের মাছ; চট্টগ্রামের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য; খাগড়াছড়ির আনারস এবং চুয়াডাঙ্গার পান। এখন যেভাবে একটি গ্রাম একটি পণ্যের কথা চিন্তা করা হচ্ছে, তা রপ্তানি পণ্য বাড়াতে কাজে দেবে বলে আশা করা যায়।

এক জেলা এক পণ্য কর্মসূচি থেকে কেন সুফল পাওয়া গেল না, তারও মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। আর নতুন উদ্যোগের জন্য আমলাতান্ত্রিকতার পরিবর্তে স্থানীয় সরকার তথা ডিসি কার্যালয়, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদকে যুক্ত করলে ভালো ফল মিলতে পারে। সরকার এখন গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিচ্ছে। সেই লক্ষ্যে ‘একটি গ্রাম, একটি পণ্য’র এই স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রামে তৈরি পণ্যকে দেশে-বিদেশে মূলধারার বাজারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তৃণমূল নারী উদ্যোক্তাদের সক্রিয় সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের তৈরি হস্তশিল্প ও খাদ্যসামগ্রীর বাণিজ্য সম্ভাবনা কাজে লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ‘একটি গ্রাম, একটি পণ্য’ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রামভিত্তিক পণ্যকে মূলধারার বাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হবে। পণ্যের সঙ্গে পণ্যের কারিগরদেরও মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোন গ্রাম থেকে কোন কারিগর পণ্যটি তৈরি করল; তা সবার সামনে তুলে ধরা হবে। উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে হলে পণ্য তৈরির কারিগরদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গ্রামে তৈরি পণ্যের কারিগর ও তৈরির স্থান চিহ্নিত করে তা দেশি-বিদেশি বাজারে পৌঁছে দেওয়া হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে ১২৮টি পণ্য নিয়ে জীবিকায়ন শিল্পপল্লী গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড ছয়টি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উদ্যোগগুলো হচ্ছে- পল্লীতে টেকসই জীবিকায়ন-কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পল্লী পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রসার, পল্লী উদ্যোক্তা উন্নয়ন, দক্ষ জনসম্পদ সৃষ্টি, উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মানোন্নয়ন ও বিপণন সংযোগ তৈরি। সরকার বর্তমানে বিআরডিবির পল্লীতে পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ও উৎপাদিত পণ্যের সুসংহত বিপণন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে তৃতীয়পর্যায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পে এক পণ্যে এক পল্লীভিত্তিক জীবিকায়ন শিল্পপল্লী গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৪৮ জেলার ২২০টি উপজেলায় ২০২৬ সালের মধ্যে ১২৮টি পণ্যভিত্তিক জীবিকায়ন শিল্পপল্লী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পল্লীপণ্যের গুণগত মানোন্নয়ন, বহুমুখীকরণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, বাজার সম্প্রসারণ ইত্যাদি কার্যক্রমের সমাহারে জীবিকায়ন শিল্পপল্লী উন্নয়নে নবযুগের সূচনা করবে। এটি বাস্তবায়িত হলে পল্লী কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পল্লী অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এলাকাভিত্তিক সুফলভোগীদের জন্য তাদের ভৌগোলিক এলাকায় উৎপাদিত পণ্যের জন্য ঋণের পরিমাণ বাড়ানোসহ কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ, পণ্যের গুণগত মানোন্নয়নের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর ও শ্রমঘন এসব পণ্য উৎপাদনে বেশি পুঁজির দরকার হয় না। তাই প্রতিটি গ্রাম থেকে হস্তশিল্পজাত পণ্য নির্বাচন করতে হবে, যার মধ্যে খাদ্যজাত পণ্যও থাকতে পারে। নতুন উদ্যোগের জন্য আমলাতান্ত্রিকতার পরিবর্তে স্থানীয় সরকার তথা ডিসি কার্যালয়, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদকে যুক্ত করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। দেশের একমাত্র ভাসমান পেয়ারার বাজার ঝালকাঠি জেলায়। বরিশালের মিষ্টি আমড়া বলতে যা বোঝানো হয়, তার ৮০ শতাংশই ঝালকাঠির। এ ছাড়া শীতলপাটি, সুপারি এবং হাতেভাজা একধরনের মুড়ি রয়েছে ঝালকাঠিতে, যা অন্যসব জেলা থেকে আলাদা। কিশোরগঞ্জের শিদল বা চ্যাপা শুঁটকি, রাতাবোরো চাল এবং পনির- এ তিন পণ্যের খ্যাতি রয়েছে। এগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে যথাসময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে হবে। ডিসিদের কাছ থেকে তালিকা পেলে তা থেকে দেশসেরা পণ্য নির্বাচন করবে সরকার। ভবিষ্যতে সেগুলোর ব্র্যান্ডিংও করা হবে। তারই অংশ হিসেবে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাসহ দেশে–বিদেশে বিভিন্ন মেলায় এসব পণ্যের প্রদর্শন ও বিপণনের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হবে। এ ছাড়া এসব পণ্য উৎপাদনে স্বল্পসুদে, বিনা সুদে বা বিনা জামানতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। এর বাইরে আগামী পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে যেসব মেলা হবে, সেগুলোতে হস্তশিল্পজাত পণ্যের বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা যেন নেওয়া হয়, সে জন্য পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

জাপান সরকার আঞ্চলিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ১৯৭৯ সালে প্রথম একটি গ্রাম একটি পণ্যকে আন্দোলন আকারে শুরু করে। এ আন্দোলনের জনক দেশটির একটি অঞ্চলের তৎকালীন গভর্নর মরিহিকো হিরামাৎসু। ১৯৮০ সাল থেকে এ আন্দোলনকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজ শুরু করে দেশটি। তাতে কয়েক বছরের মধ্যেই গ্রাম থেকে উচ্চমূল্য সংযোজনের ৩০০ পণ্য চিহ্নিত করে জাপান। জাপানের এ আন্দোলন পরে কিরগিজস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। একটি গ্রাম একটি পণ্য কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে কাজ করতে জাপানি রাষ্ট্রদূতের সহযোগিতা চেয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী। রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেনও। ২০০৮ সালে এক জেলা এক পণ্য কর্মসূচি হাতে নেয় বাংলাদেশ। পৃথিবীর যেকোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ উন্নয়ন অপরিহার্য। আমাদের দেশে এখনো নগর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। যদিও আমাদের সংবিধানে এ বৈষম্য দূর করার জন্য কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিককরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের ওপর সমধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় লক্ষ্য বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হলেও সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে সরকারি বেতনভুক্ত যেসব ব্যক্তি জড়িত তাদের কর্মের প্রতি অনীহা, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, দুর্নীতি, অদক্ষতা, আন্তরিকতা, একাগ্রতা ও বিশ্বস্ততার অভাব প্রভৃতি এ বিষয়ক সরকারের প্রতিটি কার্যক্রমকেই বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। এমন অনেক ফসল আছে যেগুলো মৌসুমি কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের কারণে সেসব ফসলও এখন সারা বছর উৎপন্ন করা সম্ভব। অতীতে যে ভূমিতে বার্ষিক একটি ফসল হতো এখন একই ভূমিতে বার্ষিক দুটি বা ক্ষেত্রবিশেষে তিনটি ফসলের চাষ করা হচ্ছে। আবার একই ভূমিতে একটি ফসলের ফাঁকে ফাঁকে আরেকটি ফসলের চাষ হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ধান ও মাছের চাষ একই ভূমিতে একসঙ্গে করা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রতিটি ফসল ও মাছ উৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটালেও কৃষকপর্যায়ে পাইকারি বিক্রয়মূল্য এবং ভোক্তাপর্যায়ে খুচরা বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ব্যাপক ফারাক থাকায় বাড়তি উৎপাদন ও বাড়তি মূল্য কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারছে না। বর্তমানে আমাদের বেশকিছু কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। এসব পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অপ্রচলিত পণ্য বিধায় রপ্তানিকারকদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেওয়া হয়। যদিও এ প্রণোদনার একটি অংশ কৃষকের পাওয়ার কথা; কিন্তু আজ আমাদের দেশের কৃষক সে প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত। এসব কারণেই আমাদের গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব দীর্ঘদিন ধরে একটি আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় কৃষিভূমির পরিমাণ খুবই কম; কিন্তু উন্নত বীজ ও সার এবং বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে কৃষিজ প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে। বাংলাদেশের কৃষকরা এক বছর যে ফসল উৎপাদন করে লাভবান হয় পরবর্তী বছর একই ফসল উৎপাদনে উদ্যোগী হয়। এভাবে একজনকে লাভবান হতে দেখে অনেকে একই ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এভাবে ফসলের বাড়তি উৎপাদনের কারণে মূল্য পড়ে গিয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসলের উৎপাদন, বিপণন ও চাহিদা বিষয়ে কৃষকের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকলে তাদের ক্ষতির আশঙ্কা কমে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক


সফলতার নেপথ্য শক্তি ও করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার

জীবনে সফলতা কে না চায়? আমরা সফল মানুষের গল্প বলতে ও শুনতে পছন্দ করি; কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, প্রাত্যহিক জীবনে একটু সচেতন থাকলে আমরাও পেতে পারি জীবনের কাঙ্ক্ষিত সফলতা! মানুষ একদিনে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায় না। এর শুরুটা হয় স্বপ্ন দিয়ে। স্বপ্নের বাস্তবায়নে সম্পাদিত কর্মে প্রতিটি মুহূর্তে মনঃসংযোগের প্রয়োগই তাকে সফলতার চূড়ান্ত ধাপে অধিষ্ঠিত করে।

মনঃসংযোগ অর্জনে চাই নিরন্তর চেষ্টা। মনঃসংযোগ অনুশীলনের ধাপভিত্তিক চেষ্টার নামই হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। মনঃসংযোগ অনুশীলনের আধ্যাত্মিক চেষ্টার নাম হলো ধ্যান বা মেডিটেশন। মনঃসংযোগ অনুশীলনের সামাজিক চেষ্টার নাম হলো কৃতজ্ঞতা, ভক্তি বা শ্রদ্ধা প্রকাশ। আর মনঃসংযোগ অনুশীলনের শারীরিক চেষ্টার নাম হলো খেলাধুলা, ব্যায়াম ও সূর্যস্নান। আমরা যে মোড়কেই অনুশীলন করি না কেন জীবনের শান্তি, শৃঙ্খলা, প্রশান্তি, উন্নতি ও সফলতার মূলে রয়েছে মনঃসংযোগ। মনঃসংযোগ মানুষকে যৌক্তিকভাবে ভাবনার ক্ষমতা প্রদান করে। কোনো কাজে নিরবচ্ছিন্নভাবে লেগে থাকার মানসিক শক্তি জোগায়।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বই পড়া, লেখার চর্চা, মুখস্থ করা, গণিতের সমাধান করা- সবকিছুই কিন্তু মনঃসংযোগের ধাপভিত্তিক অনুশীলন। এমনকি তিন ঘণ্টা বসে কোনো পরীক্ষা দেওয়াও মনঃসংযোগ চর্চার অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়। মনঃসংযোগের আরেকটি প্রাত্যহিক চর্চা হলো গণিতের হিসাবগুলোর কাগজে-কলমে করার অভ্যাস গড়ে তোলা। জীবনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় গাণিতিক হিসাবে ক্যালকুলেটরের ব্যবহার মনঃসংযোগ বৃদ্ধির অন্তরায়। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই এক ধরনের এবং প্রশ্নের প্যাটার্ন ভিন্ন ধরনের। ফলে গাইড বইয়ের বিগত সালের প্রশ্নপত্র সমাধান না করে পরীক্ষায় ভালো করার চেষ্টা করা বৃথা। পাঠ্যবই ও প্রশ্নপত্রের মধ্যে এমন বিশাল ব্যবধান থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পড়ানো যাচ্ছে না। ফলে পাঠ্যবই পড়ার মাধ্যমে মনঃসংযোগ বাড়ানোর অভ্যাস গড়ে তোলা যাচ্ছে না। এতে সমগ্র জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বর্তমানে সমাজের প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আমরা মনঃসংযোগ বিচ্যুতির চর্চায় মেতে আছি। যেদিকে দৃষ্টি যায়, দেখি কেউ বসে নেই। সবাই নিজের জীবন গঠনের সময় অন্যকে দিতে ব্যস্ত। তবে সেটা সজ্ঞানে নয়, না জেনে। দেখি পিয়ন টুলে বসে আছে কর্মকর্তার হুকুম তামিলের অপেক্ষায়, কিন্তু টুলে বসে থাকলেও চোখটা স্মার্টফোনে। নিজের জীবনের মূল্যবান সময়ক্ষেপণের জন্য স্মার্টফোন হয়েছে এক অনন্য সাধারণ মাধ্যম। সংবাদপত্রের খবরে দেখেছি ইন্টারনেটের কোনো ইংরেজি কনটেন্টের অংশ গুগল অনুবাদের মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। টিচার্স কমনরুমে দেখি, বই পড়ে ক্লাসের প্রস্তুতি বিরল ঘটনা। সবার চোখ মুঠোফোনে। আমরা নিজেরাও পড়তে ভুলে গেছি বা যাচ্ছি। আবার বাচ্চারাও যে পড়বে, সেটিও হয়ে উঠছে না। আমরা তো আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোনদের হাতে বই দেখেছি। আর এখনকার বাচ্চারা বড়দের হাতে সকাল, দুপুর, বিকাল, রাত শুধু মুঠোফোন দেখছে। তাদের ধারণা জন্মাচ্ছে এভাবেই বুঝি জীবন গড়তে হয়। কোনো কিছুতেই দীর্ঘক্ষণ মনঃসংযোগ করার ক্ষমতা আমরা হারাচ্ছি। জনসচেনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ সময়ের দাবি।

জীবনে উন্নতি সাধন করার জন্য দেহকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি আমাদের মনকেও সুস্থ রাখা প্রয়োজন রয়েছে; যে কাজটা আমরা সহজেই করতে পারি ধ্যানের মাধ্যমে। মেডিটেশন হলো মনের এমন এক অবস্থা যখন আমাদের মস্তিষ্ক অপ্রয়োজনীয় সবকিছু থেকে নিজেকে আলাদা করে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে নিমগ্ন হয় এবং মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ও নিখুঁতভাবে ব্যবহার করতে শেখে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের থেকে শুরু করে নোবেল বিজয়ী, বিজ্ঞানী বা লেখকদের অনেকের মধ্যেই একটি অভ্যাস খুবই সাধারণ আর তা হলো মেডিটেশন। দৈনিক ১০-১৫ মিনিট মেডিটেশন পড়াশোনা ও কর্মে একাগ্রতা আনয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবেই ফেলবে।

কৃতজ্ঞতা হলো একটি মানবীয় গুণ যা সুখী ও সফল হওয়ার জন্য একান্ত অপরিহার্য। কৃতজ্ঞতা গুণটি আমাদের ব্যবহার্য গ্লাসটিকে ‘অর্ধেক খালি’ না দেখে ‘অর্ধেক পূর্ণ’ হিসেবে দেখতে সাহায্য করে। কৃতজ্ঞতা মানুষকে ইতিবাচক আবেগ অনুভব করতে সহায়তা করে। সুন্দর অভিজ্ঞতা উপভোগ, প্রতিকূলতার সঙ্গে মোকাবিলা এবং মানুষে মানুষে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে কৃতজ্ঞতা, ভক্তি বা শ্রদ্ধার জুড়ি মেলা ভার। যখন আমরা নিজেরা কৃতজ্ঞ হই- মনের ভেতরে এক অনাবিল তৃপ্তি এবং শান্তির অনুভূতি আসে। যা আমাদের মনঃসংযোগকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ মানব জাতিকে সৃষ্টিকর্তার প্রতি এবং পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে আহ্বান জানিয়েছে। এমন প্রশ্ন মনে জাগতেই পারে যে, সৃষ্টিকর্তা মানব জাতির কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা আশা করেন কেন? তিনি তো প্রয়োজন মুক্ত। এর উত্তর-প্রকৃতপক্ষে তিনি চান যে আমরা কৃতজ্ঞ হয়ে উঠি যাতে আমরা নিজেরাই এর থেকে উপকৃত হতে পারি। কৃতজ্ঞতা, ভক্তি, শ্রদ্ধা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে আমাদের একটি মধুর সম্পর্ক তৈরি করে। আসুন আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই এ জন্য যে, আমরা চোখ দিয়ে দেখতে পাই, কান দিয়ে শুনতে পাই, হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারি। কৃতজ্ঞতা জানাই পিতা-মাতাকে যারা নিজেদের আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে আমাদের বড় করেছেন। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি দেশ মাতাকে। যার আলো, বাতাস ও জলের ছোঁয়ায় আমাদের দেহের প্রতিটি কোষ গঠিত।

জীবনে সফলতা লাভের জন্য শরীরবৃত্তীয় জৈব প্রাণরস বা হরমোনের সঠিক মাত্রায় নিঃসরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এন্ডোরফিন, সেরোটনিন, ডোপামিন এবং অক্সিটোসিন হরমোনের সঠিক মাত্রায় নিঃসরণ মানুষকে প্রাণবন্ত ও একাগ্রচিত্তের অধিকারী করে। এগুলোর সঠিক নিঃসরণের জন্য মানব জীবনে খেলাধুলা ও ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। আর ডোপামিন হরমোন নিঃসরণে সূর্যালোকের উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সূর্যালোক থেকে যে ভিটামিন ডি আমরা পাই সেই ভিটামিন ডির সঙ্গে ডোপামিন হরমোন নিঃসরণের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সূর্যের আলো ভিটামিন ডির অন্যতম প্রধান উৎস। শরীরে ভিটামিন ডির ঘাটতি হলে মনের একাগ্রতা বা মনঃসংযোগ বিঘ্নিত হয়। কারণ শরীরে ভিটামিন ডির ঘাটতিতে মানসিক চাপ বা উদ্বেগ দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া যথেষ্ট বিশ্রাম নেওয়ার পরও অলসতা ও ক্লান্তিবোধ ভিটামিন ডির অভাবেই হয়। অকারণে ক্লান্তি ভাব, ঝিমুনি এবং শুয়ে থাকার ইচ্ছা হতে পারে শরীরে ভিটামিন ডির অভাবে।

কায়ার অনুপস্থিতিতে ছায়া যেমন অস্তিত্বহীন; তেমনি মনঃসংযোগের ঘাটতিতে জীবন হতে পারে অসফল। তাই জাতি গঠনে সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাক মনঃসংযোগের নিরন্তর চর্চা।

লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


আকাশপথের খাবার

প্রতীকী ছবি
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
প্রদীপ সাহা  

যারা আকাশপথে ভ্রমণ করেন তারা প্রত্যেকেই জানেন, বিমানের ভেতরের আবহাওয়া এবং পরিবেশটি কেমন থাকে। বিমানের ভেতর আর্দ্রতা থাকে মাত্র ১৫ শতাংশ। বিমানের শব্দে আরোহীদের চারপাশে ঠিক যেন মেলা থাকে এক ধোঁয়াটে সাদা চাদর। আর বায়ুচাপের কারণে শরীরের তরল হয় ঊর্ধ্বমুখী। এ রকম পরিস্থিতিতে তৃষ্ণা বেড়ে যায়, শ্বাস কম প্রবাহিত হয় এবং ঘ্রাণশক্তির ব্যাঘাত ঘটে। জার্মানির ফ্রাউনহফার ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বিমানে পরিবেশন করা খাবার সম্পর্কে এক মজার তথ্য প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, আকাশপথে ভ্রমণের সময় বিমানের খাবারে লবণ, ঝাল এবং অন্যান্য মশলাযুক্ত খাবার আরও বেশি দরকার। কারণ বিমানের ভেতরের পরিবেশটা কিছুটা ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ার মতো বিষয়। যখন সর্দি হয়, তখন নাক বন্ধ হয়ে ঘ্রাণশক্তির সমস্যা হয় এবং স্বাদের অনুভূতি কমে যায়। বায়ুচাপ কমে গেলেও ঠিক এমনটাই ঘটে। জামার্নির লুফ্থহানসা এয়ারলাইনস এবং এর ক্যাটারিং সহযোগী ফ্রাউনহফার ইনস্টিটিউটকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করা হয়েছিল, ১০ হাজার মিটার উঁচুতে কোন ধরনের খাবার ভালো লাগবে এবং কোনটি লাগবে না- এ গবেষণার জন্য একটি বিমানের সামনের অংশে ৩০ মিটার দীর্ঘ টিউব আকৃতির চেম্বার তৈরি করা হয়েছিল। চেম্বারটির ভেতরের বায়ুচাপটি ছিল নিয়ন্ত্রিত এবং স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। আর্দ্রতার পরিমাণ রাখা ছিল ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে। আকাশে থাকার সময় বিমানের ভেতরে যে পরিবেশটি থাকে, তেমন পরিবেশই তৈরি করা হয়েছিল চেম্বারটিতে। ভূ-পৃষ্ঠে বায়ুচাপ থাকে ৯৫০ হেক্টো প্যাসকল, কিন্তু বিমান যখন আকাশে থাকে তখন এর ভেতরের বায়ুচাপটি থাকে ৭৫০ থেকে ৮০০ হেক্টো প্যাসকল। ঠিক যেভাবে বিমানের আসনগুলো কাঁপে এবং শব্দ হয়, এখানেও ঠিক একইভাবে কাঁপন এবং শব্দ হয়। শুধু তাই নয়, বিমানে দেওয়া খাবারের মেন্যুর মতোই এখানেও খাবার দেওয়া হয়। কিছু খাবার দেওয়া হয়, যা সবসময় প্রচলিত আকাশপথের খাবারের চেয়ে আলাদা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে ফ্রাউনহফার ইনস্টিটিউটের গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, আকাশ ভ্রমণে খাবার হতে হবে কড়া ধরনের, অর্থাৎ ঝালে-মশলায় ভরা। মশলাদার খাবার যেমন থাই বা ইন্ডিয়ান খাবার হবে এ পরিবেশে দারুণ মানানসই। কারণ এ খাবারের স্বাদটি সবসময় এক থাকে। এর মশলাদার ঝালঝাল ভাবটি কখনো কমে যায় না; কিন্তু সাধারণ খাবারে বাড়তি মশলা ঢেলে দিয়ে তবেই স্বাদ বাড়াতে হয়।

এক জরিপে দেখা গেছে, আকাশ ভ্রমণে যাত্রীরা টমেটোর সস্ বেশি খায়। আর কেন তারা টমেটোর সস্ বেশি খায়, এ প্রশ্নের উত্তরও খুঁজেছিলেন গবেষকরা। লুফ্থহানসা এয়ারলাইনস তার বিমানের খাবারের সঙ্গে বছরে ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন লিটার টমেটোর সস্ সরবরাহ করে থাকে। টমেটোর এ সস একই সঙ্গে লবণ আর ঝালের কাজ করলেও অনেকে বলেছেন, বায়ুচাপের সঙ্গে সঙ্গে টমেটোর স্বাদও বদলাতে থাকে। তাই মাটিতে বা ভূপৃষ্ঠে টমেটো জ্যুসের যে বদনাম রয়েছে, সেটির স্বাদই আকাশপথে ভ্রমণের সময় সুস্বাদু হয়ে ওঠে। কম বায়ুচাপের কারণে আকাশপথে কফি খেতে একেবারেই খারাপ লাগে। যেকোনো ডেজার্টে আরও চিনি ঢেলে তারপর এর মিষ্টি ভাবটা আনতে হয়। অনেক বিমানেই প্যাক করা স্যান্ডউইচ এবং কিছু মাঝারি ধরনের সাদামাটা খাবার পরিবেশন করা হয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন কোনো ঝাল-মশলাদার খাবার কিংবা স্বাদ বাড়ায় এমন মুখরোচক খাদ্য বিমানের খাবার মেন্যুতে যুক্ত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত খাবারের মেন্যুতে টমেটোর সস বা জুস টিকে থাকছে।

লেখক: কলাম লেখক, সাভার, ঢাকা।


বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুজিবনগর সরকার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন

মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থনের জন্য মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। টানা ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুমুক্ত হয় এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে দেশমাতৃকার সম্মান রক্ষায় মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলার সূর্যসন্তানরা। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলেও শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল, বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে। এ সরকারের প্রধান (রাষ্ট্রপতি) হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই নামানুসারে বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ হয় মুজিবনগর এবং অস্থায়ী সরকারও পরিচিত হয় মুজিবনগর সরকার নামে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল বাংলাদেশের প্রথম সরকারের রাজধানী। মঞ্চে থাকা চেয়ারগুলোর মধ্যে একটি খালি রাখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়- ‘যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়াছে সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য মনে করি, সেইহেতু আমরা বাংলাদেশে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি এবং উহার দ্বারা পূর্বাহ্ণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি।’ (মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসসি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পৃ. ৩২৪, কাকলী প্রকাশনী, ২০১৪)। প্রথমে কোরআন তিলাওয়াত হয়। তারপর বাংলাদেশের মানচিত্রশোভিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হলো। স্থানীয় চার তরুণ গাইলেন জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…।’

নবগঠিত সরকার শপথ নেওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট) একটি দল গার্ড অব অর্নার দেয়। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বক্তৃতা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাষণে বলেন, ‘...আমাদের রাষ্ট্রপতি...শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দি। তার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।’ (মেজর অব. রফিকুল ইসলাম পিএসসি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পৃ. ৩২৪, কাকলী প্রকাশনী, ২০১৪)। তাজউদ্দীন আহামদ তার ভাষণে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই জন্য যে, তারা আমাদের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি দেখে যাওয়ার জন্য বহু কষ্ট করে, বহু দূর-দূরান্ত থেকে এখানে উপস্থিত হয়েছেন।’ বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে স্বাধীনতাকামী বাঙালি প্রথমে দেশের ভেতরেই প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলে। পাকিস্তানি সেনারা যখন প্রতিটি শহরে ও গ্রামে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে, তখন দেশের ভেতরে থেকে যুদ্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মার্চের শেষ দিকে ঝিনাইদহের সে সময়কার এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ পিএসপি এবং মেহেরপুরের এস.ডি.ও তৌফিক এলাহী চৌধুরী সিএসপির সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ সহযোগী আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে সীমান্ত পার হন এবং ৩ এপ্রিল দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত সরকারের সহযোগিতা চান। প্রশ্ন হলো, কাকে এবং কীভাবে সহযোগিতা দেবে তারা? এজন্য একটি আইনানুগ কাঠামো দরকার। তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায় ফিরে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের খুঁজে বের করলেন, তাদের রাজি করালেন। তিনি যুক্তি দেখালেন, সরকার গঠন না হলে ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছিল সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হবে। অর্থাৎ একথা স্পষ্ট হল যে, পাকিস্তানের সামরিক আদালতের বিচারে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি দেওয়া হবে। এ সামরিক বিচারের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের সব রাষ্ট্রনেতার কাছে বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার আবেদন জানান। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে মস্কোর একটি সভাতে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যা ঘটছে তাকে এখন আর ওই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। প্রায় এক কোটি মানুষ আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ওই মানুষগুলোর কি নিজের দেশের বসবাস করার বা কাজ করার অধিকার নেই? এখন বিশ্বের রাষ্ট্রনেতাদের দেখতে হবে যাতে এই অসহায় মানুষগুলো নির্ভয়ে নিজের দেশে ফিরে যেতে পারে।’ ৭ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ভারতে আসেন। বাংলাদেশ পরিস্থিতি আলোচনায় কিসিঞ্জার জানালেন বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে কোনো যুদ্ধে ভারত অগ্রসর হলে আমেরিকা ভারতের পাশে দাঁড়াবে না। সে সময় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় কিসিঞ্জার ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে গোপনে চীনে গিয়েছিলেন। ইন্দিরার পরামর্শদাতা পি. এন. হাকসার এবং এল. কে. (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রদূত) প্রধানমন্ত্রীকে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায্য নিতে পরামর্শ দিলেন। কিসিঞ্জারের চীন-বৈঠকের এক মাস পর ‘রুশ-ভারত শান্তি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা’ অর্থাৎ ‘রুশ-ভারত মৈত্রী’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৯ আগস্ট ১৯৭১। এর ফলে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসির আদেশ দিতে ভয় পেয়ে যায়।

১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্যে অর্থ তহবিল গঠনের লক্ষ্যে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর আয়োজন করে আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি জনগণ। সে কনসার্টে প্রায় ৪০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে সাবেক বিটলস সঙ্গীতদলের লিড গিটারবাদক জর্জ হ্যারিসন, ভারতীয় সেতারবাদক রবিশঙ্কর ও সরোদবাদক ওস্তাদ আলী আকবর খাসহ আরও অনেকে অংশগ্রহণ করেন। মার্কিনি কবি অ্যালেন গীন্সবার্গ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতা সংলগ্ন ভারতীয় সীমান্ত ধরে বাংলাদেশের কাছাকাছি আসেন। তার সঙ্গে ছিলেন কোলকাতার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সীমান্ত অঞ্চলে শরণার্থীদের অশেষ দুর্দশা ও লাঞ্ছনাকে অবলম্বন করে তিনি তার অন্যতম দীর্ঘ কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ রচনা করেন। মুজিবনগর সরকার ২৪ মে বিচারপতি চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করে। জনাব চৌধুরী ছিলেন মুজিবনগর সরকারের দ্বিতীয় প্রতিনিধি যিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি নরওয়ে, সুইডেন, মিসর, ইরাক, জর্ডান, সিরিয়া, সৌদি আরব, আলজেরিয়া প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘে অবস্থিত আন্তর্জাতিক প্রেস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ড. যোগেন্দ্র কুমার ব্যানার্জীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিভিন্ন দেশ পরিষ্কার ধারণা লাভ করে। ১৯ আগস্ট কানাডার টরেন্টোতে বাংলাদেশ সংকট নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেন, কানাডা, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশের জনপ্রতিনিধিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ২৬ জুলাই হাউস অব কমন্সের হারকোর্ট রুমে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকিট প্রকাশ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১০ পয়সার টিকিটে বাংলাদেশের মানচিত্র এবং পাঁচ পয়সার টিকিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি ব্যবহৃত হয়। বিদেশে চিঠিপত্র পাঠাতে ভারত সরকার এই ডাকটিকিটগুলো ব্যবহারের অনুমতি দেয়।

১৯৭১ সালের ৮ মে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের জরুরি মিটিংয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে একটি তহবিল গঠন করা হয়। এই ফান্ড ৩,৭৬,৫৬৮ পাউন্ড পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগ্রহ করে; যা সরাসরি বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছিল। এভাবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে মহান মুক্তিযুদ্ধ। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত পাকিস্তান বাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল নিয়াজী পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর যৌথ কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে বিকাল ৪.৩১ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। মুজিবনগর সরকার ছিল জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই গঠিত সরকার। মুক্তিযুদ্ধের ওপর এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে বাংলার যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার ঠিক ২১৪ বছর পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আরেক আম্রকাননে যেন বাংলার সেই অস্তমিত সূর্য আবারও উদিত হয়।

লেখক: পুলিশ সুপার, নৌ-পুলিশ, সিলেট অঞ্চল

বিষয়:

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র: এক অনন্য ইতিহাস

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রাশিদুল হাসান

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রণীত হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট বলে বিবেচিত হয়। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত গণপরিষদের ৪০৪ জন সদস্যকর্তৃক স্বাক্ষরিত ও অনুমোদিত, যা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে পূর্ণাঙ্গরূপে উপস্থাপিত হয় এবং সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য আইনি দলিল হিসেবে স্বীকৃত।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করে।

১৭ ডিসেম্বর, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৮৮ আসন পায়। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার এবং প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় এম মনসুর আলীকে পূর্ব পাকিস্তান পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার নির্বাচিত করা হয়। ’৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং এম মনসুর আলী পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ বিজয় মেনে না নিয়ে ষড়যন্ত্রের নীল-নকশা বুনতে থাকেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সমঝোতার নাটক ব্যর্থ হওয়ার পর ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৮ মার্চ, জিওসির অফিসে জেনারেল রাও ফরমান আলী ও জেনারেল খাদিম রাজা বৈঠকে বসেন। ‘বৈঠকে জেনারেল ফরমান অফিসিয়াল প্যাডের ওপর নতুন পরিকল্পনাটি লিপিবদ্ধ করেন। যার দ্বিতীয় অংশটি লেখেন জেনারেল খাদিম। পরিকল্পনাটি সংশোধনপূর্বক চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল আব্দুল হামিদ খান অনুমোদন করেন’- (সূত্র: উইটনেস অব স্যারেন্ডার, লেখক: সিদ্দিক সালিক, যুদ্ধকালীন সময়ে আইএসপিআরের পিআরও)। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে জেনারেল ফরমানের নেতৃত্বে ঢাকায় এবং জেনারেল খাদিমের নেতৃত্বে অন্যান্য ১০টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে অপারেশনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সামরিক অভিযানের কোড নেম ছিল ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১১টা ৩০ মিনিটে ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে শুরু হয় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। সায়মন ড্রিংই প্রথম ২৫ মার্চের পরিকল্পিত গণহত্যার খবরটি ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে অবহিত করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি তার বর্ণনায় বলেন, ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দখলপূর্বক, পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল লক্ষ্য করে কামান ও মর্টার হামলা চালায়। হলের পার্শ্ববর্তী পুকুরে শতশত লাশ ভাসছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের অগণিত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রতিবেদনে বলেন, ‘আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং সন্ত্রস্ত এক নগরী’।

অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ‘দ্যা রেপ অব বাংলাদেশ’ বইয়ের মুখবন্ধে বলেন, হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অমানবিক কার্যকলাপে পড়েছি; কিন্তু ইস্ট বেঙ্গলে যা দেখলাম, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং যন্ত্রণাদায়ক।

’৭১-এর ২৬ মার্চ ০০:২০ প্রথম প্রহরে পাকিস্তান পার্লামেন্টের মেজরিটি পার্টির লিডার আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন- ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন..........সকল শক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ কর.......(অনূদিত: শেখ মুজিবুর রহমান)’। অতঃপর রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর নিজ বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তাটি তাৎক্ষণিকভাবে মগবাজার ওয়্যারলেস স্টেশনে পাঠানো হয়। স্বাধীনতার বার্তাটি ডিএইচএফ চ্যানেলে মগবাজার থেকে সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত জাতিসংঘের জাহাজ মিনি-লা-ট্রিয়া, গ্রিক জাহাজ সালভিস্তার ভিএইচএফ চ্যানেলে সমগ্র বিশ্বে প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে, বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে লয়ালপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। লয়ালপুর মার্শাল ‘ল’ কোর্টে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্টিলিজেন্স স্পট রিপোর্ট ৪৩-এর ১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, পাকিস্তানের পূর্ব অংশকে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।

২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাবিষয়ক আর্কাইভ তাদের অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

১ এপ্রিল ভোরে তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, বিএসএফের ডিজি কেএফ রুস্তমজী ও গোলক মজুমদার একটি সামরিক কার্গো বিমানে দিল্লির উদ্দেশে কলকাতা বিমান বন্দর ত্যাগ করেন। ৩ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব? ইজ হি অল রাইট? জবাবে তাজউদ্দীন আহমেদ বলেন বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তার স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন’ (সূত্র: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, লেখক: ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম)। উভয়ে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল এক বিশেষ অধিবেশনে ১৯৭০ সালের নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। উক্ত গণপরিষদের অধিবেশনেই অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান প্রণীত হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণকর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ’৭১-এর ২৬ মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রক্রিয়ায় আইনি দলিল হিসেবে স্বীকৃত।

১০ এপ্রিল গণপরিষদের বিশেষ অধিবেশনে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব অপর্ণ করা হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে উল্লিখিত সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় যাহা ‘মুজিব নগর’ সরকার হিসেবে পরিচিতি পায়। ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত জনপ্রতিরোধ শুরু হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়, উক্ত যুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধুপ্রতিম ভারত সরকারের ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উক্ত সরকারের ভূমিকা ছিল অনন্য। উক্ত সরকার কর্তৃক কর্নেল এমএজি ওসমানীকে সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক এবং এমএ রবকে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং ১১ জন সেক্টর কমান্ডার নিয়োজিত হন যথাক্রমে- জিয়াউর রহমান, কেএম সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের, রফিকুল ইসলাম, মীর শওকত আলী, সিআর দত্ত, আবু ওসমান চৌধুরী (আগস্ট পর্যন্ত), এমএ মঞ্জুর, এমএ জলিল, এএনএম নূরুজ্জামান, এমএ বাশার।

প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটের সঙ্গে পরামর্শ পূর্বক উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন এবং বর্ষীয়ান জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিং ও অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদকে সদস্য হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। মুজিবনগর সরকারের মেয়াদকাল ছিল ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত।

১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল কলকাতা পাকিস্তান মিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীর নেতৃত্বে ৫০ জন কর্মকর্তা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ৬ এপ্রিল দিল্লি পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব কেএম শেহাবুদ্দিন আহমেদ ও আমজাদুল হক পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট দিল্লিতে ২০ বছরমেয়াদি ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের পক্ষে দলিলে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরন সিং এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো। হিমালয়ের তুষার ও সোভিয়েটের বন্ধুত্ব এই দুটি ছিল চীনের বিরুদ্ধে ভারতের রক্ষাকবচ। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজির নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সেনা অস্ত্রশস্ত্রসহ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিত সিং আরোরা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারের উপস্থিতিতে বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে অত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন যার শিরোনাম হলো ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব স্যারেন্ডার’।

৩০ লাখ শহীদের তাজা তপ্ত রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা অভ্যুদয়ের পশ্চাতে রয়েছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী নেতৃত্ব ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞা। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি নতুন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে।

লেখক: প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় চার নেতা পরিষদ ও কলামিস্ট।

বিষয়:

মুজিবনগর দিবসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা

ঐতিহাসিক মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা এলাকায় তোলা। ছবি: সংগৃহীত
আপডেটেড ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ ২২:০২
ড. মো. শাহিনুর রহমান

ভৌগোলিকভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার পলাশী আম্রকানন আর বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা বা মুজিবনগর আম্রকাননের দূরত্ব সরাসরি ধরলে বড় জোর তিরিশ কিলোমিটার আর পাকা সড়কের ঘুরপথে ৮২ কিলোমিটারের বেশি হবে না। বাংলার ইতিহাসে এ দুই আম্রকাননের গুরুত্ব বাড়িয়ে বলার অবকাশ নেই। এ দুই কাননের প্রথমটিতে প্রায় পৌনে তিনশ’ বছর আগে, ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদের কাছে শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার পরাজয় ও মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। অপর আম্রকাননটিতে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য পুনরুদিত হয়, ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী ইংরেজি সময় গণনার ভিত্তিতে ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রটি আসে পরবর্তী ১০ এপ্রিল তারিখে। এ ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন এবং অনুমোদন করা হয়। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর, ১৭ এপ্রিল তারিখে একটি যুদ্ধকালীন বিপ্লবী সরকার বা স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম সরকার গঠনের মাধ্যমে সদ্যোজাত দেশটিকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়। এদিন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকুঞ্জে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং যুদ্ধকালীন সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ শপথ গ্রহণ করে। তারপর থেকে বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ হয় ‘মুজিবনগর’ আর ১৭ এপ্রিল দিনটি উদযাপন করা হয় ‘মুজিবনগর দিবস’ হিসেবে।

নবগঠিত মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়ার পরপরই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জগৎ সভায় বাংলাদেশের আত্মপ্রতিষ্ঠার উচ্চাকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সাংবিধানিকভাবে অনুমোদিত, যুক্তিসঙ্গত ও সম্ভবপর সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার জন্যে একটা কায়েমি স্বার্থবাদী মহল যে-অবিরাম অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে তা প্রতিহত করে এ ইতিহাসকে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করার জন্য মুজিবনগর সরকার বা দিবসের যথোপযুক্ত গুরুত্ব নির্ণয় ও স্মরণ করা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ আর অধ্যবসায় নিয়ে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের উচিত বঙ্গবন্ধুসহ সকল স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক সংগঠকদের সর্বক্ষণ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণে রাখা।

স্মর্তব্য, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এক ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে, কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরাচারী সরকার বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রিত্ব দিতে অস্বীকার করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করে। অবশেষে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে কিন্তু তার নাম আর দিকনিদের্শনাকে সামনে রেখেই বাঙলাদেশের সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক সরকার- মুজিবনগর সরকার- ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল শপথ নিয়ে কার্যভার গ্রহণ করে। গণপরিষদের সকল সদস্য এদিন বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পূর্ণ করার মধ্য দিয়ে জাতিকে পূর্ণ স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। এজন্য বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি আর তার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস এক অভূতপূর্ব স্থান অধিকার করে আছে। কারণ অতীত হাজার বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে এই প্রথম বাংলাদেশে তার ভূমিপুত্রদের একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

একাত্তরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রকাশের সাত দিন পর, ১৭ এপ্রিল বৃহত্তর কুষ্টিয়ার মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলা নামের একটি ছোট গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নেয়ার পর জায়গাটির নতুন নাম রাখা হয় মুজিবনগর এবং এটিই হয়ে ওঠে এ সরকারের সদরদপ্তর। একটি নতুন জাতির জন্ম আর তাদের প্রথম স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের মাহেন্দ্রক্ষণটির প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার জন্যে সেদিন ভারতসহ বিভিন্ন দেশের শয়ে শয়ে সাংবাদিক মুজিবনগরে এসে জড়ো হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু সেদিন সশরীরে সেখানে উপস্থিত ছিলেন না বটে, কিন্তু তার দিয়ে যাওয়া দিকনির্দেশনা অনুযায়ীই সমস্ত কার্যক্রম চলছিল। প্রতিটি মুহূর্তেই তিনি ছিলেন প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধুর নামই ঘোষণা করা হল সদ্যোজাত রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে। কিন্তু তিনি তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মনোনীত করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী তাজউদ্দিন আহমদকে। এ ছাড়া এম. মনসুর আলী বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী, এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান প্রথম স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, এবং পরবর্তী কালে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রমাণিত খোন্দকার মোশতাক পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী, এবং আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী (তৎকালীন কর্নেল) বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। শপথ গ্রহণের পরপরই এ সরকার বেসামরিক প্রশাসন চালানোর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা এবং তাদের জন্যে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করা, জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে আন্তর্জাতিক সমর্থন নিশ্চিত করা, এবং যুদ্ধের নির্মম, ক্লান্তিকর, কালো দিনগুলো থেকে দ্রুত মুক্তিলাভ নিশ্চিত করার জন্যে সর্বতোমুখী প্রয়াস চালাতে থাকে। অসীম দেশাত্মবোধ আর নজিরবিহীন বিচক্ষণতাই ছিল এই বিপুল কর্মযজ্ঞের পেছনকার মূল চালিকাশক্তি।

মুজিবনগর সরকার একটি নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা আর কুশলী সমম্বয়ের মাধ্যমে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার অবচেতনে তাদের মনোবল চাঙা করে তুলেছিল এবং পুরো যুদ্ধকালে তদ্রুপ রেখেছিল। আমাদের শ্রেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার সহযোগী নেতৃবৃন্দ, যারা মুজিবনগর সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তারা এই ঐতিহাসিক ক্রান্তিকালে জাতিকে তথা জাতির চলমান স্বাধীনতা যুদ্ধকে পরিচালনার গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাঁধে শুধু তুলেই নেননি, সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে সে-দায়িত্ব পালন করে জাতিকে পৌঁছে দিয়েছেন স্বাধীনতার অভীষ্ট লক্ষ্যে। একাত্তরের এপ্রিলে শপথ গ্রহণের পর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আট মাস ধরে এ সরকার দেশের সশস্ত্র যুদ্ধকে ক্রমবর্ধমানভাবে অব্যাহত রেখেছে। অনড়-অটলভাবে তারা তাদের প্রয়াস চালিয়ে গেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ভিত্তিস্বরূপ আমাদের জাতীয় ঐক্যকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য। ঘরে-বাইরে সব শত্রুর বিরুদ্ধে তারা অক্লান্ত যুদ্ধ করেছেন সর্বোচ্চ বীরত্বের সঙ্গে, তবে তার চেয়েও বড় কথা, যুদ্ধ চলাকালে পুরোটা সময় ধরে তারা আমাদের অবিকল্প মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা অবিচলভাবে অনুসরণ করেছেন, এবং গণমানসে তার ভাবমূর্তি অম্লান রেখেছেন। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল গঠিত হওয়ার পর মুজিবনগর সরকার জাতির যুদ্ধপ্রয়াসে এক নতুন গুরুত্ব আর তাগিদের সঞ্চার করে। এর ফলে এমনকি সেই ধ্বংস ও মৃত্যুর মুহূর্তেও বাংলাদেশের জনগণের মনে যুদ্ধজয়ের ব্যাপারে একটা দৃঢ় আস্থার সৃষ্টি হয় এবং তারা আন্তর্জাতিক সমাজে তাদের দেশের অবস্থান হৃদয়ঙ্গম করতে শুরু করে।

মুজিবনগর সরকার গঠনের যুগান্তকারী পদক্ষেপটিকে বিজ্ঞজনেরা বিবেচনা করেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পূর্ণ বাস্তবায়নের পথে একটি যথোপযুক্ত সাংবিধানিক, যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হিসেবে। মুজিবনগর দিবস আমাদের জাতীয় ইতিহাসে একটি মাইলফলক সংগঠন। দিনটির সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যের কয়েকটি দিক এখানে তুলে ধরা হলো।

প্রথমত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো আন্দোলন নয়, বরং একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনিবার্য সম্প্রসারণ, সেটা আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরা। সেইসঙ্গে এটাও সারা বিশ্বের কাছে নিশ্চিত করা যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্বদানের ব্যাপারে মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত মানুষের এবং স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এসব লক্ষ্য বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করাটা মুজিবনগর সরকার জন্য যেমন অপরিহার্য ছিল, তেমনি ছিল ভারত সরকারের জন্যও।

তখন বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের গভীর সংকটে জর্জরিত। বহু দেশ আমাদের সংগ্রামের সাথে একাত্মতা প্রকাশের পাশাপাশি সাহায্যের হাত বাড়ালেও, বিশ্বের দুটি বৃহৎ শক্তি যথা যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এমন একটি প্রতিকুল পরিস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের যেকোন একটি ভুল সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ লড়াই হিসেবে চিহ্নিত করার সম্ভাবনা জাগাতে পারতো।

দ্বিতীয়ত, মুজিবনগর সরকার গঠনে আরও দেরি হলে বা আদৌ গঠন করা না গেলে নিশ্চিতভাবে কোনো ধরনের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তো বিশৃঙ্খলভাবে। চলমান জনযুদ্ধকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার জন্যে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল। মুজিবনগর সরকার দক্ষভাবে দায়িত্বটি পালন করে, যার ফলে আওয়ামীপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা মূলধারার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ের আভাবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্বের চোখে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা ছিল।

তৃতীয়ত, যুদ্ধের শুরুতে সাধারণ জনগণ, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক, পুলিস, আনসার, ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যগণ ইত্যাদি সবাই স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশ নিলেও, তাদের সে-প্রয়াসের পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। এদের সবাইকে সঙ্ঘবদ্ধ করে একটি একক আদেশানুক্রমের মধ্যে নিয়ে আসা এবং তাদের নিজ নিজ রণাঙ্গণ নির্দিষ্ট করে দেয়া সম্ভব হয়েছে মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার ফলেই।

মুজিবনগরে শপথ নেয়া স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার তার অসাধারণ কর্মতৎপরতার গুণে অচিরেই সাফল্যের তুঙ্গে পৌঁছে যায়। মাত্র নয় মাসের মধ্যে এ সরকার এক অসাধারণ কার্যকর ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলে। এ সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী এইচ. টি. ইমাম লিখেছেন, “১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সরকার আকারে বিশাল ছিল না, কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর এবং দক্ষ ছিল। মন্ত্রিসভার প্রাত্যহিক বৈঠক ছাড়াও যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো প্রয়োজন ও সময়ের তাগিদে। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থায় যেভাবে সরকার পরিচালনা করতে হয়, ঠিক সেভাবে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা এবং আমরা সবাই কাজ করেছি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি ছিল দ্রুত এবং দৃঢ়। বাস্তবায়নও হতো ক্ষিপ্র গতিতে।” (এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, পৃ. ৬৫)

যুদ্ধ চলাকালে অনেক দেশেই প্রবাসী সরকার গঠিত হওয়ার বহু নজির আছে। তবে এগুলোর মধ্যে কিন্তু মুজিবনগর সরকার ছিল অনন্য। এ সরকার শুধুমাত্র প্রবাসী ছিল না, এর নিজস্ব ভূখণ্ডও ছিল। ভারত সীমান্ত সংলগ্ন নিজস্ব ভূমিতেই এ সরকার শপথ নিয়েছে এবং সদরদপ্তর স্থাপন করেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেসব এলাকা পাক হানাদারমুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল বা যেসব এলাকা হানাদার বাহিনী দখল করতে পারেনি, সেসব মুক্তাঞ্চলে সরকার সবরকমের সামরিক এবং বেসামরিক প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। এসব মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়মিত পরিদর্শনে আসতেন বিদেশি সাংবাদিকরা। একথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে মুজিবনগর সরকার নামে বিভিন্ন সময়ে অভিহিত এই সরকারই প্রথম পূর্ণাঙ্গ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি মাইলফলক যা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে ‘জীবন ও বৈধতা’ দিয়েছে। জাতির পিতার কারাবন্দি অবস্থায় তারই দিকনির্দেশনা অনুযায়ী যে মহান নেতারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদেরকে জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে।

সামরিক স্বৈরসরকার ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৭১-এ যে-সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়, তাতে প্রাথমিক সাফল্য আসে দলের সুপ্রিমো বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেও তাকে রাষ্ট্রপ্রধান করে জননির্বাচিত সরকার গঠনের মধ্যে দিয়ে। এসময় নবগঠিত সরকারকে যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধুর চার ঘনিষ্টতম ছায়াসহচর-অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, অর্থমন্ত্রী এম. মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান। ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু নিজেই সরকারপ্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তারপর ১৯৭৫-এ আবার লোহার বাসরে কালসাপ এসে ঢোকে। পাকিস্তানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা নিহত হওয়ার পর আবার ফিরে আসে সেই সামরিক প্রেতচ্ছায়া। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা কন্যা, বর্তমান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম, আত্মদান-আত্মত্যাগের পর অবশেষে গণতন্ত্র এদেশে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। দেশে অনতিদীর্ঘ কাল ধরে একটা জননির্বাাচিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত থাকায় অর্থনীতিতে একটা বর্ধিষ্ণু স্থিতিশীলতা এসেছে। দেশ এখন অপ্রতিহতভাবে এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে।

এই গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস আমাদের প্রেরণা, আমাদের দিকপ্রদর্শক বাতিঘর। প্রত্যেক বাঙালির কর্ম ও চিন্তায় মুজিবনগর দিবসের তাৎপর্যকে ধারণ করতে হবে। দিনটি বাংলাদেশিদের কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ, সে-ব্যাপারে জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে বিদেশিদেরকেও অবগত করতে হবে। মুজিবনগর দিবসের গৌরবোজ্জ্বল গুরুত্ব আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই।

লেখক: অধ্যাপক; ইংরেজি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

বিষয়:

বাঙালি কী চাও তুমি?

আপডেটেড ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ ১৭:৫৬
রাজীব কুমার দাশ

বাঙালি কী চাও তুমি?
রুধির অপমান?
সানকি ভরতি পান্তা ইলিশ?

ব্যাসবাক্যের অপর নাম যেমন বিগ্রহবাক্য
প্রেমের পূর্ণরূপ যেমন সমর্পণ;

সেদিনও বছর ফেরত সুদাসল সূত্রে চক্রবৃদ্ধি সারি সারি
সুখ দুঃখ হাঁড়ি পাতিল মটকা কলস নিয়ে
হাজির হয়েছিল পহেলা বৈশাখের প্রথম
দিন।

নিগ্রহ প্রতীতি প্রতীকী কল্পমূর্তি ছায়ামূর্তি তিষ্ঠ তিষ্ঠ বীণা হাতে
সবাই দেখেছিল সাতষট্টির সকাল
রমনা বটমূল।

ভালোবাসা প্রেম মমতা দেয়নি কখনো একচ্ছত্র সমতা
তাইতো মানুষ মানুষেতে এত এত বৈষম্য কাড়াকাড়ি মারামারি যুদ্ধ;

সেদিন বাঙালি ঠোঁটে গেয়েছিল সাম্যসংগীত
হাতে ছিল প্রেমবীণা
বেজে চলেছিল অবিরত আগামীর শাস্ত্রীয়
সংগীত।

কে জানত?
আগামীর ঘরে ঘরে শাস্ত্রীয় সংগীত গাইবেন
এক একজন যন্ত্রী যন্ত্রিণী
যাপিতজীবনের সমুদয় দুঃখবেদনা এঁকে দেবে
দেয়াল চিকা পোস্টার ব্যানার ফেস্টুন রংবেরঙ মুখোশ সঙ
কোনো এক নাম না জানা
অখ্যাত চিত্রকর।

অখ্যাত নারী পুরুষ শিশু কণ্ঠে ব্যঙ্গসংগীত গাইয়ে
কাঁপন ধরিয়ে দেবে নাক কাটা রাজা ও
টুনটুনি পাখি গল্পের মতন;

জন্ম নেবে এক একজন সাঙ্গীতিক আধ্যাত্মিক গীতিকার সুরকার তানসেন।

সুরের মূর্ছনা তানপুরা তর্জনী হাতে তানসেন কণ্ঠে
ফেটে যাবে হিমালয়
মহান স্বাধীনতার জমাট বাঁধা বরফখণ্ডও এক দিন;
বাঙালি কী চাও তুমি?

কেন বলতে পারনা?
রমনা বটমূল থেকে হয়েছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণ।

লেখক: রাজীব কুমার দাশ
প্রাবন্ধিক ও কবি, পুলিশ পরিদর্শক।


হাওরের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মো. হুমায়ুন কবীর

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি-বন্যা নিত্যনৈমিত্তিক ও অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা; কিন্তু সে বৃষ্টি যদি আগাম হয় তবে সেটা সব সময় কল্যাণ বয়ে আনে না। এমনই একটি ঘটনা এবার ঘটেছে ভাটির দেশ, ধানের দেশ, গানের দেশ, প্রাণের দেশ হাওরে। গানের দেশ বলছি এ জন্য, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি সুরের গানের টানের জন্য বিখ্যাত এলাকা হলো হাওর এলাকা। আর সে জন্যই শাহ্ আব্দুল করিম, হাছন রাজার মতো গানের জাদুকরের সৃষ্টি হয়েছিল সেসব এলাকায়। কারণ নৌকা বাইতে বাইতে মাঝিরা সেখানে লম্বা লম্বা সুরে গলা ফাটিয়ে সুর তোলে গানে।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি বিরাট অংশ ভাটি এলাকার হাওর হিসেবে পরিচিত। বৃহত্তর সিলেটের জেলাগুলো- নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে এ বিশাল হাওর এলাকা গঠিত। এ এলাকার একটি বিশেষত্ব হলো সেখানে বছরে ৭ মাসই পানিতে তলিয়ে থাকে। বছরে মাত্র একটি ফসল বোরোধান উৎপাদিত হয়ে থাকে। এ সময়ে সেখানে প্রাকৃতিকভাবেই মিঠাপানির অনেক দেশি প্রজাতির মাছ উৎপাদিত হয়ে থাকে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত বিচিত্র ও বাহারি রকমের ধান ও মাছ দেশের চাহিদা মিটিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে বিদেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে।

এ অঞ্চলের একটি বড় রকমের দুঃখ হলো আগাম বন্যা ও অতিবৃষ্টি। প্রতি বছরে একমাত্র বোরো ফসল কাটার সময় এলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে শিলাবৃষ্টি ও আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের; কিন্তু প্রতি বছরই কিছু না কিছু ফসল বিনষ্ট হলেও ২০১৭ সালে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল বলে জানিয়েছে বিভিন্ন জরিপকারী সংস্থাগুলো। সেখানে বিস্তীর্ণ হাওর এলাকায় প্রায় দুই লক্ষাধিক হেক্টর জমির ধান ফসল যার বারো আনা নষ্ট হয়েছিল। সেখানে ৫ লক্ষাধিক মেট্রিক টন ধান নষ্ট হয়েছিল যার বাজারমূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকারও বেশি।

কৃষক সারা বছরের সঞ্চয় এক সঙ্গে করে জমা রাখে যাতে বোরো মৌসুমে ধান আবাদকালে চাষাবাদের খরচ জোগান দেওয়া যায়। শুধু তাই নয়- সার, সেচ, কীটনাশক, আগাছা নাশক, শ্রমিকসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য এ সঞ্চিত অর্থ খরচ করা হয়। সেই সঞ্চিত অর্থই এ ব্যয় নির্বাহের জন্য যথেষ্ট না হওয়ায় কৃষকরা দিশেহারা হয়ে দাদন ব্যবসা কিংবা মহাজনী কারবারিদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়তে বাধ্য হন। দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রয়োজনের সময় সহজশর্তে ব্যাংক লোন পান না। তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই কৃষকরা উচ্চ সুদে বেসরকারিী সংস্থা কিংবা জমিতে রেখেই নামেমাত্র মূল্যে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।

পাহাড়ি ঢলে উজান থেকে নেমে আসা বানের পানির তোড়ে সব ধরনের বাঁধ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সেই বাধভাঙা পানি যখন ধান খেতের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখন আর হাওরবাসীর কান্নার সীমা থাকে না। হাওরের ধানগুলো এমনিতেই নিচু এলাকায় হয়। সেখানে এত পরিমাণ নিচু যে সেখান থেকে আর পানি অন্যত্র নামিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। সে জন্য অল্প বৃষ্টিতেই মৌসুমের শুরুতেই ধানের জমিগুলো পানিতে তলিয়ে গিয়ে নষ্ট করে দিয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা।

জানা যায়, সেবার শুধুমাত্র মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত হাকালুকি হাওরেই নষ্ট হয়েছিল ২৫ মেট্রিক টন বিভিন্ন বিরল প্রজাতির মাছ। বৃষ্টির পানিতে আধাপাকা ধানের গাছ পানির নিচে চলে যাওয়ায় সেখানে সেগুলো পচে গিয়ে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে। সেই দুর্গন্ধে পানিতে অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস সৃষ্টি হয়ে পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছিল। আমরা জানি রাসায়নিকভাবে কোনো কিছুর নরমাল অর্থাৎ নিরপেক্ষ পানির পিএইচের আদর্শ মাত্রা হলো ৭; কিন্তু এ ক্ষেত্রে পানির নিচে ধানের খড় পচে গিয়ে পানির স্বাভাবিক পিএইচ মান ৭ থেকে ৩-৪-এ নেমে গিয়ে পানি অ্যাসিডিক হয়ে পড়ছিল। এতে মারা গিয়েছে মাছসহ পরিবেশের জীববৈচিত্র্যের অন্যান্য সজীব উপাদান।

জানা গেছে, এগুলো সমাধানের জন্য যদিও সংশ্লিষ্ট এলাকার মৎস্য ও কৃষি বিভাগ যৌথভাবে চুনসহ অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহার করে পানির স্বাভাবিক পিএইচ মাত্রায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে, তারপরও তড়িৎ কোনো ফল পেতে দেরি হচ্ছে। তাই সেখানে মাছ মরে মরে ভেসে উঠছে। ঠিক সে কারণে বিষাক্ত মাছ ধরে যাতে জনস্বাস্থ্যের কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয় সে জন্য সেখানে সাত দিন মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

এসব এলাকায় এমন দুর্যোগে মরে গিয়ে ভেসে ওঠা মাছ খেয়ে সেখানকার পানিতে ভেসে বেড়ানো হাঁসগুলো মারা যায়। বিভিন্ন সময়ে পরিসংখ্যানে প্রকাশ পেয়েছে সেসব এলাকায় প্রায় পঁচিশ লক্ষাধিক হাঁস পালন করে থাকেন সেখানকার কৃষকরা। আর শুধু হাঁস কেন, সেখানে মারা পড়ছে অন্যান্য প্রাণী ও জীবজন্তু। কারণ এক অর্থে সেখানকার খাদ্যশৃঙ্খলে দেখা দেয় এক প্রকার বিপর্যয়। একদিকে সেখানকার মানুষ যেমন আশ্রয় ও খাবারহীন হয়ে পড়ে, সেই সঙ্গে আশ্রয় ও খাদ্য সংকটে পড়ে সেখানকার গবাদিপশুসহ সব প্রাণীকুল। সেখানে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী অন্যান্য জীব যেমন- সাপ, গুইসাপ, ব্যাঙ, বিভিন্ন বিরল দেশি প্রজাতির মাছ ইত্যাদি সবই এখন হুমকির সম্মুখীন।

সম্প্রতি পত্রিকান্তরের একটি খবর আরও বেশি আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। আর সেটি হলো- আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওরের অদূরে পার্শ্ববর্তী ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় স্থাপিত বিভিন্ন খনির উত্তোলন। সেখানে কয়লা থেকে শুরু করে মারাত্মক ইউরেনিয়াম পর্যন্ত রয়েছে। আর ইউরেনিয়াম হলো এমন একটি মারাত্মক রাসায়নিক যা কি না পারমাণবিক চুল্লির উপজাত হিসেবে নিঃসৃত হয়ে থাকে। এ থেকে বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়লে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে মেঘালয়ের এসব খনি থেকে উজানের ঢলের পানির স্রোতের সঙ্গে যদি ইউরেনিয়ামসহ কোনো ধরনের দূষিত রাসায়নিক আমাদের হাওরে চলে আসে তখন তা শুধু যে হাওরেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা কিন্তু নয়। তা তখন সারা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্যই একটি মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

২০১৭ সালের দুর্যোগের পর সেখানকার বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা গেছে, এবারের আগাম বর্ষা ও বন্যা বিগত প্রায় শতাধিক বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এত বিশাল ক্ষয়ক্ষতি স্মরণকালের মধ্যে আর জীবিত কারও চোখে পড়েনি। সেখানে কারও বাড়িতে ধান নেই, চাল নেই, নেই কোনো নগদ অর্থকড়ি। চারদিকে শুধু হাহাকার। কারণ একটি মাত্র বোরো ফসল আবাদের জন্য কৃষকরা তাদের সর্বস্ব বিনিয়োগ করে থাকে। এখন তারা সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

আমরা জানি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাবেক মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সেই কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার মানুষ। তিনি শিকড়ের টানে সেসব বন্যাপীড়িত মানুষের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার জন্য সেসব এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন যা আমরা গণমাধ্যমে প্রচারিত হতে দেখেছি। সেখানকার সরেজমিন পরিস্থিতি দেখে তিনি এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৯ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে একটি সমাবর্তনে যোগ দিতে এসেও সেই হাওর এলাকার মানুষের প্রতি তার সহমর্মিতা ও উষ্মা প্রকাশ করেতে ভুল করেননি। তিনি তার মনের বেদনার কথা বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।

সেসময় বিষয়টি গণমাধ্যমের অন্যতম একটি হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী ঘটনা হওয়ার কারণে কথা উঠেছিল যে সেখানে প্রয়োজনের তুলনায় তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। বেশ কয়েকটি কৃষক সংগঠন হাওরের দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে দাবি-দাওয়া করে আসা হচ্ছিল। সেখানে এখন খবর পাওয়া গেছে, সেখানে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সেখানে পরিবারপ্রতি ন্যায্যমূল্যে ১০ টাকা কেজি দরে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে ইত্যাদি।

কেন হয়েছিল সেবারের এমন ভয়াবহ অবস্থা? কারণ অন্য বছরগুলোতে বর্ষাটা সাধারণত বৈশাখের শেষের দিকে শুরু হয়; কিন্তু সেবার তা বৈশাখই শুধু নয়- শুরু হয়েছে চৈত্রের শুরুতেই। বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে এগুলোই আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল। তা ছাড়া হাওরের সার্বিক উন্নয়নের জন্য যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। সেখানে বেড়িবাঁধ, বিভিন্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসমূহ যখন সম্পন্ন হবে তখন এ ধরনের সমস্যা কম হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আমরা জানি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর কারও কোনো হাত নেই। তবে একে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিছুটা মিনিমাইজ করা যায়। এগুলোকে মিনিমাইজ করার জন্য বর্তমানে সরকারের ইচ্ছায় হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি হাওরের কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিবিড়ভাবে গবেষণার মাধ্যমে উন্নয়নের জন্য চালু করা হয়েছে হাওর কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র। আরও নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক সমন্বিত প্রকল্প। যেগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের হয়তো হাওরের মানুষের এমন কান্না আর দেখতে হবে না। তবে এ মুহূর্তে আমাদের সাধ্যমতো তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।

যেকোনো ধরনের সমস্যারই তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করা কঠিন। বিগত দিনে অতীতের সরকারগুলোর পক্ষ থেকে এসব পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দিকে কেউই দৃষ্টি দেয়নি। যদি আগে থেকেই এসব এলাকার মানুষের জন্য কাজ করার জন্য সমন্বিত ও সম্মিলিতভাবে দৃষ্টি দেওয়া যেত তাহলে এসব সমস্যার অনেকাংশেই অনেক আগেই সমাধান সম্ভব হতো। তবে আশার কথা দেরিতে হলেও যেহেতু এসব এলাকার সার্বিক উন্নয়নে পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে এর সুফল এক সময় আসবেই। তবে এসব গৃহীত অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলো যেন সঠিক ও সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়- সেগুলো দেখভাল করার জন্য বর্তমান সরকার ও রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্ব ব্যক্তি রয়েছেন।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


banner close