মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি ও আঞ্চলিক হুমকি

দেলোয়ার হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
দৈনিক বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত
দৈনিক বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১০:৩১

দেলোয়ার হোসেন

২০১৭ সালে গণহত্যা সংঘটিত করে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং তারা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে বাংলাদেশে আগে থেকে অবস্থান করা শরণার্থীর সঙ্গে এ বিপুলসংখ্যক যোগ হয়ে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। সে সময় মিয়ানমারের আধা সামরিক আধা বেসামরিক সরকারের সৃষ্ট এই রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং নির্যাতন ভয়াবহ পরিস্থতির সৃষ্টি করে। মিয়ানমারের এই রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা শুরু হয় মূলত ১৯৭৮ সাল থেকে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিলেও শরণার্থী সমস্যা নিরসনে মিয়ানমার সরকারের ভূমিকা সব সময়ই নেতিবাচক ছিল।

১৯৬২ সাল থেকে মিয়ানমারে সামরিক জান্তাদের শাসন জারি ছিল। একটানা পঞ্চান্ন বছর ধরে সেখানে সামরিক শাসন বলবৎ ছিল। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সে নির্বাচনে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বা এনএলডি বিজয় লাভ করে। কিন্তু সামরিক জান্তারা সে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে এবং অং সান সু চিকে গৃহে অন্তরীণ করে রাখে। প্রায় ২০ বছর ধরে গৃহে অন্তরীণ ও কারাবাসের পর তাকে মুক্তি দেয়া হয় এবং মিয়ানমারে আংশিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। তবে সেটাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ২০২১ সালে মিয়ানমার তার আগের চেহারায় ফেরত আসে এবং এনএলডি ও সামরিক শাসকদের ক্ষমতা ভাগাভাগির অবসান ঘটিয়ে পুরো সামরিক শাসনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। অং সান সু চিকে বন্দি করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে সামরিক শাসক বহু মামলা দায়ের করে। সেই সব মামলার বেশ কিছুটার রায়ে তিনি এখনো বন্দি আছেন। এ ছাড়া এনএলডিসহ বিভিন্ন সামরিক শাসনের বিপক্ষের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন এখনো অব্যাহত আছে। যে নির্বাচনকে কারচুপির অভিযোগে সামরিক শাসকেরা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেই নির্বাচন তাদেরই তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নিজেদের তদারকিতে সম্পন্ন নির্বাচনকেই প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে তারা প্রকারান্তরে দেশটির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করেছে। ফলে মিয়ানমারে একটি নজিরবিহীন রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক শাসক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে রাজি হলেও এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়নি। উল্টো তারা দেশটির অভ্যন্তরে বিভিন্ন সামরিক সংঘাত সৃষ্টি করে সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।

পাশাপাশি, সামরিক জান্তার স্বার্থে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতা দেশটির নাগরিকেরাও ইতিবাচকভাবে নেয়নি। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সেখানে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই প্রতিবাদী মানুষ বাইরে নেমে আসে। প্রতিবাদকারীদের হত্যা, দমন-পীড়নের পরও তাদের আন্দোলন থেমে নেই। মিয়ানমারের নানা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে সেখানকার সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘুদের ওপর হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, সহিংসতা ও নিপীড়ন চালিয়েছে। আমরা জানি, দীর্ঘদিন ধরেই সেখানকার সামরিক শাসকরা প্রায় ১০-১২টি গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত আছে। কিন্তু সম্প্রতি সেটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এক সময়কার আরাকান বলে পরিচিত রাখাইন রাজ্যে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসার সঙ্গে মুহুর্মুহু সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। অবশ্য মিয়ানমারের অন্যান্য সীমান্তেও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সংঘর্ষ হচ্ছে। চীনের সঙ্গে বা থাইল্যান্ডের সঙ্গে কিংবা ভারতের সঙ্গে সীমান্তে দীর্ঘ সময় ধরে সংঘর্ষ চললেও আরসার সঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তে যুদ্ধ এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে।

মিয়ানমারের যে নিন্দিত, বেপরোয়া ও উসকানিমূলক আচরণ সীমান্তে দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাস্তবতাও জড়িত। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর মিয়ানমার জান্তা দেশের ভেতরেই রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বেশ চাপে রয়েছে, যার সর্বশেষ সংস্করণ আরাকান আর্মির সঙ্গে তাদের তুমুল সংঘাত। সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, জান্তা সরকার ১৭ শতাংশ ভূমিতে তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এনইউজি তথা মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ ৫২ শতাংশ অঞ্চলে। বাকি অংশের আধিপত্য নিয়ে চলছে সংঘাত। রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ তারই অংশ। এসব যুদ্ধে জান্তা সরকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এর জের ধরে এক ধরনের নাজুক রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে। তবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যা-ই থাক; সীমান্ত লঙ্ঘন হওয়া অথবা সীমান্তের ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই মিয়ানমার জান্তাবাহিনীর।

সীমান্ত পরিস্থিতি হয়তো কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে। কিন্তু মিয়ানমারের ক্ষেত্রে তা যেভাবে নিয়মিতভাবে ঘটছে, সেটাই প্রমাণ করছে, দেশটির সামরিক বাহিনী কতটা বেপরোয়া। যদিও তারা ভেতরে-বাইরে উভয় দিক থেকেই চাপের মধ্যে রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে; রোহিঙ্গা গণহত্যার কারণে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে শুরু করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপে রয়েছে; গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা এখনো চলমান। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত সংঘাত ছাড়াও সামরিক শাসনের বাইরে মিয়ানমারের যে ঐক্য সরকার গঠিত হয়েছে, সে ঐক্য সরকারও দেশের মানুষ এবং বাইরের সমর্থন নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলছে এবং সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এত চাপের মধ্যেও মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বেপরোয়া মনোভাবের পেছনে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাইওয়ান সংকট এবং ইউক্রেন যুদ্ধকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশের সীমান্তে এখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আরসার সঙ্গে যে তুমুল সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, তার বড় ধরনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়ছে। তারা বারবার বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সীমানা লঙ্ঘন করেছে। এ পর্যন্ত তাদের রাষ্ট্রদূতকে জবাবদিহির জন্য চারবার তলব করা হয়েছে। কিন্তু এখানে মূল বিষয়টি হলো, মিয়ানমারের সামরিক শাসক দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক সংকটের পাশাপাশি সামরিক সংকট সৃষ্টি করেছে। তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটাচ্ছে, গণহত্যার মতো যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করতেও পিছপা হচ্ছে না। তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। সম্প্রতি তারা একটি স্কুলে আক্রমণ চালিয়ে ১১ জন শিশুকে হত্যা করেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতৃত্ব এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা প্রকাশ করলেও সামরিক জান্তার উন্মত্ততা হ্রাস না পেয়ে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে তারা হত্যা করেছে।

এখানে আরসার সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের সংঘর্ষের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর আরসার সামরিক সক্ষমতাও বেশ কার্যকর। আরসার সঙ্গে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর শতাধিক সদস্য নিহত হয়েছে এবং কয়েক ডজন সামরিক স্থাপনা হাতছাড়া হয়েছে। ফলে আরসার সঙ্গে সংঘর্ষে মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা বেশ খানিকটা ব্যাকফুটে চলে গিয়েছে।

পাশাপাশি, এই সংঘর্ষের বিষয়টি আরেকটি কারণেও তাৎপর্যপূর্ণ। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আগামী বছর একটি বৈধতার নির্বাচনের ছক কষছে বলে আমরা জানি। ওই নির্বাচনে রাখাইন রাজ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই বস্তুত আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা।

মিয়ানমার তার সীমান্তে যে তীব্র সংঘাত সৃষ্টি করে চলেছে এবং রোহিঙ্গা সংকটকে জিইয়ে রাখার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তা এই গোটা অঞ্চলকে একটি বড় হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তারা এ অঞ্চলের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য বৃহৎ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। মিয়ানমারের সীমান্তে সংঘাত সৃষ্টি করে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টির অপতৎপরতার বিপরীতে বাংলাদেশ এখনো শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি মিয়ানমারের সামরিক উসকানিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে মোকাবিলা না করতাম, তা হলে এ অঞ্চলে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হতো। মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা তাদের শাসনপ্রক্রিয়াকে বৈধতা লাভ করানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশকে উসকানি দিয়ে সংঘাত সৃষ্টি করতে চাইছে।

পাশাপাশি, এবার তাদের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট নেশনস বা আসিয়ানের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আসিয়ানের কয়েকটি দেশ সহানুভূতি প্রকাশ করলেও সংস্থা হিসেবে সেটি মিয়ানমারের পক্ষেই ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক সংকট সৃষ্টি হলে আসিয়ান মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু দেশটির সামরিক শাসক সেই চাপকে অগ্রাহ্য করে চলেছে। ফলে এখন তারা নতুন করে যে সীমান্ত সংঘাত সৃষ্টি করছে, সেটাকে শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্যা বলে বিবেচনা করার অবকাশ নেই। এটা প্রকৃত অর্থেই একটা আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা বলে প্রতীয়মান হওয়া দরকার।

এখানে বাংলাদেশ মিয়ানমারের আগ্রাসী আচরণের বিরুদ্ধে যেভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে, সেটা খুবই ইতিবাচক। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে আসিয়ান দেশভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলাপ করেছে। অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও বৈঠক করেছে। এখানে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশকে সীমান্ত সংঘাতের বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তোলার তৎপরতার পরিধি বৃদ্ধি সাপেক্ষে পূর্ণ সমর্থন দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটা খুবই ইতিবাচক। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার মতো দেশগুলো আগে থেকেই মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সরব রয়েছে এবং বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে, তবে সেগুলো যথেষ্ট নয়। কিন্তু এসব রাষ্ট্রের মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থান এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে বলে মনে করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে আসিয়ান অধিভুক্ত দেশগুলো এখন যেমন মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে, তেমনি চীন এবং ভারতকে এ রকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। আমরা জানি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে এই দুটি রাষ্ট্র সমর্থন প্রদান করেছিল। এখনো যদি তারা সমর্থন অব্যাহত রাখে, তা হলে এ অঞ্চলকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এমনকি এই দুটি দেশের যে বিশাল বিনিয়োগ মিয়ানমারে রয়েছে, যে কানেক্টিভিটির পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটাও ব্যাহত হতে পারে। বাংলাদেশ তাই বহু আগেই বলে আসছে, মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তসংঘাত শুধু দুটি দেশের বিষয় নয়, এটি একটি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক বিষয়। ফলে এখনই দরকার জাতিসংঘে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আঞ্চলিক শান্তি বিনষ্ট করার অপতৎপরতা বন্ধ করার ব্যাপারে আলোচনা করা এবং তাদের বিরুদ্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করা। তা না হলে এখানকার আঞ্চলিক শান্তি বিপন্নতার হুমকিতে পড়তে বাধ্য হবে।

লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



বাংলার মৃত্যুঞ্জয়ী নেতা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
জাফর ইকবাল রাসেল

হে ঘুমন্ত পিতা,

চিরনিদ্রায় তুমি এখন কেমন আছো?

অজানা দেশে পাথর চোখে তুমি কি স্বপ্ন দেখো?

তুমি কি এখনো ধানসিঁড়ির তীরে বেড়াতে আসো?

সুখসাগরে তুমি কেমন আছো?

তোমার বজ্রকণ্ঠ আমরা আজও শুনি-

পদ্মা নদীর তীরে, লক্ষ মানুষের ভিড়ে,

আজও বেঁচে আছো তুমি সবার হৃদয়ে।

পিতা, ক্ষমা করো আমায়

তোমার স্বপ্নকে আমি ছুঁয়ে দেখতে পারিনি

পেটের দায়ে কাজ করি আমি সকাল-রাত্রি

তোমার ছবি বাঁধিয়ে রেখেছি হৃদয়ে

তবুও নিলামের বাজারে বিক্রি হইনি আমি এখনো,

আমি নেতা হতে পারিনি,

দাঁড়িয়ে থাকি আমি নেতাদের পিছনে

তোমার অচেনা, পাথরের নিষ্ঠুর এই শহরে।

পিতা, তোমার রূপসী বাংলা এখন নতুন রূপে,

তবে, কম্বল চোরেরা এখনো আছে এদিকে-সেদিকে,

মুক্তিরা অনেকেই বেঁচে আছে লাজুক চোখে-

অস্ত্রসহ যুদ্ধের ট্রেনিং জমা দিয়েছে অনেক আগেই।

জিন্না-টুপিওয়ালাদের এখনো পাওয়া যায়,

মার্কিনিরা এখনো তাদের চালায়

অস্ত্রবিহীন আমি যুদ্ধ করে চলেছি

তোমার স্বপ্নের লাল সবুজের লাগি

তুমি এসে দেখে যাও, ক্ষুধা নেই এখানে

টুপির চেয়ে শস্য এখন অনেক বেশি,

তবে আমি মাংস, পিঁয়াজ আর খেজুর খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি;

অপুষ্ট গ্রামে আর মেঠোপথ নেই বললেই চলে,

চিঠি, টেলিগ্রাম, ডাকপিয়নও নেই,

বিজলির আলোতে তোমার রূপসী আলোকিত;

নদী পারাপারের জন্য এখন আমরা ভিক্ষা করি না,

পদ্মা, যমুনা, মেঘনা পাড়ি দিই নিমেষেই,

উড়ালসেতুতে দাঁড়িয়ে অন্যরকম অনুভূত হয়,

নিজেকে আর ক্ষুদ্র লাগে না নক্ষত্রের কাছে

দুঃখ শুধু এতটুকুই, তুমি দেখলে না কিছুই ।

এখন আমি কবিতা লিখি ভালোবাসার,

তোমার মতো তর্জনী উঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হয় -

লিখতে ইচ্ছে হয়,

‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’।

কি সুন্দর সেই কথা, হৃদয়েতে গাঁথা !

জয় বাংলা, জয় মুক্তির পিতা,

শুভ জন্মদিন বাংলার মৃত্যুঞ্জয়ী নেতা।

বিষয়:

স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ এবং একজন বঙ্গবন্ধু

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মীর আব্দুল আলীম

মার্চ মাস বাঙালির স্বপ্নসাধ যৌক্তিক পরিণতির এক মাস। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বিষাদ, আবেগ-অনুভূতি বিজড়িত মাস এই মার্চ। এই মার্চে ৪টি দিবস খুবই গুরুত্ব বহন করে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ২০২২ জাতীয় দিবস, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবস, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস এবং ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা। এ মাসের ২৬ তারিখে এ দেশের জন্ম; আবার এ মাসের ১৭ তারিখে জন্মেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। তাই মার্চ বাঙালি জাতির জন্য অর্থবহ এক মাস। এ মাসেই তার জাদুকরী ভাষণ বাঙালি জাতিকে স্বপ্নে বিভোর করেছিলেন তিনি। গর্জে উঠেছিল বাঙালি। স্বাধীনতার প্রেরণার উৎস ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ওই ভাষণ। ঐতিহাসিক এই ভাষণের পর প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের গহিনে লালন করা তখনো অধরা ‘স্বাধীনতা’ যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

একজন বঙ্গবন্ধু, একটাই বাংলাদেশ। শত বছর আগে ১৭ মার্চে জন্ম নেওয়া তেজোদীপ্ত এই মানুষটি গর্জে ওঠেন ৭ মার্চ; সেই গর্জনেই অর্জন ১৬ ডিসেম্বর। পৃথিবীর বুকে নাম লেখালো স্বাধীন বাংলাদেশ। তার মেধা, প্রজ্ঞা, সততা, সাহস সর্বোপরি দেশপ্রেমেই বাংলাদেশের জন্ম হয়। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ঘটনা হচ্ছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক স্বপ্নসাধ পূরণ হয়। ১৯৭১ সালে এসে যে রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে যদিও তার গোড়াপত্তন হয়েছিল বহু বছর আগে। তারপরে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মার্চে এসে বাঙালির সেই স্বপ্নসাধ যৌক্তিক পরিণতিকে স্পর্শ করে।
১ মার্চ রাতেই স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়। সেই সংগ্রাম পরিষদ ৩ মার্চ পল্টনে একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই শোভাযাত্রায় শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করলেন। ইশতেহারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সব কথা বলা ছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের চৌহদ্দি কী হবে, এই পতাকা বাঙালির পতাকা হবে, জয় বাংলা বাঙালির স্লোগান হবে, বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তি-সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক। সব কিছু বলা হয়েছিল। সে সময় মুহুর্মুহু স্লোগান হয়, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। ২ তারিখে পতাকা উত্তোলন, ৩ তারিখে ইশতেহার পাঠ, আর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু। এভাবেই স্বাধীনতার পটভূমি তৈরি হয়।

আজ বঙ্গবন্ধু নেই। আছে তার স্মৃতি। ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ আজও বাংলার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গাঁথা আছে। বঙ্গবন্ধুকে কী করে ভোলে বাঙালি। বাঙালি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে তাকে। এবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করছে বাংলাদেশ। এ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময়কে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছে। শত বছর আগে ১৭ মার্চ প্রিয় এ মানুষটির জন্ম। তিনি ভালোবেসেছিলেন বাঙালি জাতিকে। বীর হতে চাননি যিনি; ভয় পাননি শহীদ হতেও। রক্ত দিয়ে যিনি দেশবাসীর ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করতে প্রস্তুত ছিলেন সর্বদা- তাকে কী করে স্মরণ না করে বাঙালি? বঙ্গবন্ধু ক্ষমতাকে ভালোবাসেননি, হৃদয় দিয়ে দেশকে ভালো বেসেছেন, দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন। অর্থ লোভ তাকে ছোঁয়নি কখনো। দেশের ভালোবাসার কাছে তার কাছে অর্থ ছিল তুচ্ছ। এমন নেতা কি আর জন্মাবে কখনো এ দেশে? যা দেখছি তাতে বোধ করি কখনোই না। বঙ্গবন্ধু হয়ে আর আসবেন না কখনো কেউ। এক বঙ্গবন্ধু, এক বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। বাংলাকে ভালোবাসার এমন মানুষ আর কখনোই আসবে না এ দেশে। তার মতো করে কেউ বাংলাকে আর ভালোবাসবে না; বাঙালিকে তার মতো করে আর কেউ আগলে রাখবে না।

আমরা সত্যি অকৃতজ্ঞ জাতি। যিনি আমাদের দেশমাতৃকাকে উপহার দিলেন, এই তাকেই কত না নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। জাতির জনকের বাসভবনে রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়া হলো সেদিন। শিশু রাসেলের কান্না আর আকুতিও ওদের হৃদয় স্পর্শ করল না। শুধু তই নয়, হত্যাকারীরা তার কবর তিন মাস পর্যন্ত পাহারা দিয়েছে। সেখানে কাউকে আসতে দেওয়া হয়নি। এমনকি দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ছবি এ দেশে নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধুর কবর দেখতে না দেওয়া, তার হত্যার ছবি প্রকাশের নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ ঘৃণ্য হন্তারক ওই সামরিক শাসকরা তাতে ভয় পেত। তাদের ভয়টা ছিল এখানেই যে, তারা নিশ্চিত জানত জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি শক্তিশালী। তারা আরও জানত সে সময় এসব ছবি প্রকাশ পেলে কোনো কিছুতেই বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।

সেই ১৫ আগস্ট। সিঁড়িতে পড়ে আছে বাঙালি জাতির প্রাণপ্রিয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তমাখা নিথর লাশ। সিঁড়ি গড়িয়ে রক্ত চলে এসেছে বাহির আঙ্গিনায়। মহান সেই নেতার রক্তসোঁদা মাটিতে মিশে গেছে। তিনি তো শুধু এ দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, ছিলেন না দলবিশেষের প্রধান। দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী ঝড়-মেঘ ইতিহাসের পথে আমাদের যাত্রায় তিনি ছিলেন সঙ্গী ও পথপ্রদর্শক। তাকে ভুলব কেমন করে? তাকে কি ভোলা যায় কখনো? তাই তো ইতিহাসের এই মহানায়কের উদ্দেশে কবি লিখেছিলেন, ‘যতদিন রবে পদ্মা, যমুনা/গৌরী, মেঘনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।’

অবিসংবাদিত এই নেতার জীবন চলার পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ’৬০-এর দশক থেকেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ লাখো মানুষের উপস্থিতিতে ঢাকার তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বজ্রদৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তারই বজ্র নির্ঘোষ ঘোষণায় উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত জাতি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ধারণ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অদম্য সাহস ও আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক শক্তি নিজের বাঙালিসত্তার গভীর অনুরণন উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। কখনো স্বভাবের প্রেরণায়, কখনো সযত্ন উৎসাহে তার উন্মোচন ঘটিয়েছিলেন। দেশবাসীকেও তেমনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেই সত্তার জাগরণ ঘটাতে। দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে এক মোহনীয় স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তিনি ধীরে ধীরে, সেই স্বপ্ন সফল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন সবার প্রতি। কী বিপুল সাড়া তিনি পেয়েছিলেন, তার পরিচয় তো আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। ১৯৭১ সালে যেভাবে তিনি অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, তাতে বিস্মিত হয়েছিল সারা বিশ্ব। ক্ষাত্র শক্তির সঙ্গে নৈতিক শক্তির দ্বন্দ্ব পৃথিবীতে এই প্রথম সংঘটিত হয়নি; কিন্তু বাংলাদেশের এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে ঐক্য, যে শৃঙ্খলা, যে দুর্জয় সংকল্পের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল তার তুলনা হয় না। তারপর সেই ৭ মাচের্র ভাষণ, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যে শুনেছে সে ভাষণ তারই শরীরে বয়ে গেছে বিদ্যুৎপ্রবাহ। কী ছিল সে ভাষণে? কোনো অজ্ঞাত তথ্য নয়, কোনো অপ্রত্যাশিত ঘোষণা নয়, ভাষার কোনো কারুকার্য নয়, বলার কোনো পরিশীলিত ভঙ্গি নয়। তাতে ছিল এ দেশের সর্বশ্রেণির মানুষের অকথিত বাণীর প্রকাশ, তাদের চেতনার নির্যাস, বক্তব্যের অবিসংবাদিত আন্তরিকতা। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে এই আন্তরিকতার বন্ধন গড়ে উঠেছিল বলেই তো শত্রুদেশে বন্দি থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে তার প্রেরণা ছিল সক্রিয়। স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন দৃঢ় সংকল্পবব্ধ ছিল সবাই তেমনি প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল তার নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলার। বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেই তিনি বলেছিলেন যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে; পূর্ণ হবে না। এই ছিল তার স্বপ্নেরই অংশ। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই তাকে সপরিবারে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বিশাল প্রতীক এবং নিরন্তর প্রেরণার উৎস। এইসব উপাদানের সমন্বয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং এই ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং সর্বোচ্চ স্থানটি যে বঙ্গবন্ধুর যুক্তিবাদী, বিচারশীল এবং ইতিহাসবোধসম্পন্ন সব মানুষই এটা স্বীকার করবেন। এ ব্যাপারে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তবুও কিছু লোক বিতর্ক তুলেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর হত্যা দিবসকে ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে পালনের সরকারি সিদ্ধান্তকে ক্ষমতার জোরে অন্যায়ভাবে বাতিলও করে দিয়েছেন। তাদের এই সিদ্ধান্ত ছিল অদূরদর্শী, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বিরোধী এবং ইতিহাসকে অস্বীকার করার নামান্তর। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপরবর্তী নানা অস্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহের স্রোতে এই দিনটিকে ১৯৭৫ পরবর্তীকাল থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক নানা স্বার্থ,

স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্ত এবং কিছু লোকের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে এটি সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যখন এই দিনকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করল তখন তাকে সব গণতান্ত্রিক, ইতিহাসবোধসম্পন্ন ও শুভবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত দলের মানুষেরই এটা মেনে নেওয়া উচিত ছিল। কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশ আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রায় সিকি শতাব্দী সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন এবং তারই ফলে মানুষের মনে তার চিন্তা-চেতনা গভীরভাবে প্রভাব ফেলে এবং ধাপে ধাপে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনকে রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম, একটি ইতিহাস। বাঙালির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি। তার জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। সংগ্রামের মধ্যেই তিনি বড় হয়েছিলেন। তার জন্ম তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায়। ছাত্র অবস্থায় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠন, কপ, পিডিপির আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে মহানায়ক হিসেবে ’৭০-এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে এ দেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত করেন। অবিসংবাদিত এই নেতার জীবন চলার পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ’৬০-এর দশক থেকেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ লাখো মানুষের উপস্থিতিতে ঢাকার তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তারই ঘোষণায় উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত জাতি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ধারণ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অদম্য সাহস ও অকুতোভয় আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক শক্তি নিজের বাঙালিসত্তার গভীর অনুরণন উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। দেশবাসীকেও তেমনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেই সত্তার জাগরণ ঘটাতে। দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে এক মোহনীয় স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তিনি ধীরে ধীরে, সেই স্বপ্ন সফল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন সবার প্রতি। কী বিপুল সাড়া তিনি পেয়েছিলেন, তার পরিচয় তো আমরা স্বচক্ষে দেখেছি।

বঙ্গবন্ধুকে জীবনের একটা বড় অংশ বাঙালি জাতির জন্য ত্যাগ করতে হয়েছে। দেশের জন্য দিয়েছেন নিজের জীবনও। জেল-জুলুম ছিল তার জীবনের একটা অংশ। বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেই তিনি বলেছিলেন, ‘যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না’। এই ছিল তার স্বপ্নেরই অংশ। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই তাকে সপরিবারে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখা মানুষ। তিনি চলে গেলেন। আর ফিরে এলেন না। আফসোস, এমন একটা নেতা এ দেশে আর জন্মায়নি একটিও। তার মতো করে বাংলাকে আর ভালোবাসেনি কেউ, দেশের মানুষকে আগলে রাখেনি কেউ। হে মহান নেতা ভালো থেকো, স্বর্গীয়সুখে থেকো। হাজারও সালাম তোমায়।

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক

বিষয়:

অপরিপক্ব পেঁয়াজ বিপণনে কৃষকের লাভ কি?

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
 ড. মিহির কুমার রায়

পেঁয়াজের একটি বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে খাদ্য উপকরণে যেমন- পুষ্টিগুণ বৃদ্ধিতে, ক্যালসিয়াম-সালফার-ভিটামিন সংযোজনে, শরীরের তাপমাত্রা কমাতে, লিভারের হজমশক্তি বাড়াতে, ত্বকের সমস্যা নিরসনে, ক্যানসার ও ডায়াবেটিক রোগ নিয়ন্ত্রণে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিগত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ২৬ লাখ ১৯ হাজার টন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে বছরে ২৪ লাখ টন। আবার উৎপাদিত পেঁয়াজের একটি অংশ (প্রায় ৩০ শতাংশের মতো) বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয় বিধায় মোট ঘাটতি ৮ থেকে ৯ লাখ টন থেকেই যায় যা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়, প্রতি বছরই যা স্বাভাবিক নিয়ম এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে আমদানি ও উৎপাদন মিলিয়ে দেশে মোট পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ৩৪ লাখ টন। দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন এবং প্রতিদিন সারা দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৬ হাজার টন আর ঢাকা শহরেই চাহিদা প্রতিদিন দেড় হাজার টন। সাধারণভাবে তিন ঋতুতে পেঁয়াজের চাষ হলেও বর্ষায় এর চাষ বেশি হয় যদিও বন্যার একটা অনিশ্চয়তা কিংবা বর্ষার একটি সংকট রয়েই যায়। তারপরও যে বছর পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়, সে বছর আবার কৃষক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন এবং পরবর্তী বছরে পেঁয়াজ চাষে কৃষক আর উৎসাহিত না হয়ে অন্য ফসলে চলে যান। যার ফলে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যায় পরবর্তী বছরে।

দেশের বাজারে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই পেঁয়াজের দাম অস্থিতিশীল। ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় বর্তমানে পেঁয়াজের দাম প্রায় তিনগুণ। সাধারণত প্রতি বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত মূল মৌসুমের পেঁয়াজ বা হালি পেঁয়াজ তোলেন কৃষক। তবে এবার দাম বেশি থাকায় আগেভাগেই উত্তোলন শুরু করেন চাষিরা। এতে তারা লাভবান হলেও সার্বিকভাবে দেশের মোট উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। নির্ধারিত সময়ের আগেই অপরিণত পেঁয়াজ উত্তোলন শুরু হওয়ায় সরকারের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। তবে কৃষকরা বলছেন, শুধু বাড়তি দাম নয়, বরং ভারত থেকে আমদানি শুরু হলে দর কমে যাওয়ার আশঙ্কায় আগেভাগেই পেঁয়াজ তুলতে শুরু করেছেন চাষিরা।

পেঁয়াজের সিংহভাগ উৎপাদন হয় রবি মৌসুমে। এ মৌসুমে মুড়িকাটা ও হালি দুই জাতের পেঁয়াজ চাষ করেন কৃষক। আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাসের প্রথম দিকে কন্দ বা মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয়। এরপর চাষ করা হয় চারা বা হালি পেঁয়াজ। সাধারণত ডিসেম্বরের শেষ দিকে মাঠ থেকে মুড়িকাটা পেঁয়াজ কাটা শুরু হয়। মধ্য মার্চ থেকে পুরোদমে হালি পেঁয়াজ তোলা শুরু হয়। যদিও চলতি মৌসুমে দাম বেশি থাকায় নির্ধারিত সময়ের ১৫-২০ দিন আগেই কৃষক পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করতে শুরুও করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে চারা বা হালি পেঁয়াজ ১ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে, মুড়িকাটা বা কন্দ পেঁয়াজ ৬৬ হাজার ৬৬১ হেক্টর ও বীজ পেঁয়াজ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে, বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকায়। গত বছরে এ সময়ে দাম ছিল কেজিপ্রতি ৩০-৪০ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় বর্তমানে পেঁয়াজের দাম প্রায় তিনগুণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন দাম বেশি থাকলেও ভারত থেকে আমদানি হলে সামনে দাম কমে যেতে পারে। ফলে কৃষক দ্রুত তাদের উৎপাদিত ফসল বাজারে বিক্রির দিকে ঝুঁকছেন।

পেঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় একটি জেলা পাবনা। এখানকার পেঁয়াজ সারা বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়। জেলার সুজানগরের চাষি আবেদ আলী এ বছর ৩৬ শতক জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছেন। এরই মধ্যে তিনি ৩৭ মণ উত্তোলন করেছেন। যদিও এ জমিতে কমপক্ষে ৪৫ মণ ফলন হওয়ার কথা। তিনি ৩৭ মণ বিক্রি করে প্রায় ৯৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। কিন্তু অন্য বছর ফলন এর চেয়ে বেশি হলেও সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা বিক্রি করা যেত। পাবনায় এ বছর ৯ উপজেলায় ৫৩ হাজার ২৭৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কৃষি বিভাগ; কিন্তু আবাদ হয়েছে ৫২ হাজার ৬৪০ হেক্টরে। এ জমিতে প্রাথমিকভাবে ৭ লাখ ৬৪ হাজার ৪৯৬ টন পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেওয়া হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই উত্তোলন শুরু হওয়ায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজবাড়ীতেও চলতি বছর বেশি লাভের আশায় অপরিণত পেঁয়াজ তুলতে শুরু করেছেন কৃষক। এতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় এ বছর ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় এক হাজার হেক্টর বেশি। জেলায় পেঁয়াজ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজার টন। যদিও কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ভালো দাম পেয়ে চাষিরা যেভাবে উত্তোলন শুরু করেছেন এভাবে চলতে থাকলে জেলায় পেঁয়াজ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। রাজবাড়ীর কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি হালি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকায় আর খুচরায় ১০০-১১০ টাকা। তবে বাজারে আসা এসব পেঁয়াজ এখনো পরিপক্ব হয়নি। সাধারণত গাছ মারা যাওয়ার পর পেঁয়াজ পরিপক্ব হয়; কিন্তু সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সবুজ রঙের গাছ থেকেই কৃষক পেঁয়াজ তুলে ফেলছেন। কৃষক বলেন, ‘সামনে ভারত থেকে আমদানি শুরু হলে দাম কমে যেতে পারে। ফলে এখন কাঁচা পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করছেন চাষিরা।’ রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বলেন, ‘অপরিপক্ব পেঁয়াজ না তুলতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তার পরও বেশি দামের আশায় উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।’ ফরিদপুরের সালথা উপজেলার কৃষকরা জানান, ভারত থেকে আমদানি শুরু হলে দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কায় আগেভাগেই তারা পেঁয়াজ তুলতে শুরু করেছেন। কৃষক বলেন, ‘বর্তমানে উৎপাদন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত যে পরিমাণ খরচ হয় তাতে ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে প্রবেশ করলে দেশি পেঁয়াজের দাম কমে যাবে। এতে লাভ করা তো দূরের কথা উল্টো লোকসানের মুখে পড়তে হবে। তাই পরিপক্ব হওয়ার আগেই বিক্রি করছি।’ সালথা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, এ বছর উপজেলায় ১১ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। দাম ভালো পাওয়ায় কিছু জমির পেঁয়াজ উত্তোলন করছেন চাষিরা। আর ১০-১২ দিন পর উত্তোলন করলে ঘরে রাখতে পারবেন। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৭৫৪ টন। রোপণ করা হয়েছে ৩ হাজার ২৩৫ হেক্টর জমিতে। একজন কৃষক জানান, চরে পেঁয়াজ চাষে বিঘাপ্রতি খরচ হয় ১৩-১৫ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে গড়ে ৪০-৫০ মণ ফলন হয়। খরচ বাদে প্রতি বিঘায় ৪০-৪৫ হাজার টাকা পাওয়া যায়। রমজান মাস বলে ৮০-৯০ দিনের পেঁয়াজ উত্তোলন করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। দামও বেশি পাওয়া যাচ্ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জানান, পেঁয়াজ সাধারণত ১১০-১২০ দিনের মধ্যে উত্তোলন করলে ফলন ভালো মানের হয়। সেই সঙ্গে দেখতে হবে গাছের পাতা হলুদ ও গোড়া নুয়ে পড়েছে কি না। এমন হলে পেঁয়াজ জমি থেকে তুলে নিতে হবে। এ ছাড়া কৃষক স্বভাবতই লাভবান হওয়ার চেষ্টা করবেন। তার পরও পেঁয়াজ পরিপক্ব অবস্থায় জমি থেকে তুলে শুকিয়ে বিক্রির পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান বলেন, ‘যারা আগাম পেঁয়াজ আবাদ করেন তারা মার্চ থেকে উত্তোলন শুরু করেন। এ বছর দাম বেশি। তাই কৃষক আগেভাগেই তুলে ফেলতে চাইবেন, সেটা স্বাভাবিক। কৃষক বিক্রি করলে সেখানে তাদের নিষেধ করার সুযোগ নেই। তবে অপরিণত পেঁয়াজ তুলে ফেললে সামগ্রিক উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। বছরের শেষদিকে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। মূলত অনিশ্চিত বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে কৃষকরা তাদের দাম নিয়ে সব সময় শঙ্কায় থাকেন। বাজারে দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকলে তারা অপরিণত পেঁয়াজ তুলতেন না। আমাদের বাজারে দাম হঠাৎ ওঠানামা করে। ভারত আমদানি বা রপ্তানি করবে এমন সিদ্ধান্তেও দাম ওঠানামা করে।

তারপরও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের পরনির্ভরতা কাটিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বিশেষত কৃষিজাত পণ্যের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরমার্শ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। দেশের মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী এবং বছরে ২ থেকে ৩ বার চাষ করার মতো উফশী জাতের বীজ রয়েছে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষাকালীন পেঁয়াজের চাষ, পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ ও পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য দেশে প্রয়োজনীয় ওয়্যার হাউস নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। পেঁয়াজ আমাদের দেশে মূলত শীতকালীন ফসল যা দেশের ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে থাকে আর ৩০ শতাংশ নিয়ে জাতির চিন্তা। এখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-২ এবং বারি পেঁয়াজ-৫ জাতের ৩টি গ্রীষ্মকালীন জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। পেঁয়াজ এমন একটি মসলাজাতীয় ফসল যা পৃথিবীব্যাপী উৎপন্ন হয় এবং সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় ভারত ও চীন দেশে বিশেষত আর্দ্র অঞ্চলগুলোতে যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব কম হয় আর হালকা শীত থাকে। আমদানি বাণিজ্যে আমদানিকারকদের সব বাণিজ্য সুবিধা প্রদান করতে হবে, টিসিবির কার্যক্রম ভোক্তাবান্ধব হতে হবে, বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে, বাজার স্থিতিশীল হতে হবে, সঠিক নিয়মে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে হবে ও বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখলে মূল্য বিপর্যয়ের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না যা কৃষক, ভোক্তা ও সরকারের জন্য একটি স্বস্তির বিষয় হতে বাধ্য। সর্বোপরি পেঁয়াজ উৎপাদনে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক জ্যাস্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা।


বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
তাপস হালদার

১৭ মার্চ বাঙালি জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন।১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে শিশুদের জন্য উৎসর্গ করে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রিয় বাংলাদেশকে শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসভূমিতে পরিনত করার নতুন শপথ নিতেই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন জাতীয় শিশু দিবস পালিত হচ্ছে।তাঁর কর্ম ও রাজনৈতিক জীবনের অসামান্য গৌরবের ইতিহাস প্রতিটি শিশুর মাঝে চারিত্রিক দৃঢ়তার ভিত্তি গড়ে উঠুক এটাই জাতীয় শিশু দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।

হাজার বছর আগে বাঙালি জাতির জন্ম হলেও জাতি হিসেবে কোনো স্বীকৃতি ছিল না,নিজস্ব কোনো জাতিস্বত্বা ছিলনা,স্বাধীন কোনো ভূ-খণ্ডও ছিলনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির সেই আক্ষেপ মোচন করেছেন। তিনি পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়,বাঙালি জাতির আস্থার ঠিকানা। বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল।তিনি দেশের জন্য জীবনের সবটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শৈশব থেকেই অন্যায়ের প্রতি যেমন ছিলেন প্রতিবাদী,ঠিক তেমনই গরীব অসহায় মানুষদের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল।এই অসাধারণ গুনটি তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। স্কুল বয়স থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।ম্যাট্রিক পাশের পর কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই রাজনৈতিক জীবনের বড় পরিবর্তন আসে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক,হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীদের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই বাঙালিদের উপর অন্যায়,অবিচার,শোষণ,নির্যাতন নেমে আসে। পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে তরুণ শেখ মুজিব। ধীরে ধীরে তিনি বাঙালিদের আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসেন।প্রতিবাদকে সংগঠিত করতে তিনি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সে লক্ষ্যেই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠন করেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। আর ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক ও কারাবন্দী থাকা অবস্থায় তিনি যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। সাংগঠনিক দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে খুব দ্রুতই দলের নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর হাতে চলে আসে।পর্যায়ক্রমে সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দলগুলো শেরে বাংলা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে সরকার গঠন করে। মন্ত্রীসভার কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে শপথ নেন শেখ মুজিবুর রহমান।

৫২-এর ভাষা আন্দোলন,৬৬-এর ছয়দফা,৬৯ এর গনঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে দেয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি।১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ৬ -দফার পক্ষে বাংলার জনগণ নিরঙ্কুশ রায় দেয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে উত্তাল হয়ে উঠে পুরো বাংলা। দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু বুঝে যায় একমাত্র স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালিদের মুক্তি সম্ভব নয়।সেজন্যই ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন,‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তারপর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হায়েনারা ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের উপর অপারেশন সার্চলাইটের নামে গনহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। এরপর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বঙ্গবন্ধুর শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও বঙ্গবন্ধুর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। মুজিবনগর সরকারে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্রপতি ছিলেন। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাকে বুকে ধারণ করেই মুক্তিযুদ্ধ করেছে। আর বঙ্গবন্ধুর ডাকেই বাঙালিরা মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।১ ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বঙ্গবন্ধু পান ‘জাতির পিতা’র স্বীকৃতি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে তাঁর হাতেই বাংলাদেশের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।বঙ্গবন্ধুর হাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়।

টুঙ্গিপাড়ার ‘খোকা’,রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছে প্রিয় ‘মুজি্ব ভাই',মুক্তিকামী মানুষের ভালোবাসায় অর্জন করলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি,মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে হয়ে ওঠেন ‘জাতির পিতা' আর একটি বাঙালিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়ে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’তে পরিনত হন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাস করতেন দেশটি হবে সবার।তিনি পাকিস্তানি দ্বিজাতি তত্ত্বকে ধারণ করতেন না। প্রত্যেকটি নাগরিকের সমানাধিকরণে বিশ্বাস করতেন। এজন্যই বাংলাদেশের সংবিধানের জাতীয় চারটি স্তম্ভের একটি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্থান দিয়েছিলেন।তিনি ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রেখেছিলেন। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্থান দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,‘আমরা ধর্মকে আইন দ্বারা পরিবর্তন করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে,হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে,বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে,খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।’

বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিশালতা পরিমাপ করা খুবেই কঠিন।তিনি ছিলেন মহাসাগরের মতো।বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী,কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়া চীন' বই গুলো পড়লে তাঁর সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে।কঠিন দেশপ্রেম,বিশাল মহানুভবতা,দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব,মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা,অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।তিনি বাঙালির প্রতিটি সংকটে পথ নির্দেশনা দিয়েছেন।এখনও বঙ্গবন্ধুর আদর্শই বাঙালির মুক্তির পথ দেখায়।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ-দৌলার পরাজয়ের পর স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল।তারপর থেকে বাঙালিদের একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য বিভিন্ন সময়ে অনেক সূর্য সন্তান স্বপ্ন দেখেছেন,সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু কেউই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিনত করতে পারেননি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই মহান নেতা যিনি শুধু স্বপ্নই দেখেননি,স্বপ্নকে বাস্তবে পরিনত করেছেন। ২১৬ বছর পর ১৯৭১ সালে বাঙালিদের জন্য স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন।এজন্যই বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু এক ও অবিচ্ছেদ্য।একে অপরের পরিপূরক। তিনিই বাঙালির ধ্রুবতারা,আলোর দিশারী। ভারতের মহাত্মা গান্ধী,যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন,দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা,ভিয়েতনামের হো চি মিন,তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক,যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো প্রত্যেকেই স্ব স্ব দেশের জাতির পিতা। তাঁদের ছাড়া যেমন সেসব দেশের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না,ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়না।

বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে হলে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস জানতে হবে।বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একে অপরের সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত।একটি থেকে অপরটি আলাদা করা যাবে না।বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন।স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি।কবি মহাদেব সাহা ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’? কবিতায় বলেছেন,‘তাই আমার কাছে বার্লিনে যখন একজন ভায়োলিনবাদক/বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল/আমি আমার দুপকেট থেকে ভাঁজ করা একখানি ১০ টাকার নোট বের করে শেখ মুজিবের ছবি দেখিয়েছিলাম/বলেছিলাম,দেখো এই বাংলাদেশ।’

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য,সম্প্রীতি বাংলাদেশ।


পিতার জন্মদিন

রাজীব কুমার দাশ
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রাজীব কুমার দাশ

‘পিতা

স্মরণে বরণে তোমার জন্মদিনে কী দেব জানিনা তোমার এনে দেয়া শিরদাঁড়া খাড়া হিমালয় এভারেস্ট মাথা উঁচু পরিচিতি তুমি না জন্মালে আমরা কোনোদিনই পেতাম না।’

পিতা, আজ তোমার জন্মদিন। আমাদের একা রেখে কেমন আছো;
জানিনা। তুমি না জন্মালে পেতাম না বিশ্বদরবারে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে চলার পরিচিতি ঠিকানা। তুমি না জন্মালে পেতাম না বুক ফুলিয়ে বলা সাহসে, - ‘আমি বাঙালি’ বলার অধিকার। তুমি না জন্মালে পেতাম না গণতন্ত্র সার্বভৌমত্ব সংবিধান; পেতাম না, মা মাটি দেশের সম্মান।


পিতা, আমাদের কথা চিন্তা করে ঘটা করে পালন করেননি নিজের জন্মদিন। শিখিয়েছেন কীভাবে মাথা উঁচু করতে বাঁচতে হয়। তর্জনী উঁচিয়ে মুক্তির দিশারী দৃষ্টিতে বলেছেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

পিতা, আমাদের ভালো রাখতে আপনি বেছে নিয়েছেন, কতটা কষ্ট নির্মম নির্যাতন। আমাদের মুখে ভাত, কাপড়, পাসপোর্ট, মানচিত্রের প্রয়োজনে হাসিমুখে ৪ হাজার ৬৮২ দিন অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে বসে নির্যাতনের রোজনামচা লিখে গেছেন।

আপনি হারা ছাড়া আমাদের দুঃখ নেই এখন। আপনার এক জীবনে দুঃখ কী!? দুঃখ কীভাবে শক্তি সাহস নির্বাণ মুক্তি আনন্দ হাসিতে চলমান রাখতে হয়; তাও আপনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন।


পিতা, তোমায় হারিয়ে কাঁদছে মানচিত্র, কাঁদছে সংবিধান। ঘরে ঘরে কাঁদছে হারান পরান আতিক শেফালি জোছনা মালতি সজল। তুমি ছাড়া আমরা নিঃস্ব পরিবার জগৎ সংসার।


পিতা, তুমি হারা বাংলাদেশ সংসারে আমরা এতিম অসহায়। তোমার জন্মদিনে দেবার মতন কিছু নাই। আমাদের সুখের ঘুমে রেখে জেগে আছো তুমি মানচিত্রের বুকে, বেঁচে আছো সংবিধানের পাতায়; মুক্ত বলাকা হৃদয়ে উড়ে চলেছো লাল সবুজ পতাকায়।

পিতা, কোথায় নাই তুমি? যেদিকে দু’চোখ যায়, সেদিকে তুমি আর তুমি। অনেক অনেক ভালো থেকো পিতা; আমাদের দেখে রেখো সদা সর্বদা। তুমি হারা সংসারে বেদনার মেঘে সারাবছর জমা করি অনেক অশ্রু। তোমার জন্মদিনে তোমার সন্তানের দেবার মতন কী ই বা এমন আছে!? কেঁদে কেঁদে বলছি পিতা- ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।’


লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি,

পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ।


১৭ মার্চ ১৯২০ ও আজকের বাংলাদেশ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. নাসিম বানু

শতবর্ষ আগে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ‘খোকা’র জন্ম। কালের আবর্তে এই ‘খোকা’ বাঙালির প্রিয় শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মানসে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটান, স্বাধীনতার মন্ত্রে অধিকার আদায়ে সংগ্রামী হতে একতাবদ্ধ করেন। কালক্রমে বাঙালি জাতির এই মহানায়ক ‘খোকা’ই গণরায়ে বাঙালির বঙ্গবন্ধু, বিশ্ব জনমতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং নেতৃত্বের দূরদর্শিতায় ও সক্ষমতায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের রূপকার, স্থপতি ও জাতির পিতা। বাঙালি জাতির ইতিহাসে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে মার্চ একটি ঘটনাবহুল মাস। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রাজনৈতিক কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, পরক্রমায় ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার লগ্নে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সামরিক শাসন কর্তৃক বন্দি হন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার সূত্রে বাঙালি জাতি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে দেশ দখলমুক্ত হয়। তবে স্বাধীনতার পূর্ণতা লাভ করে বঙ্গবন্ধুর বন্দিত্বের অবসানে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু দেশে প্রত্যাবর্তন করে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের টেকসই সম্ভাবনার রাজনৈতিক দলিল হিসেবে এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের সংবিধান এবং অর্থনৈতিক দলিল হিসেবে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা জাতিকে উপহার দেন। জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক অমর মূল্যবোধের আহ্বানে একটি ন্যায় ও সমতাভিত্তিক জাতি গড়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতার এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনন্য নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অগ্রসর হন। উৎপাদন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় মালিকানা, শিল্পের প্রকৃত মজুরি ও কর্মসংস্থান, আয়ের বৈষম্য রোধ ও কৃষি উৎপাদনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশীদারিত্ব ও অধিকার নিশ্চিত এবং দারিদ্র্য বিমোচনের অঙ্গীকার নিয়ে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণীত হয়। বঙ্গবন্ধুর এই গৃহীত পরিকল্পনায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রীয় মালিকানা সফল বাস্তবায়নে দেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৮.৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত হয়। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আজও বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির এই হার অর্জন করা যায়নি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এ দুটি দলিল বিশ্বে আজও সমভাবে সমাদৃত ও নন্দিত। জাতির দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে রাজনৈতিক ও উন্নয়ন দলিল দুটির নীতি, অঙ্গীকার ও ভাবনা থেকে আমরা দীর্ঘদিন দূরে থেকেছি। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বঙ্গবন্ধু প্রণীত ঘোষিত অসামান্য এ দুটি দলিলের অন্তরনিহিত উন্নয়ন ভাবনা ও বাস্তবায়ন কৌশলেরই একটি বৈশ্বিক রূপ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও আজ এসডিজি বাস্তবায়নে অংশীদার ও অঙ্গীকারবদ্ধ। সংবিধানের মূলনীতির আলোকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে আইনের শাসন, শাসনব্যবস্থার জবাবদিহিতা এবং প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার, সহাবস্থান এবং সামাজিক সম্প্রীতি নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোট নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি দেশের প্রতিটি নাগরিকের ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে একতাবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েই বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় উন্নীত করেছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় মর্যাদা দানের তার অবদানের কথা জাতি আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। বাংলা ভাষার জন্য আত্মাহুতি দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি আজ সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পুনর্গঠন, উন্নয়ন ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক ঐক্য, প্রশাসনিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক বিশেষ করে শিল্পোৎপাদনে কর্ম উপযোগী নাগরিকের অংশগ্রহণ ও অধিকার নিশ্চিত এবং সমবায় ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে গ্রামীণ কৃষি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভীত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক দোসরদের ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর এই মৃত্যুতে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা ব্যাহত, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু, গণতন্ত্র মানবতার চর্চা বাধাপ্রাপ্ত এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত তারই কন্যা ‘হাসু’ অর্থাৎ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আশার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক ও অগ্রগণতান্ত্রিক সামরিক শাসনের দেশে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে ক্ষমতায় এসে আইনের শাসন মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ার মনোনিবেশ করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে পুনরায় একের পর এ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মতো আর্থিক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করে দারিদ্র্য বিমোচনে উদ্যোগী হন এবং ইতোমধ্যে দারিদ্র্যের হার ২০%-এর নিচে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। তার উন্নয়নমূলক আর্থিক কার্যক্রমে বাংলাদেশে যোগাযোগ ও অন্যান্য অবকাঠামোগত বিপুল উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, শিল্পের প্রসার ঘটেছে, কৃষিতে আধুনিকায়নের ছাপ পড়েছে, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালন সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গৃহহীন মানুষ গৃহ পেয়েছে, সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বিধবা ভাতা, বৃদ্ধ ভাতা, মুক্তিযুদ্ধ ভাতা, ন্যায্যমূল্যে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের পরিমাণ ও পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। শহর ও গ্রামীণ জীবনমানের বৈষম্য কমেছে, উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটেছে, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, নাগরিকের মাথাপিছু আয় ও গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই নারীগোষ্ঠী এখন আর অবহেলিত নয়। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, শিল্প-কারখানা অর্থাৎ সমাজের প্রতিটি স্তরে তাদের অংশগ্রহণ আইনানুগভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সমবায় নীতি-কৌশলের আলোকে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনার পক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদান করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক প্রভাব এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিল করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়শীল দেশের কাতারে সামিল। ১৯৭৫ সালের মতো শেখ হাসিনার ইর্ষণীয় সাফল্যে দেশীয় উগ্র-সাম্প্রদায়িক ও একাত্তর সালের পরাজিত গোষ্ঠীর ভাব-শিস্য ও তাদের আন্তর্জাতিক দোসররা পুনরায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এই অপশক্তি গণতন্ত্র, মানবাধিকার প্রভৃতি স্পর্শকাতর ফাঁকাবুলি উচ্চারণ করে অসাংবিধানিক কায়দায় বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংগঠিত যুদ্ধ ও জাতিগোষ্ঠী নিধনের বিরুদ্ধে তাদের কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। ঐতিহাসিক এই মার্চ মাসে বাঙালি জাতিকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই অপশক্তি মোকাবিলা করে দেশের গণতন্ত্র মানবাধিকার ও উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

লেখক: প্রো-উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
তোফায়েল আহমেদ

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লিতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন মাতৃক্রোড়ে যে শিশু প্রথম চোখ মেলেছিল, পরবর্তীকালে সে শিশুর পরিচিতি দেশের সীমানা পেরিয়ে পরিব্যাপ্ত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। পিতা-মাতার আদরের ‘খোকা’; রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের সুপ্রিয় ‘মুজিব ভাই’; সমসাময়িকদের প্রিয় ‘শেখ সাহেব’ থেকে মুক্তিকামী বাঙালির ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অর্জন করেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি; কায়েমি স্বার্থবাদীদের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে হয়ে ওঠেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা-‘জাতির পিতা’ এবং পরিশেষে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’। বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তার নাম একাকার হয়েছে। এ তো শুধু একটি নাম নয়- বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস। যে জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক। ১৭ মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে প্রতি বছর পালিত হয়ে থাকে। এ বছর জাতির জনকের ১০৫তম শুভ জন্মদিনে সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে তার ঐতিহাসিক অবদানকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছে।

বঙ্গবন্ধু জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, বাঙালির মুক্তির জন্য নিজকে উৎসর্গ করা। ধাপে ধাপে প্রতিটি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৪৮ থেকে ’৫২ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন; ’৫০ থেকে ’৫৪ জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ; ’৫৪ থেকে ’৫৬ সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসন; ’৬৪-তে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতা; ’৬৬-তে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্থাৎ স্বাধিকার তথা ৬ দফা; ’৬৯-এর গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকূপ থেকে মুক্তমানব হয়ে বেরিয়ে এসে সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি এবং সংখ্যাগুরুর অধিকার আদায়; ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভূমিধস বিজয় অর্জন ও পরিশেষে ’৭১-এ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক এই পর্বগুলো সংঘটনে তাকে জীবনের ১৩টি বছর কারান্তরালে কাটাতে হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিকামী মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘ওঃ রং ংধরফ ঃযধঃ হড় ড়হব ঃৎঁষু শহড়ংি ধ হধঃরড়হ ঁহঃরষ ড়হব যধং নববহ রহংরফব রঃং লধরষং.’ অর্থাৎ ‘বলা হয়ে থাকে যে, সত্যিকার অর্থে কেউ একটি জাতিকে জানতে পারে না যতক্ষণ না কেউ একজন এর কারাগারে বন্দি থাকে।’ ২০১২-তে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য সরকারি সফরে দক্ষিণ আফ্রিকা যাই এবং রোবেন আইল্যান্ডে নেলসন ম্যান্ডেলার কারাকক্ষ পরিদর্শন করি। এখানেই আমার মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকেও মিয়ানওয়ালি কারাগারে এরকম একটি নির্জন কক্ষে বন্দি রাখা হয়েছিল। এই বন্দিশালাতেই নেলসন ম্যান্ডেলা তার দীর্ঘ ২৭ বছর কারাজীবনের ১৮ বছর বন্দি ছিলেন। স্বচক্ষে দেখেছি বন্দিশালার নির্জন সেলটি। যেখানে সংরক্ষিত রয়েছে কারাবন্দি ম্যান্ডেলার বিছানার জন্য একটি ও গায়ে দেওয়ার জন্য আরেকটি কম্বল, একটি প্লেট, গ্লাস ও জগ। ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থটি পাঠ করে জেনেছি কারারুদ্ধ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সম্বল ছিল একটি থালা, বাটি, গ্লাস আর কম্বল। প্রকৃতপক্ষে ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থটির শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন ‘জেলখানার সম্বল থালা-বাটি-কম্বল।’ এখানে গিয়েই বারবার আমাদের কেন্দ্রীয় কারাগার এবং পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারের কথা ভেবেছি-যে কারাগারে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘকাল বন্দিজীবন অতিবাহিত করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক সম্মেলনে গিয়ে মিয়ানওয়ালি কারাগারের প্রিজন গভর্নর (জেল সুপার) হাবীব আলীর কাছ থেকে বর্ণনা শুনেছি, কারাকক্ষের সামনে কবর খুঁড়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী অথবা কবর বেছে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কবরকেই বেছে নিয়ে বলেছিলেন, ‘যে বাংলার আলো-বাতাসে আমি বর্ধিত হয়েছি, মৃত্যুর পর এই কবরে না, আমার লাশ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিও।’ জাতির পিতা সাড়ে ৯ মাস পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারের নির্জন সেলে বন্দি ছিলেন। মিয়ানওয়ালি কারাগার ভিন দেশে হওয়ায় আমরা তা সংরক্ষণ করতে পারিনি। তবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের যে কক্ষে তিনি বন্দি ছিলেন সে সব সংরক্ষণ করা হয়েছে। আগরতলা মামলায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের যেখানে তিনি বন্দি ছিলেন সেটিও জাদুঘর করা হয়েছে। মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে আত্মোৎসর্গকারী নেতৃত্বের রয়েছে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত আদর্শিক মিল। যেমন- ’৭১-এর ৪ মার্চ বাঙালির সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে জাতির জনক বলেছিলেন, ‘চরম ত্যাগ স্বীকার করা ছাড়া কোনোদিন কোনো জাতির মুক্তি আসে নাই।’ তদ্রূপ দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘জনগণের মুক্তির জন্য অবশ্যই সবকিছু ত্যাগের জন্য প্রকৃত নেতাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু সবসময় বলতেন, ‘মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত।’ ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি দেশের মানুষকে ভালোবাসি, সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তাদের খুব বেশি ভালোবাসি।’

বঙ্গবন্ধু সবসময় ছোটকে বড় করে তুলতেন। যেসব জায়গায় সফর করতেন, বক্তৃতায় সেখানকার নেতা-কর্মীদের বড় করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতেন। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকে থানার, থানা আওয়ামী লীগের নেতাকে জেলার এবং জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকে জাতীয় নেতায় উন্নীত করে তিনি জাতির পিতা হয়েছেন। ফলত, সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজও বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করেই টিকে আছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন হৃদয়বান এক মহান নেতা। কারও দুঃখ তিনি সহ্য করতে পারতেন না। পরকে সহজেই আপন করে নিতেন। যারা বিরোধী ছিলেন তাদের কাছে টেনে নিতেন। তিনি যখন বলতেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না’, মানুষ তাই বিশ্বাস করত। তিনি ক্ষমতার জন্য, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করেননি। প্রিয় মাতৃভূমিকে শোষণ-বঞ্চনার নাগপাশ থেকে রক্ষা করে বাঙালিরা যাতে বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারে সে জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে রাজনীতি করেছেন। ’৬৭-এর ১৭ মার্চ নিজের জন্মদিনে লিখেছেন, ‘‘আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লিতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই- বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস।’” (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা-২০৯) মনে পড়ছে ’৭১-এর রক্তঝরা ১৭ মার্চের কথা। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ৫২-তম জন্মদিন ছিল। দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে তখনকার প্রেসিডেন্ট ভবন অর্থাৎ পুরাতন গণভবন সুগন্ধা থেকে দুপুরে যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে ফিরে এলেন তখন বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘৫২-তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না, আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু। আমি তো আমার জীবন জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি।’ জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে আসা জনসাধারণকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে আবৃত্তি করে বলতেন, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।’

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই বঙ্গবন্ধু লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। বারবার ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সময়োপযোগী। সেই কবে ’৬৬-তে হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তারই নির্দেশে উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা...’ গানটি গীত হয়েছিল। সেই সম্মেলনে দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ২০ মার্চ পল্টন ময়দানের বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘৬ দফা কর্মসূচি নিয়ে অনেকের কাছে গিয়েছি, কেউ আমাকে সমর্থন করে নাই।’ কবিগুরুর গান থেকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে...।’ আরও বলেছিলেন, ‘আমার দলের নেতা-কর্মীরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তবে আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছবই।’ বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার সব ষড়যন্ত্র আইয়ুব খান গ্রহণ করেছিল। আগরতলা মামলার সরকারি নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা। স্বৈরশাসক তাকে প্রধান আসামি করে ফাঁসিকাষ্ঠে দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু মাথা নত করেননি। এ দেশের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতির পিতার মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছিল। সেই গণআন্দোলন প্রবল গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত করে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহওয়ার্দী উদ্যান) গণসংবর্ধনায় জাতির পিতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই বাঙালির বন্ধু তথা ‘বঙ্গবন্ধু’। ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আই ফিল ফর মাই কান্ট্রি অ্যান্ড মাই পিপল, অ্যান্ড দ্যান মাই ফ্যামিলি।’ সবকিছুর ঊর্ধ্বে জাতির পিতার কাছে ছিল বাঙালি ও বাংলাদেশ। তিনি ছিলেন বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা। যেখানেই মুক্তিসংগ্রাম সেখানেই তিনি সমর্থন করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করা যায় ভারতের মহাত্মা গান্ধী, আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভিয়েতনামের হো চি মিন, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, যুগস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর সাথে। তাদের সমকক্ষ নেতা ছিলেন তিনি। পৃথিবীতে অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে আলোচনার টেবিলে বসে। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছেন রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে। নিজ জীবনকে তিনি বাঙালি জাতির জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন বলেছিলেন, ‘যে মরতে চায়, তাকে কেউ মারতে পারে না।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, তার মৃত্যু নাই।’ বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের একজন মহান নেতা, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। তিনি চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন। একবার যে সিদ্ধান্ত নিতেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হলেও আপস করতেন না।

‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের লালিত স্বপ্ন। ’৬৯-এর ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে স্বকণ্ঠে স্লোগান দেন, ‘আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ।’ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যা কিছু সংঘটিত হয়েছে সবকিছু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হয়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলা ’৫২-তে বলেছিলেন, ‘একদিন আমি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হব।’ আর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এক দিন আমি এই দেশকে স্বাধীন করব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার কাছে তুচ্ছ।’ সেই লক্ষ্যে উপনীত হতে ধাপে ধাপে তার আরাধ্য কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ’৭০-এর নির্বাচনে নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত কবর দেবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ জনগণের জন্যই ছিল তার রাজনীতি ও কর্মসূচি। বক্তৃতায় সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমাকে মোনেম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আইয়ুব খানও পারেনি- কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারি।’ বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসার মর্যাদা দিতে তিনি একাই রক্ত দেননি সপরিবারে রক্ত দিয়ে সে ঋণ পরিশোধ করে গেছেন।

’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানের সর্বকালের সর্ববৃহৎ জনসমুদ্রে হৃদয়ের অর্ঘ্য ঢেলে আবেগমথিত ভাষায় বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ স্থির-প্রতিজ্ঞ থেকে জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘ভাইয়েরা, তোমাদের এক দিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। আজকে আমি বলি, আজকে আমাদের উন্নয়নের জন্য আমাদের ঘরে ঘরে কাজ করে যেতে হবে।’ সেদিন বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে-গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।’ বঙ্গবন্ধু জীবনের প্রতিটি ধাপেই বাঙালির সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। যে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য তিনি যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন বাঙালির জয়গান, সেই বাংলা ও বাঙালির জন্য তার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের যে দরদ, যে ভালোবাসা তার গভীরতা অপরিমেয়।

লেখক: সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।


বঙ্গবন্ধু: বাংলার মানুষের আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু

মো. আহসান হাবিব
আপডেটেড ১৭ মার্চ, ২০২৪ ১৫:৩৭
মো. আহসান হাবিব

নিপীড়িত, নিষ্পেষিত আর অধিকার বঞ্চিত বাঙালিকে নির্মম শাসন-শোষণ, অমানবিক নির্যাতন, সর্বোপরি দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে যিনি মুক্ত করেছিলেন, তিনিই বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজকের এই সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁরই স্বপ্নের ফসল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের আজকের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। আজ তাঁর ১০৪তম জন্মবার্ষিকী। বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন) ছিলেন। মাতা সায়েরা খাতুন। এই দম্পতির চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে মুজিব ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তার বড় বোন ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী; তার ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের।

টুঙ্গিপাড়া নামক অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেয়া শেখ পরিবারের সেই ছোট্ট খোকাই হয়ে উঠেছেন একটি জাতির মুক্তির মহানায়ক।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের ইতিহাস। ২৩ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম ও দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তাদের সোনালি অর্জন স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনতে সফল হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ডানাতে ভর করেই বাঙালি বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের জন্মভূমিকে স্বাধীন দেশ হিসেবে জায়গা করে দিয়েছে। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার অদম্য সাহস জুগিয়েছিলেন জাতির পিতা। রাজনৈতিক জীবনের প্রথম লগ্ন থেকেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন দেশের জন্য। দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়াই ছিল তার প্রধান ব্রত। তাঁর এই দেশপ্রেম তাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাংলাদেশের জাতির পিতা হিসেবে পরিচিত করে বিশ্বব্যাপী। ৫৫ বছরের সংগ্রামী জীবনে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। যা তাঁর জীবনের সিকিভাগ। জেল-জুলুমের অমানবিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এবং ভাষা আন্দোলন ও বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে তিনি পরিণত হন জাতির পিতা ও বিশ্ব নেতৃত্বে। জাতির পিতার সমগ্র শৈশব পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি তাঁর শৈশব অতিবাহিত করেছেন এ বাংলার জল, কাদা আর পানিতে। মানুষের অত্যন্ত কাছাকাছি থেকেছেন সেই শিশুকাল থেকেই। শৈশব থেকেই তিনি মানুষের হৃদয়ের গভীরে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। যার প্রতিফলন আমরা তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে লক্ষ্য করি। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানের সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু উপাধি পান। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘...জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি... আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু বাংলাদেশ।’ ’৭১- এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালিকে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ওই ডাকে বাংলার আপামর জনতা মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুত হয়েছিল। তাঁরই প্রেরণায় এবং বজ্রকণ্ঠে অনুপ্রাণিত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালি আমজনতা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ পাকবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের সাগরে উদিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য। কয়েক লক্ষ মা-বোনের লুণ্ঠিত সম্ভ্রম ও কোলশূন্য আর্তনাদে বিষাদময় আকাশে-বাতাসে উড্ডীন হয় স্বাধীন সোনার বাংলার লাল সবুজের পতাকা।

পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি মুক্তি লাভ করল। প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার তাদের কারাগারে রাখতে পারল না। বন্দিজীবন থেকে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্যই হয়েছিল পাকিস্তান সরকার। বন্দিশালা থেকে সদ্য মুক্ত হওয়া বঙ্গবন্ধুকে সাংবাদিকরা বলেছিলেন, ‘আপনি যে আপনার বাংলাদেশে ফিরে যাবেন সেই দেশ তো এখন ধ্বংসস্তূপ!’ তখন বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, ‘আমার বাংলার মানুষ যদি থাকে, বাংলার মাটি যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শস্য- শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করব।’

বঙ্গবন্ধু সারাটি জীবন দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের তাগিদে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি মনে-প্রাণে চেয়েছিলেন এদেশের খেটে খাওয়া, মেহনতি মানুষ যেন সুখে থাকে, পেটে অন্ন থাকে, হাতে পয়সা থাকে। এককথায় বাঙালির জীবন যেন হাসি- খুশিতে ভরপুর থাকে। বঙ্গবন্ধু এমন একজন স্বাপ্নিক সত্ত্বা, যিনি স্বপ্ন দেখতেন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ নিজস্ব অর্জন দিয়ে সাফল্য লাভ করবে। এমনকি পৃথিবীর বুকে নিজস্ব অর্জন, সম্পদ, কৃতিত্ব দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। জাতির পিতা শোষণহীন-বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। তিনি প্রতিনিয়ত ভাবতেন বাংলার মানুষ উন্নত জীবন পাবে। দারিদ্র্যের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবে, বেকারত্ব ঘুঁচে যাবে, সমূলে উৎপাটন হবে দুর্নীতির বিষদাঁত। সদ্য স্বাধীন দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে পুনর্গঠন করতে বহুমুখী পরিকল্পনাও করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু চিরকাল মানুষকে যোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দেয়ার কথা অকপটে বলে গেছেন। প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিত করতে তাই তো বলেছেন, ‘এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পাবে, পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন; তখনই শুধু এই লাখো আত্মা তৃপ্তি পাবে। প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিত করা খুব জরুরি।’ শেখ মুজিবুর রহমান আপাদমস্তক একজন সত্যিকারের বীর বাঙালি। তিনি চেয়েছিলেন সম্মানের সঙ্গেই বাঙালি জাতি বেঁচে থাকবে।

বঙ্গবন্ধু বাংলার সাধরণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখলে কখনো স্বাভাবিক থাকতেন না। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাকারবারীদের কারণে বাংলার সহজ সরল মানুষগুলো যখন দুর্ভোগ পোহায় তখন অভিভাবক হয়ে এটা মানতে পারতেন না। তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘দীর্ঘ ৩ বছর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি, চোরে নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী। কিন্তু আর না। বাংলার মানুষের জন্য জীবনের যৌবন আমি কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি। এ মানুষের দুঃখ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই।’ বঙ্গবন্ধু এমনই ছিলেন, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর মন হু হু কাঁদত। বঙ্গবন্ধু মনে-প্রাণে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণের ভোটে জনগণের প্রতিনিধিরা দেশ চালায়, এর মধ্যে কারও কোনো হাত থাকা উচিত নয়।’

যুগে যুগে ধর্ম নিয়ে বহুদেশে হানাহানি, সংঘাত, রক্তপাত এমনকি জীবনও দিতে হয়েছে মানুষকে। জাতির পিতা সবসময় একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন। ‘আমার রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান তার ধর্ম-কর্ম করবে, হিন্দু তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে, বুদ্ধিস্ট তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে, খ্রিষ্টান তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু ধর্মের নামে আর ব্যবসা করা যাবে না।’ বাঙালি এই কথায় বঙ্গবন্ধুর চোখে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্নই দেখতে পেয়েছিল। বাংলা, বাংলার ইতিহাস ও শেখ মুজিবুর রহমান তিনটি অবিচ্ছিন্ন সত্ত্বা। একটি ছাড়া অন্যটি যেমন অসম্পূর্ণ, তেমনি একটি ছাড়া অন্যটি ব্যাখ্যা করা যায় না। অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু কখনো সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেননি। বঙ্গবন্ধু যে সবসময়ে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ভূমিকা পালন করেছেন, তা ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানি শাসকদের মদতে পূর্ব পাকিস্তানে, বিশেষ করে ঢাকায় একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। সেই দাঙ্গাতে হিন্দু পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়ার মাধ্যমে তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় আমরা পাই। এই যে মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীদের সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করা এগুলো অসাম্প্রদায়িকতার চমৎকার উদাহরণ। বাংলার কৃষক, মজুর আজ বেশি লাঞ্চিত ও অবহেলিত। একশ্রেণির মুনাফালোভী, কালোবাজারী স্বার্থান্বেষী মহলের ন্যায্য মূল্য না দেয়া নামক বিষাক্ত ছোবলে অতিষ্ঠ আমার কৃষক ভাইয়েরা। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা সেদিনই হবে যেদিন থেকে বাংলার কৃষক ভাইয়েরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবে। মনে রাখতে হবে কৃষক বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। কৃষকই দেশের আসল নায়ক। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের মুখের অন্ন জোগায়। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো। তাই তিনি সার্বিক কৃষিখাতকে বেশি গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।

নারীর প্রতি যথাযথ আস্থা ও সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে তিনি অধিক জোর দিয়েছিলেন। পুরুষের সফলতা বা কোনো অর্জনে কোনো না কোনো নারীর ভূমিকা থাকেই। একজন পুরুষের জীবনে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের দিকে দৃষ্টপাত করলেই সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। বঙ্গবন্ধু পুরুষদের উদ্দেশে তাই বলেছেন, ‘পুরুষ ভাইরা আমার যখন কোনো রকমের সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান তাদের দিতে হবে।’ শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না। শিক্ষার মাধ্যমেই সত্যিকার উন্নতি সম্ভব। এই মহান নেতা দেশের মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে, উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখতেন। নকল করে শিক্ষিত না হয়ে, বরং প্রকৃত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে শিক্ষিত হওয়ার কথা বলেছেন। তাই ছাত্রদের এবং অভিভাবকদের উদ্দ্যেশে তিনি বলেছেন, ‘ছাত্র ভাইয়েরা লেখাপড়া করেন। আপনাদের লজ্জা না হলেও আমার মাঝেমধ্যে লজ্জা হয় যখন নকলের কথা শুনি।’ অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি খবর পাই বাপ-মা নকল নিয়া ছেলেদের-মেয়েদের এগিয়ে দিয়ে আসে। কত বড় জাতি! উঁহু! জাতি কত নিচু হয়ে গেছে।’ বঙ্গবন্ধু নকলমুক্ত শিক্ষার স্বপ্ন দেখতেন। বঙ্গবন্ধুর দেশে কোনো বেকার থাকুক এটা তিনি কোনোভাবেই মানতে পারতেন না। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে যুবক ভাইদের মুক্ত করার চেষ্টা উনি প্রতিনিয়ত করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’ বাংলার যুবকরা বেকারত্বের হিংস্র থাবায় নিঃশেষ হোক এমনটা জাতির পিতা কখনো চাননি। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বদা দুর্নীতি, চুরি, লুটপাট, অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলেন। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন।

বঙ্গবন্ধু তাই বলেছিলেন, ‘এখনো কিছু সংখ্যক লোক, এত রক্ত যাওয়ার পরেও যে সম্পদ আমি ভিক্ষা করে আনি, বাংলার গরিবকে দিয়ে পাঠাই, তার থেকে কিছু অংশ চুরি করে খায়।... এই চোরের দলকে বাংলার মাটিতে শেষ করতে হবে।’ অত্যন্ত দুঃখজনক এই যে, চুরি ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ আজও আমরা পাইনি। চুরি, দুর্নীতি নামক অপছায়া আজও বাংলার মাটিতে জিইয়ে আছে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনেপ্রাণে তরুণ বাঙালি। অন্যায়ের কাছে তিনি কোনোদিন মাথা নত করেননি। শোষণহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তিনি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি উৎখাত করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন একাধিক বক্তৃতায়। সামাজিক বৈষম্য কমাতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার নির্মূল করতে।

’৭৫- এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতিকে পরিবার পরিজনসহ হত্যা করা হয়। জাতির পিতার হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ঘাতকদের দণ্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন ঘাতক বিভিন্ন দেশে পলাতক আছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে ভারতে আত্মগোপন করা বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি আবদুল মাজেদকে ঢাকার মিরপুর থেকে আটক এবং তার ফাঁসি কার্যকর মুজিববর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার।

জাতির পিতার অসামান্য আত্মত্যাগ আর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমরা দেখেছি আলোর মুখ। মূলত তাঁরই আলোয় আলোকিত বাংলাদেশ।

‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি মহৎ/ তাই তব জীবনের রথ/ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার/ বারম্বার/ তাই/ চিহ্ন তব পড়ে আছে, তুমি হেথা নাই।’ (- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

তিনি নেই ঠিকই, কিন্তু তাঁর আদর্শ, তাঁর চেতনা, তাঁর মহৎ কীর্তি, তাঁর স্বপ্ন বুকে ধারণ করে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, পৃথিবীর বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়েছেন। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অভিহিত করেছিলেন। বাংলাদেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ি নাই। পিতা মুজিবের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, দারিদ্র্যতা দূর করেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল। শেখ হাসিনা সন্ত্রাস এবং জঙ্গি দমনেও সফল। এছাড়া মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, ২০২১ সালের ডেল্টা প্ল্যানের মত মেগা প্ল্যান হাতে নিয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ৪ লেনের মহাসড়ক সর্বোপরি জাতির পিতার প্রদর্শিত পথেই এগিয়ে যাচ্ছে আজকের বাংলাদেশ।

‘সাবাস বাংলাদেশ / এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/ জ্বলে-পুড়ে ছারখার / তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ (- সুকান্ত ভট্টাচার্য)।

জাতির পিতার বাংলাদেশ কারো কাছে মাথা নোয়ায়নি আর নোয়াবেও না।

আজকের তরুণ প্রজন্ম আগামী দিনের কাণ্ডারি হয়ে যে যার অবস্থান থেকে দেশের অগ্রযাত্রায় কাজ করবে। তাই আজ আমরা যারা নতুন প্রজন্ম আছি, তারা সবাই বঙ্গবন্ধুর অদম্য সাহস ও প্রজ্ঞায় অনুপ্রাণিত হয়ে হাজারো বঙ্গবন্ধু হয়ে বাংলার মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবো। আমরা যেন বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের মাধ্যমে জাতিকে উপহার দিতে পারি অর্থনৈতিক মুক্তি, দিতে পারি মানবিক মূল্যবোধের প্রকৃত স্বাধীনতা, নির্মূল করতে পারি জঙ্গিবাদ আর দূর করতে পারি হানাহানি। একই সঙ্গে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে তাঁর সুযোগ্য কন্যাকে সহায়তা করবো। জাতির পিতার জন্মদিনে এই হোক প্রত্যয়, এই হোক অঙ্গীকার।

লেখক: কলামিস্ট


মিঠাপানির মাছ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
খন্দকার হাসানুজ্জামান  

‘মাছে ভাতে বাঙালি’ কথাটি সেই ছোট্টবেলা থেকেই বিভিন্ন গল্প, উপন্যাসের পাতায় কিংবা নাটক, সিনেমায়, অনেক সময় মুরুব্বিদের মুখে মুখে শোনা যেত, যা এখন আর শোনা যায় না, এমনকি নতুন প্রজন্ম এজাতীয় স্লোগানের সঙ্গে অপরিচিত।

আমাদের এই বাংলাদেশে মিঠাপানির মাছের উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়লেও, এর মূল্য নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে।

পূর্বে যখন নদী-নালা, খাল-বিল, হাওরে-বাঁওড়ে, পাওয়া অফুরন্ত মিঠাপানির মাছ ছিল সহজলভ্য, দাম ও ছিল হাতের নাগালের ভিতর এবং পরিমাণে কমবেশি যাহাই হোক বাঙালির প্রতিদিনের পাতে মাছ থাকতই।

সেই সময়ের মাছের আমদানির সঙ্গে মূল্যও ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণের কারণেই নদী থেকে আগের মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নদীদূষণের কারণে মাছের উৎপাদন কমছে। নদীশাসন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে যত্রতত্র বাঁধ দেওয়ার ফলে প্রধান প্রধান নদীর পানি কোনোভাবেই, বিল-হাওর বা প্লাবনভূমিতে প্রবেশ করতে পারছে না।

ফলে মিঠাপানির মাছ উৎপাদন হয়ে পড়ছে দুরূহ এবং মাছের চাহিদা মোটামুটি কৃত্তিম চাষের ওপর নির্ভরশীল।

সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরেই বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। অর্থাৎ প্রতিবছর দেশজ চাহিদার শতভাগ দেশীয় উৎপাদন দিয়ে পূরণ করার সক্ষমতা পেয়েছে সেই সময় থেকে।

মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় দেওয়া তথ্যানুযায়ী দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২.৫ আসে মৎস্য খাত থেকে।

উক্ত মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী ২০০৭-২০০৮ অর্থ বছরে উৎপাদিত মাছের চেয়ে প্রায় ৮৫% শতাংশ বেশি মাছ উৎপাদন হয়েছে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে। এই ১৫ বছরে মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬০ গ্রাম থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৮ গ্রাম।

চাহিদার চেয়ে বেশি মাছ উৎপাদন হলেও রপ্তানির হিসাবে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে নেই।

২০২১-২০২২ অর্থ বছরে বাংলাদেশ প্রায় ৭৪,০০০ হাজার মেট্রিক টন মাছ রপ্তানি করে প্রায় ৫০০০ হাজার কোটি টাকা আয় করে।

২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। এই সময় মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৭০,০০০ মেট্রিক টন এবং আয় হয়েছে ৪৮০০ কোটি টাকার মতো।

এ ছাড়া মিয়ানমার, ভারত, চীন ও থাইল্যান্ড থেকেও বিভিন্ন মাছ আমদানিও করে থাকে বাংলাদেশ। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ ক্রমাগত উন্নতির দিকে থাকলেও বিভিন্ন কারণে, এই উৎপাদনের সুফল সাধারণ মানুষ ও প্রান্তিক মৎস্যচাষিরা ভোগ করতে পারছেন না

ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষের মনোভাব একই রকম ‘ইলিশ বা রুই-কাতলার মতো মাছ কিনতে না পারলেও সিলভারকাপ, তেলাপিয়া, সরপুঁটি বা পাঙ্গাশের মতো অপেক্ষাকৃত কমদামি মাছই ছিল, নিম্ন আয়ের মানুষের’ প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস কিন্তু কালক্রমে সেসব মাছের দামও এখন এই জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

মাছের উৎপাদনের দিক দিয়ে দিনে দিনে উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দাম নিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের হতাশাও বেড়ে চলেছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা FAO-এর দা স্টেট অফ ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুক্ত জলাশয় বা মিঠা পানির মাছ উৎপাদন বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।

বিশ্বে যত মিঠাপানির মাছ উৎপন্ন হয় তার ১১% উৎপাদন করে বাংলাদেশ।

মোট মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বিশ্বে তার পঞ্চম স্থান থেকে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে।

বিশিষ্ট মৎস্য গবেষক সৈয়দ আজিম মন্তব্য করেছেন, মাছের সহজলভ্যতা কিন্তু আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। পাঙাশ, তেলাপিয়া, পাবদা, সরপুঁটি, কইয়ের মতো মাছ বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপকহারে চাষ হচ্ছে ফলে বাজারে এই প্রকার মিঠাপানির মাছ পাওয়াও যায় বেশি। তবে এসব মাছের দামও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তদারকি ও বাজার নিয়ন্ত্রকদের সুদৃষ্টি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম বৃদ্ধি রোধ প্রয়োজন।

বর্তমান সরকারের মৎস্য বিভাগের বিশেষ তদারকিতে মিঠাপানির মাছ চাষে জেলা উপজেলায় মৎস্য কর্মকর্তাদের রয়েছে প্রচুর আগ্রহ ও প্রান্তিকপর্যায়ে মাছ চাষে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও ফলপ্রসূ কর্মসূচি এ সর্বাত্মক সহযোগিতা দেশের সর্বত্র প্রশংসনীয়।


আগুন ও আমাদের সতর্কতা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

গণমাধ্যমকর্মী বৃষ্টি খাতুনের মরদেহ ১১ দিন পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ ডিএনএ প্রফাইলিংয়ের মাধ্যমে। বৃষ্টির পরিচয় নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে পুলিশ তার বাবা সবুজ শেখের কাছে মরদেহটি হস্তান্তর করে। অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই ঘটনাটি ঘটেছে বেইলি রোডে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করা গণমাধ্যমকর্মী বৃষ্টি খাতুনের ক্ষেত্রে আর এ জন্যই আগুন নিয়ে সতর্ক থাকার উদ্দেশ্যে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছি। যাতে আর কোনো সহকর্মীকে হারিয়ে আমাদের যেন আগামীতে ব্যথিত হতে না হয়।

আগুন কী? আগুন হচ্ছে জ্বালানি, অক্সিজেন ও তাপ এই তিনটি প্রজ্বলন উৎসের সমন্বয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত একটি অবিচ্ছিন্ন দহন-প্রক্রিয়া।

আগুনের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এর ফলাফল অধিকাংশ সময়েই সুখকর ও ইতিবাচক, যেমন- রান্নার কাজে আগুনের ব্যবহার। আবার আগুনের ফলাফল নেতিবাচকও হয়ে থাকে, যেমন- বেইলি রোড়ের আগুন, নিমতলী ট্র্যাজেডি ইত্যাদি। তৈরি পোশাক কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও কম নয়, যেমন- সারাকা গার্মেন্টস, তাজরীন ফ্যাশন, গরিব অ্যান্ড গরিব ইত্যাদি অগ্নিদুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল দেশে।

কেন এই ঘটনাগুলো ঘটছে এবং একই রকম দুর্ঘটনার পর আমাদের করণীয় কী, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম মন্তব্য দিচ্ছেন। ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোর সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো জানাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রকম বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের পেছনে মানুষের অসাবধানতা ও অজ্ঞতাকে দায়ী করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এখানকার কর্মকর্তারা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময়ে সারা বিশ্বেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। তবে মানুষ সচেতন হলে এই দেশে এটা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা জোনের সহকারী পরিচালক আগুন লাগার প্রধান কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেন, সেগুলো হলো-

জ্বলন্ত চুলা থেকে

জ্বলন্ত সিগারেট, ম্যাচের কাঠি ও মশার কয়েল থেকে

মোম বা কেরোসিনের খোলা বাতি থেকে

বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে

গ্যাস লিকেজ থেকে

কয়লা বা এ রকম গরম ময়লা-আবর্জনা ও অন্যান্য দাহ্য বস্তু

আগুন নিয়ে খেলা বা রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে।

সচরাচর বাসাবাড়ি ও আবাসিক হোটেলে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটে। এসব স্থানে সাধারণত মানুষের অসাবধানতায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ ছাড়া আগুন লাগলে প্রাথমিক পর্যায়ে কী করতে হবে, সেটাও জানেন না সাধারণ মানুষ।

তিনি আরও বলেন, এখন কেউ সিগারেটের ফিল্টার যত্রতত্র ফেললে আগুন ধরে যেতে পারে। এ ছাড়া গ্যাসের ক্ষেত্রেও এমন হয়। এই মৌসুমে সবকিছু ‍শুষ্ক থাকায় আগুন জ্বলে উঠতে পারে। কিন্তু বর্ষার সময় সেটা হয় না।

আগুন লাগলে করণীয় কী?

কোথাও আগুন লাগলে প্রথমেই আশপাশ থেকে দাহ্য বস্তু সহজেই জ্বলে ওঠার মতো জিনিসপত্র দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে।

আগুনে অক্সিজেনের উৎস বন্ধ করতে হবে।

তেল থেকে আগুন লাগলে পানি দেওয়া যাবে না, সেখানে বালু ছিটিয়ে দিতে হবে।

গ্যাস থেকে আগুন লাগলে দরজা-জানালা খুলে দিতে হবে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে পরে পানি দিয়ে ঠাণ্ডা করতে হবে।

আগে থেকে সতর্ক থাকব যেভাবে-

রান্নার পর চুলার আগুন সম্পূর্ণ নিভিয়ে ফেলতে হবে। গ্যাসের চুলা হলে ফুঁ দিয়ে না নিভিয়ে রান্না শেষ হলে চুলার চাবি ভালো করে বন্ধ করতে হবে।

গ্যাসের চুলা জ্বালানোর আগে অবশ্যই রান্নাঘরের দরজা-জানালা খুলে নিতে হবে।

ভবনে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইশার, হোস পাইপ), দুই বালতি পানি ও বালু মজুত রাখতে হবে।

শিশুদের আগুন নিয়ে খেলা থেকে বিরত রাখতে হবে।

বৈদ্যুতিক মেইন সুইচ নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। বাধাহীনভাবে প্রবেশ করা যায়, এমন স্থানে স্থাপন করা যাবে না। দুর্ঘটনার শুরুতেই মেইন সুইচ বন্ধ করতে হবে।

দাহ্য বস্তু আছে, এমন স্থানে খোলা বাতির ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে হবে। প্রশিক্ষণ নিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তা ব্যবহার করতে হবে।

অভিজ্ঞ ইলেকট্রিশিয়ান দিয়ে নিয়মিত ভবনের বৈদ্যুতিক ক্যাবল (তার) ও ফিটিংস পরীক্ষা করাতে হবে।

অনুমোদিত ডিস্ট্রিবিউটর থেকে মানসম্মত গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের আগে লেবেল ও মেটেরিয়াল সেফটি ডাটাশিট পড়ে নিতে হবে।

খোলা আগুন দিয়ে নয়, সাবানের ফেনা দিয়ে গ্যাস সিলিন্ডারের লিকেজ পরীক্ষা করতে হবে।

প্রতি তিন বছর পরপর সিলিন্ডারের হাইড্রোলিক প্রেসার টেস্ট করা হয়েছে, এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হবে।

এসি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবার চালুর আগে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।

ভবন ঝুঁকিপূর্ণ কি না বুঝব কীভাবে?

কোনো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ কি না, সেটা কীভাবে জানা যাবে, দেখে বোঝার উপায় আছে কি না- জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা জোনের সহকারী পরিচালক বলেন, অগ্নি নিরাপত্তার দিক থেকে কোনো কোনো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে সেটা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা পরিদর্শন করলেই বুঝতে পারেন। তবে ভবন ভেঙে পড়ার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস আগে কিছু বলতে পারে না।

তিনি আরও জানান, ভবন নির্মাণের সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলীরা এ বিষয়ে বলতে পারবেন। বর্তমানে ফায়ার সার্ভিসে এ বিষয়ক কোনো বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী নেই। তবে অগ্নিকাণ্ড বা ভূমিকম্পের মতো ঘটনার ক্ষেত্রে আগে থেকে সতর্কতা নেওয়া যেতে পারে এমন কয়েকটি বিষয় তিনি জানান-

বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে কি না, তা জানতে হবে।

ভবনের ঝুঁকি পরীক্ষা করে সে অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে।

বহুতল ভবনে যদি প্রবেশ ও বের হওয়ার গেট একটা থাকে, তবে সেটা ঝুঁকিপূর্ণ।

বহুতল ভবনে যদি অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম না থাকে সেটাও ঝুঁকিপূর্ণ।

ভবনে বের হওয়ার একাধিক গেট আছে, কিন্তু সেগুলো মালামাল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে, এটাও ঝুঁকিপূর্ণ।

এসব বিষয় নজরে রেখে ভবন নির্মাণ করলে মানুষের জীবনের ঝুঁকি কমে যাবে। এ ছাড়া ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কমে আসবে বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, একটা ভবন বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, এটা খারাপ না ভালো। এটা ঝুঁকিপূর্ণ কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা ছাড়া বোঝার কোনো উপায় নেই। এভিডেন্স দরকার, ক্যালকুলেশন করে দেখাতে হবে যে বিল্ডিংটা ঝুঁকিপূর্ণ।

পুরান ঢাকার মতো ঘিঞ্জি এলাকা খারাপ, এ রকম কথা আন্দাজে বলা হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। পরীক্ষা করা ছাড়া এটা বলা যাবে না বলে অভিমত দেন তিনি। ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা আছে এমন বিশেষজ্ঞরাই কোনো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ কি না বা কোনো অবকাঠামো পরিত্যক্ত ঘোষণা করা যাবে কি না, সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারবেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

সর্বোপরি দেশের সব জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সব প্রকার বাড়িঘর, ঘিঞ্জি এলাকা, বস্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপসনালয়, শিল্প ও গার্মেন্টস কারখানা, হাসপাতাল, বহুতল ভবন, বাণিজ্যিক বহুতল মার্কেট ইত্যাদিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আরও ব্যাপক আকারে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবহার, অগ্নিনির্বাপণ পদ্ধতির মহড়া ও সচেতনতা তৈরিতে ব্যাপক প্রচার ও প্রশাসনের নীতিমালা প্রয়োগ ও সমাজবদ্ধ সর্বস্তরের জনগণের উদার সম্পৃক্ততা এবং প্রিন্ট ও ইলেট্রনিক মিডিয়ার বিশেষ ভূমিকা থাকা দরকার।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।


ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
হীরেন পণ্ডিত

বঙ্গবন্ধুর জন্ম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের চার কন্যা এবং দুই পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবা-মায়ের দেয়া আদুরে নাম খোকা। কিশোর বয়সেই তাঁর প্রতিবাদী চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। তারপর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা, গরিব-দুঃখী মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও তাদের দুঃখ দূর করার প্রতিজ্ঞা তাঁকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। স্কুল থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

বঙ্গবন্ধু পড়াশোনার চেয়ে রাজনীতিই বেশি করেছেন। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পিতা তাঁকে বাধা দেননি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, তাঁর বাবা তাঁকে বলেছিলেন, “বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছো এতো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না”। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখানে মুসলিম লীগের একজন কর্মী হিসেবে তিনি তার অগ্রজদের নজর কাড়েন।

প্রত্যেক দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন নেতা থাকেন যেমন রাশিয়ার (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) লেনিন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাওসেতুং, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ভিয়েতনামের হো-চি মিন, কিউবার ফিদেল কাস্ট্রো, ঘানার পেট্রিস লুমাম্বা ও কওমী নক্রুমা, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর মতো বঙ্গবন্ধুও তাঁর অসামান্য দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের চিরঞ্জীব উদাহরণের জন্য বিশ্ব-ইতিহাসের অনিবার্য ও অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি শুধু বাঙালির বঙ্গবন্ধু নয়, বিশ্ববরেণ্য ও বিশ্বনন্দিত এক রাজনীতিবিদ।

বঙ্গবন্ধু সাহসী এক মহান সংগ্রামী বীর। শত্রুর মুখোমুখি হতে কখনো পিছপা হননি। রাজনৈতিক জীবনে বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন, কিন্তু কখনো আত্মগোপন করেননি। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ২৫ মার্চের সেই ভয়াবহ রাতে বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাননি। দেশ ও মানুষের প্রতি অসীম ভালোবাসা, মানবিকতা ও অসীম সাহসিকতার অসামান্য ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয় করেছিলেন বাংলার ধনী-গরিব, কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের হৃদয়। তাই বঙ্গবন্ধু আমাদের মহান নেতা। তাঁরই নেতৃত্বে স্বাধিকারের জন্য দীর্ঘ ২৩ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি আমরা। তারই আহ্বানে ১৯৭১ সালে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ এদেশের অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। শত্রুর কাছে থেকে ছিনিয়ে এনেছে বিজয়। এনেছে লাল-সবুজের পতাকার স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ তাই এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব তিনি শুধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একজন স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, অনন্য সাধারণ এক ঐক্যের বন্ধনে বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করে হাজার বছরের বাঙালি জাতির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে বহু খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এই বাংলাতে জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু দুর্বার এক উন্মাদনায় কেউ বাঙালিকে জাগাতে পারেননি। তাই বঙ্গবন্ধুকে সবাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি উপাধি দয়েছে, তেমনি তাঁকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করা কোনদিন সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের এক সম্মোহনী শক্তি ও যাদুস্পর্শে বাঙালিদের জাগিয়ে তুলে উদ্দীপ্ত ও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার মন্ত্রে।

১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। এই প্রতিবেদনে তাকে অভিহিত করা হয় 'রাজনীতির কবি' হিসেবে। তবে সেদিন যারা রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন তাদের মতে, সেই জ্বালাময়ী ভাষণ কোনো ভাষণ নয়, বরং একজন দক্ষ, সুনিপুণ কবির ছন্দময় কবিতা। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্য বিতরণ করা হয়েছিল। তবে সেদিন বাংলায় কবির মতো বক্তব্য রাখলেও বঙ্গবন্ধুকে প্রথম ‘রাজনীতির কবি’ এর মতো একটি সুন্দর উপাধিতে ভূষিত করে নিউজউইক ম্যাগাজিন। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ম্যাগাজিনটি তাদের প্রচ্ছদজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দিয়ে লিড নিউজে তাঁকে অভিহিত করে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের জন্যই তাকে এ উপাধি দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাঁর বেশ ক'জন সমালোচক মন্তব্য করেন, শেখ মুজিব তার চরমপন্থি সমর্থকদের কাছে প্রায় নতিস্বীকার করেছেন এবং যে গণজোয়ারে তিনি পরিবেষ্টিত সেই জোয়ারের চূড়ায় তিনি চড়তে চাইছেন। তবে এই নতুন বাঙালি জাতির লড়াইরত নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের আবির্ভাব সারাজীবন ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য তার সংগ্রামেরই যৌক্তিক ফলাফল। শেখ মুজিব যদি জোয়ারের চূড়ায়ও চড়তে চেয়ে থাকেন, তবুও সেখানে তার অবস্থানটা মোটেও আকস্মিক ছিলনা।

১৯১৭ সালে শোষিতের পক্ষে সংঘটিত হয় রুশ বিপ্লব। পৃথিবীর রাজনীতি দ্বিধাবিভক্ত হয় শোষিত আর শোষকের পক্ষে। এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে সূচিত হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা সক্রিয় ধারা। রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু উজ্জীবিত হয়েছিলেন রুশ বিপ্লবের মূলমন্ত্রে-শোষিতের পক্ষে, ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের দেশপ্রেম আলোড়িত করেছিল তাঁকে। একইসঙ্গে গান্ধী-নেহেরুর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন তাকে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি অন্তরে গভীরভাবে গ্রহণ করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ। নেতাজি সুভাষ বসুর স্বদেশি আন্দোলন তরুণ শেখ মুজিব উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন প্রবলভাবে।

বঙ্গবন্ধু আত্মপরিচয়, আপন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, অবিভক্ত ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে ধারণ করেছিলেন হৃদয়ের গভীরে। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, সিপাহি বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, গারো-হাজং বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহসহ অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সব আন্দোলন-সংগ্রামকে অন্তরে ধারণ করেন। অবিভক্ত ভারতে শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও দারিদ্র্য থেকে বাংলার দুঃখী মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষায় তিনি যুক্ত হন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। বরাবরই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। সে কারণেই তিনি যুক্ত হন গান্ধী-জিন্নাহ-নেহেরুর ব্রিটিশবিরোধী নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে। শোষিত, বঞ্চিত, দরিদ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর মুক্তির আকাক্সক্ষায় তখন সমর্থন দেন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। কিন্তু ১৯৪৭-এর পর যখন মাতৃভাষা বাংলার ওপর আঘাত এলে, মুখোশ উন্মোচিত হয় পাকিস্তানি শাসকদের, বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদে সোচ্চার হন, যুক্ত হন রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনে।

১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠকে মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অভিমত ব্যক্ত করে, তখন কুমিল্লার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো মুসলিম লীগ সদস্য কিংবা পূর্ব বাংলার কোনো মুসলিম লীগ সদস্যই তার প্রস্তাব সমর্থন করেননি। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের পর ক্রমেই এ দেশের মানুষও সংগঠিত হয় স্বাধিকার ও জাতীয়তাবাদের চেতনায়। আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে থাকে শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। শাসনতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন সবই সেই সংগ্রামের মাইলফলক। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ে এসব আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পরীক্ষিত বঙ্গবন্ধু কী করে সবার প্রিয় নেতা হয়ে উঠেন, সে ইতিহাস সবারই জানা। ঊনসত্তর সালের প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করে সামরিক বাহিনীর এক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করেন।

তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন ১৯৫৮ সালে। ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচন দেওয়ার ঘোষণা দিলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন নির্বাচনী হাওয়ায় সরগরম হয়ে ওঠে। ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী স্বতন্ত্রসহ পাকিস্তানের অন্যান্য নয়টি দল পেয়েছিল অবশিষ্ট ১৪০টি আসন। নির্বাচনে ১৬০টি আসনে জয়ী হওয়া ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের জন্য সংরক্ষিত নয়টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭টি আসন। সর্বমোট আসন সংখ্যা ছিল ১৬৭। সাধারণ নির্বাচনের পাশাপাশি অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনের ৩০০ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৮৮টি আসন। অর্জিত হয় বাঙালির বিপুল বিজয়। ভূমিধ্বস বিজয় বা ল্যান্ড স্লাইড ভিক্টরি যাকে বলে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নানা টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করছিল।

এলো একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ! মার্চ মাসের শুরু থেকেই সারা দেশ অসহযোগ আন্দোলন, বিক্ষোভ-সংগ্রামে টালমাটাল। রাজনীতির কবি প্রতিদিন রচনা করছিলেন বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের নতুন নতুন নতুন অধ্যায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করলে সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকা হয়ে ওঠে, প্রতিবাদে, ক্ষোভে উত্তাল মিছিলের শহর। একাত্তরের ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অকস্মাৎ ঢাকায় এলেন। ইতোমধ্যে ৭ মার্চে রেসকোর্সের জনসভায় রাজনীতির অকুতোভয় কবি বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। স্বাধীনতার অমোঘ আহ্বান। ভাষণ নয়, যেন বাংলার মানুষের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার এক অনন্য কবিতা যে কবিতা পাঠ করলেন কবি ১৯ মিনিট ধরে অত্যন্ত প্রতীকী স্টাইলে। ঢাকায় এসে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে আলোচনার নামে সাজানো নাটকের অন্তরালে করলেন গভীর গোপন ষড়যন্ত্র। ১৬-২৪ মার্চ পযন্ত মুজিব-ইয়াহিয়া বেশক’টি বৈঠক চলার পর আলোচনা অমীমাংসিত রেখেই কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ ঢাকা ত্যাগ করেন ইয়াহিয়া।

আর ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পরিকল্পিত নীলনকশা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী শুরু করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংস গণহত্যা। ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর রাতের গভীরে চালায় অতর্কিত হামলা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পূর্বপ্রস্তুতি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টের (ইপিআর) ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেন থেকে গোপন ট্রান্সমিটার সেটের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তা পাঠান। সেই রাতে বঙ্গবন্ধু তার সব সহকর্মী নেতাকে নিরাপদ অবস্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন; কিন্তু তিনি থেকে যান ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজ বাড়িতেই। গ্রেফতার বরণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। এসব ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যত ষড়যন্ত্র, অপচেষ্টাই হোক না কেন, তাকে কখনো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। তিনি ছিলেন আমাদের অবিসংবাদিত নেতা, রাজনীতির এক অকুতোভয় কবি।

কবি কল্পনা করেন, ভাবেন, স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের প্রতিরূপ ‘কবিতা’। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছেন রাজনীতি নিয়ে, সেই স্বপ্ন ছিল একটি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দেয়ার। কবিদের মতোই বঙ্গবন্ধু রূপ দিয়েছেন তাঁর স্বপ্নের। লিখলেন পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে এই জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দেয়ার স্বপ্নের সে প্রতিরূপ, সে কবিতা।

বঙ্গবন্ধুর সে কবিতাই হয়ে উঠলো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। রাজনীতির এই কবিকে নিয়ে নানা দেশ এবং বিদেশের নানা লেখক, কবি লিখলেন গল্প, গান, কবিতা, নাটক। নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের খুব কম রাষ্ট্রনায়ক ও রূপকারকে নিয়ে এত অধিক সংখ্যক কবিতা লেখা হয়েছে। অগ্রজ কবিদের লেখনী থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমকালীন কবিরা যেমন লিখছেন, আগামী দিনের কবিরাও তেমন বঙ্গবন্ধুকে তাদের কবিতায় চিত্রিত করবেন নানাভাবে নানারঙে। যতকাল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থাকবে, ততকাল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত হবে কোনো না কোনো কবিতা, গল্প, উপন্যাস।

বঙ্গবন্ধু রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে ‘থালা বাটি কম্বল-জেলখানার সম্বল’ লেখা থেকে বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ রচনাসমূহ যে কত গভীর ও বিশাল কবিতার প্রতীক, উপমা ও কালের ক্যানভাস সমৃদ্ধ তা সহজেই অনুমেয়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘ জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই- তারা জানে না জেল কি জিনিস। আমি অনেকবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছি। রাজবন্দী হিসেবে জেল খেটেছি, সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খাটতে হয়েছে। তাই সকল রকম কয়েদির অবস্থা নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি।’ এমন চমৎকার ভাষায় কাব্যিক উচ্চারণে বন্দী জীবনকে চিত্রিত করার এত সহজ-সরল ভঙ্গিমা ক’জন মহান কবি ইতিহাসে উপস্থাপন করতে পেরেছেন তা সকলের অজানা।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট


ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
হীরেন পণ্ডিত

বঙ্গবন্ধুর জন্ম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের চার কন্যা এবং দুই পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবা-মায়ের দেয়া আদুরে নাম খোকা। কিশোর বয়সেই তাঁর প্রতিবাদী চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। তারপর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা, গরিব-দুঃখী মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও তাদের দুঃখ দূর করার প্রতিজ্ঞা তাঁকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। স্কুল থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

বঙ্গবন্ধু পড়াশোনার চেয়ে রাজনীতিই বেশি করেছেন। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পিতা তাঁকে বাধা দেননি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, তাঁর বাবা তাঁকে বলেছিলেন, “বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছো এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না”। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখানে মুসলিম লীগের একজন কর্মী হিসেবে তিনি তার অগ্রজদের নজর কাড়েন।

প্রত্যেক দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন নেতা থাকেন যেমন রাশিয়ার (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) লেনিন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সে তুং, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ভিয়েতনামের হো-চি মিন, কিউবার ফিদেল কাস্ট্রো, ঘানার পেট্রিস লুমাম্বা ও কওমী নক্রুমা, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর মতো বঙ্গবন্ধুও তাঁর অসামান্য দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের চিরঞ্জীব উদাহরণের জন্য বিশ্ব-ইতিহাসের অনিবার্য ও অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি শুধু বাঙালির বঙ্গবন্ধু নন, বিশ্ববরেণ্য ও বিশ্বনন্দিত এক রাজনীতিবিদ।

বঙ্গবন্ধু সাহসী এক মহান সংগ্রামী বীর। শত্রুর মুখোমুখি হতে কখনো পিছপা হননি। রাজনৈতিক জীবনে বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন, কিন্তু কখনো আত্মগোপন করেননি। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ২৫ মার্চের সেই ভয়াবহ রাতে বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাননি। দেশ ও মানুষের প্রতি অসীম ভালোবাসা, মানবিকতা ও অসীম সাহসিকতার অসামান্য ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয় করেছিলেন বাংলার ধনী-গরিব, কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের হৃদয়। তাই বঙ্গবন্ধু আমাদের মহান নেতা। তাঁরই নেতৃত্বে স্বাধিকারের জন্য দীর্ঘ ২৩ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি আমরা। তারই আহ্বানে ১৯৭১ সালে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ এদেশের অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। শত্রুর কাছে থেকে ছিনিয়ে এনেছে বিজয়। এনেছে লাল-সবুজের পতাকার স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ তাই এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব তিনি শুধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একজন স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, অনন্য সাধারণ এক ঐক্যের বন্ধনে বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করে হাজার বছরের বাঙালি জাতির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে বহু খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এই বাংলাতে জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু দুর্বার এক উন্মাদনায় কেউ বাঙালিকে জাগাতে পারেননি। তাই বঙ্গবন্ধুকে সবাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি উপাধি দিয়েছে, তেমনি তাঁকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করা কোনদিন সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের এক সম্মোহনী শক্তি ও যাদুস্পর্শে বাঙালিদের জাগিয়ে তুলে উদ্দীপ্ত ও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার মন্ত্রে।

১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। এই প্রতিবেদনে তাকে অভিহিত করা হয় ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। তবে সেদিন যারা রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন তাদের মতে, সেই জ্বালাময়ী ভাষণ কোনো ভাষণ নয়, বরং একজন দক্ষ, সুনিপুণ কবির ছন্দময় কবিতা। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্য বিতরণ করা হয়েছিল। তবে সেদিন বাংলায় কবির মতো বক্তব্য রাখলেও বঙ্গবন্ধুকে প্রথম ‘রাজনীতির কবি’ এর মতো একটি সুন্দর উপাধিতে ভূষিত করে নিউজউইক ম্যাগাজিন। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ম্যাগাজিনটি তাদের প্রচ্ছদজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দিয়ে লিড নিউজে তাঁকে অভিহিত করে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের জন্যই তাকে এ উপাধি দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাঁর বেশ কজন সমালোচক মন্তব্য করেন, শেখ মুজিব তার চরমপন্থি সমর্থকদের কাছে প্রায় নতিস্বীকার করেছেন এবং যে গণজোয়ারে তিনি পরিবেষ্টিত সেই জোয়ারের চূড়ায় তিনি চড়তে চাইছেন। তবে এই নতুন বাঙালি জাতির লড়াইরত নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের আবির্ভাব সারাজীবন ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য তার সংগ্রামেরই যৌক্তিক ফলাফল। শেখ মুজিব যদি জোয়ারের চূড়ায়ও চড়তে চেয়ে থাকেন, তবুও সেখানে তার অবস্থানটা মোটেও আকস্মিক ছিল না।

১৯১৭ সালে শোষিতের পক্ষে সংঘটিত হয় রুশ বিপ্লব। পৃথিবীর রাজনীতি দ্বিধাবিভক্ত হয় শোষিত আর শোষকের পক্ষে। এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে সূচিত হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা সক্রিয় ধারা। রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু উজ্জীবিত হয়েছিলেন রুশ বিপ্লবের মূলমন্ত্রে-শোষিতের পক্ষে, ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের দেশপ্রেম আলোড়িত করেছিল তাঁকে। একইসঙ্গে গান্ধী-নেহেরুর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন তাকে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি অন্তরে গভীরভাবে গ্রহণ করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ। নেতাজি সুভাষ বসুর স্বদেশি আন্দোলন তরুণ শেখ মুজিব উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন প্রবলভাবে।

বঙ্গবন্ধু আত্মপরিচয়, আপন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, অবিভক্ত ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে ধারণ করেছিলেন হৃদয়ের গভীরে। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, সিপাহি বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, গারো-হাজং বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহসহ অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সব আন্দোলন-সংগ্রামকে অন্তরে ধারণ করেন। অবিভক্ত ভারতে শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও দারিদ্র্য থেকে বাংলার দুঃখী মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় তিনি যুক্ত হন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। বরাবরই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। সে কারণেই তিনি যুক্ত হন গান্ধী-জিন্নাহ-নেহেরুর ব্রিটিশবিরোধী নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে। শোষিত, বঞ্চিত, দরিদ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর মুক্তির আকাক্সক্ষায় তখন সমর্থন দেন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। কিন্তু ১৯৪৭-এর পর যখন মাতৃভাষা বাংলার ওপর আঘাত এলে, মুখোশ উন্মোচিত হয় পাকিস্তানি শাসকদের, বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদে সোচ্চার হন, যুক্ত হন রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনে।

১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠকে মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অভিমত ব্যক্ত করে, তখন কুমিল্লার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো মুসলিম লীগ সদস্য কিংবা পূর্ব বাংলার কোনো মুসলিম লীগ সদস্যই তার প্রস্তাব সমর্থন করেননি। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের পর ক্রমেই এ দেশের মানুষও সংগঠিত হয় স্বাধিকার ও জাতীয়তাবাদের চেতনায়। আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে থাকে শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। শাসনতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন সবই সেই সংগ্রামের মাইলফলক। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ে এসব আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পরীক্ষিত বঙ্গবন্ধু কী করে সবার প্রিয় নেতা হয়ে ওঠেন, সে ইতিহাস সবারই জানা। ঊনসত্তর সালের প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করে সামরিক বাহিনীর এক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করেন।

তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন ১৯৫৮ সালে। ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচন দেওয়ার ঘোষণা দিলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন নির্বাচনী হাওয়ায় সরগরম হয়ে ওঠে। ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী স্বতন্ত্রসহ পাকিস্তানের অন্যান্য নয়টি দল পেয়েছিল অবশিষ্ট ১৪০টি আসন। নির্বাচনে ১৬০টি আসনে জয়ী হওয়া ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের জন্য সংরক্ষিত নয়টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭টি আসন। সর্বমোট আসন সংখ্যা ছিল ১৬৭। সাধারণ নির্বাচনের পাশাপাশি অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনের ৩০০ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৮৮টি আসন। অর্জিত হয় বাঙালির বিপুল বিজয়। ভূমিধ্বস বিজয় বা ল্যান্ড স্লাইড ভিক্টরি যাকে বলে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নানা টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করছিল।

এল একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ! মার্চ মাসের শুরু থেকেই সারা দেশ অসহযোগ আন্দোলন, বিক্ষোভ-সংগ্রামে টালমাটাল। রাজনীতির কবি প্রতিদিন রচনা করছিলেন বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের নতুন নতুন নতুন অধ্যায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করলে সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকা হয়ে ওঠে, প্রতিবাদে, ক্ষোভে উত্তাল মিছিলের শহর। একাত্তরের ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অকস্মাৎ ঢাকায় এলেন। ইতোমধ্যে ৭ মার্চে রেসকোর্সের জনসভায় রাজনীতির অকুতোভয় কবি বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। স্বাধীনতার অমোঘ আহ্বান। ভাষণ নয়, যেন বাংলার মানুষের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার এক অনন্য কবিতা যে কবিতা পাঠ করলেন কবি ১৯ মিনিট ধরে অত্যন্ত প্রতীকী স্টাইলে। ঢাকায় এসে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে আলোচনার নামে সাজানো নাটকের অন্তরালে করলেন গভীর গোপন ষড়যন্ত্র। ১৬-২৪ মার্চ পযন্ত মুজিব-ইয়াহিয়া বেশক’টি বৈঠক চলার পর আলোচনা অমীমাংসিত রেখেই কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ ঢাকা ত্যাগ করেন ইয়াহিয়া।

আর ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পরিকল্পিত নীলনকশা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী শুরু করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংস গণহত্যা। ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর রাতের গভীরে চালায় অতর্কিত হামলা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পূর্বপ্রস্তুতি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টের (ইপিআর) ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেন থেকে গোপন ট্রান্সমিটার সেটের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তা পাঠান। সেই রাতে বঙ্গবন্ধু তার সব সহকর্মী নেতাকে নিরাপদ অবস্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন; কিন্তু তিনি থেকে যান ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজ বাড়িতেই। গ্রেফতার বরণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। এসব ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যত ষড়যন্ত্র, অপচেষ্টাই হোক না কেন, তাকে কখনো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। তিনি ছিলেন আমাদের অবিসংবাদিত নেতা, রাজনীতির এক অকুতোভয় কবি।

কবি কল্পনা করেন, ভাবেন, স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের প্রতিরূপ ‘কবিতা’। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছেন রাজনীতি নিয়ে, সেই স্বপ্ন ছিল একটি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দেয়ার। কবিদের মতোই বঙ্গবন্ধু রূপ দিয়েছেন তাঁর স্বপ্নের। লিখলেন পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে এই জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দেয়ার স্বপ্নের সে প্রতিরূপ, সে কবিতা। বঙ্গবন্ধুর সে কবিতাই হয়ে উঠল আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। রাজনীতির এই কবিকে নিয়ে নানা দেশ এবং বিদেশের নানা লেখক, কবি লিখলেন গল্প, গান, কবিতা, নাটক। নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের খুব কম রাষ্ট্রনায়ক ও রূপকারকে নিয়ে এত অধিক সংখ্যক কবিতা লেখা হয়েছে। অগ্রজ কবিদের লেখনী থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমকালীন কবিরা যেমন লিখছেন, আগামী দিনের কবিরাও তেমন বঙ্গবন্ধুকে তাদের কবিতায় চিত্রিত করবেন নানাভাবে নানারঙে। যতকাল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থাকবে, ততকাল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত হবে কোনো না কোনো কবিতা, গল্প, উপন্যাস।

বঙ্গবন্ধু রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে ‘থালা বাটি কম্বল-জেলখানার সম্বল’ লেখা থেকে বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ রচনাসমূহ যে কত গভীর ও বিশাল কবিতার প্রতীক, উপমা ও কালের ক্যানভাস সমৃদ্ধ তা সহজেই অনুমেয়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই- তারা জানে না জেল কী জিনিস। আমি অনেকবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছি। রাজবন্দী হিসেবে জেল খেটেছি, সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খাটতে হয়েছে। তাই সকল রকম কয়েদির অবস্থা নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি।’ এমন চমৎকার ভাষায় কাব্যিক উচ্চারণে বন্দী জীবনকে চিত্রিত করার এত সহজ-সরল ভঙ্গিমা ক’জন মহান কবি ইতিহাসে উপস্থাপন করতে পেরেছেন তা সকলের অজানা।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট


প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো দরকার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
শফিকুল ইসলাম

দেশের জীবন আর প্রবাসজীবনে একটা বড় পার্থক্য আছে। দেশে পরিচিত পরিবেশে কাজ আর প্রবাসে অপরিচিত দেশে কাজ অনেক ব্যবধান। একেবারে মননশীল হয়ে কাজ করতে হয় প্রবাসে। না হলে রুটি-রোজগার মেলে না। চরম বাস্তবতায় কঠিন পরিশ্রম করে কাজ শিখে নিতে হয়। দিন দিন দক্ষতা বাড়াতে হয়। কাজে সফলতা দেখাতে হয়। ধীরে ধীরে স্ব স্ব কর্মে দক্ষ হয়ে ওঠে। প্রবাসে যারা পড়াশোনা করে তারাও অধ্যবসায় সাধন করে নিজেকে একটা ভালো অবস্থানে দাঁড় করায়। এ জন্য দেখা যায় যারা বিদেশে পড়াশোনা করেছে তাদের গোড়া শক্ত। কর্মক্ষেত্রে বেশি দক্ষতা দেখাতে পারে তারা।

দেশে এখন প্রবাসীর সংখ্যা ১ কোটি ৬০ লাখ প্রায়। যদিও এ তথ্যের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র, বিএমইটির তথ্য এবং প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের তথ্যের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা অবসর নিয়ে দেশে আসে অথবা চুক্তির মেয়াদ শেষ করে ১০ বছর, ১৫ বছরে দেশে আসে তখন তারা পরিপূর্ণ দক্ষ হয়ে দেশে আসে।

আমরা দেখতে পাই, যে লোকটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে আসে তার চাল-চলন এবং কথা-বার্তায় মার্জিত স্বভাব। পরিবারের প্রতিটি লোককে কাজে লাগাতে উৎসাহ দেয়। কেউ যেন অন্যের উপার্জনের ওপর নির্ভর করতে না হয় সেই চেস্টা করেন। তিনি বাস্তবে দেখে এসেছেন পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। কখনো কখনো দেখা যায় তার কর্ম অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেন; কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে সফলতার মুখ দেখতে পান না।

আবার কখনো কখনো দেখা যায়, উৎপাদশীল কাজে দক্ষতা নিয়ে দেশে এসে বেকার বসে আছে। অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারছেন না। উদ্যোক্তার অভাব, পুঁজির অভাব, পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছেন না। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের দক্ষতা কাজে লাগাতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কিছু আর্থিক উদ্যোগ সরকারের আছে। ব্যাংক থেকে লোন দেয়। এটা পর্যাপ্ত নয়। তাদের সর্বদিকে সাপোর্ট দিতে হবে। যে প্রকল্প হাতে নেয় সেটা যেন বাস্তবায়ন করতে পারে এ জন্য সরকারের দায়িত্বরত টিম তদারকি করতে হবে। দেশকে উন্নত করতে হলে সবার সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়।

যারা গবেষণা করে বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তাদের দেশের কাজে লাগাতে হবে। আমাদের দেশের মানুষকে দক্ষ করতে এসব প্রবাসীদের দক্ষতা অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে।

নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত প্রবাসীদের সাফল্য গাঁথা তুলে ধরতে হবে। প্রবাসে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যারা দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায় তাদের উদ্বুদ্ধ করতে এমন উদ্যোগ দরকার।

ব্যবসা-বাণিজ্যের বিনিয়োগে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশিরা। প্রবাসীরা বিভিন্ন দেশে গড়ে তুলেছেন হাইপার মার্কেট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, স্বর্ণের দোকান, মোবাইল দোকান, সেলুন, সুপার মার্কেট, পারফিউমস ফ্যাক্টরি, রিয়েল এস্টেট, মুদি দোকান, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, রেডিমেড গার্মেন্টস ট্রেডিং, বোরকার দোকান, অ্যামব্রয়ডারি, স্টিল ওয়ার্কশপ, গ্যারেজ, প্রিন্টিং প্রেসসহ ছোট-বড় নানা রকম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এগুলো কর্মদক্ষতা ও সততায় বেশ সুনাম ও সাফল্যের সঙ্গে তারা পরিচালনা করে যাচ্ছেন বাংলাদেশি প্রবাসী ব্যবসায়ীরা।

এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আমিরাতে প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যে ব্যবসায়ী রয়েছেন প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজারের মতো। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা আরও অন্তত লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। ক্রমান্বয়ে প্রচুরসংখ্যক বাংলাদেশি নিয়োগ করেছেন তারা। প্রবাসীরা ব্যবসা বাণিজ্যের পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

সরকারের পক্ষ থেকে সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে আগামীতে বড় ধরনের বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের রেমিট্যান্সপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে প্রবাসীবান্ধব কর্মসূচি নিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও সমাজকর্মী


banner close