শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির

তোফায়েল আহমেদ।
দৈনিক বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত
দৈনিক বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১০:২৪

তোফায়েল আহমেদ

বাংলার গণমানুষের নন্দিতনেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেশের মানুষ দীর্ঘায়ু কামনা করে দোয়া ও আশীর্বাদ করছেন। তিনি আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ চার দশক নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে জেল-জুলুম ও মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে জনগণের রায় নিয়ে চারবার সরকারে অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় বিশ্বাসঘাতকের হস্তে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হন। ওই সময় তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান। ’৮১-এর ১৭ মে নির্বাসন শেষে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। যেদিন প্রিয়নেত্রী স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন সেদিন শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না, ছিল সর্বব্যাপী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ। স্বৈরশাসনের অন্ধকারে নিমজ্জিত স্বদেশে তিনি হয়ে ওঠেন আলোকবর্তিকা, অন্ধকারের অমানিশা দূর করে আলোর পথযাত্রী।

’৭৫-এর পর আওয়ামী লীগ যখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল, তখন তিনি দলের হাল ধরেন। ’৮১-এর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিলে আমরা জীবন-পণ চেষ্টা করে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে আওয়ামী লীগের ঐক্য ধরে রেখে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপর দলের নেতৃত্বভার অর্পণ করে তার হাতেই তুলে দিয়েছিলাম দলের রক্তভেজা সংগ্রামী পতাকা। কাউন্সিলে অনেক আলাপ-আলোচনার পর জাতীয় ও দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের বৃহত্তর ও মহত্তর প্রয়োজনে তার আগমন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ। নেতৃত্ব গ্রহণের পর তাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই তিনি রাজনীতি করছেন। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতেই দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রস্তাবে শহীদের রক্তে ভেজা দলীয় ও জাতীয় পতাকা স্বহস্তে তুলে নিয়ে প্রমাণ করেছেন সেদিনের কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত আমাদের সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল। এরপর শত-সহস্র আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত। স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও সফলভাবে কাউন্সিল অধিবেশন করার মাধ্যমে কায়েমি স্বার্থবাদীদের চক্রান্ত আমরা ব্যর্থ করেছিলাম। কাউন্সিলের সার্বিক সাফল্য কামনা করে শেখ হাসিনা এক বার্তায় বলেছিলেন, ‘আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে এগিয়ে যান’। বার্তাটি সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক অধিবেশনে পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। দলের শীর্ষ পদ গ্রহণে তার সম্মতিসূচক মনোভাব সম্পর্কে কাউন্সিলরদের উদ্দেশে বলেছিলাম, ‘আমরা সকলেই একটি সুসংবাদের অপেক্ষায় আছি।’ শেখ হাসিনা তার বার্তায় সর্বপ্রকার দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে ‘আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির’ মাধ্যমে কাউন্সিলর ও নেতাদের বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি সোনার বাংলা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ’৮১-এর ১৭ মে দেশে ফেরার আগে স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার নির্দেশে ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি’ গঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের এ ব্যাপারে সতর্ক ও সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছিলাম আমরা। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে গণবিরোধী স্বৈরশাসকের ভিত কেঁপে উঠেছিল।

’৮১তে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর সামরিক শাসনবিরোধী গণআন্দোলন সংগঠিত করেন। সামরিক শাসকের নির্দেশে ’৮৩-এর ফেব্রুয়ারিতে তাকেসহ আমাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সামরিক গোয়েন্দারা চোখ বেঁধে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় এবং বিনা কারণে একটানা ১৫ দিন আমাদের আটক রাখা হয়। ’৮৪-এর ফেব্রুয়ারি ও নভেম্বরে নেত্রীকে পুনরায় গৃহবন্দি করা হয়। ’৮৫-এর মার্চে তাকে ৩ মাস এবং আমাকে ৬ মাস বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকা সত্ত্বেও ’৮৬-এর ১০ নভেম্বর তিনি যখন সচিবালয় অবরোধ কর্মসূচির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তখন পুলিশ তাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গাড়িতে উপবিষ্ট থাকা অবস্থায় তার গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং পরদিন ১১ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে ১ মাসের আটকাদেশ দেয়া হয়। ’৮৮-এর ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে তার গাড়িবহরে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন বঙ্গবন্ধু কন্যাকে রক্ষায় বহু নেতা-কর্মী প্রাণ বিসর্জন দেন। ’৯০-এর ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়; প্রবল গণরোষের ভয়ে সামরিক সরকার ঐ দিনই তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর ’৯১-এর ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করলে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ’৯৪-এ তার আহ্বানে ট্রেনমার্চের সময় ঈশ্বরদী রেল স্টেশনের উত্তরপ্রান্তে বন্দুকধারীরা তার কামরা লক্ষ্য করে গুলি করে। সেদিনও তিনি সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পর ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন ও নিউইয়র্ক টাইমসের ১৪-১৫ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি থামব না, এসব ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন করতেই হবে। আমি নিজের জীবনের জন্য ভীত হয়ে পড়লে গোটা জাতি ভীত হয়ে পড়বে। আমি জানি, কিছু বুলেট আমায় তাড়া করছে।’ ঘাতকের সর্বশেষ নিষ্ঠুর আঘাত এসেছিল ২০০৪-এর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে। সেদিন প্রিয়নেত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও জীবন দিতে হয়েছে আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা-কর্মীকে। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সর্বমোট ২১ বার হামলা হয়েছে। অকুতোভয় শেখ হাসিনার বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর মতোই অসীম সাহসী, চিত্ত তার ভয়শূন্য!

তার নেতৃত্বে একটানা বহু বছর দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (তখন একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল) হিসেবে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে কাছ থেকে তাকে দেখেছি। যখন তার কাছে বসে ক্যাবিনেট মিটিং বা সভা-সফর করেছি, তখন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা-ই পালন করতেন; একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে তার সঙ্গে আপস করতেন না এবং ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও মাথা নত করতেন না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও জাতির পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সেই আদর্শ অর্জন করেছেন। তিনিও লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করেন এবং সেই লক্ষ্য পূরণে থাকেন অবিচল। ’৮৬তে তিনি প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেন এবং বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে জাতীয় সংসদে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। ’৯১-তেও বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। মাগুরার একটি উপনির্বাচনে বিএনপি যখন পরাজিত হতে চায়নি এবং জোর করে ভোট ডাকাতি করেছিল তখন বাধ্য হয়ে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে বিজয়ী হয়ে ’৯৬-এ গণরায় নিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছিলাম। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েই তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন। ’৯৬তে ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ প্রশস্ত করেছেন। ২০০১-এ ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া সেই বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। আবার ২০০৮-এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে ২০০৯-এ সরকার গঠন করে সেই বিচারের কাজ শেষ করে আদালতের রায় বাস্তবায়নের পথ করে দেন। বাংলার মাটিতে খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। যেখানে বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছিলেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাংলার মানুষকে কলঙ্কমুক্ত করে চলেছেন।

২০০৮-এর নির্বাচনে রূপকল্প-২০২১-এ ঘোষিত হয়েছিল বাংলাদেশ হবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এবং ‘মধ্যম আয়ের দেশ’। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তব। ২০০৯ থেকে এই ১৩ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে বাংলাদেশের। ‘বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে আমরা ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হয়েছি। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের লাইসেন্স প্রাপ্তির মাধ্যমে ‘নিউক্লিয়ার নেশন’ হিসেবে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব পরমাণু ক্লাবের সদস্য। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করার পরে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ; পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন; বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫,২৩৫ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ; করোনা অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার ও রপ্তানি আয় ৫২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। এ ছাড়া পায়রাবন্দর, গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনসহ বহু উন্নয়নমূলক কাজ এখন সমাপ্তির দিকে। অতিমারি ও যুদ্ধ না হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়াত। ২০২০-২১ অর্থবছরে জনগণের মাথাপিছু আয় ২,৫৯১ ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমরা স্বল্পন্নোত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হয়েছি।

২০২০-এ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ এবং ২০২১-এ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সারা দেশে সগৌরবে পালিত হয়েছে। এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে। জাতির পিতা দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। এক. বাংলাদেশের স্বাধীনতা, দুই. অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেননি। সেই কাজটি নিষ্ঠা, দক্ষতা ও সততার সঙ্গে শেখ হাসিনা করে চলেছেন। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে, শিল্প ও কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে, নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত গ্রামগুলো শহরে রূপান্তরিত হচ্ছে। একদা যারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি’, আজ তারাই বলে, ‘বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের’। ’৭৩-এ আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর মহান ব্রতে সেই কথা বারবার প্রমাণ করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে জাতিসংঘে বলেছিলেন, ‘আমি বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস করে সে অর্থ দিয়ে দরিদ্র দেশের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। বর্তমানে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় করা বিপুল অর্থের এক-দশমাংশও যদি জনগণের জন্য খরচ করা হয় তবে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য মুছে যাবে এবং তাতে বৃহৎ শক্তিবর্গেরও মর্যাদাই বৃদ্ধি পাবে।’ বঙ্গবন্ধুকন্যাও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাতির পিতার আদর্শের প্রতিধ্বনি করে শান্তি ও নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন।

প্রিয় মাতৃভূমির স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে শেখ হাসিনার অঙ্গীকার, ‘৫০ বছরের গ্যাসের মজুত না রেখে আমি গ্যাস রপ্তানি করব না।’ সেই অঙ্গীকার তিনি সমুন্নত রেখেছেন এবং দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে শক্তিশালী করেছেন। ’৯৬-এ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভের পর ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি’, ‘গঙ্গার পানি চুক্তি’ করেছেন। চুক্তি অনুযায়ী পাওয়ার কথা ৩৪ হাজার কিউসেক, অথচ তারই দক্ষতায় শুষ্ক মৌসুমে ৬৪ হাজার কিউসেক পানি পাওয়া গেছে। ’৯৮-এর বন্যায় ভিজিএফ কার্ড প্রবর্তনের মাধ্যমে বন্যার্ত ৩ কোটি মানুষকে নিরবচ্ছিন্নভাবে খাদ্য সরবরাহ করেছেন। ’৯৬-এ তিনি যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে তখন দেশের খাদ্য ঘাটতি ছিল ৪০ লাখ মেট্রিক টন। সেই খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে বাংলাদেশ খাদ্য রপ্তানিকারক দেশে উন্নীত হয়েছে। ধান, গম ও ভুট্টার ফলনে বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে অগ্রসরমাণ বাংলাদেশ। বর্তমান বিশ্বে প্রতি হেক্টর জমিতে গড় উৎপাদন প্রায় ৩ টন আর বাংলাদেশে তা ৪.১৫ টন। ২০১৪-এর ৭ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কো প্রধান ইরিনা বোকোভা শেখ হাসিনার হাতে ‘শান্তিবৃক্ষ’ পদক তুলে দেয়ার সময় বলেছিলেন, ‘সাহসী নারী শেখ হাসিনা সারা পৃথিবীকে পথ দেখাচ্ছেন।’ দারিদ্র্য বিমোচন, শান্তি স্থাপন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, সুশাসন, মানবাধিকার রক্ষা, আঞ্চলিক শান্তি, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নারী ও শিশুমৃত্যুর হার কমানো এবং ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাফল্যে প্রশংসনীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এ পর্যন্ত বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বিশ্বের খ্যাতনামা বিভিন্ন বিদ্যাপীঠ তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। ২০১৫-এর ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭০তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ প্রদান করা হয় তাকে। নির্যাতিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সারা বিশ্বে তিনি ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধিতে পরিচিত হয়েছেন।

তিনি নিয়মিত পড়াশোনা করেন। ক্যাবিনেট মিটিংগুলোতে যথাযথ হোমওয়ার্ক করে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে আসেন। যখন একটি বিষয় প্রস্তাব আকারে পেশ করা হয়, তখন সেই বিষয়ের খুঁটিনাটি সমস্ত বিষয় তিনি সভায় সবিস্তারে তুলে ধরেন এবং সঠিকভাবে প্রতিটি প্রস্তাবের উপরে সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেন। তার এই অবাক করা প্রস্তুতি আমাদের মুগ্ধ করে। উদয়াস্ত কাজ করেন। আমাদের দেশে যারা বুদ্ধিজীবী-কবি-সাহিত্যিক-সমাজসেবক, তাদের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ান তিনি। একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বহু পুরস্কার এবং খেতাবে তিনি বিভূষিত। পিতা-মাতার মতো সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত শেখ হাসিনা সংস্কৃতিবান খাঁটি বাঙালি নারী।

বাংলার মানুষের প্রতি শেখ হাসিনার দরদ এবং মমত্ববোধ, তার জ্যোতির্ময় পিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনা থেকে আহরিত। তবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তিনি কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে পরিচিত; বরং আপন যোগ্যতায় স্ব-মহিমায় বাংলার কোটি মানুষের হৃদয়ে তিনি অধিষ্ঠিত। শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক না, আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে ইতিমধ্যে তিনি প্রতিষ্ঠিত। এবার জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনে পুনরায় বাংলায় বক্তৃতা প্রদানের মধ্য দিয়ে তিনি প্রিয় মাতৃভাষাকে গৌরবান্বিত করেছেন। বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত প্রিয়নেত্রী শেখ হাসিনার ৭৬তম শুভ জন্মদিনে তার দীর্ঘজীবন কামনা করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে নিবেদন করছি:

‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,

জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর

আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী

বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি ॥’

লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।


ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

মুসলিম ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জনপদের কিশোরগঞ্জকে ঘিরে রয়েছে অনেক ইতিহাস। প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্যের বিখ্যাত নানা দর্শনীয় স্থান রয়েছে এখানে।

আড়াইশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ তারই একটি নিদর্শন। পাগলা মসজিদটি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার হারুয়া নামক স্থানে বর্তমানে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত, যা একসময় নদীর মাঝে ছিল একপাড় থেকে সরু রাস্তা ও অন্য পাড় থেকে বাঁশের সাঁকো দিয়ে মুসল্লিরা চলাচল করত। জনশ্রুতি অনুসারে, ঈশা খানের পরবর্তী আমলে তারই এক বংশধর দেওয়ান জিল কদর খান ওরফে ‘জিল কদর পাগলা’ নামক এই বংশের একজন ব্যক্তি নদীর তীরে বসে নামাজ পড়তেন। তিনি অত্যন্ত মুজ্জফ ছিলেন তিনি দেওয়ান হয়বত খাঁর নাতি দেওয়ান মোহাম্মদ খাঁর ছেলে পরবর্তীতে ওই স্থানটিতে একটি মসজিদ নির্মিত হয়।

জিল কদর পাগলার নামানুসারে মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এই দেওয়ান জিল কদর দাদ খান পাগলা সাহেবের কবর হয়বতনগর বড় গোরস্তানে রয়েছে । অপর জনশ্রুতি অনুসারে, তৎকালীন কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর জমিদার পরিবারের ‘পাগলা বিবি’র নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয়।

কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিমে নরসুন্দা নদীর তীরে এই তিনতলা বিশিষ্ট মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটি একসময় নরসুন্দা নদীর প্রায় মাঝেই ছিল, একদিকে বাশের সাঁকো অন্যদিকে সরু রাস্তা দিয়ে লোকজন যাতায়াত করত। নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় এখন নদীর হারুয়া পাড়েই মসজিদটি এবং আশপাশে অনেক সুরম্য দালানকোঠায় আবৃত।

যদিও আশির দশকেও এই মসজিদটি ছিল আধাপাকা এবং টিনের ঘর এবং এর মোতোয়ালি ছিলেন হয়বতনগরের সর্বশেষ জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খানের বড় ছেলে, কিশোরগঞ্জ মিউনিসিপ্যালটির (বর্তমান পৌরসভা) চেয়ারম্যান দেওয়ান সাত্তার দাদ খান (সাইয়ারা মিয়া)। সাইয়ারা মিয়াকে সবাই চেয়ারম্যন সাহেব বলেই জানত, তিনি টানা ১৪ বছর চেয়ারম্যন ছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে দেওয়ান ফাত্তাহ দাদ খান ওই মসজিদের মোতোয়ালি নিযুক্ত হন, এ ছাড়াও তিনি তার দাদা কিশোরগঞ্জের অন্যতম জমিদার দেওয়ান মান্নান দাদ খানের দানকৃত মাঠ যা বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত সম্পন্ন ঈদগাহ ময়দান, শোলাকিয়া ঈদগাহেরও মোতোয়ালি। মসজিদটি মোগল স্থাপত্যশৈলীর কারুকার্যময় গঠন কাঠামোতে তৈরি করা হয়।

নামাজির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৮২ সালে সংস্করণ ও কলেবর বৃদ্ধির জন্যে পুরোনো কাঠামো ভেঙে সামনের অংশ পুনর্নির্মাণ করা হয়। ’৯০-এর দশকে ১১ তলা সুউচ্চ মিনারসহ বর্তমান কাঠামোয় রূপান্তর করা হয়। মসজিদ-সংলগ্ন ১৩২ কেভি বিদ্যুৎ লাইনের কারণে কলেবর বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বিদ্যুৎ লাইন মসজিদের খরচে স্থানান্তরিত করে এর আরও উন্নয়ন করা হবে। মসজিদের আয়তন বহুগুণে বাড়িয়ে জানাজা- ঈদগাহ-কবরস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।

এর পাঁচতলা সুউচ্চ মিনারটি বহুদূর থেকে সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। পাগলা মসজিদের ইমরাত খুবই সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীও বেশ চমৎকার। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত পাগলা মসজিদটি নানা ধরনের ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থাপনা হিসেবে খ্যাত।

অন্য একটি মহলে জনশ্রুতি আছে যে, পাগলবেশী এক আধ্যাত্মিক পুরুষ, হয়বতনগর বাড়ির এক বংশধর জিল কদর পাগলা একদিন খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর মধ্যস্থলে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের কাছে স্থিতু হন এবং তাকে ঘিরে আশপাশে অনেক ভক্তকুল সমবেত হন। ওই পাগলের মৃত্যুর পর তার সমাধির পাশে পরবর্তীতে এই মসজিদটি গড়ে ওঠে। ফলে কালক্রমে মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’ নামে পরিচিত পায়।

অত্র অঞ্চলের সহজ সরল মানুষের বদ্ধমূল ধারণা কোনো বিপদে পড়লেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে এই মসজিদে নামাজ পড়া ও শিরনি দেওয়ার নিয়ত করলেই আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন তা কবুল করবেন এবং সেই বিশ্বাসের মূলেই এই মসজিদে সবধর্মের জনগণেরই পবিত্রতা প্রকাশে

ব্যাকুলভাবে সাড়া দিয়ে আসছেন ।

ফলে সাধারণ মানুষ এমন বিশ্বাসের আলোকে পাগলা মসজিদে প্রচুর দান-খয়রাত করে থাকেন এবং ক্রমেই তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ মসজিদের আয় দিয়ে কমপ্লেক্সের বিশাল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মসজিদের আয় থেকে বিভিন্ন সেবামূলক খাতে অর্থ সাহায্য করা হয়।

মসজিদটি কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিমে হয়বতনগর সংলগ্ন হারুয়া নামক এলাকায় অবস্থিত। শহরের যেকোনো স্থান থেকে রিকশাযোগে বা পায়ে হেঁটে বা অন্য যে কোনো পরিবহনযোগে সহজেই এই মসজিদে যাওয়া যায়।


গরমের বিপদ হিটস্ট্রোক: ঝুঁকি এড়াতে করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ

সারা দেশে প্রচণ্ড দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে, গরম বেড়ে চলছে। দেশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। সারা দেশেই গরমে হাঁসফাঁস এবং নাভিশ্বাস অবস্থা, আর গরমের উৎপাতে দিশেহারা মানুষ এবং প্রাণীকুল। এ ছাড়া নানা রকম অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। তবে কয়েক দিনে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

হিটস্ট্রোক কী : গরমের সময়ের একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যার নাম হিটস্ট্রোক। চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী, প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, তাকে হিটস্ট্রোক বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় রক্ত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। কোনো কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ত্বকের রক্তনালি প্রসারিত হয় এবং অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। গরম বাড়লে শরীরও ঘামতে শুরু করে, ঘাম বাষ্পীভূত হলে শরীর ঠাণ্ডা হয় এবং ঘামের মাধ্যমেও শরীরের তাপ কমে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে বেশি সময় অবস্থান বা পরিশ্রম করলে তাপ নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব হয় না। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপদসীমা ছাড়িয়ে যায়, খাম বন্ধ হয়ে যায় এবং হিট

স্ট্রোক দেখা দেয়।

হিট স্ট্রোক কাদের বেশি হয় : প্রচণ্ড গরমে ও আর্দ্রতায় যে কারও হিটস্ট্রোক হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন-
১. শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা যেহেতু প্রায়ই বিভিন্ন রোগে ভোগেন যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার বা হার্টের রোগী, স্ট্রোক বা ক্যানসারজনিত রোগে যারা ভোগেন, এমনকি যেকোনো কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা নানা ওষুধ সেবন করেন, যা হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

২. যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। যেমন কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক।

৩. শরীরে পানিস্বল্পতা হলে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

৪. কিছু কিছু ওষুধ হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষ করে প্রস্রাব বাড়ানোর ওষুধ, বিষণ্নতার ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ ইত্যাদি।

হিটস্ট্রোকের লক্ষণগুলো কী : তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে হিটস্ট্রোকের আগে অপেক্ষাকৃত কম মারাত্মক হিট ক্র্যাম্প অথবা হিট এক্সহসশন হতে পারে। হিট ক্র্যাম্পে শরীরের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়, শরীর দুর্বল লাগে এবং প্রচণ্ড পিপাসা পায়। এর পরের ধাপে হিট এক্সহসশনে দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস, মাথাব্যথা, ঝিমঝিম করা, বমিভাব, অসংলগ্ন আচরণ ইত্যাদি দেখা দেয়। এই দুই ক্ষেত্রেই শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে এবং শরীর অত্যন্ত ঘামতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এর লক্ষণ গুলো হলো-
১. শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়।

২. ঘাম বন্ধ হয়ে যায়।

৩. ত্বক শুষ্ক ও লালচে হয়ে যায়।

৪. নিশ্বাস দ্রুত হয়।

৫. নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়।

৬. রক্তচাপ কমে যায়।

৭. খিঁচুনি, মাথা ঝিমঝিম করা, অস্বাভাবিক আচরণ, হ্যালুসিনেশন, অসংলগ্নতা ইত্যাদি।

৮. প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়।

৯. রোগী শকেও চলে যায়। এমনকি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

প্রতিরোধের উপায় কী : গরমের দিনে কিছু সতর্কতা মেনে চললে হিটস্ট্রোকের বিপদ থেকে বেঁচে থাকা যায়। এগুলো হলো-
১. হালকা, ঢিলেঢালা পোশাক পরুন। কাপড় সাদা বা হালকা রঙের হতে হবে। সুতি কাপড় হলে ভালো।

২. যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন।

৩. বাইরে যেতে হলে মাথার জন্য চওড়া কিনারাযুক্ত টুপি, ক্যাপ বা ছাতা ব্যবহার করুন।

৪. বাইরে যারা কাজকর্মে নিয়োজিত থাকেন, তারা মাথায় ছাতা বা মাথা ঢাকার জন্য কাপড়জাতীয় কিছু ব্যবহার করতে পারেন।

৫. প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল পান করুন। মনে রাখবেন, গরমে ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুই-ই বের হয়ে যায়। তাই পানির সঙ্গে সঙ্গে লবণযুক্ত পানীয় যেমন-খাবার স্যালাইন, ফলের রস, লাচ্ছি ইত্যাদিও পান করতে হবে। পানি অবশ্যই বিশুদ্ধ হতে হবে।

৬. তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী পানীয় যেমন- চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত।

৭. রোদের মধ্যে শ্রমসাধ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এসব কাজ সম্ভব হলে রাতে বা খুব সকালে করুন। যদি দিনে করতেই হয়, তবে কিছুক্ষণ পরপর রোদ থেকে সরে গিয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর লবণযুক্ত পানি ও স্যালাইন পান করতে হবে।

আক্রান্ত হলে কী করণীয় : প্রাথমিকভাবে হিটস্ট্রোকের আগে যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সহসশন দেখা দেয়, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হিটস্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই যা করতে পারেন তা হলো-
১. দ্রুত শীতল কোনো স্থানে চলে যান। যদি সম্ভব হয়, ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিন।

২. ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে ফেলুন। সম্ভব হলে গোসল করুন।

৩. প্রচুর পানি ও খাবার স্যালাইন পান করুন। চা বা কফি পান করবেন না।

কিন্তু যদি হিটস্ট্রোক হয়েই যায়, তবে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে, ঘরে চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে রোগীর আশপাশে যারা থাকবেন তাদের করণীয় হলো-

৪. রোগীকে দ্রুত শীতল স্থানে নিয়ে যান।

৫. তার কাপড় খুলে দিন।

৬. শরীর পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে বাতাস করুন। এভাবে তাপমাত্রা কমাতে থাকুন।

৭. সম্ভব হলে কাঁধে, বগলে ও কুঁচকিতে বরফ দিন।

৮. রোগীর জ্ঞান থাকলে তাকে খাবার স্যালাইন দিন।

৯. দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

১০. সব সময় খেয়াল রাখবেন হিটস্ট্রোকে অজ্ঞান রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং নাড়ি চলছে কি না। প্রয়োজন হলে কৃত্রিমভাবে নিশ্বাস ও নাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হতে পারে। হিটস্ট্রোকে জীবন বিপদাপন্ন হতে পারে। এমনকি রোগী মারাও যেতে পারেন। গরমের এই সময়টায় সবাইকে সাবধানে থাকতে হবে। দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও হাসপাতালে ভর্তি করে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া গেলে বেশির ভাগ রোগীই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।

১১. গরমে শিশুদের জন্য ঝুঁকিটা বেশি। বাচ্চাদের বেশি বেশি পানি খাওয়াতে হবে। তারা যেন রোদের মধ্যে অনেক বেশি দৌড়ঝাঁপ না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সবাইকে মনে রাখতে হবে, এই গরমে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে এর থেকে বেঁচে থাকা উচিত।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক


প্রতিদিনের সাত হজ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মুফতি আলী হুসাইন

আপনি কি হজ না করেও হজের নেকি অর্জন করতে চান? আপনার সামর্থ্য নেই মক্কা যাওয়ার, নেই আর্থিক সংগতি তারপরও কি আপনি একজন হাজির মর্যাদা অর্জন করতে আগ্রহী? যারা অর্থ ও শ্রম দিয়ে কাবা শরিফ পৌঁছেছেন; অশেষ নেকি অর্জনে সক্ষম হয়েছেন; মহান রবের নৈকট্য লাভ করেছেন; কাবা চত্বরে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি তুলেছেন আর আপনি দেশের সীমানা অতিক্রম করেননি কিন্তু সাধ্য না থাকলেও মনে বড় স্বাদ আছেÑ তাদের মতো বিপুল নেকি অর্জন করবেন বলে। তা হলে এবার আপনাকে জানতে হবে এমন কি আমল যার দ্বারা আপনি হজ না করেও হজের নেকি লাভ করবেন। বাইতুল্লাহ শরিফে না গিয়েও হাজিদের মর্যাদা অর্জন করবেন।

আপনার বিশ্বাস হোক আর না-হোক

* মাত্র তিন মিনিট সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজের সাওয়াব লেখা হবে।

* মাত্র ছয় মিনিট সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পরিপূর্ণ একটি ওমরার সাওয়াব লিখা হবে।

* মাত্র ১৫ মিনিট সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজের সাওয়াব লেখা হবে।

* মাত্র এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজের সাওয়াব লেখা হবে।

* মাত্র দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করে একটি আমল করুন, আপনার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজ ও ওমরার সাওয়াব লেখা হবে।

এখন নিশ্চয়ই আপনার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, এটা জানার জন্য যে, কি সেই আমল? যে আমল করলে এতগুলো হজ ও ওমরার সাওয়াব লেখা হবে। তাহলে এখনই জেনে নিন, সেসব আমল সম্পর্কে, যেগুলোর মাধ্যমে হজ না করেও হজের নেকি পাওয়া যায়; মক্কায় না গিয়েও হাজিদের সমান মর্যাদা ও নেকি অর্জন করা যায়।

এক. জামাতের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হলে পরিপূর্ণ একটি হজের সাওয়াব হাসিল হয়।

হাদিসে এসেছে, আবু উমামা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ফরজ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়, তার এক হজের সমান নেকি লাভ হয়। আর যে ব্যক্তি কোনো নফল নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হয়, তার জন্য একটি পরিপূর্ণ ওমরার সাওয়াব লেখা হয়। [মুসনাদে আহমাদ: ২২৩০৪]

এক ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করলে পরিপূর্ণ একটি হজের সাওয়াব অর্জন হয়, তাহলে যে ব্যক্তি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে, নিঃসন্দেহে তার পাঁচটি পরিপূর্ণ হজের সাওয়াব অর্জন হবে। তারপরও মানুষ কি করে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা থেকে দূরে থাকে! অথচ মাত্র ১৫ মিনিটের ব্যাপার!

দুই. যে ব্যক্তি ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে জায়নামাজে বসে থেকে যিকির-আযকার, দোয়া-দরুদ বা কোরআন তিলাওয়াতে লিপ্ত থাকে, তারপর সূর্য একটু ওপরে ওঠে গেলে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নেয়, তাহলে তার আমলনামায় পূর্ণ একটি হজ ও পূর্ণ একটি ওমরার সাওয়াব লিখে দেওয়া হয়।

হাদিসে এসেছে, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে। অতঃপর সূর্য ওঠা পর্যন্ত জায়নামাজে বসে যিকির-আযকার করতে থাকে, তারপর (সূর্য একটু ওপরে ওঠে গেলে বা ইশরাকের সময়) দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নেয়, তার জন্য পরিপূর্ণ একটি হজ ও ওমরার সওয়াব অর্জন হয়। রাসুলুল্লাহ শেষোক্ত শব্দটি তিনবার বলেন- পরিপূর্ণ হজ ও ওমরা, পরিপূর্ণ হজ ও ওমরা, পরিপূর্ণ হজ ও ওমরা। [তিরমিযি: ৫৮৬]

মানুষ ও জিন জাতির জন্য কি সুবর্ণ সুযোগ! মাত্র দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করেই হজ ও ওমরার সাওয়াব অর্জন করতে পারে।

তিন. যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ৩৩ বার আল্লাহু আকবার, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ পাঠ করবে, তার আমলনামায় একটি হজ, একটি ওমরা এবং আল্লাহর রাস্তায় দান করার নেকি লাভ করবে।

আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনÑ

একদল দরিদ্র মুহাজির সাহাবিগণ রাসুলুল্লাহর নিকট এসে অনুযোগ করল, ধনী ব্যক্তিরা উচ্চমর্যাদাও নায-নেয়ামতে আমাদের থেকে অগ্রগামী। তিনি বললেন এটা কীভাবে? তারা বলল, আমরা যেভাবে সালাত আদায় করি তারাও সেভাবে সালাত আদায় করে, আমরা যেভাবে সওম পালন করি তারাও সেভাবে সওম পালন করে। তারা দান-সাদাকাহ করে, আমরা দান-সাদাকা করি না, তারা গোলাম আজাদ করে আমরা করি না। রাসুলুল্লাহ বললেন, আমি তোমাদেরকে এমন কিছু শিখিয়ে দেব কি? যার দ্বারা তোমরা তোমাদের অগ্রগামীদের মর্যাদায় পৌঁছতে পারবে এবং তোমাদের পশ্চাৎগামীদের আগে যেতে পারবে। কেউ তোমাদের অগ্রগামী হতে পারবে না। তবে তোমাদের মতো কেউ আমল করলে ভিন্ন কথা। তারা বলল, আপনি বলুন ইয়া রাসুলাল্লাহ!। রাসুলুল্লাহ তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা প্রত্যেক সালাতের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল-হামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। বর্ণনাকারী আবু সালেহ বলেন, অতঃপর দরিদ্র মুহাজিরগণ আবার রাসুলুল্লাহর নিকট এসে অবহিত করলেন যে, আমাদের সম্পদশালীরা তো আমাদের আমলের কথা শুনে তারাও তদ্রূপ আমল শুরু করেছে। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেনÑ

এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছে তা দান করেন। [বুখারি: ৮৪৩, মুসলিম: ৫৯৫]

এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন,Ñ

যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ এবং ৩৩ বা র আলহামদুলিল্লাহ, ৩৩ বার আল্লাহু আকবার, মোট ৯৯ বার পাঠ করবে এবং ১০০ বার নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করবেÑ

‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লাশারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহুয়া আলা কুল্লিশাইন কাদির’

তাহলে তার সমস্ত গোনাহ মিটিয়ে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনারাশির সমপরিমাণ হয়। [মুসলিম:৫৯৭ ]

মাত্র তিন মিনিট সময় ব্যয় করে কি বিপুল পরিমাণ নেকি অর্জন করা যায়!

চার. যে ব্যক্তি দীন শিক্ষা করা বা শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করে, তার আমলনামায় একটি পরিপূর্ণ হজের সাওয়াব দান করেন।

হাদিসে এসেছে, আবু উমামা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি শুধু কল্যাণ শিক্ষা লাভ কিংবা কল্যাণ শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করবে, তাকে পরিপূর্ণরূপে হজ পালনকারীর ন্যায় প্রতিদান দেওয়া হবে। [তাবরানি কাবির: ৭৪৭৩]

সৌভাগ্যবান ওই ব্যক্তি, যে মসজিদে গমন করে কোরআন হিফজ করার জন্য কিংবা করানোর জন্য, ধর্মীয় জ্ঞানার্জন বা শিক্ষা প্রদান অথবা জুমআর খোৎবা শ্রবণের উদ্দেশ্যে। অতঃপর পরিপূর্ণ হজের সাওয়াব নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। মাত্র এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেই এই মহৎ নেকি অর্জন সম্ভব। তারপরও কি এব্যা পারে অলসতা করা উচিত?

পাঁচ. রমাদানের এক ওমরা এক হজের সমান।

হাদিসে এসেছে, ইবনে আব্বাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন,Ñ নিশ্চয়ই রমাদান মাসের ওমরা পালনে হজের সমান নেকি হাসিল হয়। [বুখারি ও মুসলিম]

হে দীনি ভাই ও বন্ধুগণ! নেক কাজে আর বিলম্ব নয়। এখনই ছুটে আসুন, রমাদান মাসে ওমরা পালনের জন্য, আপনি একটি পরিপূর্ণ একটি কবুল হজের সমান নেকি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন। সেই সঙ্গে আছে পাপমুক্তির পরোয়ানা। ইনশাআল্লাহ!।

ছয়. হাজিদের সাহায্য করলে হজের সওয়াব পাওয়া যায়।

যায়েদ বিন খালিদ আল-জুহানি [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো যোদ্ধাকে যুদ্ধের সরঞ্জামের জোগান দেবে বা যোদ্ধার পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করবে কিংবা কোনো হাজির আসবাপত্রের জোগান দেবে অথবা কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার-ও অনুরূপ নেকি অর্জন হবে কিন্তু উদ্যোক্তার সামান্য পরিমাণ নেকিও কমবে না। [নাসাঈ: ৩১৮০]

সুতরাং হাজিদের হজ পালনের প্রস্তুতিতে সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। এই নেকি অর্জনের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহী হওয়া উচিত। বিশেষত আমরা যারা হজ করতে সামর্থ্য রাখি না।

এখন তিনটি উপঢৌকন সম্পর্কে কথা বলে আলোচনা শেষ করব।

এক. যে ব্যক্তি নিজ বাড়ি বা কর্মস্থলে অজু করে মসজিদে কোবায় আগমন করব, অতঃপর সেখানে নামাজ আদায় করবে, তার আমলনামায় একটি ওমরা করার নেকি অর্জন হবে।

সাহল ইবনে হুনাইফ [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নিজ ঘরে অজু করে মসজিদের কোবায় গিয়ে নামাজ পড়ে, তার একটি ওমরার সাওয়াব হাসিল হয়। [নাসাঈ: ৬৯৯]

আমরা যা জানতে পারলাম

* প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ আলহামদুল্লিাহ, ৩৩ আল্লাহু আকবার পাঠ করতে সর্বোচ্চ তিন মিনিট সময় ব্যয় হবে, বিনিময়ে আপনি পাবেন একটি হজ ও একটি ওমরার সাওয়াব।

* মাত্র ছয় মিনিট সময় ব্যয় করে আপনি মসজিদে কোবায় দুই রাকাত নামাজ আদায় করুন, বিনিময়ে পাবেন পূর্ণ একটি ওমরা পালনের নেকি।

* ১৫ মিনিট সময় ব্যয় করে আপনি জামাতের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায় করুন, বিনিময়ে পাবেন একটি কবুল হজের সওয়াব।

* এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে আপনি মসজিদে গিয়ে কিছু ধর্মীয় জ্ঞান বা কল্যাণকর কিছু শিখুন কিংবা জুমার খুতবা শ্রবণ করুন, বিনিময়ে আপনি পাবেন একটি কমপ্লিট একটি কবুল হজের সাওয়াব।

* ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে, জায়নামাজে বসে থেকে যিকির-আযকার করতে থাকুন, তারপর সূর্য উঠে গেলে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নিন, বিনিময়ে পাবেন একটি পরিপূর্ণ হজ ও পরিপূর্ণ ওমরার সাওয়াব।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই জানতে পেরেছেন যে, কীভাবে একজন মুসলিম প্রতিদিন সাতটি হজ পালনের নেকি লাভ করবে?

* ঘরে অজু করে মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে পাঁচটি কবুল হজের নেকি লাভ হয়।

* ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে, জায়নামাজে বসে থেকে যিকির-আযকার করতে থাকুন, তারপর সূর্য ওঠে গেলে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নিন, বিনিময়ে পাবেন একটি পরিপূর্ণ হজ ও পরিপূর্ণ ওমরার সাওয়াব।

* এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে আপনি মসজিদে গিয়ে কিছু ধর্মীয় জ্ঞান বা কল্যাণকর কিছু শিখুন কিংবা জুমার খুতবা শ্রবণ করুন, বিনিময়ে আপনি পাবেন একটি কমপ্লিট কবুল হজের সাওয়াব।

আপনার প্রাত্যহিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক কবুল হজের ছক

প্রতিদিন ৭ হজ

প্রতি সপ্তাহে ৭ˣ৭= ৪৯

প্রতি মাসে ৭ ˣ ১০=২১০

প্রতিবছর ৩৬৫ ˣ ১২=২৫৫৫

প্রতিদানের দিক দিয়ে ওহুদ পাহাড়ের চেয়ে বৃহৎ। কোনো বিবেকবান মুসলিম ব্যক্তির জন্য অবহেলা করা উচিত নয়।


গ্রামের জিয়াফত বা মেমানি  

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আলমগীর খোরশেদ 

ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে দেখতাম অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে মুরুব্বি কেউ মারা গেলে চল্লিশ দিন পর মৃত্যুবার্ষিকী পালনে কিংবা কারোর বিয়ে, মেয়ের কান ফুটা, খৎনা, এলাকার কোনো খেলায় জয় ইত্যাদি উপলক্ষে গ্রামোময় ভোজ বা খাওয়ার যে আয়োজন করত সেটাকেই মেমানি বা মেজবানি বলা হতো। মেমানি বা মেজবানি বলতে আতিথিয়েতা বা গণভোজকে বোঝায়। যা সবার জন্য উন্মুক্ত। ধনী-গরিব সবাই একসঙ্গে বসে মেমানির খাবার খেতো।

বাংলাদেশে মেজবানি বলতে যদিও চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য ভাবা হয়; কিন্তু এটা বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব জেলাসহ সিলেট, খুলনা এমনকি দেশের বাইরে ইউরোপ, আমেরিকায়ও মেমানি বা মেজবানি প্রচলিত আছে। গৃহস্থদের ধান মাড়াই শেষ হলে গ্রামের বাড়িতে কাছারি ঘরের সামনে নামা খালি জমিসহ মেমানি বা মেজবানির আয়োজন করা হতো। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে এটাকে ‘জিয়াফত’ বলা হয়ে থাকে। জিয়াফত হলো ফার্সি শব্দ, যার অর্থ হলো ভোজ বা ভোজসভা। তা একটি ঐতিহ্যগত আঞ্চলিক উৎসব। প্রতিবেশী, পাড়া তথা সামর্থ্য অনুযায়ী পুরো গ্রামের লোকজনদের মেমানিতে দাওয়াত দেওয়া হতো। মেমানির যিনি আয়োজক তিনি বা তার লোকজন পাড়াময় হেঁটে হেঁটে বাড়ির মুরুব্বিদের দাওয়াত দিতেন। দাওয়াত দিতে পরিবারের সবাইকেসহ বলতে হতো, না হলে রাগ করে আসত না কেউ।

মেমানির খাবার: মেমানিতে সাদা ভাত, মরিচ ও মসলাসহ গরুর মাংস সঙ্গে ছোট আলুর ঝোল, মাছভাঙ্গা সঙ্গে আলুর ঝোল, মাষকলাইয়ের ডাল আর থাকত মজার জিনিস ‘মিডুরি’। মিডুরি হলো চালের গুঁড়া, আখের গুড়, নারকেল গুঁড়া গরম মসলা সহযোগে তৈরি তরল মিষ্টিজাতীয় খাবার। মিডুরিটা খাবারের শেষে পরিবেশন করা হতো। বাবুর্চির সুনাম নির্ভর করত মিডুরি ও গরুর মাংস রান্নার ওপর। সবশেষে দেওয়া হতো পান সঙ্গে চিকন করে কাটা সুপারি, খয়ের, চুন ও পাতা এবং জর্দা।

মেমানির ডেকোরেশন: তখনকার দিনে এখনকার সময়ের মতো ডেকোরেটর ছিল না। বিয়ে, ওয়াজ মাহফিলে কাপড়ের তৈরি বড় সামিয়ানা টানানো হতো, যাতে কোনো সমিতি বা প্রতিষ্ঠানের নাম, সন তারিখ, সাকিন এসব লাল, নীল সুতো দিয়ে লেখা থাকত। রান্নার জন্য বিভিন্ন পাড়া বা গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি থেকে পিতলের তৈরি বড় ডেকচি যাকে ‘মেমানির ডেক’ বলত, তা আনা হতো। ডেকচির গায়ে ওপরের দিকে ডেকচির মালিকের নাম, সন তারিখ, সাকিন ইত্যাদি পিতল খোদাই করে লেখা থাকত। পাড়া থেকে চেয়ার, প্লেট বা বাসন, সানকি আনা হতো। গ্রামের লোকেরা চাটাই বিছিয়ে তাতে কলাপাতায় মেমানির খাবার খেতো।

মেমানির গরু কেনা: দাওয়াত দেওয়ার পর কর্তাব্যক্তি মেমানির জন্য গরু কেনায় অভিজ্ঞ বা মিডিয়া যে, তাকেসহ পাড়ার ও বাড়ির লোকজন নিয়ে গরু কিনতে বাজারে যেতেন। গরুর দালাল দেখলেই বোঝা যেত, নারিকেল তেল দিয়ে আঁচড়ানো মাথা চকচক করত। লুঙ্গিটা নিচ থেকে উল্টায়ে কোমরে বাঁধা, ছাতাটার বাঁট পিছনে ঘাড়ের কাছে শার্টে ঢুকানো। কখনোই তার চোখ দুটো স্থির নয়। গরুর মালিকের সঙ্গে ও ক্রেতার সঙ্গে এমনভাবে চোখের ভ্রু নামিয়ে উঠিয়ে কথা বলত যে সাধারণ মানুষ ওই চোখের ভাষা বোঝা কঠিন।

মেমানির কাজ ও ব্যস্ততা: অনুষ্ঠানের আগের রাত যেন কর্মযজ্ঞ। এ রাতে বাড়িতে কারোর ঘুম নেই। বিকেল থেকেই বাবুর্চি তার সহযোগী লোকজন, চামচাসহ অন্যান্য উপাদান, চার-পাঁচটা গরু জবাইয়ের কসাই ও তার লোকজন সবাই এসে হাজির হতো। গরু জবাই করে একটার পর একটা টুকরা করে বাবুর্চি মাংস বুঝে নিতো। পুকুর থেকে মাছ ধরার জন্য জেলেকে খবর দেওয়া হলে জেলে এসে পুকুরে জাল ফেলত। পুকুরের এপার থেকে ওপারে জাল টেনে নিলে ওদিকে মাছের লাফালাফি শুরু হতো। বড় বড় কাতল, রুই, মৃগেল, ঘাসকার্প মাছ উঠিয়ে আনা হতো। বাবুর্চি বলে দিত কত কেজি মাছ লাগবে। পেঁয়াজ, মসলা, আদা, রসুন বাটার জন্য মহিলারা শীল-পাটা নিয়ে বসে যেত। গাঁইল চেঁহাইট দিয়ে পেঁয়াজ, রসুন, পেষার কাজ করা হতো। এত লোক রাতে খাবারের জন্য খিচুড়ি পাক করত বাবুর্চি।

উঠানের কোণে লম্বা পরিখা বা মাটি কেটে গর্ত করে লম্বা চুলা বানানো হতো। ধান সিদ্ধ দেওয়ার বড় কড়াইয়ে ভাত রান্না হতো। চাল সিদ্ধ হতেই কড়াই উঠিয়ে নিয়ে গরম ভাত বড় বাঁশের তৈরি খাঁচায় ঢেলে দেওয়া হতো পানি ঝরে যাওয়ার জন্য। পানি ঝরে গেলে ভাত বিছিয়ে রাখা নতুন চাটাইয়ে স্তূপ করে রাখা হতো। চুলা ধরানোর জন্য পাটশোলার আঁটি, কেরোসিন তৈল রাখা হতো, লাকড়ির পাশে। বাড়ির মুরুব্বি যিনি, তাকে দিয়ে চুলা ধরানোর উদ্বোধন করা হতো।

মেমানি খাওয়ানোতে বিভিন্ন গ্রুপ: এত লোকের আয়োজনে নিয়মানুবর্তিতা জরুরি বিধায় লোকজনদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দায়িত্ব দেওয়া হতো। মাটির পেয়ালায় রান্না করা গরুর মাংস, মাছ, ডাল, মিডুরি দেওয়া হতো। এক গ্রুপ মাংস, অন্য গ্রুপ মাছ, অন্যরা ডাল, মিডুরি ও পানি দেবে, এভাবে। বাবুর্চিকে বলা থাকত নির্দিষ্ট লোক বা গ্রুপ ছাড়া তরকারি বা খাবার দেবে না।

শেষকথা: গ্রামে এখন আর মেমানি, মেজবানি বা জিয়াফতের আয়োজন করে না কেউ। একান্নবর্তী পরিবারগুলো হারিয়ে গেছে। সবাই হয়ে গেছে আত্মকেন্দ্রিক। একান্ত নিজের মানুষ ছাড়া কেউ কাউকে এক বেলা খাওয়ায় না এখন। মেমানি, জিয়াফত বা মেজবানি তো অনেক খরচের ব্যাপার। এখনকার বাবা-মা মারা গেলে মেমানি করার মন-মানসিকতা থাকে না সন্তানের। পরিবর্তনের হাওয়ায় সব বদলে গেছে। আজকের প্রজন্ম বুঝবেই না মাটিতে চাটাইয়ে বসে কলাপাতায় ভাত খাওয়ায় কি মজা আর কি আনন্দ। আধুনিকতায় গা ভাসানো ও সংসারের আয়োনিক বন্ধন ভেঙে যাওয়ায় হারিয়ে গেছে মেমানি, মেজবানি বা জিয়াফতের মতো গ্রামীণ ঐতিহ্য। যা কেবল স্মৃতিময় হয়ে আছে মধ্য বয়সি প্রজন্মের।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক


সড়কে মৃত্যুর মিছিল: দায়ী কে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম এ মান্নান

কথায় আছে যেখানে ঠেকবে সেখানেই শিখবে; কিন্তু আমি এই কথার কোনো সত্যাসত্য খুঁজে পাচ্ছি না। তবে দিব্যজ্ঞানে যেটা ঠাওর করতে পারছি সেটা হলো উল্টো বুদ্ধির লোপ পায় বা হতবুদ্ধি হয় বা বুদ্ধির বৈকল্য ধরা পড়ে। যদি তাই না হতো তাহলে প্রতি বছর এবং বারবার এত এত সড়ক দুর্ঘটনা এবং এত এত অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটবে কেন? এত এত লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটবে কেন? এত এত মানুষ মারা যাবে কেন? কই এর তো কোনো স্থায়ী সুরাহা দেখতে পাচ্ছি না। নাকি এখানে শেখার কিছু নেই। শুধু ঠেকেই যাবে?

দেশে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসে। ব্যাপারটা এমন যে কাজ নেই তো খই ভাজ। একটি তদন্ত কমিটি হয়। কমিটি আদা-জল খেয়ে কয়েক দিন দৌড়ায়। ওই পর্যন্তই। শুধু শুধু ব্যস্ত হওয়া। ফল যে লাউ সেই কদু। আমরা আশায় থাকি শুধু শুধু।

দেশে কী পরিমাণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে চট্টগ্রাম-১১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২০২১ সালে সংসদের প্রশ্নোত্তর-পর্বে বলেছিলেন, দেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে। এরপরও কি বোঝার বাকি থাকে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ কী? কারা দায়ী? নিশ্চয় এই তিন বছরে ওই ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো ফিটলেস হয়ে গেছে। নতুন করে আরও শত শত গাড়ি ফিটনেস হারাচ্ছে। যেগুলোকে আমরা বলি লক্কর-ঝক্কর, ধাক্কা না দেওয়া পর্যন্ত খাড়াইয়া পড়।

আমরা প্রায়ই দেখতে পাই রাস্তায় গাড়ি বিকল হয়ে যেতে। গাড়ির যাত্রীদের গাড়ি থেকে নেমে ধাক্কা দিতে, নিদেনপক্ষে আরেক গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা দিতে। ফাঁকে দেখি গাড়ির মাদকাসক্ত চালককে আরাম-আয়েশ করে মাদক ফুঁকতে। এমনতর ধুঁকে ধুঁকে চলা গাড়ি আর মাদক ফুঁকে চলা চালকের কাছে যাত্রীরা কী নিরাপত্তা পাবে? যেখানে গাড়ির চালক বসেন তার মাথার ওপরে প্রায়ই একটা লেখা চোখে পড়ে। দোয়া কুনুত। লা-ইলাহা...। এখন বুঝতে পারছি এ দোয়ার শানেনজুল কী। গাড়ি এবং চালকের কারও প্রতি যাত্রীদের ভরসা নেই। একমাত্র ভরসা আল্লাহ মালেকশাই।

গোড়ায় গলদ একটা কথা আছে। এটার শানেনজুল আবার একটু তাড়াতাড়ি বুঝতে পারছি। গাড়ির যিনি চালক হবেন তাকে দক্ষ এবং যোগ্য হতে হবে। এবং গাড়ির শতভাগ ফিটনেস থাকতে হবে। এটার ঘাটতি থাকলেই গোড়ায় গলদ। এখানে দুটোরই চরম সংকট। আর বড় গোড়ায় গলদ হলো যারা এসবের অনুমোদন দেন তারা। এর থেকে বড় গলদ আর নেই।

বেশ কয়েক বছর আগে সম্ভবত ২০১৯ সালের ঘটনা। তখন সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু নিয়ে রাজধানী প্রায় অচল করে দিয়েছিল ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা। তাদের উত্তেজনা প্রশমন করতে প্রশাসনকে অসীম বেগ পেতে হয়েছিল। তারা নিজেরাই রাজধানীর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছিল। আর সরকারি চাকুরে ট্রাফিক পুলিশরা অন্দরমহলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অতিশয় আশ্চার ব্যাপার হলো যারা কোনোদিন জানত না ট্রাফিক পুলিশ কী জিনিস, সিগন্যাল কী জিনিস সেই তারাই দায়িত্ব নিয়ে নিল সারা রাজধানীর ট্রাফিকের নিয়ন্ত্রণ। গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না, গাড়ির ফিটসেন আছে কি না। কাগজ ঠিক আছে কি না- এসব তল্লাশি করতে বেশুমার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছিল। অবাক করা কাণ্ড হলো তাদের তল্লাশি থেকে বাদ পড়েনি মন্ত্রী-এমপিদের গাড়ি পর্যন্ত। অনেকে তল্লাশির ভয়ে বিকল্প পথ ধরে পগারপার হয়েছেন। এখানেই বলা যায় যেখানে ঠেকবে সেখানেই শিখবে। তারা ঠেকেছে, তারা শিখেছে, তারা কাজ করে দেখিয়েছে এবং তারা সফল হয়েছে।

কারা ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারেন তাদের পক্ষে কোনো এক মন্ত্রীর সরল উক্তি ছিল, গাছের ছবি দেখে যে বলতে পারবে এটা গাছ, মাছের ছবি দেখে যে বলতে পারবে এটা মাছ সে-ই গাড়ির চালক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবে। অর্থাৎ প্রতীক চিনতে পারলেই তিনি যোগ্য হবেন। অবশ্য কী কারণে যেন ওই মন্ত্রী পরে অনেক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুয়ায়ী গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৩ হাজার ৫৬২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এসব দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৩১৭ জন লোক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫ হাজার ১৭২ জন। গত বছরের তুলনায় এবার সড়ক দুর্ঘনা এবং মৃত্যু দুটোই বেশি। চলতি বছর তিন মাসে প্রায় দেড় হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং নিহত হয়েছে ১৩৬৭ জন।

আমরা সবাই জানি যে প্রতি ঈদের সময় বিপুলসংখ্যক লোক বাড়ি ফেরেন। আবার ঈদপরবর্তী সময়ে বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরেন। ফলে যাওয়া এবং আসার সময় সড়কে যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পায়। এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামানো- এটা কিন্তু স্বাভাবিক নয়। আরও স্বাভাবিক নয় অদক্ষ-অযোগ্য গাড়ির চালক দিয়ে গাড়ি চালানো; কিন্তু আমরা বাস্তবে তাই দেখতে পাচ্ছি। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের নিত্যসঙ্গী হচ্ছে, রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল ভারী হচ্ছে। যা কখনো কাম্য নয়।

অতি সম্প্রতি দেশে ঘটে গেল ভয়াবহ দুটি সড়ক দুর্ঘটনা। যা গা শিউরে ওঠার মতো। ভয়াবহ ওই সড়ক দুর্ঘটনার একটি ঘটে ফরিদপুরে। ওই ঘটনায় বাস এবং পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে নারী ও শিশুসহ ১৪ জন নিহত হয়েছেন। আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে ঝালকাঠিতে। এতে ট্রাক-প্রাইভেটকার ও ইজিবাইকের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। এই দুটি ঘটনাই কি দিবালোকের মতো পরিষ্কার নয়, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা কোথায়।

সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা হামেশাই যে কথাটি শুনতে পাই বা দেখতে পাই তা হলো বাসের সঙ্গে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ বা ধাক্কা, বাসের সঙ্গে ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ বা ধাক্কা, নইলে গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কা ইত্যাদি। আর এসবের মূলে যা শুনতে পাই তা হলো গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানো। ফলে বাস বা ট্রাককে প্রায়ই দেখা যায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে বা নদীতে পড়ে থাকতে।

কথায় আছে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? এই যে যত্রতত্র ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে এর জন্য দায়ী কিন্তু অদক্ষ গাড়ির চালক এবং ফিটনেসবিহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি। তাই এর দায় কিন্তু প্রশাসন এড়াতে পারবে না। রাস্তায় যেসব গাড়ির চালক গাড়ি চালাচ্ছেন তাদের নিয়ে শঙ্কার শেষ নেই। এসব চালকের বেশির ভাগের গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। আবার যাদের আছে তাদের অনেকের লাইসেন্স জাল। এ ছাড়া আছে অপ্রাপ্ত বয়স্ক গাড়ির চালকও। আবার অনেক চালক আছেন যারা নেশাগ্রস্ত। তারা নেশা করেই গাড়ি চালিয়ে থাকেন। একজন গাড়ির চালক যদি নানা দোষে দুষ্ট থাকেন এবং তিনি যে গাড়িটি চালান সেটি যদি ফিটনেসবিহীন গাড়ি হয়ে থাকে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে থাকে তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে এটাই তো বাস্তবতা, এটাই স্বাভাবিক। অথচ মোটরগাড়ি চালনা আইনের ধারা ৪ এবং ৫-এ উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে। অন্যথায় তিনি আইন লঙ্ঘনের দায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অথবা অনধিক ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন; কিন্তু আমরা কি এসবের বাস্তবতা দেখতে পাই। পাই না।

কাজির গরু নাকি কেতাবে থাকে গোয়ালে থাকে না। আমাদের সড়কে যানবাহন আইনের ক্ষেত্রেও তাই। আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। যদি সড়কে যানবাহন আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হতো এবং দক্ষ ও যোগ্য গাড়ির চালক গাড়ি চালাতেন এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির নিবন্ধন বাতিল করা হতো তাহলে সড়কে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিল রোধ করা যেত; কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে। কিন্তু গত দুই দিনে দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় যে ২৮ জন লোক প্রাণ হারাল এর দায়ভার কে নেবে?

সব শেষে যে কথা বলব তা হলো আইনের সঠিক প্রয়োগ। দেশে লাখ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে। সবার আগে এসব গাড়ির নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। আর যিনি রাস্তায় গাড়ি চালাবেন তাকে অবশ্যই দক্ষ এবং যোগ্য চালক হতে হবে এবং গাড়ি চালানোর বৈধ সনদ থাকতে হবে। আর যে গাড়িটি সড়কে চলবে সেটিও হতে হবে শতভাগ চলাচলের উপযোগী। কোনোভাবেই মেয়াদোত্তীর্ণ নয়।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক


খন্দকার আসাদুজ্জামান: অবিস্মরণীয় একটি নাম

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
খন্দকার হাসানুজ্জামান

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে গঠিত মুজিবনগর সরকারের অর্থসচিব, ভাষাসৈনিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যার অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে, যিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের লোভনীয় সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধা উপেক্ষা করে মাতৃভূমির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে সর্বদা কাজ করে গেছেন, আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি কেবল ভূমিকাই রাখেননি পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশের উপযোগী প্রশাসন গড়ে তোলার সব পরিকল্পনা ও নীতি-নির্ধারণে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ভাষা আন্দোলনেরও একজন বলিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।

রাজনীতি ও দেশের বৃহত্তর কল্যাণে অগ্রাধিকার বিবেচনায় তিনি তার কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে ছিলেন। শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী হিসেবে তিনি তার এলাকার বাইরেও বৃহত্তর পরিসরে কাজ করে গেছেন। চাকরি জীবনের শুরু থেকেই সৎ এবং কর্মনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে তার সুখ্যাতি রয়েছে। রাজনীতিতেও তিনি যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। তিনি সরকারি চাকরি শেষে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন।

মরহুম খন্দকার আসাদুজ্জামান টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের নারুচী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৫ সালের ২২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তাদের ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি ওই এলাকায় ‘মিয়া বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত। পিতা মরহুম খন্দকার আব্দুস সামাদ এম এ (এলএলবি) ছিলেন বহুমুখী প্রজ্ঞার অধিকারী একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। খ্যাতনামা উকিল হিসেবে তার অবদান ছিল সুদৃঢ়। এলাকায় তো বটেই এমনকি টাঙ্গাইল বারেও তিনি ‘সামাদ উকিল’ হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। খন্দকার আব্দুস সামাদ স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তার মা ছালেমা খাতুন। বর্তমান গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বেরুয়া গ্রামের তৎকালিন ঢাকা জেলার প্রথম মুসলিম ডাক্তার শামসুদ্দিন খান সাহেবের একমাত্র কন্যা। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, ধর্ম পরায়ণ দানশীলতার খ্যাতি ছিল চারদিকে।

মরহুম খন্দকার আসাদুজ্জামানের কর্মজীবন ছিল বেশ বর্ণাঢ্য ও ঘটনা বহুল। ১৯৬০ সালে প্রতিযোগিতামূলক পাকিস্তান সুপ্রিয়র সার্ভিস (সিএসপি) কেডারে যোগদান করেন। প্রায় ৩০ বছর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সর্বত্র তিনি সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৫৮ সালে রাজশাহীতে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের যুগ্ম অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গঠিত প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। এই কর্মবীর মানুষটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO), এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকে (ADB) বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন একাধিকবার। এমনকি অবসর গ্রহণের পরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে তার মধ্যে WORLD BANK, UNDP অন্যতম।

১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত শিল্প সচিব ১৯৭২-১৯৭৩ পাট সচিব ১৯৭৪-১৯৭৫ এবং ১৯৮৭-১৯৮৯ ভূমি সচিব ১৯৮৬-১৯৮৬ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সচিব ১৯৯০-১৯৯১: পরিকল্পনা সচিব ১৯৯১-১৯৯৩। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে খন্দকার আসাদুজ্জামান একটি অবিস্মরণীয় নাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা জাতি চিরকাল তাকে স্মরণ করবে। সরকারি উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকেও মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালান।

মাত্র ৬০০০ টাকা নগদ তহবিল নিয়ে মুজিবনগর সরকারের অর্থবিভাগের দায়িত্ব নেন এবং সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেওয়ার পর তার মনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হয়, তিনি বুঝতে পারেন দেশের অবস্থা খুবই খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দেওয়ায় তিনি তখন নিশ্চিত হন, রাজনৈতিক দুর্যোগ অতি নিকটে। এই সময়, দেশে চলছে অসহযোগ আন্দোলনে বাঙালি জাতি যে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা লাভের আশায় তাতে তিনি একজন সচেতন নাগরিক ও একজন রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে কীভাবে ভূমিকা পালন করা যায় ভাবছিলেন তখন পরিস্থিতি ক্রমেই জটিলতার দিকে ধাবিত হতে দেখে তিনি আরও কিছু সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। এই বৈঠক হয় সালাউদ্দিন সাহেবের বাসায়। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সালাউদ্দিন, মুজিবুল হকসহ আরও বেশ কয়েকজন সিএসপি অফিসার। বৈঠকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।

১ মার্চ সংসদ অধিবেশন বন্ধ করে দেয় যা ৩ মার্চ হওয়ার কথা ছিল, বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ হতে ৬ মার্চ সারা দেশে হরতালের কর্মসূচি দেন। ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণে স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, যার কাছে যা আছে তাই নিয়েই প্রস্তুত থাকো, শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। শেষে বললেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’

ঢাকা, জয়দেবপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে এবং এমভি সোয়াতে অস্ত্র আনাতে পাকিস্তানি সরকারের কুমতলব সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ খন্দকার আসাদুজ্জামান তার নিজ জেলা শহর টাঙ্গাইলে চলে আসেন। সেখানে গিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২৪ মার্চ তার এক আত্মীয় ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে আসেন তার মাধ্যমে ঢাকা একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে জানতে পারেন। ২৫ মার্চ আলোচনা ভেঙে যায়।

টাঙ্গাইলে বসেই তিনি ঢাকার সব ঘটনার তথ্য পান। ২৬ মার্চ সকালেই তিনি টাঙ্গাইলের সব রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসেন এবং আগামী দিনের কর্মসূচি সম্পর্কে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ওই দিনই টাঙ্গাইল জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আর এই সংগ্রাম পরিষদের পরামর্শ দাতা হিসেবে খন্দকার আসাদুজ্জামানকে উপদেষ্টা নির্বাচিত করা হয়। তিনি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে ওই দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্য ঝড়ের বেগে বিভিন্ন স্থানে চষে বেড়ান, অস্ত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের জন্য ময়মনসিংহ যান। সেখানে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা রফিকউদ্দিন ভূইয়া, সৈয়দ আব্দুস সুলতান সহনবেশ কয়েকজন নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন জেলা প্রশাসকের বাসায়।

তিনি সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার চেষ্টা বেশ প্রশংসনীয়। তারপর তিনি জয়পুরহাট ও হিলি হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছে তিনি মালদা জেলার ডিসির সঙ্গে দেখা করেন এবং সংবাদ পান আরও কিছু নেতৃত্ব স্থানীয় নেতারা ভারতে আসছেন। তিনি কলকাতা গিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামরুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন। সরকার গঠনের বিষয়েও আলাপ-আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে নেতারা খন্দকার আসাদুজ্জামান ও নুরুল কাদের খানকে একটি সরকারের কাঠামো তৈরি করার দায়িত্ব দেন।

মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের অপরাধে সরকার খন্দকার আসাদুজ্জামানকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং তাকে ধরার জন্য ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তার সঙ্গে আরও ১২ জন সিএসপি অফিসারের ও বিচার করে একই মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদান করে। সঙ্গে সঙ্গে দণ্ডিত অফিসারদের সম্পত্তির ৫০ ভাগ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে খন্দকার আসাদুজ্জামানের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে চিরদিনের জন্য লেখা থাকবে।

রাজনীতি: ১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর বৃহত্তর গণমানুষের কল্যাণে কাজ করার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এ ক্ষেত্রে তিনি হয়ে ওঠেন গণমানুষের মধ্যমণি, বিশেষ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটি আশার আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখা দেন। সেই ১৯৭৩-এর পর থেকে ১৯৯১-এর জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত এই আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া ছিল।

স্বীয় যোগ্যতা ও বাবার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তিনি চলে আসেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে টাঙ্গাইল ২ গোপালপুর -ভূয়াপুর আসন থেকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘদিন পর আসনটি পুনরুদ্ধার করেন।

কারাবরণ : দেশের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকায় খন্দকার আসাদুজ্জামান তার বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হন একাধিকবার। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ৯২-এর ক ধারা বলে গভর্নর শাসন ও জরুরি ঘোষণার পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর পাকিস্তানিদের দোসর তৎকালিন খুনি সরকার তার ওপরও নির্মম খড়গ চালায়। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় চার নেতার সঙ্গে তাকেও কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।

অবদান: নিজ এলাকা দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার নানাবিধ অবদান আজ স্বীকৃত। মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সুবিদিত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও দেশের হয়ে কাজ করেছেন সুনাম ও সাফল্যের সঙ্গে। এলাকার উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা তার চাকরি জীবনের শুরু থেকেই। তিনি টাঙ্গাইলে বিশেষ করে গোপালপুর ভূঞাপুরের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা।

সন্তান : তার জ্যেষ্ঠপুত্র খন্দকার মাহবুব উজ্জামান ২০০৮ সালের ৭ মে তারিখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তিনি কম্পিউটার সায়েন্সের একজন উচ্চতর ডিগ্রিধারী ছিলেন। তিনি জেম নিট ওয়ারের এমডি ছিলেন। ছোট ছেলে খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল বিকম (অনার্স) এমকম করেন। তিনি বেশ কয়েকবার বিজিএমইএ-এর সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। বহুবার FBCCI প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী ঢাকা ক্লাবের দুইবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।

বড় মেয়ে অপরাজিতা হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ এমএ করেছেন। তিনি সংরক্ষিত মহিলা আসনের টাঙ্গাইলের এমপি। বড় মেয়ে অপরাজিতা হকের স্বামী বিশিষ্ট সাংবাদিক, একাত্তর টিভির সিইও মোজাম্মেল হক বাবু। ছোট মেয়ে তামান্না জামানের স্বামী কমিউনিটি ব্যাংকের এমডি ও সিইও মাশিহুল হক চৌধুরী। ছোট মেয়ে তামান্না জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে বিএসসি অনার্সসহ এমএসসি(ফার্স্ট ক্লাস) তিনি ১৯৯৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তিনি তখন মুজিবনগর সরকারি কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন।

তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার মিন্টু রোডের বাসায় এবং তার নির্দেশ মোতাবেক ১৯৯৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শুধু টাঙ্গাইল ২ গোপালপুর-ভূঞাপুরে নয়- সারা বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে, সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন, স্বাধীনতার চেতনার কথা বলেন, কি কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, কি কারণে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, জাতির জনকের কি স্বপ্ন ছিল,

অনেক সময় বক্তব্য দিতে গিয়ে এতটা আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন যে তার মনের অজান্তেই দুচোখ ছলছলে করে উঠত এবং এটা দেখে ওই সভারও অনেকেরই দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত বিশেষ করে জাতির জনকের পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা যখন বলতেন। দেশের স্বার্থে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানান। পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল ২ গোপালপুর-ভূঞাপুর থেকে দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ১৯৭৩-এর পর থেকে আওয়ামী লীগের এই আসনটি হাতছাড়া হয়েছিল, সেই আসনটি ১৯৯৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে আসনটি পুনরুদ্ধার করেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

পরবর্তীতে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। সাফল্যের সঙ্গে তিনি এই অর্পিত দায়িত্ব পালন করে প্রশংসিত হন। সাফল্যেরই নন্দিত নাম যেন মরহুম খন্দকার আসাদুজ্জামান। তিনি ২৫ এপ্রিল ২০২০ সালে ইন্তেকাল করেন। আমরা তার বিদেহি আত্মার শান্তি ও জান্নাত কামনা করি। আমিন।

লেখক: পরিবেশবিদ ও কলামিস্ট


তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সমীরণ বিশ্বাস

সূর্যের জ্বলন্ত রশ্মিতে যেন টগবগে আগুন ঝরছে। নিজের উত্তাপ শক্তিমত্তা জানান দিতে বিন্দুমাত্র ছাড় দিচ্ছে না শহর, গ্রাম, পথ-ঘাট, সড়ক-মহাসড়ক সবখানেই সূর্যের খরতা! পিচঢালা পথ যেন জ্বলন্ত উনন! জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা এ জীবন যেন ওষ্ঠাগত! গত কয়েক দিন, দেশজুড়ে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহে তেতে উঠেছে প্রাণিকুলও। বাতাসেও আগুনের ছটা। মৌসুমের প্রথম তাপপ্রবাহই চলতি মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। টানা কয়েক দিন ধরেই তাপমাত্রার পারদ চড়াই হয়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গায়। এখন থেকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড সীমান্তবর্তী এ জেলায়। তাপমাত্রার উত্তাপ ছড়িয়েছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে- যা অতি তীব্র দাবদাহ! এরই প্রভাবে কোথাও কোথাও গলে যাচ্ছে রাস্তার পিচ! দেশের অন্য জেলাগুলোও পুড়ছে খরতাপে। পশ্চিম-দক্ষিণ অঞ্চলে বয়ে যাচ্ছে ৪১ ডিগ্রি তীব্র দাবদাহ। দেশের অন্য জেলাগুলোও পুড়ছে অতি তাপপ্রবাহে। এদিকে প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে না পেরে অনেকেই অচেতন হয়ে পড়ছেন। দেখা দিচ্ছেন নানাবিধ রোগব্যাধি ও স্বাস্থ্য সমস্যা। তীব্র গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া কেউই বের হচ্ছে না ঘর থেকে। অনেকেই বের হচ্ছেন ছাতা নিয়ে। গরমে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন কর্মজীবীরা। আবহাওয়া অফিসের মতে দেশজুড়ে গরমের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে।

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটাকে মৃদু দাবদাহ বলে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে গেলে ধরা হয় মাঝারি দাবদাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে ধরা হয় তীব্র দাবদাহ চলছে। ঢাকায়, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে তীব্র দাবদাহ চলছে।

আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরসহ সারা দেশই আজ শ্যামল সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের অত্যন্ত অভাব; কিন্তু বিদেশে এমনটি হয় না। সেখানে নগর পরিকল্পনার সময়ে উদ্যান ও প্রান্তরের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়। সুতরাং মানুষকে বাঁচতে হলে তার আদিম জীবনের প্রতিবেশী গাছ-তরুলতাকেও বাঁচাতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে তাই বিজ্ঞানীরা রব তুলেছেন, পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে গাছ-তরুরাজির শ্যামল ছায়ায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে তাই বৃক্ষ রোপণের প্রয়োজনীয়তা আছে।

ঐতিহ্যের শহর ঢাকা। চার শ বছরের পুরাতন ঢাকাকে বলা হয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের নগরী। ১৩৪ বর্গ মাইলের এ শহরে বাস করে ১ কোটি ৪১ লাখ মানুষ। বর্তমানে জনসংখ্যা আরও অনেক বেশি। ধারণা করা হয় প্রায় ২ কোটির কাছাকাছি। প্রতি বর্গ মাইলে ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষের বসবাস বলা চলে এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। বিশ্ব ব্যাংক বলছে ২০৩৫ সাল নাগাদ জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লাখ হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাল, নদী, ডোবা, বৃক্ষ নিধন করে ঘর-বাড়ি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে ফলে পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। কমে যাচ্ছে সবুজের পরিমাণ।

জাপানের কিয়োটো ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন গবেষক ঢাকা শহরের সবুজ নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের মতে ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল ১২ %, ২০১৫ সালে ৮% এবং বর্তমানে ৬-৭%-এর বেশি না। ঢাকায় যত পরিমাণে গাছ কাটা হয় তার অল্প পরিমাণই রোপণ করা হয়। বৃক্ষ নিধনের ফলে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বত্রই এই একই চিত্র বিরাজমান।

প্রকৃতির এই আগুনঝরা তীব্র দাবদাহ বাড়িয়ে দিয়েছে; দেশজুড়ে বৈধ-অবৈধ ইটের ভাটা, শহর ও নগর অঞ্চলে মিল-কারখানা, শপিংমল, দোকান, মার্কেট, হোটেল-মোটেল, বাসাবাড়ি, সর্বক্ষেত্রে এসির ব্যবহার প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গিয়েছে। তারই সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরিকল্পিত বৈধ-অবৈধ ব্যাটারি, সিএনজি, ডিজেল, পেট্রোলচালিত গাড়ি, রিকশা, অটোরিকশা বিভিন্ন যানবাহন, যার প্রতিটি কর্মকাণ্ড তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কার্যকর প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন রকমের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহারের ফলেও প্রতিনিয়ত উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। দেশজুড়ে নদী-নালা,খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, ভরাটের যেন একটি মহোৎসব চলছে! এসব কর্মকাণ্ডই আজকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত তীব্র তাপপ্রবাহের জন্য দায়ী। আমাদের দৈনিক কৃতকর্ম সংবরণ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা কষ্টসাধ্য এবং চ্যালেঞ্জিং হবে। শুধু বৃক্ষ রোপণ করেই এই সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন করা কঠিন হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটগুলো ফসলের উপকারী পোকামাকড়ের অস্তিত্বকেও এখন হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে কৃষিতে নির্বিচারে রাসায়নিক ও কীটনাশক প্রয়োগ। যার ফলে এই অযাচিত কীটনাশক ফসলের মাটিতে মিশে মাটির কার্বন নিঃসরণকে বাড়িয়ে তুলছে; যার কারণে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে।

দাবদাহে কৃষি খাতে বিপর্যয়ের শঙ্কা ও করণীয়

তীব্র দাবদাহে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের কৃষি খাত। দিন দিন দেশব্যাপী তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। ৩৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা ধানের জন্য অসহনীয়, দেশে চলছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা! যা সার্বিক ধান উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় অন্তরায়! এই অতি দাবদাহে ধান ছাড়াও আম, কাঁঠাল, লিচু ও তুলাসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। ভুট্টা ও সোয়াবিন উৎপাদনেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তীব্র দাবদাহে ফল-ফসলের ব্যবস্থাপনা

বোরো ধানে হিটশক ( তাপজনিত ক্ষতি) বা গরম বাতাস (৩৫ ডিগ্রি C+) প্রবাহ হলে ধান চিঁটা হতে পারে। তাই জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি, কাইচথোড় (Panicle stage of rice) হতে ফুল ফোটা পর্যায় পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে। আম, কাঁঠাল এবং লিচুগাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত (৭ থেকে ১০ দিন অন্তর) সেচ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে গাছের শাখা-প্রশাখায় পানি স্প্রে করে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া যেতে পারে। এতে ফল ঝরে পড়া কমবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া মাটিতে রস ধরে রাখার জন্য সেচের পর গাছের গোড়ায় মালচিং দেওয়া যেতে পারে।

তীব্র দাবদাহে সবজি ফসলের ব্যবস্থাপনা

ফল এবং পাতাজাতীয় সবজির জমিতে আগামী এক সপ্তাহে মাটির ধরন বুঝে প্রয়োজনীয় দুই থেকে তিনটি সেচ ব্যবস্থা করতে হবে। জৈব সারের পানি ধারণক্ষমতা বেশি, সে জন্য জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। ফল এবং সবজির চারাকে তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য মালচিং ও সেচ নিশ্চিত করতে হবে। চলমান তাপপ্রবাহের কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিতে হবে।

তীব্র দাবদাহে প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা

প্রাণিসম্পদের তাপপ্রবাহজনিত পীড়ন (স্ট্রেস) সহনশীল করতে, গবাদিপশু, পোলট্রির ঘর শীতল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। গবাদিপশুকে দিনে একাধিকবার গোসল করিয়ে দিতে হবে অথবা পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। গবাদিপশুকে পানির সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ, ভিটামিন সি এবং গ্লোকোজ ইত্যাদি মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। দাবদাহের এই সময় গবাদিপশুকে ঘরে আবদ্ধ না রেখে গাছের বা প্রাকৃতিক ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। গবাদিপশুকে এই সময় শুকনো খড় না দিয়ে কচি সবুজ ঘাস খেতে দিতে হবে। অতি দাবদাহে খাবার কমিয়ে দিতে হবে। প্রচণ্ড গরমের সময় গবাদিপশুকে কৃমিনাশক, টিকা কিংবা প্রাণীর পরিবহন পরিহার করতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হলে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

তীব্র দাবদাহে মৎস্য সম্পদ বাঁচাতে ব্যবস্থাপনা

তুলনামূলক কম গভীরতার পুকুরে নতুন পানি যোগ করে গভীরতা কমপক্ষে ৫ ফুট করতে হবে যাতে নিচের পানি কিছু ঠাণ্ডা থাকে এবং মাছ সেখানে থাকতে পারে। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে পানির মধ্যে মাচা করে লাউজাতীয় গাছ লাগিয়ে পুকুরে ছায়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পুকুরের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ জায়গায় চারদিকে বাঁশের ঘেরাও দিয়ে কচুরিপনা/ নারকেলগাছের পাতা রাখা যেতে পারে। দিনের বেলায় রোদের সময় অর্থাৎ দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গভীর নলকূপ থেকে পানির সরবরাহ করে কমপক্ষে ৫ ফুট বা তার বেশি পানির উচ্চতা বজায় রাখতে হবে। সকালবেলায় শতকে ২০০-২৫০ গ্রাম লবণ বা ১০০ গ্রাম ভেট স্যালাইন গুলে পুকুরে ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। রাতের বেলায় এরেটর/ব্লোয়ার/মেশিন (পুকুরের পানিকে ফোয়ারা বা ঘুরনি তৈরি করে বাতাসের অক্সিজেনকে পানিতে দ্রুত মেশাতে সহায়তা করে) চালিয়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে অন্যথায় শতকে ১০ গ্রাম হারে অক্সিজেন ট্যাবলেট পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরের পানি স্বাভাবিক ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত পুকুরে খাবার সরবরাহ কমিয়ে দিতে হবে বা প্রয়োজনে সাময়িক বন্ধ রাখতে হবে। সকালে এবং সন্ধ্যার পর খাবার অল্প করে দিতে হবে। ভিটামিন-সি মিশিয়ে (৭-৮ গ্রাম/কেজি খাদ্যে) খাদ্যের সঙ্গে খাওয়াতে হবে তাপমাত্রা স্বভাবিক না হওয়া পর্যন্ত। এ সময় দিনের বেলায় মাছ/পোনা স্থানান্তর বন্ধ রাখতে হবে বা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। গত কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মারাত্মক দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। তাই আসুন আমরা সবাই সতর্ক হই এবং অন্যকে সতর্ক করি।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ


সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তোয়াব খান

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এম নজরুল ইসলাম

ইতিহাসের সাক্ষী তিনি। সেই কবে থেকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখছেন সময়ের বয়ে চলা ও পরিবর্তন। জন্ম ব্রিটিশ ভারতে। এরপর পাকিস্তানি শাসন পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ। সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেছেন। দেখেছেন একাত্তর। ধারণ করে চলেছেন একাত্তরের চেতনা। অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে, একজন বিপ্লবী কলম সৈনিক হিসেবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হতো তার ‘পিণ্ডির প্রলাপ’। তার জীবনকে কোনো মামুলি জীবন বলা চলে না। ইতিহাসের সাক্ষী হতে হতে তিনি আজ নিজেই তো এক ইতিহাস। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে নানা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এক মানুষ তিনি। তার জীবনখাতার পাতাগুলোও তো কম বর্ণিল নয়। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে তিনি এক উজ্জ্বল তারকা। সাংবাদিকদের সাংবাদিক তিনি এতে কোনো সন্দেহ নেই। পেশাগত জীবনে ছয় দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসে আজ তিনি নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। সব সময়ে সমসময়ের প্রতিনিধি। তাই যথার্থ আধুনিক। সেই আধুনিকতার প্রতিফলন তার পেশা ও ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পরতে।

একালের গায়ক নচিকেতার গানে আছে, ‘অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন/ শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন’। ৮৫ বছরের মুখর জীবনে মিডিয়ার মহীরুহপ্রতিম এই মানুষটির পথচলাও যেন অন্তবিহীন। ব্যক্তি জীবনে যেমন স্মার্ট আর স্টাইলিশ তিনি; তার লেখনীও তেমন নির্মেদ আর তীক্ষ্ণ। যদিও পাঠক হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তিনি লিখেছেন কম, লিখিয়েছেনই বেশি। আপাত গম্ভীর এই মানুষটিকে আবিষ্কারই করতে হয়। এই আবিষ্কারের আরেকটি গূঢ় কারণ হচ্ছে, তার জীবন তো কোনো মামুলি জীবন নয়। চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু যে পথের, তা আজও বহমান। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে নিজেকে সঠিক খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এ জন্যই তিনি সমসাময়িক। আধুনিক।

তিনি এক অসাধারণ গল্পকথক। অনুপুঙ্খ বলে যান আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। দীর্ঘ সময়ের প্রতিটি ঘটনা তার নখদর্পণে। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগই নেই। তার চেতনায় একাত্তর, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। সাংবাদিক হিসেবে তিনি পরিবর্তনগুলো যেমন দেখেছেন, তেমনি সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবেও দেখেছেন খুব কাছ থেকে। খুব কাছে থেকে স্বাধীনতার মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছেন। ১৯৭৩-৭৫-এ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুই বেছে নিয়েছিলেন তাকে। ছিলেন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের প্রেস সচিব। ১৯৮০-৮৭-তে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। পালন করেছেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বও।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার সাতক্ষীরার রসুলপুরে। পড়েছেন সাতক্ষীরার সার্ধশত বছরেরও বেশি পুরোনো পিএন (প্রাণনাথ) স্কুলে। স্কুলের পাট চুকিয়ে ঢাকায় কলেজে পড়তে আসা। বছর না ঘুরতেই ভাষা আন্দোলনে উত্তাল দেশ। ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় হলেন। এর পর থেকেই ভেতরে ভেতরে একটা পরিবর্তনের হাওয়া। অজান্তে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দীক্ষা। বদলে যায় জীবনের গতিপথও। ক্রমেই শিকেয় উঠছে পড়াশোনা। পেয়ে বসে বিপ্লবের নেশা। ১৯৫৩ সালে কেজি মুস্তফার সঙ্গে বের করেন সাপ্তাহিক জনতা। এর মধ্য দিয়েই হাতেখড়িও হয়ে যায় তার সাংবাদিকতা জীবনের। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন সংবাদে। ১৯৬১ সালে সংবাদের বার্তা সম্পাদক। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে। বার্তা সম্পাদক হিসেবেই। ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। সত্যবাক নামে দৈনিক বাংলায় শুরু করেন ‘সত্যমিথ্যা, মিথ্যাসত্য’ শিরোনামে বিশেষ কলাম। এ কলামে উঠে আসে একটি স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক চিত্র। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একেকটি মাইলফলক রচিত হয়েছে তারই নেতৃত্বে। প্রথম চাররঙা সংবাদপত্র এর মধ্যে একটি। ‘সবসময়েই পাঠকরাই আমার প্রাইমারি কনসার্ন’, এ কথা সব সময় বলেন তিনি। তার একমাত্র বই ‘আজ এবং ফিরে দেখা কাল’।

বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ‘সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান’ বলতে যা বোঝায়, তার শেষ সলতে তিনি। না, নিজেকে মানিক মিয়া কিংবা জহুর হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তুলনা করেন না কখনো। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ওরা যে-সাংবাদিকতা করেছেন, তার ধারে-কাছেও আমরা নেই।’ কিন্তু আমরা জানি, সাংবাদিক হিসেবে সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য কর্মজীবন তার। সম্পাদকদের সম্পাদক তিনি। দেশের সংবাদপত্র জগতের প্রিয়মুখ। ২০১৬ সালে একুশে পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে তাকে। একই বছর ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমি সম্মানিত ফেলো হিসেবে নির্বাচিত করেছে। অগ্রজপ্রতিম সাংবাদিক হিসেবে দেশের সব সংবাদকর্মীর মনে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনটিও তো জাতীয় প্রেস ক্লাবের এই আজীবন সদস্যের দখলে।

এই নির্মোহ-নির্লোভ মানুষটির নাম তোয়াব খান। নামটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র যে মানুষটির চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তাকে একবার দেখে ভেতরের মানুষটিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। আপাতগাম্ভীর্যের আড়ালে যে সংবেদনশীল মানুষটির বাস, তাকে আবিষ্কার করা সহজ নয়। এর জন্য সময় ও শ্রম দিতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তোয়াব খান নিজে কয়জনের কাছে উন্মোচিত করেছেন নিজেকে? গুরুগম্ভীর তোয়াব খানের আড়ালে যে স্নেহময় মানুষটি লুকিয়ে, তাকে কি তিনি প্রকাশ করেছেন সবার সামনে? তবে, আপাতগম্ভীর এই মানুষটির সাহচর্য যারা পেয়েছেন, তারা জানেন, ওই গাম্ভীর্যের খোলস খসে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না। আর সে কারণেই বলা যেতে পারে একজন তোয়াব খানকে আবিষ্কারই করতে হয়। এই আবিষ্কারের আরেকটি গূঢ় কারণ হচ্ছে, তার জীবন তো কোনো মামুলি জীবন নয়। চলমান এক ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনকালে শুরু যে পথের, তা আজও বহমান। নানা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটপরিবর্তন আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সঙ্গে নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে তিনি সময়ের সঙ্গে সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এ জন্যই তিনি সমসাময়িক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে ‘তোয়াব খান’ নামটি উচ্চারিত হয় পরম শ্রদ্ধায়।

অগ্রসর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন তিনি। বহুদর্শী মানুষটি নামের পেছনে ছোটেননি কখনো। অদ্ভুত আড়ালচারিতা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে লড়াই এখনো চলছে, সে লড়াইয়ে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তোয়াব খান।

আজ তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন তোয়াব ভাই। আপনার স্নেহছায়ায় আরও অনেকটা পথ হাঁটতে চাই আমরা।

লেখক: সভাপতি সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ


পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোতাহার হোসেন

পাহাড়, আর পাহাড়ের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া পানির ঝর্ণাধারা ও গাছগাছালির অপরূপ শোভায় প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা বান্দরবানের নৈস্বর্গিকতাকে গ্রাস করছে সহিংসতা এবং আতঙ্কের কালো মেঘে। বান্দরবানের রুমা, থানছিতে গত কয়েক দিন ধরে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র সহিংসতা, মসজিদে হামলা, ব্যাংক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের টাকা ও থানার অস্ত্র লুঠের ঘটনায় পাহাড়ের কোলে প্রকৃতির নৈস্বর্গিকতায় গড়ে ওঠা বান্দরবানের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ,আতঙ্ক বিরাজ করছে। বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন, তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরত দেখা দেয়। শঙ্কার মধ্যে সরকারের ঐকান্তিকতায় যৌথবাহিনী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবের নিরন্তর প্রচেষ্টায় পার্বত্য ঐতিহ্য বৈষাবি এবং বাংলা নববর্ষে বৈশাখী উৎসব, মুসলমানদের পবিত্র ঈদ উৎসবের সব আয়োজন সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি ঈদ, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে টানা সরকারি ছুটিকে কেন্দ্র করে ভ্রমণপিপাসু মানুষ এই তিন জেলার প্রকৃতির অপরূপ শোভামণ্ডিত এবং নয়নাভিরাম পর্যটন স্পট ভ্রমণ সীমিত আকারে হয়েছে। এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের শীর্ষমহল থেকে শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, আমাদের চৌকস সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগ অব্যাহত রাখা দরকার। তবে এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে দেশের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শান্তি রক্ষায় প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য ও সিদ্ধান্ত।

উল্লেখ্য পাহাড়ি জনপদ বান্দরবানে কেএনএফএর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুধু পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের জন্য নয় একই সঙ্গে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। প্রসঙ্গত গত ২ এপ্রিল সন্ধ্যার পর রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে হানা দেয় কেএনএফ। এ সময় তারা পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪টি অস্ত্র এবং ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক নেজামউদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ১৬ ঘণ্টা না যেতেই ৩ এপ্রিল দুপুরে একই সশস্ত্রগোষ্ঠী থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ১৭ লাখ টাকা লুট করে। পরদিন ৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে কেএনএফ। অবশ্য ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তাদের জেলে পাঠিয়েছে। চলছে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান। উদ্ধার হয়েছে অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজার; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেএনএফের সঙ্গে বান্দরবানের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির দফায় দফায় আলোচনার মধ্যে কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো? অন্যটি হচ্ছে: সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফেলতিতে রুমা ও থানচিতে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অবতারণা কি না- এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখা দরকার।

বিগত দিনে দেখা গেছে, যখনই পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো আর্থিক অস্ত্র সংকটে পড়ে তখন তারা নিজেরা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে, জড়িয়ে পড়ে। আর তখনই চাঁদাবাজি, লুঠরাজ ও সহিংসতায় লিপ্ত হয় এবং তখন তাদের শক্তি, সার্মথ্য, সক্ষমতা জানান দিতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিগত দিনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনায় এমনটি প্রমাণ হয়। যদি তাই না হয় তাহলে শান্তি আলোচনার আড়ালে কেএনএফ ব্যাংক, থানা লুঠ, মসজিদে হামলা করবে কেন? তারা অর্থ সংগ্রহে মনোযোগী হলো কেন? এ কারণে তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার পাশাপাশি শতভাগ সতর্কতা বজায় রেখে সংকট নিরসনে মনোযোগ দেওয়া দরকার ছিল; কিন্তু তা সম্ভবত করা হয়নি। কারণ থানা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় আগ থেকে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিলে হয়তো ব্যাংক লুঠ ও থানায় হামলা, অস্ত্র লুঠ ঠেকানো যেত। আর এ কারণেই রুমা ও থানছি এসব ঘটনাকে নিছক ‘ব্যাংক ডাকাতি’ বা ‘আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা’ হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এসব সহিংসতার মধ্য দিয়ে কেএনএফ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কাজেই এর নেপথ্যে তাদের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, আন্তর্জাতিক সংযোগ, আঞ্চলিক ও চীন-মিয়ানমারের ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে তা খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ এই নব্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে শুধু সাময়িক অভিযানে সুফল মিলবে না।

প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাহাড়ের বিবাদমান রক্তক্ষয়ী সংঘাত, সহিংসা বন্ধে আমাদের সেনাবাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। কারণ বিগত সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রয়েছে। এদিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ওই অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি ’ স্বাক্ষরিত হয়। পরে পার্বত্য শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ি জনগণের বিশেষ অবস্থান ও মর্যাদার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে পাহাড়ের রক্তাত্ত জনপদে প্রত্যাশিত শান্তি ফিরে আসে একই সঙ্গে পাহাড়ি বাঙালির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চলে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ।

অবশ্য ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি, র‌্যাব, বিজিবি, সেনাপ্রধান বান্দরবান সফর করে পাহাড়ি জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে কেএনএফ নির্মূলে সাড়াশি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও সেখানে অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযানে কেএনেএফের প্রধান নাথান বমের ঘনিষ্ঠ কেএনএফের ‘প্রধান সমন্বয়কারী’ চেওসিম বমসহ দুজন র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। এ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন এই তথ্য জানিয়েছেন।

অন্যদিকে, বম জনগোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন নাগরিক বলেছেন, চেওসিম বমের শ্যারণপাড়ার বাড়িতে কেএনএফ প্রধান নাথান বমের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার প্রধান সমন্বয়কারী শামীম মাহফুজের বৈঠক হয়েছিল। ২০২১ সালের শেষে ও ২০২২ সালের প্রথম দিকে এমন বৈঠক হয়। কারও কারও মতে তার বাড়িতেই কেএনএফের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী শারক্কীয়ার চু্ক্তি হয়েছিল। মাসিক তিন লাখ টাকার চুক্তিতে জঙ্গিদের কেএনএফ সদস্যরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল।

অন্যদিকে, কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয় গত বছরের মে মাসে। ওই কমিটির সঙ্গে গত ৫ মার্চ দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয় বেথেল পাড়ায়। শান্তি আলোচনার মধ্যেই ২ এপ্রিল বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে ও পরদিন ৩ এপ্রিল থানচির সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ১৭ লাখ টাকা, দুটি লাইট মেশিনগানসহ (এলএমজি) ১৪টি অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায় কেএনএফ সদস্যরা। পাশাপাশি সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তারা। পরপর দুই উপজেলায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী।

খবর অনুযায়ী কেএনএফ ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে তৎপরতা শুরু করে। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর আগেও গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। সেই আস্তানায় গত বছর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও কেএনএফের বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। সংশ্লিষ্ট মহলের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন কেএনএফকে কারা অস্ত্র সরবরাহ, অর্থ, বৈদেশিক সাহায্য দিচ্ছে। কাজেই কেএনএফকে অস্ত্র, অর্থ ও জনসমর্থন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। এটা করা না গেলে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অপূর্ণতা থেকে যাবে। তাই নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য বান্দরবানে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শান্তি আলোচনা ভেস্তে গেলেও সরকারের উচিত সংলাপের জন্য পথ উন্মুক্ত রাখা। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলের মানুষের মৌলিক চাহিদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের মতো সংগঠনের সঙ্গেও এদের যোগাযোগ আছে।

আগের মতো পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার স্বার্থে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিতে পারে। পাশাপাশি বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ তাদের নিয়মিত টহল, তল্লাশিতে নিয়োজিত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, যে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের যেন ক্ষতি না হয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি পাহাড়, বন, নদীনির্ভর। তাদের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, অধিকার সমুন্নত থাকলে কেএনএফের মতো কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অপতৎপরতা চালাতে সাহস করবে না। প্রত্যাশা পাহাড়ে শান্তি আসবে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।

লেখক: সাংবাদিক


আস্থাই আসল

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

মানুষ তার নিজের বোধ বিশ্বাসের বিশ্বে বাস করতে চায়। সে তার সব পদক্ষেপকে নিজের নিরীখেই যৌক্তিক ভাবতে ভালোবাসে। জগৎ ও সংসার সংক্রান্ত উপলব্ধি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো যার যেমন চিন্তাচেতনা তদানুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। মনসচক্রবালের চৌহদ্দীভেদে দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য হয়ে থাকে।

নৃতত্ত্ববিদ আর সমাজতত্ত্ববিদ যথাক্রমে পৌরুষ ও পরিবেশকে মানুষের বোধ বিশ্বাস সৃষ্টির নিয়ামক ভেবে থাকেন। উভয়ের মতবাদের মধ্যে বৈরিতা নেই- বরং পরিপূরকের সম্পর্ক আছে। অস্থি-মজ্জার সঙ্গে মিশে থাকা জাত্যাভিমানে এবং পরিবেশ প্রভাবের মেলবন্ধনে যে অয়োময় প্রতীতি গড়ে ওঠে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে তা ব্যষ্টি ও সমষ্টির সমাজকে গতিদান করে। সমাজ এগোচ্ছে না পিচুচ্ছে - ভাঙছে না গড়ছে তা শনাক্তকরণের কাজে নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিকের সমীক্ষা সমীকরণের বিকল্প নেই।

সবার ওপর মানুষ সত্য এ উপলব্ধিরও কোনো বিকল্প নেই। মানুষই নিজকে ও সবাইকে, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের অবয়বে সময়কে, পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণকে নিয়ন্ত্রণ করে। অবকাঠামো গড়ে যে সভ্যতা সংস্কৃতির বিকাশ সে ঘটায়, তার ধ্বংসের কারণও আবার সেই সৃষ্টি করে। মুক্তবুদ্ধি মানুষ যেমন দৃষ্টির প্রসারে আলোকিত হয়, অবরুদ্ধ চিন্তা-চেতনায় বন্ধ্যিত্ব বরণের ফলে অন্ধকারে ডুবে যাওয়াও তার ভাগ্যে ঘটতে পারে। ভালো পথ যাচাই ও গ্রহণ বর্জনের প্রশ্নটিও আদিকাল থেকেই অব্যাহতভাবে অমীমাংসিত আছে বলেই জীবন ও সমাজ গতিশীল। বৈধ-অবৈধর প্রতি আসক্তি ও আকর্ষণের তারতম্যের মধ্যে সমাজের পরিবেশ-পরিচয় প্রকাশ পায়।

সৃজনশীলতা মানুষের অন্যতম ধর্ম। প্রকৃতির অপার সম্পদ ও সৌন্দর্যকে রূপান্তর ও বহুমাত্রিক ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে মানুষ তার মেধা ও মননকে কাজে লাগায়। মানুষের মধ্যে যে সুকুমার বৃত্তিগুলো সৃজন সম্ভাবনায় উন্মুখ হয়ে আছে উপযুক্ত পরিবেশের পরিপোষক সমর্থনে ফল্গুধারার মতো তা বেরিয়ে আসতে পারে। এখানেও সৃজনশীলতা গঠন ও ধ্বংসের উভয়পর্যায়েই হতে পারে। সৃজনশীলতা গঠন না ধ্বংসের তা নির্ভর করে পরিবেশের প্রযত্ন প্রয়াস ও চাহিদার ওপর। ঘটনার প্রকৃত কারণ নিহিত থাকে নেপথ্যে। যার দ্বারা ঘটনা ঘটে সে উপলক্ষ মাত্র, যে কারণে ঘটনা ঘটে কিংবা যে ঘটনা ঘটায় সেটিই মুখ্য। ভাড়াটিয়া খুনিকে দোষী সাব্যস্ত করার পাশাপাশি কার দ্বারা এবং কেন খুনি ভাড়া করা হলো তার যথাযথ হদিস হওয়া বাঞ্ছনীয় সমস্যার প্রকৃত নিষ্পত্তির লক্ষ্যেই। নইলে সমাজের নৈতিক ভারসাম্য আর মূল্যবোধের প্রতি আস্থার ভিত্তিতে ধরতে পারে ভাঙন। এটা প্রকৃতির অমোঘ বিধান যে- অন্যায়-অনিয়মের পরিবেশ সৃষ্টিকারী ও ইন্ধনদাতা অন্যায়কারীর চেয়ে বেশি দায়ী। একে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই- কেননা প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘনকারীর অনিবার্য পরিণতিও অলঙ্ঘনীয়। কার্যকারণ ছাড়া কোনো কিছু যেমন ঘটে না তেমনি কোনো ক্রিয়াই প্রতিক্রিয়াহীন থাকে না।

মানবকল্যাণ কামিতার আদর্শ সময় ও সমাজভেদে নানান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে থাকে। মানবকল্যাণধর্মী মূল্যবোধের বিকাশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত জরুরি, শত বাধা-বিপত্তি সংশয়-সংকট সন্ধিক্ষণেও সত্য-সুন্দরের সনাতন উপলব্ধি থাকবে জাগ্রত। বিভ্রান্তির বেড়াজালে শাশ্বত মূল্যবোধ হারিয়ে যাবে কি না কিংবা নিরুদ্দিষ্ট হবে কি না তা নির্ভর করে ব্যষ্টি ও সমষ্টির আকাঙ্ক্ষার আকৃতি আর সজাগ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃতির ওপর। জনকল্যাণের নামে, সংস্কারের নামে কুশাসন-শোষণ মুক্তির নামে নানান মতবাদ-উপায়-উপলব্ধির অবয়বে শাশ্বত মূল্যবোধের ভাঙাগড়া চলে। শুভ উদ্যোগে বিশ্বাস ও প্রত্যয় হয় সুদৃঢ়। আত্মমর্যাদাবোধের বিকাশ আর কল্যাণকামিতায় আসে প্রাণ প্রাচুর্য। পক্ষান্তরে ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তাচেতনা দ্বারা তাড়িত পদক্ষেপে সৃষ্ট হতবাক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেয় সব ক্ষেত্রে। বিশ্বাস আর আস্থায় ধরে ভাঙন। মানুষ বিশ্বাসের বিশ্বে নিরাপত্তা নির্ভরতায় বাস করতে চায়। আস্থা নিজের প্রতি, সমাজের প্রতি অতীব প্রয়োজন। আস্থার অবর্তমানে কিংবর্তব্যবিমূঢ় ব্যক্তি সমাজে জগদ্দল পাথর হয়ে দাঁড়ায় এবং কিয়ৎকাল পরে তার চলৎশক্তির গতিধারায় ঘটতে পারে অশুভ দিকপরিবর্তন। নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাফিক যেমন পদে পদে কারণে-অকারণে অহেতুক যানজটের হেতুতে পরিণত হয়। অসহিষ্ণুতা আর পারস্পরিক দোষারোপের বেড়াজালে সহযোগিতা সহমর্মিতার মেলবন্ধন হয়ে পড়ে সুদূর পরাহত। রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি যেমন বহু রোগ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে, আত্মস্বার্থ উদ্ধারের ভেদবুদ্ধি প্রবল হলে ব্যষ্টি ও সমষ্টির সর্বনাশের সঙ্গে নিজের সর্বনাশও যে জড়িত- এ উপলব্ধিটাও হারিয়ে গেলে সমূহ বিপদ।

সমাজে নানান উপায় ও উপলক্ষে এমন সব ঘটনাবলির উদ্ভব হয় যা সমাজের গতিপ্রকৃতির দিকনির্দেশ করে। গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে সমাজ সমৃদ্ধ হয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের দ্বারা বিজ্ঞান ও সভ্যতার অনেক সুযোগ সহজে হাতের কাছে এসে যায়- ধ্যান-ধারণায় তা যেমন নতুন মাত্রা যোগ করে, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠান ক্ষেত্রেও সূচিত হয় নানান সুযোগ। শোষণ বঞ্চনা বৈষম্যের অবসান ঘটাতে মানুষ সংগ্রাম করে- শোষণহীন বঞ্চনা বৈষম্যরহিত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায় বুক বাঁধে। প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে দেখলে সংগ্রামের সার্থকতা সে খুঁজে পায়, উদ্দীপ্ত চেতনায় দীপান্বিত হয়ে ওঠে। তার এবং সবার ঐকান্তিক প্রয়াস প্রচেষ্টায় উন্নয়ন ও সংহতি সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণের পরিতৃপ্তিতে তুষ্ট জনগোষ্ঠীকে কোনো বাদ বিসংবাদ বিভ্রান্ত করতে পারে না। আগে যেমন বলা হয়েছে- মানুষ তার কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা খুঁজে ফিরে নিয়ত নিজের নিরীখে। যদি দেখা যায় ক্ষুদ্র ও খণ্ডিত স্বার্থবাদিতায় নানান বিভ্রান্তি ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে তার আত্মত্যাগের মহৎ উদ্দেশ্যগুলো তা হলে তার সক্রিয় অংশগ্রহণের যৌক্তিকতার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য-অভিপ্রায়ের, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ানের আঙিনায় অপব্যাখ্যার আগাছা জন্ম হয়। প্রয়োজনে অনুরূপ সে আগাছা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের চলৎশক্তির জন্য সেটা এক দারুণ দুঃসংবাদ।

অথচ ব্যষ্টি ও সমষ্টির মধ্যে নিয়ত এ প্রয়াস প্রত্যাশিত থেকে যায় যে তীব্র প্রতিযোগিতাময় প্রাগ্রসরমান বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে তালমিলিয়ে তুলনামূলক সমৃদ্ধি অর্জনের। এটা অত্যন্ত জরুরি ও প্রয়োজন, প্রতিনিয়ত সফলতা-ব্যর্থতার খতিয়ান পর্যালোচনা, ভুল পদক্ষেপকে শনাক্ত করে শ্রেয়তর পদক্ষেপ গ্রহণের ঐকান্তিকতার পরিপোষণ এবং বিভ্রান্তি ও বিভক্তি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র প্রশ্রয় পেয়ে যাতে উন্নয়নের ধারায় বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র একসূত্রে গাঁথা এবং তার বর্তমান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যমণ্ডিত অতীতকে সফল বর্তমানে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে পারলেই তা সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের সোপান হিসেবে স্বীকৃত হবে। আজকের বর্তমানও এক দিন ইতিহাসের বিবেচ্য বিষয় হবে। সব সময় অতীত বন্দনা ও প্রতিষ্ঠায় দৃষ্টি ও মনোযোগ নিবদ্ধ থাকলে বর্তমানের কী হবে? কোন পরিচয়ে বর্তমান ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে সে বিবেচনাও যথেষ্ট জরুরি। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই বর্তমানকে বিনির্মাণ প্রয়াস প্রচেষ্টার দ্বারা সোনালি ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সার্থক হতে পারে।

অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্র নির্বাচন ও পন্থা নির্ধারণেও সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। অতীতের উদাহরণ এনে বর্তমানের ভুল-ভ্রান্তিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টার চেয়ে আত্মঘাতী প্রতারণা আর নেই। গুড প্রিসিডেন্স বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে সমৃদ্ধ হতে যতখানি সহায়তা করে ব্যাড প্রিসিডেন্স তার চেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতীতেও এমনটি করা হয়েছে এই বলে যদি বর্তমানের অপকর্মের যৌক্তিকতা দাঁড় করানো ও সাফাই বন্দনা শুরু হয় তাহলে গঠনমূলক মূল্যবোধের বিকাশকে অসম্ভবই শুধু করে তোলা হবে না, চক্রবৃদ্ধি হারে তার মাশুল গুণতে হয় অতীতের মতো ভবিষ্যৎকেও। অথচ কথা ছিল ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’

৫৩ বছরে পা দেওয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে এই সময় ও সমাজে বয়স, বর্ণ, পর্যায় ও প্রকারভেদে নানান কিসিমের মানুষ এখনো রীতি-পদ্ধতি, নীতি ও নিয়মে ঔপনিবেশিত। শ্রমজীবী কর্মক্লান্ত মানুষের পাশাপাশি অতি চালাক ফিটফাট ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও কর্মী, শিক্ষাবিহীন শিক্ষিতের সমারোহের পাশে প্রযুক্তি প্রখর মেধাবী মুখ, মুক্তবুদ্ধি শান্ত সমাহিত চিন্তাচেতনার সারিতে সহসা মৌলবাদী চেহারার মানুষ, উন্নয়নকর্মীর পাশাপাশি নিজের আখের গোছাতে তৎপর এনজিও কর্ণধার, সন্ত্রাসীর ভয়ে আতঙ্কিত মানুষ, চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী আত্মোৎসর্গীকৃত সেই পুলিশ সার্জেন্ট, ষড়যন্ত্রের শিকার গৃহহীন মানুষ, খবরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে হাসিমুখের মানুষের পাশাপাশি বানভাষী মানুষ, নিঃস্বার্থ ত্রাণকর্মীর পাশে সুযোগসন্ধানী- অসৎ উদ্দেশ্য অভিলাষী চোখের মানুষ, কোণঠাসা সৎ ও নিষ্ঠাবান চাকুরে, ধান্দাবাজ আর আত্মস্বার্থের শর্করা সমৃদ্ধ জনস্বার্থসেবী আমলা, অবিবেচক বাসের হেলপার, ট্রাকের মাতাল ড্রাইভার, নীল, সাদা অধ্যাপক, একচোখা আতেল, রাজনৈতিকশিল্পী, ঋণখেলাপি, ব্রিফকেসবাহী নতুন শিল্পপতি, নকল সরবরাহকারী, উদ্ধত ছাত্রনেতার সামনে অসহায় অধ্যক্ষ, জামিনপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী, কুকুরের মাংস বিক্রেতা আর অ্যাসিডে দগ্ধ তরুণীর দেশে সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটার।

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক


হাড়ে হাড়ে বুঝছি, উষ্ণায়ন কী? 

প্রতীকী ছবি
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
লিয়াকত হোসেন খোকন 

যত দিন যাচ্ছে, আমরা যেন হাড়ে হাড়ে বুঝছি, উষ্ণায়ন কাকে বলে। উষ্ণায়নের গ্রাসে পৃথিবী তলিয়ে যাওয়া এক প্রকার নিশ্চিত। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান সেই মতকেই প্রবল সমর্থন জোগাচ্ছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের আবহাওয়া-সংক্রান্ত রিপোর্টে যেমন স্পষ্ট হয়েছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে রেকর্ড হারে। সেই হার এতটাই বেশি, ২০২৩ সালটি উষ্ণায়নের পুরোনো সব রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা গত বছরে গড়ে প্রায় ১.৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।

২০১৫ সালে প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো সম্মিলিতভাবে স্থির করেছিল পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রিতে আটকে রাখার। এটাই বিপদ-মাত্রা। ফেলে আসা বছরটি দেখিয়ে দিল, পৃথিবীর এই বিপদ-মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে।

এমনটা যে অপ্রত্যাশিত, তা নয়। দীর্ঘ দিন ধরে একটু একটু করে জলবায়ু পরিবর্তনের চিহ্নগুলো স্পষ্ট হয়েছে। প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনগুলো তো বটেই, অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চেরও মূল আলোচ্য হয়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার ক্ষতিকর প্রভাব ঠেকাতে সম্ভাব্য পথগুলো।

জলবায়ু পরিবর্তন কোনো একটিমাত্র দেশের নিজস্ব সমস্যা নয়, সুতরাং প্রতিরোধের পথগুলোও ঐকমত্যের ভিত্তিতে একযোগে নেওয়া প্রয়োজন; কিন্তু এত দিন ধরে এত অর্থ ব্যয়ে যে আলোচনা, প্রতিশ্রুতি পর্ব চলে এসেছে, তা একটি বৃহদাকার অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে মাত্র। কার্বন নিঃসরণের মাত্রার দ্রুত হ্রাস এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্পগুলোর ওপর অধিক গুরুত্বারোপ উষ্ণায়ন প্রতিরোধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে বিভিন্ন সময় ধার্যও করেছে বিভিন্ন দেশ; কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাপেক্ষে সেই লক্ষ্যমাত্রাও ক্রমশ অধরা মনে হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির এমন হার অব্যাহত থাকলে ইতোমধ্যেই যে বিপুল জলবায়ুগত পরিবর্তনের আশঙ্কা, তার মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত সময় হাতে থাকবে তো?

উন্নত দেশগুলো তাদের অর্থ এবং পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জোরে যে দ্রুততায় কার্বন-শূন্য লক্ষ্যমাত্রার দিকে যেতে পারে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পক্ষে তা অর্জন করা কঠিন।

পৃথিবীর অনেক দেশই এখনো কয়লার ওপর অতি নির্ভরশীল। পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উপযোগী পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তার জোগান আসবে কোথা থেকে?

উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপানির তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। দ্রুততর হচ্ছে হিমবাহ গলনের প্রক্রিয়া। ক্রমশ বাড়ছে সমুদ্রপানির উচ্চতা। বিপদের মুখে অগণিত উপকূলবাসী। বিপদ অন্যত্রও। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বৃদ্ধি পেলে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আগামী দিনে বাড়বে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট। খামখেয়ালি আবহাওয়ায় কৃষিকাজ ব্যাহত হলে আগামী দিনে খাদ্যসংকট ঘনীভূত হবে। এর কোনো কথাই কিন্তু নতুন নয়। প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসের বাইরে বিশ্ব কোনো কার্যকর পথের সন্ধান দিতে পারল না, সেটা উষ্ণায়নের চেয়ে কম উদ্বেগের নয়।

বিশ্ব উষ্ণায়ন শব্দ দুটো কয়েক বছর আগেও আমাদের কাছে অচেনা ছিল। মাঝেমধ্যে কথাটা শুনতাম। মানে বুঝতাম না। ভাবতাম, এটা বোধহয় বিশেষজ্ঞদের ব্যাপার। আমাদের না বুঝলেও চলবে! অবশেষে তাই বুঝতে হলো, উষ্ণায়ন কী, হাড়ে হাড়ে বুঝছি আজ।

পানিও ফুরিয়ে আসছে-

ভূ-গর্ভের পানিও এখন ব্যাপকভাবে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে ভূ-গর্ভের পানিও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ভূ-গর্ভের পানিতেও আর্সেনিক ইত্যাদি বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। ফলে ভূ-গর্ভের পানিও এখন আর সুপেয় নয়।

কাজেই ভূ-পৃষ্ঠ এবং ভূ-গর্ভের পানি সংরক্ষণের এবং পানি ব্যবহারে মিতব্যয়িতার এখন বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো এ জন্য বিশেষ বৈজ্ঞানিক কৌশল অবলম্বন করছে। এ ছাড়া ব্যবহৃত পানিও শোধন করে পুনর্ব্যবহার যোগ্য করে তোলার এখন বিশেষ প্রয়াস শুরু হয়েছে।

আমাদের দেশে বিশেষ করে পানি সংরক্ষণ, পানি পুনর্ব্যবহার যোগ্যকরণ ইত্যাদি প্রকল্প তো দুরস্ত, এখনো ৭০ শতাংশ মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে পারেনি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চল, দুর্গম পাহাড়ি, গ্রামাঞ্চল ইত্যাদি এলাকার মানুষ খাল, বিল, নদী-নালার দূষিত পানি পান করেই নানা অসুখ-বিসুখ সঙ্গে করে জীবনধারণ করে আছে।

ঘুম থেকে ওঠার পরই প্রথম প্রয়োজন পানীয়জল। বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও শুধু সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে এবং দুর্নীতির জন্য সেই বিশাল পরিমাণ টাকার অপচয় হয়ে আসছে স্বাধীনতার পর থেকেই। পানি সম্পদ প্রকল্পের নামে প্রচুর টাকা বরাদ্দ হলেও চাহিদা বিন্দুমাত্র মিটছে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া মানুষ, জীবজন্তু, গাছ বাঁচতে পারে না। শুধু বাঁচার প্রশ্নই নয়, পানিছাড়া সম্পূর্ণভাবে জীবনযাপনই অচল হয়ে পড়ে। কৃষিতে প্রধান অবলম্বন পানি। সেই পানির অভাবের সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তায় মানুষ।

ভূ-পৃষ্ঠের পানি খুব শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে। বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানীয়জল ভূ-পৃষ্ঠে দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। নদী, নালা, খাল, বিলে যে পানি রয়েছে তাও চরমভাবে দূষিত। দুর্গম ও গ্রামীণ এলাকার মানুষ নদী-নালার দূষিত পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ ছোট-বড় নদীর পানিই দূষিত ও বিষাক্ত। এই বিষ ক্রমশ বাড়ছে। নদী-নালা-খাল-বিল ইত্যাদির দূষিত পানি কৃষি কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদনেও খুব দ্রুত মিশে যাচ্ছে বিষাক্ত নানা রাসায়নিক। খাদ্যসহ ওইসব কৃষি উৎপাদন খেয়েই মানুষ দৈনন্দিন জীবন ধারণ করছে। এর ফলে সারা বিশ্বেই নিত্য-নতুন নানা অসুখ-বিসুখের প্রভাব ঘটছে।

এদিকে বিশ্বজুড়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রকাশ, আগামী অর্ধশতকের মধ্যেই ভূ-পৃষ্ঠের এই দূষণমুক্ত পানিও ফুরিয়ে যাবে। আবহাওয়ার পরিবর্তন, উষ্ণায়ন ইত্যাদি এর কারণ। তখন মানুষের কী হবে?

লেখক: পরিবেশবিদ ও চিঠি বিশেষজ্ঞ


হুম সাহিত্য-নির্ঘুম জীবন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রাজীব কুমার দাশ

মানুষ কেন! প্রাণীকে কোনোকিছু শিখিয়ে দিতে হয় না। বংশগতি সংরক্ষণ ও বাঁচার প্রয়োজনে সে সব কিছু শিখে নেয়। হোক সেটা সংঘর্ষ শান্তি, শ্রান্তি, বিনোদন, দারিদ্র্য বিমোচন।

অনলাইনে পড়ালেখা, সিনেমা নাটক প্রেম, বিরহ, সংসার, চাকরি; পাতি নেতা, বড় নেতা হওয়ার বাসনা, রান্না, কান্না, খুড়ি, আপু হয়ে ধর্মগুরুর উপদেশ রিল; ইউটিউবার সেলিব্রেটি হতে দেখা উপলব্ধি নিয়ে মানিকনগর গ্রামের বেকার যুবক সাকলাইন নারী-পুরুষ স্বাবলম্বী হতে অনলাইন হাতেখড়ি স্কুল খুলে দিলেন। চ্যাট অপশনের শত শত সাংকেতিক ইমোজি স্টিকার হাসি, কান্না, ঘৃণা ভাষা রপ্ত করেন। মুখ বেঁকিয়ে গাল ফুলিয়ে কোমর নিতম্ব সাপের মতন দুলিয়ে দুর্দান্ত রিল ব্যবসায়ী হতে রিচলিত স্খলিত শরীরী ভাষা প্রশিক্ষণ দিতে লাগলেন। ‘হুম’ শব্দের প্রায়োগিক দুর্দশা নিয়ে হাতে-কলমে ইশারা তালি তালিম মিশেল ভাবনায় রয়ে-সয়ে একাকার জীবন গড়ে নিলেন। মানিকনগর বর্ধিষ্ণু গ্রামের সরল-গরল ঘরানা মানুষের চিত্র-বিচিত্র রংধনু মনের রং, ঢং, সঙ, জীবন ধীরে ধীরে ক্ষীয়মাণ হতে হতে হুম সাহিত্যে হাত পাকিয়ে- পাস্তুরায়ন নিরুপদ্রব অন্তর্জাল জীবন সাহিত্যে যে যার মতন একা একা ইমোজি স্টিকার জীবন বেছে নিলেন।

মানিকনগর গ্রামে চা দোকানের বাগড়া-ঝগড়া, বিবাদ, মারামারি থেমে গেল। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হাট-বাজার হয়ে গেল- রাক্ষস-খোক্ষসপুরী। সবার কানে কানে লাগানো ব্লুটুথ হেডফোন। নেই হাঁকডাক চিৎকার-চেঁচামেচি, অট্টহাসি কোলাহল। গাজীপুর পুবাইল সিনেপাড়ার শুটিং স্পট ভাড়াটে উপকরণ ঘরবাড়ি জমিজিরাত বউ-বাচ্চার মতন পাল্টে গেছে এখানেও রাতারাতি মানুষের জীবনাচার। নতুন করে হাতেখড়ি জীবনাচারের সুফল পেতে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে কিছুদিন। তবে এটা ঠিক, বর্তমান হয়ে আগামী দিনের ফেসবুকীয় শুদ্ধাচার সবাই মেনে নেন। মানিকনগর গ্রামের মানুষজন এখন পারতপক্ষে কথা বলেন কম। মৌনতা বাড়িয়ে দেয় দীর্ঘজীবন,- রহস্য জেনে কুশল বিনিময়েও তারা সংহত সংযত। দরিদ্র্যতা একমাত্র নরক অভিশাপ জেনে তারা পারতপক্ষে ফেসবুকীয় মনিটাইজেশন শুদ্ধাচারের বাইরে হাঁটেন কম।

এবারের এমপি প্রার্থী মানিকনগর গ্রামের চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন। ফেসবুকীয় মনিটাইজেশন দয়াপানে তাকিয়ে কোনোমতে সংসার চালান। ফেসবুক আছে যার পৃথিবী তার, মুখে স্লোগান হাতে বুড়ো আঙুল ঘষে ঘষে পরশুরাম লাঙল চষে বেড়ান -আট ইঞ্চি চার ইঞ্চি টাচ স্ক্রিনে।

গর্ব করে চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন বলেন- এ ব-দ্বীপের আলম, আদম, রতন, স্বপন, মুরগি-ছাগল চোর, কলম চোর, প্রজেক্ট চোর, ছেচড়া প্রতারক বাটপার যেখানে এমপি হয়ে টেবিল চাপড়ে ভিআইপি হতে পারেন; পুলিশ পাহারায় সাইরেন বাজিয়ে পুলিশ পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দিতে পারেন; সে তুলনায় আমি তো ভিআইপি প্রার্থী। কারোর টাকা মেরে খাইনি, দেশের টাকা পাচারের বদনাম নেই, সন্ত্রাস করিনা, দখল বে-দখলে রাখিনি ব্যক্তিগত কিংবা সংখ্যাগুরু লঘু কারোর সম্পদ কিংবা সম্পত্তি। কারোর বউ, মেয়ে ভাগিয়ে বিয়ে করিনি। নারী নিয়ে লটর-পটরের বদনাম নেই। নাচি, গাই, খাই, দাই, এটা-ওটা দেখাই। বানরের মতন লম্পঝম্প দিয়ে ফরেন টাকা ডলারে আনি। দেশের মান-ইজ্জত রুজি-বরকত বাড়িয়ে দিয়েছি সোমালিয়া জলদস্যুদের মতন কয়েকগুণ বেশি। সোমালিয়া নৌবাহিনী সদস্যরা যেমন সরকারি চাকরি শেষে রিটায়ার্ড করে জলদস্যু টিমে কাজ করেন; আমিও আগামী বছর পাঁচেক পরে ফ্রিল্যান্সিং পেশা বেছে নিতে পারব।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়ন পরীক্ষা জিতে হুম স্টিকার প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে জনমত জরিপে চৌধুরী ময়েজ উদ্দিনের পক্ষে ইউটিউবার অপু ভাই রাঁধুনি শেফালি খালা ভাড়াটিয়া জিহ্বাস্ত্র নিয়ে সেফুদার আকাশচুম্বী স্বপ্ন দেখানো ভোট বিজ্ঞাপন যুদ্ধে ইউটিউবার এমপি প্রার্থী চৌধুরী ময়েজ উদ্দিনই এগিয়ে রইলেন। সবার দেওয়া এটা-ওটা প্রতিশ্রুতি বিজ্ঞাপন যুদ্ধের ডামাডোলে চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন অনলাইন অফলাইনে বললেন, - প্রিয় মানিকনগর কাঞ্চননগর পাইন্দং বেড়াজালী রাঙ্গামাটিয়া নিবাসী, যদি এমপি পদে নির্বাচিত হতে পারি; ইন্টারনেট সেবা ফ্রি পাবেন। সার-কীটনাশক ফ্রির পাশাপাশি মাঠে-ঘাটে সিনেমা-নাটক দেখবেন, ভিডিও কলে কথা বললেন মন চাইলে প্রেম করবেন। পরিবারের সবাইকে চোখে চোখে রাখবেন।

চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন প্রতিশ্রুতি প্রতিজ্ঞা বিজ্ঞাপন দিয়ে বাজিমাত করে সবার মন জিতে এমপি চেয়ারপানে অপেক্ষা করতে থাকেন। মেম্বার হতেও যেরকমের উতলা টেনশন কাজ করে; তার চেয়েও সহজ মনে চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন বিপুল ভোট পেয়ে এমপি হয়ে গেলেন। ছোটখাটো কালভার্ট ব্রিজ অনলাইনে উদ্বোধন করেন। উপজেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিং নিয়ে ওসি উপজেলা চেয়ারম্যান ইউএনও নিয়ে আমিত্ব অহঙ্কার নেই বললেই চলে। নিজেও সরকারি কাজের বাইরে অনলাইনে আয় করেন। পার্থক্য এটুকুন, সরকারের টাকা নয়ছয়
করেন না।

চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন- মার্কিন লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সে বিখ্যাত উক্তি- সুযোগ ও পার পেয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা থাকলে সবাই খারাপ ব্যবহার করেন; নিয়ে বেশ সতর্ক ও সংযত। সে সুযোগ পারতপক্ষে এমপি সাহেব কাউকে দেন না। যথারীতি এমপি চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন নিজ এলাকায় হুম অনলাইন হাতেখড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। হুম একাডেমি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দিকে দিকে হুম প্রেম হুম বিচ্ছেদ নির্ঘুম জীবন গতিধারা গড়ে হুম সাহিত্যে- রাতারাতি প্রথাবিরোধী এমপি অমরত্ব এনে দেন।

চিরকালই মানুষ চেয়েছে সুখ-শান্তি। জাগতিক সুখ-দুঃখের বাইরে একমাত্র প্রথাবিরোধী হাতে গোনা কজন ছাড়া হেঁটেছেন কম। লাখো মানুষেতেও প্রথাবিরোধী মানুষ নেই বললেই চলে। তাই তো মানুষের কাছে সুখের বিপরীতে সম্পর্কের গুরুত্ব কম। শখ সুখ আয়েশী জীবনের বিপরীতে মানুষের নির্ঘুম জীবন। হোক না বাবা-মা, সন্তান, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বকীয়া-পরকীয়া অজাচার নিষিদ্ধ সম্পর্ক বন্ধু সুজন-কুজন। যেকোনো প্রকারেই হোক না কেন মানুষের সুখ চাই। সে অয়োময় মরীচিকা সুখের খোঁজে মানুষ সময়ের সঙ্গে গা ভাসিয়ে হয়েছেন, যুগে যুগে দেশান্তরী সুখান্তরী। সুখের ধ্রুপদী মহোৎসবে কেউ হয়েছেন মহারাজ সম্রাট; কেউবা পিছিয়ে পড়ে হয়েছেন নিষণ্ন নিষাদী।

সংসদ অধিবেশন সপ্তাহখানেক ধরে মুলতবী। এমপি হোস্টেল ছেড়ে চৌধুরী ময়েজ উদ্দিন নিজের এলাকা পরিদর্শন করতে যাচ্ছেন। হুম হুম অধিবেশন স্পিকার মুখে হুম হুম জয়যুক্ত হয়েছে টেবিল চাপড়িয়ে এরই মাঝে দেশ-বিদেশের ভাইরাল মুখ ময়েজউদ্দিন। এমপি হয়েও ফেসবুকীয় শুদ্ধাচার মনিটাইজেশন সাহিত্যের বাইরে পারতপক্ষে যেতে চান কম। ফ্রি ইন্টারনেট পাওয়ার পরে রাতারাতি পাল্টে গেছে মানিকনগর গ্রামের হালচাল।

কেউ কারোর সঙ্গে মেসেঞ্জার হোয়াটসঅ্যাপ টেলিগ্রাম ছাড়া পারতপক্ষে অধরওষ্ঠ এক করে কথা বলেন কম। বিয়ে-শাদি কনে দেখা হয়ে প্রেম-বাসর দেন-দরবার পর্যন্ত ফেসবুক রিল মনিটাইজেশন বাণিজ্যে সবকিছু সেরে নেন। এলাকায় এমপি হয়ে আসার পরেও কদর নেই তেমন। দান-দয়া নিতেও কেউ আসেন না তেমন। গ্রামের মুরব্বি ছাড়া যুবশক্তি কেউ দেখা করতে চাইছেন না দেখে এমপি চৌধুরী ময়েজউদ্দিন সাহেব বেশ চিন্তিত। কেউ কেউ সরবে নীরবে বলাবলি করে বলেন,- নেই আমাদের পারিবারিক সনাতনী বন্ধন। নেই পরিবার সংসার। নেই বউ-বাচ্চা। মুরব্বিরা ক্রন্দন করে বলেন, বাবা আমাদের বেশি টাকার দরকার নেই। আমরা ইন্টারনেট সংসার চাই না। এনে দাও ঠিক আগের মতন অটুট পারিবারিক বন্ধন। সবকিছু এনে দাও আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম যেমন।

এমপি সাহেবের সরকারি গাড়িতে জাতীয় পতাকা। কানে ব্লুটুথ পরে হেলেদুলে সিংঘম রাজকীয় থোরাই কেয়ার না করে হেঁটে চলেছেন, কিছু কিশোর গ্যাং। সাইট না পেয়ে ফেসবুকীয় শুদ্ধাচার মনিটাইজেশন ধনী কিশোর গ্যাং চোখে চোখ রেখে এমপি সাহেবকে বলেন, ‘আপনি এমপি তাতে আমাদের কী? আপনার কাজ- জনগণের সেবা করা।’ এমপি চৌধুরী ময়েজউদ্দিন প্রটেকশন পুলিশের দিকে তাকালেন। কিশোর গ্যাং এবার- সহজ প্রশিক্ষণ বিশাল মনিটাইজেশন বাণিজ্য যুদ্ধ জেতা গেরিলা কৌশলে মোবাইলে লাইভ চালু রেখে বলেন, আপনারা দেশপ্রেম বোঝেন না; দেশপ্রেমিক মনিটাইজেশন রেমিট্যান্স যোদ্ধা চেনেন না। আপনাদের কে বেতন দেয়? কোথা থেকে আসে বেতন? আপনারা এমপি পুলিশের বেতন এ সহজ-সরল ফেসবুক মনিটাইজেশন যোদ্ধাদের নিকট হতে আসে।

এ কী! মিনিট কয়েকের মাঝে হাজার লক্ষ আবেগীয় পর্যবেক্ষক এমপি পুলিশ নিয়ে নয়ছয় বলে চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে লাইক-শেয়ারে সারি সারি ফোরাত কারবালা বেদনাশ্রু বইয়ে দিচ্ছেন। কিশোর গ্যাং বেধনাস্ত্র হয়ে অনেক টাকা কামাই করে নিলেন। ফেসবুকীয় পৃথিবী দ্বীপের ভরাট বেদনার। ব-দ্বীপের ঘরে ঘরেও চলছে ফেসবুকীয় লাভ বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। সে ট্রায়াঙ্গলে নেই লজ্জা-শরম নামের কোনো নৌযান সাগরযান কিংবা ডুবোযান। ঘরে ঘরে চলছে অন্তর্জাল চিৎকার হাহাকার। সংসার নেই, সংসার কই আমার? ক্রন্দন। কোথায় স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, পরিজন প্রেমিক-প্রেমিকা আমার-তোমার-তার?

ঢাকা মোহাম্মদপুর তাজমহল সড়কের সি ব্লক, গোশালা কোচিং সেন্টারে চলছে ফেসবুক মনিটাইজেশন শোকের মাতম। গোশালা মালিক পি সরকার, সংসার কই? আমার সংসার কই? বলে হাপিত্যেশ করে চলেছেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, তার ফেসবুকীয় মনিটাইজেশন সংসারে অন্য কেউ সংসার পেতে বসে আছেন। মাঝেমধ্যে টেস্টোস্টেরন হরমোন মেডিসিন গিলে আবেগহীন দায়সারা কণ্ঠে চিৎকার করে বলেন- শিমুল, তুমি কই? তুমি কই? কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না কেন যেন তোমায়! দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে তোমার দেহ-মন; আমি সুখের সংসার করতে চাই। পৃথিবীদ্বীপ ব-দ্বীপের ঘরে ঘরে চলছে সুখে সংসার করার তীব্র হাহাকার শোকের মাতম।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ।


গুণগত রাজনৈতিক সংস্কৃতিচর্চার সংকট

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

যেকোনো নির্বাচন সামনে এলেই গুণগত রাজনীতির প্রসঙ্গ চলে আসে। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি এখন বেশ চাঙ্গা। ইতোমধ্যেই উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা ও আচরণবিধিমালায় বেশকিছু সংশোধনী এসেছে। সংশোধনীতে চেয়ারম্যান পদে জামানতের পরিমাণ ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করা হয়েছে। আর ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামানত পাঁচ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রাার্থী হতে ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনসূচক সইয়ের যে তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হতো, এবার তা বাদ দেওয়া হয়েছে। আসন্ন উপজেলা নির্বাচন থেকেই এসব বিধান কার্যকর হবে।

ধারণা করা যাচ্ছে, জামানত বাড়ানোর ফলে সৎ লোকদের প্রার্থী হতে বেগ পেতে হবে। যারা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিংবা যাদের আয়ের অন্য কোনো উৎস রয়েছে শুধু তাদের জন্যই সহজ হবে। উপজেলা নির্বাচনে সাদাকালোর পাশাপাশি রঙিন পোস্টার ও ব্যানার করতে পারবেন প্রার্থীরা। এতে ধনীদের প্রার্থিতায় বেশ সুবিধা পাবে। এতে নির্বাচনে বৈষম্য তৈরি হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মূলত যারা সচ্ছল তাদের জন্য তো এটা কোনো বিষয় নয়, কিন্তু অনেক প্রার্থী আছেন, যাদের জনগণ পছন্দ করে, তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল, অন্যান্য দিক দিয়ে ভালো। তাদের জন্য বেশ অসুবিধাই হবে। ইতোমধ্যেই আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজনদের প্রার্থী হতে নিষেধ করেছেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় কোন্দল নিরসন এবং নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে দায়িত্বশীল নেতাদের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হওয়া গেছে।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ছেলে, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের শ্যালক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের ভাগ্নেকে নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার জন্য ফোন করে দলের হাইকমান্ড থেকে জানানো হয়েছে। পরক্ষণেই এটাও আমরা লক্ষ্য করেছি যে, সংশ্লিষ্টদের কেউ কেই তাদের আত্মীয়কে ভোটে প্রার্থী না হতে বলেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো চূড়ান্ত সমাধান নয়। এমপি-মন্ত্রীদেও আত্মীয়-পরিজন নিজ যোগ্যতাতেই দলীয় পদ-পদবি পেতে পারেন। অথবা তারা নির্বাচনের জন্য যোগ্য হতে পারেন। কিন্তু প্রভাবশালী আত্মীয়ের প্রভাবমুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি ভোট বর্জন করায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকায় অনেকের অর্থবিত্তের পরিমাণ বাড়ায় অনেকেই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে চান। এখন যারা অর্থবিত্ত কিংবা সম্পদশালী তাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দলের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সখ্য বাড়িয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কেউ কেউ প্রার্থী হিসেবে ফেভার পাচ্ছেন। সম্প্রতি সাধারণত লক্ষ্য করা যাচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা প্রভাব বিস্তার করার জন্য নানা মেকানিজম করে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, প্রকৃত নিবেদিত নেতা যারা তারা অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচিত হতে পারেন না। অর্থনৈতিকভাবে এবং পেশিশক্তিতে বলিয়ানরাই নির্বাচিত হয়ে আসে। কারণ তারা মাঠ পর্যায়ে অনৈতিকভাবে মেকানিজম প্রয়োগ করে ভোট তাদের নিজেদের ফেভারে নিয়ে আসতে পারে।

রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ক্ষমতা পাশাপাশি অবস্থান করায় শক্ত প্রতিপক্ষ ক্রমেই দুর্বল হওয়ায় নিজের দলের মধ্যে দ্ব›দ্ব, সংঘাত ও কোন্দলের মাত্রাও বেড়েছে যথেষ্ট। বিশেষ করে একই ব্যক্তি বারবার সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় এবং দলের অন্যান্য নিবেদিত বঞ্চিত হওয়ায় এ ধরনের প্রতিযোগিতার মাত্রা বেড়েছে। জাতীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজ অঙ্গ সংগঠনগুলোতেও এমন প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ কথা বলার অবকাশ নেই যে, সরকার পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে রয়েছে। সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য-বিবৃতি, কার্যক্রম এবং অর্জন আত্মবিশ্বাসের বিষয়টি প্রমাণ করছে বারবার। তবে একদিকে যেমন আত্মবিশ্বাস বাড়ছে অন্যদিকে নিজেদেরকে যথাযথভাবে মজবুত করতে না পারার দীর্ঘশ্বাসও দীর্ঘ হচ্ছে। দলের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা সচেতন মহলকেও যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে। সঙ্গত কারণেই আগামী দিনগুলোতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির মাঠে নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ানোর শঙ্কা তৈরি করেছে।

আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে এবং জাতি হিসেবে নিজেদেরকে এগিয়ে নিতে হলে বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার বিকল্প নেই। আর এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন হবে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে উপযুক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করা। পদ্ধতিই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাবে। আর মানসিকতার পরিবর্তন হলেই আচরণ বদলাবে এবং আচরণ বদলালেই রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহযোগিতাভিত্তিক সংস্কৃতি সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হবে, ঘৃণাবোধের অবসান ঘটবে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনীতিতে প্রতিহিংসাপরায়নতা ও ঘৃণাবোধের পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন যে, চোখের বদলে চোখ নিলে সারা পৃথিবী অন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে একটি বিষয় খুব সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ক্ষমতায় থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতা এবং ক্ষমতায় না থাকলে তাদের মানসিকতা স্ববিরোধী আচরণের শামিল। রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ গুণগত পরিবর্তন মোটামুটিভাবে আমাদের একটি জাতীয় অঙ্গীকার ও সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। সাধারণ জনগণও মনে-প্রাণে তা চায়। কিন্তু তা সত্তে¡ও সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে ঘৃণা বা প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করার কোনো উদ্যোগই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং মনে হয় যে, মাননীয় সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে সকল নেতা-কর্মী দলীয় প্রধানকে খুশি করার জন্যই যেন এমন অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। গোটা জাতি আজ এমন অশুভ প্রতিযোগিতায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যারা যান, তারা রাতারাতি রাষ্ট্রের সবকিছুর ‘মালিক’ বনে যান। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে শুরু করে বাস টার্মিনাল পর্যন্ত সবকিছুই দখলে নিয়ে নেন। আর এগুলো অনেক ক্ষেত্রে তারা কর্মী-সমর্থক ও আপনজনদের মধ্যে ফায়দা হিসেবে বিতরণ করেন। এভাবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের ধারক-বাহক না হয়ে বহুলাংশে সিন্ডিকেটের রূপ ধারণ করে। একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই দলের প্রয়োজন হয়। দলের সৃষ্টি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে সুনির্দিষ্ট আদর্শ বা কর্মসূচি বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিজেদের সমর্থকদের মধ্যে বিতরণ নয়। তাই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দলবাজি এবং ফায়দাবাজির কোনো অবকাশ নেই। কারণ রাষ্ট্রের সব সম্পদের মালিক জনগণ এবং সরকারের দায়িত্ব ‘রাগ বা বিরাগের বশবর্তী’ না হয়ে দল-মত নির্বিশেষে নাগরিকদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা। ক্ষমতাসীনরা অনেকক্ষেত্রেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি-দুবৃর্ত্তায়নে লিপ্ত হয়ে পার পেয়ে যান। রাজনীতিকে যারা জনকল্যাণের পরিবর্তে ব্যবসায়িক হাতিয়ারে পরিণত করেছেন, তাদের করাল গ্রাস থেকে রাজনীতিকে মুক্ত না করতে পারলে এর বিপরীতে অগণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতায়ন আসবে। যা ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন হবে রাজনীতিবিদদের সর্বক্ষেত্রে নৈতিক আচরণ। নৈতিকতা বিবর্জিত রাজনীতি ভণ্ডামির শামিল। রাজনীতিতে অনৈতিকতার অবসান ঘটলেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলের পথ সুগম হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের জন্য একই সঙ্গে প্রয়োজন হবে গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য উপযুক্ত ডিজাইন গ্রহণ করা। সে জন্য গণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ পদ্ধতি চালু হলে রাজনীতিতে জনগণের ক্ষমতায়নের যাত্রা শুরু হবে। পদ্ধতিই দুর্নীতিবাজ-দুবৃর্ত্তদেরকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিতাড়িত করবে। সে সঙ্গে রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা ও শিষ্টাচারসহ রাজনীতিতে অনৈতিকতার অবসান, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতিষ্ঠা পাবে। এখন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য আরও বেশি প্রয়োজন সময়োপযোগী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা চালু করা।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

banner close