জেনোসাইড বা এক্সটার্মিনেশন অব এ রেস হচ্ছে একটি জাতিকে নির্মূলকরণ প্রক্রিয়া। আর এটি করা হয়ে থাকে জাতিগত বিদ্বেষ, জাতিগত অহমিকা, উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা বা কোনো অন্ধ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র বা অনুরূপ কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সশস্ত্র শক্তির মাধ্যমে কোনো সুনির্দিষ্ট অপশক্তির স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে যে হত্যাকাণ্ডের সূচনা করে ও তারপর দীর্ঘ নয় মাস ধারাবাহিকভাবে তা চালিয়ে যায়, সেটি ছিল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যেকোনো সংজ্ঞানুযায়ী গণহত্যা।
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে যুগে যুগে সংঘটিত অসংখ্য জেনোসাইড: রোহিঙ্গা, ইয়াজিদি, দাফুর, হুতু, রুয়ান্ডা, বসনিয়া, কম্বোডিয়া, আর্মেনিয়া, গ্রিক ইত্যাদি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নাৎসিদের হাতে নিধনকৃত দেড় কোটিরও অধিক প্রাণের সঙ্গে সংখ্যাগত ও নৃশংসতার মাপকাঠিতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বর্বরদের হাতে নিহত বাংলাদেশের ৩০ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুই কেবল তুলনীয়। আর সে জন্যই ১৯৭১ সালেই লন্ডন টাইমস লিখেছিল: ‘If blood is the price of independence, then Bangladesh has paid the highest price in history’ (‘রক্তই যদি স্বাধীনতার মূল্য হয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ দাম দিয়ে তা কিনেছে’)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানব ইতিহাসে এত বড় গণহত্যা আর কোথাও সংঘটিত হয়নি।
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা করাকে ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা বলা হয়। আরও সুনির্দিষ্টভাবে গণহত্যা হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক, এথনিক, রাজনৈতিক অথবা জাতিগত জনসমষ্টিকে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিত, ধারাবাহিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ড। আইসিসি সংবিধির ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে গণহত্যার যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তা এই সংজ্ঞাকে সমর্থন করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানপন্থিরা সুপরিকল্পিতভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে জাতিগত নিধন প্রক্রিয়া চালায় ও মাত্র নয় মাসে তিন মিলিয়ন নিরীহ প্রাণ হরণ করে তার প্রমাণ বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে অসংখ্য গণকবর, অগণতি বধ্যভূমি, আর কোটি মানুষের সাক্ষ্য ও আর্তনাদ। এই হত্যাকাণ্ডগুলো হঠাৎ করে সংঘটিত কোনো নিধনযজ্ঞ নয়, বরং কতগুলো বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে বাঙালি জাতির বিপক্ষে একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীর সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ।
বস্তুত একাত্তরের ২৫ মার্চের অনেক আগে থেকেই পাকিস্তানের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার পরিকল্পনা করা হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত ও স্বীকৃত গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত যে একাত্তরের ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট তৈরি হয়েছিল ১৯৭০ সালের নভেম্বরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস-পরবর্তী গণ-অসন্তোষ দমনের লক্ষ্যে হাতে নেয়া অপারেশন ব্লিটজের ওপর ভিত্তি করে। মূল উদ্দেশ্য ছিল: পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব থেকে যেকোনো পন্থায় বঞ্চিত করা। পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে ওঠা ছয় দফার আন্দোলনকে দমানো; এ জন্য ছয় দফা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগকে এর নেতৃত্বসহ এক মাসের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করা। ছয় দফা আন্দোলনের সহায়তাকারী শক্তিসমূহ: অন্যান্য সমমনা রাজনৈতিক দলসমূহের নেতা-কর্মী, আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী, ছাত্র সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মী, সাংস্কৃতিক জোটসমূহ ও ব্যক্তিত্ব যারা শেখ মুজিবের ছয় দফার প্রতি সহানুভূতিশীল, তাদের এবং সর্বোপরি এ দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে হত্যা করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা নিশ্চিত করা। পূর্ব পাকিস্তানে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে করে এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় না থাকে ও যাতে করে এ অঞ্চলের সব রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও এগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি আর কখনো পাকিস্তানের ‘অখণ্ডতা’র বিরুদ্ধে সোচ্চার না হতে পারে বা সংগঠিত হতে না পারে। সেই সঙ্গে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রধান শহর এমনভাবে দখল করে নেয়া, যেন কোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কোথাও গড়ে উঠতে না পারে।
১৯৭০-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় পাকিস্তানি সামরিক, সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের জন্য ছিল এ অশনিসংকেত। গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের প্রতিবেদনে দেখানো সংখ্যার চেয়ে আওয়ামী লীগ অন্ততপক্ষে ৫০টি আসন বেশি পায়। ফলে সারা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার একমাত্র দাবিদার হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও রাজনীতিবিদরা দুটি বিষয় আমলে নিয়েছিল। প্রথমত, তারা হিসাব করেছিল যে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সর্বাধিক ১২০টি আসন পেতে পারে। বাকি আসনগুলো ভাগবাটোয়ারা হবে পশ্চিম পাকিস্তানপন্থি দলগুলোর মধ্যে (জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ ইত্যাদি)। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানপন্থিরাই শেষাবধি সরকার গঠন করবে। এ বিষয়ে পাকিস্তানিদের নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল মওলানা ভাসানীর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা ও “ভোটের আগে ভাত চাই” স্লোগান ও উগ্র বামপন্থিদের অন্ধ আওয়ামীবিদ্বেষ ও স্বাধীনতা বিরোধিতা।
উল্লেখ্য, উগ্র বামপন্থিরা মাওবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। আর স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তাদের ভূমিকা ছিল আরও ন্যক্কারজনক। দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল সংবিধান প্রণয়ন-সম্পর্কিত। ইয়াহিয়া ও তার সহযোগী সামরিক কর্মকর্তারা এটাও হিসাব করে রেখেছিল যে একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্টে ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নের যে বাধ্যবাধকতা নির্বাচনের আগেই Legal Framework-এর মাধ্যমে জুড়ে দেয়া হয়েছিল তা পূরণ করা রাজনীতিবিদদের পক্ষে সম্ভব হবে না। ফলে সামরিক শাসন অবধারিতভাবেই দীর্ঘায়িত হবে।
এ ধরনের বিশ্লেষণ ও সেই সঙ্গে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইয়াহিয়াকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা দখল করার পর তার সহকর্মীদের এ কথা বলতে: “Gentlemen, we must be prepared to rule this unfortunate country for the next 14 years or so” (ভদ্রমহোদয়গণ, এই দুর্ভাগা দেশকে পরবর্তী ১৪ বছরের জন্য শাসন করার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। (সূত্র: Brigadier Abdul Rehman Siddiqi ‘East Pakistan: The Endgame- An Onlooker’s Journal 1969-1971)। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের নির্ধারিত ১৬৯ আসনের ১৬৭টি আসনে বিজয়ী করে এ দলটিকে সারা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত করে। ফলে আওয়ামী লীগ একাই পাকিস্তানের ক্ষমতার দাবিদার হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে ভুট্টোর পিপলস পার্টি পায় ৮১টি আসন, যার সব কয়টিই পশ্চিম পাকিস্তানে। এমন বাস্তবতায় বাঙালিকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য একদিকে ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র নানা প্রকার অছিলার সৃষ্টি করে যেতে থাকে, অন্যদিকে তারা সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাঙালির অধিকার নস্যাৎ করার লক্ষ্যে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। সত্তরের ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর পরই একাত্তরের ১২ জানুয়ারি ইয়াহিয়া ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ও ছয় দফা থেকে শেখ মুজিবকে সরে আসতে বলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই সংবিধান প্রণয়ন হবে বলে সরাসরি জানিয়ে দেন।
বাংলাদেশে গণহত্যার পরিকল্পনার একটি বড় অধ্যায় রচিত হয় ভুট্টোর লারকানার বাড়িতে। সত্তরের নির্বাচনোত্তর ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকের পর এই বাড়িতে ইয়াহিয়া-ভুট্টো বৈঠক হয়, যেখানে জেনারেল হামিদও উপস্থিত ছিল। পাখি শিকারের নামে ইয়াহিয়া এই বাড়িতে দুই দিন অবস্থান করে ও মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার মতে এখানেই পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে একটি গোপন সিদ্ধান্ত এরা নিয়ে নেয়। পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে বাংলার নেতা শেখ মুজিবকে কখনোই ইয়াহিয়া, ভুট্টো বা অন্য কোনো পাকিস্তানি নীতিনির্ধারক আমলে নিতে প্রস্তুত ছিল না। আসলে বাঙালিদের ক্ষমতা হস্তান্তর করা বা ক্ষমতার অংশীদার করার মতো কোনো প্রকার মানসিক শক্তি পাকিস্তানিদের কখনোই ছিল না। এই অর্বাচীনতাই পাকিস্তানি জেনারেল ও রাজনীতিবিদদের বাংলাদেশে নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করতে উৎসাহিত করেছে। তাই সত্তরের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর থেকেই পরিকল্পনামাফিক ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো হতে থাকে। এই সেনা সমাবেশের গতি পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ব্রিটিশ লেখক রবার্ট পেইনের মতে, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনা সদর দপ্তরের বৈঠকে ইয়াহিয়া, ভুট্টো গং অন্য সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলিত হয় ও বাংলাদেশে গণহত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় (‘ম্যাসাকার : আ ট্র্যাজেডি অ্যাট বাংলাদেশ’- রবার্ট পেইন)।
২৫ মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানে শুরু করা এই গণহত্যার কিছুদিন আগে ইয়াহিয়া পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিল: ‘Kill 3 million of them and the rest will eat out of our hands’ (‘ওদের ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করো, বাকিরা আমাদের হাত চেটে খাবে’)। যেকোনো জাতি বা জাতিগোষ্ঠীকে হত্যা বা নির্যাতনের লক্ষ্যবস্তু বানানো বা বানানোর পরিকল্পনা করাও গণহত্যার শামিল। ১৯৭১ সালের হত্যাকাণ্ডগুলো যে পরিকল্পনামাফিক একটি জাতিকে টার্গেট করে করা হয়েছিল, তা উপরোক্ত নির্দেশ থেকেই স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
সুদীর্ঘ পরিকল্পনামাফিক পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকরা পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে তোলে হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য জল্লাদ বাহিনী। তাদের উপযুক্ত সমরাস্ত্র, প্ল্যান ও ব্রিফিং দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয় ধারাবাহিকভাবে। এই ব্রিফিংয়ের একটি অন্যতম অংশ ছিল বাঙালি জাতিবিরোধী বর্ণবাদ, যা গণহত্যার অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। তৃণমূল পর্যায়ের পাকিস্তানি সৈনিকদের ভেতর বাঙালিবিদ্বেষ উসকে দেয়ার জন্য তাদের বলা হতো যে বাঙালিরা কাফের, কাজেই ওদের হত্যা বা নির্যাতন করা একজন মুসলমানের কর্তব্য। বাঙালির সম্পদ ও বাঙালি নারীরা দখলে এলে গনিমতের মাল হিসেবে তাদের ব্যবহার করা জায়েজ। এ জন্যই সাধারণ পাকিস্তানি সৈনিকরা গণহত্যা ও নির্যাতনে কোনো নিয়মনীতি, সীমা-পরিসীমা মেনে চলেনি। অত্যাচার চলেছে পুরোপুরি মধ্যযুগীয় কায়দায়। ক্ষমার বা দয়ার কোনো লেশমাত্র এখানে ছিল না। বাঙালি হত্যার বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণভাবে একজন পাকিস্তানির ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়। এখানে কোনো জবাবদিহির ক্ষেত্র রাখা হয়নি: ‘We can kill anyone for anything. We are accountable to no one’, অর্থাৎ ‘আমরা যে কাউকেই ইচ্ছে করলেই হত্যা করতে পারি। আমাদের এ জন্য কারও কাছেই জবাবদিহি করতে হয় না।’ এমনই ছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যায় জড়িত জনৈক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের উচ্চারণ (ড্যান কগিন, টাইম ম্যাগাজিন)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইহুদি নিধনের ক্ষেত্রে একজন নাৎসি সৈনিককে প্রদত্ত অধিকারও ছিল ঠিক এমনটিই।
অগ্নিঝরা মার্চ বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। কিন্তু সেই সূচনালগ্ন ছিল অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা আর যন্ত্রণার। বাংলার স্বাধীনতার পথ ছিল রক্তে রঞ্জিত, পিচ্ছিল ও কণ্টকাকীর্ণ। বাঙালির প্রতিটি সংগ্রামের মুহূর্তের সঙ্গে, প্রতিটি অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সঙ্গে লিখিত আছে রক্ত ঝরানোর কাহিনি। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলার জোট বাঁধার ইাতহাস এ দেশের মানুষের অধিকার হরণের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের শুরুতেই তিনি এই রক্ত ঝরানোর ইতিহাসের ও এ দেশের মানুষের হাহাকারের কথা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। আর ইতিহাসের সেই চরম সন্ধিক্ষণে দেশের মানুষের সংগ্রামকে কোন পথে পরিচালিত করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে তার সুস্পষ্ট রূপরেখা তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই রূপরেখা অনুসরণ করে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ধারণ করে ও মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে লক্ষ বাঙালি অস্ত্র হাতে বাধ্য করে ১৯৭০ সালের ১৬ ডিসেম্বরে প্রকাশ্যে ৯৩ হাজার পাকিস্তানিকে নত মস্তকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে।
লেখক: সাহিত্যিক ও অধ্যাপক, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
পৃথিবী নামক গ্রহে প্রাণী বসবাসের উপযোগী পরিবেশের কারণেই আমরা এই পৃথিবীর বাসিন্দা। পরিবেশ বলতে আমাদের আশপাশের সব কিছুকেই বোঝায়। এই পরিবেশে আছে মানুষ, পশু-পাখি অর্থাৎ সব ধরনের প্রাণী, মাটি, পানি, বায়ু, গাছপালা, বনজঙ্গল, চন্দ্র, সূর্য, মেঘমালা, পাহাড়, খাল, বিল, নদী, সাগর ইত্যাদি। এ সব কিছু নিয়েই প্রাকৃতিক পরিবেশ। আর মানুষের সৃষ্ট পরিবেশ হলো- জীবনের চাহিদা মেটাতে মানুষ প্রতিনিয়ত যা গড়ে তুলছে। যেমন- ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, যানবাহন, পুল-সাঁকো, কলকারখানা, দীঘি, নালা, পুকুর, কুয়া, খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, ব্যবসাকেন্দ্র, নগর, বন্দর প্রভৃতি। এ ছাড়াও রয়েছে সামাজিক পরিবেশ। সব মিলিয়ে বলা যায়, আমরা পরিবেশ দিয়েই ঘেরা।
পরিবেশ সংরক্ষণের কথা আগে শুরু হলেও, ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম র্যাচেল কারসন সুনির্দিষ্টভাবে পরিবেশের কথা তুলে ধরলেন তার সাইলেন্ট স্প্রিং (Silent Spring) বইতে। তিনি বললেন, বসন্ত নীরব হতে চলেছে। পাখি আর গাইবে না। তাই পাখির কলতানে মুখরিত হবে না বসন্তের দিনগুলো। কেননা, বিষাক্ত কীটনাশক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের ফলে ফসল তোলার পর ক্ষেতে পড়ে থাকা শস্য খেয়ে পাখি প্রাণ হারাবে। এমনি ভাবে আরও কত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। এ থেকেই জন্ম নিল এক নতুন ভাবনা। আর তা হলো পরিবেশ ভাবনা।
১৯৬২ সালে লেখিকা র্যাচেল কারসন যে ভাবনার সূত্রপাত করলেন সে ভাবনার সম্প্রসারণে, ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের ডাকে বিশ্বের ৯৩টি দেশের প্রতিনিধিরা স্টকহোমে বসলেন বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে। দীর্ঘ আলোচনার পর ২৬টি ধারাসংবলিত ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করলেন অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিরা। স্টকহোমের এ ঘোষণাপত্রই হলো বিশ্ব পরিবেশের ম্যাগনাকার্টা। এর প্রথম ধারাতে বলা হয়েছে বিশুদ্ধ নির্মল পরিবেশ মানুষের জন্মগত অধিকার। এর দ্বিতীয় ধারায় রয়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ বায়ু, পানি, মাটি, উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা। এমনি ভাবে বিভিন্ন ধারায় রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জীবনের মান উন্নয়নের জন্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য প্রদান, অত্যাবশ্যক পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা, উন্নয়ন কার্যক্রম ও পরিবেশ রক্ষায় দ্বন্দ্ব দূর করে যুক্তিসঙ্গত পরিকল্পনা গ্রহণ, সম্পদের সঙ্গে সংগতি রেখে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা ও গণমাধ্যমে পরিবেশের গুরুত্বারোপ করা, উন্নত পরিবেশ সৃষ্টিতে গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ, পরিবেশের উন্নয়নের আন্তরাষ্ট্রীয় পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করা এবং মানব প্রজাতি ও পরিবেশকে রক্ষা করতে পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারসহ ধ্বংসলীলায় ব্যবহৃত সব অস্ত্র বিলুপ্ত করা। আর তারই ধারাবাহিকতায় মানুষকে পরিবেশ-সচেতন করে তুলতে ‘একটি পৃথিবী’ এ বক্তব্য সামনে রেখে, ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালনের যাত্রা শুরু হয়।
সৃষ্টির রহস্য এমনই যে পৃথিবীর সব কিছুতেই রয়েছে অপূর্ব সমন্বয় ও ছন্দ এবং চমৎকার ভারসাম্য, যা মানুষের বসবাসের অনুকূল ও উপযোগী অবস্থা গড়ে তুলেছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশে সবকিছুর প্রয়োজন রয়েছে, যা একে অন্যের সম্পূরক ও পরিপূরক। গাছপালা ও পশু-পাখি থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য পাই। আবার বিভিন্ন জীবজন্তুর জন্যও রয়েছে খাদ্যের ব্যবস্থা। যেমন- গরু-ছাগলের জন্য মাঠে মাঠে ঘাস, পাখির জন্য গাছের ফল ও পোকামাকড়, মাছের জন্য রয়েছে ছোট ছোট পোকামাকড় ইত্যাদি। মানুষ, জীবজন্তু ও গাছপালার জন্য রয়েছে পানি, বাতাস, আলো। গাছ সব প্রাণীকে বেঁচে থাকার জন্য দিচ্ছে অফুরন্ত অক্সিজেন আর গাছের জন্য মানুষ দিচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড। বাঁচার জন্য যা কিছু প্রয়োজন মানুষ পৃথিবীর এ অনুকূল পরিবেশ থেকে তা গ্রহণ করছে। পৃথিবী ছাড়া চন্দ্র, মঙ্গল গ্রহ বা অন্য কোনো উপগ্রহে মানুষ বা কোনো প্রাণীর বসবাসের মতো এমনকি বাঁচার মতো অনুকূল পরিবেশ নেই। তাই তো আমাদের এই পৃথিবী সুন্দর ও আদর্শ পরিবেশের অধিকারী। যত দিন এ পরিবেশের ভারসাম্য থাকবে তত দিন এ পৃথিবী সুন্দর থাকবে এবং আমরা সুখ-শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারব। এ কথা আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে, আমরা যে পরিবেশ ব্যবহার করছি তা আমাদের পূর্বপুরুষরা রেখে গেছেন। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সবার। কোনো অবস্থাতেই একে নষ্ট করার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু বিশ্ব পরিবেশ আজ এক অস্বাভাবিক অবস্থার মুখোমুখি। বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশের পরিবেশ বিভিন্নমুখী সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে এক ভয়াবহ অবস্থার দিকে এগিয়ে চলেছে, যা আমাদের জীবনে বয়ে আনছে চরম দুর্ভোগ। এর মূলে রয়েছে সাময়িক লাভের জন্য পরিবেশের প্রতি অসতর্কতা, অযত্ন, অবহেলা ও জ্ঞান-বুদ্ধি-বিচার বিবর্জিত ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী আচরণ। অপরিকল্পিতভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। কারণ বর্ধিত জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্নভাবে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ায় এক অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ক্রমে এ ভূখণ্ড বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে উন্নয়নশীল দেশের প্রায় ৮০ ভাগ বনভূমি উজাড় হয়েছে এবং বাস্তব রীতির ভারসাম্য রক্ষাকারী প্রাণীসহ প্রায় ৭০ ভাগ বন্য প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে।
যেকোনো দেশে স্বাভাবিকভাবে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি প্রয়োজন। আর আমাদের মতো জনবহুল দেশে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হলে কমপক্ষে দেশের এক-তৃতীয়াংশ বনভূমি আবশ্যক। কিন্তু নির্বিচারে ব্যাপকভাবে গাছপালা কেটে উজাড় করে ফেলায় আমাদের বনভূমি কমে ১০ শতাংশেরও নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে অক্সিজেনের অভাবে আমাদের নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে। গাছপালা কেটে ফেলায় বনভূমির অভাবে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে এবং আবহাওয়া হচ্ছে উত্তপ্ত। বাড়তি জমি লাভের জন্য পুকুর, দীঘি, জলাশয় ইত্যাদি ভরাট করায় ক্ষতিকর শুষ্ক ও রুক্ষ পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক গতি-প্রবাহকে রোধ করার ফলে চর পড়ে নদী শুকিয়ে ব্যাপক অঞ্চলে মরুকরণের প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ মরুকরণের প্রক্রিয়ার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় জমির উপরিভাগে লবণাক্ততা বাড়ছে ও সেচব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষিকাজ অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
শিল্প বিপ্লব আমাদের সভ্যতার অগ্রগতিতে নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। কিন্তু বর্ধিত মানুষের জীবনের চাহিদা মেটাতে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র কলকারখানা নির্মিত হওয়ার ফলে পরিবেশ ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে। কলকারখানা ও ইটভাটার চিমনির ধোঁয়ায় বাতাস দূষিত হচ্ছে। কলকারখানার আবর্জনা ও ব্যবহৃত ময়লা নদীতে ফেলার ফলে পানি দূষিত হয়ে মাছসহ অন্যান্য প্রাণী মারা যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষের যাতায়াতের জন্য রেল, মটরগাড়ি, লঞ্চ, স্টিমার, বিমান চলাচল করছে এবং এগুলোর বিকট শব্দ ও হর্নের শব্দ আমাদের রক্তচাপ বাড়াচ্ছে, যা হৃদরোগের অন্যতম কারণ। আবার এগুলোর কালো ধোঁয়া ফুসফুসের রোগ সৃষ্টি করে। অনেক সময় অতিরিক্ত যাত্রী ও মালবোঝাই করায় দুর্ঘটনা ঘটে, যার ফলে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হয়।
অপরিকল্পিত জনসংখ্যার চাপে প্রকৃতি ক্রমশই বিপর্যয়ের দিকে এগুচ্ছে। শিল্প ও অন্যান্য বর্জ পরিশোধনের ক্ষমতা ক্রমেই প্রকৃতি হারিয়ে ফেলছে। আবার অক্সিজেন তৈরির অন্যতম স্থান বনভূমি প্রতি বছর অন্ততপক্ষে ১ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়া রোধ করা না গেলে একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অক্সিজেনের দারুণ ঘাটতি দেখা দেবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বৃক্ষনিধন, শুষ্কতা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির কারণে মরুকরণ প্রক্রিয়ায় বিশ্বের ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার অর্ধেকই হলো এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সৃষ্টিনির্ভর কৃষিভূমি, সেচভূমি, চারণভূমি ও বনভূমির প্রায় ৩৩ লাখ বর্গমাইল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য প্রোটেকশন অব নেচার’-এর হিসাব মতে, গত প্রায় ১০০ বছরে পৃথিবী থেকে ৭৬ প্রজাতির প্রাণী, কয়েক হাজার রকমের গাছপালা বিলুপ্ত হয়েছে। আরও প্রায় ২৬ প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির পথে। প্রতি বছর ২০ কোটি টনের বেশি মনো-অক্সাইড, ৫ কোটি টন হাইড্রো কার্বন, ১২ কোটি টন ছাই ও ১৫ কোটি টন সালফার ডাই-অক্সাইড, কলকারখানা থেকে নির্গত হয়ে পৃথিবীর পরিবেশকে আক্রান্ত করছে (নিউ টাইমস থেকে)।
পরিবেশ বিনষ্টের সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর দিক হলো, ওজোনস্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ওজোনস্তর ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। বায়ুদূষণের ফলে এক ধরনের গ্যাস বায়ুমণ্ডলের নির্দিষ্ট স্তরে ওজোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যা সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পারমাণবিক বিস্ফোরণের কারণে ওজোনস্তর অতি উত্তপ্ত হলে বায়ুমণ্ডলে অন্যতম উপাদান নাইট্রোজেন ভেঙে যায় এবং প্রচুর পরিমাণ নাইট্রিক অক্সাইড সৃষ্টি হয়, যা ওজোন প্রতিবন্ধকতায় ফাটল ধরায়। এ প্রক্রিয়ায় ওজোনের ক্ষতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তা ছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে অসহনীয় আবহাওয়া, অস্থিতিশীল জলবায়ু ও অস্বাভাবিক তাপমাত্রা ওঠানামা করার ফলে সামুদ্রিক প্রাণী ও গাছপালা বিলপ্ত হয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
পরিশেষে, সুখী-সুন্দর প্রগতিশীল জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়ভাবে অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন। যেহেতু আমরা পরিবেশের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। তাই পরিবেশ সংরক্ষণ ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের উন্নয়নের জন্য, প্রগতির জন্য, সমৃদ্ধির জন্য, শান্তির জন্য, সর্বোপরি অস্তিত্বের জন্য একটিই লক্ষ্য হবে- সুষ্ঠু পরিবেশ সংরক্ষণ। সরকারি ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হলে সুষ্ঠু পরিবেশ সংরক্ষণ সম্ভব। সে লক্ষ্যেই আমাদের কাজ করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। শিক্ষার আলোই মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারে। শিক্ষিতজনই দেশ ও জাতির সমস্যা সমাধানের কথা ভাবতে পারে, পথনির্দেশ করতে পারে। তাই শিক্ষার মাধ্যমেই পরিবেশ সংরক্ষণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হবে, এ প্রত্যাশাই করি।
লেখক: অধ্যাপক ও সাবেক ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
ভূস্বর্গ কাশ্মীরে জি-২০ সম্মেলন আয়োজনকে কেন্দ্র করে কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি ভারতকে। কিন্তু সম্মেলন শেষে নিন্দুকদের সমালোচনার বদলে গুরুত্ব পেয়েছে জি-২০ দেশগুলোর ভারতের কাশ্মীর নিয়ে করা ইতিবাচক সব আলোচনা। কাশ্মীর উপত্যকার সৌন্দর্যের পাশাপাশি উন্নয়নে মুগ্ধ তারা।
জি-২০ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা ভূস্বর্গ বলে পরিচিত কাশ্মীরের উন্নয়নে ভারত সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলোরও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জঙ্গিদের হুমকি উপেক্ষা করে নির্বিঘ্নেই সম্মেলন শেষ হয় উপত্যকায়। পর্যটনের বিকাশে এই সম্মেলনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয় ভারত সরকার। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষও মুখিয়ে ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অতিথিদের স্বাগত জানাতে। অতিথিদের বরণ করতে ছিল না কোনো কার্পণ্য। অতিথিরাও স্থানীয়দের আতিথেয়তায় নিজেদের খুশির কথাই শুনিয়েছেন। সব মিলিয়ে উৎসবে মেতে উঠেছিল ভারতের গোটা কাশ্মীর উপত্যকা।
বিশ্বের ২০টি অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত দেশ মিলে গঠিত হয় জি-২০ বা গ্রুপ অব টোয়েন্টি। বিশ্বের ২০টি দেশের অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা এই গোষ্ঠীর সদস্য। ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক আর্থিক স্থিতিশীলতা উন্নয়ন-সম্পর্কিত নীতি নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যেই এই জি-২০ গঠিত হয়। বিশ্বের ১৯টি ধনী দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত এই গোষ্ঠীর সদস্যরা হলো আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। ২২ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রস্তুতি বৈঠকে ১৬টি দেশের ৬০ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দেন। তবে সৌদি আরব, তুরস্ক, মিসর ও চীন এই সম্মেলন বয়কট করে। কিন্তু তাদের বয়কটও সম্মেলনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জঙ্গিবাদীদের পাকিস্তানি মদদের বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে ধরা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সামনে খুলে গেছে পাকিস্তানের মুখোশ। চীনও কূটনৈতিকভাবে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে এই সম্মেলনে যোগ না দিয়ে।
জি-২০ গোষ্ঠীর সদস্য নয় বাংলাদেশ। তবে আয়োজক দেশ ভারতের আমন্ত্রণে এই সম্মেলনে অতিথি সদস্য হিসেবে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশও। সম্মেলনের ফাঁকে বিভিন্ন আলোচনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপক প্রশংসা হয়। জি-২০ বৈঠক বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশেও বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ভারতীয় কূটনীতিকদের মতে, দিল্লি চিরকালই ঢাকাকে পরম বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করে। তাই জি-২০ সম্মেলনের আয়োজনেও বাংলাদেশকে বিশেষ আমন্ত্রিত দেশ হিসেবে যুক্ত করেছে। বাংলাদেশও সেই সুযোগ হাতছাড়া করেনি।
এই সম্মেলনের আয়োজন প্রসঙ্গে ভারতের পর্যটন সচিব অরবিন্দ সিং বলেন, জম্মু-কাশ্মীরকে দুনিয়ার পর্যটন মানচিত্রে নতুন করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এই সম্মেলন কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সম্মেলন দারুণ সফল। পর্যটন বিকাশে অবকাঠামো ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে ভারত কাশ্মীরের বর্তমান উন্নততর অবকাঠামো এবং উপত্যকায় জঙ্গিবাদকে পরাস্ত করে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে ভারত। সব দেশের প্রতিনিধিদের মুখে তাই কাশ্মীরের প্রশংসা শোনা যাচ্ছে এখন। পশ্চিমা দেশগুলোও বুঝতে পারছে, সীমান্তের ওপার থেকে চীনের বন্ধুদেশ পাকিস্তান ভারতীয় নাগরিকদের ওপর কীভাবে প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে। মুসলিম দেশ হয়েও কাশ্মীরের নিরীহ মুসলিমদের ওপর ক্রমাগত আঘাত হানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক স্তরে জঙ্গিবাদীদের মদদদাতা ইসলামাবাদ।
শ্রীনগরে সম্মেলনের মূল বিষয় ছিল, ‘কাশ্মীর ও সিনেমাশিল্প’। কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে বহু ভালো সিনেমা তৈরি হয়েছে। তবে সেখানে কিছুদিনের জন্য জঙ্গিবাদীদের অপতৎপরতায় সিনেমাশিল্পে ভাটা আসে। পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে এখন। আবারও লেন্সবন্দি হচ্ছে ভূস্বর্গের সৌন্দর্য। তাই ভারতের কেন্দ্রীয় পর্যটন প্রতিমন্ত্রী তথা জম্মুর ভূমিপুত্র, জিতেন্দ্র সিং বলেছেন, গত কয়েক বছরে কতটা বদল এসেছে আবহাওয়ায় এই বৈঠকের আয়োজনই হচ্ছে তার বড় প্রমাণ। নির্বিঘ্নে সম্মেলন শেষ হওয়ার জন্য তিনি পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্থানীয় নাগরিকদেরও ধন্যবাদ জানান। উধমপুর থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্য জীতেন্দ্র সিং বলেন, কাশ্মীরের মানুষই উপত্যকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কাশ্মীরের অবদান বলে শেষ করা যাবে না বলে মনে করেন ভারতের পর্যটন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বহু ছবির শুটিং হয়েছে এখানে। কিন্তু বিদেশি শক্তির মদদে আচমকা ১৯৯০ সাল থেকে সিনেমাশিল্প থমকে যায়। তবে বর্তমান সরকারের চেষ্টায় আবার সেই সময় ফিরে এসেছে। সিনেমার মধ্য দিয়ে এখানকার অর্থনীতিকে চাঙা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পাশাপাশি বিদেশিদেরও কাশ্মীরের সৌন্দর্যকে সেলুলয়েডে বন্দি করার আমন্ত্রণ জানান তিনি। ভারতের পর্যটন প্রতিমন্ত্রী জীতেন্দ্র সিং আরও জানান, কাশ্মীরে নতুন করে কেউ সিনেমা করতে চাইলে সরকার সব রকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
৩৭০ ধারা বাতিলের পর জম্মু ও কাশ্মীর এখন উন্নয়নের শিখরে রয়েছে। ভারত সরকার সরাসরি মন দিয়েছে কাশ্মীরের উন্নয়নে। বেকারদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে অবকাঠামোর উন্নয়নকে দেয়া হয়েছে সর্বাধিক গুরুত্ব। শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ঢেলে সাজানো হয়েছে কাশ্মীরের পর্যটনশিল্পকেও। স্থানীয় হস্তশিল্পের পাশাপাশি বিশ্ববিখ্যাত আপেল বাগানেও এখন খুশির হাওয়া বইছে। জঙ্গিবাদকে পরাস্ত করে আসলে কাশ্মীরের মানুষ এখন ভারত সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছেন। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে যোগাযোগব্যবস্থারও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার মানও। বিদেশিরা কাশ্মীরের পরিস্থিতি সরেজমিন দেখে অভিভূত। আরও বেশি করে পর্যটক আসবেন কাশ্মীরে, এই সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় খুব খুশি সাধারণ হোটেল ব্যবসায়ীরাও। সব মিলিয়ে কাশ্মীরে জি-২০ সম্মেলন ঘিরে রয়েছে বাড়তি এক উন্মাদনা।
সেপ্টেম্বরেই ভারতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনের আগে কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর ভূখণ্ডের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরার প্রয়াস ১০০ শতাংশ সফল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পশ্চিমাদের মনে কাশ্মীর নিয়ে কিছুটা সন্দেহ থাকলেও এখন তা পরিষ্কার হয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন। কারণ তারা পাকিস্তানের জঙ্গিবাদকে মদদ দেয়ার বিষয়টি যেমন বুঝতে পেরেছেন, তেমনি চীনের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবও টের পেয়েছেন। তাই সবদিক থেকেই শ্রীনগরের সম্মেলন সফল।
সেপ্টেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিশা দিতে পারবে বলেও কূটনৈতিক মহলের অনুমান। ভারতের সভাপতিত্বে জি-২০ ইতিমধ্যেই সদস্য দেশগুলোর মনে আলাদা দাগ কাটতে শুরু করেছে।
ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর ঘিরে বারবার অপতৎপরতা চালানোর চেষ্টা করেছে পাকিস্তান। এই অঞ্চলে ধর্মের নামে তারা যেই জঙ্গিবাদ চালায়, তা তিরস্কারের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন এই অঞ্চলের স্থানীয়রা। বিশেষত ৩৭০ ধারা বাতিলের পর থেকে এই অঞ্চলে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতার পথ সহজ হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থা প্রবর্তনের টানেল পথ থেকে শুরু করেই এই অঞ্চলকে স্বাবলম্বী করতে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি অন্যান্য সেবা কার্যক্রম নিশ্চিত করেছে ভারত।
সেই সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ব্যবসা ও চাকরির সুযোগের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি পর্যটকদের সাদরে আমন্ত্রণ জানাতে সক্ষম হয়েছেন জম্মু ও কাশ্মীরের অধিবাসীরা। একসময় শীতে কাশ্মীরে প্রবেশ করা ছিল বেশ দুর্গম ও অসম্ভব। কিন্তু এখন আপনি-আমি চাইলে বছরের যেকোনো সময় যেতে পারব কাশ্মীরে। সেই সঙ্গে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ পাকিস্তান ও তার জঙ্গিবাদকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করায় বিরাজমান রয়েছে এক শান্তিময় অবস্থা।
ভারতীয় উপমহাদেশে ভূস্বর্গখ্যাত কাশ্মীর জি-২০ সম্মেলন শেষে আরও একবার বিশ্বের বুকে পরিচিত হয়ে উঠছে ভূস্বর্গ হিসেবে। আশা করা হচ্ছে, এই সম্মেলনের মাধ্যমে আবারও পর্যটন ও সিনেমা খাতে আগের জৌলুস ফিরে পাবে জম্মু ও কাশ্মীর।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ আয়োজিত ‘ব্যাংকিং অন ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার উল্লেখ করেন, খেলাপি ঋণ কমানো ও করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে ব্যাংকের ব্যবসার বৈচিত্র্য বাড়বে বলেও তিনি বিশ্বাস করেন। অন্যদিকে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের অভিমত হচ্ছে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা এককভাবে তফসিলি ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়, এই কাজের জন্য সামাজিক প্রতিশ্রুতি দরকার। তাদের আরও বক্তব্য হচ্ছে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে এবং এ খাতে লোকবল বাড়াতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের। বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাই ব্যাংক খাতের জন্য এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকাররা হতাশ হয়ে এখন আইনি কাঠামো শক্ত করে চোর ডাকাতের মতো ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিতে চাচ্ছে, জেলজরিমানা করে খেলাপিদের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টির পরিবেশ তৈরির প্রত্যাশা করছে। কিন্তু আদালতে মামলা হলে ঋণখেলাপি স্বস্তি পায়, ঋণ গ্রহীতার মৃত্যু পর্যন্ত মামলা চলতেই থাকে। কারণ অর্থ ঋণ আদালতে কোনো মামলায় ব্যাংক বিজয়ী হলেও সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য আরেকটি মামলা করতে হয়। অন্যদিকে খেলাপি গ্রাহকের উচ্চ আদালতে রিট করার সুযোগ তো সব সময়ই থাকে। গভর্নর বলছেন, খেলাপি ঋণ কমানোর দায়িত্ব ব্যাংকের শীর্ষ নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন তাদেরই নিতে হবে। ব্যাংকের শীর্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নেয়া উচিত। কারণ প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের বেতন কাঠামোর সঙ্গে জাতীয় বেতন স্কেলের কোনো সঙ্গতি নেই, ঈর্ষণীয় বেশি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় এত উচ্চ বেতনের কর্মকর্তার দায়িত্বও উচ্চ থাকা অপরিহার্য। উচ্চ বেতন কাঠামোর কর্মকর্তাদের দায় ও দায়িত্ব অর্পণযোগ্য নয়। মামলা ঠুকে দিয়ে দায় ও দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল বন্ধ করা জরুরি।
গভর্নরের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের শুধু ‘দূরদর্শী নীতিমালা’ প্রণয়নে আবদ্ধ থাকার মধ্যে সমাধান নিহিত নয়। বর্তমান গভর্নর বহু বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণের সঙ্গে জড়িত। তিনি গভর্নর হওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের পরিচালক ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণে পরিচালক পর্ষদের সম্মতি অপরিহার্য। তিনি নিশ্চয়ই যথাযথ ভূমিকা পালন করেছেন। আমার ধারণা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদের কিছু সদস্য নিজস্ব দাপ্তরিক কাজে এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে, পর্ষদ সভায় উপস্থাপিত স্মারকগুলো পড়ে দেখার সময়ও পান না। অনেকে অফিস থেকে সভায় আসার পথে ট্রাফিক জ্যামে গাড়িতে বসে একটু চোখ বুলিয়ে নেন। এসব পর্ষদের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, আমলারা সেনাসদস্যদের মতো বড় কর্মকর্তাদের সমীহ করেন, সিনিয়র আমলার মতের বিরোধিতা করে পর্ষদ সভায় ঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধস্তন আমলারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ যথাযথ ভূমিকা পালন করলে ব্যাংকিং জগত নিয়ে সরকারকে এত বিব্রত হতে হয় না। আর্থিক কেলেঙ্কারি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার খবর অহরহ মিডিয়ায় আসছে।
করোনা-উত্তর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাসসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে প্রতিটি দেশেই মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। শুধু মূল্য বাড়ার কারণে বেশি অর্থ দিয়ে আগের তুলনায় এখন কম পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভোক্তার চাহিদা কমছে, চাহিদা কমায় আমাদের রপ্তানি কমছে। একই যুক্তিতে আমাদের চাহিদা এবং আমদানি কমার কথা। কিন্তু তা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে হচ্ছে না। কারণ নিত্যব্যবহার্য পণ্য, জ্বালানি তেল এবং পোশাকশিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমানোর কোনো উপায় নেই। বিশ্বমন্দায় বস্ত্রের চাহিদা কমে গেলে পোশাক শিল্পের ওপর অতিনির্ভরতা আমাদের অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং অবরোধ আরোপের হিড়িক বন্ধ না হলে দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে যাবে, ব্যাংকে অলস টাকা ও খেলাপি ঋণ আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংকের দূরদর্শী নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন।
সরকার এবং ব্যাংক কৃচ্ছ্রসাধন করছে বলে মনে হয় না। ইন্টারনেটের যুগে তথ্য সংগ্রহে ব্যক্তিকে সশরীরে বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কোথায় কী সমস্যা তা চিহ্নিত করা সম্ভব হলে সমাধান ঘরে বসেও করা সম্ভব। উন্নত দেশগুলোতে এখনো লোকজন ঘরে বসে নেটের মাধ্যমে অফিসের কাজ করছে। আর বাংলাদেশে এখনো বিভিন্ন অজুহাত সৃষ্টি করে সরকারের লোকজন বিদেশে যাচ্ছেন। বিদেশি ঋণে বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশ ভ্রমণের অপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ থাকেই। বিদেশে না গেলে অর্থ অব্যয়িত থেকে যাবে, এই কারণ দেখিয়ে অসংখ্য কর্মকর্তা এখনো অহরহ বিদেশ ভ্রমণ করছেন। জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কর্মশালা, সেমিনার বা প্রশিক্ষণে যোগদান বর্তমান প্রেক্ষিত বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয়। স্বাভাবিক অর্থনৈতিক অবস্থায় এগুলোরও প্রয়োজন আছে, কিন্তু এখন নয়। রেমিট্যান্স বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে বিদেশে বক্তৃতা দিতে যারা যাচ্ছেন তাদের পক্ষে সামান্যতম অবদান রাখা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে হয় না। কারণ হুন্ডির লাভ বক্তৃতা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হচ্ছেন অসংখ্য ব্যবসায়ী, সাংবাদিক। তাদের জন্য সরকারের খরচ না হলেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা কিন্তু ব্যয় হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে বিপিএল ক্রিকেটের আয়োজন জরুরি ছিল বলে মনে হয় না। আনন্দ আর বিনোদনেও অগণিত লোক বিভিন্ন দেশ নিজের টাকায় ভ্রমণ করছেন, চিকিৎসা করতে তো যাচ্ছেনই। দূরদর্শী নীতি প্রণয়নে এসব সাধারণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
ঋণের মান কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তা হলে কি এত দিন যথাযথ আঙ্গিকে যাচাই করা হতো না? না হলে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে না কেন? প্রতিটি ব্যাংকে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ রয়েছে, নিয়মিত নিরীক্ষণ হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও নিয়মিত পরিদর্শন হয়। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালক পর্ষদে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকেন। পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষা বা পরিদর্শন কোনোটাই কাজে আসছে না। কাজে আসলে এত বেশি খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকে যারা পরিদর্শন করে রিপোর্ট তৈরি করেন তাদের প্রতীতি হচ্ছে, নীতিনির্ধারকরা আপস করেন, আপস করেন বলেই চূড়ান্ত অনুমোদিত রিপোটে পরিদর্শিত ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র থাকে না। তবে জাতীয় স্বার্থে মাঝে মাঝে আপস করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই আপসের সঙ্গে দুর্নীতি থাকলে খেলাপি ঋণ বাড়বেই। দুর্নীতি ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল তদারকির কথা অস্বীকার করা যাবে না। তাই বলে পরিদর্শন ও তদারকির নামে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয়। প্রতিটি লোন কেস যথাযথভাবে যাচাই করা সমীচীন। কিন্তু যাচাইয়ের নামে কালক্ষেপণ অপরাধ, বিলম্বিত সিদ্ধান্তে পরিস্থিতির পরিবর্তনে প্রকল্পে বিনিয়োগ অলাভজনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণে অযাচিত বিলম্বে দুর্নীতি বাসা বাঁধতে সহায়তা করে।
পর্যাপ্ত জামানত না নিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় লোন দেয়া হলে লোন আদায়ের ঝুঁকি বাড়ে। বর্তমান গভর্নর আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ইমেজ একটু বেড়েছে। বর্তমান গভর্নর অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকছেন, কারও তোষামোদিতে বিগলিত হচ্ছেন না, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয় তা তফসিলি ব্যাংকের এখতিয়ারে ছেড়ে দিচ্ছেন। পুনঃতফসিল বা বড় লোনগুলোর অনুমোদন এখন সব ব্যাংক তাদের নিজ দায়িত্বে করে থাকে। তবে প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা, সততা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও দায়িত্ব রয়েছে, মন্ত্রণালয়ের প্রতি আস্থা স্থাপন করলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। মনে রাখা দরকার, খেলাপি ঋণের কারণে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোই সমস্যায় পড়ছে না, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বহু দিন আগে ঋণ অবলোপন করে ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্সশিট পরিষ্কার করা হয়েছিল। কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কমানো হয়েছিল। কিন্তু এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বারবার খেলাপি ঋণ কমানো সঠিক নয়, কারণ অবলোপন করার পর তা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়, ব্যাংকাররাও তা আদায়ের কথা ভুলে যান। খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে থাকলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, প্রকৃত উদ্যোক্তা ঋণ পাবে না। বাজার অর্থনীতির কাজ হচ্ছে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মধ্যস্বত্বার সৃষ্টি করা, এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ে, কর্মসংস্থান হয়। ব্যাংকের ব্যর্থতায় সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করে খেলাপি ঋণ আদায় জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দাভাব তা কাটিয়ে উঠতে হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মানুষের আয় বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বাড়াতে হলে অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হলে প্রকৃত উদ্যোক্তাকে সময়মতো প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান দিতে হবে। ঋণের জোগান দিতে হলে খেলাপি ঋণ হ্রাস করতে হবে। ব্যাংকের সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি, তাই বড় বড় কোম্পানিগুলোকে লোন দেয়ার জন্য ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতা করে নিজের অবস্থান দুর্বল করছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো জিইয়ে রাখার কোনো মানে হয় না, বড় ও শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত করে দেয়াই শ্রেয় হবে। ঘটনা ঘটার বৎসরাধিক পরে পরিদর্শনপূর্বক আরও বৎসরাধিক কাল অতিবাহিত করে সংশ্লিষ্ট পরিদর্শিত ব্যাংককে অনিয়ম নিয়মিত করার জন্য নির্দেশনা দেয়ার বিলম্বিত রীতি বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিবর্তন করতে হবে।
লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক বাংলাদেশ ব্যাংক
অগ্নিসন্ত্রাসের প্রসঙ্গ এলেই সাধারণ জনতার মধ্যে এক ধরনের ভয়, শঙ্কার আবির্ভাব ঘটে থাকে। অর্থাৎ যারা অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা স্বচক্ষে অবলোকন করেছে কেউই ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি চায় না। এক ধরনের অস্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশের সৃষ্টির মাধ্যমে অরাজকতা আনয়নের চেষ্টায় একটি পক্ষ চেষ্টা চালিয়েছিল। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো পৃথিবীর মানুষ অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা অবলোকন করেছে। কেবল বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ নয়, পুরো পৃথিবীর মানুষ অগ্নিসন্ত্রাসীদের প্রত্যাখ্যান করেছে, অগ্নিসন্ত্রাসীরা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বাংলাদেশে নির্বাচন আসন্ন, নির্বাচন সামনে রেখে দেশের সব জায়গায় নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিদেশি বন্ধুদের ভূমিকা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটুকু সহনীয় পর্যায়ে থাকতে পারে- এ বিষয়গুলো নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
এ আলোচনার মধ্যেই সাম্রাজ্যবাদে বিশ্বাসী আমেরিকা বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। নতুন ভিসানীতি কার্যত সরকারের বাইরে যারা আছে তাদের জন্য অনেকাংশে শাপেবরের ন্যায়। সরকারের বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে, তাদের ধারণা ছিল আসন্ন নির্বাচনে বিদেশি বন্ধুরা হস্তক্ষেপ করবে এবং এ মর্মে জনগণের সঙ্গে একাত্ম্য না হয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে অভিযোগ দিয়ে আসছিল। কখনো কখনো বিদেশি কূটনীতিকরা কূটনৈতিক শিষ্টাচার না মেনে এ দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে আলোচনার উত্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে ভিয়েনা কনভেনশনের শর্তানুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয় এবং কূটনীতিকরাও খানিকটা হলেও সাবধানতা অবলম্বন করে বক্তব্য দিচ্ছেন।
এহেন পরিস্থিতিতে আমেরিকার ভিসানীতি সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সংকট ব্যতিরেকে কিছু নয়। ভিসানীতিতে বলা আছে, নির্বাচনে বাধা সৃষ্টিকারী, ভোটারদের ভয় দেখানো, নাশকতা সৃষ্টি করা ও অগ্নিসন্ত্রাসকারীরা ভিসা পাবে না। সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো এক দফায় তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে নির্ধারণ করেছে। সেখানে উল্লেখ আছে- দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না, নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনকালীন প্রশ্নে বরাবরেই মতোই নীরব কূটনীতিকরা। কূটনীতিকদের প্রত্যাশা হচ্ছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কাজেই নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বিদেশি বন্ধুদের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিক দলের, এখন রাজনৈতিক দলগুলো যদি বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে এই মর্মে; বিদেশিদের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থার সমসাময়িক রীতির পরিবর্তন হবে, তাহলে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। কূটনীতিকরা কোনোভাবেই দেশের প্রচলিত আইনের পরিবর্তনের জন্য অনুরোধ জানাতে পারবে না, কেননা এটি রীতিবিরুদ্ধ হবে। বিদেশিরা যেটি করতে পারে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাতে পারে। সরকার কিন্তু এ বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে, যেকোনো মূল্যে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যদি আপনি দেখেন সরকারের মেয়াদে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রত্যেকটি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হচ্ছে এবং সরকার নির্বাচনে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করছে না। এ থেকে সহজেই অনুমেয়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর।
কেননা বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কোনোরূপ সংকট নিশ্চয় সরকার চাইবে না। বর্তমান সরকারের প্রধান বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, জনগণ চাইলে আছি, না চাইলে নাই। এ কথা থেকেই প্রতীয়মান হয়, সরকার চাচ্ছে জনগণের ভোটাধিকারের মাধ্যমেই আগামীর নতুন সরকার গঠিত হোক। আবার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করার ক্ষেত্রেও সরকার বদ্ধপরিকর। অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন পরিচালিত হবে। বর্তমানে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান নেই। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করতে চাইলে সংসদে উত্থাপিত এ-সংক্রান্ত বিলে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের প্রয়োজন রয়েছে। সংসদের বাইরে যারা এক দফা দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে, তাদের সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই। কাজেই নিয়মানুযায়ী আওয়ামী লীগ বাদে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সংসদে তত্ত্বাবধায়ক বিল প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের সুযোগ নেই।
সুতরাং ভিসানীতি ও বিদ্যমান সংবিধান সাংঘর্ষিক নয়। ভিসানীতিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হবে, আর নির্বাচন নির্বিঘ্নে পরিচালিত হতে হবে। যারা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দেবে এবং নাশকতা সৃষ্টি করবে, অগ্নিসন্ত্রাস করবে তাদের যুক্তরাষ্ট্র ভিসা প্রদান করবে না। অতীতে দেখা গেছে, সরকার নিয়মানুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে এবং একটি গ্রুপ তাদের তত্ত্বাবধায়কের দাবি উত্থাপন করে নির্বাচনের বিরোধিতা করে অগ্নিসন্ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে, স্বাভাবিক কাজে যারা ঘর থেকে বের হয়েছে তাদেরও নানা ফ্যাসাদে ফেলে কুপ্রবৃত্তি মানসিকতার বিকাশ ঘটিয়েছে। আর্থিক ও মানসিকভাবে সাধারণ জনগণের ওপর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে খাটো করেছে। এ পরিস্থিতির যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটাতে পারে ওই পক্ষটি; সে জন্যই আমেরিকা ভিসানীতিতে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে।
ভিসানীতি ও বিএনপির এক দফা আন্দোলন সাংঘর্ষিক। বিএনপির এক দফা দাবি হচ্ছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে। ভিসানীতিতে কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়া কেমন হবে সে বিষয়ে বলা নেই। আবার সরকার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনে বদ্ধপরিকর। এখন বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে, তাহলে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যে অরাজকতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, পুনরায় এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েই যায়। সে জায়গা থেকে নির্বাচনের আগে আমেরিকার ভিসানীতিতে এ বিষয়টির অন্তর্ভুক্তি বিএনপির জন্য একটি সতর্কবার্তা বটে। কেননা নির্বাচন ঘিরে অরাজকতার সৃষ্টি হলে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। কোনো দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে গেলে বৈশ্বিক রাজনীতির ব্যানারে সেসব মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুতরাং আসন্ন নির্বাচনে সব পক্ষকেই সতর্ক অবস্থানে থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি প্রকৃত অর্থে সরকার ও সরকারের বিরোধী জোটের জন্যই সতর্কবার্তা। এ ক্ষেত্রে সরকারের ইচ্ছার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার সামঞ্জস্যতা রয়েছে। এ হিসেবে সরকারি দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের জন্য ভিসানীতি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আবার যারা আওয়ামী জোটের বাইরে রয়েছে, সেসব দলকে প্রকারান্তরে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য পরোক্ষ নির্দেশনা বটে। নির্বাচনের রেসের বাইরে থেকে নির্বাচন আয়োজনে যারা বাধার সৃষ্টি করবে, মূলত তাদের জন্যই ভিসানীতি দুশ্চিন্তার। তথাপি আমেরিকার কর্তৃত্ববাদের বিষয়টি কিন্তু আবারও সমস্বরে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, নির্বাচনিক প্রক্রিয়া, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ইত্যাদি সংক্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের ছবক দেয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয় (যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্যানুযায়ী), দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ, রাজনৈতিক নেতৃত্বে এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতায়।
কাজেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের উচিত হবে, একসঙ্গে আলোচনায় বসে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা। ভিন্ন দেশের ছবক গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ আমাদেরই গড়তে হবে, সেখানে অন্যরা কোনোভাবেই আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে না। কিছু রাষ্ট্র রয়েছে যারা শুধু মোড়লগিরি করে বেড়ায়, কিন্তু কার্যত কাজের কাজ কিছুই করে না। সমস্যাকে কীভাবে জিইয়ে রাখা যায়, সে জায়গা থেকে চেষ্টা করে মধ্যস্থতার নামে ওই রাষ্ট্রটির বিভিন্ন জায়গা থেকে অলিখিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যায় কথিত মোড়লরা। সবার কাছে প্রত্যাশা থাকবে, আসন্ন নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় আগামীর নতুন সরকার গঠিত হবে এবং ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবে রূপদানের মাধ্যমেই স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ সম্ভব।
লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজেট তৈরি করা হয়নি। দেড় বছর ধরে দেশে ডলারসংকট। ডলারসংকটের কারণে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হচ্ছে না। এত বড় একটি ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, যা ডলারসংকট আরও বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যালান্স শিট এক্সপ্যান্ড করেছে। ফলে এ অর্থবছরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাপা হয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়েছে। আবার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়ে দিলেও ডলারসংকটের চাপ একই রকম থাকবে।
ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিলে আবার ঝুঁকি তৈরি হয়। কারণ বর্তমানে ব্যাংক খাতে আমানত কম। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ কমছে না। ব্যাংক থেকে অনেকে টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিনিয়ত ডলার কিনছে। এর বদলে নগদ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। তাই ব্যাংকে এমনিতেই এক রকমের তারল্যসংকট রয়েছে। ব্যাংক খাতের সক্ষমতা আগের চেয়ে কমেছে। তার মধ্যে সরকার বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে। সরকারকে ঋণ দিতে চাইবে ব্যাংক। এটি ব্যাংকের জন্য লাভজনক। কারণ সরকারকে ৭-৮ শতাংশ সুদে ঋণ দিলেও এটি ব্যাংকের জন্য লাভজনক। এতে এই টাকা আবার একটি নির্দিষ্ট সময় চলে আসবে। ব্যাংকের জন্য ঝুঁকি কম। ব্যক্তি খাতে ঋণ দিলে অনেক সময় খেলাপি হয়। তবে ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে আগ্রহী হলেও বেসরকারি খাতে প্রভাব পড়বে। রাজস্ব আয় পরোক্ষ করের ওপর জোর দেয়া হয়েছে বেশি। এমন যদি হয় বাইরের দেশে ডলারের দাম কমে যায় এবং জিনিসপত্রের দাম কমে যায়, তাহলে দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। তবে এ বছর দেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে কম, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বেশি। এই মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ ডলারসংকট। এযাবৎকালে এ রকম ডলারসংকট দেখা যায়নি বাংলাদেশে। ১৯৮৭-৮৯ সালে এ রকম ডলারসংকট দেখা দিয়েছিল। ফলে সার্বিক দিক বিবেচনা করলে এটি সময় উপযোগী বাজেট হয়নি।
এ বাজেট গতানুগতিক বাজেট। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ বাজেট দিয়ে অর্থনীতির অস্থিরতা রোধ করা সম্ভব হবে না। এ সময়ের জন্য একটি বাস্তবধর্মী বাজেট হওয়া দরকার ছিল। রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত নয়। ফলে সামগ্রিকভাবে এ বাজেট দিয়ে অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনা সম্ভব নয়। এবারের বাজেটে আগের চেয়ে সরকার ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ আগামী অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হবে বেসরকারি খাত। এটি অযোক্তিক।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। গত ১০ মাসের নিট বিক্রি নেগেটিভ। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙার পরিমাণ বেশি। সরকারের কোষাগার থেকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন বিধিনিষেধ বাড়ানো এবং আরোপ করার কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সামাজিক সুরক্ষা বিবেচনায় এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হয়নি। কারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর নির্ভর করে সংসার চালিয়ে থাকেন। নানা রকমের বিধি আরোপ করার কারণে সুদ কমে গেছে।
আর সুদের টাকা বেশি দিলেও তো মানুষের জন্যই তো এ ব্যয়। তাই সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা কমিয়ে আনা উচিত। ব্যাংকনির্ভরতা বাড়ালে সমস্যা দেখা দেবে। বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ পেলেও ছোট ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবেন না। কারণ ব্যাংকে এক ধরনের তারল্যসংকট তৈরি হবে।
অর্থনীতিতে নানা রকমের ইন্ডিকেটর রয়েছে। সেই ইন্ডিকেটর মোতাবেক একটি সূচক আরেকটি সূচকের ওপর নির্ভর করে। ফলে সামষ্টিকভাবে পর্যালোচনা করলে এই বাজেট বাস্তবসম্মত নয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সম্প্রতি সাতমসজিদ রোড এলাকার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে সড়ক বিভাজন তৈরি করতে গিয়ে সেখানে গাড়ির চাপ ও যানজট বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন গাছ কাটার প্রতিবাদ জানালেও জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া গাছ কাটার প্রক্রিয়া কয়েক মাস বন্ধ রাখার পর গত ৮ মে থেকে রাতের আঁধারে আবার চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এলাকার বট, বরই, বকুল, কৃষ্ণচূড়া শিরীষগাছসহ ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম এলাকার পাখি, পতঙ্গ ও সরীসৃপের মতো জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া প্রকৃতির এসব অনুষঙ্গ দীর্ঘকাল এলাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, যা ধ্বংস না করেই সেখানকার সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন সম্ভব ছিল বলে অভিমত পরিবেশবাদী সংগঠনের। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রখ্যাত পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিকল্পনা কার্যকর করতে গাছ কাটার মহোৎসবের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিছুদিন আগে। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’ নামের এক প্রকল্পের আওতায় নাকি সহস্রাধিক গাছও কেটে ফেলা হয়েছে! নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যে নানা প্রজাতির প্রাণী ও পাখির বিচরণ ছিল, বৃক্ষ নিধনের ফলে তা হুমকির মুখে পড়বে বলে পরিবেশবিদদের অভিমত। মানুষের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে নগরায়ণ আর উন্নয়নকাজে গাছ কাটার প্রয়োজন হতেই পারে। তবে তা কখনো প্রকৃতিকে ধ্বংস করে হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নগরায়ণ কার্যক্রমকে সফল করতে বিভিন্ন অঞ্চলে কাছ কাটা হয়েছে। বিশেষ করে মানুষের লোভের কবলে পড়ে দেশে নির্বিচারে নানা প্রজাতির গাছপালা নিধন করা হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। একটি অসাধু চক্র উন্নত প্রজাতির পুরোনো গাছ কেটে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে মুনাফা লুটেছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের কারণেও বিনষ্ট হচ্ছে বিপুল বনসম্পদ, বিপন্ন হয়েছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ।
জীববৈচিত্র্য রক্ষার লক্ষ্যে গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বহুবার। এই আদেশবলে কোনোক্রমেই বনভূমি থেকে কোনো গাছ কাটা যাবে না। এমনকি ঝড়ের কবলে অথবা মড়কে আক্রান্ত হয়ে বনাঞ্চলে যেসব গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, সেগুলোও কেউ সংগ্রহে নিতে পারার কথা নয়। কিন্তু কোনো আইনকানুন-বিধিনিষেধ আরোপ করেও বৃক্ষনিধন বন্ধ করা যায়নি। লুকিয়ে নয়, প্রকাশ্যে, লোকচক্ষুর সামনেই চলছে গাছ কাটার মহাযজ্ঞ।
সারা দেশে এমনই বৃক্ষ নিধনের মহাযজ্ঞে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতীক পাহাড় কাটার পাশাপাশি পাহাড়ের বন উজাড় ও বৃক্ষ নিধনের ফলে জীববৈচিত্র্য হচ্ছে হুমকির সম্মুখীন, বন্য প্রাণী হারাচ্ছে আবাসস্থল। প্রকৃতি হয়ে পড়ছে ভারসাম্যহীন। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসাবমতে, বাংলাদেশে বর্তমান বনভূমির পরিমাণ ১১ দশমিক ২ শতাংশ, যা বিশ্বের কম বনাঞ্চলের দেশ হিসেবে এশিয়ায় অবস্থান তৃতীয়। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সময় দেশে যে আয়তনের বনাঞ্চল ছিল, এখন তার অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বৃক্ষ এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। দেশে বর্তমানে মোট ভূমির পরিমাণ ১ কোটি ৪০ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে ১২ লাখ হেক্টর রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯০ সাল থেকে ১০ বছর মেয়াদে সংরক্ষিত বনে গাছ কাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর বেশ কয়েকবার এর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় বৃক্ষ কাটা থেমে থাকেনি। ভাওয়াল গড়, মধুপুর গড় দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। একসময় বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ বনভূমি কেটে ফেলে আবাসস্থল তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু এর বিপরীতে নতুন করে অধিক পরিমাণ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়নি বহুকাল ধরে। উপরন্তু দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অবিরাম চলছে নগর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। মানুষের নিত্যনতুন চাহিদা মেটাতে তৈরি হতে থাকে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা। আর এসব করতে গিয়ে কেটে ফেলা হয় প্রচুর পরিমাণ গাছপালা।
প্রাকৃতিক নিয়মেই উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে গঠিত জীববৈচিত্র্য অপরের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকে। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিতভাবে অবদান রাখে। বাংলাদেশের পাহাড় অঞ্চল, সমতল ভূমি এবং উপকূলীয় এলাকার সামান্য বনাঞ্চল, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড় এলাকার বনের কিছু গর্জন, সেগুন, জারুল এবং গামারিজাতীয় বৃক্ষ, দিনাজপুর, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের বনাঞ্চলের গাছপালা প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় অনেকটা সহায়তা করছে। বাংলাদেশের অহংকার তথা বিশ্বের প্রধান ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির গাছের ১০৬টির অস্তিত্ব ইতিমধ্যে বিলুপ্তপ্রায়। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমে খুলনা ও পটুয়াখালীজুড়ে অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন দীর্ঘকাল ধরে দেশের জীববৈচিত্র্য তথা পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রেখে চলেছে। প্রায় ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশের মোট বনভূমির প্রায় ৪৪ শতাংশজুড়ে এ বনের সুন্দরী, গেওয়া এবং কেওড়াগাছ রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় সুন্দরবনের বিপুল পরিমাণ গাছপালা ও পশুপাখির ভূমিকা অপরিসীম। কারণ উপকূলীয় বনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে বাতাসে আর্দ্র থাকে। বনভূমি যেকোনো উৎস থেকে আসা পানিপ্রবাহের চাপ কমায় এবং ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস থেকে দেশের মাটিকে রক্ষা করে। অধিকন্তু গাছপালা বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ কমিয়ে দিয়ে বাতাসে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে এবং বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়। ঝড়ঝঞ্জা, সাইক্লোন, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে। বাংলাদেশের ওপর স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলো দেশের বিভিন্ন স্থানসহ উপকূলীয় এলাকার বিশাল একটি অংশ লণ্ডভণ্ড করে দেয়। বিশেষ করে দেশের অমূল্য সম্পদ সুন্দরবন উপকূলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকার বন বিনষ্ট হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে সুন্দরবনের অবস্থানের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বিশাল জনবসতি এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। সুন্দরবনই ঝড়ের গতিবেগ রোধ করে ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ প্রকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করেছে। বাঁচিয়েছে উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য মানুষকে।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বনভূমি উজাড়, বন্য প্রাণীর বিলুপ্তিসহ অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পকারখানার দূষণকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এটি অনস্বীকার্য যে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়ে দেশের পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করতে অধিকতর বনাঞ্চল সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক। এ ক্ষেত্রে উপকূলীয় বনায়নেরও কোনো বিকল্প নেই। দেশের অরক্ষিত বিশাল চরাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বনাঞ্চল সৃষ্টি করে সবুজবেষ্টনী গড়ে তোলা জরুরি। উপকূলীয় বনভূমি সুরক্ষাসহ উপকূলীয় এলাকায় নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি জোরদার করা হলে তা ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে দেশকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। পুরোনো বন সংরক্ষণ, নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি এবং সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করে দেশের বনভূমিকে আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে উন্নীত করা অবশ্যই সম্ভব। পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়কে গুরুত্ব যতদূর সম্ভব গাছপালা, বনভূমি উজাড় না করে উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলমান রাখা জরুরি। উন্নয়নের পথে অগ্রসরমাণ বাংলাদেশের পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করে উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে বন্ধ করতে হবে বৃক্ষ নিধন। গাছ কাটা একটি আইনগত অপরাধ। রাজধানী ঢাকায় ইমারত নির্মাণ, সড়কসহ নানা ধরনের নগর অবকাঠামো তৈরির প্রক্রিয়ার ফাঁদে গাছপালা, জলাধার রক্ষা ব্যাপারটি উপেক্ষিত থাকার ফলাফল ইতিমধ্যেই টের পাওয়া গেছে।
পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়ার আগেই বৃক্ষ নিধন, জলাধার ভরাট বন্ধ করে এক বাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আগামীতে রাজধানীসহ দেশের যেকোনো অঞ্চলে গাছ কাটা বন্ধসহ পরিবেশ রক্ষায় দেশের প্রত্যেক মানুষকে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী
একাদশ জাতীয় সংসদের সর্বশেষ বাজেট অধিবেশনে গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি হচ্ছে সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট। এই বাজেট বাস্তবায়নকালেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কাজেই এবারের বাজেট নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটি হচ্ছে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থাপিত পঞ্চম জাতীয় বাজেট এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩তম বাজেট। এর মধ্যে ৫২টি পূর্ণাঙ্গ বাজেট এবং একটি ছিল খণ্ডিত বা আংশিক সময়ের জন্য বাজেট। এর মধ্যে আজকে যে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে সেটিসহ আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বিভিন্ন সময় সর্বাধিক ২৫টি বাজেট উপস্থাপন করছে। বিএনপি আমলে বিভিন্ন সময় মোট ১৭টি বাজেট উপস্থাপন করা হয়। আর সেনাশাসক এরশাদ আমলে মোট ৯টি বাজেট প্রণীত হয়। বাংলাদেশে সর্বাধিক ১২টি করে বাজেট প্রণয়ন করেন বিএনপি-দলীয় অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও আওয়ামী লীগ-দলীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য প্রথম বাজেট প্রণয়ন করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সেই বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য যে বাজেট বর্তমানে বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে, তার আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট আজ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার সার্বিক আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রস্তাবিত বাজেট চরিত্রগত দিক থেকে সম্প্রসারণমূলক বাজেট। বাজেটে রাজস্বপ্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশের মতো। মোট রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে রাজস্ব আসবে ৪ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করার জন্য আগামী বাজেট বাস্তবায়নকালে বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের যে অবস্থা তাতে বাড়তি ৪৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা বেশ কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। উল্লেখ্য, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। কাজেই আগামী অর্থবছরের জন্য এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সংশয় প্রকাশ করছেন। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত সূত্র থেকে সরকার ঋণ গ্রহণ করবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যাবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জন্য যে বাজেট প্রস্তাবনা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা এমন একসময় প্রণয়ন করা হয়েছে যখন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। এখনো বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার শুরু হয়নি। তবে যেকোনো সময় মন্দা দেখা দিতে পারে। নানা ধরনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি স্তিমিত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি এখনো তিন বছর ধরে চলা করোনা অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে ২০২২ সালের সূচনালগ্নে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যে এতটা দীর্ঘমেয়াদি হবে, তা অনেকেই অনুধাবন করতে পারেননি। বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব হয়েছে অতি ভয়ংকর। ফলে এক দেশের অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি হলে তার প্রভাব অন্য দেশের ওপরও পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়েছে তার প্রভাব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পড়েছে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রচণ্ডভাবে পড়েছে। অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই নিম্নমুখী রয়েছে। অর্থবছরের সমাপ্ত হওয়া ১০ মাসের অর্থনীতির যে চিত্র তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। একমাত্র রেমিট্যান্স ও পণ্য রপ্তানি খাতের আয় কিছুটা ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। অবশিষ্ট প্রায় সব খাতের অবস্থাই এখন অত্যন্ত খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। কথায় বলে, উচ্চ রিজার্ভ এবং ব্যক্তি খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ একটি দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অবস্থা। এমনকি তুলনামূলক কম স্ফীত রিজার্ভ এবং ব্যক্তি খাতে উচ্চমাত্রায় বিনিয়োগও কাম্য হতে পারে। কিন্তু বিনিয়োগবিহীন রিজার্ভ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যক্তিবিনিয়োগ এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ উভয়ই নিম্নমুখী রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপির ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল ২৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। পরবর্তী তিন অর্থবছরে এটি ছিল যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ ও ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ানো না গেলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পেতে পেতে গত মে মাসে ৩ হাজার ১৭ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। অথচ জুলাই, ২০২২-এ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৯৫৯ কোটি ডলার। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে পরিসংখ্যান প্রদান করে আইএমএফ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা তার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে পরিমাণ প্রদর্শন করে তার মধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডে দেয়া ৭ বিলিয়ন ডলারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু যে অর্থ আমার হাতে নেই তাকে কোনোভাবেই রিজার্ভ অর্থ হিসেবে প্রদর্শনের সুযোগ নেই। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমার কারণে সরকারকে তার উন্নয়ন ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। সরকার যদি ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণ করে, তাহলে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক-ঋণপ্রবাহ নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে। বিনিয়োগ কার্যক্রম ব্যাহত হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে ৭৯ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) সরকারের ব্যাংকঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে সরকার ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকাসহ অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করবে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করবে। চলমান মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। গত আগস্টে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ শিল্প ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমেছে ৫৬ শতাংশ। আর মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ৩১ শতাংশ। কাঁচামাল আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ শিল্প খাতে এক ধরনের স্থবিরতা রিরাজ করছে। কিন্তু ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি সেই হারে কমছে না। তার অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণ নিয়ে একটি মহল অন্যত্র প্রবাহিত করছে। এমনকি বিদেশে পাচার করছে বলে অনেকেই মনে করেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অস্বাভাবিক উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি। আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। এপ্রিলে এসে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো, এমনকি ভারতও তাদের উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্য প্রদর্শন করতে পারছে না। এই অবস্থায় আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়ে দিয়ে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত এক বছরে অন্তত তিনবার পলিসি রেট বাড়িয়েছে। আগে পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ, এখন তা ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু পলিসি রেট বাড়ানোর এই উদ্যোগ বাজারে অর্থ সরবরাহ কমানোর ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বাড়ালেও ব্যাংকঋণের সুদের আপার ক্যাপ (৯ শতাংশ) প্রত্যাহার করেনি। ফলে ব্যাংকঋণ গ্রহণ করা এখন আরও সহজ এবং সস্তা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এই হার খুব একটা উচ্চাভিলাষী বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ উচ্চমাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব অনুসারে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়ে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে সাড়ে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। তবে এই মুহূর্তে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাজেটে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বল্পমূল্যে খাবার জোগানসহ নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিধি বাড়ানো হয়েছে।
নিকট-অতীতে কখনোই সরকার রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তেমন একটা সাফল্য প্রদর্শন করতে পারেনি। তাই রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অথচ নেপালের মতো দেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে ২৩ শতাংশ। কাজেই আমাদের এ ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে হবে। আগামী অর্থবছরে ট্যাক্স আদায় বৃদ্ধির জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেয়া হলেও এই সুযোগ কেউ গ্রহণ করেননি। তাই আগামী অর্থবছরে এই সুযোগ আর থাকছে না। এটি খুব ভালো একটি উদ্যোগ। কারণ পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সুযোগ দিলেও খুব বেশিসংখ্যক মানুষ এই সুযোগ গ্রহণ করেনি। এ ছাড়া টাকা পাচারকারীদের শাস্তিদানের পরিবর্তে সামান্য ট্যাক্স প্রদানের বিনিময়ে অবৈধ অর্থ দেশে ফেরত আনতে দেয়াটা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, করমুক্ত আয় পুরুষদের ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লাখ টাকা এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৪ লাখ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। আগামী অর্থবছর থেকেই সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হবে। যারা টিআইএনধারী, তারা রিটার্ন দাখিল করলেই ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
দুনিয়ার সপ্তম আশ্চর্যের যারা আবিষ্কারকর্তা, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ঘর কাবাকে এ তালিকায় স্থান দেননি। বস্তুত কাবাঘরের সৌন্দর্যও অপরূপ রূপের, যা হাজার হাজার বছর ধরে দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে মানুষকে আকর্ষণ করে রেখেছে। প্রতিটি বছর আর কোনো স্থাপনাকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি মানুষের আবর্তনের ঘটনা দুনিয়ায় আর একটিও নেই।
এ ঘরের অনেক নাম রয়েছে। প্রথমত কাবা, যার অর্থ ‘সম্মুখ’ বা ‘সামনে’। আর একটি রয়েছে বায়তুল্লাহ, এর অর্থ আল্লাহর ঘর। একে হারাম শরিফও বলা হয়। কারণ এখানে যেকোনো প্রকার গুনাহ এবং যাবতীয় নাজায়েজ কাজ হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঝগড়া-বিবাদ, যুদ্ধও এখানে নিষেধ।
ইবনে কাসির হাদিস শরিফ বায়হাকির উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া দুনিয়ায় আগমনের পর আল্লাহতাআলা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে তাদের কাবাঘর নির্মাণের আদেশ দেন। ঘর নির্মিত হয়ে গেলে তাদের তা তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করার নির্দেশ দেয়া হয়।’ এ সময় আল্লাহ দুনিয়ার প্রথম নবী আদম (আ.)-কে বলেন, ‘হে আদম আপনি দুনিয়ার প্রথম মানুষ এবং এ গৃহ মানবজাতির জন্য প্রথম ঘর।’ (তাফসির ইবনে কাসির)।
মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলবি তার কিতাবে এ ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন, আল্লাহতাআলা যখন আদম (আ.)-কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় নামিয়েছেন, তখন তার সঙ্গে আল্লাহ তার নিজের ঘরও নামিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘হে আদম, আমি আপনার সঙ্গে আমার নিজের ঘরও নামাচ্ছি। দুনিয়ায় এর তাওয়াফ করা হবে, যেমনটা আমার আরশে এর তাওয়াফ করা হয় এবং এর দিকে ফিরে এমনভাবে নামাজ পড়া হবে যেমন আমার আরশের দিকে ফিরে নামাজ পড়া হয়ে থাকে।’ (ফাজায়েলে হজ, অনুবাদ: মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের, দ্বীনি প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ১৪৪০ হিজরি, পৃষ্ঠা ৮)।
কাবাঘরের এ স্থাপনা হজরত নূহ (আ.)-এর যুগ পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। কিন্তু নূহের যুগে যে মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়, তাতে কাবাঘরের এ স্থাপনাও বিধ্বস্ত হয়। পরে হজরত ইব্রাহিম (আ.) প্রাচীন ভিত্তির ওপরই এ গৃহ পুনর্নির্মাণ করেন। মুফতি শাফি (র.) তার পবিত্র কোরআন তাফসির কিতাবে লিখেছেন, ‘ইব্রাহিম (আ.) এবং ইসমাইল (আ.) কাবার প্রাথমিক ভিত নির্মাণ করেননি, বরং আগের ভিতের ওপরই কাবাঘর পুনর্গঠন করেন।’ (পবিত্র কোরআনুল করিম, মুফতি শাফি (র.) তাকসিরকৃত, কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, মদিনা, ১৪১৩ হি. পৃষ্ঠা ১৮৮)। সুরা হজেও উল্লিখিত হয়েছে, ‘যখন আমি ইব্রাহিমের জন্য কাবাঘরের স্থান ঠিক করে দিলাম।’ (সুরা হজ, আয়াত : ২৬)। এ থেকে আলেমরা সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে, কাবাঘরের জায়গা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। কোনো কোনো কিতাবে বলা হয়েছে, ইবারাহিম (আ.)-কে কাবাঘর নির্মাণের আদেশ দেয়ার পর ফেরেশতাদের মাধ্যমে বালুর স্তূপের নিচে পড়ে থাকা কাবাঘরের পূর্বের ভিতকে চিহ্নিত করে দেয়া হয়।
পরবর্তীকালে এক দুর্ঘটনায় প্রাচীর ধসে গেলে কাবার পাশে বসবাসকারী জুরহাম গোত্রের লোকেরা একে পুনর্নির্মাণ করেন। এভাবে কয়েকবার বিধ্বস্ত হওয়ার পর একবার আমালেকা সম্প্রদায় ও একবার কোরাইশরা এ গৃহ নির্মাণ করে। সর্বশেষ এ নির্মাণে মহানবী (সা.)-ও শরিক ছিলেন এবং তিনিই ‘হাজরে-আসাওয়াদ’ স্থাপন করেছিলেন।
কিন্তু ইসলাম-পূর্ব যুগে কোরাইশদের এ নির্মাণের ফলে ইব্রাহিম (আ.)-এর মূল ভিত্তি সামান্য পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রথমত, একটি অংশ এর ‘হাতিম’ কাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, ইব্রাহিম (আ.)-এর নির্মাণে কাবা গৃহের দরজা ছিল দুটি, একটি প্রবেশের জন্য এবং অন্যটি পশ্চাৎমুখী হয়ে বের হওয়ার জন্য। কিন্তু কোরাইশরা শুধু পূর্ব দিকে একটি দরজা রাখে। তৃতীয়ত, তারা সমতল ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে দরজা নির্মাণ করে, যাতে সবাই সহজে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। বরং তারা যাকে অনুমতি দেয়, সে-ই যেন প্রবেশ করতে পারে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার হজরত আয়েশা (রা.)-কে বলেন, ‘আমার ইচ্ছা হয়, কাবাগৃহের বর্তমান নির্মাণ ভেঙে দিয়ে ইব্রাহিমের নির্মাণের অনুরূপ করে দিই। কিন্তু কাবা গৃহ ভেঙে দিলে নতুন মুসলিমদের মনে ভুল-বোঝাবুঝি দেখা দেয়ার আশঙ্কার কথা চিন্তা করেই বর্তমান অবস্থা বহাল রাখছি।’ হজরত আয়েশা রাজিয়াল্লাহু আনহার ভাগ্নে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) মহানবী (সা.)-এর উপরোক্ত ইচ্ছা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদিনের পর যখন মক্কার ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি ওপরে ওই ইচ্ছাটি কার্যে পরিণত করেন এবং কাবাঘরের নির্মাণ ইব্রাহিম (আ.)-এর নির্মাণের অনুরূপ করে দেন। মাওলানা আমিনুল ইসলাম তার তাফসির কিতাবে আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়েরের এ সংস্কারকাজ ৬৪ হিজরির ২৭ রমজানে শেষ হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। (তাফসিরে নূরুল কোরআন, আলবালাগ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পঞ্চম মুদ্রণ, ২০১২, পৃষ্ঠা ৪৪৫)।
কিন্তু হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর ইসলাম-পূর্ব জাহেলিয়াত আমলের কোরাইশরা যেভাবে নির্মাণ করেছিল, সেভাবেই পুনর্নির্মাণ করেন। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের পর কোনো কোনো বাদশাহ উল্লিখিত হাদিস অনুযায়ী কাবাঘরকে ভেঙে আবার নির্মাণ করার ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন ইমাম হজরত মালেক ইবনে আনাস (রা.) ফতোয়া দেন যে, ‘এভাবে কাবাঘরের ভাঙাগড়া অব্যাহত থাকলে পরবর্তী বাদশাহদের জন্য একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়ে যাবে এবং কাবাঘর তাদের হাতে একটি খেলনায় পরিণত হবে। কাজেই বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে, সে অবস্থায়ই থাকতে দেয়া উচিত।’ গোটা মুসলিম সমাজ তার এ ফতোয়া গ্রহণ করে নেয়। তবে মেরামতের প্রয়োজনে ছোটখাটো কাজ সব সময়ই অব্যাহত থাকে। মাওলানা আমিনুল ইসলাম তার তাফসির কিতাবে লিখেছেন, ‘কোশাই বিন কিলাব নামে একজন কাবাঘরের সংস্কার করেছিলেন এবং তিনি প্রথম কাবাঘরকে গিলাফ দ্বারা আবৃত করেন।’ (তাফসিরে নূরুল কোরআন, প্রথম খণ্ড, আলবালাগ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পঞ্চম মুদ্রণ, ২০১২, পৃষ্ঠা ৪৪৪)।
কাবাঘর বানানোর পর আল্লাহতাআলা এ ঘর এবং এ ঘরের চারপাশকে ‘নিরাপদ’ বলে ঘোষণা করেন:
১. ‘ওরা কি দেখে না আমি কাবাঘরের চারপাশ যা হারাম শরিফ বলে পরিচিত, তাকে নিরাপদ বলে ঘোষণা করেছি।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৬৭)।
২. ইব্রাহিম (আ.)-ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ, মক্কাকে নিরাপদ শহর করে দিন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১২৬)।
৩. ‘যে কেউ কাবাঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ।’ (সুরা আল-ই-ইমরান, আয়াত: ৯৬-৯৭)।
৪. ‘মসজিদ-উল-হাবামের কাছে (কাবার কাছে) যুদ্ধ করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯১)।
৫. ‘আমার ঘরকে পবিত্র রেখো।’ (সুরা হজ, আয়াত: ২৬)।
৬. ‘আমি কাবাঘরকে মানুষের মিলনক্ষেত্র ও আশ্রয়স্থল হিসেবে তৈরি করেছি।’ [সুরা বাকারা, আয়াত: ১২৫)।
তাই কাবাঘর হলো দুনিয়ার মধ্যে একটি বিশেষ নিরাপদ স্থান। দুনিয়ায় এ রকম আরেকটি দৃষ্টান্তও নেই। এটি ইমানদারদের জন্য একটি মিলনক্ষেত্র এবং আশ্রয়স্থলও। তবে যারা অবিশ্বাসী, ইমানহীন এবং আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে, আল্লাহর অংশীদার বানায়, তারা কাবাঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। (সুরা তওবা, আয়াত: ২৮)।
লেখক: গবেষক ও ইতিহাসবিদ
নির্বাচনের রাজনীতি একটা বিজ্ঞান- এখানে হিসাব খুব জটিল। ভুল হলে গরল। আওয়ামী লীগ সেই হিসাবে ব্যর্থ হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম বলেছিলেন, ‘নৌকার বিজয় হয়েছে।’ সমসাময়িক রাজনীতির যে হালচাল, তাতে নৌকার নয়, তারই জয়। তবে নৌকার পরাজয় হয়েছে কি না সেই প্রশ্নটা জরুরিভাবে উসকে দিচ্ছে- জাহাঙ্গীর আলমের ভাষায় ‘এটি নৌকার নয় বরং ব্যক্তি আজমত উল্লার পরাজয়’- এ আলাপে। নেটিজেনদের ঠাট্টা- সুষ্ঠু ভোটের জন্য আমেরিকার চাপে প্রথম ‘বলি’ হলেন আজমত উল্লা।
জাহাঙ্গীর ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছেন নির্বাচনের অঙ্ক তিনি ভালোই বোঝেন। আঁচ করতে পেরেছিলেন তাকে নির্বাচন করতে দেয়া হবে না, তাই মাকে প্রার্থী করে রাখেন। তার এ কৌশলী সিদ্ধান্তের কাছে আওয়ামী লীগ হেরেছে। জাহাঙ্গীরের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা, উপস্থিত বুদ্ধি ও জনগণের সজাগ দৃষ্টির কাছে আওয়ামী লীগের ‘কৌশল’ হেরেছে। এ ছাড়া গাজীপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার রাজনীতির কাছে, তার আদর্শের কাছে হেরেছে।
আওয়ামী লীগ ভেবেছিল জাহাঙ্গীরের মা অখ্যাত। ছেলের মতো প্রভাব ফেলতে পারবেন না তিনি। ব্যাপারটা হালকাভাবে নেয়াটা আওয়ামী লীগের ভুল ছিল। বহু দিন ধরে তারা এ কাজটি করে আসছে, ‘প্রতিপক্ষকে কখনো দুর্বল ভাবতে নেই’।
প্রার্থী হওয়ার আগে জাহেদা খাতুনকে রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে গাজীপুরের মানুষ চিনত না, নির্বাচন তো দূরের কথা, কোনো রাজনৈতিক কমর্সূচিতে তিনি ছিলেন না। জাহাঙ্গীর তার সেই মায়ের পক্ষে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটকে একাট্টা করেছেন। নীরব সমর্থকদের সংগঠিত করেছেন। তিনি তার মাকে নিয়ে সাধারণ ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে গেছেন, কান্নাকাটি করেছেন। ভোটারদের সহানুভূতি আদায় করেছেন। আর আজমত উল্লা ভোটারদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না। জাহাঙ্গীরের মাকে তিনি খুব একটা হিসাবে ধরেননি। এটা ছিল ক্ষমতাসীনদের ভুল।
বাংলাদেশে এতদিন উত্তরাধিকারের রাজনীতির সংস্কৃতিতে বাবা কিংবা মায়ের আসনে সন্তান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। এবার তার উল্টোটি ঘটতে দেখা গেল। ছেলে আর মা মিলে আজমত উল্লাকে ১৬ হাজার ভোটে পরাজিত করেছেন। তা নিশ্চিত করেছেন আওয়ামী লীগের কৃপাধন্য ব্যক্তিরাই। তারা বিশ্বাস করেন, জাহাঙ্গীর রাজনীতিতে আসার পর এবং মেয়র হয়ে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। সরকারের ভেতরেও অনেকে আছেন যারা তার থেকে সুবিধা নিয়েছেন। এটাকে কাজে লাগিয়েছেন জাহাঙ্গীর।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গাজীপুরের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানান সমীকরণ-নানা আলাপ শুরু হয়েছে। এটা ঠিক, সরকারের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল এ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার ব্যাপারে। কেননা, জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, মানুষের মুখে ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন- নির্বাচন হবে তো? তাতে সব দল অংশ নেবে তো? কাজেই সেই চ্যালেঞ্জকে অনেকটাই সামাল দিতে পেরেছে সরকার। এটা একটা ইতিবাচক দিক। এ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা বাড়াবে। দলের নেতারা ইতিমধ্যে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন একইভাবে অবাধ-সুষ্ঠু হবে। এ শুধু কথার কথা। নিজের নাক কেটে কেউ অপরের যাত্রা ভঙ্গ করে না।
আওয়ামী লীগের ভেতর আরেকটি আওয়ামী লীগ তৈরি হয়েছে, তা প্রমাণ হয়েছে এ নির্বাচনে। এ আওয়ামী লীগ মোটেও ‘অরিজিনাল’ নয়। এর আগেও আমরা নানাভাবে এটা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এ বিষয়টিকে অনেকটা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গত ১৫ বছরে নানা ছদ্মাবরণে নানাভাবে একটি গোষ্ঠী আওয়ামী লীগের ভেতরে ঢুকে গেছে, এরা যে কখন আওয়ামী লীগের ভেতর প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে, দল এটা ধারণা করতে পারেনি। এখন যারা আওয়ামী লীগ করেন তাদের মধ্যে একটা অংশ তা করেন স্বার্থসিদ্ধির জন্য, দলের আদর্শের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি খুব ক্ষীণ- এটাও এ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছিল অতি আত্মবিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী। ২০১৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে অহঙ্কার এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ মনে করেন, দল যাকে মনোনয়ন দেবে তাকে প্রভাব খাটিয়ে জিতিয়ে আনবে। গাজীপুরে সেই প্রবণতা দেখা গেছে। যার কারণে যেভাবে গুরুত্ব সহকারে মাঠে কাজ করার দরকার ছিল, সেভাবে তারা গাজীপুরে কাজ করেননি। রাজনীতি হুমকি, ধমকের বিষয় নয়। একটি সমঝোতার কৌশল। এ চিরন্তন সত্যটা আওয়ামী লীগ ভুলেই গেছে।
জাহাঙ্গীর ও তার মা যখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন, তখন আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ‘দমননীতি’ কৌশল নিয়েছিল। জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ভুল কৌশল প্রয়োগ করেছেন। ভোটের আগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা, দুদকে তলব, প্রচারের সময় গাড়ি ভাঙচুর, তার কর্মীদের ওপর পেশিশক্তি প্রয়োগ- সবই জনগণের মধ্যে জায়েদা খাতুনের পক্ষে এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি করেছে। ভোটের দিন দেখা গেছে, নৌকা গলায় ঝুলিয়ে তারা ঘড়ি মার্কায় ভোট দিয়েছেন।
গাজীপুরে পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। তারা জানাল- ব্যক্তি জাহাঙ্গীর আলমের ইমেজ ও তার উন্নয়ন কাজ নগরবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। তারা বলছেন, মেয়র থাকাবস্থায় সড়ক সম্প্রসারণের নামে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি নেয়াসহ নানারকম অনিয়মের কারণে কিছুটা জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। তবে তার তিন বছরের শাসনামলে এলাকায় অনেক উন্নয়ন করেছেন তিনি। রাস্তাঘাটসহ এলাকার চিত্র পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এর প্রতিদান তারা ভোটের মাঠে দিয়েছেন। তাদের ধারণা, তাকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হলে থমকে যায় উন্নয়ন কাজ। নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নাজেহাল হন জাহাঙ্গীর। কিন্তু সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা তার ওপর অটুট থাকায় নির্বাচনের মাঠে প্রভাব ফেলে জায়েদা খাতুনের বিজয়।
জাহাঙ্গীর আলমের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণেই তার বিজয় সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। ঋণখেলাপির দায়ে তার প্রার্থিতা বাতিল হবে- এটা জানত জাহাঙ্গীর। তাই তার পক্ষে মা জায়েদা খাতুনকে তিনি মেয়র পদে দাঁড় করান। ছেলের কৌশলে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছেন মা। সাধারণ নারী ভোটারদের অকুণ্ঠ সমর্থন, শ্রমিকদের মধ্যে জাহাঙ্গীরের জনপ্রিয়তাও জায়েদা খাতুনের জয়ে ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া নির্বাচনের প্রচারে কয়েক দফা হামলা, বাধা দেয়ার বিষয়টি মানুষের নজর কেড়েছে। ফলে মানুষ অনেকটা বিরক্ত হয়েই আজমত উল্লা খানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। বিরোধী শিবিরের ভোটও পড়েছে জাহাঙ্গীরের মায়ের ব্যালটে। বুকে নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে অনেকেই ভোট দিয়েছেন ‘আম্মাজানকে’। জায়েদা খাতুন যেসব আসনে এজেন্ট দিতে পারেননি, সেখানেও জিতেছেন তিনি। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় তারা ও তাদের শরিকরা জায়েদা খাতুনের প্রতীকে ভোট দিয়েছেন।
আজমত উল্লা মার্জিত, বিনয়ী ও স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ হিসেবে গাজীপুরের রাজনীতিতে পরিচিত হলেও তার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দলের তৃণমূলের নবীন কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগের ঘাটতি রয়েছে। সেটি বয়সের কারণে হোক কিংবা তার ব্যক্তিগত অন্য কোনো কারণেই হোক।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে ঢিলেমি ছিল প্রচারে। বড় বড় শোডাউন এবং রোডশো করলেও মানুষের দ্বারে দ্বারে যাননি। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে একাধিক নেতা পরাজয়ের কারণ হিসেবে বলছেন, দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী মধ্যে ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব, গ্রুপিং। এতে আওয়ামী লীগের ভোট দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের একাংশ গোপনে ঘড়ির পক্ষে কেন্দ্রে কাজ করেছে। নৌকার প্রার্থী তা ধরতে পারেননি। তার এজেন্টরা কেন্দ্রের ভেতরেও নৌকার পক্ষে তৎপর ছিলেন না। ভোটের পর আজমত উল্লা বলেছেন, দলে থাকা বেইমানদের গাদ্দারিতে হেরেছেন। আবার সাধারণ মানুষের সঙ্গে আজমত উল্লার যোগাযোগ জাহাঙ্গীরের মতো নিবিড় নয়। গাজীপুর-টঙ্গীর ভোটারদের একটি বড় অংশ শ্রমিক। তারা জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে নানা সময়ে সাহায্য-সুবিধা পেয়েছেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো ও নির্বাচনী ব্যবস্থাটি এমন জায়গায় চলে গেছে যে, কার চেয়ে কে কতটা যোগ্য ও ভালো মানুষ- সেটি তার জয়-পরাজয়ের নিয়ন্ত্রণ করে না। মানুষ এখন ভোট দেয় কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, বরং অনেক সময় ভোট দিয়ে তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। যে কারণে দেখা যায়, দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকের বাইরে থাকা বিপুল ভোটারের অনেকেই সুযোগ পেলেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হন। আবার ক্ষমতাবানের কাছ থেকে তার কমিউনিটির অনেক মানুষ যেমন উপকৃত হন, তার বিপরীতে বিপুলসংখ্যক মানুষ বঞ্চিত এবং নানাভাবে নির্যাতিতও হন। ফলে তারা ভোটের সময় ‘দেখিয়ে দেয়ার’ অপেক্ষায় থাকেন। এ দেখিয়ে দেয়ার ব্যাপারগুলো গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঘটেছে। মানুষের ক্ষোভের আঁচটা যে মাত্রায় ছড়িয়েছে, এর প্রভাবটা এ নির্বাচনে পড়েছে। প্রশ্ন হলো- এ জয় কি তাহলে মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ?
বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়েছিল আওয়ামী লীগই। দলের মধ্যে একটা অংশ তো বিরুদ্ধে ছিলই। গাজীপুর নির্বাচন আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহ এবং বিভক্তির ভয়ংকর রূপ বের হয়েছে। উপরিভাসা দলে ঐক্য থাকলেও ভেতরে দলীয় কোন্দল চরমে। যার খেসারত আওয়ামী লীগকে দিতে হয়েছে। আর এ কারণেই গাজীপুরের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি, অভ্যন্তীরণ দ্বন্দ্ব, জনগণের মনোভাব ইত্যাদি সম্পর্কে দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে যে সঠিক তথ্য নেই, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনগুলোতেও যদি এরকম অন্তর্কলহ থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য বিষয়টি শুভ হবে না। আওয়ামী লীগকে উন্নয়নগর্বে আত্মমগ্ন থাকলে চলবে না। দলের মধ্যে বিভেদ, একশ্রেণির নেতা-কর্মীর ঔদ্ধত্য, বাড়াবাড়ি আচরণের জন্য ভেতরে ভেতরে যেসব শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ করার ক্ষেত্রে আলসেমি করলে ফল কেমন হবে তা গাজীপুরই জানিয়ে দিচ্ছে।
লেখক: প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন
হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে তোলা সভ্যতা এখন ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত। আমাদের সংস্কৃতিতে বিদ্রোহ আছে, বিষণ্ণতা আছে। সেখানে ভাষা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির ঐক্যের ভিত্তি। ওই ভাষা বিকশিত হয়েছে, বাংলা ভাষায় অতুলনীয় সাহিত্য ও সংগীত রচিত হয়েছে, কিন্তু ভাষা বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। শ্রেণির কারণে। বাঙালি তার ভাষার দ্বারাও বিভক্ত বটে। সেখানে সাম্প্রদায়িকতা ছিল, ছিল আঞ্চলিকতা; সব বাঙালিকে আজও শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব হয়নি, শিক্ষিত বাঙালি সবাই বই পড়ে না, উচ্চশিক্ষিতরা চর্চা করে ইংরেজি ভাষার। এ থেকে উত্তরণের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।
অর্থনীতির বিশেষ বিন্যাসের ওপর শ্রেণির অবস্থান। কিন্তু এ সত্যটাকে সে চায় এড়িয়ে চলতে। অর্থ যত বাড়ে, ততই বাড়ে ঘরের আসবাব আর বাড়ে কতকগুলো অমূর্ত ধারণার তার উৎসাহ। তখন সে কথা তোলে চরিত্রের, সত্যের, নীতির, ন্যায়-অন্যায়ের। এরাও আসবাবই এক প্রকারের- মানসিক আসবাব। কিন্তু বড় বড় ধারণার নিচে নিয়ামক শক্তি যে স্থূল অর্থনীতি, সেই স্পষ্ট সত্যটাকে যতক্ষণ পারা যায়, যেভাবে পারা যায়, যতবার পারা যায় অস্বীকার ও উপেক্ষা করার কাজটা সমানে চলতে থাকে। যেন রৌপ্য মুদ্রার দাপটটা মেনে নিলেই শুভকর্মের সমস্ত শুচিতা বিনষ্ট হয়ে যাবে, যেন অর্থোপার্জনের ব্যতিব্যস্ত কাজটা অতিশয় নোংরা ও নীতিবিগর্হিত।
অমূর্ত ধারণাগুলোকে নিয়ে অনেক রকম শব্দ করা হয়, কিন্তু সব শব্দ ছাপিয়ে ওঠে একটা কথা- শিক্ষা। শিক্ষা চাই, শিক্ষা দিতে হবে, শিক্ষার আলো লাগলে অন্ধকারের আর রক্ষে নেই, একেবারে উদ্বাস্তু হয়ে যাবে। এর কারণ আছে। শিক্ষাই সেই সদর সিঁড়ি যা বেয়ে আমরা মধ্যবিত্তরা উঠে এসেছি। বিদ্যা দিয়েই বিত্ত অর্জন করেছি, যদি করে থাকি এবং যেটুকু করেছি। আর দেশ যেহেতু একই সঙ্গে অজ্ঞ ও দরিদ্র তাই বিদ্যা নিজেই একধরনের বিত্ত। কিন্তু যখন শিক্ষা প্রসারের হট্টগোল ওঠে তখন এ কথাটা খেয়াল করা হয় না যে, প্রসারের জন্য পথঘাট তৈরি আছে কি না শিক্ষা আমরা ক্রয় করি। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতা তো সবার নেই, যার আছে শিক্ষা শুধু সে-ই পাবে, এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীর বুদ্ধিগত যোগ্যতার কথাটা প্রায় অবান্তর। অর্থাৎ শিক্ষাবিস্তারের বড় বড় সড়ক আটকে রেখে শিক্ষাকে তাড়া দেয়া হচ্ছে ছড়িয়ে পড়ার। আর পরিসংখ্যানের হিসাব দেখিয়ে বড়াই চলছে যে, শিক্ষা দেশের আনাচে-কানাচে বিস্তর আলো বিতরণ করছে। বড় প্রশ্ন আরও একটা আছে। যে শিক্ষাটা তাড়া দেয়া হচ্ছে তার প্রকৃতিটা কী? ঔপনিবেশিক যুগের শিক্ষাব্যবস্থা কেরানি তৈরির যন্ত্রের চেয়ে বড় কিছু ছিল না, একটা প্রচলিত সমালোচনা। সেই ব্যবস্থার সংশোধন হয়তো কিছুটা হয়েছে, কিন্তু তার খোলনলচে বদল অনেক দূরের কথা। আর যদি শুধু কেরানি তৈরি নাও হয়, রদবদলের মাধ্যমে ব্যবস্থাটা যদি উৎপাদনশীল হয়েও ওঠে, তাহলে কি দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে দুধ ও মধুর বন্যা বয়ে যাবে? ধরে নিলাম অনেক বিজ্ঞানী, কারিগর, অর্থনীতিবিদ কি পণ্ডিত তৈরি হলো, দেশের উৎপাদনও বাড়ল কিছু, কিন্তু তাতে দেশের অগুনতি মানুষের বিশেষ কি আসবে যাবে? যা উৎপন্ন হবে তার প্রায় সবটাই তো বিত্তবান ও মধ্যবিত্তরা দখল করে নেবে। যেমন নিয়েছে অতীতে, নিচ্ছে এখনো। বস্তুত এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ধনবণ্টনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার মধ্যে কুশলী ও দক্ষ মানুষ তৈরি অর্থ মধ্যবিত্ত শ্রেণিটাকেই আরও খানিকটা শক্ত ও স্ফীত করা। বিদ্বানের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে উৎকেন্দ্রিকতা, পরিবেশ সম্পর্কে হীনম্মন্যতা, ক্ষোভ ও ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃণা। পরিপুষ্টি যা ঘটছে তা এ বোধেরই। তাই শিক্ষা যদি বিবেকের উদ্বোধন না ঘটায় তাহলে তার সদম্ভ বিস্তারে বরং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কারণ আছে। সংখ্যায় বাড়ছে অথচ ক্রয়ক্ষমতায় বাড়ছে না এমন অবস্থা অর্থনীতিতে বিপজ্জনক; শিক্ষাব্যবস্থায় ততোধিক। শিক্ষাস্ফীতি মুদ্রাস্ফীতির চেয়েও ক্ষতিকর।
শিক্ষা বিস্তারের উল্টো পিঠে আরেকটা সমস্যার অস্তিত্বও স্বীকার করতে হয়। শিক্ষিত হলে মানুষ অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে চায়, তার প্রবণতা হয় নিজের চারপাশে একটা দূরত্ব ঘনিয়ে নেয়ার। সেই খানে প্রয়োজন সাহিত্যের। সাহিত্য পারে মানুষকে তার সংকীর্ণ স্বার্থের ক্ষুদ্র বিবর থেকে বের করে এনে বাইরের বৃহৎ জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে। কাজেই শুধু শিক্ষার সংখ্যাগত বিস্তার ঘটছে, সৎ ও বিবেকবান সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে না—এটাও সুখবর নয়, কেননা এর তাৎপর্য হলো, বুদ্ধি এগিয়ে গেছে, বিবেক আছে পেছনে পড়ে। কিন্তু সাহিত্যের যে প্রকারভেদ আছে সেটাও মেনে নেয়া আবশ্যক। সাহিত্যের মাধ্যমে যদি মধ্যবিত্তের মানসবিলাস, উগ্র নগরচেতনা, নকল আধুনিকতা, বিষয়বস্তুর চেয়ে আঙ্গিককে অধিক গুরুত্ব দেয়ার অভিরুচি—ইত্যাকার বিষয়কে দেশময় ছড়িয়ে দেয়া হয় তাহলে সেই সংক্রামক ব্যাধিতে কোনো মঙ্গল সূচিত হবে এমন বিবেচনা করা কঠিন। আসলে মধ্যবিত্ত সাহিত্যের বিস্তার মানে মধ্যবিত্ত চেতনারই বিস্তার, নব্যশিক্ষিতের অবরোধ দশাটা যাতে আরও পাকাপোক্ত হয় তারই ব্যবস্থা গ্রহণ। পাকিস্তান আমলে দেখা গেছে, সাহিত্যের ঐতিহ্য নিয়ে বিস্তর বিতণ্ডা হয়েছে এবং ঐতিহ্য দেশে খুঁজে না পাওয়া গেলে বিদেশেও তার খোঁজাখুঁজি চলছে। এ কাজটার পেছনে শুধু যে শাসকের প্ররোচনা ছিল তা নয়, সেই সঙ্গে সক্রিয় ছিল মধ্যবিত্তের অভিমান ও অহমিকা। তার অতীত থাক বা না থাক, অতীত নিয়ে গর্ব থাকা চাই। কিন্তু আপত্তি এখানে যে, আমরা আমাদের মধ্যবিত্ত অভিমান ও অহমিকার বোঝা দেশের মানুষের দুর্বল ও নিরপরাধ কাঁধের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছি। সাহিত্যকেও তাই মধ্যবিত্ত গণ্ডির বাইরে আনা অত্যন্ত আবশ্যক।
শিক্ষা ও সাহিত্য পরিবর্তনের পন্থা বটে, কিন্তু তাদের চেয়ে সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত ফলপ্রসূ পন্থা আছে। সেটা রাজনীতি। মধ্যবিত্তের ছুঁতমার্গ ও শুচিবাইগ্রস্ততা রাজনীতির প্রশ্নে যতটা স্পষ্ট, তেমন বোধহয় আর কোথাও নয়। তার দৃষ্টিতে রাজনীতি হলো একটা পেশা। পেশাদার যারা এতে শুধু তাদের এখতিয়ার—যেমনটা সত্য আর পাঁচটা পেশার ব্যাপারে। কিন্তু এ পেশাটা আর পাঁচটা পেশার মতো মহৎ নয়, এমনকি সত্ত্ব নয়; বরং এটা খারাপ পেশাই, খারাপ লোকদেরই পেশা, বখাটেদের শেষ আশ্রয়। কূটকৌশল ও চক্রান্ত এ পেশার ভিত্তি, অসত্য ভাষণ ও নীতিহীন আচরণ এর অবলম্বন। ভালো মানুষ ও ভালোমানুষির পক্ষে এ পেশা—একে ব্যবসায়ও বলা যায়—খুবই অনুপযোগী। অর্থাৎ অনেক নীতিচিন্তার কুজ্ঝটিকার মধ্যে এ সত্যটিকেই অবজ্ঞা করা হয় যে, রাজনীতিকে জীবন থেকে আলাদা করা যায় না, রাজনীতি শুধু খবরের কাগজ, জনসভা বা সংসদ কক্ষের ব্যাপার নয়। এ আমাদের গৃহজীবনেরও অনিবার্য অঙ্গ। দেশের রাজনীতির আওতার বাইরে আমরা কেউই নই। সমাজ-সম্পর্কের এ জটিলতার দিনে সমাজের প্রভাবকে এড়িয়ে সাধু বা সুফিদের মতো ব্যক্তিগতভাবে সৎ জীবনযাপন করার কথা ভাবা অবাস্তব ও অবান্তর কল্পনাকে প্রশ্রয় দেয়া। কেননা, সমাজ প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকে আক্রমণ করছে, ব্যক্তিগত জীবন কী চেহারা নেবে তা ঠিক করে দিচ্ছে। কাজেই সমাজ যাতে সততার সহায়ক হয় সে চেষ্টা করা দরকার সৎ থাকার ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই। সব দিক দিয়েই রাজনীতি হচ্ছে এ কালের মানুষের বিধিলিপি একে অবজ্ঞা করা, তেমনি অসম্ভব যেমন অসম্ভব আলো-বাতাসকে অবজ্ঞা করা। অসুস্থ রাজনীতিকে সুস্থ করার উপায় রাজনীতি থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়, রাজনীতিতে স্বাভাবিকভাবে অংশগ্রহণ করা।
ব্যক্তির জীবনে রাজনীতির এ গুরুত্ব প্রাচীনকালে অ্যাথেন্সবাসী এবং আধুনিককালে চীন দেশবাসী যথার্থ উপলব্ধি করেছেন। গ্রিক ভাষায় ‘নির্বোধ’ বলতে বোঝায় তেমন মানুষ, সামাজিক ব্যাপারে যে অংশগ্রহণ করে না (অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞানী হ্যামলেট একজন নির্বোধ, কিন্তু নির্বোধ বলে নিন্দিত ডন কুইক্সট একজন বুদ্ধিমান)। নির্বোধকে এভাবে নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত করার মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত অ্যাথেনীয় গণতন্ত্রের সৃজন ও বিকাশে তার বড় একটি ভূমিকা ছিল। প্রাচীন অ্যাথেন্সে রাজনীতিকে মনে করা হতো সামাজিক জীবনের প্রধানতম অংশ ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকশক্তি। সব নাগরিকের অংশগ্রহণ, সবাইকে একত্র সংলগ্নকারী চেতনা এবং সবার নাগরিক অধিকার-সচেতন সাম্যদৃষ্টিকে বাদ দিয়ে অ্যাথেন্সের কালজয়ী ও বিশ্ববন্দিত সভ্যতাকে কল্পনা করা অসম্ভব।
নব্যচীনের প্রায় অবিশ্বাস্য শক্তির উৎসও ওই একই স্থানে। চীনে রাজনীতিই প্রথমে আসে—শিল্পের আগে, এমনকি উৎপাদন ব্যবস্থারও আগে। রাজনীতিই নিয়ন্ত্রিত করে সামাজিক ব্যবস্থার সব এলাকাকে। সঠিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন সঠিক উৎপাদন নেই, সঠিক শিক্ষা নেই। সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পর্কে নানাবিধ প্রচারের কুয়াশা ভেদ করেও যেটুকু তথ্য জানা গেছে তাতে বোঝা যায় বিপ্লবের কর্মীদের যে মানসিকতার সঙ্গে তীব্র দ্বন্দ্বে নিয়োজিত হতে হয়েছে তার সেই অতি প্রাচীন ব্যাধি যা না-কি বলে, অনবরত বলে, যে যিনি পদার্থবিজ্ঞানী তিনি হবেন শুধু ওই বিজ্ঞানেরই বিশেষজ্ঞ, ঐতিহাসিক যিনি তার একমাত্র দায়িত্ব ইতিহাসের জ্ঞান সঞ্চয় করা, তার বাইরে তিনি যাবেন না, গেলে ক্ষতি হবে জ্ঞানের, অপচয় ঘটবে সময়ের, বিচলিত হবে নিমজ্জিতচিত্ত অভিনিবেশ। তাকে হতে হবে পিপীলিকা, অথবা মাকড়সা, সংগ্রহ করবেন পরিশ্রমে, নয়তো প্রতিভা বলে গড়বেন সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ঊর্ণনাভ। এই মনোবৃত্তির মধ্যে পৃষ্ঠপোষকতা আছে সামাজিক অজ্ঞতার ও বিচ্ছিন্নতার এবং ততোধিক আছে আত্মনিমগ্নতা ও স্বার্থপরতা। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য এ মনোবৃত্তি সম্পূর্ণ অনুপযোগী ও মারাত্মকরূপে ক্ষতিকর। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গ্রিকরা যাকে নির্বুদ্ধিতা বলতেন, নব্যচীনেরা যাকে বলেন ব্যাধি, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের চিত্তভূমিতে তা একটি অত্যুজ্জ্বল ও অতিপ্রাথমিক সত্য। এ মধ্যবিত্তের জীবনে সামাজিকতা অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকতা আছে বহুদিন, কিন্তু সমাজবদ্ধতা নেই আন্তরিক; ঐক্যবোধ ও সাম্য-দৃষ্টি—অনুপস্থিত উভয়েই। রাজনীতিতে অনুৎসাহ, এবং রাজনীতির বাইরে থাকাকে উৎকৃষ্ট নৈতিক গুণ মনে করার তাৎপর্য তাই নিতান্ত সামান্য নয়।
দেশের উন্নতি হচ্ছে এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে হবে সেটা কার উন্নতি। আর দেখতে গেলেই দেখা যাবে, সে উন্নতি আসলে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের। শ্রেণিভেদটা যে গড়ে উঠেছে তা ভবিষ্যৎ সংঘর্ষেরই প্রস্তুতি। বৈষম্যে, অত্যাচারে, নিষ্পেষণে সেই প্রস্তুতিই তীব্র হচ্ছে, তার শক্তিই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতের সংগ্রামে হ্যামলেটদের বড় ভূমিকা থাকবে না, তা তারা যতই বিচক্ষণ হন, ডন কুইক্সটদের থাকবে তা তাদের নিয়ে বিজ্ঞমন্য হ্যামলেটরা যতই হাস্যকৌতুক করুন।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি
পরিবেশ কিংবা জলবায়ুর সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু শব্দ সাধারণ মানুষের বুঝতে সমস্যা হয়। এর অর্থ এই নয় যে শব্দগুলো অনেক কঠিন ভাষায় রচিত। আসলে শব্দগুলো সহজ-সরল বাংলা ভাষায়ই রচিত। এগুলো বহুল প্রচলিত শব্দ হলেও এর অর্থ সর্বসাধারণের মাথায় ঢোকে না। আবার সামান্য একটু বুঝিয়ে দিলেই বিষয়টি মনে রাখতে পারেন অনেকেই। তেমনি কিছু শব্দ আছে, যেমন: জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ওজোনস্তর ও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ইত্যাদি। ইতিপূর্বে শব্দগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলেও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি এখনো। তাই আজকের আলোচ্য বিষয়- ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ নিয়ে।
তবে আলোচনার আগে আমাদের জেনে নিতে হবে সেই উপরোক্ত শব্দগুলোর অর্থগুলো। যেমন: ‘মানুষের নানা কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বোঝায়।’ সহজ বাংলায় পরিবেশ অথবা জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হলে ওই এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ বলা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় ‘ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া’ সংক্ষেপে ‘ইসিএ’। যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে শব্দগুলো ব্যাপক পরিচিত। অন্যদের কাছেও যে অপরিচিত শব্দ, তা কিন্তু নয়। শুধু বোঝার ব্যাপারটাই কাজ করে; অন্য কিছু নয়।
আমাদের দেশে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা নিরূপণ করা হয়েছে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে। সেই আইনে প্রথম দেশের আটটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও চারটি এলাকা সংযোজন করা হয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশই জলাভূমি। এলাকাগুলো যথাক্রমে সুন্দরবন, কক্সবাজার, টেকনাফ উপদ্বীপ (পেনিনসুলা), সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, সিলেটের হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, নড়াইলের মারজাত বাঁওড়, ঢাকাবেষ্টিত বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু-শীতলক্ষ্যা নদী ও গুলশান-বারিধারা লেক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর সংশোধিত ধারা ৫-এর বিভিন্ন উপধারায় বিস্তারিত তথ্য দেয়া আছে। ব্যাখ্যা দেয়া আছে, কেন এই ১২টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ব্যাখ্যার যৎসামান্য তথ্য নিম্নে তুলে ধরার চেষ্টা করছি আমরা।
প্রথমে সুন্দরবনের কথাই আসা যাক। এই বন শুধু আমাদের জাতীয় সম্পদই নয়, এটি আমাদের জাতীয় বনের মর্যাদাও পেয়েছে। এ ধরনের শ্বাপদসংকুল বৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। যেমন দুর্গম, তেমনি জীববৈচিত্র্যে ঠাসা এ বন। এই বনটি বিভিন্ন কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন বিধায় এর চারপাশের প্রান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। ফলে যে কেউ ইচ্ছা করলেই অবাধে মৎস্য আহরণ, গাছগাছালি কর্তন করতে পারে না। তাতে করে মৎস্যসম্পদ ও বৃক্ষরাজি রক্ষার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের সার্কেল সুরক্ষিত হচ্ছে।
সিলেটের হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, নড়াইলের মারজাত বাঁওড় মিঠাপানির জলাশয়। এতদ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, জলজ উদ্ভিদ, পরিযায়ী পাখি স্থানীয়দের অত্যাচারের কারণে অস্তিত্বসংকটে পড়েছিল। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার এই হাওর-বাঁওড়গুলোকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ওই অঞ্চলে কেউ মর্জি মোতাবেক সম্পদ বিনষ্ট করার সুযোগ পাচ্ছে না এখন আর।
কক্সবাজার-টেকনাফের উপদ্বীপে বন্য প্রাণীর প্রজননক্ষেত্র এবং সামুদ্রিক প্রাণীদের নিরাপদ চারণভূমি বিধায় এ দুটি অঞ্চলকেও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তাতে করে সামুদ্রিক প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে।
সেন্ট মার্টিন ও সোনাদিয়া দ্বীপের গুরুত্ব এবং জীববৈচিত্র্যের আধিক্যের কারণে এ দুটি দ্বীপকেও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়ছে। এখানে দুর্লভ অলিভ রিডলি টার্টলের (জলপাইরঙা কাছিম) প্রজননস্থল। এ ছাড়া সোনাদিয়া দ্বীপে বিপন্ন প্রজাতির পাখি চামচঠুঁটো বাটানের আবাসস্থল। অন্যদিকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে দুর্লভ জীববৈচিত্র্য ছাড়াও পরিবেশগত কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন। বিশেষ করে এ দ্বীপ পর্যটক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। যেমন: পলিথিন, কোমলপানীয়ের কৌটাসহ নানা ধরনের আবর্জনা ফেলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে পর্যটকদের রাত্রিযাপন কিংবা আয়েশের জন্য বেশ কিছু হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। এতে করে মাটি খোঁড়াখুঁড়ির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে সেন্ট মার্টিন ভাঙনের কবলে পড়ে, বিষয়টি গোচরীভূত হতেই সরকার রাত্রিযাপনে নিষেধাজ্ঞাসহ দ্বীপটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
অন্যদিকে বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু-শীতলক্ষ্যা নদী ও গুলশান-বারিধারা লেক অসহনীয় মাত্রায় দূষণের কবলে পড়ে। কলকারখানা নির্গত অপরিশোধিত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, পলিথিন ও গৃহস্থালির আবর্জনায় জলাশয়ের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পানি বিবর্ণ হয়ে এসেছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জলজ উদ্ভিদ, পোকামাকড় ও মাছ মারা যাচ্ছে; স্থান বদল করছে। এসব প্রতিবেশগত কারণে জলাশয়গুলো হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, ফলে সরকার সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে এ এলাকাগুলোকে।
দেশে এ ধরনের আরও কিছু সংকটাপন্ন এলাকা রয়েছে। তার মধ্যে ‘চলনবিল’ অন্যতম। আমরা আশাবাদী বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সেটিও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত হবে একদিন। শুধু চলনবিল-ই নয়, দেশে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জলাশয় কিংবা বন-বনানী রয়েছে, সেসব এরিয়াকে অতিসত্বর ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে বলে নেয়া আবশ্যক, সরকার বিভিন্ন সংকটাপন্ন এলাকা সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করলেও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকারের একার নয়; আমাদের ঘাড়েও বর্তায়, যা সবার মনে রাখতে হবে। কারণ দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সবারই। আমাদের বেঁচে থাকতে হলে জলবায়ুর পরিবর্তন যেমন ঠেকাতে হবে, তেমনি জীববৈচিত্র্যও রক্ষা করতে হবে। বলে নেয়া ভালো, আমাদের বেঁচে থাকার সঙ্গে এই সার্কেলটি বিশেষভাবে যুক্ত। সুতরাং আমরা জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করি উদ্দাম গতিতে।
আমরা জানি, পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে হলে একটি মাধ্যম প্রয়োজন। আর সেই উকৃষ্ট মাধ্যমটি হচ্ছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তাই আমরা ইচ্ছা করলে সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে, সবুজ বাঁচিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে পারি। পাশাপাশি পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাগুলোর গুরুত্ব মানুষের কাছে তুলে ধরি। নিজের উদ্যোগে প্রচারকাজে অংশ নিয়ে দেশকে সবুজ সমাহারে ভরে তুলি। এ বিষয়ে কাজ করতে যুব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি আমরা, ‘আসুন ফেসবুকে সময় না কাটিয়ে দূষণমুক্ত বাংলাদেশ তথা সবুজ বিশ্ব গড়ে তুলি নিজ দায়িত্বে।’ নিজ নিজ উদ্যাগে এই সংরক্ষিত এলাকাগুলোর প্রতি নজরদারি এবং পরিধি বাড়িয়ে দিই আমরা। যাতে এতদাঞ্চলে কোনো ধরনের উপদ্রব না ঘটে। তবেই আমাদের এই সবুজ গ্রহ স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তে পারবে, সেই সঙ্গে আমরাও বেঁচে থাকার যথাযথ উপাদান পেয়ে যাব।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট
বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাপান আর যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। প্রকৃত অর্থে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নিরাপত্তার স্বার্থ, আর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর ভিত্তি করা যুক্তরাষ্ট্র-জাপান সম্পর্ক মূলত যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য বিস্তারের এক কার্যকরী পন্থায়ই পরিণত হয়। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী চুক্তি ও সমঝোতার দরুন জাপানের শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ওপর নিজ নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য নির্ভরশীল থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জাপানকে নিজ স্বার্থ অনুযায়ী বিশ্বব্যবস্থায় ব্যবহার করা আরও সহজ হয়ে ওঠে। এ জন্যই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপান ওয়াশিংটনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।
এই মিত্রতা এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল অনেকটাই একই লক্ষ্য অর্জনের জন্য গঠিত। ওয়াশিংটনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ও স্বার্থ বাস্তবায়নে এখন এক অনন্য ও সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে জাপানের সফট্ পাওয়ার বেশ কার্যকরী ও এর ব্যাপ্তিও অনেক। এ অঞ্চলে জাপান যে পরিমাণ বাণিজ্যিক ও উন্নয়নমূলক বিনিয়োগ করেছে তাতে সৃষ্ট জাপানের প্রভাব এই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে দুর্বলতাগুলো উত্তরণে সহায়তা করবে। যুক্তরাষ্ট্র এখন উপলব্ধি করছে যে, ভারত মহাসাগর এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলব্যাপী নিজ স্বার্থ ও কৌশল বাস্তবায়নে যে বিশ্বাসযোগ্যতা, সফট্ পাওয়ার ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রয়োজন সেটা ওয়াশিংটনের নেই। আদৌ সেটা হওয়ারও নয়। কিন্তু জাপান এর ঠিক উল্টো। এ ক্ষেত্রে জাপানের এই অঞ্চলব্যাপী বিস্তর সুখ্যাতি রয়েছে। জাপানের সামরিক সীমাবদ্ধতার কারণে জাপানকে নিয়ে এ অবধি তেমন কোনো আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বা আশঙ্কারও সৃষ্টি হয়নি। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে জাপানের বিভিন্ন পর্যায়ের বিনিয়োগ ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা আজও হয়নি।
তবে জাপান এখন তার বৈশ্বিক পরিচিতি পরিবর্তন করতে অনেকটাই সচেষ্ট। জাপান এখন ভারত মহাসাগর অঞ্চলে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী, যাতে নিজ প্রভাব আরও বিস্তৃত করতে পারে। এর প্রধান কারণ, অবশ্যই চীনের প্রভাব বিস্তার রোধ করা। চীন ভারত মহাসাগর, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে যে পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করেছে, সেটাকে প্রতিরোধ করতে জাপান এখন তার কূটনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতিতে বিপুল পরিবর্তন আনতে প্রতিনিয়ত কাজ করছে।
জাপানের এই পরিবর্তন প্রচেষ্টায় জি৭ সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ এক সুযোগে পরিণত হয়। এ বছরের জি৭ সম্মেলনের স্বাগতিক ও জি৭ গ্রুপের প্রেসিডেন্ট জাপান। একই সঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদও পেয়েছে জাপান। এরই সুবাদে জাপান সম্প্রতি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলপত্র প্রকাশ করেছে। এই কৌশলপত্রগুলো জাপানের আঞ্চলিক নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশল, নীতি পরিবর্তনের সবচেয়ে প্রকট নিয়ামক বহন করে। তিনটি কৌশলপত্রই জাপানের জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বর্ধন কর্মপরিকল্পনা। অর্থাৎ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে জাপান যে এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নয়, বরং নিজ সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে আরও সক্রিয় ও প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে চায়, সেটা তারা পরিষ্কার করেই বিশ্বব্যাপী জানান দিয়েছে। জাপানের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গির এই ব্যাপক পরিবর্তন দেশটির সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই করা হচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী আগ্রাসী মনোভাব থেকে সরে আসার প্রত্যয়ে জাপান যে সংবিধান, চুক্তি ও সমঝোতাগুলো প্রবর্তন করে, সেগুলোর প্রতি এখনো শ্রদ্ধা বজায় রাখছে। পরিবর্তন শুধু এতটুকুই যে, জাপান এখন আঞ্চলিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে তার কূটনীতি বিস্তৃত করতে আগ্রহী। জাপানকে এখন আর সেই নীরব পরোক্ষ দর্শক নয়, প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যাবে ভারত মহাসাগর ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে।
জাপান তার এই অভিলাষ খুব স্পষ্টভাবেই জি৭ সম্মেলনে প্রকাশ করেছে। জি৭ সম্মেলনের সদস্যদের পাশাপাশি জাপান এবার ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ করে। আমন্ত্রিতদের তালিকা পর্যালোচনা করলেই স্পষ্ট হয় যে, জাপান এখন বৈশ্বিক পর্যায়ে, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথ অঞ্চলে আরও নিবিড়, ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ভূমিকা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। এ জন্যই দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। জাপান এখন পশ্চিমাবিশ্ব, তথা বিশ্ব সাত মোড়লের হয়ে এই অঞ্চলে তাদের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা প্রদান করতে চায়। জাপান এই অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্যিক ও উন্নয়নমূলক বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে চায়। একই সঙ্গে যেখানে প্রয়োজন সেখানে বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতা বা নিরাপত্তা নীতি পরিবর্তন কিংবা প্রতিরক্ষা নীতি পরিবর্ধন, অর্থাৎ যেকোনো পদক্ষেপ নিয়ে জাপান পশ্চিমাদের জন্য এ অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি করতে এখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যাতে চীনের বর্ধমান প্রভাব ও আধিপত্য যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ করা যায়। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মাধ্যমে চীন প্রতিরোধের যে কৌশল নিয়েছিল, সেটা এখন ওয়াশিংটন জাপানের মাধ্যমে করতে আগ্রহী। ভারতকে দিয়ে যে কাজ হচ্ছে না, সেটা যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই অনুভব করছিল। ভারতকে চীনের প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই ব্যর্থ। ভারত কার্যকর রূপে এই ভূমিকা পালনের কথা বারংবার বলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আঞ্চলিক সুবিধাই ভোগ করেছে। কিন্তু তেমন কোনো কার্যকরী প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি দিল্লি। উল্টো ভারতের সঙ্গে তথাকথিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে এই অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বেড়েছে বৈকি কমেনি।
এই অঞ্চলে চীনের প্রতিরোধক ও যুক্তরাষ্ট্রের চোখ-কানের ভূমিকায় ভারতের ব্যর্থতার কারণ নিয়ে একটু কথা না বললেই নয়। ভারতের মতো একটি রাষ্ট্রের তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে এখন যে সম্পর্ক সেটা আসলেও অবাক করার মতো। প্রায় সবার সঙ্গেই ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন। ভারত শুধু তার নিজের স্বার্থ দেখে, অন্যদের নয়, এমনটা সর্বদাই শোনা যায়। আর ভারত এখনো তার আমদানিকারক পণ্যের দীর্ঘ তালিকার অধিকাংশের জন্যই চীনের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ চীনের প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার সক্ষমতা বলতে গেলে নেই ভারতের। সুতরাং ভারত যে তার আকাঙ্ক্ষিত ভূমিকা কেন পালন করতে পারছে না, সেটা পরিষ্কার। আর সেটা এখন যুক্তরাষ্ট্র ভালোই উপলব্ধি করতে পারছে। মজার বিষয় হলো, ভারতের যেসব দুর্বলতা ও অক্ষমতার কারণে ভারত চীনকে এই অঞ্চলে প্রতিরোধে ব্যর্থ, জাপানের সেগুলোর একটিও নেই। অন্যদিকে একটি নির্ভরযোগ্য, সক্ষম ও প্রভাবশালী আঞ্চলিক নেতৃত্ব প্রদানে যা যা প্রয়োজন জাপানের তার প্রত্যেক বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। জাপানও বিষয়টি এখন উপলব্ধি করা শুরু করেছে। সুতরাং এই অঞ্চলে আরও প্রভাবশালী ভূমিকার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ভারতের জায়গায় অধিষ্ঠিত হতে সচেষ্ট এখন জাপান। আবার টোকিও দিল্লিকে সরিয়ে নয়, বরং সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে চাইছে। ভারতের উঠোনে, ভারতকে বাদ দিয়ে যে কাজ করা যাবে না, সেটা জাপান ভালোই জানে।
এতে করে জাপানের অনেক সুবিধাও হচ্ছে। চীনকে প্রতিরোধ করতে, ভারত মহাসাগরে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে জাপানের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জাপান ও সাউথ চীন সমুদ্র অঞ্চলে নিজ নৌবাহিনীর সক্ষমতা দিয়ে জাপান চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে সক্ষম। এ জন্য ভারত মহাসাগরে প্রতিরক্ষা প্রভাব প্রতিষ্ঠায় যে পরিমাণ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করা দরকার সেটা জাপানের আপাতত নেই। তাই ভারত মহাসাগরে নিজের নতুন প্রতিরক্ষা ভূমিকা প্রণয়নে টোকিও আপাতত ভারতের ওপর নির্ভর করছে।
বাংলাদেশের জন্য জাপান এক নির্ভরশীল, সম্মানিত, শ্রদ্ধেয় ও পরীক্ষিত বন্ধু। জন্মলগ্ন থেকেই জাপান বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন অংশীদার। আর ২০২০ সাল থেকে জাপানের সর্বাধিক উন্নয়ন সহায়তা গ্রহণকারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। এই দুটি তথ্যই বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কের ব্যপ্তি, ঘনিষ্ঠতা, গুরুত্ব, গভীরতা প্রকাশে যথেষ্ট। বাংলাদেশের কৌশলগত ভূরাজনৈতিক অবস্থান উভয় জাপান ও ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জন্য প্রয়োজনীয়। জাপান ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি করতে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে আরও বিনিয়োগ করছে।
বাংলাদেশের মতো, মিয়ানমার, ভারত ও এই অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রেও জাপানের উন্নয়ন সহায়তা প্রশংসনীয় ও কার্যকরী। এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব প্রতিরোধে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক এক অত্যন্ত কার্যকর ও প্রভাবশালী হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে জাপানের অংশীদারত্ব এ ক্ষেত্রে আরও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বাংলাদেশে এ জন্যই জাপান একটি শিল্পনগরও প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যাতে উত্তর-পূর্ব ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সাপ্লাই চেইন সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা যায়। জাপানের এই আকাঙ্ক্ষা গত এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে জাপান আরও জোরালোভাবে ব্যক্ত করে। একই সঙ্গে জাপান বাংলাদেশে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। এর মধ্যে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনে এক অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। এই বিনিয়োগ জাপানের বিগ-বি উদ্যোগের অংশ হিসেবেই করছে টোকিও। এই বিগ-বি উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশে আরও কতগুলো উন্নতমানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প ও বিনিয়োগ করবে জাপান।
জাপানের মোট বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে হয়। এ জন্য বঙ্গোপসাগর জাপানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই সমুদ্র অঞ্চলে বাংলাদেশের মাধ্যমে জাপান সরাসরি সংযোগ স্থাপন করছে। এ জন্য শুধু বাণিজ্য, আঞ্চলিক সংযোগের জন্যই নয়, জাপানের নতুন প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী প্রক্সির ভূমিকা পালনেও বাংলাদেশকে জাপানের প্রয়োজন।
যাই হোক, জি৭ সম্মেলন, উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন, আর জাপানের নতুন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গিও মাধ্যমে জাপান তার নতুন পরিচয় বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে এই ভারত মহাসাগর অঞ্চলে প্রতিষ্ঠায় তৎপর। আসন্ন দিনগুলোতে আমরা এক নতুন জাপানকে দেখব। এতদিন যে যুক্তরাষ্ট্রের পেয়াদা হিসেবেই এগিয়েছে, এখন কিন্তু সে বোর্ডের আরেক প্রান্তে পৌঁছে গেছে। এ অঞ্চলে বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক দাবা খেলার নতুন উজিরে পরিণত এখন জাপান।
লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক